মানুষ তার কর্মের ব্যাপারে স্বাধীন না পরাধীন
আল্লাহর জ্ঞানের পরিধি সর্বত্র বিস্তৃত। অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যত তার কাছে অর্থহীন। আল্লাহর জ্ঞান তার জাত-সত্তার সাথে সম্পৃক্ত তবে বহিরাগত কিছু নয়। তিনি জ্ঞান অর্জন করে জ্ঞানী হননি। যেমনি তাঁর জাত-সত্তার কোন সূচনা লগ্ন নেই,তেমনি তাঁর জ্ঞানের আদিকালও নিরূপন করা যায় না। কেননা,তিনি তো কোন বস্তুসর্বস্ব বা শারীরিক সত্তা নন। যখন জ্ঞানের কোন পরিভাষাও সৃষ্টি হয়নি তখনও তিনি ছিলেন সর্বজ্ঞানী। তিনি আদি-অন্ত সকল কিছু সম্পর্কে জ্ঞাত। সকল কিছুর জ্ঞান তার করায়ত্বে,জ্ঞানের সকল দিক তাঁর সামনেই উপস্থিত। তার জ্ঞান অনন্ত,নির্ভূল,কখনো তার জ্ঞান ভুলের শিকার হয় না। পূর্ব থেকেই সঠিক তথ্য তাঁর কাছে বিদ্যমান।
তবে আল্লাহর জ্ঞান মানব-স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না তাঁর জ্ঞান ও উপলদ্ধি ক্ষমতা। কাল ও সময় তারই সৃষ্টি,তাই তাঁর জ্ঞান কোন কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর জ্ঞানে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র বস্তু,প্রাণী,ঘটনা ও বিষয়ে কোন পার্থক্য নেই। আমাদের কর্ম-ক্রিয়ার সুক্ষ্মাতিসূক্ষ ব্যাপারও তাঁর গোচরীভূত। তাই বলে তার এ জ্ঞান মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বাধীনতাকে সীমিত করে না। আমরা আমাদের কর্ম-ক্ষমতায় সম্পূর্ণ স্বাধীন। সুতরাং সর্ববিষয়ে আল্লাহর জ্ঞানের কারণে মানুষের ভাল-মন্দ বিবেচনা ও নির্বাচনের স্বাধীনতা কোন ক্রমে খর্ব হয়ে যায় নি।
প্রশ্ন হতে পারে,‘যদি আল্লাহ্ পূর্ব থেকেই সমস্ত ব্যাপারে অবগত থাকেন তাহলে মানুষের মন্দ কাজের ব্যাপারেও নিশ্চয়ই তার জ্ঞান আছে। এমতাবস্থায় একজন অসৎ ব্যক্তি কোন অন্যায় ও অনৈতিক কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায়,স্বাধীনভাবে সে কাজটি আঞ্জাম দিতে পারে না। কেননা,আল্লাহ যা জানেন তা তো কোনক্রমে ভুল হতে পারে না। আল্লাহ যদি পূর্ব থেকেই কোন হত্যাকারীর ব্যাপারে তার অন্যায় হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে সম্যক অবগত থাকেন আর যদি সেই অন্যায় কার্যটি সম্পাদন করা না হয় তা’হলে তো আল্লাহর জ্ঞান ভুল প্রমাণিত হয়ে যাবে। তাই,আল্লাহর জ্ঞান সঠিক প্রমাণ করার জন্যে অবশ্যই উক্ত হত্যাকারীকে এ হত্যাকান্ড ঘটাতে হবে। অতএব এ অন্যায় কাজটি সেই হত্যাকারী লোকটি বাধ্য হয়েই করলো না? কেননা এক্ষেত্রে সে কাজটি করা ছাড়া হত্যাকারী ব্যক্তিটির অন্য কোন উপায় ছিল না। সুতরাং মানুষ যা কিছু করে তা আল্লাহ্-ই করিয়ে থাকেন। মানুষ স্বাধীনভাবে কোন কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম নয়’’।
নিন্মলিখিত উপায়ে অত্যন্ত সহজভাবে আমরা উক্ত প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারি :
প্রথমত : আল্লাহ কোনক্রমে অন্যায় কাজ করতে পারেন না। কেননা,অন্যায় ও অসৎ কাজ সেই করেন যিনি এসব কাজের মাধ্যমে হয়ত নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চান নতুবা যিনি একজন ত্রুটিপূর্ণ সত্তা,তার দোষ-ত্রুটি ঢাকার জন্যে অন্যের উপর যুলুম-অত্যাচারের মত নিকৃষ্ট পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কিন্তু একজন অপরিহার্য,অমুখাপেক্ষী ও সুবিচারক সত্তার জন্যে এ ধরণের কল্পধারণা সম্পূর্ণ অশোভনীয়।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর জ্ঞান,মানুষের কাজ-কর্মের স্বাধীনতাকে সীমিত করে না। মানুষ তার স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনা ক্ষমতা দিয়ে ভাল অথবা মন্দ কাজের নির্বাচন করে থাকে। এক্ষেত্রে আল্লাহ্ মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি শুধু ভাল বা মন্দ কাজ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। কে কখন কি ভাবে একটা ভাল অথবা মন্দ কাজ আঞ্জাম দিবে এ ব্যাপারে তার অনন্ত জ্ঞান রয়েছে। আর এ সমস্ত কাজগুলো যে মানুষ তার স্বীয় স্বাধীনতা বলে সম্পাদন করবে -এ বিষয়েও তিনি সম্যক জ্ঞানের অধিকারী। কেননা,আল্লাহ অসীম জ্ঞানের অধিকারী,তার জ্ঞানের পরিধি নিরূপন করা অসম্ভব।
উদাহরণ স্বরূপ যদি কোন শিক্ষক তার ক্লশের কোন ছাত্রের ব্যাপারে বলেন যে,‘ঐ ছাত্রটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করবে’। তাহলে শিক্ষক কি ঐ ছাত্রের লেখাপড়া ও তার প্রথম স্থান অধিকারের ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করলেন? কক্ষনো না। আল্লাহর জ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই একই বক্তব্য প্রযোজ্য। তিনি জানেন,তাই বলে মানুষের কাজ-কর্মের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করেন না মোটেও। আর যদি আল্লাহ-ই মানুষকে দিয়ে মন্দ ও অন্যায় কাজ করাবেন,সমাজে অবিচারের প্রসার ঘটাবেন তাহলে তিনি কোরআন পাকে কি করে মানবজাতিকে সৎ ও হেদায়েরেত পথে আহ্বান জানাতে পারেন? যে নিজেই অন্যায় কার্য করেন সে কিছুতেই অপর লোকদের ন্যায় পথে আহ্বান জানাতে পারেন না।
অপরদিকে,পরকালে বিশ্বাসীদের জন্যে এ ধরণের অমুলক প্রশ্ন অত্যন্ত বিষ্ময়কর। কেননা,আমরা আমাদের বিবেক প্রসূত দলীলপ্রমাণের সাহায্যে এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য যে,মানুষকে তার ভাল-মন্দ কাজের হিসেব দিতে হবে পরকালে। আর যদি ইহজগতে কোন মানুষের অসৎ কাজের জন্যে আল্লাহ্ দায়ী হয়ে থাকেন তা’হলে তিনি কিভাবে সে ব্যক্তির অন্যায় কাজের শাস্তি দিবেন? কেননা,মন্দ কাজটি তো ঐ ব্যক্তি করেনি বরং আল্লাহ্-ই করিয়েছেন। তারপরও যদি বান্দাকেই শাস্তি ভোগ করতে হয় তাহলে বলতে হয় এক্ষেত্রে আল্লাহ্ মানুষের উপর অবিচার করেছেন (নাঊযুবিল্লাহ্)। সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ বিবেক এধরনের আবিচার আল্লাহর উপর কখনো আরোপ করতে পারে না।
পবিত্র কোরআনের পরিভাষায় :
(قُلْ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّـهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ)
অর্থাৎ : যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় তারা কখনো সফলকাম হতে পারে না।(ইউনুস,আঃ নং ৬৯)
