কোরআন মজীদে মানব চরিত্রের নেতিবাচক দিকের উদ্ঘাটন
কোরআন মজীদ নিজেকে পরিচিত করিয়েছে تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ- “সকল কিছুর বর্ণনা” (সূরাহ্ আন্-নাহল্ : ৮৯) হিসেবে। এর মানে হচ্ছে, কোরআন মজীদ সকল জ্ঞানের আধার। আয়তনের বিচারে কোরআন মজীদ কোনো বিশাল গ্রন্থ নয়; নিজস্ব বিশেষ বাচনভঙ্গির সহায়তায় এতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সমস্ত জ্ঞান নিহিত রাখা হয়েছে। ফলে সাধারণভাবে আমরা যখন কোরআন পাঠ করি তখন এর অনেক জ্ঞানই আমাদের নযরে আসে না। কিন্তু এর জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে পরিচিত হবার উদ্দশ্যে অনুসন্ধিৎসা সহকারে বার বার অধ্যয়ন করলে এ থেকে নিত্য নতুন এমন সব জ্ঞানসম্পদ বেরিয়ে আসে যা যে কাউকে বিস্ময়ে হতবাক করার জন্য যথেষ্ট। কারণ, আমরা সাধারণতঃ আগে চিন্তাই করি নি যে, কোরআনে এমন বিষয় থাকতে পারে। এ সব জ্ঞানের মধ্যে একটি হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন ধরনের চরিত্র, মানসিকতা ও আচরণ উদ্ঘাটন।
কোরআন মজীদে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ধরনের মানব চরিত্র ও মানসিকতাকে তুলে ধরা হযেছে - যার সব কিছু নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একটি বিশালায়তন গ্রন্থ রচনা করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সূরাহ্ আল্-ফাতেহাহ্ চার ধরনের মানুষ সম্পর্কে আভাস দিয়েছে ও উল্লেখ করেছে : আল্লাহ্ তা‘আলার নে‘আমত প্রাপ্ত, আল্লাহর অসন্তুষ্টিভাজন, পথভ্রষ্ট এবং সঠিক পথের জন্য আবেদনকারী। সূরাহ্ আন্-নিসা’র ৬৯ নং আয়াতে চার ধরনের লোককে নে‘আমত প্রাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন নবী, ছ্বিদ্দীক্ব্, শাহীদ ও ছ্বালেহ্। অন্যদিকে সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর শুরুর দিকে হেদায়াতকামী লোকদেরকে জানানো হয়েছে যে, কেবল মুত্তাক্বী লোকেরাই কোরআন মজীদ থেকে হেদায়াত লাভ করবে; এরপর মুত্তাক্বীদের পরিচয় ও তাদের কয়েকটি ভাগ তুলে ধরা হয়েছে। [এ সম্পর্কে ‘কোরআনের দৃষ্টিতে : আহলে নাজাত্ কা’রা?’ শীর্ষক এক স্বতন্ত্র প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।] এখানে আমরা তাদের প্রতি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি দেবো কোরআন মজীদ যাদের বড় ধরনের নেতিবাচক চরিত্র, মানসিকতা ও আচরণ উদ্ঘাটন করেছে এবং তাদের সমালোচনা করেছে। (এখানে আমরা মানবিক দুর্বলতাজাত সাধারণ অপরাধ, যেমন : চুরি, ব্যভিচার, হত্যা ও অন্যান্য পাপকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করছি না।)
সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ২ থেকে ৫ নং আয়াতে মুত্তাক্বীদের কথা বলা হয়েছে এবং এরপর কাফের ও মুনাফিক্বদের কথা বলা হয়েছে।
সাধারণতঃ মনে করা হয় যে, কোরআন মজীদ বিশেষতঃ সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর শুরুর দিকে বিশ্বের সমস্ত মানুষকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছে, তা হচ্ছে : মুসলিম, কাফের ও মুনাফিক্ব্। এ ক্ষেত্রে “কাফের” শব্দটি “অমুসলিম”-এর সমার্থক। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। বরং এখানে “মুত্তাক্বী”, “কাফের” ও “মুনাফিক্ব্” - এই তিনটি ‘প্রধান ভাগের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যদিকে এখানে “কাফের” বলতে সমস্ত অমুসলিমকে বুঝানো হয় নি, বরং কেবল তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা জেনেবুঝে ইন্দ্রিয়াতীত অস্তিত্বে (গ্বায়ব্) ও আখেরাতে ঈমান আনতে অস্বীকার করে।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ ءَأَنْذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنْذِرْهُمْ لا يُؤْمِنُونَ. خَتَمَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ وَعَلَى أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ.
