হযরত আলী (আ.) এর অবিস্মরণীয় একটি ভাষণ : খোৎবাতুল ঘাররা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর,যিনি সবকিছু থেকে সুউচ্চ-মহান এবং তাঁর নেয়ামতের মাধ্যমে সৃষ্টির অতি নিকটবর্তী । তিনিই সকল পুরস্কার ও সম্মান দাতা এবং সকল দুর্যোগ ও দুঃখ-কষ্ট মোচনকারী। তাঁর লাগাতার রহমত ও প্রাচুর্যপূর্ণ নেয়ামতের জন্য আমি তাঁর প্রশংসা করি।
আমি তাঁর প্রতি ইমান আনি যেহেতু তিনিই আদি এবং তিনিই একমাত্র সত্য। আমি তার কাছে হেদায়েত যাচনা করি,যেহেতু তিনিই নিকটতম এবং তিনিই সৎপথ প্রদর্শক। আমি তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি,যেহেতু তিনিই সর্বশক্তিমান এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ পরাভূতকারী। আমি তাঁর ওপর নির্ভর করি,যেহেতু তিনিই অভাব মোচনকারী এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ পরিপোষক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনি তাঁকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর আদেশ পৃথিবীতে জারি করার জন্য ও ওজর খতম করার জন্য এবং অনন্ত শাস্তি সম্পর্কে সতর্কাদেশ প্রদান করার জন্য।
তাকওয়ার আদেশ
হে আল্লাহর বান্দাগণ,আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহকে ভয় করার জন্য,যিনি উপমা উপস্থাপন করেছেন এবং তোমাদের জীবনকে যিনি নির্ধারিত সময়ের গন্ডিতে বেঁধে দিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে পোষাকের আবরণ দিয়েছেন এবং তিনি তোমাদের জন্য জীবিকা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে তাঁর জ্ঞান দ্বারা ঘিরে রেখেছেন। তাঁর কাছে নির্ধারিত পুরস্কার রয়েছে। তিনি তোমাদেরকে বিস্তৃত রহমত ও অগণিত নেয়ামত দান করেছেন,সুদূর প্রসারি প্রমাণাদি দ্বারা তিনি তোমাদেরকে সতর্ক করেছেন এবং তিনি সংখ্যা দ্বারা তোমাদেরকে গণনা করেছেন। এ পরীক্ষাস্থলে ও শিক্ষণ ঘরে তিনি তোমাদের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
দুনিয়া সম্পর্কে সতর্কাদেশ
তোমরা এ দুনিয়াতে পরীক্ষার সম্মুখীন এবং দুনিয়া সম্বন্ধে তোমাদেরকে হিসাব-নিকাশ দিতে হবে। নিশ্চয়ই,এ দুনিয়া দূষিত ও ময়লাযুক্ত পানির স্থল এবং কর্দমযুক্ত পানীয়র উৎস। এর বহির্ভাগ হৃদয়কাড়া আকর্ষণীয় এবং অভ্যন্তরভাগ ধ্বংসাত্মক। এটা ছলনাময়ী প্রবঞ্চনা,ক্ষণস্থায়ী প্রতিবিম্ব এবং বাঁকা স্তম্ভ। দুনিয়ার অবজ্ঞাকারী যখন একে পছন্দ করতে শুরু করে এবং যে এর সাথে পরিচিত নয় সে যখন এতে সন্তোষ অনুভব করে তখন দুনিয়া তাকে ফাঁদে আবদ্ধ করে,তাকে এর তীরের লক্ষ্যস্থল করে নেয় এবং তার ঘাড়ে মৃত্যু-দড়ি বেঁধে তাকে সংকীর্ণ কবর ও ভীতিকর বাসস্থানে নিয়ে যায় এবং এভাবে তার কাজের বিনিময় প্রদান করে। এ অবস্থা বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। না মৃত্যু থেমে থাকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা থেকে,না জীবিতরা বিরত থাকে পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে।
