হযরত ফাতেমা (সা.আ.) রাসূল (সা.) এর অস্তিত্বের অংশ
নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন। অংশটি থেকে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর নিষ্পাপত্বের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তা কখনই অন্যায় বিষয়ে সন্তুষ্ট ও অন্যায়ভাবে ক্রোধান্বিত হন না বরং তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মানদণ্ড হলো সত্য ও ন্যায়। তাই তিনি হযরত ফাতেমা অযাচিত বা অনুচিত কারণে ক্রোধান্বিত হলে তিনি ক্রোধান্বিত হতে পারেন না যেমনভাবে সত্যনিষ্ঠ বিষয়ে হযরত ফাতেমা সন্তুষ্ট না হলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন না...
রাসূল (সা.) বলেছেন:
«فاطمة بضعة مني من أغضبها أغضبني»
‘ফাতেমা আমার দেহের (অস্তিত্বের) অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো।’
গুরুত্বপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী যে হাদীসটি মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে তা হলো তাঁর পবিত্র দুহিতা ফাতেমা (আ.) সম্পর্কিত। আলোচ্য হাদীসটি ‘হাদীসে বিদআ বা বিজআ’ নামে প্রসিদ্ধ। ধর্মীয় আলোচক ও বিশেষজ্ঞদের এ হাদীসটির উপর গবেষণা করা উচিত যাতে করে মুসলিম উম্মাহ্ তা থেকে উপকৃত হতে পারে। এ সংক্ষিপ্ত লেখনীটি এ উদ্দেশ্যেই উপস্থাপিত হচ্ছে।
হাদীসের বর্ণনা
বুখারী বর্ণনা করেছেন: আবুল ওয়ালিদ, আবু উয়াইনা থেকে এবং তিনি আমর ইবনে দিনার থেকে এবং তিনি ইবনে মুলাইকা থেকে এবং তিনি মিসওয়ার ইবনে মাখরামা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘ফাতেমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো।’১
সহীহ মুসলিমের সঙ্কলক মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ বর্ণনা করেছেন: আবু মুয়াম্মার ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম আল হাযালি, সুফিয়ান থেকে, তিনি ইবনে আবি মুলাইকা থেকে এবং আবি মুলাইকা মিসওয়ার ইবনে মাখরামা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ যে তাকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল।’২
নাসায়ী আহমদ ইবনে শুয়াইব তার ফাজায়েল গ্রন্থে মিসওয়ার ইবনে মাখরামা থেকে বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ যে তাকে ক্রোধান্বিত করল সে আমাকেই ক্রোধান্বিত করলো।’৩
হাকিম স্বীয় সূত্রে মিসওয়ার থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন: ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ। যে তাকে অসন্তুষ্ট করে আমিও তাতে অসন্তুষ্ট হই এবং যা তাকে আনন্দিত করে আমিও তাতে আনন্দিত হই।’৪
হাদীসের অর্থ এবং বিভিন্ন দিক
উল্লিখিত হাদীসগুলি বিভিন্ন শব্দ বিন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এবং তা বিশেষজ্ঞ আলেমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখানে হাদীসের দুটি বাক্যাংশকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজনীয় মনে করছি:
প্রথমটি হলো আমার অংশ বা আমার দেহের অংশ। হাদীসটিতে (বাদআ) বা (বিদআ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে কাসির বলেন: বাদআতুন অর্থ মাংসের অংশ এবং বিদআতুন অর্থ ‘অংশ’। যেহেতু কারো দেহের মাংসের টুকরা তার দেহের বা তার অংশ৫ সেহেতু হাদীসটিকে দেহের অংশ বা অংশ অর্থ করা যায়।
ইবনে মানযুর বলেন: অমুক অমুকের দেহের অংশ এর অর্থ সে তার অনুরূপ। অতঃপর তিনি আলোচ্য হাদীসটিকে উদাহরণ হিসেবে এনেছেন।৬
উপরিউক্ত অর্থে ভিত্তিতে ফাতেমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অংশ। এমন হতে পারে তা রূপক অর্থে সদৃশ বুঝাতে অথবা প্রকৃতই তিনি রাসূল (সা.)-এর অংশ অর্থাৎ হয় তাঁদের দুয়ের মধ্যে বিদ্যমান ওতপ্রোত বা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বুঝাতে তা ব্যবহৃত হয়েছে অথবা বাস্তব সম্পর্ক নির্দেশ করা হয়েছে। বাস্তব সম্পর্ক অর্থ করলে বলতে হবে যেহেতু রাসূলের নূর থেকেই হযরত ফাতিমার উৎপত্তি তাই তাঁরা একই সত্তার অধিকারী।
