আল হাসানাইন (আ.)

ডারউইরেন বিবর্তনের ভ্রান্ত ধারণা

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

ভূমিকা

আল্লাহর গ্রন্থ কোরআন যা কিনা আমাদের পথপরিচালিকা ও সাবধান বাণী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, সেটিরই কিছু অলৌকিক দিক আমরা আলোচনা করেছি। এই সমস্ত অলৌকিক বিষয়গুলো দিয়ে আল্লাহ আমাদের নিদর্শন প্রেরণ করেছেন যে এটি সত্যের গ্রন্থ এবং তিনি মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা এই বইটির ব্যাপারে বিবেচনা করে বা ভেবে দেখে। ভূ-পৃষ্ঠে সৃষ্টির নিখুত ডিজাইন সম্বন্ধে মানুষ স্বীকৃতি দান করবে আর এগুলো স্মরণের মাধ্যমে তারঁ শক্তির গুণগান করবে-এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কোরআনে নির্দেশ করেছেন আল্লাহ তাআলা। কিন্তু আজ এমন কিছু ভাবাদর্শ বিদ্যমান যেগুলো মানুষের মন থেকে সৃষ্টির সত্যের বিষয়টিকে ভুলিয়ে দিতে চায় এবং ভিত্তিহীন কিছূ ধারণা দ্বারা এ বিষয়টিকে দূরে ঠেলে দিতে চায়।

এগুলোর মাঝে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো বস্তুবাদ। বস্তুবাদ যেটিকে নিজের জন্য তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে ধরে নেয় সেটিই হল ডারউইনবাদ। প্রাণ অজৈব বস্তু থেকে যুগপৎ সংঘটনের মাধ্যমে উষ্মেষিত হয়েছে বলে যুক্তি প্রদানকারী এই থিওরিটি নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে তখনই, যখন স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করেছেন।

তিনি আল্লাহ যিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন আর ক্ষুদ্রতম ও পুংখানুপুংখ ডিজাইন তৈরী করেছেন । বিবর্তনের যে থিওরীটি পোষণ করে যে জীব জগৎ আল্লাহর সৃষ্টি নয় বরং যুগপৎ সংঘটনের ফলাফল সেই থিওরীটি সত্য হতেই পারে না।

আশ্চর্য নয় যে, যখন আমরা বিবর্তন মতবাদটির দিকে দৃষ্টিপাত করি, তখন দেখতে পাই যে এটা বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো দ্বারাই বাতিল হয়ে যায় । প্রতিটি জীবের ডিজাইন অত্যন্ত জটিল আর চিত্তাকর্ষক । উদাহরণস্বরূপ, জড় জগতে অনুসন্ধান করে আমরা দেখতে পাই যে কি এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের উপর পরমাণুগুলো অবস্থান করে আছে এবং জীব জগতে আমরা লক্ষ্য করি যে, কেমন জটিল ডিজাইনের মাধ্যমে পরমাণুগুলো একএিত হয় আর কেমন অসাধারণ সেই পদ্ধতিসমূহ; আর আমিষ, এনজাইম আর কোষসমূহের গঠন যেগুলো এই পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমেই উৎপন্ন হয়ে থাকে ।

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জীবে বিদ্যমান এই বিস্ময়কর ডিজাইন ডারউইনবাদকে অসিদ্ধ প্রমাণ করেছে ।

আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের অন্যান্য গবেষণাগুলোয় সবিস্তরে আলোচনা করেছি এবং এভাবেই তা করে যাওয়া অব্যাহত রাখব। অবশ্য আমাদের ধারণা, বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় এনে এখানেও এর উপর একটি ছোট সারাংশ তৈরী করলে তা কাজে আসবে।

বৈজ্ঞানিকভাবে ডারউইনবাদের পতন

প্রাচীন গ্রীস থেকেই একটি মতবাদ হিসেবে চলে আসলেও বিবর্তন থিওরিটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে যখন “প্রজাতির উৎস” নামক বইখানা প্রকাশিত হয়ে থিওরিটিকে বিজ্ঞান জগতে সর্বশেষ টপিকে নিয়ে আসে। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতিকে পৃথক পৃথকভাবে সৃষ্টি করেছেন-এটি ডারউইন তার এ বইখানায় অস্বীকার করেন । ডারউইনের মতানুসারে সমস্ত জীবেরই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল এবং এরা কালের যাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের মাধ্যমে বিচিত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ।

ডারউইনের থিওরিটি কোন দৃঢ় বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ছিল না; তিনি নিজেও মেনে নিয়েছেন যে এটা ছিল নিছকই এক “অনুমান”। অধিকন্তু, ডারউইন তার “থিওরীর প্রতিকূলতা ” নামক বইখানার দীর্ঘ অধ্যায়সমূহে স্বীকার করেছেন যে, থিওরিটি বহু সমালোচনামূলক প্রশ্নের উত্তর প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছিল ।

ডারউইন নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পানে তার সমস্ত আশা নিয়োগ করলেন, যেগুলো তার থিওরির প্রতিকূলতাগুলোর সমাধান নিয়ে আসবে বলে তার প্রত্যাশা ছিল । কিন্তু তার আশার বিপরীতে বৈজ্ঞানিত তথ্যগুলো এই সমস্যাগুলোর পরিধি আরো বাড়িয়ে দিল।

বিজ্ঞানের মোকাবেলায় ডারউইনবাদের এই পরাজয়টিকে তিনটি মূল আলোচ্য বিষয়ে পূণর্নিরীক্ষণ করা যায় :

১) ভূ-পৃষ্ঠে প্রাণের ঊন্মেষ কিভাবে হল-এর ব্যাখ্যা মতবাদটি কোনভাবেই প্রদান করতে পারে না।

২) থিওরিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত “বিবর্তন প্রক্রিয়াগুলোর” বিবর্তন ঘটানোর কোন প্রকার ক্ষমতা আদৌ আছে কি নেই-তা প্রমাণ করার জন্য কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই ।

৩) জীবাশ্ম রেকর্ডসমূহ বিবর্তন থিওরির প্রস্তাবনাসমূহের সম্পূর্ণ উল্টো তথ্য বা প্রমাণ সরবরাহ করে ।

এই পরিচ্ছেদে আমরা এই তিনটি মূল বিষয় সাধারণ পরিধিতে পর্যবেক্ষণ করব :

অনতিক্রম্য প্রথম ধাপ : প্রাণের ঊন্মেষ

বিবর্তন মতবাদ শুধুমাত্র তর্কের খাতিরে এটাই শুদ্ধ বলে ধরে নেয় যে, ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে আদি পৃথিবীতে আবির্ভূত একটি মাত্র জীবকোষ হতেই সমস্ত জীবিত প্রজাতির বিকাশ ঘটেছে । কিভাবে একটি মাত্র কোষ হতে মিলিয়ন মিলিয়ন জটিল প্রজাতির উদ্ভব হলো, আর বিবর্তন বলে যদি কিছু ঘটেই থাকে তবে ফসিল রেকর্ডে কেনইবা এর সামান্য কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না-এ ধরণের কোন প্রশ্নের উত্তর প্রদানে মতবাদটি অক্ষম। যাইহোক, সর্বাগ্রে, উক্ত বিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি অনুসন্ধান করতে হবে : কিভাবে এই “আদি কোষের” উৎপত্তি হলো ?