মৃত্যু ও কেয়ামত
তারা একে অপরের সমকক্ষ হতে চেষ্টা করছে এবং দল বেঁধে চূড়ান্ত লক্ষ্য ও মৃত্যুর মিলনস্থলের দিকে এগিয়ে চলছে যে পর্যন্ত না সকল বিষয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে,দুনিয়া মরে যায় এবং কেয়ামত নিকটবর্তী হয়। আল্লাহ তাদেরকে কবরের কোণ থেকে,পাখীর বাসা থেকে,পশুর গর্ত থেকে এবং মৃত্যুর স্থল থেকে বের করে আনবেন। তারা তাঁর আদেশের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায় এবং দলের পর দল নিশ্চুপ হয়ে সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় তাদের জন্য নির্ধারিত চূড়ান্ত গন্তব্য স্থানের দিকে দৌড়ে যায়। তারা আল্লাহর দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকবে এবং যারা তাদেরকে ডাকবে তাদের সকলের ডাক শুনবে। তারা অসহায়ত্বের পোশাক পরবে এবং অমর্যাদা ও হীনাবস্থা তাদের ঢেকে রাখবে। এ সময় সকল তদবির শেষ হয়ে যাবে,সকল আকাঙ্খা তিরোহিত হয়ে যাবে,সকল চিত্ত শান্তভাবে ডুবে থাকবে,গলার স্বর নুয়ে পড়বে,ঘামে মুখমণ্ডল ভিজে যাবে,ভীতি বৃদ্ধি পাবে এবং শেষ বিচারের জন্য ও কর্মের বিনিময়ে পুরস্কার অথবা শাস্তির জন্য ঘোষকের বীজসম স্বরে কানে তালা লেগে যাবে।
জীবনের সীমাবদ্ধতা
আল্লাহ তার ক্ষমতার প্রমাণ হিসাবে মানুষ সৃষ্টি করেছেন,তীব্র অনুশোচনায় তাদের মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন এবং তাদেরকে কবরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। যেখানে তারা শুকনো খাবারের ছোট্ট টুকরার মতো হয়ে যায়। এরপর তাদের একজন একজন করে জীবন ফিরিয়ে দেয়া হবে,তাদের (কর্মের) বিনিময় দেয়া হবে এবং প্রত্যেকের আমলের হিসাব নিয়ে পৃথক পৃথক করে দেয়া হবে। তাদেরকে মুক্তিপথ অনুসন্ধানের সময় দেয়া হয়েছিল,সত্য পথ দেখানো হয়েছিল এবং বেঁচে থাকার ও নেয়ামত অনুসন্ধান করার হায়াত (সময়) দেয়া হয়েছিল। তাদের জন্য সংশয়ের অন্ধকার দূরীভূত করা হয়েছিল এবং জীবৎকালে প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল যাতে তারা বিচারের দিনের দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে,যাতে সুচিন্তিতভাবে উদ্দেশ্য স্থির করে অনুসন্ধান করতে পারে,যাতে সুফল সংগ্রহের প্রয়োজনীয় সময় পায় ও পরবর্তী বাসস্থানের জন্য রসদ সংগ্রহ করতে পারে।
তাকওয়া ব্যতীত সুখ নেই
এসব উপমা ও কার্যকর মৃদু ভর্ৎসনা কতই না উপযোগী হতো যদি তা পবিত্র হৃদয়,খোলা কান,দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গী ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা গৃহীত হতো। সেই ব্যক্তির মতো আল্লাহকে ভয় কর,যে সদোপদেশ শুনলে মাথা নত করে,পাপ করলে স্বীকার করে,ভয় অনুভব কিরলে পরহেজগারি করে,বুঝতে পারলে সৎ আমলের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়,বিশ্বাস করলে মুত্তাকি হয়,শিক্ষা গ্রহণ (দুনিয়া থেকে) করতে বললে শিক্ষা গ্রহণ করে,মন্দ কাজ না করতে বললে তা থেকে দূরে সরে থাকে,(কোন বিষয়ে) ধমক দিলে (তা থেকে) বিরত থাকে,(আল্লাহর) ডাকে সাড়া দিয়ে (তাঁর প্রতি) বুকে পড়ে,পুনরায় মন্দ কাজ করলে তওবা করে,অনুসরণ করলে পুরোপুরিভাবে অনুকরণ করে এবং (ন্যায় ও সত্য পথ) দেখানো হলে তা দেখে।