উভয় ক্ষেত্রেই হাদীসের ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ’ বাক্যটির মধ্যে এ অর্থ নিহিত রয়েছে যে, মহানবী (সা.) ফাতেমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন। কিন্তু তদুপরি হাদীসটিতে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে পরবর্তী বাক্যে তা উল্লেখ করে বিষয়টির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ’ হাদীসটি আমাদের রাসূল (সা.)-এর হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে বলা এ হাদীসটির স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বিভিন্ন সময় তিনি বলেছেন: ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে।’৭
আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী তার ফাজায়েল গ্রন্থে ইমরান ইবনে হুসাইন সূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: নিশ্চয় আলী আমার থেকে এবং আমি আলীর থেকে এবং সে আমার পর সমগ্র মুমিনদের অভিভাবক।৮ তিনি হাবাশী ইবনে জুনাদা আস সুলুলী সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আলী আমার থেকে এবং আলী ব্যতীত কেউ আমার পক্ষ থেকে কোন দায়িত্ব পালন করবে না।’৯ এ জন্যই রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে সূরা তওবার প্রথম কয়েকটি আয়াত প্রচারের দায়িত্ব আলী (আ.) এর ওপরই অর্পণ করেন।
অনুরূপ হাদীস ইবনে আবি শাইবা কুফী, যাহহাক, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজা, তাবারানী, সুয়ূতী, মুত্তাকী হিন্দী ও অন্যান্যরাও বর্ণনা করেছেন।
আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন এ সকল আলেমের –যাদের গ্রন্থ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী– বর্ণনার বিপরীতে নাসিরুদ্দীন আলবানীর হাদীসটিকে দুর্বল বলার যুক্তির প্রতি কর্ণপাত করা যায় না। হাদীসটি দু’একটি সূত্রে দুর্বল হলেও সকল সূত্রে দুর্বল নয় বরং বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি হাদীসটি মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হওয়ার সত্যতাকে প্রমাণ করে। এ কারণেই তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান (বর্ণনাকারীরা সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত কিন্তু স্মরণশক্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে), গারিব (প্রত্যেক স্তরে শুধুমাত্র একজন বর্ণনাকারী বিদ্যমান) ও সহীহ (বর্ণনাকারীরা সকলেই সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং স্মরণশক্তির ক্ষেত্রেও দুর্বলতা নেই এবং হাদীসটি ত্র"টিমুক্ত ও বিরল বলে গণ্য নয়)।১০
হাদীসটি গারিব হওয়ার বিষয়টি তার সত্যতার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না। যেহেতু আহলে সুন্নাতের সংজ্ঞা মত হাদীসের বর্ণনা ধারায় কোন একটি স্তরে যদি বর্ণনাকারীর সংখ্যা এক হয়ে থাকে তাও গারিব হাদীসের অন্তুর্ভুক্ত১১ সেহেতু গারিব হাদীসকে সঠিক বলে ধরতে এবং তা গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ সহীহ ও হাসান হাদীসের ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে যেমনটি উপরিউক্ত হাদীসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। তদুপরি যদি আমরা গারিব হওয়ার কারণে কোন হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করি তবে সেক্ষেত্রে সুনানে আবু দাউদ ও দারে কুতনীর মত প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহের অধিকাংশ হাদীসকে গারিব হওয়ার কারণে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
সুতরাং আলোচ্য হাদীসটির ক্ষেত্রে গারিব হওয়া কোন সমস্যা নয়। তাছাড়া আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি গারিব নয়।
