ভারতীয় উপমহাদেশে মার্সিয়ার উৎপত্তি ক্রমবিকাশ ও সাহিত্য অবদান
মার্সিয়া সাহিত্য
শোক,দুঃখ,কান্না ও অশ্রু বিসর্জন মানুষের সহজাত স্বভাব। মানব শিশু কান্নার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করে । মানব জীবনে সুখ-দুঃখ নিত্য দিনের সহচর।
দুঃখ,শোক,মাতম মানব জীবনকে গতিময় করে । বেচে থাকার শক্তি, উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায়। মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করে । কোনো লোক যখন তার পরম পাওয়ার বা ভালোবাসার কোনো বস্তুকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে কিংবা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটে তখন মানুষ কেবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েনা,সে বুক-মাথা চাপাড়ায় এবং শোকগাথা গাইতে থাকে। কেননা, প্রিয়জনের বিয়োগ জ্বালা, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনার কারণে সৃষ্ট অদৃশ্য শোককান্নাকে সে রুখতে পারে না। এমনকি ইচ্ছে না থাকলেও অনুভূতির ভাবাবেগে মানুষ নিজের অজান্তেই কেদে ফেলে। মানুষের শোক প্রকাশের এরূপ ধারাকে মাতম বলা হয়ে থাকে। মাতমের সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশে রচিত সাহিত্যকর্মকে মার্সিয়া বলা হয়।
মার্সিয়ার সংজ্ঞা, উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ
কোনো ট্র্যাজিক বা শোকময় ঘটনা সম্পর্কে প্রশংসাসূচক গান,স্মৃতিচারণমূলক গাথা অথবা কাব্য রচনা হলো মার্সিয়া সাহিত্য। মার্সিয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ শোক করা,মাতম করা,ক্রন্দন করা-বিলাপ করা। মানব সভ্যতার আদি থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ বিলাপের মাধ্যমে শোক প্রকাশের রীতি প্রচলিত ছিল । কারবালা ট্র্যাজেডিকে ঘিরে পূর্ব যুগে গৌরবময় স্মৃতিচারণমূলক পনের হতে বিশটি শেস্নাক বা শোকগাথা লিখিত হলে তা মার্সিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতো। কিন্তু পরে মার্সিয়ার অর্থের পরিবর্তন ঘটে।
৬১ হিজরীতে কারবালার মরু প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এবং অন্যান্য বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে লিখিত প্রশংসাসূচক কবিতাই বিশেষভাবে মার্সিয়া নামে অভিহিত হয়।
হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন এবং অন্যান্য শহীদানের আত্মত্যাগের বীরত্ব গাথা প্রসঙ্গে শোকগীতিই মার্সিয়ার রূপ পরিগ্রহ করে । প্রখ্যাত কবি নিযামী মার্সিয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, কোনো মৃত ব্যক্তির জীবনের গুণ বর্ণনার ক্ষেত্রে ছন্দে রচিত বিলাপ অথবা দুঃখ প্রকাশের নাম মার্সিয়া । পাশ্চাত্য মনীষী Hughes বলেছেন, মার্সিয়া কারও শুভযাত্রা উপলক্ষে বিষাদগীতি। বিশেষ করে মুহররম মাসে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের আত্মবিসর্জন সম্পর্কে কবিত্ব ছন্দে যে শোকগাথা গীত হয় তা-ই মার্সিয়া । কারবালার শহীদদের স্মরণে মুহররম মাসে মজলিস অনুষ্ঠানে মার্সিয়া পঠিত হয়।
তাজিয়াসহ আহলে বাইতের অনুসারীরা শোক মিছিলের সময় পথ চলতে চলতে মার্সিয়া আবৃত্তি করে থাকে। মার্সিয়ার ইংরেজি প্রতিশব্দ Elegy বা Mournful poem বা Funeral Song । এই শোকগাথা বিশ্ব সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
যুদ্ধের বর্ণনাকে আশ্রয় করে আরবে প্রথম মার্সিয়া সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। আরবে মার্সিয়া রচনার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের বিষাদময়ভাব প্রকাশ করে পরস্পরের মনের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করা হতো। তামসিক যুগে মার্সিয়া সাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল বটে কিন্তু ইসলামী যুগে তা পূর্বাপেক্ষা ব্যাপকতর পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং বিকাশ লাভ করে । আত্মীয়ের মৃত্যুতে মানুষের মনে যে গভীর বেদনা ও ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তা কাব্য ও কবিতা রচনার মূলভিত্তি। আর এই ভিত্তিমূলেই প্রতিষ্ঠা পায় মার্সিয়া । পৃথিবীর সব দেশেই বেদনাবোধ হতে কাব্যসাহিত্য রূপ লাভ ঘটেছে। ইসলাম পরবর্তী যুগে যারা মার্সিয়া লিখতেন তাদের অন্যতম হলেন খানস এবং মোতামিন বিন নূব্যয়রা।
তবে কিছু কিছু আরব দেশীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকায় এ সময়ে কোনো কোনো মার্সিয়ায় গভীর বিষাদের ভাব স্পষ্ট । অন্তরে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে এ মার্সিয়া কবিতাগুলো সাহিত্যে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হযরত উসমানের মৃত্যু উপলক্ষে কাফ বিন মালিক নামক একজন আরব কবি আরবি ভাষায় মার্সিয়া কবিতা রচনা করেছিলেন । এরপর ইমাম আলী শহীদ হওয়ার পর আবি আসওয়াদ দুওয়ালী নামক অপর একজন কবি আরবি ভাষায় একখানি মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। এর মাত্র বিশ বছরের মধ্যে কারবালার ট্র্যাজেডি ঘটে। কারবালার ভয়াবহ কলংকজনক ট্র্যাজেডির সময় যদি আরব জাতির পূর্বের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকত তাহলে সবিজ্ঞ কবিগণ এমন করুণ ভাষায় আরবি মার্সিয়া রচনা করতেন যে, এর প্রভাবে সমগ্র বিশ্বে শোকের অনলশিখা প্রজ্বলিত হতো। কিন্তু ইতোমধ্যে আরব জাতির মধ্যে পূর্বের বৈশিষ্ট্য যথেষ্ট পরিমাণে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ।
বনী উমাইয়্যা রাজবংশের পতনের পর আব্বাসী রাজবংশীয় শাসকগণ কাব্য সাহিত্যের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করেন। কিন্তু এ সময়ে রাজ পুরুষদের প্রশংসাসূচক কাসিদা লিখে কবিগণ পুরস্কার লাভ করতেন। ফলে মার্সিয়া সাহিত্যের অচলাবস্থার পরিবর্তন হলো না। তবে মা আন ও জাফর বার্মাকীর বদান্যতার ফলে তাদের মৃত্যুর পর যে মার্সিয়া কাব্য লিখিত হয়েছিল তাতে গভীর শোকের আভাস পাওয়া যায়।
পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসী তার শাহনামায় সোহরাবের মৃত্যুর পর তার মাতার জবানীতে যে শোকগাথা বর্ণনা করেছেনে তা বিশেষভাবে মার্সিয়া সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য। কবি খররুখী,কবি শেখ সা’দী, ভারতের আমীর খসরু ফার্সি ভাষায় মার্সিয়া রচনা করে মার্সিয়া সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ।
বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ তুসী কারবালার যুদ্ধে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনা অবলম্বনে মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। কবি সানায়ী একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে,কবি নজিরী ও উরফী ১৬ শতাব্দীতে নতুন ধরনের মার্সিয়া রচনায় ব্রতী হন। কবি মোল্লা মুহতাশিম কাশানী সাফাবী বংশের প্রশংসা করে কাসীদা রচনা করেন।
সাফাবী বংশের সূচনালগ্নে মার্সিয়া সাহিত্য পুনরায় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং এ সময় কবি মুকবিল এককভাবে কয়েকখানা মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। তিনি কারবালার লোমহর্ষক বর্ণনা তার মার্সিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরেন। বিংশ শতাব্দীর পারস্য কবি কানী হৃদয়স্পর্শী ভাষায় কারবালার কাহিনী অবলম্বনে মার্সিয়া রচনা করেন। তার মার্সিয়াগুলো অতিব করুণ ও শ্রুতিমধুর। কানীর ও মার্সিয়া সম্বন্ধে একথা স্বীকৃত যে, তিনি তার সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। তার মার্সিয়ার গঠন প্রণালী ও ভাষা শৈলী প্রয়োগ স্বতন্ত্র। তার রচনায় ইমাম হোসাইনের শাহাদাত বৃত্তান্ত অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাবে ফুটে উঠেছে।
পারস্য হতে অনেক কবি ও সাহিত্যিকের ভারত আগমনের ফলে ভারতেও মার্সিয়া সাহিত্য ও কাব্য রচনার নতুন দিগন্ত সম্প্রসারিত হয়।
উপমহাদেশে ফার্সি মার্সিয়া সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
উপমহাদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর দিল্লী রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং রাজদরবারের ভাষা হিসাবে ফার্সি মর্যাদা লাভ করে । ফার্সী ভাষা রাজদরবারের ভাষা হিসাবে স্থান লাভ করায় ভারতীয় সাহিত্যে ফার্সি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
এ প্রসঙ্গে ড. হাবিবুল্লাহ বলেন, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণবশত ইরানের সাভাবী রাজবংশের রাজাদের সাথে তৈমুর বংশীয় সুন্নী মুঘলদের চিরন্তন শত্রুতা থাকায় এ অঞ্চলের কবিগণ অনুকূল পরিবেশের অভাবে মার্সিয়া রচনায় উৎসাহী হননি।
এর ফলে উত্তর ভারতে ফার্সি সাহিত্যে সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে মার্সিয়া রচিত হয়নি। পাক্ষান্তরে, দিল্লীর মুঘল শাসকগণের শত্রু দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শিয়া নরপতিগণের সহানুভূতি ও উৎসাহে শিয়া মাযহাবের প্রচারক ও কবি-সাহিত্যিকগণ দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে শিয়া চিন্তাধারাপুষ্ট সাহিত্য রচনার সম্প্রসারণ ঘটে।
সম্রাট বাবর লোদী বংশের শেষ সম্রাটকে পরাজিত করে ১৫২৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার পুত্র হুমামান ভারত হতে শের শাহ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ১৫৪৪ সালে সাময়িকভাবে পারস্য সম্রাট তাহমাসপের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পারস্য বা ইরান হতে তার সামরিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা লাভ ইরান ও ভারতের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের এক নব যুগের সূচনা করে ।
সম্রাট হুমায়নের ভারত প্রত্যাবর্তনের সময় বহু ইরানী কবি-সাহিত্যিকের সংশ্রবের ফলে ফার্সি ভাষা শরীফদের ভাষায় স্থান লাভ করে । মুঘল আমলে ভারতের সর্বত্র ফার্সি সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা হতে থাকে। মুঘল যুগের পূর্বেও ভারতে ফার্সি ভাষা প্রচলিত ছিল । এর আগমন ঘটে আফগানিস্তান ও তুর্কিস্তান হতে । কিন্তু মুঘল আমলে ফার্সি ভাষার মূল উৎসস্থল ইরান থেকে এ ভাষা ও সাহিত্যের প্রবাহ শুরু হয়। এ সময় দিল্লী ও দিল্লীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিকগণ ব্যাপকভাবে সাহিত্য চর্চা করেন। প্রথম তারা ফার্সি ও পরে উর্দু ভাষার কাব্য চর্চা করেন। সে সময় দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাষ্ট্রগুলোতে মার্সিয়া কাব্য চর্চা পুরা দমে শুরু হলেও উত্তর ভারতের শিয়া কবি ও সাহিত্যিকগণ সাম্রাটের ভয়ে ধর্ম সম্বন্ধীয় কোনো কাব্য রচনা করতে সাহসী হননি। বরং মুঘল রাজদরবারের কবিগণ কাসীদা রচনা করে সম্রাট ও শাসকবর্গের সন্তোষ বিধান করতেন। এর কারণ মূলত অর্থনৈতিক। কেননা, মৃত ব্যক্তির গুণকীর্তন অপেক্ষা জীবিত ব্যক্তির প্রশংসা কীর্তনের প্রতি তাদের আগ্রহ অনেক বেশি ছিল । সম্রাট শাহজাহানের রাজদরবারের কবি হাজী মুহাম্মদ জান কুদসী স্বীয় যুবক পুত্রের অকাল মৃত্যুতে এক মার্সিয়া রচনা করেছিলেন । দাক্ষিণাত্যের শাসক দ্বিতীয় আদিল শাহ এই শাসনকালে (১৫৮০-১৬২৬.খ্রি.) তার দরবারের কবি মোল্লাহ যুহুরী আদিল শাহের নির্দেশে মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন।
মুঘল যুগের সূচনালগ্নে কিছুসংখ্যক লেখক ও কবির রচনার নমুনা ঐতিহাসিক রদাযুন কর্তৃক সংরক্ষিত হয়। আমীর খসরু (১২৩৫-১৩২৫.খ্রি.) এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে জানা যায়। বুগরা খান যখন বাংলাদেশের শাসন কর্তা নিযুক্ত হয়ে আসেন তখন আমীর খসরু তার সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন। এরপর খসরু বাংলাদেশ হতে দিল্লী যান। রাজধানী দিল্লীতে গিয়ে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে প্রতিষ্ঠা পান এবং সুখ্যাতি অর্জন করেন।
