ইমাম হোসাইন (আ.) এর চেহলাম বার্ষিকী
আলোচ্য প্রবন্ধে ইমাম হোসাইন (আ.) ’র শাহাদাতের চেহলাম বার্ষিকী বা আরবাইনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ইমাম হোসাইন (আ.) আরবাইনে জিযারত পালন জায়েজ কিনা, বর্তমানে চেহলাম বা আরবাইন পালনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং এটি পালন বেদাত বা হারাম কি না এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ইমাম হোসাইনের (আ.) চেহলাম বার্ষিকী বা আরবাইনের ঐতিহাসিক ভিত্তি
প্রথমে আ রবাইন কী সে সম্পর্কে আলোচনা করব। আরবাইন ( اربعین) বা আরবাঊন (اربعون) আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে চল্লিশ বা চল্লিশতম। আল-ইয়াওমুল আরবাঊন বা আল-ইয়াওমিল আরবাঈন হচ্ছে চল্লিশতম দিন। বাংলাদেশে মৃত্যুর পর চল্লিশতম দিবসে মৃত ব্যক্তির স্মরণে যে ইসালে সওয়াব ও দুয়ার অনুষ্ঠান করা হয় তাকে চল্লিশা বা চেহলাম (ফার্সী শব্দ) বলা হয়ে থাকে।
আর ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালায় ১০ মুহাররম অর্থাৎ আশুরার দিনে শাহাদাত বরণের পর চল্লিশতম দিন অর্থাৎ ২০ সফরকে আরবাইন বলা হয়। আর এ দিনে ইমাম হোসাইন এবং তার সঙ্গীসাথিদের স্মরণে শোকানুষ্ঠান বা আযাদারি পালন ও জিয়ারত করা হয়। আর এ জিয়ারত হচ্ছে মুস্তাহাব।
২০ সফর অর্থাৎ ইমাম হোসাইন (আ.) ’র আরবাইন উপলক্ষে জিয়ারত ও দুআগুলো বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদিস ও দুআর গ্রন্থ যেমনঃ শেখ তূসী প্রণীত তাহযীবুত তাহযীব ও মিসবাহুল মুতাহাজ্জিদ এবং শেখ আব্বাস কোমী প্রণীত মাফাতীহুল জিনান ইত্যাদিতে বর্ণিত আছে। ইমাম হোসাইন (আ.) ’র আরবাইনসহ সকল জিয়ারতে যেসব দুআ তথা মহানবী (সা.) ,হযরত ফাতেমা (সা.আ.) ,হযরত আলী (আ.) , ইমাম হাসান এবং আহলে বাইত (আ.) ’র অন্য সকল ইমাম (আ’) র জিয়ারতে যেসব দুআ পড়া হয় তার অন্তর্নিহিত অর্থ অত্যন্ত উচুঁ মানের একইসাথে উচুঁ পর্যায়ের মারেফাত ও তাত্ত্বিক ইসলামী জ্ঞানে পরিপূর্ণ।
ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আসলে ইসলামী তাত্ত্বিক জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও মারেফাতের ভাণ্ডার হচ্ছে এ সব দুআ ও জিয়ারতনামা। আমরা সংক্ষেপে ইমাম হোসাইন (আ.) র আরবাইনের জিয়ারতের দুয়ার মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করছিঃ প্রথমত: ইমাম হোসাইনের উপর সালাম দেয়া হয়েছে। এরপর তাঁর পরিচিতি এবং তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা,আল্লাহর রাহে তাঁর জিহাদ,ধৈর্য-সবর ও শাহাদাত বরণের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যে তাঁর মাতামহ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উম্মতকে বিচ্যুতি ও গোমরাহী থেকে রক্ষা করা। এসব বিষয় এতে বর্ণিত হয়েছে।
এরপর ইমাম হোসাইনের হত্যাকারীদের উপর লানৎ দেয়া হয়েছে। তারপর তাঁর আধ্যাত্মিক মাকাম এবং তাঁর সকল কর্মকাণ্ড ও গোটা জীবন যে সুমহান ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তিনি যে মহান আল্লাহ পাকের ঐশী প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন, আল্লাহর রাহে জিহাদ করে মজলুমভাবে শহীদ হয়েছেন এ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে।
তারপর মহানবী (সা.) এর সুন্নাহ অনুসরণ করে ইমাম হোসাইনের মুহাব্বতকারী ও অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন এবং তাঁর শত্রু ও হত্যাকারীদের প্রতি শত্রুতা ও ঘৃণা প্রদর্শনের কথা বর্ণিত হয়েছে।
