নারী বৈষম্য এবং ইসলাম
বলা হয়ে থাকে ইসলাম হচ্ছে মানবতা এবং মানবজাতির কল্যাণ ও মঙ্গলের সাথে সংশ্লিষ্ট মূল্যবোধের প্রতিশব্দ। এই ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে এবং তাদের সত্যিকার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছে।
নারীদেরকে একটি পরিবারের ভিত্তিপ্রস্তর বলে বিবেচনা করা হয়। সদগুণসম্পন্ন একজন নারী পরিবার গঠনে সহায়তা করে থাকে। আর একটি সদগুণবিশিষ্ট পরিবার একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। ইসলামে তাই মায়েদের গঠনমূলক ভূমিকা পালনের বিষয়টি সবসময়ই স্বীকৃত। এর সর্বোত্তম নমুনা হচ্ছেন হযরত ফাতিমা তুয যাহরা (আ.)। তাই তাঁর জন্মদিনটিকে ইরানে ‘মাতৃ দিবস’ ও নারী দিবস’ হিসাবে উদ্যাপন করা হয়।
মহানবী (সা.)-এর উন্নত চরিত্রবিশিষ্ট কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) ছিলেন একজন আদর্শ নারী এবং সকল বিবেচনায় পরিপূর্ণ নৈতিক গুণ ও উৎকর্ষের প্রতীক। তাঁর গুণ ও উৎকর্ষ মুসলিম মহিলাদেরকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে একটি সত্যিকার অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকে। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর সাথে তাঁর আদর্শ বৈবাহিক জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত একটি চমৎকার শিক্ষা বিদ্যমান। ইসলামে একটি ন্যায়সঙ্গত সমীকরণের ভিত্তিতে স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্য সুনির্ধারিত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘নারীদের তেমনই ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের ওপর পুরুষদের।’ (সূরা বাকারা : ২২৮) কুরআন মজীদে আরো বলা হয়েছে : ‘তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যে স্থানে বাস কর তাদেরকেও সে স্থানে বাস করতে দিও; তাদেরকে উত্যক্ত করো না সংকটে ফেলার জন্য, তারা গর্ভবতী হয়ে থাকলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাদের জন্য ব্যয় করবে, যদি তারা তোমাদের সন্তানদেরকে স্তন্য দান করে তবে তাদেরকে পারিশ্রমিক দিবে এবং সন্তানের কল্যাণ সম্পর্কে তোমরা সঙ্গতভাবে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করবে; তোমরা যদি নিজ নিজ দাবিতে অনমনীয় হও তাহলে অন্য নারী তার পক্ষে স্তন্য দান করবে। বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে।’ (সূরা তালাক : ৬ ও ৭)
পবিত্র কুরআন নারী সমাজের মর্যাদার ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন সাধন করে তদানীন্তন আরব জাহেলিয়াত (অজ্ঞতার যুগ) ও অন্যান্য সমাজের শৃঙ্খল থেকে তাদেরকে মুক্তিদান করে। তদানীন্তন রোমান, পারসিক, ভারতীয়, চীনা এবং অন্যান্য সমাজে নারীদেরকে কেবল একটি অস্থাবর সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা হতো। ইহুদি ও খ্রিস্ট সমাজ নারীকে সকল মন্দের উৎস বলে বিবেচনা করত। নারীদের দুর্দশা বৃদ্ধিতে খ্রিস্ট আইন চির কৌমার্য ও একগামিতার মতো অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক বিধান প্রবর্তন করেছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির বর্তমান চরম বিশৃঙ্খলাকে এসবেরই প্রতিক্রিয়া বলে ব্যাখ্যা করা যায়। এর ফলে নারীরা ফুটন্ত কড়াই থেকে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
মধ্যযুগে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে যখন মহিলারা নাগরিক অধিকার ভোগ করছিল এবং বিশিষ্ট স্থানে উন্নীত হয়েছিল ঠিক সে সময় তারা ইউরোপীয় চার্চের আদেশে দগ্ধীভূত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে নির্দোষ যৌন অধিকারকে কিভাবে অস্বীকার করা হয় নিম্নোল্লিখিত ইংরেজি শ্লোক থেকে তা অনুধাবন করা যায় : ‘কুকুর, নারী ও আখরোট গাছে/ তুমি যত বেশি কামড় দাও ততই ভালো।’
