কারবালা ও ইমাম হোসাইন (আ.)- ৩য় পর্ব
হযরত ইমাম হোসাইনের ইরাক অভিমুখে যাত্রা
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) হিজরী ৬০ সালের জিলহজ্বের ৩ তারিখ মঙ্গলবার বর্ণনান্তরে ৮ই জিলহজ্ব বুধবার মুসলিমের মৃত্যূর খবর পাওয়ার আগেই মক্কা থেকে বের হন। কারণ, তিনি যেদিন মক্কাত্যাগ করেন সেদিনই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় শহীদ করা হয় । বর্ণিত আছে, হোসাইন (আ.) ইরাকের উদ্দেশ্য যাত্রা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর জন সমাবেশে দাড়িয়ে বলেন-
“মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলে খোদার প্রতি দরুদ । এরপর তিনি ফরমান, মহান আল্লাহ আদম (আ.) এর সন্তানদের উপর মৃত্যূর দাগ একে দিয়েছেন, যা তাদের জন্য সৌন্দর্য, যেমন যুবতীদের গলায় হারের দাগ (সৌন্দর্য) একে দেয় । আমি আমার পূর্ব পূরুষদের দেখার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি । যেমনি ভাবে হযরত ইউসুফকে দেখার জন্য হযরত উয়াকুব উদগ্রীব ছিলেন । আমার নিহত হওয়ার জন্য একটি ভূখণ্ড নির্ধারিত রয়েছে যেখানে আমি গিয়ে পৌছব। আমি বোধ হয় দেখতে পাচ্ছি যে, মরুভূমির নেকড়েরা নাওয়ামীস ও কারবালার মধ্যবর্তী স্থানে আমার দেহকে টুকরা টুকরা করছে, যাতে তাদের ক্ষুধার্ত পেটগুলোকে সান্তনা দেয় । সত্যিই ভাগ্যের লিখন থেকে পালানো যায়না । মহান আল্লাহ যাতে খুশী আমাদের পরিবারও তাতে খুশী । আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বালা মুসিবত আসে তাতে আমরা ধৈর্য ধারণ করব। তিনি ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করবেন আমরা যে পয়গম্বরে খোদার (সা.)দেহেরই অংশ । আমরা রাসূলে পাক (সা.) থেকে কোন আবস্থাতেই পৃথক হব না । বেহেশতে তার সাথেই থাকব । এভাবেই তার সন্তুষ্টির ভাগী হওয়া যাবে আর আল্লাহ তার রাসূল (সা.) কে যে ওয়াদা দিয়েছেন তা পূর্ণ হবে । যারা আমাদের সাথে জানকে বাজী রেখে লড়তে প্রস্তুত এবং শাহাদত বরণ ও আল্লাহর সাথে মুলাকাতের জন্য উদগ্রীব তারা আমাদের সাথে আসুন, আল্লাহর সাহায্যে আগমীকাল আমরা মক্কা থেকে বের হয়ে যাব ।”
বর্ণিত আছে, আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জাবীর তাবারী ইমামী তার ‘দালায়েলুল ইমামাহ’ গ্রন্থে নিজস্ব বর্ণনা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আবু মুহাম্মদ ওয়াকেদী ও যারারা ইবনে খালাজ বলেছেন যে, হোসাইন (আ.) ইরাকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পূর্বে আমরা তার সাথে সাক্ষাত করে কুফাবাসীর অবহেলা সম্পর্কে তাকে অবহিত করি । তাকে আমরা বলেছি যে, কুফাবাসীর অন্তরসমূহ আপনার সাথে কিন্তু তাদের তরবারীগুলো আপনাকে হত্যার জন্য প্রস্তুত । এ কথা শুনে হোসাইন (আ.) হাত তুলে আকাশের দিকে ইশারা করেন । আসমানের দরজাগুলো খুলে গেল এবং অগনিত ফেরেশতা নাজিল হল-যাদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না । অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর যদি এমন না হত যে, আমার দেহ কারবালা প্রান্তরের নিকটবর্তী হবে, যদি সওয়াব হাতছাড়া হওয়ার ভয় না করতাম তাহলে এই শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে তাদের সাথে লড়াই করতাম । কিন্ত আমি নিশ্চিত যে, আমার ছেলে আলী ছাড়া আমি এবং আমার সকল সঙ্গীদের নিহত হওয়ার স্থান ওখানেই নির্ধারিত ।
