আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমায় ক্রন্দনের ভূমিকা
এরফান ও অধ্যাত্মবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম হোসাইনের জন্য শোক প্রকাশ ও ক্রন্দন-আহাজারিকে আল্লাহর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক পরিভ্রমণের (আল্লাহর দিকে যাত্রা) সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে
মনের দহন এবং ক্রন্দন : একজন আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে ঐকান্তিকতার সাথে ক্রন্দন ও অন্তর্জ্বালা প্রকাশ অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ এবং তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এরূপ অনুভূতি সৃষ্টিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করেন এবং সবসময় তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেন। যদি তিনি প্রকৃতই সেটা অর্জনে ব্যর্থ হন অর্থাৎ শোকে মুহ্যমান হয়ে অশ্রু না ঝরাতে পারেন,তবে অন্ততপক্ষে ঐকান্তিকতার সাথে কান্নার ভাব অর্জনের জন্য একাগ্রচিত্ত হন।
সর্বোপরি ইবাদতের পথপরিক্রমায় ইস্তিগ্ফারের (ক্ষমা প্রার্থনা) সময়ই হোক অথবা যে কোন অবস্থায়,ক্রন্দন ও দগ্ধ হৃদয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। কখনই এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয় এবং এর স্বরূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। হৃদয়ের দহন এবং ক্রন্দন ভালোবাসার কারণে হোক অথবা ভয়ে,ইস্তিগফারের অবস্থায় হোক অথবা কোরআন পড়া অথবা শোনার সময়,সিজদায় অথবা অন্য যে কোন অবস্থায় হোক,অবশ্যই তা গভীর অনুধাবন ও অন্তর্দৃষ্টি থেকে উৎপত্তি লাভ করে। যে উপলব্ধি করতে পারে সেই দগ্ধ হয় ও অশ্রু ঝরায় আর যে উপলব্ধি করতে পারে না সে দগ্ধও হয় না এবং অশ্রুও ঝরায় না।
সূরা বনি ইসরাঈলের ১০৭-১০৯ নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব,এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,যারা অনুধাবন করতে পারে তারা পবিত্র কোরআনের আয়াতের সামনে বিনয়ী ও নম্র হয় এবং ক্রন্দন করে :
)قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا (107) وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا (108) وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا(
“(হে নবী) তুমি বল,তোমরা একে (কোরআনকে) বিশ্বাস কর আর না-ই কর,নিশ্চয় যাদেরকে এর আগে (আসমানি কিতাবের) জ্ঞান দেয়া হয়েছে যখনই তাদের সামনে এটি পড়া হয় তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। তখন তারা বলে : ‘আমাদের প্রভু পূত-পবিত্র মহান,অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা পূর্ণ হবে।’ আর তারা ক্রন্দন করতে করতে নত মস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে; (মূলত এ কোরআন) তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি করে। ”
একজন নিষ্ঠাবান আধ্যাত্মিক সাধককে এই আয়াতগুলোর তাৎপর্য গভীরভাবে বোঝার উপদেশ দিচ্ছি; কারণ,এটা আল্লাহর মহা সত্যবাণী।
যে কোন সুগভীর জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত এবং শোনার সাথে সাথে এর সত্যতা ও যথার্থতা বুঝতে পারবে ও অন্তরে তা বিশ্বাস করবে। প্রভুর অঙ্গীকারসমূহকে সুনিশ্চিতভাবে দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারবে। ফলশ্রুতিতে তার বিনয়,নম্রতা ও ঈমান অনেক গুণে বৃদ্ধি পাবে। ঐশী উৎসাহ,উদ্দীপনা,আকুলতা এবং আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা তার সমগ্র অস্তিত্বকে ছেয়ে ফেলবে। তখন তার চেষ্টা ও সাধনা আরো গতিশীল ও পূর্ণতা লাভ করবে। দারিদ্র ও দুনিয়াবিমুখতার পথ বেছে নেবে,আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে ও দগ্ধ হৃদয়ে অশ্রু ঝরাবে। তার অন্তরের দহন ও নয়নের অশ্রু যেন আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের আশায় রয়েছে।
যে মহাসত্য ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারেনি সে যে নিজের জাহান্নাম নিজেই তৈরি করেছে-এবং তার মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছে-তা অনুভব করতে পারেনি। সে তার অন্তরের ওপর যে পর্দা পড়েছে এবং যা পড়ার কারণে সে বিভিন্ন রূপ বিপদে পতিত হচ্ছে তা বুঝতেই পারেনি।