আল্লামা মানাভী বলেন: ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে’ মহানবী (সা.)-এর এ হাদীসটির অর্থ হলো আলী বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ভালবাসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত এবং আমিও তার সঙ্গে ঐ সকল ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত। এ কারণেই তিনি এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও সংযুক্তির কথা বলা হয়েছে। আরবদের ভাষায় বিষয়টি এভাবে বলা হয়ে থাকে যে, অমুক অমুকের সাথে এতটা সম্পৃক্ত যে, তারা যেন একে অপরের সাথে একীভূত হয়েছে।১২
যখন কেউ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর মধ্যে বিদ্যমান বৈবাহিত সম্পর্কের বিষয়টিকে দৃষ্টি দিলে লক্ষ্য করবে যে, তাদের মধ্যে এই সম্পর্কটি সকল দিক থেকে পূর্ণ অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে মিল ও সম্পর্ক রয়েছে। যদি কেউ ‘যে আলীকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল’ এবং ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে’ বাণী দুটির পাশে ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ যে তাকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট ছিল’ এবং ‘ফাতেমা আমার অংশ যে তাকে ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট করলো সে আমাকেই ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট করলো’ বাণী দুটিকে মিলিয়ে দেখি তবে পবিত্র কোরআনের ‘আর প্রত্যেক বস্তু আমি সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায় যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’ আয়াতটির সত্যতাই আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে যে, পূর্ণতা ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার দৃষ্টিতেও মহান আল্লাহ্ এরূপ জুড়ি সৃষ্টি করেছেন। সকল ক্ষেত্রেই আলী ও ফাতেমা পরস্পরের জুড়ি ও সমকক্ষ ছিলেন। উপরিউক্ত হাদীসগুলির ‘আমার অংশ’ ও ‘আমার থেকে’ কথাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিশেষ ক্ষেত্রটিকে ব্যতিক্রম করা হয়েছে তা ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্য ও অধিকার প্রযোজ্য। তাই নবুওয়াতের বিষয়টিকে বাদ দিওে বাকী সকল বৈশিষ্ট্য ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার তারা অধিকারী ছিলেন।
নবম হিজরীতে রাসূল (সা.) সূরা তওবার প্রথম কয়েক আয়াত প্রচারের জন্য আবু বকরের নেতৃত্বে হজ দলকে প্রেরণ করলে জিবরাঈল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে বলেন: এ আয়াত আপনি অথবা এমন কেউ যে আপনার থেকে সে ছাড়া কেউ প্রচারের অধিকার রাখে না। তখন রাসূল (সা.) আলীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রেরণ করেন।১৩
একইরূপ ঘটনা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে যখন আবু লুবাবা তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় অনুশোচিত হয়ে তওবার উদ্দেশ্যে নিজেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আল্লাহ্ শপথ করে বলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) যদি এসে তাকে মুক্ত না করেন তিনি ঐ অবস্থায়ই থাকবেন, তার তওবা গৃহীত হলে হযরত ফাতেমা তাকে শৃঙ্খলামুক্ত করতে গেলে তিনি আপত্তি জানান। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন: ‘নিশ্চয় ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ।’ অতঃপর ফাতেমা তার বাঁধন খুলে দেন।১৪
দ্বিতীয়টি হলো যে ফাতেমাকে ক্রোধান্বিত করে সে রাসূলকেই ক্রোধান্বিত করে অর্থাৎ ফাতেমার ক্রোধে রাসূল (সা.) ক্রোধান্বিত হন।
প্রথমে আমরা বাক্যাংশের অর্থ ও অনুরূপ বর্ণনা থেকে তার মধ্যে যে মূল্যবান সম্পদ লুকায়িত রয়েছে তা উদঘাটনের চেষ্টা করব। তিনটি শিরোনামে আমরা আলোচনাটি উপস্থাপন করব।
প্রথমত ফাতেমার ক্রোধে রাসূলের ক্রোধান্বিত হওয়ার বিষয়টি অসংখ্য গ্রন্থে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আমরা মিসওয়ার সূত্রে ইবনে মাখরামা ব্যতীত অন্যান্য সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো তাতে ফাতেমার ক্রোধে এমনকি স্বয়ং আল্লাহ্ ক্রোধান্বিত হন বলে বলা হয়েছে। আমরা এরূপ কয়েকটি বর্ণনা এখানে উদ্ধৃত করছি।