এ ধরনের লোক সত্যের সন্ধানে ব্যস্ত থাকে এবং (জাগতিক মন্দ থেকে) দৌড়ে পালিয়ে রক্ষা পায়। এরা নিজের জন্য রসদ (সৎ আমল) সংগ্রহ করে,নিজেদের বাতেনকে পবিত্র করে,পরকালের জন্য নির্মাণ করে এবং তাদের ভ্রমণ,অবস্থান ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে যাত্রা পথের রসদ সংগ্রহ করে। এরা (পরকালের) আবাস স্থলের জন্য পূর্বেই প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রেরণ করে। হে আল্লাহর বান্দাগণ,তিনি কেন তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার কারণ চিন্তা করে আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁকে ততটুকু ভয় কর যতটুক (ভয় করতে) তিনি তোমাদের বলেছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতির সত্যতার প্রতি আস্থা রেখে ও বিচার দিবসের ভয় পোষণ করে নিজেদেরকে তার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার যোগ্য করে গড়ে তোল ।
আল্লাহর নেয়ামত সম্পর্কে
তিনি তোমাদের জন্য কান তৈরি করে দিয়েছেন যাতে তোমরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধারণ করে রাখতে পার এবং অন্ধত্বের স্থলে দৃষ্টি দানের জন্য চক্ষু তৈরি করেছেন। তিনি ছোট ছোট অংশের সমাহার করে তোমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ তৈরি করেছেন। এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বক্রতা ও নির্মাণশৈলীর আকর বয়সের সাথে সুসমন্বিত। দেহ এদেরকে ধারণ করে রেখেছে ও হৃদপিণ্ড এদের খাদ্য যোগান দিতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। অন্যান্য বড় বড় নেয়ামত ছাড়াও তিনি তোমাদের দেহে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা তৈরি করেছেন। তিনি তোমাদের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি তোমাদের শিক্ষার জন্য অতীত জনগণের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করেছেন। সেসব লোক তাদের হিস্যা পূর্ণ উপভোগ করেছিল এবং তারা সম্পূর্ণ বাধা-বিঘ্নহীন ছিল। মৃত্যু তাদেরকে পরাভূত করেছিল এবং তাদের কামনা-বাসনা পূর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যুর হস্ত তাদেরকে আলাদা করে দিয়েছিল। শরীর সুস্থ থাকা কালে তারা নিজেদের রসদ সংগ্রহ করেনি এবং যৌবনে দ্বীধাগ্রস্থ অবস্থায় তারা শিক্ষা গ্রহণ করেনি।