মুতায়াম্মার ইবনে মুসান্না মাকতালুল হোসাইন নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, তালবিয়ার দিনগুলো আসার সাথে সাথে আমর ইবনে সাআদ ইবনে আস বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কায় উপনীত হয় । ইয়াজিদের পক্ষ থেকে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় যে, সম্ভব হলে হোসাইনকে যেন হত্যা করে, যদি যুদ্ধ করতে হয় তার সাথে যুদ্ধ করবে । কিন্ত ঐ দিনই ইমাম হোসাইন মক্কা থেকে বেরিয়ে হয়ে যান ।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) হতে বর্ণিত মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া সেই এক রাতে হযরত হোসাইনের খেদমতে উপস্থিত হন, যার পরের দিনই সেখানেই তার যাত্রা করার কথা ছিল । তিনি বললেন- ভাইজান, আপনি জানেন যে, কুফাবাসী আপনার পিতা ও ভাইয়ের সাথে প্রতারণা করেছে । আমি আশংকা করছি তারা আপনার সাথেও প্রতারণা করবে । যদি ভাল মনে করেন মক্কায় থাকুন, কেননা আপনি আতি প্রিয় ও সম্মানিত ব্যাক্তি । তিনি বললেন– আমার ভয় হচ্ছে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া অতর্কিতে আল্লাহর ঘর হেরেমে এসে আমাকে হত্যা করবে এবং এর ফলে আমার দ্বারা আল্লাহর ঘরের মানহানি হবে । মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া বললেন–আপনার যদি এই আশংকা হয়, তাহলে ইয়ামেনের দিকে গমন করুন । কেননা সেখানে আপনি সম্মানিত হবেন । ইয়াজিদও আপনার নাগাল পাবে না । অথবা মরুভূমির কোথাও গিয়ে বসবাস করুন । বললেন-তোমার এই প্রস্তাব আমি চিন্তা করে দেখব ।
হযরত হোসাইনের কাফেলার মক্কা ত্যাগ
রাতের শেষ ভাগে হোসাইন (আ.) মক্কা থেকে যাত্রা করেন । এ সংবাদ মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার কাছে পৌছল । তিনি তাড়াতাড়ি এসে হযরত হোসাইন (আ.)যে উটনীতে সওয়ার ছিলেন, তার লাগাম ধরে বললেন- ভাইজান ! আপনি কি আমাকে ওয়াদা দেননি যে, আমার প্রস্তাব চিন্তা করে দেখবেন । বললেন-হ্যাঁ । জিজ্ঞেস করলেন- তাহলে যাওয়ার জন্য এত তাড়াহুরা করছেন কেন ? ইমাম বললেন- তুমি যাওয়ার পর রাসূল (সা.) আমার কাছে আসেন এবং বলেন-
یا حسین اخرج الی العراق فانّ الله قد ش أ ان یراک قتیلا –
“হে হোসাইন! তুমি ইরাকের দিকে যাও । কেননা, আল্লাহ তোমাকে নিহত হিসাবে দেখতে চান ।” মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া বললেন- انّ لله و انّ الیه راجعون
এখন যে নিহত হওয়ার জন্য যাচ্ছেন, এই মহিলাদের কেন সাথে নিয়ে যাচ্ছেন । হোসাইন (আ.) বললেন- রাসূলে খোদা (সা.)আমাকে বলেছেন যে-
انّ الله قد ش أ ان یراهن سبایا