বলে রাখা দরকার যে,উল্লিখিত আয়াতে যে জ্ঞান এবং সূক্ষ্ণ দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে-এবং ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের ক্রন্দনকারী হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে-তা শাস্ত্রীয় বা তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়; বরং অন্য এক জ্ঞান ও দর্শন। তা না হলে কত বিদ্বান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানী আছেন যাঁরা শাস্ত্রীয় এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী,কিন্তু তাঁদের মধ্যে এই বিশেষত্ব নেই।
সর্বাবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয়ের জ্বালা প্রকাশ এবং ক্রন্দন করা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী এবং আল্লাহর জ্ঞানে ধন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানীদের বিশেষত্ব। পবিত্র কোরআন এটাকে নবিগণের-যাঁরা সকল আধ্যাত্মিক সাধক এবং ঐশী জ্ঞানের অধিকারীর শিক্ষক-বিভিন্ন গুণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সূরা মারইয়ামে আল্লাহর মনোনীত কিছুসংখ্যক বান্দা ও নবীকে তাঁদের বৈশিষ্ট্যসহকারে স্মরণ করা হয়েছে। তাঁদের ব্যাপারে বলা হয়েছে :
)أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا(
‘এরা হচ্ছে আদমের বংশধর সেসব নবী যাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা অনুগ্রহ করেছেন এবং যাদের তিনি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছেন এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশধর,যাদেরকে আমি পথপ্রদর্শন করেছি এবং মনোনীত করেছি,যখনই তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তখন এরা ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়ত।’ (সূরা মারইয়াম : ৫৮)
)إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(
অর্থাৎ যখন তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহর তা‘আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় আল্লাহকে সিজদা করার জন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ত।
এই অংশটি (আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াতের সময়) তাঁদের বিনয় ও নম্রতার সাথে সিজদা করা এবং ক্রন্দনের সংবাদ দেয়। তাঁদের এই কান্না আল্লাহর ভালোবাসায় হোক আর তাঁর ভয়েই হোক।
এই আয়াতে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে রহস্যময় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত। আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহর নির্বাচিত একদল নবীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের ব্যাপারে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন,এরাই হলো তাঁরা যাঁদের সম্পর্কে পূর্বে (এ সূরায় উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে) বলা হয়েছে। এরাই তাঁরা আল্লাহ যাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন-
أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ অতঃপর আয়াতের শেষে
)إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(
এই বাক্যটি দ্বারা তাঁদের বিনয়ের সাথে মাথা নত করে অশ্রু ঝরানোকে আল্লাহর অনুগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি এ সূক্ষ্ম ও গূঢ় রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে যে,মহান আল্লাহ যাঁকেই বিনয় ও নম্রতার সাথে তাঁর সামনে মাথা নত করা এবং মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করেন তা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ,রহমত ও ফযিলত।
হে ভাই! মনের হাসি,দুঃখ ও কান্নার
প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা উৎসমূল,
জেনে রাখ তায়
এও জেনে রাখ,রয়েছে প্রতিটির স্বতন্ত্র ভাণ্ডার ও চাবি
রয়েছে যা এক মহা উন্মোচকের হাতের মুঠোয়(মাসনভী, পঞ্চম দফতর।)
হাফেজ বলেন :
ভোর রাতের এত বেদনা ও ক্রন্দন
সবই জানি তোমার থেকে হে পরমজন!
কোরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে-
)وَمَن يُؤْمِن بِاللَّـهِ يَهْدِ قَلْبَهُ(
যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে পথ দেখিয়ে দেন।
রাসূল (সা.)ও বলেছেন:
قلب المؤمن بین اصبعین من اصابع الرحمن
মুমিনের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে অবস্থান করছে। (বিহারুল আনওয়ার, ৭০তম খণ্ড , পৃষ্ঠা ৩৯)
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন :
ان القلوب بین اصبعین من اصابع الله,یقلبها كیف یشاء,ساعة كذا,وساعة كذا
নিশ্চয় অন্তরসমূহ আল্লাহর আঙ্গুলগুলোর দু’টির মাঝে রয়েছে; তিনি যেমনভাবে চান তা পরিবর্তন করেন,একেক সময় একেক রকম।(বিহারুল আনওয়ার, ৭০তম খণ্ড , পৃষ্ঠা ৩৯)
এই দুই রেওয়ায়াত থেকে প্রত্যেকে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী এ বিষয়টি বুঝতে পারে।
প্রথম রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে,ঐ ব্যক্তির অন্তর প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তা তাঁর রহমান নামের পূর্ণ অধীনে রয়েছে এবং এই নামের কিরণ ও তাজাল্লীর ছায়ায় প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ ঈমান আনয়নকারীদের অন্তরসমূহ তাদের যোগ্যতা এবং ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহর ‘রহমান’ নামের বিভিন্ন স্তরের প্রকাশের নিয়ন্ত্রণাধীন।
দ্বিতীয় রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে,অন্তরসমূহ-বিশ্বাসীদের অন্তর হোক বা যে কোন অন্তর-‘আল্লাহ’ নামের নিয়ন্ত্রণাধীন। আর এই পবিত্র ও বরকতময় নামের বিভিন্নরূপ প্রকাশ রয়েছে। তিনি তাঁর ইচ্ছামত প্রত্যেক হৃদয়কে এ নামের বিশেষ তাজাল্লি দ্বারা পরিচালিত করেন এবং ব্যক্তির প্রবণতা ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তার অবস্থার পরিবর্তন করেন,একেক সময় একেক রকম।
সালেক (আধ্যাত্মিক যাত্রী)-কে অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে ক্রন্দন করাটাকে তার বন্দেগির পথে সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে নিজের জন্য সুবর্ণ সুযোগ মনে করতে হবে। বিশেষ করে এই মাকামে (মাকামে ইস্তিগফারে) যা কিছু মনের দহন দ্বারা অর্জিত হয় তার কদর তারা ভালোভাবেই জানে। যখনই এমন তাওফিক লাভ হয় তখন ইস্তিগফারের সাথে আকুতি মিনতি এবং অনুনয় প্রার্থনাকে অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে হাতছাড়া করে না। সে সতর্ক থাকে যে,শত্রু যেন তাকে ধোঁকা দিতে না পারে এবং তার সম্মুখে যে রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে শয়তান সূক্ষ্ম চক্রান্ত দ্বারা সে পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে না পারে। সুতরাং অনুনয়-বিনয়,প্রার্থনা ও ইস্তিগফার কখনই বন্ধ করে না,নিজের এ অবস্থাকে বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং অন্য সময়ে তা হবে এমন মনে করে অমনোযোগী হয় না। কারণ,সে জানে যে,এই সৌভাগ্য এত সহজে অর্জন করা যায় না এবং এই সুযোগ সবসময় আসে না। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :
اذا اقشعر جلدک و دمعت عیناک، فدونک دونک، فقد قصد قصدک.
‘যখন তোমার দেহ আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং তোমার চোখ থেকে অশ্রু বর্ষিত হয়,তখন জেনো,তিনি তোমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন বলেই তুমি এমন অনুভূতির অধিকারী হয়েছ।’(উসূলে কাফি, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৮)
শোক ও কান্নার অন্য দিক : আরেফদের হৃদয়ের শোক এবং প্রেমাসক্ত ও ভীতদের কান্নার পর্দার একদিকে যেমন রয়েছে হৃদয়ের দগ্ধতা অন্যদিকে তেমনি রয়েছে স্বস্তি,আনন্দ,উপভোগ এবং মর্যাদার অনুভূতি।
এখন রাসূল (সা.) এবং ইমামদের বাণী থেকে এর অর্থ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
দগ্ধ হৃদয়,কান্না এবং মানসিক প্রশান্তি
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : ‘কিয়ামতের দিন প্রতিটি চক্ষু থেকেই অশ্রু ঝরবে,কিন্তু ঐসব চক্ষু ছাড়া যেসব চক্ষু আল্লাহর নিষেধসমূহকে পরিহার করে চলেছে এবং ঐ চক্ষু যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য জাগ্রত থেকেছে এবং ঐ চক্ষু যে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে।’(উসূলে কাফি, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৮)
এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে,পর্দার এ পাশে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী মুখটিই পর্দার ওপাশে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন প্রশান্ত এবং নিশ্চিন্ত রূপে প্রকাশিত হবে। কেননা,কিয়ামতের দিন পর্দার অন্তরালের গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ হওয়ার দিন। {যেদিন গোপন বিষয়সমূহ প্রকাশিত হবে (সূরা আ’লা : ৯)} ঐ দিন পর্দার আড়ালে থাকা সত্যই সামনে হাজির হবে।
দুঃখ,কান্না ও আনন্দ উপভোগ
রাসূল (সা.) বলেছেন : আল্লাহ্ তা‘আলা শোকাহত ও ব্যথিত হৃদয়কে ভালোবাসেন।(বিহারুল আনওয়ার, ৭৩ তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭)
আল্লাহর ভালোবাসার অর্থ বান্দাদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা। যার ফলে হাদীসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে,বান্দার হৃদয় যখন পর্দার এ পাশে শোক ও কান্নায় বিহ্বল তখন পর্দার অপর দিকে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
আর এই আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ উপভোগ করা যায়। ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন : ‘আল্লাহর নিকট রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনায় যে অশ্রুবিন্দু ঝরে তার চেয়ে অধিক প্রিয় কোন কিছু নেই।’(উসূলে কাফি, ২য় খণ্ড , কিতাবুদ দোয়া)
এটা এই অর্থে যে,বান্দা রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রু ঝরায় ও আকুতি প্রকাশ করে তা তাঁর নিকট খুবই প্রিয় অর্থাৎ এ দুঃখ ও কান্নার আড়ালে তার হৃদয় তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং সে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের আনন্দ উপভোগ করছে। পর্দার আড়ালের ঐশী আকর্ষণই আধ্যাত্মিকতার পথিককে সর্বক্ষণ আকৃষ্ট করে রেখেছে এবং এই আকর্ষণই এই জগতে শোক-দুঃখ ও অশ্রুর আকৃতিতে প্রকাশিত হয়। একদিকে মনের দুঃখ,পেরেশানি ও অশ্রু বিসর্জন অন্যদিকে মনের আনন্দ,পবিত্র পানীয়ের স্বাদ আস্বাদন এবং তাঁর দর্শনের আনন্দ উপভোগ। যদি কারো এপার ওপার দু’পারে কী ঘটছে দেখার সুযোগ থাকে অর্থাৎ তিনি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছান,তখন এপারে ও ওপারে উভয় জগতের আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পারবেন। তিনি এক ব্যক্তিকে একই সময়ে পরস্পর বিপরীত দুই অবস্থায় দেখতে পাবেন।
এই দিকে (দুনিয়ায়) তাকে শোকাহত,অশ্রু বিসর্জনকারী ও আবেদন-নিবেদনকারী রূপে দেখতে পাবে। অন্যদিকে (আখেরাতে) পবিত্র পানীয় পানের আনন্দ,ঐশী দর্শনের স্বাদ আস্বাদনরত অবস্থায় দেখবে। এরূপ মর্যাদা আসলেই বিস্ময়কর যে,দুঃখের মাঝে আনন্দ,আনন্দের মাঝে দুঃখ,কান্নার মাঝে হাসি এবং হাসির মাঝে কান্না।
এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক যে,আমরা ধারণা করি এ বিশ্বজগতের প্রকৃত স্বরূপ,গভীর রহস্য এবং গোপনীয়তা সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও বুঝেছি। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কখনই এরূপ নয়। কারণ,সত্যের রূপকে যে দেখবে তার অবস্থা ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের মতো হবে,যাঁরা আশুরার রাতে ক্রন্দনের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছেন। আর এজন্যই নিজেদের সমগ্র সত্তাকে তাঁর পথে এভাবে বিসর্জন দিতে পেরেছেন।
শোককান্না এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ
ইমাম সাদিক (আ.) এক রেওয়ায়াতে আবি বাছিরকে দোয়া এবং কান্না সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন যেখানে তিনি তাঁর সম্মানিত পিতা ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর বান্দার মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অবস্থা হচ্ছে সিজদায় ক্রন্দনরত অবস্থা।’(উসূলে কাফি, ২য় খণ্ড, কিতাবুদ দোয়া, বাবুল বুকা)
এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে,এ কর্মের বাহ্যিক দিক হলো ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়া,কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ দিক হলো মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের আনন্দে আপ্লুত হওয়া।