এসব লোক কি তাদের যৌবনে পিঠ-নুজ্ব বৃদ্ধ বয়সের জন্য অপেক্ষা করেছে? তারা কি সুস্বাস্থ্যের সময় রোগ-ক্লিষ্ট অবস্থার জন্য অপেক্ষা করেছে? তারা কি জীবৎকালে মৃত্যু-মুহুর্তের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখেছে? যখন প্রস্থানের সময় নিকটবর্তী হয়ে গেল,তীব্র শোক-দুঃখ-বেদনা-ভোগান্তি ও মুখের লালা শুকানো শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় যাত্রাকাল হাতের কাছে এলো,বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের সাহায্য চাওয়ার সময় হলো এবং (যন্ত্রণায়) বিছানায় এপোশ ওপাশ করতে লাগলো,তখন কি নিকটজন মৃত্যুকে প্রতিহত করতে পেরেছিল? তখন কি শোক প্রকাশকারিনী মহিলারা তাদের কোন কল্যাণ করতে পেরেছিল? বরং তারা তাদেরকে সংকীর্ণ কবরে আটকে রেখে কবরস্থানের একাকীত্বে পরিত্যাগ করেছে।
সেখানে বিষাক্ত প্রাণী তাদের চামড়া ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলেছে এবং দুঃখ-দুর্দশায় তাদের সজীবতা বিনষ্ট হয়ে গেছে। ঝড় তাদের আলামত (হদিস) বিলুপ্ত করে দিয়েছে এবং দুর্যোগ তাদের চিহ্ন মুছে ফেলেছে। তাদের সতেজ শরীর ও হাড় পচে গলে গেছে। রূহ (আত্মা) সমূহ পাপের বোঝা বয়ে চলেছে এবং গায়েব সম্পর্কে তাদের একীণ হয়েছে। কিন্তু এখন আর কোন নেক আমল যোগ করা অথবা তওবা দ্বারা কোন বাদ আমল ক্ষালন করার সুযোগ নেই। তোমরা কি এসব মৃত লোকদের পিতা,পুত্র,ভ্রাতা ও আত্মীয়-স্বজন নও? তোমরা কি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে না? তোমরা কি তাদের পথে যাবে না? কিন্তু তোমাদের হৃদয়ে এখনো সাড়া জাগে নি। এখনো তোমরা হেদায়েত থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। এবং ভুল পথে চলছো। তোমরা এমনভাবে চলছো মনে হয় যেন এসব কথা তোমাদের বলা হচ্ছে না-অন্য কাউকে বলা হচ্ছে এবং তোমরা যেন মনে কর সঠিক পথ হচ্ছে দুনিয়ার সম্পদ স্তুপীকৃত করা।
বিচার দিনের প্রস্তুতি সম্পর্কে
এবং জেনে রাখো,তোমাদেরকে সিরাতের পথ অতিক্রম করতে হবে যেখানে পদক্ষেপ হবে কম্পমান,পা ফসকে পড়বে এবং প্রত্যেক পদক্ষেপে বিপদের আশঙ্কা থাকবে। হে আল্লাহর বান্দাগণ,সেসব জ্ঞানী লোকের মত আল্লাহকে ভয় কর যারা পরকালের চিন্তায় অন্য সব বিষয় পরিত্যাগ করেছে,আশা যাদেরকে দিবাভাগে পিপাসু রাখে,বর্জন যাদের আকাঙ্খাকে কুঁকড়ে দিয়েছে এবং আল্লাহর জেকের যাদের জিহবাকে সদা সঞ্চরমান করেছে। বিপদের আভাস দেখা দেয়ার আগেই তারা ভয়ে ভীত থাকে। তারা বন্ধুর পথ এড়িয়ে সুস্পষ্ট পথে চলে। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা সংক্ষিপ্ত পথ অনুসরণ করে,ধোকা তাদের চিন্তাকে বিকৃত করে না এবং (কোন বিষয়ের) অস্পষ্টতা তাদের চোখকে অন্ধ করে না।
তারা প্রশংসনীয়ভাবে এ পৃথিবীর পথ অতিক্রম করে যায়। তারা নেক আমল নিয়ে পরকালে পৌছায়। তারা (পাপের) ভয়ে (পূণ্যের দিকে) দ্রুত চলে। (জীবনের) স্বল্প সময়ে তারা দ্রুত অগ্রসর হয়। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মনিয়োগ করে এবং পাপ থেকে দৌড়ে পালায়। আজই তারা আগামীকালের জন্য মনোযোগী হয় এবং তাদের চিন্তা-চেতনায় ভবিষ্যৎ প্রতিভাত হয়। নিশ্চয়ই,বেহেশত প্রকৃষ্ট পুরস্কার এবং দোযখ শাস্তি ও ভোগান্তির স্থল। আল্লাহ্ প্রকৃষ্ট প্রতিশোধ গ্রহণকারী ও সাহায্যকারী এবং কুরআন প্রকৃষ্ট যুক্তি ও (বাতিলের সাথে) সংঘর্ষকারী।