“(হে রাসূল!) নিঃসন্দেহে যারা কাফের হয়েছে (গ্বায়ব্ ও আখেরাতে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে) তাদেরকে আপনি সতর্ক করে থাকুন বা সতর্ক না করে থাকুন, তাদের জন্য তা সমান; তারা ঈমান আনয়ন করবে না। কারণ, আল্লাহ্ তাদের অন্তরসমূহের ওপর ও (অন্তরের) কর্ণসমূহের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তাদের (অন্তরের) দৃষ্টিশক্তির ওপর আবরণ রয়েছে। অতএব, তাদের জন্য রয়েছে বিরাট শাস্তি।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৬-৭)
এখানে যে, সমস্ত অমুসলিমকে বুঝানো হয় নি তা সুস্পষ্ট। কারণ, অমুসলিমদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান করা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তাই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগ থেকে শুরু করে সকল যুগেই অমুসলিমদেরকে ইসলামের দাও‘আত্ দেয়া হয়েছে এবং তাদের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তবে যে সব অমুসলিম সত্যকে গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত কেবল তারাই ইসলামের দাও‘আত্ সঠিকভাবে লাভ করলে তাতে সাড়া প্রদান করে এবং যুগে যুগে সাড়া দিয়েছে। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, “তারা ঈমান আনয়ন করবে না” কথাটি তাদের সম্পর্কে বলা হয় নি, বরং বিশেষ একটি গোষ্ঠী সম্বন্ধে বলা হয়েছে। বিশেষ করে الَّذِينَ كَفَرُوا (যারা প্রত্যাখ্যান করেছে/ অস্বীকৃতি জানিয়েছে) বলায় অর্থাৎ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা থেকে সুস্পষ্ট যে, এরা জন্মগত অমুসলিম হওয়ার কারণে নয়, বরং জেনেবুঝে ইন্দ্রিয়াতীত মহাসত্তায় ও পরকালে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, যুগে যুগে দেখা গেছে, শিক্ষিত ও তথাকথিত জ্ঞানী লোকেরা খুব কমই ইসলাম গ্রহণ করেছে, বরং অশিক্ষিত, কম শিক্ষিত ও অ-পণ্ডিত লোকেরাই বেশী ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ কারণে তথাকথিত পণ্ডিত কাফেররা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে উপহাস-বিদ্রুপও করে থাকে। এটা একটা প্রণিধানযোগ্য বিষয় বটে। প্রকৃত ব্যাপার হলো অশিক্ষিত ও কম শিক্ষিত লোকেরা হলো অনাবাদী উর্বর জমির ন্যায় যাতে সহজেই আগাছা উৎপাটন করে উত্তম ফসল ফলানো যায়। তাদের মধ্যে সত্যকে অনুধাবন ও গ্রহণ করার ক্ষমতা বহাল আছে বিধায় তারা খুব সহজেই সত্যকে গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে ভ্রান্ত জ্ঞানের অধিকারী পণ্ডিতরা হচ্ছে বিশালাকারের বিষবৃক্ষের ন্যায় - যা তার জমিকেও বিষাক্ত করে ফেলে - যা উৎপাটন করে সেখানে উত্তম ফসল ফলানো খুবই কঠিন, বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, যখন বলা হয় যে, এ পরিবর্তনশীল জীবন ও জগতের পিছনে একজন বস্তু-উর্ধ পরম জ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান স্রষ্টা না থাকলে কোনো কিছু অস্তিত্ব লাভ করতো না এবং এরূপ সত্তা একাধিক হলে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেতো, তখন একজন সরলমনা অশিক্ষিত ও কমশিক্ষিত লোক সহজেই তার সত্যতা অনুধাবন করতে পারে। কিন্তু যে পণ্ডিতের চিন্তাশক্তির ওপরে ভ্রান্ত জ্ঞানের আবরণ পড়েছে তার পক্ষে এটা গ্রহণ করা কঠিন। কারণ, এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান এতো সহজ এটা তাদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
বস্তুতঃ অজ্ঞতা হচ্ছে এক ধরনের পর্দা, তবে তা সঠিক জ্ঞানের অস্ত্রের সাহায্যে সহজেই ছিন্ন করা যায়। কিন্তু ভ্রান্ত জ্ঞানের পর্দা খুবই পুরু এবং তা ছিন্ন করা খুবই কঠিন; সাধারণতঃ ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। তাই বলতে হয় : কুশিক্ষার চেয়ে অশিক্ষা ভালো।
এই জ্ঞানের পর্দার বিষয়টিও কোরআন মজীদে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلا تَذَكَّرُونَ.