এরপর তাঁর ইমামতের ব্যাপারে সাক্ষ্যদান এবং তাঁর প্রতি জিয়ারতকারীর আনুগত্য এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য জিয়ারতকারীর সদাপ্রস্তুত থাকার ব্যপারেও সাক্ষ্যদান করা হয়েছে, যাতে করে আল্লাহ পাক যেন তাকে অর্থাৎ জিয়ারতকারীকে এ দুনিয়া ও আখেরাতে ইমাম হোসাইন (আ.) এর সাথে রাখেন। ইমাম হোসাইন ও আহলুল বাইতের শত্রুদের সাথে নয় এবং শেষে ইমাম হোসাইন (আ.) ও আহলে বাইত এর উপর দরুদ প্রেরণ করা হয়েছে।
এবার, আরবাইনের ঐতিহাসিক ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলছি।
মশহুর (প্রসিদ্ধ) অভিমত হচ্ছে যে ২০ সফর ৬১ সালে বন্দিত্বদশা থেকে মুক্তি পাবার পর দামেস্ক খেকে মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) এবং আহলে বাইত (আ.) র কাফেলা কারবালা আগমন করেন এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শহীদদের নেতা মজলুম ইমাম হোসাইন (আ.) ’র কাটা মাথা কবরে শুইয়ে দিয়ে তাঁর দেহের সাথে যুক্ত করে দাফন করেন।
সেখানে তারা ৩ দিন অবস্থান করে শহীদদের নেতা এবং তাঁর শহীদ সাথীদের জন্য আজাদারি করেন।
আবার তাবেয়ী আতা থেকে বর্ণিত আছে-আমি (রাসুলুল্লাহর সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আনসারীর সাথে (হিজরী ৬১সালের) ২০ সফর গাযেরিয়ায় (কারবালা) পৌঁছাই। জাবির (রা.) ফুরাত নদীতে গোসল করে পবিত্র একটি পোশাক পরেন। এরপর তিনি বলেন- আতা তোমার সাথে সুগন্ধি কিছু আছে কি । আতা বললেন আমার সাথে কিছু সুউদ (এক ধরণের সুগন্ধি) আছে। তখন তিনি তা থেকে কিছু নিয়ে মাথা ও গায়ে মাখেন এবং খালি পায়ে ইমাম হোসাইন (আ.) এর কবর জিয়ারত করতে গেলেন।
কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ৩ বার আল্লাহু আকবর বলেন এবং এরপর তিনি মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে তাকে আমি বলতে শুনলাম-‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আলাল্লাহ’ অর্থাৎ ১৫ রজবে যে জিয়ারতনামা পড়া হয় সেটার মতোই (দ্রঃ মাফাতীহুল জিনান,পৃঃ৮৫৮) ।
আর এটাই হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.) ’র আরবাইনের (চেহলাম) প্রথম জিয়ারত। এরপর থেকে এ জিয়ারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান বিশেষ করে ইরাকে।
ইমাম হোসাইন (আ.) ’র চেহলাম বার্ষিকী বা আরবাইনের জিয়ারত পালন জায়েজ হওয়া সংক্রান্ত শরয়ী দলিল
ইমাম হোসাইন (আ.) ’র শাহাদাতের চেহলাম বা আরবাইনের শোক ও জিয়ারত পালন জায়েজ। আর এর জায়েজ হওয়া সংক্রান্ত দলিল দু ধরণের।
প্রথমত: সর্বসাধারণ (আম) দলিল যা হচ্ছে সূরা হজের ৩৬ নং আয়াতঃ আর যে ব্যক্তি আল্লাহর (দ্বীনের) নিদর্শনসমুহের (শাআয়িরুল্লাহ) সম্মান প্রদর্শন করে তাহলে তা হবে তার হৃদয়ের তাক্ওয়ার নির্যাস। যেখানে সাফা-মারওয়া পাহাড় এবং কুরবানীর উটকে আল্লাহ পাকের দ্বীনের নিদর্শনাদির (শাআয়িরুল্লাহ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সেখানে নিঃসন্দেহে মহান নবী,ওয়ালী,নেক-সালেহ,সিদ্দীক ও শহীদগণ যে হবেন আল্লাহ পাকের দ্বীনের সর্বশ্রষ্ঠ নিদর্শন তা বলার আর অপেক্ষা ব়াখে না।
তাই এসব পূণ্যবানদের সম্মান বা তাযীম প্রদর্শন হবে নিঃসন্দেহে অন্তঃকরণসমুহের তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ। তাঁদের প্রতি অসম্মান ও বেআদবি করলে অন্ততঃপক্ষে তাদের ব্যাপারে নির্বিকার,নিস্পৃহ,নির্লিপ্ত ও উদাসীন থাকলে মনের যে তাক্ওয়া অর্জিত ও বিকশিত হবে না।