তাই এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাস,‘কোন কিছু থেকে কোন কিছু হয় না,যা কিছু হয় আল্লাহ্ থেকে হয়’। মানুষকে সত্য পথে দিক নির্দেশনার পরিবর্তে ভ্রান্ত পথে ধাবিত করে অনায়াসে। যারা এ ধরণের ভ্রান্ত আক্বিদায় বিশ্বাসী তারা মুসলমান বলে দাবী করলেও হয় তারা পরকালে অবিশ্বাসী নতুবা আল্লাহকে আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে নিজেদের ঈমানের অপরিপক্কতারই সাক্ষ্য দিতে সচেষ্ট। তারা ঈমানের বেশভূষা পরিধান করলেও প্রকৃত ঈমানের স্বাধ আস্বাদন করতে পারেননি।
সুতরাং যেহেতু মন্দ কাজের জন্য মানুষ স্বয়ং দায়ী তাই ঐ মন্দ কাজের শাস্তিও তাকেই ভোগ করতে হবে। আল্লাহ্ মানুষের হেদায়াতের জন্যে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। মানুষ তার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বীয় স্বাধীনতা ও বিবেক-বিবেচনা প্রয়োগে সম্পূর্ণ সক্ষম।
সর্বজনবিদিত একটি সত্য কথা হল : “আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন”-এর দু’টি অর্থ হতে পারে।
একটি হলো : “আল্লাহ্ যে কাজই আঞ্জাম দিয়ে থাকেন তাই ভাল কাজ হিসেবে পরিগণিত,যদিওবা সে কাজটি বিবেকপ্রসূত মন্দকাজ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।”
অপরটি হলো : “আল্লাহ্ কোন মন্দকাজ আঞ্জাম দিতে পারেন না। তিনি শুধু ভাল কাজই করেন।”
এখান থেকেই ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় দু’টি মতবাদ তৈরী হয়ে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে,যা একটি অপরটির বিপরীত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই যে,আল্লাহর সকল কাজই ভাল কাজ। কিন্তু মতভেদ হচ্ছে এ নিয়ে যে,“মানুষ ধর্মের বিধিনিষেধের সাহায্য ব্যতিরেকে স্বাধীন বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ভাল-মন্দের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা এবং এর পার্থক্য নিরূপণ করতে কি সক্ষম?
এটা স্মরণ রাখা দরকার যে আল্লাহর সকল কাজ তার মহাপ্রজ্ঞা ক্ষমতা দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই আল্লাহর কোন কাজই অকারণে সংঘটিত হয় না,প্রতিটি কাজের পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ নির্ধারিত থাকে। আমাদের বিবেক ও বুদ্ধি ক্ষমতাও যেহেতু মহান আল্লাহর সৃষ্টি,তাই এর স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে ভাল-মন্দ সম্পর্কে স্বাধীনভাবে বিচার ক্ষমতার প্রয়োগে যথার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।
এর বিপরীতে আশআরী মতাবলম্বীরা বিবেক-বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে মানুষের জন্যে ভাল-মন্দের জ্ঞানকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা বলেন,ধর্মীয় বিধি-বিধান আগমনের পূর্বে মানুষ কোন বিষয়ের ভাল-মন্দ ধারণা অর্জন করতে পারে না। ধর্ম যা আদেশ করেছে তাই হচ্ছে ভাল কাজ আর ধর্মের সকল নিষিদ্ধ কাজই হচ্ছে মন্দ কাজ। মুলতঃ ভাল-মন্দের ধারণা ধর্মীয় বিধি-বিধান থেকেই প্রসূত।