যেহেতু বিবর্তনবাদ সৃষ্টি কৌশলকে অস্বীকার করে আর অতি প্রাকৃতিক কোন প্রকার মধ্যস্থতাকে মেনে নেয় না, সেহেতু তা এতেই অটল থাকে যে, “আদিকোষ” কোন ডিজাইন,পরিকল্পনা বা কোন ব্যবস্থাপনা ছাড়াই প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী এক আকস্মিক যোগাযোগের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। এই মতবাদ অনুযায়ী, যুগপৎ ঘটনাসমূহের ফলস্বরূপই নিশ্চিতভাবে জড় বস্তুগুলোই একটি জীবকোষের জন্ম দিয়েছে । যাহোক, এটা এমনকি জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অনাক্রম্য নিয়মাবলীর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ একটি দাবী ।

প্রাণী থেকে প্রাণীর উৎপত্তি

ডারউইন তার বইখানায় প্রাণের উদ্ভবের ব্যাপারটি কখনও উল্লেখ করেননি । জীবিত সত্তাগুলোর গঠন কাঠামো অত্যন্ত সরল-এ অনুমানের উপরই তার সময়কার বিজ্ঞানের আদি ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল । মধ্যযুগ থেকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের নামে একটি থিওরী দাবী করে আসছিল যে, জড় বস্তুগুলো একত্রে মিলিত হয়েই জীবের উদ্ভব ঘটায়, আর এটি তখন বিস্তৃতভাবে গ্রহনযোগ্য ছিল । সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হতো যে, ফেলে রাখা অতিরিক্ত খাবার থেকে পোকামাকড় আর গম থেকে ইদুঁর জন্ম নেয় । এই মতবাদটি প্রমাণের জন্য মজার মজার গবেষণা চালানো হতো । একটি ময়লা কাপড়ের টুকরায় কিছু গম ফেলে রাখা হতো আর কিছুক্ষন পরেই তা থেকে ইদুঁর জন্ম নেবে বলে বিশ্বাস করা হতো । অনুরূপভাবে মাংস থেকে কীটের উৎপত্তিকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের একটি প্রমাণ বলে ধারণা করা হতো । অবশ্য মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে এটা বোঝা গেলো যে, কীটগুলো মাংসে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে হাজির হয় না, বরং খালি চোখে দেখা যায় না-এমন কিছু লার্ভার আকারে মাছিগুলো কীটগুলোকে বহন করে নিয়ে আসে ।

এমনকি যে সময়ে ডারউইন তার “প্রজাতির উৎপত্তি” বইখানা লিখেন তখনও ব্যাকটেরিয়া জড়বস্তু থেকে জন্ম নেয় এমন একটি বিশ্বাস বিজ্ঞান জগতে বহুল প্রচলিত ছিল ।

অবশ্য ডারউইনের বই প্রকাশনার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় লুই পাস্তুর দীর্ঘ পর্যবেক্ষন ও গবেষণা শেষে তার ফলাফল ঘোষণা করেন যা ডারউইনের মতবাদের ভিত্তি স্থাপনকারী এই স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনকে মিথ্যা প্রমাণ করে । ১৮৬৪ সনে, সর্বোনে দেয়া এক বিজয়ী লেকচারে লুই পাস্তুর বলেন, “এই সরল গবেষণাটি হতে প্রাপ্ত গুরুতর আঘাত থেকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের মতবাদটি আর কখনও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে না ।”

বিবর্তন মতবাদটির সমর্থকগণ পাস্তুরের এই তথ্যগুলোকে দীর্ঘ সময় ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। অবশ্য বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যখন জীবকোষের অতি জটিল গঠনের জট খুলে দিল, তার সাথে সাথে যুগপৎ ঘটনায় প্রাণের অস্তিত্ত্বে আসার কাল্পনিক ধারণা সম্পূর্ণ অচলাবস্থার সম্মুখীন হলো ।

বিংশ শতাব্দীতে সিদ্ধান্তহীন প্রচেষ্টা

খ্যাতনামা রুশ জীববিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন প্রথম সেই বিবর্তনবাদী, যিনি বিংশ শতাব্দীতে “প্রাণের উৎপত্তি ” বিষয়টিকে নিয়ে আবার নূতন করে কাজ শুরু করেন । ১৯৩০ সনে তিনি বিভিন্ন থিসিস নিয়ে এগিয়ে আসলেন আর প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন যে, জীবকোষ যুগপৎ ঘটনায় উৎপন্ন হতে পারে। অবশ্য এবারও এই অনুসন্ধানগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো আর ওপারিনকে নিম্নোক্ত স্বীকারোক্তিখানি করতে হলো : “যাইহোক, দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়তোবা কোষের উৎপত্তি বিষয়ক সমস্যাটি জীবসমূহের বিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের বেলায় সবচেয়ে অস্পষ্ট একটি পয়েন্ট হিসেবে রয়ে গিয়েছে ।”

ওপারিনের বিবর্তনবাদী অনুসারীগণ প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক সমস্যাটির সমাধানকল্পে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এই পরীক্ষাগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুপরিচিত পরীক্ষাটি সম্পন্ন করেন ১৯৫৩ সনে আমেরিকান রাসায়নবিদ ষ্ট্যানলী মিলার। তিনি গবেষনার একটি সেট তৈরী করলেন; তার যুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর আদি পরিবেশে কিছু গ্যাস বিদ্যমান ছিল যেগুলোকে তিনি তার সেটটিতে একসংগে মেশালেন ও মিশ্রণটিতে শক্তি সরবরাহ করলেন। অবশেষে সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরণের জৈব অণু (এমাইনো এসিড) উৎপন্ন করলেন যেগুলো প্রোটিনের গঠন কাঠামোতে বিদ্যমান থাকে ।

সে সময় এ পরীক্ষাটিকে বিবর্তনের স্বপক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উপস্থাপন করা হয়েছিল । কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই এ গবেষণাটি অগ্রহনযোগ্য বলে প্রকাশিত হলো; কেননা গবেষণায় যে পরিবেশ ব্যবহৃত হয়েছিল তা পৃথিবীর প্রকৃত অবস্থা হতে ছিল অনেক অনেক ভিন্ন ।

দীর্ঘ নীরবতার পর মিলার স্বীকার করে নিলেন যে, তিনি যে পরিবেশের মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন তা বাস্তবে নেই ।

বিংশ শতাব্দী জুড়ে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দানে বিবর্তনবাদীদের পেশকৃত সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো । সান্ডিয়াগো স্ক্রিপস ইনস্টিটিউট থেকে ভূ-রসায়নবিদ, জেফরী বাদা, ১৯৯৮ সনে আর্থ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক অনুচ্ছেদে এ সত্যটি মেনে নিয়ে বলেন :

আজ এই বিংশ শতাব্দী ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালেও সবচেয়ে বড় যে অমীমাংসিত সমস্যাটির মুখোমুখি আমরা হ‪চ্ছি, যেমনটি হয়েছিলাম এ শতকে প্রবেশের সময়; সমস্যাটি হল : ভূ-পৃষ্ঠে প্রাণের সঞ্চার হলো কিভাবে ?

জীবদেহের জটিল গঠন

প্রাণের উৎপত্তি প্রসংগে বিবর্তন মতবাদ এমন একটি বড় ধরণের অচলাবস্থায় সমাপ্ত হওয়ার একটি প্রাথমিক কারণ যে সমস্ত জীবগুলো অত্যন্ত সরল গঠনের বলে বিবেচনা করা হয়েছিল, সেগুলোরও অবিশ্বাস্য ধরণের জটিল গঠন রয়েছে। মানবপ্রযুক্তি দ্বারা তৈরী সমস্ত পণ্যের চেয়ে একটি জীবকোষ অধিকতর জটিল । আজ এই সময়ে এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ল্যাবরেটরীগুলোতেও অজৈব বস্তুগুলোকে একত্রিত করে একখানি জীবকোষ তৈরী করা যায় না ।

একখানি কোষ তৈরীতে প্রয়োজনীয় শর্তাদির পরিমাণ এত বিপুল যে এটাকে যুগপৎ ঘটনায় সংঘটিত হওয়ার ব্যাখ্যা দেয়াই ভার । কোষের গঠন কাঠামোতে ব্লক হিসেবে ব্যবহৃত হয় যে প্রোটিনগুলো, তাদের প্রতিটি গড়ে ৫০০ এমাইনো এসিড নিয়ে গঠিত; যুগপৎভাবে সংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় সে প্রোটিনগুলোর তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা ১০৯৫০ ভাগেরও এক ভাগ। গাণিতিকভাবে ১০৫০ ভাগের চেয়ে কম কিংবা ক্ষুদ্রতর যে কোন সম্ভাবনা বাস্তবে অসম্ভব।