শয়তান সম্পর্কে সতর্কোপদেশ
আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। আল্লাহকে ভয় করতে যিনি তাঁর সতর্কবাণী দ্বারা সকল ওজর দূরীভূত করেছেন এবং তাঁর প্রদর্শিত (সত্য) পথের সকল প্রমাণাদি (হেদায়েতের) পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে সেই শক্র সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন,যে গোপনভাবে হৃদয়ে প্রবেশ করে গোপনে কানের ভেতর কথা বলে এবং বিভ্রান্ত করে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। এ শক্র তোমাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়,ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী করে রাখে,খারাপ ও অন্যায় কাজকে আকর্ষণীয় করে দেখায় এবং জঘন্য পাপকেও সহজ করে দেখায়। যখন তার প্রতারণা ও অঙ্গীকার শেষ হয় তখন সে তার অনুচরদের যা ভাল বলেছিল,যা সহজ বলেছিল ও যা নিরাপদ বলেছিল তাতে দোষ খুঁজে বের করে ভয় দেখাতে শুরু করে ।
মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে
চিন্তা করো মানুষের কথা,যাদের আল্লাহ বেগে স্খলিত বীর্য থেকে অন্ধকার জরায়ুতে সৃষ্টি করেছেন। এরপর আকার বিহীন জমাট বাধা রক্ত,এরপর ভ্রণ,এরপর দুগ্ধপোষ্য শিশু,এরপর কিশোর এবং এরপর পূর্ণবয়স্ক যুবকে পরিণত করেছেন। তিনি তাকে স্মৃতিশক্তিসহ হৃদয়,কথা বলার জন্য জিহ্বা এবং দেখার জন্য চোখ দান করেছেন যাতে সে (চার পাশের যা কিছু আছে তা থেকে) শিক্ষা গ্রহণ করে ও বুঝতে পারে এবং (আল্লাহর) আদেশ পালন করে ও পাপ থেকে বিরত থাকে।
যখন সে স্বাভাবিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তার গঠন উন্নতি লাভ করে তখন সে আত্ম-গর্বে পতিত হয় ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। সে অসংখ্য আকাঙ্খায় জড়িয়ে পড়ে,দুনিয়ার আনন্দের জন্য তার কামনা-বাসনা পূরণে ডুবে যায় এবং তার (হীন প্রবৃত্তিসম্পন্ন) লক্ষ্য অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন সে কোন পাপকে ভয় করে না এবং কোন আশঙ্কাতেই ভীত হয় না। সে পাপে আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তার ক্ষণকালীন জীবন সে গোমরাহিতে অতিবাহিত করে। সে কোন পুরস্কার অর্জন করে না এবং কোন দায়িত্বও পরিপূর্ণ করে না। ভোগ-বিলাসের মধ্যেই জীবনঘাতী পীড়া তাকে হতবুদ্ধি ও পরাভূত করে। সে শোকে,দুঃখে,ব্যথা ও বেদনায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে। সহোদর ভাই,স্নেহশীল পিতা,বিলাপরত মায়ের এবং ক্রন্দনরত বোনের উপস্থিতিতে সে পাগল-করা অস্বস্তি,সংজ্ঞাহীনতা,চিৎকার,শ্বাসরুদ্ধকর ব্যথা ও মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরায় ।