বরং আল্লাহ পাকের দ্বীন ও হযরত সালেহ (আ.) এর মুজেযা ও নুবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ ও নিদর্শন উষ্ট্রীর অসম্মান ও তা হত্যা করার কারণে সালেহ (আ.) র কওম যে আল্লাহর আজাবে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেরকম বালা-মুসিবতে পড়বে ও অভিশপ্ত হবে সে বিষয়টি এ আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের দ্বীনের নিদর্শনস্বরূপ মহান নবী ও ওয়ালীদের যারা অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করবে তারা নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর গজব ও লানতের পাত্র হবে এবং আল্লাহ পাক তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন।
যে ইমাম হোসাইন (আ.) বেহেশতের যুবকদের নেতা এবং যাঁর ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন- ‘হোসাইন (আ.) আমা হতে এবং আমি হোসাইন হতে’। সেই হোসাইন (আ.) আল্লাহ পাকের সর্বশ্রেষ্ট নিদর্শনাদির অন্তর্ভূক্ত যার সম্মান ও তাযীম হবে অন্তরের তাক্ওয়া বিকশিত হওয়ার কারণ।
তাঁর প্রতি সম্মান ও তাযীমের স্বরূপ হচ্ছে তাঁর সুখ ও আনন্দে সুখী হওয়া ও আনন্দ প্রকাশ করা এবং তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে মজলুমাবস্থায় কারবালায় শহীদ করে তাঁর পরিবারবর্গকে বন্দী করার কারণে তাঁর জন্য শোকপ্রকাশ ও আযাদারী করা।
মহান আল্লাহর ওয়ালীর প্রতি তাযীম ও সম্মানের বাস্তব নমুনা হচ্ছে উক্ত ওয়ালীর সুখে সুখী হওয়া এবং তাঁর দুঃখে দুঃখী হওয়া। আর ইমাম হোসাইনের শাহাদত দিবসে (১০ মুহররম) এবং আরবাইন (চেহলাম) উপলক্ষে তাঁরই জিয়ারত ও শোকানুষ্ঠান পালন নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর নিদর্শনাদির সম্মান ও তাযীমের বাস্তব নমুনাস্বরূপ।
শুধু তাই না বছরের যে কোন দিন ও সময়ে বেহেশতের যুবকদের নেতার জন্য শোকপ্রকাশ ও আজাদারি করা যে কাম্য ও মুস্তাহাব তা উক্ত আয়াতের সর্বজনীনতা (উমূম) ও নিঃশর্ততা (ইতলাক) থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত: আইয়ামুল্লাহ’র কথা স্মরণ করার আয়াত হচ্ছে সূরা ইব্রাহীম-১৪। আয়াতটিতে বলা হয়েছে-মূসাকে আমি আমার নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমার সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে আলোতে আনা এবং তাদেরকে আল্লাহর দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে উপদেশ দাও। এতে নিদর্শন রয়েছে পরম ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য। আর নিঃসন্দেহে আশুরা, ২০সফর বা আরবাইনের দিবস আইয়ামুল্লাহর বা আল্লাহর দিনগুলোর অন্তর্গত কারণ আইয়ামুল্লাহ এ আয়াতে আম (সর্বজনীন) এবং তা গুটিকতক দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয় নি।
তৃতীয়ত: বিশেষ দলিল- (ক) ইমাম জয়নুল আবেদীন এবং আহলে বাইত (আ.) ’র আরবাইনের দিনে কারবালা আগমন ও ইমাম হোসাইন (আ’) ’র জিয়ারত ও তাঁর জন্য শোকপালন এবং মহানবী (সা.) র সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আনসারীর ২০সফর ৬১হি. সালে কারবালা আগমন ও ইমাম হোসাইন (আ.) ’র কবর জিয়ারত সংক্রান্ত বর্ণনা ও রেওয়ায়তসমুহ।
(খ) ২০ সফর আরবাইনের জিয়ারত সংক্রান্ত আহলে বাইতের ইমামদের (আ) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়তসমুহ যেমন-আহলে বাইত (আ.) ’র একাদশ ইমাম হাসান আল-আসকারী (আ.) থেকে বর্ণিত মুমিনের আলামত হচ্ছে ৫টিঃ
১.দিবারাত্রি ৫১ রাকাত নামায (১৭ রাকাত ফরয,২৩রাকাত নফল ও মুস্তাহাব এবং ১১রাকাত তাহাজ্জুদ বা রাতের নামায) আদায় করা,
২. ২০সফর ইমাম হোসাইন (আ.) ’র আরবাইনের চেহলাম জিয়ারত,
৩.ডান হাতের আংগুলে আংটি পড়া,
৪.মাটির উপর সিজদায় কপাল রাখা এবং
৫. নামাজে হামদ ও সূরা পড়ার আগে জোরে জোরে অর্থাৎ উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম বলা।