কোষের কেন্দ্রে অবস্থিত ডি.এন.এ. একটি অবিশ্বাস্য ডাটা ব্যাংক, যা বংশগতির সমস্ত তথ্যাবলী বহন করে থাকে । গণনা করে দেখা গেছে যে, ডি.এন.এ. তে যে তথ্যাদি সংকলিত রয়েছে তা যদি লিপিবদ্ধ করা যেতো তাহলে তা ৯০০ ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়ার এক বিশালাকায় লাইব্রেরী তৈরী করতো, যেখানে প্রতি ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়া রয়েছে ৫০০ পৃষ্ঠা ।

এই পয়েন্টটিতে একটি উভয় সংকট তৈরী হয় : ডি.এন.এ. কেবলমাত্র বিশেষ ধরণের কিছু প্রোটিনের (এনজাইম) সহায়তায় বিভাজিত হয় । আবার এ এনজাইমগুলো সংশ্লেষনের মাধ্যমে তৈরী হওয়ার যাবতীয় তথ্যাবলী ডি.এন.এ. এর গায়ে সংকলিত থাকে । আর এই তথ্যাবলী থেকেই সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াগুলো বুঝে নেয়া যায় । দেখা যাচ্ছে যে, উভয়েই পরস্পর পরস্পরের উপর নিভর্রশীল । আর তাই কোষ বিভাজনের সময় তাদের উভয়কে একই সঙ্গে বর্তমান থাকতে হবে। এ কারণেই প্রাণ নিজে নিজেই উৎপত্তি লাভ করবে-এরূপ কাল্পনিক সম্ভাবনাটি বাতিল হয়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ায় সান্ডিয়াগো ইউানভার্সিটির সুনামধন্য বিবর্তনবাদী, অধ্যাপক রেসলি অরগেল, সায়েন্টিফিক এমেরিকান ম্যাগাজিনের ১৯৯৪ সনের সেপ্টেম্বরের প্রকাশনায় একটি আর্টিকেলে এ সত্যটি স্বীকার করে বলেন :

এটা একেবারেই অসম্ভব যে গঠনগতভাবে জটিল প্রোটিন ও এমাইনো এসিড উভয়েই একই সময়ে একই জায়গা হতে উৎপন্ন হবে । তদুপরি এদের একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব অসম্ভব বলেই মনে হয় । আর তাই, প্রথম দৃষ্টিতে একজন এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, প্রকৃতপক্ষে প্রাণ কখনও রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরী হতে পারতো না ।

বলতে দ্বিধা নেই যে, যদি প্রকৃতিগত কারণে প্রাণের উৎপত্তির সম্ভাবনা না থাকে, তবে তখন এটাই মেনে নিতে হবে যে, এক অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক উপায়েই প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। এ সত্যটুকু সুস্পষ্টভাবে সেই বিবর্তন মতবাদকে বাতিল ঘোষণা করে যার প্রকৃত উদ্দেশ্য “সৃষ্টি কর্ম” কে অস্বীকার করা।

কাল্পনিক বিবর্তন প্রক্রিয়াসমূহ

দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ডারউইনের মতবাদকে বাতিল করে দেয় তা হলো-“বিবর্তনের প্রক্রিয়াবলী” হিসেবে যে দুটি ধারণার অবতারনা করা হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবে বিবর্তন ঘটানোর কোন ক্ষমতা নেই বলে বুঝা গিয়েছে ।

ডারউইন “প্রাকৃতিক নির্বাচন” প্রক্রিয়াকে তার উত্থাপিত বিবর্তনবাদের ভিত্তি হিসাবে দাঁড় করান। তিনি এই পদ্ধতির উপর যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তা তার বইটির নামকরণেই স্পষ্ট হয়ে উঠে : “প্রজাতির উৎপত্তি, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে .......।”

প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবেচনা করে যে, যে সমস্ত জীব অধিকতর শক্তিশালী ও যেগুলো তাদের আবাস ভূমির স্বাভাবিক অবস্থায় অধিকতর উপযোগী বা যোগ্যতর বলে বিবেচিত হয় তারাই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, কোন এক হরিণের পাল যখন অন্য কোন হিংস্র জন্তুর কবলে পতিত হয়, তখন যে হরিণগুলো অধিকতর দ্রুত বেগে দৌড়ে যেতে পারে তারাই কেবল টিকে থাকবে । অবশ্য প্রশ্নাতীতভাবেই, এই পদ্ধতি কোন হরিণের মাঝে বিবর্তন ঘটায় না আর একে বিকশিত করে অন্য কোন প্রজাতি, যেমন, ঘোড়ায় রূপান্তরিত-করে না ।

অতএব বিবর্তন ঘটানোর কোন ক্ষমতাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের নেই । ডারউইন নিজেও এ সত্যটি অবগত ছিলেন আর তাকে তার প্রজাতির উৎস নামক বইটিতে নিম্ন লিখিত উক্তিখানি করতে হয়েছিল : “প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকূল বৈষম্য কিংবা বৈচিত্র্য না ঘটা পর্যন্ত প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না ।”

ল্যামার্কের প্রভাব

তাহলে কিভাবে এই “অনকূল পরিবর্তনগুলো” ঘটবে ? ডারউইন তার যুগের বিজ্ঞানের আদি ধারণার দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের চেষ্টা করেন । ডারউইনের পূর্ব যুগে বিদ্যমান ফ্রান্সের জীববিজ্ঞানী ল্যামার্কের মতানুসারে, জীব তাদের জীবদ্দশায় তাদের অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মে প্রেরণ করেছিল আর সেগুলো প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে একত্রীভূত হয়ে নূতন প্রজাতির প্রাণীর উদ্ভব ঘটিয়েছিল । যেমন, ল্যামার্কের মতে, জিরাফগুলো এক ধরণের কৃষ্ণকায় হরিণ থেকে বিকশিত হয়েছিল । যখন হরিণগুলো উঁচু বৃক্ষের পাতা খাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করত, তখন তাদের ঘাড় একটু একটু করে প্রসারিত হয়ে এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে লম্বা হয়েছে ।

ডারউইন নিজেও একই ধরণের উদাহরণ দিয়েছেন; দৃষ্টান্ত স্বরূপ তিনি তার প্রজাতির উৎস বইটিতে বলেছেন যে খাবারের খোঁজে পানিতে নামতে গিয়ে কিছু ভালুক কালের পরিক্রমায় নিজেরাই তিমিতে রূপান্তরিত হয়েছিল ।

যাই হোক, বিংশ শতাব্দীতে ম্যান্ডেল উত্তরাধীকার সূত্রাবলী আবিষ্কার করলেন আর বংশানুগতি সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান কর্তৃক সে সূত্রগুলোর যথার্থতা যাচাই করা হলো । বংশানুগতির বা উত্তরাধীকার সূত্রগুলো সে সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে আর অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে প্রেরিত হয়-এ ধরণের উপাখ্যানটি নাকচ করে দেয়। এভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন, বিবর্তন প্রক্রিয়া হিসেবে সমর্থন পেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় ।

নব্য-ডারউইনবাদ এবং মিউটেশন

ডারউইন ভক্তরা ১৯৩০ সালের শেষ দিকে একটি সমাধানে পৌছার লক্ষ্যে “আধুনিক সংশ্লেষন থিওরী” কিংবা আরো সাধারণভাবে যেটি নব্য-ডারউইনবাদ নামে পরিচিত, সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। নব্য-ডারউইনবাদে মিউটেশন প্রক্রিয়াটি যোগ করা হয়; আর মিউটেশন হলো-বাহ্যিক কিছু কারণ যেমন, বিকিরণের (Radiation) কিংবা সংযোজন ভ্রান্তির (Replication error) কারণে জীবদেহের জীনে সংঘটিত বিকৃতি; উপরোক্ত ফ্যাক্টরগুলোর জন্য প্রাকৃতিক মিউটেশনের সঙ্গে “অনুকল পরিবর্তনের কারণ” হিসেবে জীনে এ বিকৃতি ঘটে থাকে ।