তারপর তাকে কাফন পরিয়ে দেয়া হয় এবং সে সম্পূর্ণ শান্ত ও অন্যের অনুগত হয়ে যায়। তারপর তাকে কাঠের তক্তায় করে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় যেন সে দারুণভাবে দুর্দশাগ্রস্থ ও পীড়া কবলিত। যুবকেরা ও সাহায্যকারী ভ্রাতাগণ তাকে তার একাকীত্বের ঘরে নিয়ে যায় যেখানে সকল দর্শনার্থীর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর যারা সঙ্গে গিয়েছিলো ও যারা বিলাপ করেছিলো তারা চলে এলে ভয়ঙ্কর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও বিপজ্জনক পরীক্ষার জন্য তাকে কবরে বসানো হয়। সে স্থানের বড় দুর্যোগ হচ্ছে গরম পানি ও দোযখে প্রবেশ–অনন্ত আগুনের শিখা ও অগ্নিচ্ছটার প্রচণ্ডতা। এ অবস্থার কোন বিরাম নেই,আরামের জন্য কোন বিরতি নেই,হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা নেই,প্রবোধ দেয়ার জন্য মৃত্যু নেই এবং ব্যথা ভুলিয়ে দেয়ার জন্য নিদ্রা নেই। সে বরং প্রতি পলে অনুপলে মৃত্যুর মুহুর্ত কাটায়। আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি।
মৃতদের কাছ থেকে গ্রহণীয় শিক্ষা
হে আল্লাহর বান্দাগণ! তারা আজ কোথায় যারা দীর্ঘ বয়স পর্যন্ত বেঁচে থেকে আল্লাহর নেয়ামত ভোগ করেছিলো। তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো এবং তারা শিখেছিলো,তাদের সময় দেয়া হয়েছিলো এবং তারা বৃথা সময় নষ্ট করেছিলো,তাদেরকে সুস্থ রাখা হয়েছিলো এবং তারা কর্তব্য ভুলে গিয়েছিলো; তারা দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলো,জীবনযাপনের সুব্যবস্থা পেয়েছিলো,দুঃখময় শাস্তির বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিলো এবং বিপুল পুরস্কারের ওয়াদা করা হয়েছিলো। সুতরাং পাপ পরিত্যাগ কর,যা তোমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এবং অসৎ আমল পরিত্যাগ কর,যা আল্লাহর রোষে তোমাদের নিপতিত করে ।
হে লোকসকল,তোমাদের যাদের চোখ আছে,কান আছে,স্বাস্থ্য আছে ও সম্পদ আছে-তারা বলতো কোথাও কি কোন আত্মরক্ষার স্থল,কোন নিরাপদ আশ্রয়,আত্মগোপন করার স্থান বা পালিয়ে যাবার স্থান আছে? না,নাই। যদি না থাকে তবে “কিরূপে তোমরা মুখ ফেরাও” (কুরআন-৬ : ৯৫,১০ : ৩৪,৩৫ : ৩,৪০ : ৬২) এবং কোথায় তোমরা সরে যাচ্ছে? কী জিনিসের দ্বারা তোমরা প্রতারিত হয়েছো? নিশ্চয়ই,এ বিশাল পৃথিবীতে তোমাদের অংশ হলো শরীরের মাপে এক টুকরা জমি যেখানে তোমরা চির শায়িত থাকবে। কাজেই বর্তমানটা তোমাদের আমলের এক সুবর্ণ সুযোগ ।
হে আল্লাহর বান্দাগণ,যেহেতু তোমাদের ঘাড় ফাঁস মুক্ত,রূহ প্রতিবন্ধকহীন এবং যেহেতু এখনো হেদায়েতের পথ অন্বেষণ করার সময় আছে,তোমাদের শরীর সুস্থ আছে,তোমরা দলবদ্ধভাবে জড়ো হতে পার,তোমাদের সম্মুখে বাকি জীবন পড়ে আছে,তোমরা ইচ্ছা করলেই সৎ আমলের সুযোগ আছে,তওবা করার সুযোগ আছে এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থা আছে; সেহেতু তোমরা আল্লাহর রজ্জু ধরো। সংকীর্ণ অবস্থায় পতিত হবার আগে,দুঃখ-দূর্দশা অথবা ভয় ও দুর্বলতায় স্পর্শ করার আগে,অপেক্ষমান মৃত্যু হাজির হবার আগে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ কর্তৃক অবরুদ্ধ হবার আগে তোমরা সৎ আমল করো।
(জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত নাহজ আল বালাঘার ৮২তম খুৎবা থেকে সংকলিত)