সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী
বিশ্ব বিধাতা পরিপূর্ণ ও পরম সত্তা। তাঁর জাত বা সারসত্তা সকল প্রকার গুণাবলীতে ভরপূর। কেননা,যা কিছু আমরা পরিপূর্ণতা বলে আখ্যায়িত করে থাকি তার সবকিছুই তাঁর সারসত্তায় বিরাজমান। আর যা কিছু আমাদের ধারণারও অতীত তাও তাঁর জন্যে ধারণা করা যায়। তিনি পরম পরিপূর্ণ।
তিনি সাবর্জনীন প্রভু,তাঁর প্রভূত্বের সীমারেখা টানা যায় না। তিনি চিরন্তন,চিরঞ্জীব,শাশ্বত ও অমর। আল্লাহ্ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই চূড়ান্ত সার্বভৌম ও সর্বশক্তিমান। তিনি সর্বজ্ঞ,সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কোন স্থান,কাল বা পাত্রে সীমাবদ্ধ নন। স্থান,কাল,পাত্র তাঁর জন্যে কল্পনা করারও অশোভনীয়। আমাদের চর্ম চক্ষুর মাধ্যমে তাঁকে দেখা অসম্ভব। কেননা,তিনি তো কোন বস্তুগত সত্তা নন। তিনি কোন মিশ্র বা যৌগিক সত্তা নন। যে সমস্ত ত্রুটি ও অপূর্ণাঙ্গতা একজন পরম পরিপূর্ণ সত্তার জন্যে অশোভনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় তার সকল কিছু থেকে তিনি মুক্ত।
অধিকন্তু পূর্ণতা,পরিপূর্ণতা,সব ধরনের কল্যাণ ও মঙ্গল বিষয়ক বস্তু,তাঁর-ই সৃষ্টি। তিনি সকল পরিপূর্ণতার পরিপূর্ণতাদানকারী। কেননা,পূর্বোল্লেখিত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে,তিনি একজন অপরিহার্য সত্তা। কোন অপরিহার্য সত্তার জন্যে নির্ভরশীলতা ও মুখাপেক্ষিতার প্রশ্নই উত্থাপন হতে পারে না।
আল্লাহ্ ন্যায় বিচারক,সুবিচারক ও সুবিচক্ষণ। তিনি হাকিম,সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও প্রজ্ঞাবান। তাঁর প্রতিটি কার্যে সুনির্দিষ্ট কারণ নিহিত থাকে। তিনি অযথা কোন কাজ সম্পাদন করেন না।
তিনি সকল সৃষ্টির নিয়ন্তা ও রিজিক্দাতা। সকল সৃষ্টির রিজিক তিনিই প্রদান করে থাকেন। তিনি সর্বজ্ঞানী। অসম্ভব বস্তুজগত সম্পর্কেও তিনি জ্ঞাত।
তাঁর সকল গুণাবলী তাঁর জাত সত্তারই অন্তর্গত। আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী তাঁর জাতের উপর আরোপিত নাকি তাঁর জাতের সাথে একাকার? এ নিয়ে যুগ যুগ ধরে আশআরী ও মু’তাযিলিদের মধ্যে বিতর্ক হয়ে আসছে। মু’তাযিলিরা আল্লাহর একত্বের রক্ষা এবং চিরবিদ্যমান সত্তার একাধিকত্ব ও তাঁকে বস্তুগত গুণাবলীর সাথে তুলনার বিষয়টি গুড়িয়ে দেয়ার নিমিত্তে আল্লাহর গুণাবলীকে তাঁর জাত সত্তার সাথে মিশিয়ে একক সত্তার ধ্বনি দিয়ে আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছেন। তারা আল্লাহর জাত ছাড়া অন্য কিছুকে স্বীকার করতে একেবারে নারাজ। এ প্রসঙ্গে ক্বাজী আব্দুল জাব্বার আল মু’তাযিলি বলেন :
“আমাদের শেখ,আবু আলী বিশ্বাস করেন যে আল্লাহর জাতের মধ্যে চাঁরটি গুণ (ক্ষমতা,জ্ঞান,হায়াত বা জীবন ও অস্তিত্ব) যথোযোগ্য বিদ্যমান।
তিনি আরো বলেন,আমাদের শেখ,আবু হাশিম বলেন,এই (চার প্রকার) গুণাবলী আল্লাহর জাত সত্তার অন্তর্গত।
অতএব,উপরোক্ত দুই শেখের বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে :
আল্লাহ্ সুবহানাহু নিজ সত্তাতেই জ্ঞানী,শক্তিশালী ও জীবিত,জ্ঞান,ক্ষমতা ও হায়াতের মাধ্যমে নয়।”(শারহ্ আল্ উসুল আল খামসা, পৃঃ ১৮২)
আর আশআরীরা মু’তাযিলিদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আল্লাহর সিফাতকে তাঁর জাত থেকে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণাবলীর সাথে আল্লাহর গুণাবলীর তুলনা দিয়েছেন।(মাকালাত আল্ ইসলামিয়িন, খণ্ড ১, পৃঃ ২২৪)
