আল হাসানাইন (আ.)

হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস সাদিক (আ.)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস সাদিক (আ.) হিজরী ৮৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরী ১৪৮ সনে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন। তাকে মদীনার জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়।

তিনি ছিলেন আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম। তার যুগে তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল। ঐসবের মধ্যে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে ‘মুসাওয়াদাহ’ বিদ্রোহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা,ঐ বিদ্রোহের মাধ্যমেই উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত হয়। এছাড়াও ঐসময়ে সংঘটিত বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও উমাইয়া খেলাফতের পতনের কারণ ঘটিয়েছিল। পঞ্চম ইমাম হযরত বাকের (আ.) তার দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামত কালে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃংখল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন। এভাবে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগটি ছিল উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ। হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পান। ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার কাছেই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ,মুহাম্মদ বিন মুসলিম,মুমিন তাক,হিশাম বিন হাকাম,আবান বিন তাগলুব,হিশাম বিন সালিম,হারিয,হিশাম কালবী নাসাবাহ,জাবের বিন হাইয়্যান সুফীর (রসায়নবিদ) নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের অসংখ্য বিখ্যাত আলেমগণও তার শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। যাদের মধ্যে হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা,সুফিয়ান সাওরী,কাযী সাকুনী,কাযী আব্দুল বাখতারী,প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য,যারা ষষ্ঠ ইমামের শিষ্যত্ব বরণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় ১৪ হাজার মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদ) ও ইসলামী পন্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য। হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত হাদীস সমূহের পরিমাণ,মহানবী এবং অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদীসসমূহের চেয়ে অনেক বেশী।

কিন্তু হযরত জাফর সাদিক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন। খলিফা মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা,নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করেন। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন। তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া খলিফাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানিয়ে দেয়। খলিফা মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত। অন্ধকারাচ্ছান্ন জেলের মধ্যে তাদের উপর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের মাধ্যমে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত। তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদও করা হয়েছে। তাদের বহুজনকে আবার জীবন্ত কবর দেয়া হত। তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্রালিকা নির্মাণ করা হত।

খলিফা মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে। অবশ্য হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফ্ফাহ-র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়াও তার পিতার (পঞ্চম ইমাম বাকের আ.) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল। খলিফা মানসুর বেশ কিছুকাল যাবৎ ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখেন। খলিফা মানসুর বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল। অবশেষে সে ইমামকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। ইমাম মদীনায় ফিরে যান। ইমাম তার জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন‘তাকীয়ার’মাঝে অতিবাহিত করেন। তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগবিহীন ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন। এরপর এক সময় খলিফা মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয়।

মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদীনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠালো। ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে,মদীনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্তনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায়। অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা’(উইল) তার পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে। ইমামের‘ওসিয়ত নামায়’যাকে তার পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে,তাকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয়। এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া। কেননা এর ফলে শীয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে। খলিফার নির্দেশ অনুসারে মদীনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তার‘ওসিয়ত নামা’ চেয়ে নেয়। কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কারণ,ঐ‘ওসিয়ত নামায়’ ইমাম পাঁচ ব্যক্তিকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন। ঐ পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন : স্বয়ং মানসুর,মদীনার প্রশাসক,ইমামের সন্তান আব্দুল্লাহ আফতাহ্,ইমামের ছোট ছেলে মুসা কাজেম এবং হামিদাহ। এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে খলিফার সকল ষড়যন্ত্র ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেল।#আল-হাসানাইন

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)