বর্তমানে এই পৃথিবীতে বিবর্তনের মডেল হিসেবে আমরা যেটিকে দেখতে পাই তাই হলো নব্য-ডারউইনবাদ । থিওরিটি এটাই বলে যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে মিলিয়ন মিলিয়ন জীব এসেছে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যদ্দারা জীবগুলোর জটিল অঙ্গাদি যেমন: কান, চোখ, ফুসফুস আর পাখাসমূহে “মিউটেশন” কিংবা জিনগত বিশৃংখলা সংঘটিত হয় । তথাপি একটি নির্জলা বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা এ থিওরিটিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে :

মিউটেশন কখনো জীবদেহের বিকাশ বা উন্নয়ন ঘটায় না বরং তার ক্ষতিসাধন করে ।

এর কারণটি অত্যন্ত সাধারণ : ডি.এন.এ. এর রয়েছে একটি অতি জটিল গঠন আর এলোপাতাড়ি যে কোন পরিবর্তন এ কাঠামোটির ক্ষতি সাধন করে । আমেরিকার জিনতত্ত্ববিদ বি.জি. রাঙ্গানাথান বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন :

মিউটেশন হলো ক্ষুদ্র, এলোপাতাড়ি আর ক্ষতিকর প্রক্রিয়া। এগুলো কদাচিৎ ঘটে আর ঘটলেও ভাল লক্ষণ যে, এরা কার্যকরী হবে না। মিউটেশনের ৪টি বৈশিষ্ট্য এটাই সূচিত করে যে, প্রক্রিয়াটি কখনো বিবর্তনজনিত বিকাশ ঘটায় না। অত্যন্ত জটিল জীবদেহে এলোপাতাড়ি পরিবর্তনগুলো হয় ব্যর্থ নচেৎ ক্ষতিকর বলে পরিলক্ষিত হয়। একটি ঘড়িতে এলোপাতাড়ি পরিবর্তন একে কোন উন্নতর ঘড়িতে রূপান্তরিত-করতে পারে না। খুব সম্ভবত এতে ঘড়িটির ক্ষতি হবে অথবা বড়জোর তা ব্যর্থ হবে। ভূমিকম্প কখনও নগরীর সমৃদ্ধি ঘটায় না বরং এর ধ্বংসই ডেকে আনে।

এটা কোন আশ্চর্যের কথা নয় যে, মিউটেশনের কোন উদাহরণই কার্যকরী হয় না, তার মানে, মিউটেশন প্রক্রিয়া জীনের গায়ে বিদ্যমান সংকেতলিপির কোন প্রকার উন্নয়ন ঘটায়-এমন কোন দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয় না। সব ধরণের মিউটেশনই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মিউটেশনগুলো-যাদের বিবর্তন প্রক্রিয়া বলে উপস্থাপন করা হয়েছে, তারা প্রকৃতপক্ষে জীবদেহে জীনের কতকগুলো সংঘটনমাত্র, যেগুলো বরং দেহের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায় বলেই দেখা গিয়েছে। আর সাথে সাথে তা জীবগুলোকে অচল ও পঙ্গু করে দেয়। (মানব দেহে মিউটেশনের ক্ষতিকর প্রভাবের সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ-ক্যান্সার ) এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া কখনো কোন “ক্রমবিকাশ পদ্ধতি” হতে পারে না। অন্যদিকে প্রাকৃতিক নির্বাচনও “নিজে নিজে কিছু করতে পারে না” যা ডারউইন নিজেও মেনে নিয়েছেন। এই তথ্যগুলো আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রকৃতিতে কোন “বিবর্তন প্রক্রিয়া” বিদ্যমান নেই। যেহেতু “বিবর্তনের কোন পদ্ধতিরই” অস্তিত্ব নেই সেহেতু বিবর্তন নামের কাল্পনিক কোন প্রক্রিয়াও সংঘটিত হয়নি।

ফসিল বা জীবাশ্ম রেকর্ডঃ মধ্যবর্তী কোন আকৃতির অস্তিত্ব নেই

বিবর্তন মতবাদ কর্তৃক প্রস্থাবিত-কোন দৃশ্যকল্প সংঘটিত হয়নি-এ সত্যটির সবচেয়ে পরিষ্কার সাক্ষ্য বহন করছে “ফসিল রেকর্ড”।

বিবর্তন মতবাদ অনুসারে প্রতিটি জীব তার পূর্বসুরী থেকে জন্ম নিয়েছে। পূর্বে বিদ্যমান কোন প্রজাতি সময়ের ধারাবাহিকতায় অন্য কোন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে আর এভাবে বাকী প্রজাতিগুলোও অস্তিত্বে এসেছে। এ মতবাদ অনুসারে, এই রূপান্তর প্রক্রিয়া মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়েছে।

এই যদি ব্যাপার হতো তখন অবশ্যই অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির অস্তিত্ব থাকত আর এরা দীর্ঘ পরিবর্তন কাল জুড়ে বর্তমান থাকতো ।

উদাহরণস্বরূপ, অতীতে কিছু অর্ধমাছ/অর্ধসরীসৃপ এর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকত তাদের পূর্ব থেকে বিদ্যমান মাছের বৈশিষ্টের সঙ্গে সরীসৃপের কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হতো। কিংবা কতক সরীসৃপ পাখি জাতীয় প্রাণী থাকতো যাদের পূর্বে রয়ে যাওয়া সরীসৃপের বৈশিষ্টের সংগে পাখির বৈশিষ্ট্য যোগ হতো। যেহেতু এরা একরূপ হতে অন্য রূপে উত্তরণের সময় জন্ম নিত সেহেতু তাদের অক্ষম, ত্রুটিপূর্ণ, পঙ্গু জীব হিসেবেই বিদ্যমান থাকার কথা । বিবর্তনবাদীরা এমন সব কাল্পনিক জীবের কথা বলে থাকেন যা অতীতে তাদের রূপ পরিবর্তনকালীন সময়ে “দুয়ের মধ্যবর্তী আকারে” (intermediate forms) বিদ্যমান ছিল বলে তাদের বিশ্বাস ।

সত্যিই যদি এ ধরণের প্রাণীর অস্তিত্ব থাকত, তারা সংখ্যা ও বৈচিত্র্যে হতো মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন অবধি। আরো গুরুত্বপূর্ণ যে, অদ্ভুত এই প্রাণীগুলোর দেহাবশেষ ফসিল রেকর্ডে বিদ্যমান থাকার কথা। প্রজাতির উৎপত্তি বইটিতে ডারউইন বলেছেন :

আমার থিওরীটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে একই গ্রুপের সমস্ত প্রজাতির মাঝে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপনকারী মধ্যবর্তী গঠনের এ ধরণের প্রাণীর সংখ্যা নিশ্চিত ভাবেই হবে অসংখ্য ....... ।

ফলস্বরূপ তাদের অতীতে বিদ্যমান থাকার প্রমাণ কেবলমাত্র তাদের ফসিলসমূহে থেকে পাওয়া যেতে পারে ।

ডারউইনের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো

যদিও বিবর্তনবাদীরা ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ফসিল খুঁজে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তথাপি এখনও পর্যন্ত কোথাও কোন অন্তর্বর্তীকালীন গঠনের প্রাণী খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাটি খুঁড়ে তুলে আনা সমস্ত ফসিলগুলো বিবর্তনবাদীদের প্রত্যাশার বিপরীত তথ্য প্রদর্শন করে এটাই প্রমাণ করছে যে, পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে আকস্মিকভাবে আর পরিপূর্ণ আকার নিয়ে।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীবাশ্মবিদ, ডিরেক ভি. এগার নিজে একজন বিবর্তনবাদী হয়েও তিনি এ সত্যটি মেনে নিয়েছেন এভাবে :