“(হে রাসূল!) আপনি কি তাকে দেখেছেন যে স্বীয় প্রবৃত্তিকে তার ইলাহ্ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং (এ কারণে) আল্লাহ্ তাকে জ্ঞানের ওপরে পথভ্রষ্ট করেছেন, আর তার (অন্তরের) শ্রবণশক্তির ওপর ও তার অন্তঃকরণের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন ও তার (অন্তরের) দর্শনশক্তির ওপর আবরণ তৈরী করে দিয়েছেন? অতঃপর আল্লাহর পরে আর কে তাকে পথপ্রদর্শন করবে? অতঃপর তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?” (সূরাহ্ আল্-জাছীয়াহ্ : ২৩)
এখানে সুস্পষ্ট যে, জ্ঞান অর্থাৎ ভ্রান্ত জ্ঞান যার পথভ্রষ্টতার কারণ এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা-লালসা যাকে সত্য গ্রহণে বাধা দেয় আল্লাহ্ তাকে জোর করে পথপ্রদর্শন করেন না, কারণ, জোর করে পথপ্রদর্শন করা আল্লাহর নীতি নয়; এমতাবস্থায় কারো পক্ষেই তাকে পথপ্রদর্শন করা সম্ভব নয়।
কোরআন মজীদে ইসলামের দুশমন কাফের ও মুনাফিক্বদের বিভিন্ন ধরনের আচরণ ও নেতিবাচক মানসিকতা বিভিন্ন আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন : তারা আল্লাহ্ ও ঈমানদারদের সাথে প্রতারণা করে। এরশাদ হয়েছে :
يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ.
“তারা আল্লাহ্ ও ঈমানদারদের সাথে প্রতারণা করে, তবে (প্রকৃত পক্ষে) তারা কেবল তাদের নিজেদেরকে ব্যতীত কাউকে প্রতারণা করে না, কিন্তু তারা তা অনুভব করে না।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৯)
তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, কিন্তু নিজেদেরকে সংশোধনকারী বলে দাবী করে। এরশাদ হয়েছে :
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لا تُفْسِدُوا فِي الأرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
“আর তাদেরকে যখন বলা হয় যে, ধরণীর বুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে : অবশ্যই আমরা সংশোধনকারী।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১১)
তারা ইখলাছ্বের অধিকারী মু’মিনদেরকে নির্বোধ বলে মনে করে। এরশাদ হয়েছে :
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ أَلا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَكِنْ لا يَعْلَمُونَ
“আর তাদেরকে যখন বলা হয় যে, লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে সেভাবে ঈমান আনো, তখন তারা বলে : “আমরা কি সেভাবে ঈমান আনবো যেভাবে নির্বোধ লোকেরা ঈমান এনেছে?” জেনে রেখো, নিঃসন্দেহে তারাই হলো প্রকৃত নির্বোধ, কিন্তু তারা তা জানে না।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৩)
মুনাফিক্বরা ঈমানদারদেরকে নিয়ে উপহাস করে। এরশাদ হয়েছে :
وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ
“আর যখন তারা তাদের শয়ত্বানদের সাথে গোপনে মিলিত হয় তখন বলে : অবশ্যই আমরা (মু’মিনদের ও ইসলামের প্রতি) উপহাসকারী।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৪)
কাফেররাও মু’মিনদেরকে বিদ্রুপ করে। এরশাদ হয়েছে :
زُيِّنَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُونَ مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا
“যারা কাফের হয়েছে তাদের জন্য পার্থিব জীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে দেয়া হয়েছে এবং তারা ঈমানদারদেরকে বিদ্রুপ করে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ২১২)