প্রকৃত পক্ষে যদি আমরা ভাল মন্দের ধারণাকে ধর্মের বিধি-বিধান ও নিয়মাবলীর মাধ্যমে অক্টোপাসের মত আবদ্ধ করে ফেলি তাহলে প্রশ্ন হতে পারে যেখানে ধর্মের কোন আলো-বাতাস পৌঁছেনি,যেখানকার জনগণ ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কোন ছোঁয়া পায়নি তারা কি ভাল-মন্দ অনুধাবনের ক্ষমতা রাখে না? তারা কি ভাল কাজ করা আর মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার অধিকার রাখে না? এসব প্রশ্নের উত্তরে যদি আশআরীগণ বলেন,তাদের ভাল-মন্দ অনুধাবন করার ক্ষমতা নেই তাহলে তারা বাস্তবতাকেই উপেক্ষা করেছেন। আর যদি বলেন,তারা ভাল-মন্দের কোন কাজ নির্বাচন করার অধিকার রাখেন না তাহলে বলতে হবে তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত স্বাধীনতার উপর খবরদারী করেছেন। আর আশআরীদের মতে এ ধরনের জনগোষ্ঠির হিসাব-নিকাশ হবে কিভাবে পরকালে,কিয়ামতের ময়দানে? আশআরী মতাবলম্বীরা এ সব প্রশ্নের উত্তর দানে সম্পূর্ণ অপারগ।
মূলত : আল্লাহ্ সকল মানুষকে সমানভাবে ভাল-মন্দের বিচার ক্ষমতা দান করেছেন। যেখানে ধর্মের বিধি-বিধান অবতীর্ণ হয়নি অথবা পৌঁছেনি তাদের হিসাব-নিকাশ তাদের বিবেকের কাছে থেকেই নেয়া হবে কিয়ামতের দিবসে। এ ব্যাপারে আবুল হাসান মুসা বিন জা’ফার (তাঁর উপর আল্লাহর অফুরন্ত শান্তি বর্ষিত হোক) ---- এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন :
“হে হিশাম,নিশ্চয়ই মানুষের জন্যে আল্লাহর দুটি হুজ্জাত বা অকাট্য দলিল রয়েছে। একটি হচ্ছে জাহেরী বা প্রকাশ্য হুজ্জাত অপরটি বাতেনী বা অপ্রকাশ্য হুজ্জাত। জাহেরী হুজ্জাত হচ্ছে রাসুল,আম্বীয়া,ও ইমামগণ আর বাতেনী হুজ্জাত হচ্ছে আক্বাল বা বিচার বুদ্ধি।”(উসুলে কাফি,খণ্ড- ১,পৃষ্ঠা- ৬০,কিতাব আল্ আকল ওয়াল জাহল,হাদিস নং- ১২)
প্রকাশ্য হুজ্জাত যেমনিভাবে মানুষকে ভাল কাজের দিকে দেহায়েত করেন তেমনি অপ্রকাশ্য তথা গুপ্ত হুজ্জাতও মানবজাতিকে সৎ ও ন্যায়ের দিকে পথ নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
ভাল কাজের কতগুলো উদাহরণ হচ্ছে : সুবিচার করা,ন্যায্য অধিকার দান ইত্যাদি। আর মন্দ কাজ যেমনঃ অবিচার করা,অন্যায়ভাবে অধিকার হরণ ইত্যাদি। ভাল কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভাল আর মন্দ তার নিন্দনীয় কাজের জন্যে মন্দ। ধর্মীয় বিধি-বিধান এসে ভাল কাজকে ভাল করতে পারে না,বরং পূর্বে থেকেই ভাল। সকল ভাল কাজই ধর্মের অনুকূলে। অপরদিকে মন্দ কাজ শুধু শরিয়তের আইন প্রণয়নের কারণে তা মন্দ হয়ে যায় না,বরং পূর্বে থেকেই আপন বৈশিষ্ট্যবলে মন্দ কাজ হিসেবে পরিগণিত। ধর্মীয় অনুশাসন কখনো ভাল কাজকে মন্দ আর মন্দ কাজকে ভাল বলে ঘোষণা দিতে পারে না। কেননা বিবেক বিরোধী কোন কাজই ধর্মীয় নীতিমালায় স্থান পায় না। আল্লাহ্ স্বয়ং সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও মহা-বিবেকবান। মানুষের বিবেকবুদ্ধিও তারই সৃষ্টি। তাই বুদ্ধিবৃত্তি নিষ্কুলুষ ভাবে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম।
স্মরণীয় যে,আমাদের ভাল-মন্দের আলোচনা ঐ সব ক্রিয়া-কর্ম নিয়ে আবৃত যারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং জাতসত্তাগত দৃষ্টিকোন থেকে ভাল অথবা মন্দ। দৃষ্টান্তস্বরূপ সুবিচার অথবা অত্যাচার-যুলুম ইত্যাদি ধরা যেতে পারে। আমাদের আলোচনা এমন সব ভাল-মন্দের গুণগত মান নিয়ে ব্যাপৃত যেগুলো চিরন্তন ও শাশ্বত,যেগুলো ভাল-মন্দের আবরণ পরিধান করে স্থান কাল পাত্র ভেদে পরিবর্তনশীল নয়। এর বিপরীতে এমন সব ভাল বা মন্দ কাজ পৃথিবীতে বিদ্যমান যা ভালমন্দের আবরণে নিজেকে