হাকেম তার ‘মুসতাদরাক্’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন: আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব, হাসান ইবনে আলী ইবনে আফফান আল আমেরী থেকে, তিনি কুফার অধিবাসী মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে দুহাইম থেকে তিনি আহমাদ ইবনে হাতিম থেকে, তিনি তার পিতার সূত্রে আলী ইবনে হুসাইন থেকে এবং তিনি তার পিতার সূত্রে আলী ইবনে আবি তালিব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ফাতেমাকে বলেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।১৫
হাকেম এ হাদীসটির টীকাতে বলেন: হাদীসটি সহীহ সূত্রে বর্ণিত কিন্তু বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি। উল্লেখ্য যে, বুখারী ও মুসলিম তাদের সহীহ গ্রন্থে সকল সহীহ হাদীস বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে রচনা করেন নি। (মুকাদ্দাতু সাহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০; ইবনে হাজার আসকালানী, হুদাস সারি, পৃ.৭; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৫৭) এ কারণেই বুখারী তার ‘তারিখুর কাবির’ গ্রন্থে অসংখ্য হাদীসকে সহীহ বলেছেন কিন্তু তার সহীহ গ্রন্থে তা অন্তুর্ভুক্ত করেন নি।
যাহহাক বর্ণনা করেছেন: আবদুল্লাহ্ ইবনে সালিম আলমাফলুয -যিনি সর্বজন প্রশংসিত এক ব্যক্তি ছিলেন- হুসাইন ইবনে যাইদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব থেকে, তিনি উমর ইবনে আলী ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মাদ থেকে, তিনি তার পিতার সূত্রে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) ফাতেমাকে বলেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।১৬
তাবরানী বর্ণনা করেন: মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ আল হাদরামী, আবদুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালিম আল কাবযাজ হতে, তিনি হুসাইন ইবনে যাইদ ইবনে আলী হতে, তিনি আলী ইবনে উমর ইবনে আলী হতে, তিনি জাফর ইবনে মুহাম্মাদ হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি আলী ইবনে হুসাইন হতে, তিনি হুসাইন ইবনে আলী (রা.) হতে, তিনি আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ ফাতেমাকে বলেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।১৭
হাইসামী বলেন : হাদীসটি তাবারানী হাসান সূত্রে বর্ণনা করেছেন।১৮ সালিহ আশশামীও হাদীসটির সনদকে হাসান বলেছেন।১৯
অনেক হাদীসবেত্তার দৃষ্টিতেই হাদীসটি মুস্তাফিজ (বর্ণনাকারীদের প্রতিটি স্তরে তিন অথবা তার অধিক সংখ্যক বর্ণনাকারী রয়েছে) সূত্রে বর্ণিত এবং তার বর্ণনাকারীরা বিশ্বস্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
দ্বিতীয়ত হাদীসের এ অংশটি থেকে প্রমাণিত হয় হযরত ফাতেমাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করা হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ এবং তাকে সন্তুষ্ট করা অপরিহার্য। এমন কি তাঁকে কষ্ট দান ও ক্রোধান্বিত করা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করার শামিল যেমনভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করা মহান প্রতিপালকের রহমতের অন্তুর্ভুক্ত হওয়ার কারণ।
তৃতীয়ত বর্ণিত অংশটি থেকে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর নিষ্পাপত্বের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তা কখনই অন্যায় বিষয়ে সন্তুষ্ট ও অন্যায়ভাবে ক্রোধান্বিত হন না বরং তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মানদণ্ড হলো সত্য ও ন্যায়। তাই তিনি হযরত ফাতেমা অযাচিত বা অনুচিত কারণে ক্রোধান্বিত হলে তিনি ক্রোধান্বিত হতে পারেন না যেমনভাবে সত্যনিষ্ঠ বিষয়ে হযরত ফাতেমা সন্তুষ্ট না হলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন না। সুতরাং যখন বলা হয়েছে আল্লাহ্ নিঃশর্তভাবে ফাতেমা (আ.)-এর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত হন তখন নিঃসন্দেহে বলা যায় হযরত ফাতেমার ক্রোধ, সন্তুষ্টি, আনন্দ ও বিষন্নতা সব সময়ই আল্লাহ্ ক্রোধ ও সন্তুষ্টির অনুগত। তিনি কখনই পার্থিব ও বৈষয়িক কারণে কারো উপর ক্রোধান্বিত বা অন্যায়ভাবে কারো প্রতি সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হন নাই।