এ যুগের নাস্তিকরা কোনোরূপ অকাট্য তথ্যসূত্রের সহায়তা ছাড়াই দাবী করে থাকে যে, সর্বপ্রথম ধর্মের উদ্ভব হয় প্রকৃতির বিভিন্ন ভয়-ভীতির উপকরণ থেকে এবং তখন লোকেরা বহু-ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে, পরে জ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে একেশ্বরবাদের প্রচলন হয়; বর্তমান বিজ্ঞানের যুগ হচ্ছে নিরীশ্বরবাদের যুগ। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো মানব প্রজাতি শুরুতে একেশ্বরবাদী ছিলো, পরে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও লালসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে কেউ বহু-ঈশ্বরবাদী হয়েছে ও কেউ নাস্তিক হয়েছে। নাস্তিক্যবাদ এ যুগের কোনো নতুন উদ্ভাবন নয় এবং তাদের বক্তব্যও নতুন কিছু নয়। এরশাদ হয়েছে :
وَقَالُوا مَا هِيَ إِلا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلا الدَّهْرُ وَمَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلا يَظُنُّونَ
“আর তারা বলে : “এই দুনিয়ার জীবন তো এতদ্ব্যতীত নয় যে, আমরা মারা যাই ও জীবন লাভ করি, আর মহাকাল ব্যতীত কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না।” কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞানই নেই; তারা তো কেবল আন্দায-অনুমান করছে।” (সূরাহ্ আল্-জাছীয়াহ্ : ২৪)
তারা মুসলমানদের সাথে কূটতর্ক করে - যা শয়ত্বানরা তাদের মনে জাগ্রত করে দেয়। এরশাদ হয়েছে :
إِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ
“নিঃসন্দেহে শয়ত্বানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্রত্যাদেশ করে যাতে তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করতে পারে।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আাম্ : ১২১)
তারা তাদের হৃদয়ের অনমনীয়তা নিয়ে এ কারণে আনন্দিত যে, তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, কেউই বা কোনো কিছুই তাদেরকে কুফর্ থেকে বিচ্যুত করে ঈমানের পথে আনতে পারবে না। এরশাদ হয়েছে :
وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ بَلْ لَعَنَهُمُ اللَّهُ بِكُفْرِهِمْ فَقَلِيلا مَا يُؤْمِنُونَ
“আর তারা বলে : “আমাদের অন্তঃকরণসমূহ অনমনীয়।” কিন্তু আল্লাহ্ তাদের কুফরের কারণে তাদের ওপর অভিশম্পাৎ করেছেন, সুতরাং তাদের মধ্য থেকে কদাচিৎ কেউ ঈমান আনয়ন করে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৮৮)
হেদায়াত ও গোমরাহীর পথ সুস্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও কেবল কুপ্রবৃত্তি বশে ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ বশতঃ মুশরিকরা তাওহীদের পক্ষে প্রাপ্ত বিচারবুদ্ধির রায়কে প্রত্যাখ্যান করে এবং এ ব্যাপারে অদৃষ্টবাদী কূটযুক্তি উপস্থাপন করে, তবে এ অপযুক্তির ভিত্তিহীনতা সম্বন্ধে অবগত বলেই শেষ পর্যন্ত বিনাযুক্তিতে পূর্বপুরুষদের ধর্মের অন্ধ অনুসরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
وَقَالُوا لَوْ شَاءَ الرَّحْمَنُ مَا عَبَدْنَاهُمْ مَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلا يَخْرُصُونَ. أَمْ آتَيْنَاهُمْ كِتَابًا مِنْ قَبْلِهِ فَهُمْ بِهِ مُسْتَمْسِكُونَ. بَلْ قَالُوا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُهْتَدُونَ. وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ.