“মহান আল্লাহ এসব মহিলাকে বন্দিনী হিসেবে দেখতে চান ।” এ অবস্থাতেই মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া তাকে বিদায় দেন এবং চলে যান । মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব কুলাইনি ‘কিতাবে রাসায়েল’ নামক গ্রন্থে হামজা ইবনে হামরান থেকে বর্ণনা করেন যে, আমরা হোসাইন (আ.) এর প্রস্থান এবং মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করছিলাম । ঐ মজলিসে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) উপস্থিত ছিলেন । আমাকে বললেন- হে হামজা; তোমাকে একটা হাদীস বলব । যার ফলে এ মজলিস শেষ হওয়ার পর তুমি মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া সম্পর্কে আমার কাছে কোন কিছু জানতে চাইবে না । সে হাদীস হল- হোসাইন (আ.) মক্কা থেকে যখন রওয়ানা হন তখন একটি কাগজে লিখে দেন-
بسم الله الرحمن الرحیم
হোসাইন ইবনে আলীর পক্ষ হতে বনি হাশিম গোত্রের উদ্দেশ্যে লেখা। অতঃপর যে কেউ আমার সাথে আসবে শাহাদত বরণ করবে, যে ব্যক্তি আসবে না, জয়ী হবে না। ওয়াসসালাম।
হযরত হোসাইন (আ.)তানঈম হয়ে “যাতে আরক” নামক স্থানে উপনীত হন। সেখানে ইরাক হতে আগত বশর ইবনে গালিবের সাথে তার সাক্ষাত হয়। তার কাছে জিজ্ঞেস করলেন-ইরাকের লোকেরা কেমন ? বলল-অন্তরে আপনাকে ভালবাসেন, কিন্তু তাদের তরবারী বনি উমাইয়াদের পক্ষে। তিনি বললেন-ঠিকই বলেছেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তার ইচ্ছাই চুড়ান্ত।
কাফেলা পুনরায় চলে যেতে লাগল । দ্বি-প্রহরের দিকে ছা’লাবার’ বাড়ীতে গিয়ে পৌছল। সেখানে হযরত হোসাইন (আ.) সামান্য ঘুমিয়ে পড়েন। একটু পরেই তিনি সজাগ হয়ে বলেন-এক গায়েবী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, বলছিল যে, আপনারা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন আর মৃত্যু খুব দ্রুত আপনাদেরকে বেহেশতের মাঝে নিয়ে যাচ্ছে। তার ছেলে আলী শুনে বলে উঠল-
یا ابه افلسنا علی الحق ؟ হে পিতা । আমরা কি সত্যের উপর নই? বললেন-খোদোর কসম। নিশ্চয়ই আমরা সত্যের উপর রয়েছি। আলী বলল-
اذن لا نبالی بالموت
“তাহলে আমরা মৃত্যুর মোটেও তোয়াক্কা করি না।” হযরত হোসাইন (আ.)বললেন-প্রিয় বৎস! আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। ঐ রাতে তিনি সা’লাবার বাড়ীতেই অবস্থান করেন।
আবু হিররার সাথে হোসাইন (আ.)-এর সাক্ষাত
খুব ভোরে আবু হিররা নামক এক লোক কুফা হতে এসে পৌছলেন। হযরত হোসাইনকে (আ.) সালাম দিয়ে বললেন-হে রাসূলেন সন্তান। আপনি কেন আল্লাহর হেরেম ও রাসূলে পাকের হেরেম ছেড়ে আসলেন ? বললেন-বনি উমাইয়ারা আমার ধনসম্পদ কেড়ে নিয়েছে। কিছুদিন ধৈর্য ধরেছি, তারা গালি দিয়েছে, সহ্য করেছি। এখন তারা আমাদের রক্ত ঝরাতে চায়, তাই বেরিয়ে এসেছি। খোদার কসম! এই জালিমরা আমাকে হত্যা করবে। তবে মহান আল্লাহ তাদের গায়েই অপমানের পোষাক পরাবেন। প্রতিশোধের তরবারী তাদের উপর উত্থিত করবেন। তাদের উপর এমন লোককে ক্ষমতাসীন করবেন যে, ‘সাবা’ জাতির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মহিলার মত স্বেচ্ছাচারী হবে । একখা বলার পর তিনি সেখান থেকে চলে যান।
হযরত হোসাইনের (আ.) সান্নিধ্যে যুহাইর ইবনে ক্বীন