এ কারণেই আস সুহাইল আল মালিকী২০ তার ‘আর রাউজুল আনিফ’ গ্রন্থে আবু লুবাবার পূর্বোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেছেন: এ হাদীসটি প্রমাণ করে যে হযরত ফাতেমাকে গালমন্দ করে সে কাফের (কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে) এবং যে তাঁর জন্য দোয়া করে ও তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণ না করে সে তাঁর পিতা প্রতি দরূদ প্রেরণ করেছে।২১
উপরিউক্ত সহীহ হাদীসের আলোচনা থেকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়
১. হযরত ফাতেমা (আ.) যখন কোন ব্যক্তির উপর ক্রোধান্বিত হন তখন মহান আল্লাহ্ও ঐ ব্যক্তির উপর ক্রোধান্বিত হন।
২. যখন মহান আল্লাহ্ কোন ব্যক্তির উপর রাগান্বিত হন তখন নিঃসন্দেহে সে জাহান্নামে পতিত হবে স্বয়ং আল্লাহ্ এ সম্পর্কে বলেন: যার উপর আমার ক্রোধ বর্ষিত হয় নিশ্চয় সে জাহান্নামে পতিত হয়। (সূরা তাহা: ৮১)।
৩. উক্ত আয়াতে ‘জাহান্নাম’ ইঙ্গিত করতে ‘হাওয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাওয়া হলো ঐ স্থান যেখানে উত্তপ্ত অগ্নি রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ সূরা আল কারিআতে বলেছেন: তার (পাপী ব্যক্তির) স্থান হবে ‘হাভিয়া’। এবং কি তোমাকে অবহিত করেছে যে, এটা কি? এটি অতি উত্তপ্ত অগ্নি।
৪. সুতরাং যে হযরত ফাতেমাকে যে কোনভাবেই হোক ক্রোধান্বিত করবে সে অতি উত্তপ্ত অগ্নিতে প্রবেশ করবে। এখন এই ক্রোধান্বিত করা তাঁর সম্পদ ও অধিকার হরণ করার মাধ্যমেই হোক (যেমনটি রাসূলের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ঘটেছে) অথবা তাঁর সন্তানদের হত্যা করার মাধ্যমেই হোক (যেমনটি কারবালায় ইমাম হোসাইন ও তাঁর সন্তানদের ক্ষেত্রে ঘটেছে)।
উক্ত হাদীস থেকে অন্য যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা হলো
প্রথমত যখন হযরত ফাতেমা (আ.) কোন ব্যক্তির উপর সন্তুষ্ট হবেন মহান আল্লাহ্ও তাঁর উপর সন্তুষ্ট হবেন।
দ্বিতীয়ত ‘তাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহ্ প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহ্ দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। (সূরা মুজাদিলা: ২২) –এ আয়াতের ভিত্তিতে যে (হযরত ফাতেমাকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে) মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে সে আল্লাহর দলে অন্তুর্ভুক্ত হবে। অর কিয়ামতের দিন ফেরেশতারা শুধু তাদের জন্যই শাফায়াত (সুপারিশ) করবেন যাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন: ‘তারা (ফেরেশতাগণ) ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যার প্রতি তিনি (আল্লাহ্) সন্তুষ্ট, অন্য কারো জন্য সুপারিশ করবে না।’ (সূরা আম্বিয়া: ২৮)
মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের দেহের অংশ হযরত ফাতেমা যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের অন্তুর্ভুক্ত করুন।
তথ্যসূত্র:
১. সহীহ বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১০, মানাকিবুল মুহাজিরিন ওয়া ফাজাইলুহুম অধ্যায়, দারুল ফিকর প্রকাশনী, বৈরুত, প্রকাশকাল ১৪০১ হিজরী।
২. সহীহ মুসলিম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৪১, দারুল যিকর প্রকাশনা, বৈরুত।
৩. নাসায়ী, ফাজায়েলুল সাহাবা, পৃ. ৭৮, দারুল কুতুব আল ইলমিয়া, বৈরুত।
৪. মুসতাদরাক, আলাস সাহীহাইন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫৮, দারুল যিকর, বৈরুত, ১৩৯৮ হিজরী।
৫. আন নিহায়া ফি গারিবিল হাদীস, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৩, দারুল কুতুব আল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৪২৩ হিজরী।
৬. লিসানুল আরাব, বাদ মূল ধাতু।