“আর তারা বলে : “পরম দয়াবান (আল্লাহ্) যদি (অন্যথা) চাইতেন তাহলে আমরা তাদের (ফেরেশতাদেরকে দেবী কল্পনা করে তাদের) উপাসনা করতাম না।” এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই; তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলছে। আমি কি তাঁর (এই রাসূলের আবির্ভাবের) পূর্বে তাদেরকে এমন কোনো কিতাব দিয়েছিলাম (যাতে কল্পিত দেবদেবীদের উপাসনার নির্দেশ ছিলো) এবং তারা তা আঁকড়ে ধরে আছে? বরং তারা বলে : অবশ্যই আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে একটি আদর্শিক (বা ধর্মীয়) পথের অনুসরণকারী রূপে পেয়েছি এবং অবশ্যই আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী।” (সূরাহ্ আয্-যুখরূফ্ : ২০-২৩)
আহলে কিতাব (প্রধানতঃ ইয়াহূদী ও খৃস্টান) সম্বন্ধে কোরআন মজীদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এদের মধ্য থেকে যারা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এ আলোচনার বাইরে। অন্যদের মধ্যে যারা খালেছ্ব্ তাওহীদবাদী কোরআন মজীদ তাদেরকেও আহলে নাজাত বলে গণ্য করেছে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৬২)। কোরআন মজীদে অন্যত্র এদেরকে আভিধানিক অর্থে “মু’মিন” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যরা পাপাচারী। এরশাদ হয়েছে :
وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ
“আর আহলে কিতাব্ যদি (এই রাসূলের প্রতি) ঈমান আনয়ন করতো তো তা তাদের জন্য উত্তম হতো; বস্তুতঃ তাদের মধ্যে কতক মু’মিনও রয়েছে, তবে তাদের বেশীর ভাগই হচ্ছে ফাসেক্ব্ (পাপাচারী)।” (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্ : ১১০)
এদের মধ্যে একদল - যারা ঐশী গ্রন্থের জ্ঞানের অধিকারী - মিথ্যা দ্বারা সত্যকে চাপা দেয় এবং সত্যকে গোপন করে। তাই কোরআন মজীদে তাদের উদ্দেশে এরশাদ হয়েছে :
وَلا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ.
“আর তোমরা জেনেশুনে মিথ্যার দ্বারা সত্যকে আবৃত করো না এবং সত্যকে গোপন করো না।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৪২)
তাওরাত ও ইনজীলে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ও তাঁর নিদর্শনাদি উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যকার পণ্ডিত ব্যক্তিরা তা না জানার ভান করে। এরশাদ হয়েছে :
وَلَمَّا جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ نَبَذَ فَرِيقٌ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ كِتَابَ اللَّهِ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ كَأَنَّهُمْ لا يَعْلَمُونَ.
“আর তাদের কাছে যখন একজন রাসূল এলেন যিনি তাদের কাছে যা আছে তার (সেই ঐশী গ্রন্থাদির) সত্যায়নকারী তখন তাদের মধ্যকার যে অংশটিকে কিতাব্ দেয়া হয়েছে (যাদের কিতাবের জ্ঞান আছে) তারা আল্লাহর কিতাবকে এমনভাবে তাদের পিছনে ফেলে রাখে যেন তারা (এ ব্যাপারে) কিছুই জানে না।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১০১)
তারা সত্যকে গ্রহণ করা বা না করার বিষয়টিকে গোষ্ঠীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে থাকে। তাই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতকে সত্য জানা সত্ত্বেও তা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের মনোভাব এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যেন তাদের বাইরে কারো ওপরে ওয়াহী নাযিল করে সঠিক কাজ করেন নি (না‘উযূ বিল্লাহি মিন্ যালিক্)।এরশাদ হয়েছে :
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا نُؤْمِنُ بِمَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا وَيَكْفُرُونَ بِمَا وَرَاءَهُ
“আর তাদেরকে যখন বলা হয় : “আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার ওপর ঈমান আনয়ন করো”, তখন তারা বলে : “আমরা কেবল তার ওপরই ঈমান আনয়ন করবো যা আমাদের ওপর নাযিল হয়েছে।” আর তারা এর বহির্ভূত সব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৯১)
তারা কোরআন মজীদের আয়াতের কদর্থ করে। এরশাদ হয়েছে :
يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ مِنْ بَعْدِ مَوَاضِعِهِ
“তারা কথাকে তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত করে।” (সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্ : ৪১)
তাদের বর্তমান যুগের উত্তরসুরিরাও তা-ই করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, তারা কোরআন মজীদের যুদ্ধ সংক্রান্ত কতক আয়াতের ভিত্তিতে ইসলামকে যুদ্ধ ও রক্তপাতের ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালায়। অথচ ইসলামের যুদ্ধ হচ্ছে প্রতিরক্ষামূলক এবং কেবল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছে, আর এ ক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করা হয়েছে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৯০ ও সূরাহ্ আল্-হাজ্ব্ : ৩৯-৪০)
অবশ্য ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের এ অভ্যাস অনেক পুরনো। কারণ, তারা পূর্ববর্তী কিতাবের বক্তব্যেরও অর্থবিকৃতি ঘটাতো। এরশাদ হয়েছে :
أَفَتَطْمَعُونَ أَنْ يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِنْ بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ.