বনি ফারারা ও বাজিলা গোত্রের কিছু লোক বর্ণনা করেছেন যে, আমরা মক্কা থেকে যুহাইর ইবনে ক্বীনের সঙ্গে বের হই এবং হযরত হোসাইনের (আ.) পেছনে থেকে পথ চলছিলাম । পথিমধ্যে তার পাশাপাশি এসে পৌছলাম। কিন্তু যুহাইর যেহেতু তার সাথে সাক্ষাতের আগ্রহী ছিল না, সেহেতু হযরত হোসাইন (আ.) যেখানে মনযিল(যাত্রা বিরতি) করতেন আমরা তার একটু দুরত্বে মনযিল করতাম। একদিন হযরত হোসাইন (আ.)একস্থানে যাত্রা বিরতি করেন। আমরাও সেখানে যাত্রা বিরতি করতে বাধ্য হই। যখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এমন সময় হযরত হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ হতে এক লোক এসে সালাম দিয়ে-হে যুহাইর ইবনে ক্বীন। হযরত হোসাইন (আ.) আমাকে আপনার কাছে একথা বলার জন্য পাঠিয়েছেন যে-আপনি তার কাছে আসুন। একথা শোনার পর হাত থেকে খাবার পড়ে গেল, চিন্তার সমুদ্রে যেন আমি ডুবে গেলাম।
کان علی رؤسهم الطیر
‘তাদের মাথার উপরে যেন পাখি বসে আছে’-এটি একটি আরবী প্রবাদ। (মানুষ যখন চিন্তায় তন্ময় হয়ে যায় তখনই এ প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়) যুহাইরের স্ত্রী দীলাম বিনতে ওমর বললেন-সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর রাসূলের নাতি তোমাকে ডেকেছেন, এরপরও তুমি যাবে না । তার খেদমতে উপস্থিত হতে তোমার অসুবিধা কি ? তার কথা শুনতে আপত্তি কিসের ? যুহাইর ইবনে ক্বীন উঠে দাড়ালেন এবং হযরত হোসাইনের কাছে গমন করলেন । কিছুক্ষণ পরে সহাস্য বদনে ফিরে এলেন এবং নির্দেশ দিলেন যেন তাবু তুলে নিয়ে হযরত হোসাইন (আ.)এর পাশে তা স্থাপন করা হয়। এরপর যুহাইর তার সাথীদের বললেন, যার ইচ্ছা আমার সাথে আস। নচেত এটাই তোমাদের সাথে আমার শেষ দেখা।
হযরত হোসাইন (আ.)সেখান থেকে রওনা হয়ে যুবালার বাড়ীতে উপনীত হলেন । ওখানে গিয়েই তিনি মুসলিম ইবনে আকীলের শাহাদাত বরণের সংবাদ অবহিত হলেন। তার সঙ্গীরাও সংবাদটি জানতে পারলেন। এরপর যারা পার্থিব নেতৃত্ব কর্তৃত্বের আশায় হোসাইনের (আ.) সাথে এসেছিল তারা ফিরে গেল । কেবল তার পরিবার-পরিজন এবং একান্ত অনুরক্ত সঙ্গীরা রয়ে গেল।মুসলিমের শাহাদতের সংবাদে মাতম উঠল।সবার চোখে অশ্রু প্রবাহিত হল। কিন্তু হযরত হোসাইন (আ.)তো শাহাদতের আশায় ছিলেন অটল অবিচল।
কবি ফরাযদাক৪ হযরত হোসাইনের (আ.)সাথে সাক্ষাত করলেন। বললেন ‘হে নবীদুলাল “যে কুফাবাসী আপনার চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যা করল, তাদের উপর আপনি কিভাবে আস্থা রাখতে পারেন ? হোসাইন (আ.) কেদে দিলেন এবং বললেন-আল্লাহ মুসলিমকে ক্ষমা করুন । চিরন্তন জীবন এবং অনন্ত রোজীর ভাগী হয়েছেন। বেহেশতে প্রবেশ করেছেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেছেন। তিনি তার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন । কিন্তু আমরা এখনো আঞ্জাম দেইনি। এরপর এ কবিতাগুলো আবৃত্তি করলেন-
“পৃথিবী যদিও খুব দামী বলে গণ্য হয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর পক্ষ হতে সওয়াবের মর্যাদা অনেক বেশী। মানুষের দেহ যদি মৃত্যুর জন্যই সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে তরবারীর আঘাতে আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া অতি উত্তম। মানুষের জীবিকা যদি পূর্ব থেকেই বন্টিত ও নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে জীবিকা অর্জনে মানুষ অধিক লোভাতুর না হওয়াই সুন্দর। সম্পদের আহরণ ও সঞ্চয় যদি রেখে চলে যাওয়ার জন্য হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ কেন এমন জিনিস নিয়ে কৃপণতা করে, যা তাকে পেলে চলে যেতে হবে।”