ফার্সি ভাষায় তিনি অসংখ্য কাসীদা ,গজল ও মসনবী রচনা করেন। তবে ফার্সি ভাষায় তিনি কোনো মার্সিয়া রচনা করেছিলেন কিনা জানা যায়নি।
জামালী নামে সুলতান সিকান্দার লোদীর অতিপ্রিয় একজন কবি ছিলেন । সুলতান সিকান্দার লোদী ১৪৮৮ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন । সুলতানের মৃত্যু ঘটলে কবি জামালী মর্মস্পর্শী ভাষায় একটি মার্সিয়া রচনা করেন।
উপমহাদেশে উর্দু মার্সিয়া সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
উপমহাদেশের উর্দু সাহিত্যের সূতিকাগার হিসাবে ঐতিহাসিকগণ দাক্ষিনাত্যকে অভিহিত করেছেন । উর্দু সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে এখান থেকেই। উর্দু ভাষায় মার্সিয়া কাব্যের উৎপত্তির মূলে দাক্ষিণাত্যের উর্দু কবিগণের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পারস্যে যেমন শীয়া সাফাবী রাজবংশের সূচনা হয় তেমনি ভারতের দাক্ষিণাত্যে শীয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সম্রাট বাবর কর্তৃক ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অর্ধশত বছর পূর্বেই দাক্ষিণাত্যে মার্সিয়া কাব্য রচনার প্রচলন হয়। উপমহাদেশে ফার্সি,উর্দু এবং বাংলা ভাষায় মার্সিয়া সাহিত্য ধারার প্রবর্তন যে ইরানি বণিক, দরবেশ ও পণ্ডিত মহলের অনুপ্রেরণায়ই হয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই।
ভারতের দাক্ষিনাত্যে বর্তমান হায়দারাবাদে প্রথম উর্দু ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়। সেখানে উর্দু ছিল শিক্ষিত জনসাধারণের ব্যবহৃত ভাষা । ১৩৬৪ সালে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে দাক্ষিনাত্যের বাহমানী রাজবংশের শাসকের বিদ্রোহের ফলে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ফলে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো প্রাচীন উর্দু বা দাকিনীকে রাজভাষারূপে গ্রহণ করে । এর বিশ বছর পূর্বে মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের সৈন্যবাহিনী দাক্ষিনাত্যে উর্দুর প্রবর্তন করে । তার দাক্ষিণাত্যের রাজভাষা রূপে তা গৃহীত হয়। উর্দু সাহিত্যের সূচনা দাক্ষিণাত্যের কবি ওয়ালী (১৬৬৮-১৭৪৪ খ্রি.) হতে; তবে তখনকার ভাষা ছিল দাকিনী। কবি ওয়ালী কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা অবলম্বনে মসনবী রচনা করেন;কিন্তু কোনো মার্সিয়া লিখেননি। উপমহাদেশে মার্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি কে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও খাজা মীর দার্দ-এর (১১৩৩-১১৯৯.খ্রি.) পূর্বেই মার্সিয়া কাব্য রচনার প্রচলন ছিল । এর পূর্বে মার্সিয়া ছিল চার পংক্তি বিশিষ্ট কবিতা,কিন্তু মীর্যা সওদা সর্বপ্রথম ১৭৫০ সালে ছয় পংক্তির মার্সিয়া রচনা রীতির প্রচলন করেন। তার সাহিত্য প্রতিভা ও কবিত্ব শক্তির প্রভাবে পরবর্তীকালে মীর আনিস ও মীর্যা দবীরের যুগে মার্সিয়া সাহিত্য উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে । মীর্যা সওদা দীওয়ান ও মসনবী ব্যতীত সালাম ও রচনা করেন। মীর ত্বকীও (১৭১২-১৮১০.খ্রি.) মার্সিয়া লিখে ছিলেন ।
উর্দু কবিগণের জীবন চরিত সংগ্রহকার মীর ত্বকী ও মীর হাসান সে যুগের অনেক মার্সিয়া লেখকের নাম উল্লেখ করেছেন । তাদের মধ্যে মীর আমানী,মীর আল আলী দারাখশান সিকান্দার, কাদির, গোমান, আসেমী, নদীম, সবর প্রমুখ অন্যতম। বর্তমান কালের এক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে,দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডা রাজ্যের শাসনকর্তা মুহাম্মাদ কুলী কুতুব শাহ (১৫৮০-১৬১১:খ্রি.) উর্দু ভাষার প্রথম বিশিষ্ট কবি। তিনি মার্সিয়া শ্রেণীর বহু কবিতা লিখেছেন। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্যের রাজন্যবর্গ মার্সিয়া কাব্য সাহিত্যের কবিদের শুধু পৃষ্ঠপোষকতা করেই ক্ষান্ত হননি; তারা শিয়া মাযহাবভুক্ত হওয়ায় নিজেরাও মার্সিয়া সাহিত্য ও কাব্যাদি রচনা করতে আত্মনিয়োগ করাকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতেন। বিজাপুরের আদিল শাহী শাসকগণের দান ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুহররমের মজলিস অনুষ্ঠান চালু হয়। সেই সাথে এ শাহী ও নিযামশাহী শাসকগণের রাজত্বের সময় মার্সিয়া কাব্য রচনাধারা যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়। প্রথম প্রথম এ সকল মজলিস অনুষ্ঠানে ইরানী কবি মুহতাশিম কাশানীর ফার্সি ভাষায় লিখিত মার্সিয়া পাঠ করা হতো। কিন্তু পরে উর্দু ভাষায় তা রচিত হয়। পরবর্তীতে মার্সিয়া কবিতা আবৃত্তির জন্য এক বিশেষ গোষ্ঠি গড়ে ওঠে এবং বহু মার্সিয়া কাব্য রচিত হতে থাকে। এ সময় ‘রওজাতুস শুহাদা’ নামক বিখ্যাত মার্সিয়া খানি ফজলে আলী কর্তৃক উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। অনুদিত এ গ্রন্থের নাম কারবালার কথা । এ গ্রন্থে ইমাম হোসাইনের শাহাদাত এবং কারবালার অপরাপর ঘটনা মার্সিয়া কাব্যাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
সম্রাট আকবরের সময় দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাজা আদিল শাহ ও কুতব শাহ’ নিজ নিজ রাজ্যে মুহররমের মিছিল এবং মাতম অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন।
