ঐশী নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক
ইসলামের ইতিহাসে ও ‘আক্বাএদী আলোচনায় ইমামত ও খেলাফত এবং এতদুভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক একটি অত্যন্ত বড় ধরনের বিতর্কের বিষয়।
মূল বিতর্কটি এখানে যে, সুন্নাতে ইলাহীতে নবুওয়াত্ ও রিসালাত ছাড়া আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামত বলে আদৌ কিছু আছে কিনা এবং থেকে থাকলে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত ইমাম কে বা কারা? আর যদি তা না থেকে থাকে তাহলে তাঁর আদর্শিক ও রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকারী কি অভিন্ন হবেন, নাকি বিভিন্ন হবেন এবং কীভাবে তা নির্ধারিত হবে?
এ বিষয়ে মুসলমা্নদের মধ্যে দুটি পক্ষ হয়েছে এবং উভয় পক্ষই নিজ নিজ মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন ‘আক্বলী ও নাক্বলী দলীল উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু কতক সুস্পষ্ট্ অর্থবোধক অকাট্য দলীলের পাশাপাশি কতক ব্যাখ্যাসাপেক্ষ অকাট্য দলীল ও অনেক যান্নী দলীল উপস্থাপনের ফলে এবং সুস্পষ্ট অকাট্য দলীলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ব্যাপক মতপার্থক্যের ফলে বিষয়টি ব্যাপক-বিস্তৃত ও জটিল হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে রয়ে গিয়েছে এবং কোনো অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয় নি।
এমতাবস্থায় আমি শুধু সুস্পষ্ট অর্থবোধক অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে আমার লেখা “রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) আহলে বাইত্ ও বিবিগণ”-গ্রন্থে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছি। সেখানে আমি প্রমাণ করেছি যে, আল্লাহর সুন্নাতে নবুওয়াত ও রিসালাত ছাড়াও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামত রয়েছে এবং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত প্রথম ইমাম হযরত ‘আলী (‘আঃ)।
বিষয়টি সম্পর্কে আমি ইতমামে হুজ্জাত ও সতর্কতার নীতির ভিত্তিতে আলোচনা করেছি এবং বলেছি যে, মু’মিনদের নেতৃত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত হবার ব্যাপারে যদি কারো জন্য ইতমামে হুজ্জাত না হয়ে থাকে তো যেহেতু হাদীছে গ্বাদীর অনুযায়ী নবী করীম (ছ্বাঃ) হযরত আলী (আঃ)কে মুমিনদের জন্য “মাওলা” ঘোষণা করেছেন এবং এ শব্দটির অন্যতম অর্থ ‘শাসক’, সেহেতু সতর্কতার নীতি অনুযায়ী হযরত ‘আলীকে (‘আঃ) নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর পরবর্তী শাসক হিসেবে গ্রহণ করা উচিত ছিলো। আর তা-ও ধারণায় না এলে নির্বাচিত নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের পথনির্দেশ অনুযায়ী উম্মাতের সবচেয়ে বড় আলেম হিসেবে হযরত ‘আলী (‘আঃ)কেই খলীফাহ্ নির্বাচন করা উচিত ছিলো।
অবশ্য তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টিও যথাযথভাবে সকলের দৃষ্টিতে না আসার পিছনে বিভিন্ন কারণ ছিলো – যে সম্পর্কে ফেসবুকে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ “কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও রাসূলুল্লাহ্ র (ছ্বাঃ) যুগের মুনাফিক্ব্”-এ মোটামুটি আলোচনা করেছি।
ইমামত ও খেলাফত প্রশ্নে বিতর্কে পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষ থেকে দুটি যুক্তি বার বার উপস্থাপন করা হয়। এক পক্ষ থেকে বলা হয় যে, যেহেতু হযরত ‘আলী (‘আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম সেহেতু প্রথম তিন খলীফাহর খেলাফত ছিলো অবৈধ। শুধু তা-ই নয়, কেউ কেউ এমন চরমপন্থী ‘আক্বীদাহও পোষণ করে যে, যারা হযরত ‘আলীকে (আঃ) বাদ দিয়ে অন্যদেরকে খলীফাহ্ মনোনীত করেছিলেন তাঁরা মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলেন, যদিও এ পক্ষের