বস্তুতঃ আল্লাহর জাত সত্তার সাথে সাথে তাঁর গুণাবলীর অবস্থানও অনস্বীকার্য। তবে তাই বলে তাঁর গুণাবলী তাঁর জাতসত্তা থেকে পৃথক কিছু নয়।
আল্লাহর জাত আর তাঁর সিফাত বা গুণাবলীতে কোন পার্থক্য নেই,আর এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য করা অন্যায় ও অনুচিত। তাঁর জাত থেকে তাঁর সিফাতকে (গুণাবলীকে) যে পৃথক মনে করে,বুঝতে হবে সে আল্লাহর একত্ব বিসর্জন দিয়ে দ্বিত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে।
এরকম মানুষই আল্লাহর খণ্ড অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। এ রকম বিশ্বাস যে পোষণ করে,তার পক্ষে আল্লাহর সত্যকার উপলব্ধি সম্ভব নয়---সে অজ্ঞ,সে সব সময় নিজের কোন কাল্পনিক বস্তুকেই দেবতা ভাবতে চেষ্টা করে। যে কেউ এমন বিশ্বাস পোষণ করে,সে আল্লাহর অস্তিত্ব সীমাবদ্ধতা আরোপ করবে---সে চাইবে তাঁকে স্থানে বা বিশেষ বিশেষ ক্ষমতায় বা সিফাতে (গুণাবলীতে) আবদ্ধ করে রাখতে। এভাবে সে নিজেই আল্লাহকে নিজের সৃষ্ট বস্তুর সমস্তরে নামিয়ে আনে।
আল্লাহর গুণাবলীকে আমরা দু’ভাগে বিভক্ত করতে পারি।
এক : ইতিবাচক (ثبوتیة)
দুই : নেতিবাচক (سلبیة)
অথবা
এক : সৌন্দর্যমন্ডিত ((جمالیة
দুই : মহিমামন্ডিত (جلالیة)
অতএব যদি কোন সিফাত বা গুণ ইতিবাচক হয় আর তা আল্লাহর সারসত্তার জন্যে শোভনীয় ও সৌন্দর্যময় বলে পরিগণিত হয় তা’হলে আমরা তাকে ‘জাতগত ইতিবাচক’ বা ‘সৌন্দর্যমন্ডিত’ গুণ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। তাই জ্ঞান,শক্তি ও হায়াত বা জীবন ইতিবাচক গুণের অন্তর্ভুক্ত যা তাঁর পবিত্র সারসত্তার পরিপূর্ণ অস্তিত্বের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে।
আর যখন কোন গুণ দ্বারা আল্লাহ্ থেকে ত্রুটি ও অপূর্ণাঙ্গতা এবং অন্য কিছুর প্রতি মুখোপেক্ষিতা দূরীকরণ বুঝানো হয় তখন সেই গুণকে নেতিবাচক (سلبیة) বা মহিমামন্ডিত (جلالیة) গুণ বলা হয়ে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ “দৈহিকসত্তা”,“স্থান দখল”,“স্থান পরিবর্তন” ও “গতিশীলতা”-র অস্বীকার তাঁর নেতিবাচক গুণাবলীর মধ্যে পরিগণিত।
হিজরী একাদশ শতকের প্রাজ্ঞ দার্শনিক এবং আক্বায়েদ শাস্ত্রের সুবিখ্যাত পন্ডিত সাদরুল আফাযিল মোল্লা সাদরা (রহঃ) উপরোক্ত দু’টি গুণ তথা সৌন্দর্যমন্ডিত গুণ ও মহিমামন্ডিত গুণের বিশ্লেষণ প্রদান করতে গিয়ে নিম্নের আয়াতটি উল্লেখ করেছেন।(আল-আসফার, খণ্ড ৬, পৃঃ-১১৮)
আল্লাহ্ কুরআনুল কারিমে এরশাদ করেছেন :
تَبَارَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِي الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
অর্থাৎ : তোমার প্রতিপালকের নাম মহান ও বরকতময়,যিনি মহিমান্বিত (ذِي الْجَلَالِ) এবং সম্মানিত (وَالْإِكْرَامِ)।(আর-রাহমান,আঃ নং-৭৮)
কোরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর গুণাবলী
আল্লাহ্ জ্ঞানী
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলেন :
(وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ)
অর্থাৎ : তাঁর (আল্লাহর) নিকট সমস্ত অদৃশ্য বস্তুর জ্ঞানভান্ডার সংরক্ষিত,তিনি ব্যতীত ঐ সব বস্তু সম্পর্কে অন্য কেউ অবহিত নন। ভূ-তলে ও সাগরে যা কিছু আছে সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ অবগত এবং (বৃক্ষ থেকে) এমন কোন পত্র পতিত হয় না যা আল্লাহর অজানা এবং পৃথিবীর অন্ধকার গর্ভে এমন কোন শষ্য কণা এবং শুষ্ক ও তরল পদার্থ নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে (তাঁর অনন্ত জ্ঞান ভান্ডারে) উল্লেখ করা হয়নি।(আল্ আন্আম,আঃ নং-৫৯)
আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে অনত্র,আরো বলেন :
(عَالِمِ الْغَيْبِ ۖ لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَلَا أَصْغَرُ مِن ذَٰلِكَ وَلَا أَكْبَرُ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ)
অর্থাৎ : সকল অদৃশ্য সম্পর্কে তিনি (আল্লাহ্) পরিজ্ঞাত,যমীন ও আসমান সমুহে এমন কোন বিন্দু কণা নেই,এমন কোন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বস্তু নেই যে তাঁর অসীম ও অনন্ত জ্ঞানে সংরক্ষিত হয়নি।(সাবা,আঃ নং-৩)
আল্লাহ্ ক্ষমতাবান :
পবিত্র আল্ কোরআনে উল্লেখ আছে :
(اللَّـهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّـهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ)
অর্থাৎ : আল্লাহ্ এমন এক সত্তা যিনি সাতটি আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং সেগুলোর ন্যায় আরো আসমান,যমীন থেকে তৈরী করেছেন। তিনি সাত আসমান ও যমীনের মধ্যে তাঁর বিধি-বিধান অবতীর্ণ করেন যেন সকলেই জানতে পারে যে,অবশ্যই আল্লাহ্ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান। (আত্ তালাক,আঃ নং-১২)
আল্লাহ্ চিরঞ্জীব
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ ঘোষণা করেন :
(وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ وَسَبِّحْ بِحَمْدِهِ ۚ وَكَفَىٰ بِهِ بِذُنُوبِ عِبَادِهِ خَبِيرًا)
অর্থাৎ : (হে রাসুল) তুমি চিরঞ্জীব খোদার উপর ভরসা কর এবং তাঁর প্রশংসাসহ গুণকীর্তন কর। (আল্ ফুরক্বান,আঃ নং-৫৮)
তিনি অনত্র আরো বলেন :
(اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ)
অর্থাৎ : আল্লাহ্ এমন এক সত্তা-যিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই,তিনি চিরঞ্জীব,চিরস্থায়ী। তাঁকে কখনো অলসতা ও নিদ্রা স্পর্শ করতে পারে না।(আল্ বাক্বারা,আঃ নং-২৫৫)
আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা
এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআন উল্লেখ করছে :
(وَاللَّـهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا ۚ إِنَّ اللَّـهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ)
অর্থাৎ : আল্লাহ্ তোমাদের সকল কথা-বার্তা শ্রবন করে থাকেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।(আল্ মুজাদিলাহ্,আঃ নং-১)
আল্লাহ্ প্রজ্ঞাবান
মহাগ্রন্থ আল্ কোরআনে আল্লাহ্ বলেন :
(وَاللَّـهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ)
অর্থাৎ : আল্লাহ্ জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাবান।(আন্ নিসা,আঃ নং-২৬)
আল্লাহ্ ন্যায়বিচারক :
পবিত্র আল্ কোরআনে আল্লাহ্ বলেন,
(شَهِدَ اللَّـهُ أَنَّهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ)
অর্থাৎ : আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে,তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই এবং ফেরেস্তা,জ্ঞানী ও বিদ্ব্যান ব্যক্তিগণও সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে,আল্লাহ্ ছাড়া এমন কোন ইলাহ্ নেই যিনি ন্যায়বিচার করে থাকেন।(আল্ ইমরান,আঃ নং-১৮)