মজলিসের সময় ঐ সকল স্থানে চৌদ্দটি (আহলে বাইতের চৌদ্দ জন নিষ্পাপ ব্যক্তির সাম্মানে) স্তম্ভ প্রোথিত হতো। গোলাকুণ্ডা শহরকে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হতো। মার্সিয়া পাঠকগণ রাজধানীতে শহীদগণের প্রশংসাসূচক কবিতা, মার্সিয়া এবং নওহা পাঠ করত। দশ মুহররম সুলতান স্বয়ং কালো রঙের পাশোক পরে খালি পায়ে পতাকা, পাঞ্জাসহ মিছিলে যোগদান করতেন। বীজাপুরে শাহী আম্বরখানার নাম ছিল হাসেইনী মহল। দাক্ষিণাত্যের কবি নসরতী তার কাসীদায় হোসেইনী মহলের সৌন্দর্যের বর্ণনা প্রদান করেছেন । ভারতীয় দাকিনী ভাষায় কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনামূলকা প্রাচীন একখানা গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে। এটির নিযাম শাহী রাজ্যের কবি আশরাফ কর্তৃক লিখিত হয়েছিল । অতঃপর যে মার্সিয়া কাব্য বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তা গোলকুণ্ডার প্রসিদ্ধ কবি ওয়াজহী রচিত। তৎপর অন্যান্য কবি মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। তাদের মধ্যে গোলকুণ্ডের কবি গাওয়াসী, লতীফ কাযেম, আফজল, শাহ কুলী খান, শাহী নুরী এবং বীজাপুরের মির্যা ও হাশিমীর নাম উল্লেখযোগ্য। মির্যা সারাজীবন মার্সিয়া কবিতা রচনা করে গেছেন বলে জানা যায়।
১৬৫০ সালে গোলকুণ্ডার কবি আহম্মাদ কারবালা ঘটনা নিয়ে ‘মুসিবাত-ই-আহলে বাইত’ নামক একখানি মসনবী কাব্য রচনা করেন। মুহাম্মাদ হানিফার উপাখ্যান নিয়েও দু’খানা মহাকাব্য রচিত হয়।
মীর জমীরের সময় উর্দু ভাষায় মার্সিয়া সাহিত্য পূর্ণাঙ্গ রূপলাভ করে । মীর জমীর সর্বপ্রথম মিম্বরে বসে মার্সিয়া পাঠ করার রীতি প্রচলন করেন। তার পূর্ববর্তী কবিগণ যে পদ্ধতিতে মার্সিয়া রচনা করতেন তা চল্লিশ পাঞ্চাশ বন্দের বেশি দীর্ঘ হতো না।
উল্লেখ্য যে, ‘রওজাতুস শুহাদা’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির তিনটি কপির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এর দুই কপি লণ্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে এবং এক কপি রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত আছে। মির্যা ও হাশিমীর রচিত মার্সিয়া কাব্যের পাণ্ডুলিপি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত আছে।
এরপর মীর খালিকের (১৭৭৪-১৮০৪:খ্রি.) সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। মীর খালীকের চার ভাইয়ের তিন ভাইই কবি ছিলেন । খালক, খালীক এবং মহসীন এ তিন ভাই মার্সিয়া কবিতা লিখে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন । মীর খালীকের পুত্র মীর বাবর আলী (১৮০২-১৮৭৪:খ্রি.) মার্সিয়া কাব্যের সর্বাধিক উন্নতি বিধান করেন। দাক্ষিণাত্য অপেক্ষা দিল্লী ও লক্ষৌতে এসে মার্সিয়া সাহিত্যের প্রকৃত উন্নতি সাধিত হয়েছে। লক্ষৌতে শহরের অধিকাংশ আমীর ও ওমরাহ শিয়া মাযহাবভুক্ত ছিলেন । এ কারনে তারা কারবালার বীর শহীদদের দুঃখ-কষ্টের কথা অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে আলোচনা করতেন এবং ক্রন্দন ও শোক প্রকাশ করাকে ধর্মীয় কার্যের অংশ হিসাবে গণ্য করতেন। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য কবিদেরও তারা মার্সিয়া সাহিত্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। লক্ষৌর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ (১৮৪৭-৫৬ :খ্রি.) নিজেও কবি ছিলেন । তিনি জিলদে মিরাসী,দফতর -ই-গম ও বহর-ই-আলম এবং সরমায়া-ই-ঈমান নামক তিন খানা মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন।
১৮৫৬ সালে তিনি কলকাতা আসেন এবং ১৮৮৭ সালে তার মৃত্যু ঘটে। মার্সিয়া সাহিত্যের যথার্থ উন্নতি ও বিকাশের সময় লক্ষৌ শহরে মুহররমের শোক প্রকাশের সময়কাল ১০ দিনের পরিবর্তে ৪০ দিন নির্দিষ্ট হয়। নবাব ওয়াজেদ আলী স্বয়ং মার্সিয়া কাব্য রচনা করতেন এবং তা মজলিস অনুষ্ঠানে পঠিত হতো। এ সময় কালের মার্সিয়া সাহিত্যে দু’জন বিশিষ্ট কবির সন্ধান পাওয়া যায়। তারা হলেন মীর আনীস এবং মীর্যা দবীর। তারা উভয়ই মার্সিয়া সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি ছিলেন । বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের যেমন দুই কবি চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি, তেমনি উর্দু ভাষায় মার্সিয়া কাব্য সাহিত্যের দুই শ্রেষ্ঠ কবি মীর্যা দবীর ও মীর আনিস। এই দুই প্রতিভাদীপ্ত কবির কাব্য সাধনার ফলে উর্দু মার্সিয়া কাব্যের চরম উন্নতি সাধিত হয় এবং মার্সিয়া সাহিত্য বিশেষভাবে লাভবান হয়।
বাংলায় মার্সিয়া সাহিত্যের ক্রমবিকাশ
বাঙালি সংস্কৃতিতে মার্সিয়া সাহিত্য অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী সাহিত্য হিসাবে পরিগণিত হয়ে আছে। বাঙালি মুসলমানদের জীবনের সাথে কারবালার কাহিনী ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।
কারবালার মরু প্রান্তরে মহানবী রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.) -এর সপরিবারে এই আত্মদানের ঘটনা এমন করুণ ও হৃদয়বিদারক যে, তা যুগে যুগে সাহিত্যিকদের কাব্য ও সাহিত্য রচনায় প্রেরণা যুগিয়েছে। কারবালার যুদ্ধের মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর আত্মদান চিরদিন মানুষকে ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করবে। বাংলা সাহিত্যে কারবালার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে কাল থেকেই এ দেশের মুসলমান তথা জনসাধারণের মধ্যে প্রতি বছর মুহররম মাসে শোক পালন করার রীতি চলে আসছে এবং এ বিষয়ে পুথি-কস্তক লেখার রেওয়াজ চালু হয়েছে। কারবালার ঘটনা বা মুহররমের ঘটনা নিয়ে মধ্যযুগে এবং পরবর্তীকালে যে সব পুথি ও বই লেখা হয়েছে. সেগুলোর নাম ‘জঙ্গনামা’। মকতুল হুসায়ন,শহীদ-ই-কারবালা,সংগ্রাম হুসন, এমাম এনের কেচ্ছা,শাহাদাৎ নামা,হানিফার লড়াই,বড় জঙ্গনামা,গুলজার-ই-শাহদাৎ,দাস্তান শহীদে ইকবরালী,জঙ্গে কারবালা ইত্যাদি।