“(হে ঈমানদারগণ!) তোমরা কি এরূপ মনে কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনয়ন করবে? অথচ তাদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী ছিলো যারা আল্লাহর কালাম শ্রবণ করতো, অতঃপর বিচারবুদ্ধি দ্বারা তা হৃদয়ঙ্গম করার পর জেনেশুনেই তা বিকৃত করতো।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৭৫)
তারা মুসলমানদের সাথে মেলামেশার সূত্রে অনেক সময় ভণ্ডামি করে বলতো যে, তারা ঈমান এনেছে এবং কথা প্রসঙ্গে স্বীকার করতো যে, তাওরাত ও ইনজীলে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ও তাঁকে চেনার নিদর্শনাদি রয়েছে। এ কারণে তাদের মধ্যকার অন্যরা তাদেরকে তিরস্কার করতো। এরশাদ হয়েছে :
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلا بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ قَالُوا أَتُحَدِّثُونَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ لِيُحَاجُّوكُمْ بِهِ عِنْدَ رَبِّكُمْ أَفَلا تَعْقِلُونَ.
“তারা যখন মু’মিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে : “আমরা ঈমান এনেছি।” আর তারা যখন গোপনে পরস্পর মিলিত হয় তখন বলে : তোমরা কি তাদেরকে (মু’মিনদেরকে) সেই বিষয় জানিয়ে দিচ্ছো যা আল্লাহ্ তোমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন - যাতে তারা তোমাদের রবের কাছে এর সাহায্যে তোমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ দাঁড় করাতে পারে? তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাও না?” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৭৬)
তাদের ভাবখানা এই যে, তারা এ সত্য প্রকাশ না করলে বোধ হয় আল্লাহ্ তা‘আলা জানতেন না যে, তারা জেনেশুনে সত্যকে গোপন করছে। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
أَوَلا يَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ.
“তারা কি জানে না যে, আল্লাহ্ জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা প্রকাশ করে?” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৭৭)
তারা মুমিনদেরকে ইসলাম থেকে কুফরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। এরশাদ হয়েছে :
وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّارًا حَسَدًا مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ
“আহলে কিতাবের অনেকেই তাদের কাছে সত্য সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের অন্তরের ঈর্ষাবশতঃ কামনা করে যে, তোমাদেরকে যদি তোমাদের ঈমানের পরে কুফরে ফিরিয়ে নিতে পারতো!” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১০৯)
অনেক লোক আছে যারা অন্যদেরকে সৎকর্মের নির্দেশ দেয়, কিন্তু নিজেরা তা করে না। এ ধরনের লোক যেমন আহলে কিতাবের মধ্যে ছিলো ও আছে তেমনি নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে দাবী করে এমন লোকদের মধ্যেও। এরশাদ হয়েছে :
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلا تَعْقِلُونَ.
“তোমরা কি লোকদেরকে নেক কাজের জন্য আদেশ দাও কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব্ পাঠ করছো। তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাও না?” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৪৪)
ভণ্ড নবীদের সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :
فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَذَا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلا فَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا يَكْسِبُونَ.