এই কুসংস্কার অব্যাহত রয়েছে বর্তমান দিনগুলোতে। পশ্চিমা সংস্কৃতির শিল্পকৌশলে তা এক কলংক হিসাবে বিরাজ করছে। আজকের পশ্চিমা ও ধর্মহীন সমাজে নারী অধিকার সম্পর্কে বহু সনদ ও ঘোষণা থাক সত্ত্বেও স্ত্রী প্রহার, বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে এবং অন্যান্য অসৎ উদ্দেশ্যে তাদেরকে ব্যবহার করা একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যিকার অর্থে, পশ্চিমা জগতে তথাকথিত ‘নারী মুক্তি আন্দোলন’ এর কারণ হলো ঐসব সমাজে যুগ যুগ থেকে চলে আসা অবাধ যৌনাচারের কুঅভ্যাস এবং নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি ইনসাফ করার পরিবর্তে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করে একটি বিকৃতি ও বিপথগামিতা সংরক্ষণ করা।
একটি প্রকৃত ইসলামী সমাজে নারী মুক্তির প্রশ্ন কখনই উত্থিত হয় না। কেননা, ইসলাম পুরুষকে মুক্তি দেয়ার দিন থেকেই নারীকে মুক্তিদানের ব্যবস্থা করেছে। ইসলাম তাদের স্ব স্ব জৈবিক যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্যের সৌহার্দমূলক কাঠামোর আওতায় তাদের অধিকার বিবৃত করে উভয়কেই সকল প্রকার সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছে। এটি কেবল কোন তত্ত্ব নয়। মহানবী (সা.) এবং তাঁর আহলে বাইত এ ব্যাপারে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে গেছেন। সকল যুগের ঈমানদার মুসলিম নারী-পুরুষ তা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে থাকে।
আজকাল কিছু কিছু সমাজের নারীরা আঁটসাঁট পোশাক পরে চলাফেরা করতে পারে, পানশালা ও ক্লাবে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে, ইচ্ছামাফিক পান করতে এবং পছন্দমতো ডিসকো নাচে অংশ নিতে পারে এবং যে কারো সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এমনকি তারা বাণিজ্যিক পণ্যের বাজার উন্নতির জন্য দেহ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে। এক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যের কথা হলো যে, এই ধরনের নারীদেরকে স্বাধীন বা মুক্ত নারী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এসব সমাজের আইন ঐসব নারীকে তাদের কুঅভ্যাস থেকে ফেরানোর পরিবর্তে তাদের মধ্যে আরো সামাজিক ব্যাধির বিস্তার ঘটায় এবং অসুস্থতা সৃষ্টি করে। এর ফল হিসাবেই মরণব্যাধি এইড্স বিস্তার লাভ করে এবং মাতৃকেন্দ্রিক একক পরিবার গড়ে ওঠে।
ইসলামে নারীদের স্বাধীনতার ধারণা এসব তথাকথিত সহনশীল সমাজের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত, মহান ও মর্যাদাপূর্ণ। অথচ কপট পশ্চিমা জগৎ মহিলাদের সম্ভ্রম রক্ষাকারী এবং অবমাননা থেকে নিরাপত্তা দানকারী ইসলামী আইন-কানুন এবং বিশেষত শালীন পোশাক ও উদ্দেশ্যের পরিশুদ্ধতার নীতিকে প্রায়শই সমালোচনা করে থাকে। কিন্তু মনে রাখা আবশ্যক যে, নারী-পুরুষের সমতার অর্থ এ নয় যে, নারীকে পুরুষের মতোই আচরণ করতে হবে বা তাদের কামজ সুরের সাথে নাচতে হবে। কারণ, এটি হবে নিজস্ব নারীত্বের কাছে নিজের হীনমন্যতা।
প্রকৃতপক্ষে একজন স্বাধীন নারী সবসময় সুন্দর ও শালীন পোশাক পরিধান করে। কোন মহিলাকেই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বলা যাবে না, যদি সে তার খেয়ালি মনের দাসত্ব করে। শালীনতা ও সংযম ইসলামের বিশ্বাসকে মজবুত করে। হিজাব স্বয়ং নারীর জন্য প্রকাশ্যে চলাফেরার সুযোগ সৃষ্টি করে এবং লোভী মানুষের উসকানি ও লাম্পট্য লিপ্সা থেকে রক্ষা করে নারী স্বাধীনতার এক অলৌকিক আভা দান করে। আর এ ধরনের একটি অতি উন্নত মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই পাশ্চাত্যে পারিবারিক বন্ধনকে দুর্বল করার এবং সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। কালামে পাকে বলা হয়েছে : ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে এবং মুমিনদের নারীগণকে বল তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজদিগের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।’ (সূরা আহযাব : ৫৯)