কায়েস ইবনে মাসহার এর শাহাদত
হযরত হোসাইন (আ.)কুফায় সুলাইমান ইবনে সা’দ খাজায়ী, মুসাইয়েব ইবনে নাজিয়া, রেফাআ ইবনে সাদ্দাদ এবং তার একদল অনুসারীর বরাবরে একখানা পত্র লিখলেন এবং কায়েস ইবনে মাসহার সায়দাভীকে দিয়ে তা পাটিয়ে দিলেন, কায়েস কুফার নিকটে পৌছতেই ইবনে যিয়াদের গুপ্তচর হোসাইন ইবনে নুমাইর তাকে দেখতে পান। সে তাকে তল্লাশী করতে চাইল। তিনি হযরত হোসাইন (আ.)-এর চিঠিখানা বের করে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। হোসাইন ইবনে নুমাইর তাকে ইবনে যিয়াদের নিকট নিয়ে গেল। ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করল-তুমি কে? বললেন-আমীরুল মু’মেনীন আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) এবং তার ছেলের অনুসারী। জিজ্ঞেস করল-চিঠি কেন তুমি ছিড়ে ফেলেছ ? কায়েস বললেন-তুমি যাতে চিঠির বিষয়বস্তু অবহিত না হও, তার জন্য। ইবনে যিয়াদ জানতে চাইল-চিঠি কার কার কাছে লেখা হয়েছিল? বললেন-কুফার কিছু অধিবাসীর উদ্দেশ্যে হযরত হোসাইন (আ.) পাঠিয়েছিলেন। যাদের নাম আমার জানা নেই। ইবনে যিয়াদ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল-খোদার কসম! তাদের নাম না বলা পর্যন্ত তোমাকে ছাড়বনা। অথবা বিকল্প পথ হল, মিম্বারে গিয়ে হোসাইন এবং তার বাপ ও ভাইকে গালমন্দ করতে হবে । অন্যথায় তরবারীর আঘাতে তোমাকে টুকরা টুকরা করে ফেলব। কায়েস বললেন-যাদের উদ্দেশ্যে পত্র লেখা হয়েছে, কিছুতেই তাদের নাম তোমাকে বলবনা। তবে মিম্বরে গিয়ে হোসাইন এবং তার পিতার নামে গালমন্দ দিতে প্রস্তুত আছি । এরপর তিনি মসজিদের মিম্বরে আসলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও তারীফ এবং রাসূলে খোদার (সা.) উদ্দেশ্যে দরূদ পাঠালেন । এরপর হযরত আলী ইবনে আবী তালেব (আ.) এবং হাসান ও হোসাইন (আ.) এর জন্য কায়মনোবাক্যে আল্লাহর রহমত কামনা করলেন। এরপর বললেন হে জনতা! আমি হলাম হযরত হোসাইনের (আ.)পক্ষ হতে তোমাদের কাছে প্রেরিত দূত। তিনি এখন অমুক স্থানে অবস্থান করছেন। তোমরা তার দিকে ধাবিত হও এবং তাকে সাহায্য কর। এ সংবাদ ইবনে যিয়াদের কাছে পৌছে গেল । সাথে সাথে হত্যার নির্দেশ দিল। তাকে ‘দারুল ইমারা’ প্রাসাদের ছাদের উপর নিয়ে মাটিতে নিক্ষেপ করা হল। তাতে তিনি শাহাদত বরণ করলেন । হযরত হোসাইনের (আ.) কাছে তার শাহাদতের খবর পৌছার পর খুব কান্নাকাটি করলেন এবং বললেন-আল্লাহ আামাদের অনুসারীদের জন্য একটি ভাল জায়গা নির্বাচন করুন। দয়া করে আমাদেরকে এমন জায়গায় একত্রিত করুন। হে আল্লাহ! তুমি সব কিছুর উপরই কর্তৃত্বশালী, ক্ষমতাবান। বর্ণিত আছে যে, ‘হাজেয’ নামে প্রসিদ্ধ এক লোকের বাড়িতে বসেই চিঠিখানা প্রেরণ করেন। বর্ণনান্তরে ভিন্নমতও রয়েছে।
হযরত হোসাইনের (আ.) সামনে হোর ইবনে এযিদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