“পরিতাপ তাদের জন্য যারা নিজ হাতে গ্রন্থ রচনা করে এবং এরপর বলে যে, এটা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে - যাতে তারা এর সাহায্যে সামান্য সম্পদ ক্রয় করতে পারে (পার্থিব সম্পদ হস্তগত করতে পারে)। সুতরাং পরিতাপ সে জন্য যা তারা নিজেদের হাতে লিখেছে এবং পরিতাপ সে জন্য যা (যে সম্পদ) তারা অর্জন করে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৭৯)
তারা মনে করতো যে, তারা যতোই গুনাহ্ ও সীমালঙ্ঘন করুক না কেন এবং সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করুক না কেন, কেবল কিতাবধারী হবার কারণেই তারা দোযখের আগুন থেকে বেঁচে যাবে, আর তাদের শাস্তি হলেও অল্প সময়ের জন্য শাস্তি হবে এবং এরপর তারা নাজাত পাবে। মুসলমান হবার দাবীদারদের মধ্যেও অনেক লোক একই ধারণা পোষণ করে। এদের সকলের সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :
وَقَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلا أَيَّامًا مَعْدُودَةً قُلْ أَتَّخَذْتُمْ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدًا فَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ عَهْدَهُ أَمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ. بَلَى مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ.
“আর তারা বলে : “আগুন আমাদেরকে মাত্র সীমিত কিছু দিনের জন্য ব্যতীত স্পর্শ করবে না।” (হে রাসূল!) বলুন, তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে এমন কোনো অঙ্গীকার গ্রহণ করেছো - যেহেতু তিনি কখনোই স্বীয় অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করছো যা তোমাদের জানা নেই? হ্যা, (প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে,) যে ব্যক্তি মন্দ (পাপ) উপার্জন করেছে এবং সে পাপ তাকে পরিবেষ্টিত করে নিয়েছে, এ ধরনের লোকেরা হবে দোযখের অধিবাসী এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৮০-৮১)
তারা মনে করতো যে, কেবল তারাই আহলে নাজাত। মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে এ ধরনের দাবী করে থাকে। অথচ আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, তাই তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান পোষণকারী ও ইখলাছ্বের সাথে যথাযথ কর্ম সম্পাদনকারীরাই আহলে নাজাত (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৬২)। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
قُلْ إِنْ كَانَتْ لَكُمُ الدَّارُ الآخِرَةُ عِنْدَ اللَّهِ خَالِصَةً مِنْ دُونِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الْمَوْتَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ. وَلَنْ يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ. وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُعَمَّرَ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُون.
“(হে রাসূল!) বলুন, আল্লাহর কাছে আখেরাতের গৃহ যদি অন্য লোকদেরকে বাদ দিয়ে একান্তভাবে কেবল তোমাদের জন্যই হয়ে থাকে তাহলে তোমরা মৃত্যু কামনা কর (যাতে অবিলম্বে সে গৃহ লাভ করতে পারো) যদি তোমরা (তোমাদের দাবীর ক্ষেত্রে আন্তরিকতার দিক থেকে) সত্যবাদী হয়ে থাক। কিন্তু তারা স্বহস্তে যা কিছু প্রেরণ করেছে সে কারণে তারা কখনোই তা কামনা করবে না। আর আল্লাহ্ পাপাচারীদের সম্পর্কে সদা অবগত আছেন। বরং (হে রাসূল!) আপনি তাদেরকে আয়ুর ব্যাপারে লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী লোভী দেখতে পাবেন, এমনকি মুশরিকদের চেয়েও। তাদের মধ্যে একেক জন হাজার বছর বেঁচে থাকতে চায়। অথচ এ ধরনের দীর্ঘায়ু তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করবে না। আর তারা যা করছে আল্লাহ্ সব সময়ই তা দেখছেন।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৯৪-৯৬)
তারা আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ মানতো এবং কিছু অংশ মেনে চলাকে যরূরী গণ্য করতো না। বর্তমানে মুসলমান হবার দাবীদার লোকদেরও একটি বিরাট অংশের অবস্থা এ রকমই। বিশেষতঃ তারা রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে আল্লাহ্ তা‘আলার বিধান মেনে চলা প্রয়োজন বলে মনে করে না। তাই দেখা যায় কতক লোক ফরয নামাযের বাইরেও অনেক নামায পড়ে এবং একাধিক বার হজ্ব করে এসেছে, কিন্তু ঘুষ খেতে ও জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করতে দ্বিধাবোধ করে না। আল্লাহ্ তা‘আলা এ ধরনের লোকদের সম্পর্কে এরশাদ করেন :
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ.