ইংরেজ আমলে কারবালার করুণ কাহিনী নিয়ে বিস্তর কাব্য ও সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ বিষয়ে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্দুর সাহিত্যমান অতুলনীয়। যদিও এতে প্রচুর ইতিহাস বিকৃতি রয়েছে । তাছাড়া বাংলা কাব্যে কতিপয় কবি এ বিষয়ে নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আবুল মা আলী, মুহম্মদ হামিদ আলী, কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী,মীর রহমাত আলী,কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে কারবালার ঘটনা নিয়ে মুহররম মাসে মুসলমানের একাংশ যে বিষাদময় গীতিকা গেয়ে থাকে তার নাম জারি গান। প্রকৃতপক্ষে মুহররমের মর্মস্পর্শী ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফার্সিও উর্দু ভাষার মতো বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য করুণভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, জারিগান তারই এক বিশিষ্ট রূপ।
এই উপমহাদেশে কারবালার ঘটনা নিয়ে সাহিত্য নির্মাণের সূচনা হয় পনের শতকের শেষার্ধ্বে তখন কারবালার ঘটনা নিয়ে লেখা মার্সিয়া পড়া হতো। হিন্দু- মুসলমান সবাই মুহররমের মিছিল করত। মাতম করতো এবং এ মাতম উপলক্ষে ইরানী কবি কাশানীর ফার্সি হফতবন্ধ পড়া হতো। কিন্তু অনতিকাল পরে দাকিনী ভাষায় (প্রাচীন উর্দু ভাষায় ) কারবালার করুণ ঘটনা নিয়ে এক প্রকার মার্সিয়া কবিতা রচিত হতে লাগল। আহমদে নগরের কবি আশরাফ প্রথম বারের মতো মার্সিয়া লিখতে শুরু করেন। দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ভারত ও অন্যান্য স্থানে কারবালা ঘটনা অবলম্বনে বিষাদময় কবিতা লেখার প্রচলন হয় এবং ধীরে ধীরে তার বিস্তৃতি ঘটে। বাংলা ভাষায় কারবালার ঘটনা নিয়ে সর্বপ্রথম কে সাহিত্য রচনার সূচনা করেন সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে এ পর্যন্ত যতদূর তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাতে শায়খ ফয়জুল্লাহ কারবালা সম্বন্ধে জয়নবের চৌতিশা রচনা করেন যা এ সম্পর্কিত প্রথম বাংলা কবিতা বলে গণ্য করা হয়। সমসাময়িক কালে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ও অর্থমন্ত্রী বাহরাম খান ‘মাকতাল হোসেন’ রচনা করেন। মাকতাল হোসেন-এ ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনার বর্ণনা স্থান পায়। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামের অধিবাসী মুহম্মদ খান এ সম্পর্কিত কয়েকখানি কবিতা রচনা করেন। রংপুরের ঘোড়াঘাট সরকারের অধীন ঝাড় বিশিলা গ্রামের কবি হায়াৎ মামুদ কাশেমের লড়াই নিয়ে ‘জঙ্গনামা’ নামে কাব্য রচনা করে মার্সিয়া সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবি হামিদ কারবালা ঘটনা নিয়ে ‘সংগ্রাম’ রচনা করেন। ব্রিটিশ আমলে ফকীর গরীবুল্লাহ ‘জঙ্গনামা’ রচনা করেন। গরীবুল্লাহর ‘জঙ্গনামা’ অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য হিসাবে পরিচিতি লাভ করে । আঠার শতকে রাঢ় অঞ্চলে কারবালার ঘটনা হিন্দু- মুসলমান লেখক ও পাঠকদের মধ্য প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করে । কবি রাধাচরণ এ ‘এমাম এনের কেচ্ছা’ রচনা করেন।
উনিশশ তাকে চট্টগ্রামের কবি মোহাম্মদ হামিদ উল্লাহ খানে রচিত গুলজার-ই-শাহাদাৎ বা শাহাদা স্থান কাব্য খানি আগাগোড়া সাধু ভাষায় রচিত হয়। সুনামগঞ্জের লক্ষণ শ্রী পরগনা অধিবাসী ওয়াহিদ আলী পাচশ’ পৃষ্ঠার এক কাব্য ‘বড় জঙ্গনামা’ রচনা করেন। অতঃপর বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং কবি-সাহিত্যিকগণ কারবালার ঘটনা নিয়ে সাহিত্য সৃজনে পাশ্চাত্য ভাবের আমদানি ঘটান। এ কবিদের মধ্যে মুহাম্মদ হামিদ আলী, মতীয়ুর রহমান খান, কায়কোবাদ, আব্দুল বারী, আব্দুল মুনায়েম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, আজিজুল হাকিম,মুহম্মদ ইব্রাহিম প্রমুখের নাম উল্লেখ যোগ্য।
মুহাম্মাদ হামিদ আলীর পুরো নাম আবুল মা আলী মুহাম্মদ হামেদ আলী। তার বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের রাউজান থানার অধীন সুলতানপুর গ্রামে। তার জন্ম ১৮৬৫ সালে। তিনি ‘জয়নলোদ্ধার’ এবং ‘কাসেম বধ’ কাব্য রচনা করেন। কাব্য দু’খানি মুসলমান পাঠকদের কাছে যথেষ্ট সমাদর লাভ করে । ‘কাসেম বধ’ কাব্যের বিষয় কারবালার ভীষণ যুদ্ধ,নবী পরিজনের শোচনীয় দুর্গতি ও সখিনার মর্মভেদী বিলাপ। কবি নবীন চন্দ্র সনের মহাকাব্য প্রকাশের সময়কাল ১৮৯৬ সাল। এ মহাকাব্য রচনার যুগে কবি হামিদ আলী ক্লাসিক্যাল রীতিতে এ কাব্য লিখেন।
মতীযূর রহমান খান এবং কবি কায়কোবাদের আবির্ভাব একই সময়ে। মানিকগঞ্জ জেলার পারিল গ্রামে মতীয়ূর রহমানের জন্ম হয়। তিনি শক্তিকতা করতেন। তিনি ‘এজিদ বধ’ ও ‘মাসলেম বধ’ নামক দু’খানি কাব্য রচনা করেন। ‘এজিদ বধ’ কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে একটি মাত্র উপসর্গে রচিত একটি প্রকাণ্ড খণ্ড কবিতা । কবিতার প্রথমাংশে হোসাইন পরিবারের প্রতি ইয়াযীদের রূঢ় আচরণ এবং ইয়াযীদের রাজসভার বর্ণনা স্থান পেয়েছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কারবালার ঘটনা নিয়ে কাব্য রচনার ক্ষেত্রে কবি কায়কোবাদ অনন্য স্থান দখল করে আছেন। তার পূর্ব নাম মুহাম্মদ কাযেম আল কুরায়শী। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি ‘মহরম শহীদ’নামে তিন খণ্ডে সমাপ্ত কাব্য রচনা করেন।
কবি আব্দুল বারী ১৮৭৭ সালে নোয়াখালী জেলার মাইজদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘কারবালা’ কাব্য রচনা করেন। ২১০ পৃষ্ঠার কাব্যে তিনি হোসাইন শিবির সন্নিবেশ, যুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বিবরণ তুলে ধরেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী শক্তিশালী লেখক, কবি ও বক্তা ছিলেন । কারবালা ট্র্যাজেডি নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘মহাশিখা’ কাব্য।