গ.তাহযীবুত তাহযীব এবং মিসবাহুল মুতাহাজ্জিদ গ্রন্থে শেখ তূসী ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে ২০সফর ইমাম হোসাইন (আ.) ’র আরবাইনের যিয়ারত পদ্ধতি সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় ইমাম হোসাইন (আ.) র আরবাইনের (চেহলাম) জিয়ারতের বৈধতা।
বর্তমানে ইমাম হোসেন (আ.) র চেহলাম পালনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কোনো গুরুত্ব বা তাৎপর্য
‘কাতলে হোসাইন আসল মেঁ মার্গে ইয়াজীদ হ্যায় ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ’ মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহরের এ পংক্তি থেকে ফুটে উঠে ইমাম হোসাইন (আ.) র শাহাদতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য।
জালেম অত্যাচারী অনাচারী শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রের কারণে যখন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব হুমকীর সম্মুখীন হবে তখন ইমাম হোসাইন (আ.) র শাহাদত ও আত্মত্যাগের আদর্শ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করতে পারবে।
এ সুমহান হুসাইনি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন মুসলমানরা নিজেদেরকে আল্লাহর পথে জিহাদ ও শাহাদত বরণ করবে তখনই হবে ইসলামের পূণর্জাগরণ এবং যুগের ইয়াজিদ,শিমার,ইবনে জিয়াদদের পতন ও মূলোৎপাটন।
ইমাম খোমেনী (র.) এ হুসাইনি আদর্শের পূর্ণ শিক্ষা নিয়ে ও অনুপ্রাণিত হয়ে ইরানি জাতিকে জাগ্রত করে যুগের ইয়াজিদ-শিমার চক্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী পাহলভী রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিলেন সফল খাঁটি ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে।
চৌদ্দশ বছর পরে পুনরায় পৃথিবীর বুকে প্রথম ইসলামী প্রজাতন্ত্র,সরকার ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে এ সফল ইসলামী বিপ্লব আসলে করবালার হুসাইনি বিপ্লব ও আন্দোলন থেকে উৎসারিত ও ভূমিষ্ট।
ইরানের এ ইসলামি বিপ্লব মুহররম-সফর মাসের শোকানুষ্ঠান পালন এবং বিপ্লবের মিছিলগুলোয় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা শাহের সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে শাহাদত বরণ করেছেন সেই শহীদদের স্মরণে ৩য়,৭ম ও চেহলামের আয়োজিত শোকানুষ্ঠান ও প্রতিবাদী মিছিলসমুহের মাধ্যমে বিজয় লাভ করেছিল।
আর তাই এ ইসলামি বিপ্লবকে অনেকেই চেহলাম ও আরবাইনের বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
আর ইঙ্গি-মার্কিন-প্রতিক্রিয়াশীল জাহেলী আরবশাহী ও স্বৈরাচারী চক্রের প্রত্যক্ষ মদদ ও সমর্থনপুষ্ট হয়ে ইরাকের নাস্তিক্য আফলাকী-বাথপন্থী সাদ্দাম ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও হুকুমত উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে এক সর্বাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সেসময় বিপ্লবী ইরানী জনগণ ইমাম খোমেনীর আহ্বানে হুসাইনি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামি বিপ্লব ও মাতৃভূমি শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
অবশেষে ইমাম হোসাইন (আ.) র জিহাদ,শাহাদত ও আত্মত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত এ সব খাঁটি মুমিন মুজাহিদদের বিজয় সূচিত হয়েছিল। আর একইভাবে লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলন ইমাম খোমেনীর বিপ্লবী হুসাইনি আদর্শকে গ্রহণ ও বরণ করে আরবদের কাছে অপরাজেয় বলে পরিচিত ও মহাশক্তিধর ইসরাইলকে তিন তিনবার পর্যদুস্ত করে লেবানন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