ভারসাম্যপূর্ণ ‘আক্বীদাহর অধিকারীরা যথার্থভাবেই মনে করেন যে, কেবল যারা তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম ও খলীফাহ্ হিসেবে জানা থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিপক্ষে কাজ করেছে তারা ছিলো মুনাফিক্ব, কিন্তু যাদের কাছে হযরত ‘আলী (‘আঃ)-এর ইমামতের বিষয়টি সম্পর্কে ইতমামে হুজ্জাত হয় নি এমন বিরোধীরা মুনাফিক্ব ছিলেন না (এ সম্পর্কেও আমার প্রবন্ধ “কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও রাসূলুল্লাহ্ র (ছ্বাঃ) যুগের মুনাফিক্ব্”-এ আলোচনা করেছি)।
অপর পক্ষের যুক্তি হচ্ছে এই যে, যেহেতু প্রথম তিন খলীফাহর শাসনামলে হযরত ‘আলী (‘আঃ”) খেলাফত প্রশাসনের সাথে বিচারের কাজে সহায়তা সহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন, এমনকি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন সেহেতু তিনি ঐ তিন খলীফাহকে বৈধ খলীফাহ্ হিসেবে গণ্য করতেন এবং নিজেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমাম বলে গণ্য করতেন না।
আগেই বলেছি যে, অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত যে, আল্লাহর সুন্নাতে তাঁর পক্ষ থেকে ইমাম মনোনয়নের বিষয়টি রয়েছে এবং হযরত ‘আলী (‘আঃ) নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত প্রথম ইমাম ছিলেন, সুতরাং তাঁকেই শাসক হিসেবে মেনে নেয়া উচিত ছিলো এবং কারো জন্য এ বিষয়টি ইতমামে হুজ্জাত না হয়ে থাকলে তার জন্যও সতর্কতার নীতি অনুযায়ী তাঁকে ইমাম মানা বা কোরআনের পথনির্দেশ অনুযায়ী তাঁকে খলীফাহ্ নির্বাচিত করা উচিত ছিলো। এ বিষয়টি ও এ প্রসঙ্গে উপরোক্ত দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী যুক্তি প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা ছিলো – যা সময়াভাবে করতে পারি নি। তাই এখানে উক্ত দুই পরস্পর বিরোধী পক্ষের যুক্তি সম্পর্কে খুবই সক্ষেপে আলোচনা করছি।
(১) মা‘ছূম ইমাম যিনি নবী নন তিনি হচ্ছেন নবী-রাসূলের (আঃ) অনুপস্থিতিতে বা অবর্তমানে তাঁর স্থলাভিষিক্ত। কোরআন মজীদের সুস্পষ্ট ঘোষণা অনুযায়ী নবী-রাসূলগণের (আঃ) মূল দায়িত্ব শুধু আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়া তথা দ্বীনের প্রচার, তবে তাঁদের কর্মনীতিতে দেখা যায় যে, যখন তাঁরা ঐশী হুকূমাত প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছেন তখন হুকূমাত প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা করেছেন; এরূপ অবস্থায় জনগণের মধ্যে বিচার-ফয়ছ্বালাহ্ করা তথা হুকূমাত পরিচালনার জন্য কোরআন মজীদে নির্দেশ ও নির্দেশনা রয়েছে।
অর্থাৎ নবী-রাসূল ও মাছূম ইমাম (আঃ) দুই ধরনের নেতৃত্বের অধিকারী : দ্বীনী হেদায়াত ও সম্ভব হওয়া সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব।
(২) নবী-রাসূল ও মাছূম ইমাম (‘আঃ)-এর সার্বিক আনুগত্য তাঁর এ ঐশী মর্যাদার সত্যতা সম্পর্কে ইয়াক্বীনে উপনীত ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য। এ ব্যাপারে ইয়াক্বীনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে মেনে না নেয়া নেফাক্বের নিদর্শন। কিন্তু তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমানদার ও নেক আমলের অধিকারী যে মুখলিছ্ব ব্যক্তির জন্য তাঁর এ ঐশী মর্যাদা সম্পর্কে ইতমামে হুজ্জাত হয় নি সে তাঁকে গ্রহণ না করা সত্ত্বেও আহলে নাজাত (যা সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ৬২ নং আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়)।