আব্দুলল মুনায়েম ১৮৮৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার ফতেপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম হাসান,আলী আসগর,আব্দুল ওহাব,মহাবীর কাসেম ও ইমাম হোসাইন এই পাচ শহীদকে নিয়ে ‘পঞ্চ শহীদ’ কাব্য রচনা করেন।
পাবনা শহরের কৃষ্ণপুরের অধিবাসী ছিলেন কবি মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ১৮৮২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কারবালার ঘটনা অবলম্বনে তিনি ‘শহীদের খুন’ রচনা করেন।
কবি আজিজুল হাকিম ঢাকা জেলার রায়পুর থানার হাসনাবাদ গ্রামে ১৯০৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। কারবালা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি ‘মরু সেনা’ রচনা করেন।
মীর রহমত আলী নরসিংদী জেলার রসূলপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন । তার লেখা ‘মহরম কাব্য’ বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজীবন দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের জগতে এক অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছেন । কারবালাকে কেন্দ্র করে তিনি যে ক’টি কবিতা ও গান লিখেছেন তা অসাধারণ ।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য ছাড়া কারবালা ট্র্যাজেডি পল্লীর অগণিত মানুষের কাছে প্রতিভাত হয় বেদনার অথৈ সমুদ্র হিসাবে । মুহররমকে উপলক্ষ করে বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে রচিত হয়েছে অসংখ্য জারীগান ও কবিয়ালদের কবিত্ব গাথা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে,সম্রাট হুমায়ুনের সাথে ইরানী সৈনিক শিল্পী ও সাহিত্যিকগণের সংস্পর্শ বাংলাদেশের সাহিত্য,সাংস্কৃতিক সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। এ ছাড়া এ সময়ে ইরানের রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে বহু শীয়া মতাবলম্বী নর-নারী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ এবং মুঘল সম্রাটগণ কর্তৃক বহু শীয়া আমির- এবং সুবাদার সুবে বাংলার শাসক নির্বাচিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গের সুন্নি নর-নারী শিয়া ধর্মীয়ভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এ প্রভাবের কারণে মার্সিয়া সাহিত্যের বিস্তার ঘটে।
১৮৫৭ সালে দিল্লীর সর্বশেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহী বিদ্রোহের সাথে জড়িত আছেন- এ অভিযোগে ইংরেজরা তাকে বন্দি করে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে । বাহাদুর শাহ শিয়া ছিলেন । (Religious Quest of India, Oxford University Press-1930, Page No-61) বাহাদুর শাহ কাব্য ও কবিতার সমঝদার ছিলেন এবং তিনি কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সে সময় মার্সিয়া সাহিত্যের যথেষ্ট অনুশীলন হতো। কিন্তু বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়ার পরেই দিল্লী হতে শিয়া কবিগণ কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ গমন করেন এবং আস্তে আস্তে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েন। শিয়া কবিদের সংস্পর্শে এ দেশীয় কবি-সাহিত্যিকগণ মার্সিয়া রচনায় উৎসাহী হয়ে পড়েন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হতে যে সব কবি-সাহিত্যিক কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ আগমন করেছিলেন তাদের মধ্যে মার্সিয়া কাব্যের অধিকাংশ কবি শিয়া ছিলেন । কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে মুহররম উপলক্ষে তারা কাব্য রচনা করতেন। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষৌ ও দিল্লীর পরিবর্তে কলকাতা মার্সিয়া সাহিত্যের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়।
মুঘল আমলে ঢাকা শহরে শিয়াগণের বসতি স্থাপিত হয়। ফলে ঢাকাতেও বেশ কয়েকখানি মার্সিয়া কাব্য রচিত হয়েছিল । পারস্যের জগদ্বিখ্যাত কবি ফেরদৌসীর শাহনামার অনুকরণে ঢাকার কবি সৈয়দ গোলাম আলী আল মুসাড় ১৮৪৬ সালে কারবালার মর্মবিদারক কাহিনী অবলম্বনে একখানি ফার্সি কাব্য রচনা করেন।
১৭৬৩ সালে বাংলার সর্বশেষ নবাব মীর কাশিমের সাথে ইংরেজদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মীর কাশিম পরাজিত হয়ে অযোধ্যার শাসনকর্তার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাতে ইংরেজরা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়। অযোধ্যার তৎকালীন শাসক নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের আশ্রয়ে বহু কবির জীবিকা নির্বাহ হতো। তিনি অত্যন্ত বিলাসী ছিলেন বলে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করেন নি। ফলে ইংরেজ সেনাপতি বিনা যুদ্ধে জয়লাভ করে নবাবকে বন্দি করে । পরে তাকে কলকাতায় আনা হয়। এ সময় অযোধ্যার অন্তর্গত লক্ষৌ শহর হতে মার্সিয়া সাহিত্যের কবিগণ চতুর্দিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়েন। এ সকল কবির কেউ কেউ নবাবের সঙ্গে মাটিয়াবুরুজ অঞ্চল,কতক মুর্শিদাবাদ এবং কতক রামপুরের নবাব দরবারে আসেন ও তারা পুণরায় মার্সিয়া সাহিত্য চর্চা করতে থাকেন। যে সকল কবি মাটিয়াবুরুজে এসে নবাবের সাথে মিলিত হয়েছেন নবাব তাদের সম্মানজনক খেতাব ও উপঢৌকন দিয়েছেন। সপ্তগ্রহ নামে নবাবের একটি কবি পরিষদ ছিলো। এ পরিষদের সাতজন বিশিষ্ট কবিকে ‘সপ্তগ্রহ’ বলা হতো। তারা হলেন : ফতেহ উদ দৌলা বকসীউল মুলক বাকি,মাহতাব-উদ-দৌলা কাউকাব উল-মুলক সিতারা জঙ্গে দারাখশান,নওয়াব মুহম্মদ তাকি খান লক্ষৌবি,মীর্যা আলী,মীর্যা মসীতা,মীর্যা মুজাফফর আলী লক্ষৌবি,বলায়েত আলী কাশ্মীরি।