যে তথ্যটি বের হয়ে আসে তাহলো যে, ফসিলগুলো বর্গ বা প্রজাতি-এ দুয়ের যে কোন পর্যায়েই থাকুকনা কেন, যেকোন একটি স্তরে আমরা যদি এদের পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করে দেখি, তাহলে বারংবার আমরা খুঁজে পাই কোন ক্রমান্বয় বিবর্তন নয়, বরং এক গ্রুপের পরিবর্তে অন্য আরেকটি গ্রুপের যেন আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ।

ফসিল রেকর্ড থেকে এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, সমস্ত জীব প্রজাতিই কোন দুইটি প্রজাতির অন্তর্বর্তীকালীন কোন গঠন নিয়ে নয় বরং পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এটি ডারউইনের অনুমানের ঠিক উল্টো। এটি এ বিষয়টিরও একটি অত্যন্ত জ্বলন্ত প্রমাণ যে, সমস্ত জীবকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমস্ত জীব যে পূর্ববর্তী কোন প্রজন্ম হতে বিকশিত হয়ে নয় বরং আকস্মিকভাবে এবং সম্পূর্ণ অখণ্ড রূপে আবির্ভূত হয়েছে-তার একমাত্র ব্যাখ্যা এটিই হতে পারে যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে । সুপরিচিত বিবর্তনবাদী ও জীববিদ ডগলাস ফুতুইমা ও এ সত্যটি স্বীকার করে নিয়েছেন :

সৃষ্টি আর বিবর্তন-এ দুয়ের মাঝে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যাগুলো ফুরিয়ে যায়। প্রাণীসমূহ পৃথিবীতে এসেছে হয় পূর্ণাঙ্গরূপে নচেৎ আসেনি। যদি তারা পূর্ণাঙ্গরূপে না আসে তবে তারা অবশ্যই পূর্বে বিদ্যমান কোন প্রজাতি হতে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়েছে । যদি তারা পূর্ণাঙ্গ রূপেই এসে থাকে তবে বাস্তবিকভাবে অবশ্যই তারা কোন সর্বশক্তিমান মহাকৌশলী কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে।

ফসিলগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভূ-পৃষ্ঠে প্রাণসত্ত্বার আবির্ভাব ঘটেছে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গরূপে। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে, “প্রজাতির উৎপত্তি” হয়েছে সৃষ্টি কৌশলের মধ্য দিয়ে, বিবর্তনের মাধ্যমে নয়; আর এটা ডারউইনের অনুমানের ঠিক বিপরীত ।

মানব-বিবর্তনের কাহিনী

মানবজাতির উৎস-এটিই বিবর্তনবাদ ভক্তদের সর্বাধিক উত্থাপিত আলোচনার বিষয়। ডারউইনের সমর্থকগণ এই বলে দাবী করেন যে, এখনকার মানবজাতি কিছু গরিলা বা শিম্পাঞ্জী জাতীয় প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছে। কথিত এই বিবর্তন প্রক্রিয়া ৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে শুরু হয়েছিল বলে দাবী করা হয়; আরো দাবী করা হয় যে, বিবর্তন প্রক্রিয়ার সময় এখনকার মানবজাতি তার ও তার পূর্বপুরুষদের মাঝামাঝি কোন “অন্তর্বর্তীকালীন রূপে” বিদ্যমান ছিল। সম্পূর্ণ কাল্পনিক এই রূপরেখা থেকে চারটি মৌলিক শ্রেণীর একটি তালিকা তৈরী করা যায় :

১ । অষ্টোলোপিথেকাস

২ । হোমো হেবিলিস

৩ । হোমো ইরেকটাস

৪ । হোমো সেপিয়েনস

বিবর্তনবাদীগণ তথাকথিত মানবজাতির পূর্বপুরুষের নাম রেখেছেন “অষ্ট্রেলো পিথেকাস” অর্থাৎ “দক্ষিন আফ্রিকান বানর”। প্রকৃতপক্ষে, এই জীবগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বানর বৈ কিছু নয়। ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে দুজন জগৎ বিখ্যাত এনাটমিষ্ট, লর্ড সলী যুকারম্যান এবং অধ্যাপক চার্লস অক্সনার্ড বিভিন্ন অষ্টোলোপিথেকাসের নমুনার উপর গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছেন যে, এগুলো সাধারণ এক প্রকার গরিলা শ্রেণীর; এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে আর মানবজাতির সাথে এদের কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় নি।

বিবর্তনবাদীরা মানব বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়কে “হোমো” বা “মানুষ” নামে শ্রেণীকরণ করেছেন। তাদের দাবী অনুসারে হোমো শ্রেণীর জীবগুলো অষ্ট্রেলোপিথেকাসের চেয়ে উন্নতর পর্যায়ের। বিবর্তনবাদীরা এই প্রাণীগুলোর বিভিন্ন ধরণের জীবাশ্ম নিয়ে এদের নির্দিষ্ট বিন্যাসে সাজিয়ে এক অলীক বিবর্তন বিন্যাস বা পরিকল্পনা তৈরী করেছেন। এই বিভিন্ন শ্রেণীগুলোর মাঝে বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বা এদের মাঝে বিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে এমন কোন প্রমাণ কখনো দাড় করানো যায়নি; তাই এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বিংশ শতাব্দীতে বিবর্তন মতবাদের একজন অগ্রবর্তী সমর্থক আর্নস্ট মায়ার তার দীর্ঘ বিতর্ক নামক বইটিতে লিখেছেন যে, “হোমো সেপিয়েনস পর্যন্ত অগ্রসর চেইনটি হঠাৎ হারিয়ে গেছে।”

বিবর্তনবাদীগণ বিভিন্ন্ প্রজাতির মাঝে যোগসূত্র স্থাপনকারী এই চেইনটির রূপরেখা টেনেছেন এভাবেঃ অষ্ট্রেলোপিথেকাস> হোমো হেবিলিস> হোমো ইরেকটাস> হোমো সেপিয়েনস। এ চেইনটি থেকে বিবর্তনবাদীগণ দেখাতে চান যে,এই প্রজাতিগুলোর প্রত্যেকে একে অপরের আদি পুরুষ। অবশ্য বিবর্তনবাদীদের সাম্প্রতিক কালের প্রাপ্ত তথ্য হতে এটা পকাশিত হয়েছে যে, অষ্ট্রেলোপিথেকাস, হোমো হেবিলিস আর হোমো ইরেকটাস পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে একই সময়ে বিদ্যমান ছিল ।

তদুপরি, হোমো ইরেকটাস নামে শ্রেণীকৃত মানুষের একটি নির্দিষ্ট অংশ এখনও আধুনিক কাল পর্যন্ত বসবাস করে আসছে। হোমো সেপিয়েনস নিনদারথেলেনসিস ও হোমো সেপিয়েনস (আধুনিক মানুষ) একই সঙ্গে একই অঞ্চলে বসবাস করছিল ।

এ অবস্থা সুস্পষ্টভাবেই, প্রজাতিগুলোর একজন আরেকজনের উত্তরসূরী-এ দাবীটি দূর্বল করে দেয়। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ, ষ্টীফেন জে গুল্ড, নিজে একজন বিবর্তনবাদী হয়েও বিবর্তন থিওরীর এই অচলাবস্থার ব্যাখ্যা করেছেন :

আমাদের এগিয়ে যাওয়ার ধাপ কি হতে পারে যদি তিনটি হোমিনিড বংশানুক্রম (এ.আফ্রিক্যানাস, বিশাল অষ্ট্রেলোপিথেসিনস, আর এইচ. হেবিলিস) একই সঙ্গে বর্তমান থাকে আর স্পষ্টভাবে কেউই একজন আরেকজন থেকে জন্ম নেয়নি ? অধিকন্তু, পৃথিবীতে থাকাকালীন অবস্থায় এই তিনটি হোমিনিডের কেউই বিবর্তনের কোন প্রবণতাই দেখায়নি ।