উপস্থাপন এবং বিভিন্ন সময়ে বা ক্ষেত্রে আবরণ পরিবর্তন করে থাকে। যেমনঃ সত্যবাদীতা,মিথ্যা বলা,অথবা সম্মান বা অসম্মান করা। এটা কখনো কেউ ব্যক্ত করতে পারবে না যে,সব সময় সত্য কথা বলা ভাল কাজ। কখনো সত্য কথা বলা একটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। যে সত্য কথা বলার কারণে কোন মানুষ বা সমাজের ক্ষতি হতে পারে তা কখনো বিবেকবান মানুষের কাছে ভাল বলে গণ্য হতে পারে না। তদ্রূপ মিথ্যা সব সময় মন্দ কাজ বলে পরিগণিত নয়। বরং কাউকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে মিথ্যা বলাটা একটা ভাল কাজ বলে পরিগণিত হতে পারে। একইরকমভাবে সম্মান করা সর্বদা সর্বস্থানে ভাল কাজ হতে পারে না। বরং কোন অত্যাচারী শাসককে সম্মান প্রদর্শন করা একটা অমার্জনীয় অপরাধ।
আবার এমন কতগুলো ভাল বা মন্দ কাজ বিদ্যমান যে,সেগুলো যে পাত্রে ধারণ করা হয় সে পাত্রের আকার ধারণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বেত্রাঘাত করা। যখন কাউকে আদব শিক্ষা দেয়ার জন্যে বেত্রাঘাত করা হয় তখন এ কাজটি একটি ভাল কাজ হিসেবে গণ্য। আবার যখন কাউকে অত্যাচার ও বিরক্ত করার জন্যে বেত্রাঘাত করা হয় তখন এ কাজটি একটি অন্যায় কাজ বলে পরিগণিত হয়।
যারা বিশ্বাস করেন,‘মানুষের সকল ভাল-মন্দ কাজের মূলে আল্লাহর শক্তিমত্তা কাজ করছে এবং সকল কিছুর স্রষ্টাও তিনি’-তারা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয় পেশ করে থাকেন। আল্লাহ্ বলেন,
)إِنَّ اللَّـهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ(
অর্থাৎ,নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছুর উপর শক্তিমান।(আল বাকারা,আ : নং ১০৯)
তিনি আরো বলেন,
(هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا)
অর্থাৎ,তিনি আল্লাহ্,যিনি তোমাদের জন্যে যমিনের বুকে সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।(আল বাকারা,আ : নং ২৯)
তারা উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে ব্যাখ্যায় মানুষের সকল মন্দ বা অমঙ্গল কাজগুলোকেও আল্লাহর কাজ বলে চালিয়ে দিতে চান। তারা এ ধরনের আয়াতের অর্থ সমুন্নত রাখতে গিয়ে আল্লাহর ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে পরকালের হিসাব নিকাশকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছেন। কেননা,যে আল্লাহ্ নিজে মন্দ বা অমঙ্গল কাজ করেন সে আল্লাহ্ কি করে মানুষের মন্দ কাজের বিচার করবেন? আর যদি মানুষের মন্দ কাজের জন্যে তিনি নিজেই দায়ী হন তাহলে তার মন্দ কাজের জন্যে তিনি মানুষকে কি করে শাস্তি প্রদান করতে পারেন? আর এভাবেই পরকালের বিচার দিবসে হিসাব নিকাশ অর্থহীন হয়ে পড়বে। আশআরী মতাবলম্বী ব্যক্তিবর্গ এ ধরণের ভিত্তিহীন ও পক্ষপাতিত্ব বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামকে বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তি-বিরোধী একটা মতবাদে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন।