এ সময় মার্সিয়া ধারার কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অবস্থার সূচনা ঘটে। নবাব সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় আরো অনেকে মার্সিয়া কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ আগা হুসেন, খাজা আরশাদ আলী খান, মীর্যা আলী জান, আমীর আলী খান, সৈয়দ ইনশাআল্লাহ খান প্রমুখ।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কবিগণের অধিকাংশ নবাব আলীবর্দী খান ও তদীয় দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে আগমন করে কাব্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন । এ সকল কবি প্রধানত ফার্সিও উর্দু ভাষায় মার্সিয়া রচনা করতেন। বিখ্যাত ফার্সি কাব্য ‘মকতুল হুসেন’ কাব্যের অনুভাবেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবিগণ বাংলা ভাষায় মার্সিয়া কাব্য রচনায় যত্নবান হন। তাদের মধ্যে মুহম্মদ খান,হায়াৎ মামুদ, ফকীর গরীবুল্লাহ,রাধাচরণ গোপ,হামিদ অন্যতম ।
কলকাতর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু উর্দু কাব্য কারবালার করুণ ঘটনা অবলম্বনে লিখিত হয়। উর্দু ভাষাতেও মার্সিয়া কাব্য রচনার রেওয়াজ বহুকাল যাবত চলেছিল । আনাসেরে শাহাদাতায়েন,লতায়েফ আশরাফি এবং আবুল কাসিম মীর্যার জঙ্গনামা উর্দু ভাষায় লিখিত হয়েছিল । ফার্সীও উর্দু ভাষার ধর্মীয় বোধ ও প্রেরণা হতেই বাংলাদেশের বহু মুসলমান কবি-সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় মার্সিয়া রচনা করেন। এ সাহিত্যধারা সম্পর্কে সাহিত্যিক আব্দুল কাদির বলেন : ‘ধর্মীয় পুস্তকাদি ছাড়া আর এক ধরনের পুথিতে উর্দু,ফার্সির আধিক্য দেখা যায়। সে সমস্ত পুথি সাহিত্যের অধিকাংশই রচিত হয়েছে মুহররমের মর্মান্তিক ঘটনাকে উপলক্ষ করে । ইমাম হোসাইনের নিদারুণ হত্যা কাহিনীর ভিত্তিতে বাঙ্গালায় যে বিরাট পুথি সাহিত্য গড়ে উঠেছে, আমি তার নামকরণ করেছি ‘মার্সিয়া সাহিত্য’। মহাজন পদাবলী,নাথ গীতিকা,মঙ্গলকাব্য চৈতন্য সাহিত্য প্রভৃতি যেমন উপাদান ও প্রকাশ রূপের দিকে দিয়ে পরস্পর হতে পৃথক,তেমনি বাঙালার এই মার্সিয়া সাহিত্য বিষয়বস্তু ও বাকভঙ্গিতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।’
মার্সিয়া কাব্য রচনার ক্ষেত্রে কবিগণ চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, হুগলী প্রভৃতি অঞ্চলে সুবাদার অথবা শাসন কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সাহায্য ও উৎসাহ লাভ করতেন বলে মনে হয়। অন্যান্য অঞ্চল মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থানরূপে পরিগণিত হবার বহু পূর্বেই চট্টগ্রামে মুসলমানদের উপনিবেশ স্থাপিত হয়। তখন হতেই এখানে সমুমদ্রগামী বণিক ও ধর্মপ্রচারকগণ ঘাটি নির্মাণ করেছিলেন । ফলে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গে যে মুসলিম শাসকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে তার মূলে চট্টগ্রামের অবদান অনেক খানি।
চট্টগ্রামের ন্যায় অন্যান্য কেন্দ্রস্থলে এবং তৎসন্নিহিত অঞ্চলসমূহে ফার্সিও উর্দু ভাষায় কাব্য চর্চাও যথেষ্ট হতো। মুহররমের সময় কবিগণের রচিত মার্সিয়া কাব্য ও কবিতা পাঠ হতো। বাংলাদেশের শিয়া শাসক বা নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায় ইমামবাড়াগুলোতে মজলিস অনুষ্ঠান জাকজমকের সাথে পালিত হতো। এ কারণে কারবালা কাহিনী রাজধানীসহ তৎসন্নিহিত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং জনমনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে । কোনো কারণে রাজ্যের শাসক ও কর্তৃপক্ষ রদবদল হলেও দেশের মুসলিম জনসাধারণ বংশ পরস্পরায় কারবালার করুণ ও মর্মস্পর্শী কাহিনীর প্রতি চিরদিনই হৃদয়ের টান অনুভব করে এসেছে। শুধু তা-ই নয় ধর্মীয় কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর আত্মত্যাগ সম্পর্কিত কাহিনী মুসলিম নর-নারীর নিকট চিরদিন গভীর শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছে। দীর্ঘকাল যাবত মুসলমানরা হিন্দুগণের পুরান পচালী শুনে সাহিত্য রস পিপাসা মিটিয়েছেন।
পরবর্তীকালে তাদের সমাজ মানসে পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়। তারা নিজেদের ঐতিহ্য নির্ভর কাব্য কাহিনী পাঠ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো এবং এ প্রয়োজনের তাগিদেই ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতিভিত্তিক সাহিত্যের সূত্রপাত। এ সাহিত্যের অন্যতম শাখা হিসাবেই বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। কবিগণ মুসলিম ঐতিহ্য নির্ভর কাহিনী গ্রহণ করলেন বটে কিন্তু কাব্যের কাঠামোর কোনো পরিবর্তন করলেন না। কাব্য কাঠামো বাঙালি হিন্দু কবি রচিত পুরান পচালীর ন্যায় রয়ে গেল। মুসলমান কবিগণ পুরান এর প্রভাব অতিক্রম করতে পারেনি।
যা হোক এ সকল সাহিত্যের মধ্যে দু’টি ধারা লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ধারা : সপ্তদশ-অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘হরি বংশ’ প্রভৃতির অনুসরণে ‘নবী বংশ’ এবং ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’, ‘পাণ্ডব বিজয়’ প্রভৃতির অনুসরণে ‘রসূল বিজয়’, ‘মুহাম্মদ বিজয়’,কাসাসুল আম্বিয়া প্রভৃতি পয়গম্বরদের কাহিনী মূলক কাব্যাদি রচনা । দ্বিতীয় ধারা : হযরত রাসূলুল্লাহর পরবর্তী খলিফাগণের বিজয় অভিযানের বীরত্ব ব্যঞ্জক কথা ও ইমাম হোসাইনের কারবালার যুদ্ধের করুণ কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য রচনা ।