হযরত হোসাইন (আ.) আরো অগ্রসর হলেন। কুফা পৌছতে মাত্র দুই মনযিল বাকি। হটাৎ ১০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে হোর বিন এযিদ হযরত হোসাইন (আ.)-এর কাছে উপস্থিত হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-হে হোর! তুমি কি আমাদের সাহায্য করার জন্য এসেছ? নাকি আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য এসেছ? হোর বলল, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতেই এসেছি। হোসাইন (আ.) বললেন-
لا حوْل ولا قُوّة إلاّ باللّه الْعليّ الْعظيم
তখনই দু’জনের মাঝে কথাবার্তা বিনিময় হয়। পরিশেষে হযরত আবু আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.) বললেন-তোমরা যেসব চিঠি পাঠিয়েছ বা তোমাদের দূতেরা যা বলেছে, তোমার এখনকার মত যদি তার বিপরীত হয় তাহলে যেখান থেকে এসেছি, সেখানেই ফিরে যাব। কিন্তু হোর এবং তার সাথীরা হযরত হোসাইন (আ.)-এর প্রত্যাবর্তনে বাধা দিল। হোর বলল, হে রাসূলের সন্তান! এমন কোন পথ বেছে নিন যা কুফায়ও যাবে না মদীনায়ও না। যাতে ইবনে যিয়াদের কাছে কোন কৈফিয়ত দিতে পারি। বলব যে, হোসাইন এমন পথে চলে গেছে যে, তাকে আমি দেখতে পাইনি। হযরত হোসাইন (আ.) বাম দিকের পথটা বেছে নিলেন এবং ‘আজীব হাজানাতে’ উপনীত হলেন। ঐ সময়ই ইবনে যিয়াদের একটি চিঠি হোরের হাতে এসে পৌছল। ঐ চিঠিতে হোরকে হোসাইনের ব্যাপারে তার গৃহিত ব্যবস্থার কারণে কড়া ভাষায় তিরস্কার করা হয় এবং আরো কঠোরতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়।
হোর ও তার সাথীরা, হযরত হোসাইন (আ.)-এর পথ রুদ্ধ করে দাড়ায় এবং তাকে যেতে নিষেধ করে। হযরত হোসাইন (আ.)বললেন, তুমি কি বলনি যে, আমি ভিন্ন পথ ধরে চলি, যা মদীনা কিংবা কুফার পথ নয়। বলল-হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু আমীর ইবনে যিয়াদের চিঠি এসে পৌছেছে, ঐ চিঠিতে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে আপনার উপর কঠোরতা আরোপ করি। তাছাড়া তার হুকুম অনুসরণ করছি কি না পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমার বিরুদ্ধে গুপ্তচর নিয়োগ করেছে।
একথা শোনার পর হযরত হোসাইন (আ.) আপন সঙ্গী-সাথীদের মাঝে দাড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠানোর পর বললেন- হে জনতা আমাদের সামনে যে পনিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। সত্যিই দনিয়া পাল্টে গেছে। মন্দ ও কুৎসিৎ দিকগুলো প্রকাশ করে দিয়েছে। ভাল দিকগুলোকে পশ্চাতে ফেলে দিয়েছে। ক্রমাগত মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সে চলছে। অথচ পার্থিব জগতের কিছু নেই। গ্লাস থেকে পানি ঢেলে ফেলার পর যে দু’ এক ফোটা পানি থেকে যায় দুনিয়ার ততটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে। লবণাক্ত জমির মতই একটি হীন জীবন প্রবাহ এখানে বর্তমান। আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না যে, এখানে সত্যের উপর আমল করা হচ্ছে না এবং বাতিলকে বাধা দেয়া হচ্ছে না। এর ফলশ্রুতি হচ্ছে, মু’মিন আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়াকেই অগ্রাধিকার দেয়। সত্যিই আমি মৃত্যুকে সৌভাগ্য এবং জালিমদের সাথে জীবন যাপনকে অন্যায় ছাড়া অন্যকিছু মনে করছি না।