সংক্ষেপে বললে, মানব বিবর্তনের গল্পটি চালু রাখতে “অর্ধেক বানর, অর্ধেক মানুষ” এমনতর প্রাণীর বিভিন্ন ছবি এঁকে তা প্রচার মাধ্যম ও কোর্স বইতে হাযির করা হয়; খোলাখুলি বলতে গেলে এগুলো নিছকই প্রচারণার মাধ্যমে করা হয়-যা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিবিহীন একটি গল্প ছাড়া আর কিছুই নহে ।

ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীদের মাঝে অন্যতম একজন লর্ড সলী যুকারম্যান এই বিষয়টির উপর বছরের পর বছর গবেষনা চালিয়েছেন, বিশেষ করে অষ্ট্রেলোপিথেকাসের উপর ১৫ বছর ধরে কাজ করার পর নিজে একজন বিবর্তনবাদী হয়েও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, “সত্যি বলতে কি, বানর সদৃশ প্রাণী থেকে মানুষ পর্যন্ত বিস্তৃত কোন বংশ তালিকার অস্তিত্ব নেই ।”

যুকারম্যান একটি আকর্ষণীয় “বিজ্ঞানের পরিসরও” তৈরী করেছিলেন। তার মতে যা সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক তা থেকে শুরু করে যা সবচেয়ে অবৈজ্ঞানিক সে পর্যন্ত বিস্তৃত এই পরিসরটি তিনি গঠন করেন। এই পরিসরের প্রথম সারিতে থাকে সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো অর্থাৎ রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান-যেগুলো কিনা বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ডাটা ফিল্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলোর পর আসে জীব সম্পর্কিত বিজ্ঞান এবং তারপর সমাজ বিজ্ঞান। এই পরিসরের একদম শেষের দিকে আসে সবচেয়ে অবৈজ্ঞানিক বলে ধারণা করা হয় যে অংশগুলোকে, যেগুলো হলো: “অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় উপলব্ধি” যেমন টেলিপ্যাথি ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবং পরিশেষে আসে “মানব বিবর্তন” । যুকারম্যান তার যুক্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে :

আমরা তখন ঠিক বস্তুনিষ্ঠ সত্যের তালিকা থেকে অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় উপলব্ধি কিংবা মানুষের ফসিলের ইতিহাসের ব্যাখ্যার মতো অনুমান নির্ভর জীব বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর দিকে সরে যাই, যেখানে একজন বিশ্বাসী [বিবর্তনবাদী] লোকের কাছে সবকিছুই সম্ভব বলে বিবেচিত হয়-আর যেখানে [বিবর্তনে] অতি ভক্তরা কখনো কখনো একই সময়ে পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন ব্যাপারও বিশ্বাস করতে সক্ষম হয় ।

মানবজাতির বিবর্তনের গল্প গুটিকয়েক অন্ধ বিবর্তনবাদ ভক্ত ব্যক্তি কর্তৃক মাটি খুঁড়ে তুলে আনা ফসিলের পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যাই দিয়েছে শুধু, কোন সফলতা খুঁজে পায়নি ।

চক্ষু ও কর্ণের টেকনোলজী

চোখ ও কানের অসাধারণ উপলব্ধি ক্ষমতা হলো আরেকটি বিষয়-যা সম্পর্কে বিবর্তন থিওরী নিরুত্তর থেকে যায় ।

চক্ষু সম্পর্কিত বিষয়ে যাওয়ার আগে চলুন, “আমরা কি প্রক্রিয়ায় দেখতে পারি ?”-এই প্রশ্নটির একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রদান করি। কোন একটি বস্তু হতে আগত আলোক রশ্মি চোখের রেটিনার (অক্ষি গোলকের সর্ব পিছনের স্তর) উপর গিয়ে ঠিক উল্টোভাবে পতিত হয়। এখানে পতিত আলোক রশ্মিগুলো কিছু কোষের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তরিত-হয় এবং পরে তারা “দৃষ্টির কেন্দ্র” নামে মস্তিস্কের পশ্চাৎদিকের একটি ছোট এলাকায় গিয়ে পৌচ্ছে। মস্তিস্কের-কেন্দ্রে এই ইলেকট্রিক সিগন্যাল গুলো বিভিন্ন ধারাবাহিক পরিবর্তনের পর একটি ইমেজ বা প্রতিবিম্ব হিসেবে গৃহীত হয়। চলুন, এই টেকনিক্যাল পটভূমি সম্পর্কে আমরা কিছু চিন্তা ভাবনা করে দেখি।

মস্তিষ্ক আলো থেকে সম্পূর্ণ রূপে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তার মানে হলো যে, মস্তিস্কের-ভিতর ভাগটা ঘন অন্ধকার আর যে জায়গাটিতে মস্তিস্ক থাকে সেখানে আলোক পৌছে না। “দর্শনের কেন্দ্র” নামক স্থানটি একটি ঘন অন্ধকার জায়গা যেখানে কখনো আলো পৌছে না; এমনকি এটি আপনার জানা সমস্ত জায়গা সমূহের মাঝে সবচেয়ে অন্ধকার জায়গাও হতে পারে। যাই হোক, আপনি এই ঘন কালো অন্ধকারের মাঝেই একটি উজ্জ্বল আলোকিত জগৎ দেখতে পান।

চোখে তৈরী ইমেজ এত তীক্ষ্ম ও পরিষ্কার যে এমনকি বিংশ শতাব্দীর টেকনোলজিও তা অর্জন করতে সক্ষম হতে পারেনি। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আপনি আপনার বইটির দিকে তাকান, যে হাতগুলো দিয়ে বইটি ধরে আছেন সেগুলোর দিকেও তাকান, তারপর আপনার মাথা উঠিয়ে আপনার চার পাশে লক্ষ্য করুন। আপনি কি কখনো অন্য কোথাও এটির মতো এমন তীক্ষ্ম ও স্বচ্ছ ইমেজ দেখেছেন ? এমনকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নির্মাতাদের তৈরী সবচেয়ে প্রাগ্রসর টেলিভিশন পর্দাও আপনার জন্য এমনতর তীক্ষ্ম ইমেজ তৈরী করতে পারে না। এটি হলো ত্রিমাত্রিক, রঙ্গিন আর অত্যন্ত স্পষ্ট ইমেজ। একশ বছরেরও বেশী সময় ধরে এমনতর স্বচ্ছতা অর্জন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়র। কারখানা, বড় বড় জায়গা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অনেক গবেষনা করা হয়েছে, এই উদ্দেশ্যে বহু পরিকল্পনা ও ডিজাইন করা হয়েছে। আবার টি.ভি. পর্দা এবং আপনার হাতে ধরা বইটির দিকে তাকান। তীক্ষ্মতা ও স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে আপনি বিরাট এক পার্থক্য খুঁজে পাবেন। অধিকন্তু, টেলিভিশন পর্দা আপনাকে দ্বিমাত্রিক ছবি প্রদর্শন করে, যেখানে আপনার চোখ দিয়ে গভীরতাসহ একটি ত্রিমাত্রিক ছবি আপনি দেখতে পান।

বহু বছর ধরে হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার একটি ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন তৈরীর আর চোখের সমান দর্শন গুণ অর্জনের চেষ্টা চালা‪চ্ছেন। হ্যাঁ, তারা ত্রিমাত্রিক একটি টেলিভিশন সিস্টেম আবিষ্কার করেছেন বটে; তবে তা একটি কৃত্রিম ত্রিমাত্রা মাত্র। পশ্চাৎপটটি অধিকতর ঘোলাটে, পুরোভূমিটি একটি পেপার সেটিং এর মতো দেখা যায়। চোখের ন্যায় স্বচ্ছ আর পরিষ্কার ছবি তৈরী করা কখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি। ক্যামেরা ও টেলিভিশন উভয় ক্ষেত্রেই ইমেজ কোয়ালিটি হ্রাস পেয়েছে।

যে পদ্ধতিটি এই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ছবি তৈরী করে তা হঠাৎ করেই গঠিত হয়েছে বলে বিবর্তনবাদীগণ দাবী করেন। এখন যদি কেউ আপনাকে বলেন যে আপনার কক্ষের টেলিভিশনটি আকস্মিক সম্ভাবনার একটি ফলাফল, এর সমস্ত পরমাণুগুলো হঠাৎ করেই এক সঙ্গে আসতে লাগল আর ইমেজ তৈরী করার এই যন্ত্রটি তৈরী করল, আপনি কি ভাববেন ? হাজারো লোক যা পারে না, তা কিভাবে পরমাণুগুলো সম্পন্ন করতে পারে ?