“তবে তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশের ওপর ঈমান রাখো এবং কিছু অংশকে অস্বীকার কর? তাহলে (জেনে রেখো) তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করবে তাদের প্রতিদান এতদ্ব্যতীত নয় যে, তারা পার্থিব জীবনে হবে ঘৃণিত এবং ক্বিয়ামতের দিনে কঠিনতম শাস্তির কবলে নিক্ষিপ্ত হবে। আর তোমরা যা কিছুই করছো আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে উদাসীন নন।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৮৫)
মুশরিক ও আহলে কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিধানের ওপরে তাদের পূর্বপুরুষদের আচরিত নিয়ম-নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়াকে যরূরী মনে করে। দুর্ভাগ্যজনক যে, মুসলমানদেরও বিরাট অংশ এ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত, ফলে তারা তাদের পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত এমন অনেক বিধানের অনুসরণকে যরূরী মনে করে যা কোরআন মজীদের বিধানের বরখেলাফ। (এ ব্যাপারে এক বৈঠকে ‘তিন’ শব্দযোগে প্রদত্ত তালাক্ব্কে ‘তিন বার’ তালাক্ব হিসেবে গণ্য করণ সহ অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে।) আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلا يَهْتَدُونَ.
“আর তাদেরকে যখন বলা হয় : “আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ কর,” তখন তারা বলে : “আমরা বরং তারই অনুসরণ করবো যার ওপরে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি।” তাদের পূর্বপুরুষরা যদি কোনো কিছু বিচারবুদ্ধি দ্বারা অনুধাবন না করে থাকে এবং সঠিক পথ না পেয়ে থাকে (তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে)?” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৭০)
সাধারণভাবে এমন কতক লোক আছে যারা বাকজাল বিস্তার করে মানুষকে মোহিত করে নিজেদের অসদুদ্দেশ্য ও নিষ্ঠুর মানসিকতাকে গোপন করে রাখে। এরশাদ হয়েছে :
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَى مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ. وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الأرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللَّهُ لا يُحِبُّ الْفَسَادَ. وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالإثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ.
“আর লোকদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে যার কথাবর্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে এবং সে তার অন্তরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আল্লাহকে সাক্ষী করে, অথচ (প্রকৃত পক্ষে) সে কঠিন ঝগড়াটে (বিতর্ককারী)। আর সে যখন ফিরে যাবে বা শাসনক্ষমতা লাভ করবে তখন সে ধরণীর বুকে ধ্বংস ও বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এবং শষ্য ও প্রজন্ম ধ্বংসের জন্য চেষ্টা করবে, অথচ আল্লাহ্ ধ্বংস ও বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা পসন্দ করেন না। আর তাকে যখন বলা হয় যে, আল্লাহকে ভয় করো, তখন তার অহঙ্কার তাকে পাপের ওপরে ধরে রাখে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট, আর তা কতোই না নিকৃষ্ট অবস্থানস্থল!” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ২০৪-২০৬)
কোরআন মজীদে মানব চরিত্রের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসমূহ সহ অসংখ্য বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুতঃ ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানব চরিত্রে যতো দিক প্রকাশ পেয়েছে ও প্রকাশ পাওয়া সম্ভব হবে তার সবগুলোর ওপরেই কোরআন মজীদে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে কোরআন মজীদ থেকে মানব চরিত্রের নেতিবাচক দিকসমূহের আংশিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র।
এভাবে কোরআন মজীদে যে বিষয়েই অনুসন্ধান চালানো হবে সে বিষয়েই এতো তথ্য পাওয়া যাবে যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বস্তুতঃ কোরআন মজীদের মতো একটি সংক্ষিপ্ত আয়তনের গ্রন্থে যেভাবে অসংখ্য বিষয়ে সীমাহীন জ্ঞানভাণ্ডার স্থানলাভ করেছে তা-ই এ গ্রন্থের ঐশী গ্রন্থ হবার ব্যাপারে যে কোনো সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তির মনে প্রত্যয় সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। কারণ, হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মতো একজন লেখাপড়া না জানা ব্যক্তির পক্ষে এ ধরনের একটি গ্রন্থ রচনা সম্ভব বলে মনে করা কেবল আত্মপ্রতারিত জ্ঞানপাপীদের পক্ষেই সম্ভব।
http://alhassanain.org/bengali