দ্বিতীয় ধারার কাব্যগুলোর সাধারণ নাম ‘জঙ্গনামা’। ‘জঙ্গনামা’র বিষয়ব অত্যন্ত করুণ ও মর্মস্পর্শী। বাঙালি মুসলমানদের নিকট এ কাব্যের কদর হয়েছিল অত্যন্ত বেশি । প্রকৃতপক্ষে এ জঙ্গনামা বা বাংলা মার্সিয়ার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা তাদের প্রাণের কথা প্রতিধ্বনিত হতে শুনলেন এবং এর মাধ্যমে তাদের অতীত ঐতিহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শিখলেন। বাংলা মার্সিয়া কাব্যগুলো প্রধানত অনুবাদ সাহিত্য হিসাবেই গড়ে ওঠে। বাঙালি কবিগণ যদিও মূলত ফার্সি ও উর্দু কাব্যের ভাব-কল্পনা ও ছায়া আশ্রয় করে তাদের কাব্যাদি রচনা করেছিলেন তথাপি এগুলোর মধ্যে যথেষ্ট মৌলিকতা ছিল । ফলে এ কাব্যগুলো এক প্রকার অভিনব সৃষ্টি হয়ে দাড়িয়ে ছিল । সুদূর আরব ও পারস্যের মানুষের কাহিনী কাব্যাকারে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে কবিগণ যে শিল্পরস ও পরিকল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তা অনকক্ষেত্রে অবাস্তব ও উদ্ভট হয়েছে। এতে মনে হয় বাঙালি কবিগণ মাটির প্রভাব অতিক্রম করতে পারেনি।
বাংলা ভাষায় ‘জয়নবের চৌতিশা’ নামীয় একখানা মার্সিয়া কাব্য পাওয়া গিয়েছে। এটি ষোড়শ শতাব্দীর কবি শেখ ফয়জুল্লাহ রচিত। আপাতত অন্য কোন পুথি আবিস্কৃত না হওয়ায় এ কাব্যখানিকে মার্সিয়া সাহিত্যে প্রাচীনতম রচনা হিসাবে গ্রহণ করো যায়। এতে কারবালার করুণ কাহিনীর সাথে ইমাম হোসাইনের বোন বিবি যায়নাবের বিলাপ বর্ণিত হয়েছে। সম্প্রতি অধ্যাপক আলী আহম্মদ কর্তৃক আবিষ্কৃত ষোড়শ শতাব্দীর কবি দৌলত উজির বাহরাম খানের রচিত ‘জঙ্গনামা’র সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। পুথিখানির মাত্র কয়েক পাতা পাওয়া গিয়েছে। এটি শেখ ফয়জুল্লাহর সমসাময়িক বলে ধারণা করছেন ঐতিহাসিকগণ।
এরপরে চট্টগ্রামের লোকপ্রিয় কবি মুহাম্মদ খান ‘মাকতাল হোসেন’ কাব্য রচনা করেন ১৬৪৫ সনে, যা অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য। মুহম্মাদ খানের এ কাব্য বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে পঠিত হতো। রংপুরের কবি হায়াৎ মামুদের ‘জঙ্গনামা’ ১৭২৩ সালে রচিত হয় এবং পূর্ববঙ্গের সিলেটের কবি হামিদের ‘সংগ্রাম হুসন’ কাব্যের অনুলিপি হয় ১৭৪১ সালে। হয়তো কবি মূল কাব্য এর অনেক পূর্বেই রচনা করেছিলেন । হায়াত মামুদ উত্তরবঙ্গের একজন শ্রেষ্ঠ কবি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের বাংলা ভাষায় কাব্য রচনায় যে ধারার সূত্রপাত হয় তাতে বহু কবি মার্সিয়া কাব্য রচনায় যত্নবান হয়েছিলেন । এ ধারার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কবি গরীবুল্লাহ। তিনি ‘জঙ্গনামা’ কাব্য প্রণয়ন করেন। ফকির গরীবুল্লাহ ফার্সি-উর্দু-হিন্দি শব্দ মিশ্রিত বাংলা ভাষার এক নতুন ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির সূচনা করেন। তৎপর রাঢ়ের হিন্দু কবি রাধাচরণ গোপের ‘ওফাৎনামা’ এবং ইমাম গণের বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাব্য দু’খানি পশ্চিমবঙ্গের ‘এমাম এনের কেচ্ছা’ বোলপুর নিকেতনের লোহাগুড়ি গ্রাম হতে আবিস্কৃত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গের ভূরশুই কানপুর পরগনা হতে মুন্সী জোনাব আলীর ‘শহীদে কারবালা’ প্রকাশিত হয়। সাদ আলী ও আব্দুল ওহাব ‘শহীদে কারবালা’র কাব্যধারা সংযোজন করেন। মুসলমানী বাঙলায় রচিত পুথির আদি কবি ফকীর হাবিবুল্লাহ ফার্সি-উর্দু-হিন্দী মিশ্রিত বাংলা ভাষায় কাব্য রচনার যে রীতি চালু করেছিলেন তা বর্তমান সময়েও হয়ে আসছে। অতি আধুনিককালের কবিদের মধ্যে রংপুরের মুহাম্মদ ইসহাক দাস্তান ‘শহীদ কারবালা’ এবং চট্টগ্রামের কাজী আমিনুল হকের ‘জঙ্গে কারবালার’ নাম উল্লেখযোগ্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সিলেটের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মুসলমানগণের মধ্যে এক প্রকার নাগরীলিপিতে বাঙলা সাহিত্য চর্চা হতো। দেবনাগরী ভাষা হতে এটি ভিন্ন প্রকৃতির। এটি প্রধানত সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে চালু ছিল বলে এর নাম ‘সিলেটি নাগরী’। এ লিপিতে বাংলা কাব্য রচনার রীতি শুধু সিলেট অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল । স্থানীয় মুসলমানরাই ছিলেন এ কাব্যের পৃষ্ঠপোষক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে এ লিপিতে কাব্যাদি রচনা যথারীতি চালু হয়। নানা বিষয়ক কাব্যের মধ্যে মার্সিয়া ধারার কাব্য অন্যতম। সিলেটি নাগরী লিপিতে বাংলা ভাষায় একখানি জঙ্গনামা কাব্য লেখেন ওয়াহিদ আলী নামক এক কবি। ওয়াহিদ আলীর বাড়ি ছিল সুনামগঞ্জ জেলার ষোলঘর মৌজায়। তার রচিত জঙ্গনামা পাঁচশ’ পৃষ্ঠার এক সুবৃহৎ কাব্য।
আধুনিক কালের কবি-সাহিত্যিকগণ বহু কবিতা ও কাব্য রচনা করে বাংলা মার্সিয়া সাহিত্য ভাণ্ডারকে বিকশিত করে গেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি নজরুল ইসলাম মুহররম ও কারবালা কাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের ওপর ভিত্তি করে অনেক কবিতা ও ইসলামী গান রচনা করেছেন । বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলসমূহে বহু লোককবি কারবালার কাহিনীর বিষাদ অংশ অবলম্বনে অসংখ্য পল্লীগান রচনা করেছেন যা এ দেশের বিস্তৃত জনপদে আপামর জনসাধারণের অন্তরে বেদনার করুণ ভাব সৃষ্টি করেছে। কারবালা কাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশ অবলম্বনে রচিত পল্লীগানগুলোর অধিকাংশ জারী হিসাবে রচিত ও পঠিত হয়েছে। জারীগান ছাড়াও বাংলা মার্সিয়া বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। মার্সিয়ার তাল ও সুর বিষাদে পরিপূর্ণ । বাংলা মার্সিয়া সাহিত্য এবং সংগীত মুসলমানদের ধর্মীয় পটভূমিকে উপলক্ষ করেই গড়ে ওঠে এবং ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
*প্রবন্ধটি ভারতের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকের এম ফিল গবেষণায় থিসিস অবলম্বনে রচিত।
‘পবিত্র আহলে বাইতের মুহাব্বাত ঈমানের অংশবিশেষ। আর তাদের প্রতি কৃত পাশবিক অত্যাচারের কাহিনী ভুলে যাওয়ার মতো নয়। হযরত হোসাইন (রা.) এবং তার সাথীদের ওপর নিপীড়নমূলক ঘটনা এবং হৃদয়বিদারক শাহাদাত যার অন্তরে শোক এবং বেদনা সৃষ্টি করে না, সে মুসলমান তো নয়ই, মানুষ নামেরও অযোগ্য।’
মুফতী শফী (রহ.)