যে যন্ত্র চোখের তৈরী ছবির তুলনায় সাদামাটা সেকেলে ছবি তেরী করে তা যদি যুগপৎ সম্ভাবনায় তৈরী না হতে পারে তাহলে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, চোখ এবং চোখ দ্বারা দৃষ্ট ছবি হঠাৎ করেই সৃষ্টি হতে পারতো না। কানের বেলায়ও একই পরিস্থিতি খাটে। বহিঃকর্ণ অরিকলের মাধ্যমে শব্দ গ্রহন করে তা মধ্যকর্ণের দিকে পরিচালিত করে; মধ্যকর্ণ শব্দ কম্পনকে আরো তীব্রতর করে অন্তঃকর্ণে প্রেরণ করে; অন্তঃকর্ণ এই শব্দ কম্পনগুলোকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে পরিণত করে মস্তিস্কে পাঠায়। ঠিক চোখের মতোই মস্তিস্কের-শ্রবণ কেন্দ্রে শ্রবণ কাজটি সম্পন্ন হয়।

চোখের পরিস্থিতিটি কানের বেলায়ও সত্য। অর্থাৎ ব্রেইন যেমন শব্দ থেকে সংরক্ষিত, ঠিক তেমনি করে আলো থেকেও সংরক্ষিত : কোন প্রকার শব্দকে তা ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না। সুতরাং বহির্জগৎ যতোই কোলাহলপূর্ণ হোক না কেন, মস্তিস্কের-ভেতরভাগে সম্পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করে। তথাপি তীক্ষ্মতম শব্দগুলো মস্তিস্কের-ভেতরেই উপলব্ধি করা হয়। শব্দ থেকে সংরক্ষিত আপনার এই মস্তিস্কে আপনি শুনতে পান অর্কেষ্ট্রার ঐকতান আর জনবহুল জায়গার সমস্ত শব্দই আপনার মস্তিস্ক শ্রবণ করে। অবশ্য যদি ঠিক সেই মুহূর্তে কোন সঠিক যন্ত্র দিয়ে আপনার মস্তিস্কের-শব্দ মাত্রা মেপে দেখা হতো তবে দেখা যেতো যে ঐ এলাকায় পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করছে।

ঠিক চিত্রকল্পের বেলায় যেমনটি হয়েছে, তেমনি মূল শব্দের ন্যায় যথাযথ শব্দের উৎপাদন আর পুণরুৎপাদনের চেষ্টায় দশক দশকের সাধনা ব্যয় করা হয়েছে। এ সমস্ত প্রচেষ্টারই ফলাফল হলো-সাউন্ড রেকর্ডার, হাই ফাই আর শব্দের অর্থ বুঝার সিস্টেম। সমস্ত টেকনোলজীর প্রয়োগ,আর এই প্রচেষ্টায় সহস্র সহস্র ইঞ্জিনিয়ার আর এক্সপার্টগণ কাজ চালিয়ে যাওয়া সত্বেও মানুষের-কান দিয়ে শ্রুত শব্দের সমান তীক্ষ্মতা ও স্পষ্টতাসম্পন্ন শব্দ তৈরী করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। মিউজিক ইনডাষ্ট্রিতে সবচেয়ে বৃহৎ কোম্পানিগুলোর তৈরী সবচেয়ে উঁচু মানের গুণসম্পন্ন হাইফাইগুলোর কথা ভাবুন । এমনকি এই যন্ত্রগুলোয় যখন শব্দ রেকর্ড করা হয় তখন শব্দের কিছু গুণ হারিয়ে যায়; কিংবা যখন আপনি হাইফাই টি অন করেন, তখন মিউজিক শুরু হওয়ার আগে হিস্ হিস্ শব্দ শুনতে পাবেন। যাই হোক, মানব দেহের টেকনোলজীর মাধ্যমে উৎপন্ন শব্দগুলো অত্যন্ত তীক্ষ্ম আর পরিষ্কার। মানুষের কান কখনো শব্দ শোনার সময় হাইফাই এর মতো হিস্ হিস্ শব্দ কিংবা আবহতড়িৎ জনিত পট্ পট্ শব্দ শোনে না; মানুষের কান শব্দটি স্বাভাবিকভাবে যেমন ঠিক তেমনিরূপে শুনে থাকে, ঠিক তেমনি তীক্ষ্ম আর স্বচ্ছ। মানুষের জন্ম লগ্ন হতে এটা এমনিভাবেই হয়ে আসছে।

এ পর্যন্ত, সেন্সরি ডাটা উপলব্ধির ব্যাপারে মানুষের কান ও চোখ যেমন সুবেদী (সুক্ষ্ম পরিবর্তন ধরতে সক্ষম) আর সফল, মানুষ তেমনতর কোন দৃষ্টি সম্বন্ধীয় কিংবা কোন রেকর্ডিং যন্ত্র তৈরী করতে সক্ষম হয়নি।

যাই হোক, দর্শন আর শ্রবণের ব্যাপারে সমস্ত কিছুর বাইরেও এক বিরাট সত্য নিহিত রয়েছে ।

মস্তিস্কের ভেতর কে মোহময় পৃথিবী দর্শন করে, কে শোনে ঐকতান আর পাখির কিচির মিচির, আর কেইবা গোলাপের সুবাস নেয় ?

মানুষের চোখ, কান আর নাক থেকে আগত উত্তেজনা বা উদ্দীপনা ভ্রমন করে বৈদ্যুতিক রাসায়নিক স্নায়বীয় তারণা হিসেবে মস্তিস্কে গিয়ে পৌছে। কিভাবে মস্তিস্কে এই ইমেজগুলো তৈরী হয় এ সম্পর্কে বহুবিধ বর্ণনা আপনি বায়োলজী, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিষ্ট্রি বইতে খুঁজে পাবেন। কিন্তু আপনি কখনও এ বিষয়টি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য খুঁজে পাবেন না : কে সেই জন যে মস্তিস্কে এই বৈদ্যুতিক রাসায়নিক স্নায়বীয় উত্তেজনাগুলোকে ছবি, শব্দ, ঘ্রাণ কিংবা স্নায়বীয় ঘটনা হিসেবে উপলব্ধি করে থাকে ? মস্তিস্কের ভেতরে একটি চেতনা থাকে, যে চোখ, কান, নাকের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই সমস্ত জিনিস উপলব্ধি করে থাকে। এই চেতনাটি আসলে কার ? কোন সন্দেহ নেই যে, এটি মস্তিস্ক গঠনকারী নার্ভ বা স্নায়ু, চর্বি স্তর কিংবা স্নায়ু কোষের নয়। এ কারণেই ডারউইন সমর্থক বস্তুবাদীগণ-যারা সবকিছু বস্তু দিয়ে তৈরী বলে বিশ্বাস করেন, তারা কখনও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন না।

এই সচেতনতাবোধটি আসলে আত্মা বা স্পিরিটের-যাকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। ছবি দেখার জন্য আত্মাটির চোখ লাগেনা কিংবা শব্দ শুনতে কানের দরকার পড়ে না। উপরন্ত, চিন্তা ভাবনা করতে তার কোন মস্তিস্কের-দরকার হয় না।