এভাবে একটি ইসলামী সমাজের নারীরা তাদের পাশ্চাত্যের বোনদের তুলনায় অনেক বেশি সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করে থাকে। ইসলামে একজন নারীর প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার, সম্পদের মালিক হওয়ার, তার পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করার এবং মতের মিল না হলে স্বামীকে তালাক দেয়ার অধিকার রয়েছে। অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে তালাক হচ্ছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় অনুমোদিত কাজ।
একজন নারীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো মা হিসাবে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে নৈতিক উৎকর্ষ সম্পন্ন একটি সমাজের ভিত্তি রচনা করা। একমাত্র মায়েরাই তাদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে সন্তানদেরকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে, তাদের ভালোবাসা ও যথার্থ পরিচর্যা সমাজের জন্য অপরিহার্য। মায়েদের তাদের সন্তানদের ওপর অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের সন্তানদের অধিকার রয়েছে তাদের পিতামাতার ওপর। এ মর্মে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে : ‘আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করে কষ্টের সাথে, তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও স্তন ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস।’ (সূরা আহকাফ : ১৫) তাই ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’- মহানবী (সা.)-এর এই উক্তি কোন দিক থেকেই অযৌক্তিক নয়।
ছেলেমেয়েরা তাদের মায়েদের কাছ থেকে ভালো-মন্দ যাই হোক, যে মৌলিক শিক্ষা লাভ করে থাকে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। মহানবী (সা.)-এর পরিবারবর্গ এ ব্যাপারে আমাদের সামনে খুবই চমৎকার উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতিমা (আ.) লালিত হয়েছিলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজা (আ.)-এর কোলে। আবার হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কোলে গড়ে উঠেছিলেন জান্নাতে যুবকদের সর্দার ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.)। আবার হযরত ফাতিমা (আ.) তাঁর অনেক সদগুণ কারবালার বীরাঙ্গনা কন্যা হযরত যায়নাব (আ.)-কে দিয়ে গিয়েছিলেন।
কালামে পাকে বলা হয়েছে : ‘হে নবী! মুমিন নারিগণ যখন তোমার কাছে এসে বাইআত করে এই মর্মে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোন শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, তারা সজ্ঞানে কোন অপবাদ রচনা করে রটাবে না এবং সৎকাজে তোমাকে অমান্য করবে না তখন তাদের বাইআত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা মুমতাহিনা : ১২)
ইসলামে শারীরিক দিক ছাড়া আর কোন দিক থেকে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বিবেচনা করা হয় না। ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ঈমানের পুরস্কার সমান। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘অবশ্য আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ ও রোযা পালনকারী নারী, যৌন অঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও যৌন অঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী- এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।’ (সূরা আহযাব : ৩৫)