لا أرى الْموْت إلاّ سعادةً والْحياة مع الظّالمين إلاّ برما
এ বক্তব্য শোনার পর যুহা্ইর ইবনে ক্বীন দাড়িয়ে বললেন- হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান আপনার বক্তব্য শুনেছি । আমাদের কাছে এই অস্থায়ী জগতের কোন মূল্য নেই। দুনিয়ার জীবন যদি স্থায়ী হত এবং তাতে চিরদিন থাকতাম তবুও আপনার পথে নিহত হওয়াকে এই স্থায়ী জীবনের উপর অগ্রাধিকার দিতাম। এরপর হেলাল ইবনে নাফে বাজলী উঠে দাড়ালেন এবং বললেন-খোদার কসম মৃত্যু এবং শাহাদতকে আমরা ভয় পাইনা।আমাদের সেই নিয়ত ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত আছি। আপনার দুশমনদের সাথে দুশমনি এবং আপনার বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব রাখি। এরপর যুবাইর ইবনে খুজাইর উঠে দাড়ালেন এবং বললেন-হে পয়গম্বরের পুত্র আপনাকে দিয়ে আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন। যাতে আপনার সহযোগী হয়ে লড়াই করে আপনার পথে আমাদের দেহগুলো টুকরো টুকরো করি এবং বিনিময়ে কিয়ামেতের ময়দানে আপনার নানাজানের সুপারিশ নছিব হয়।
হযরত হোসাইন (আ.) কারবালায়
হোসাইন (আ.) উঠে দাড়ালেন এবং ঘোড়ায় সওয়ার হলেন । কিন্তু হোর এর বাহিনী কখনো তাকে সম্মুখ দিক থেকে বাধা দিচ্ছিল, কখনো তার পেছন থেকে এগিয়ে আসছিল। এভাবে মুহররমের ২ তারিখ কারবালা প্রান্তরে উপনীত হলেন। সেখানে পৌছার পর হযরত হোসাইন (আ.) জিজ্ঞেস করলেন-এই ভূমির নাম কি? বললেন-কারবালা। বললেন-হে আল্লাহ; বালা মুছিবত হতে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। এরপর তিনি বললেন-
هذا موْضعُ كرْب وبل أ أنْزلُوا، هاهُنا محطُّ رحالنا ومسْفكُ دمائنا، وهاهُنا واللّه محلُّ قُبُورنا
এখানে দুঃখ ও বালা-মুছিবতের স্থান নেমে পড়, এখানেই আমাদের অবতরণের, রক্ত ঝরানোর এবং আমাদের কবরের স্থান।
আমার নানা রাসূলে খোদা (সা.) আমাকে এ সংবাদ দিয়েছেন।এরপর সবাই নেমে পড়লেন। হোর এবং তার সঙ্গীরাও এক দিকে তাবু পেলল।
যয়নবের অস্থিরতা
হোসাইন (আ.)বসে আপন তরবারিতে ধার দিচ্ছিলেন । আর এ কবিতাগুলো আবৃত্তি করছিলেন-
“হে যুগ! তোমার বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব নেই। বন্ধুর সাথে শত্রুতা ছাড়া তোমার জন্য কাজ নেই। সকাল বিকাল তুমি অনেক বন্ধুকে হ্যা করেছ, অথচ তোমার এ শত্রুতা কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। প্রতিটি প্রানীই মৃত্যু পথযাত্রী তবে তুমি ছাড়া আর কারো কাছেই মানুষ চিরন্তন জীবন পায় না।”
হযরত যয়নব আলাইহিস সালাম কবিতাগুলো শুনলেন এবং বললেন-ভাইজান, একথাগুলো এমন লোকের, যে জানে যে, নিশ্চিতভাবেই নিহত হবে। হোসাইন (আ.) বললেন, হ্যাঁ, প্রিয় বোন, ব্যাপার তেমনই। যয়নব (আ.) বললেন-হায়, হোসাইন (আ.) নিজের শাহাদত ও মৃত্যুর কথাই বলছে। এসময় মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করলেন। মুখে মাথায় আঘাত করছিল এবং কাপড় ছিড়ে ফেলছির। উম্মে কুলসুম চিৎকার দিয়ে বলছিল-
وامُحمّداهُ واعليّاهُ واأُمّاهُ وا أخاهُ واحُسيْناهُ واضيعتاهُ بعْدك يا أبا عبْد اللّه.