৭. হাদীসটি ঐতিহাসিকগণ ও মুহাদ্দিসদের (হাদীস বিশেষজ্ঞদের) অনেকেই বর্ণনা করেছেন। যেমন: তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫১৪; ইবনে আসির, আল কামিল ফিত তারিখ, ইবনে আবিল হাদীদ, শারহে নাহজুল বালাগা, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৮২; তারিখে মাদিনাতে দামেস্ক, হযরত আলীর পরিচিতি পর্বে, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৮-১৫০, আল আগানী, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ১৭। হাদীস গ্রন্থের মধ্যে সহীহ তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৬৩৬, হাদীস নং ৩৭১৯; সুনানে ইবনে মাজা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৪, হাদীস নং ১১৯; আল মুসনাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৬৪, সুয়ূতী, তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৬৯; তাবারানী, আল মোজামুল কাবীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৬; মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া প্রকাশনা, কায়রো, দারু ইহয়িয়াউত তুরাসিল আরাবি ছাপাখানা, বৈরুত।
৮. ফাজায়িলুস সাহাবা, পৃ. ১৫।
৯. প্রাগুক্ত।
১০. তিরমিজী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩০০, গবেষণা ও সম্পাদনা: আবদুর রহমান মুহাম্মদ উসমান, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪৫৩ হিজরী, দারুল যিকর প্রকাশনা, বৈরুত।
১১. ড. আত তাহান, তাইসিরু মুসতালা হিল হাদীস, পৃ. ২৮।
১২. ফাইজুল কাদীর, শারহে জামিউস সাগির, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৭০, সম্পাদনা: আহমাদ আবদুস সালাম, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৫ হিজরী, দারুল কুতুব আল ইলমিয়া প্রকাশনা, বৈরুত।
১৩. মুসনাদে আহমাদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২২, হাদীস নং ১২৯৬, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯; তাফসীরে ইবনে কাসির, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৩, দুররুল মানসুর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৯; মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫১;আল খাসায়েস, পৃ. ২০।
১৪. আবদুর রহমান আস সোহাইলী, আররাউজুল আনিফ ফি শারহিস সিরাতিন্নাবাভীয়া লি ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৮, গবেষণা ও টীকা সংযোজন: আবদুর রহমান ওয়াকিল, দারুল কুতুব আল ইসলামিয়া, কায়রো।
১৫. হাকেম নিশাবুরী, আল মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫৩।
১৬. আল আহাদ ওয়াল মাসানী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৩, গবেষণা: কাসেম ফাইসাল আহমাদ আল জাওয়াবেরা, দারুত দারিয়া, আর রিয়াদ, প্রথম প্রকাশ ১৪১১।
১৭. আল মোজামুল কাবির, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৮, গবেষণা ও সংকলন: হামদী আবদুল মাজিদ আস সালাফী, দ্বিতীয় সংস্করণ, দারু ইহয়িয়াউত তুরাসিল আরাবী ছাপাখানা, বৈরুত।
১৮ . মাজমাউয যাওয়ায়িদ ওয়া মানবাউল ফাওয়ায়িদ, ৯ম খণ্ড, পৃ. ২০৩, দারুল কুতুব, বৈরুত, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৬৭ খৃষ্টাব্দ।
১৯. সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফি সিরাতি খাইরিল ইবাদ, ১১তম খণ্ড, পৃ. ৪৪, দারুল কুতুব আল ইলমিয়া, বৈরুত।
২০. তার পূর্ণ নাম হলো আবদুর রহমান ইবনে আবদুল¬াহ্ ইবনে আহমাদ ইবনে আসরাগ আসখাস আমি আস সুহাইলী আল আন্দালুসী আল মালিকী, তিনি একজন ঐতিহাসিক, হাদীসবিদ, কোরআনের হাফেজ, সাহিত্যিক, ব্যাকরণবিদ ও আভিধানিক ছিলেন তবে তিনি অন্ধ ছিলেন। তিনি ইবনিল আরাবী মালিকী ও অন্যান্যদের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তার বিরল প্রতিভার খ্যাতি মরক্কো পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তাকে শিক্ষা দানের জন্য সেখানে আসতে আহবান জানানো হলে তিনি সেখানে হিজরত করেন তারা তাকে সাদরে গ্রহণ করে।
২১. আর রাওজুল আনিফ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩২৮।