যিনিই এই স্পষ্ট ও বৈজ্ঞানিক সত্যটি পড়বেন, তারই উচিত হবে আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করা, তাঁকেই ভয় করা, আর তারঁই কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। তিনিই মস্তিস্কের-মাত্র কয়েক ঘন সেন্টিমিটার আয়তনের আলকাতরা কালো জায়গটিতে সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মান্ড কে ত্রিমাত্রিক, বর্ণিল, ছায়াময় আর আলোকোজ্জ্বল রূপে সংকুচিত ও ছোট করে আনেন ।

বস্তুবাদী বিশ্বাস

এতক্ষণ আমরা যে তথ্য উপস্থাপন করেছি, তা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিবর্তন থিওরী এমনি একটি দাবী, যার সঙ্গে বৈজ্ঞানিকদের পাওয়া তথ্যের স্পষ্টভাবেই কোন সাদৃশ্য নেই। প্রাণীর উৎপত্তি সম্পর্কে থিওরীটির দাবী বিজ্ঞানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এর প্রস্তাবিত বিবর্তনের পদ্ধতিগুলোর বিবর্তন ঘটানোর কোন ক্ষমতাই নেই, আর ফসিলগুলো প্রমাণ করছে যে, মতবাদটির জন্য প্রয়োজনীয় অন্তর্বর্তীকালীন আকার বা গঠনের কোন প্রাণী কখনও বিদ্যমান ছিল না; তাই বিবর্তন থিওরীকে অবৈজ্ঞানিক ডাটা বলে পরিত্যাগ করাই বাস্তব । এমনভাবে তা করা উচিত যেমনভাবে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মান্ডের মডেলটি বিজ্ঞানের আলোচ্য সূচী হতে বাদ দেয়া হয়েছে ।

কিন্তু তবুও বিজ্ঞানের আলোচ্যসূচীতে বিবর্তন মতবাদকে সাগ্রহেই বহাল রাখা হচ্ছে। কিছু কিছু লোক এমনকি থিওরীটির সমালোচনা গুলোকে “বিজ্ঞানের প্রতি আক্রমন” হিসাবে উপস্থাপনার প্রয়াস চালায় । কিন্তু কেন?

কারণটি হলো, বিবর্তন মতবাদ একই সূত্রে গাঁথা (একই মতালম্বী) কিছু লোকের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় অন্ধ বিশ্বাস। এরা অন্ধভাবে বস্তুবাদ দর্শনের অনুরক্ত, আর তারা ডারউইনবাদকে এজন্য সমর্থন করে কেননা এটাই একমাত্র বস্তুবাদী ব্যাখ্যা যা প্রকৃতিতে ব্যবহারের জন্য সহজেই পেশ করা যায়।

যথেষ্ট কৌতুহলের ব্যাপার যে, তারা আবার সময়ে সময়ে এ সত্যটি স্বীকারও করে থাকে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একজন প্রখ্যাত জীন তত্ত্ববিদ, খোলাখুলি বিবর্তনবাদী হিসেবে পরিচিত, রিচার্ড সি. লিওনটিন স্বীকার করেছেন যে তিনি “সর্বাগ্রে একজন বস্তুবাদী এবং তারপর একজন বিজ্ঞানী”। তিনি বলেন :

এটা এমন নয় যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠান আমাদেরকে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীর বস্তুবাদ ব্যাখ্যা গ্রহনে কোন ভাবে বাধ্য করেছে, বরং, উল্টো, পার্থিব জিনিসের প্রতি আমাদের নিজেদের প্রধান মোহ থাকার কারণে আমরা কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার সরঞ্জাম ও কিছু ধারণার সেট তৈরী করতে বাধ্য হয়েছি যেগুলো বস্তুগত ব্যাখ্যা প্রদান করে, তা যতোই হোক অন্তর্জ্ঞানের পরিপন্থী কিংবা যতোই ধাঁধাঁ লাগানো হোক তা অদিক্ষীতদের জন্য-তাতে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। অধিকন্তু বস্তুবাদই আসল ও সবকিছ, তাই আমরা আমাদের দোরগোড়ায় স্বর্গীয় পদচারণা মেনে নিতে পারি না।”

এই সুস্পষ্ট বক্তব্যগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, শুধুমাত্র বস্তুবাদ দর্শনে আসক্ত থাকার কারণেই ডারউইনবাদ নামক এক ধরণের অন্ধ বিশ্বাসকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই বিশ্বাসটি এটাই বলতে চায় যে, “বস্তু ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই ”। তাই এই মতবাদে তর্ক করে বলা হয় যে, “জড় ও অচেতন বস্তু থেকেই প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে” ।

পাখি, মাছ, জিরাফ, বাঘ, পোকামাকড়, বৃক্ষ, ফুল, তিমি ও মানবজাতি-এ ধরণের মিলিয়ন মিলিয়ন প্রজাতিসমূহ জড় পদার্থ থেকে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, যেমন বৃষ্টিধারা ,বজ্রপাত ইত্যারি ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছে-এটাই জোর দিয়ে প্রচার করে যাচ্ছে মতবাদটি। এটা যুক্তি ও বিজ্ঞান উভয়ের পরিপন্থি এক ধরণের অনুশাসন। তথাপি, ডারউইনবাদীগণ এ মতবাদটি সমর্থন করেই যাচ্ছে যেন তাদের “দোরগোড়ায় স্বর্গীয় পদচারনা মেনে নিতে” না হয়।

যারা বস্তুবাদে পক্ষপাত নিয়ে প্রাণের উৎপত্তি বিষয়টির দিকে দৃষ্টিপাত না করবেন তারাই এই পরিষ্কার সত্যটুকু দেখতে পারবেন : সকল জীব একজন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কর্ম, যিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী এবং সবজান্তা। এই স্রষ্টাই হলেন আল্লাহ-যিনি অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে বিশ্ব চরাচর সৃষ্টি করেছেন, এর ডিজাইন করেছেন অত্যন্ত নিখুঁতরূপে আর সকল জীবের আকার দিয়েছেন।

তারা বলল : আপনি পবিত্র। আপনি যা আমাদের শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই নিশ্চয়ই আপনি প্রকৃত জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়।

 

চৌদ্দশত বছর পূর্বে আল্লাহ সোবহানাল্লাহু তাআলা মানবজাতির পথচালিকা স্বরূপ কোরআন প্রেরণ করেছিলেন। এ স্বর্গীয় গ্রন্থখানা দৃঢ়ভাবে সমর্থন আর অনুসরণ করে মানবজাতি যেন সঠিক পথে পরিচালিত হয় এ আহ্বান করেছিলেন তিনি। নাযিল হওয়ার দিন থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত এ স্বর্গীয় আর সর্বশেষ বইখানা মানবজাতির জন্য একমাত্র পথচালিকা হিসেবে থেকে যাবে।

পবিত্র কোরআনের অসমকক্ষ আর অতুলনীয় রচনাশৈলী এবং এর মাঝে বিদ্যমান প্রকৃষ্ট, গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞানই সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে এটি মহান আল্লাহ তাআলার বাণী। এ ছাড়াও কোরআনের এমন বহু অলৌকিক বৈশিষ্ট্যাবলী রয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে যে এটি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলারই নাযিলকৃত গ্রন্থ। এ সমস্ত গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যাদির একটি হলো অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক যথার্থতা বা সত্যতা আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল-যেগুলো কিনা আমরা সেদিন বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিমালা দিয়ে আবিষ্কার বা সন্ধান করতে সক্ষম হয়েছি।-অবশ্যই কোরআন কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ নয়। কিন্তু এরপরও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু বিষয়াদি এ গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত রূপে ও সারগর্ভ হিসেবে বর্ণিত রয়েছে-যেগুলো বিংশ শতাব্দীর টেকনোলজী বা প্রযুক্তির মাধ্যমে কেবল সেদিন মানব জাতির সমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে। কোরআন যখন নাযিল হয়, সে সময় এ বিষয়গুলো ছিল অজানা, এটি আরো প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহর বাণী।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)