(৩) ঐশী বা দ্বীনী রাষ্ট্র নির্বিশেষে রাষ্ট্র একটি অপরিহার্য সংগঠন যার ভিত্তি হচ্ছে একটি অলিখিত সামাজিক চুক্তি। একজন শাসক বা একটি সরকার কীভাবে শাসনক্ষমতায় এলে বৈধ হবে সে ব্যাপারে বিতর্ক আছে। এ বিতর্কের উৎস বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিগত পার্থক্যের মধ্যে নিহিত। এ থেকেই আইনতঃ বৈধ (ডি জ্যুরে) শাসক/ সরকার ও কার্যতঃ (ডি ফ্যাক্টো) শাসক/ সরকার-এর ধারণার সৃষ্টি। উদাহরণস্বরূপ, গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধিকারী একটি দেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে একটি স্বদেশী সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বা বাইরের শক্তি দেশটি দখল করে কোনো বশংবদ সরকার বসালে উৎখাতকৃত সরকারটি হচ্ছে ডি জ্যুরে সরকার এবং প্রতিষ্ঠিত সরকারটি হচ্ছে ডি ফ্যাক্টো সরকার।
ডি ফ্যাক্টো সরকার একই সাথে ডি জ্যুরে না হলে তা অবাঞ্ছিত ও নিন্দনীয়, কিন্তু দেশের ভিতরে ও বাইরে তার কার্যকরতায় কোনোই পার্থক্য নেই। এর বিপরীতে ক্ষমতাচ্যুত ডি জ্যুরে সরকার তাত্ত্বিকভাবে বৈধ হলেও তার কোনো কার্যকরতা নেই।
(৪) যে রাষ্ট্রে ঐশী নেতৃত্ব শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেই সে রাষ্ট্রের সাথে সেখানে বসবাসকারী ঐশী নেতৃত্বের অনুসারীদের সম্পর্ক হবে ঐশী নেতৃত্বের দিকনির্দেশ অনুসারে। ঐশী নেতৃত্ব সেখান থেকে হিজরত করার নির্দেশ দিলে তারা হিজরত করবে, আর সেখানে বসবাস করার অনুমতি দিলে সেখানে বসবাস করবে।
(৫) যেহেতু রাষ্ট্র ব্যক্তিদের জান, মাল ও ইজ্জত-সম্ভ্রমের হেফাযত করে সেহেতু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও শারীরিক সেবা (শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ সংক্রান্ত সেবা) প্রদান করা এর সকল নাগরিকের জন্য অপরিহার্য। এমতাবস্থায় সেখানে বসবাসকারী ঐশী নেতৃত্ব ও তাঁর অনুসারীদের জন্যও তা অপরিহার্য। এ সেবা প্রদান হতে বিরত থাকার মানে শুধু অঙ্গীকার (অলিখিত বা পরোক্ষ হলেও) ভঙ্গকরণই নয়, বরং এর পরিণামে অরাজকতা বা বহিঃশক্তির আগ্রাসন ও দখল প্রতিষ্ঠার আশঙ্কা থাকায় তা কোনোভাবেই বৈধ নয়।
(৬) একটি রাষ্ট্রের শাসক বা সরকার যদি একই সাথে ডি জ্যুরে ও ডি ফ্যাক্টো শাসক/ সরকার হয় এবং জনকল্যাণকারীও হয় তা ঐ শাসক বা সরকারকে ঐশী নেতৃত্বে পরিণত করে না, তেমনি ঐশী নেতৃত্ব ও তাঁর অনুসারীগণ ঐ রাষ্ট্রের জন্য আর্থিক ও শারীরিক সেবা প্রদান করলে তা-ও ঐ সরকারের জন্য ঐশী নেতৃত্বের স্বীকৃতি প্রমাণ করে না, কারণ, ঐশী নেতৃত্ব ও তাঁর অনুসারীগণ রাষ্ট্র নামক সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার অলিখিত চুক্তি বা অঙ্গীকার পালন করেছেন মাত্র, এর মাধ্যমে তার শাসক বা সরকারকে ঐশী বৈধতার অধিকারী বলে স্বীকৃতি প্রদান করেন নি।
(৭) মোট কথা, রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ও ঐশী নেতৃত্ব দু’টি ভিন্ন বিষয়; কখনো তা অভিন্ন ব্যক্তির হাতে থাকে, কখনো তা বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে থাকে এবং উভয় অবস্থায়ই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে তা বৈধ। তবে এ দুই ধরনের নেতৃত্ব ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির হাতে থাকা অবস্থায় ঐশী নেতৃত্বের অধিকারী নয় এমন রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব কেবল রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে বৈধ; তাকে ঐশী নেতৃত্বের অধিকারী বলে দাবী করা হলে তা হবে ভিত্তিহীন।
(৮) নবী-রাসূলের (‘আঃ) ও মা‘ছূম ইমামের (‘আঃ) অবর্তমানে বা তাঁর সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সম্ভব না হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর তাত্ত্বিক প্রতিনিধি হচ্ছেন চিন্তা-চেতনা, কথা ও কাজে ভারসাম্যের অধিকারী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মুজতাহিদগণ; এ ধরনের মুজতাহিদগণের ও তাঁদের অনুসরণকারী মুমিনদের রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক এ নীতির ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে।#আল হাসানাইন