অপরদিকে,মু’তাযিলা অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন,মানুষ সম্পূর্ণ ও নিরংকুশ স্বাধীন। আল্লাহ্ মানুষকে স্বাধীনতা প্রদান করে ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ ভাল-মন্দ যা কিছু ইচ্ছে স্বাধীনভাবে তা আঞ্জাম দিতে সক্ষম। এতে আল্লাহর কোন হস্তক্ষেপ নেই। আল্লাহ্ শুধু বসে তামাশা দেখছেন,মানুষ কি করছে। আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করে সকল কিছুর দায়িত্ব তার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তারা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে আল্লাহর সুবিচার ও প্রজ্ঞার বিষয়টি উপস্থাপন করে থাকেন। মু’তাযিলিরা নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ের ন্যায় কোরআনের যতস্থানে আল্লাহর ন্যায়বিচার,অন্যায় কার্য পরিহার ও তার প্রজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোকে তাদের বক্তব্যের সমর্থনে পেশ করে থাকেন।
এক : . (إِنَّ اللَّـهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ)
অর্থাৎ,নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞাবান।(আত তাওবা,আয়াত নং ২৮)
দুই : (إِنَّ اللَّـهَ لَا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَـٰكِنَّ النَّاسَ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ)
অর্থাৎ,নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের উপর কোন প্রকার যুলুম-অত্যাচার করেন না বরং মানুষই নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করে থাকে।(ইউনুস,আয়াত নং ৪৪)
তারা বলে,যদি আল্লাহ কোন মন্দ কাজ করেন অথবা মন্দ কাজে মানুষের সাথে অংশ গ্রহণ করেন তাহলে তিনি সুবিচারকের মহান পদ থেকে অপসারিত হয়ে যাবেন। কিন্তু কোরআন ও বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল প্রমাণের মাধ্যমে সুপ্রমাণিত যে আল্লাহ একজন ন্যায় বিচারক ও আদেল। তারা আল্লাহর ন্যায়বিচারের গুণকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে আল্লাহর শক্তিমত্তাকে সীমিত করে ফেলেছেন যা আশআরী চিন্তাভাবনার চেয়েও অত্যন্ত বিপদজনক। এটা নির্ঘাত সত্য যে,বিশ্বজগতের সকল কিছু আল্লাহ্ তার স্বীয় ক্বুদরতে সৃষ্টি করেছেন। কোন কিছুই তাঁর শক্তিমত্তার বাইরে নয়। সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনি। কিন্তু মানুষের কর্মকান্ড ও অন্যান্য প্রাণীদের কর্ম-ধারা একই রকম নয়। সৃষ্টি জগতের সকল কিছুই আল্লাহ্ প্রদত্ত নিয়ম-নীতি মোতাবেক কার্য সম্পাদন করে থাকে,এমন কি মানবজাতিও। আকাশ-বাতাস,পাহাড় পর্বত,গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সকল সৃষ্ট বস্তু আল্লাহর নির্দেশের অনুগত। এক্ষেত্রে মানুষও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মানুষের কর্ম-ধারার সাথে অন্যান্য সৃষ্টির কর্ম-পদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে। অনেকে ভুলবশতঃ সবকিছুকে একই পদ্ধতি ও নিয়ম-ধারার মধ্যে সংমিশ্রণ করে অন্যান্য সৃষ্টি বস্তুসমূহের সাথে মানুষের তুলনা করে থাকেন। ফলে আল্ কোরআনে যেখানে বলা হয়েছে,‘আল্লাহ সকল কিছুকে সৃষ্টি করেছেন’। অথবা ‘আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান’। সেখানে তারা এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্পষ্ট বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে গেছেন। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সকল সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচেছ,‘কোন রকম বিবেক-বুদ্ধি ছাড়াই নির্দেশ মেনে চলতে হবে’। আর মানবজাতীর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে : ‘সকল কাজ-কর্ম বিবেকের বিশ্লেষণের মাপকাঠিতে সম্পন্ন করতে হবে’। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও আল্লাহর নির্দেশের অনুসরণ করে চলেছে মানবকুল। তবে যেহেতু সে ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা রাখে এবং সে অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে থাকে,তাই তার কর্মের ফলাফলও তাকেই ভোগ করতে হবে।
পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে,আশআরী ও তার অনুসারীদের ন্যায় মানুষকে তার ক্রিয়া-কর্মে পরাধীন মনে করা যেমনি যথার্থ বলে পরিগণিত হতে পারে না তেমনি মু’তাযিলীদের মত আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রভাবকে সীমাবদ্ধ করাও অন্যায় ও অমার্জনীয় অপরাধ বলে পরিগণিত।
এক দিকে আশআরীগণ মানুষকে এমনভাবে খাঁচাবদ্ধ করে ফেলেছে যে,তাদের মতে মানুষ স্বেচ্ছায় কোন কাজই আঞ্জাম দিতে সক্ষম নয়। পক্ষান্তরে মু’তাযিলীরা মানুষকে এমনভাবে স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষমতা প্রদান করেছে যে তাদের বক্তব্য মতে আল্লাহ্ সকল ক্ষমতা মানুষের উপর অর্পন করে তিনি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এ উভয় মতামত-ই বিভ্রান্তির শিকার।
উপরোক্ত দু’টি মতামতের মাঝামাঝি আরেকটি মতামত বিদ্যমান যা সত্যের মাপকাঁঠিতে সঠিক ও যথার্থ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে বুদ্ধিমান ও চিন্তাবিদদের মাঝে। তা’হলো একদিকে আমরা বলতে পারি মানুষের কর্ম ক্ষমতার পেছনে মূল শক্তিমত্তা হিসেবে আল্লাহ্-ই কাজ করেন। কেননা আল্লাহ্-ই তো আমাদেরকে শক্তি-সামর্থ্য,বিবেক-বুদ্ধি ও বিচার ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে আল্লাহকে মানুষের মন্দ কাজের জন্যে দায়ী করা যাবে না। কেননা মানুষ তার কাজ-কর্ম স্বেচ্ছায় আঞ্জাম দিয়ে থাকে,কারো চাপের মুখে নয়। তাই তো এ বিবেক ও বিচার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মানুষ,সমাজ,রাষ্ট্র নির্বিশেষে মানবতার জন্যে অসংখ্য খেদমত করে যেতে পারে আবার বিপরীতভাবে অপরিসীম অমঙ্গল অন্যায় ও অকল্যাণ কাজ আঞ্জাম দিয়ে যেতে পারে। তাই পূণ্য ও মন্দ উভয় প্রকার কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে পুরস্কার অথবা শাস্তি তাকেই ভোগ করতে হবে। আর এ ধরনের তৃতীয় একটি মধ্যপন্থী মতবাদের মাধ্যমেই পরকালে বিশ্বাস,আল্লাহর ন্যায় বিচার ও তার সর্বময় ক্ষমতার গুণাবলী স্ব-স্থানে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
এ সম্পর্কে নবী (সাঃ) বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ইমাম জা’ফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক বলেছেন,
‘‘বাধ্যবাধকতাও নয়,নিরংকুশ স্বাধীনতাও নয় বরং এ দু’টোর মাঝামাঝি একটি অবস্থা-ই হচেছ সঠিক।’’(উসূলে কফি, ১ম খণ্ড, পৃ:১৬০)