“হে আবু আবদিল্লাহ, আপনার পরে আমাদের যে অসহায় করুণ অবস্থা নেমে আসবে তার থেকে পানাহ চাই। হযরত হোসাইন (আ.) তাদের সান্তনা দিয়ে বললেন-প্রিয় বোন! আল্লাহর রাস্তায় ধৈর্যের পরিচয় দাও। কেননা, আসমানের বাসিন্দারা, জমিনের অধিবাসীরা সকল মানুষই তো ধ্বংস হয়ে যাবে।”
এরপর বললেন-হে উম্মে কুলসুম, হে যয়নাব, হে ফাতেমা, হে রোবাব, সাবধান! আমি যখন নিহত হব, তখন যেন গায়ের কাপড় ছিন্ন না কর। চেহারায় যেন আঘাত না কর । এমন কথা মুখ দিয়ে বল না, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না ।
অপর রেওয়ায়তে বর্ণিত, যয়নব (আ.)হযরত হোসাইন (আ.) থেকে একটু দূরে মহিলাদের মাঝে বসা ছিলেন। কবিতাগুলোর ভাবার্থ তার কানে পৌছার সাথে সাথে এমনভাবে দৌড়ে আসলেন যেন মাথার কাপড় ছিল না এবং গায়ের কাপড়ের আচল ঝুলছিল। তিনি বললেন-
واثكْلاهُ، ليْت الْموْت أعْدمنى الْحياة،
“হায়, মৃত্যু এসে যদি আমাকে নিয়ে যেত।” আমার মা যাহরা, পিতা আলী ও ভাই হাসান দুনিয়াতে নেই। তোদের স্মৃতি ও আমাদের আশ্রয় হিসাবে তুমিই আছ। হেসাইন (আ.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন-বোন! শয়তান যেন তোমার সনশীলতা ছিনিয়ে না নেয়। যয়নব (আ.) বলেন-আমার প্রাণ তোমার জন্য উৎসর্গিত। তুমি কি আসলেই নিহত হবে? হোসাইন (আ.) তার দুঃখ ও বেদনাকে অন্তরে চেপে রাখলেন, কিন্তু দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি বললেন-
لوْ تُرك الْقطا لنام
“শিকারীরা যদি (কাতা নামীয়) পাখিটিকে তার আপন জালে ছেড়ে দিত তাহলে সে তার নীড়ে শান্তিতে ঘুমাতো।”
এ কথায় তিনি ইঙ্গিত করলেন যে, “বনি উমাইয়া যদি তাকে শান্তিতে থাকতে দিত তাহলে মদীনা থেকে আমি বেরিয়ে আসতাম না।” হযরত যয়নাব (সা.আ.) এ কথা শুনে বললেন, ভাইজান! আপনি কি নিজেকে দুশমনদের হাতে বন্দি বলে মনে করছেন এবং জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেছেন? একথা চিন্তা করতেই আমার হৃদয় জ্বলে পুড়ে যায় একথা বলেই মুখে দু’হাতে প্রচণ্ড আঘাত করে টান দিয়ে নিজের কাপড় ছিড়ে ফেললেন এবং বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। হোসাইন (আ.) উঠে দাড়ালেন এবং যয়নাবের মুখে পানি ছিটিয়ে দিলেন। তাতে তার হুশ ফিরে এল। তিনি কঠোরভাবে তাকে সান্তনা দিলেন এবং তার নানা রাসূলে খোদা (সা.) ও পিতা আলী (আ.)-এর জীবনের দুঃখ মছিবতগুলোর বর্ণনা দিলেন। যেন হোসাইন (আ.)-এর শাহাদতকে সেই তুলনায় তুচ্ছ মনে করে অন্তরে সান্তনা পায়।
হোসাইনের (আ.) আহলে বাইত (আ.)ও পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে আনার কারণ হয়তো এটাই ছিল যে, তিনি যদি আহলে বাইতকে (আ.) হেজাজে অথবা অন্য কোন শহরে রেখে আসতেন তাহলে এযিদ ইবনে মুয়াবিয়া-লানাতুল্লাহ আলাইহ সৈন্য পঠিয়ে তাদেরকে বন্দী করে নিয়ে আসত এবং তাদের প্রতি নির্যাতন চালাত। যাতে হোসাইন (আ.) আল্লাহর রাস্তায় শাহাদত বরণের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে এযিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে বিরত হন।#আল হাসানাইন