আর ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও হিজবুল্লাহর জিহাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ আন্দোলনসমুহ সফল গণজাগরণ অর্থাৎ ইন্তিফাদার মাধ্যমে ইসরাইলকে দূর্বল করেছে। একইসাথে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রত্যক্ষ সামরিক,কৌশলগত ও নৈতিক সহায়তা ও সমর্থন লাভ করে গাজায় হামাস,ইসলামি জেহাদ ও অন্যন্য ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ যোদ্ধারা পাশ্চাত্য বিশেষ করে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি মদদপুষ্ট ইসরাইলকে যুদ্ধে তিনবার পর্যদুস্ত করেছে।
আজ হুসাইনি আদর্শের পতাকাবাহী ইমাম খোমেনীর স্থলাভিষিক্ত ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল ইমাম খামেনেয়ী’র যোগ্য নেতৃত্বের বরকতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান পূর্ণ সম্মান,মর্য্যাদা,শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী স্বাধীন-সার্বভৌম সফল রাষ্ট্র।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বহু দেশ যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের দ্বারা তীব্রভাবে অস্থিতিশীল,ক্ষতবিক্ষত ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। ঠিক সেই মুহূর্তে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান হুসাইনি আদর্শের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার কারণে সন্ত্রাসবাদের কবল ও এর বিষাক্ত ছোঁবল থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ যা সত্যি বিস্ময়কর।
তাই হুসাইনি আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী সফল ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী ঠিকই বলেছিলেন- এই মুহররম ও সফরই ইসলামকে জীবিত ও প্রাণবন্ত রেখেছে।
ইসলামি বিপ্লব আজ সফলভাবে ইসরাইলকে ধ্বংস ও পতনের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। আজ আসলে ইসরাইল তার জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করছে। আর এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে হুসাইনি আদর্শকে বরণ করার বরকতে।
আর যে পর্যন্ত ইরানে এ হুসাইনি আদর্শের সত্যিকার ও খাঁটি অনুসরণ অব্যাহত থাকবে সে পর্যন্ত এর বরকত,ফায়দা ও কল্যাণও সেদেশে অব্যাহত থাকবে। আমেরিকার মতো পরাশক্তিও বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এবং ইরাকের নাজাফ নগরীর মারজায়ে তাকলীদদের বিশেষ করে আয়াতুল্লাহ সিস্তানীর সঠিক নীত অবস্থানের কারণে ইরাক থেকে ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন দখলদার বাহিনী চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন-ন্যাটো জোটের দখলদারিত্বেরও বিরোধিতা করে আসছে ইরান। আর ইরানের নীতিগত অবস্থানের কারণে আফগানিস্তানেও মার্কিন-ন্যাটো দখলদার জোটও বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।
আল-কায়দা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বাহানায় আমেরিকা ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা ২০০১ সালে অগণিত নিরীহ জনগণের প্রাণহানি ঘটিয়ে ও সম্পদের ধ্বংস সাধন করে আফগানিস্তান দখল করেছিল। সেই সন্ত্রাসবাদ তো মূলোৎপাটন করতে পারেই নি বরং সন্ত্রাসবাদকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে দিয়েছে।
আসলে আমেরিকা ও তার মিত্ররা সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটনের যুদ্ধে যেমন ব্যার্থ হয়েছে ঠিক তেমনি তারা এ যুদ্ধে নিষ্ঠারও পরিচয় দেয় নি। তারা পূর্বপরিকল্পিত নীল-নক্সার ভিত্তিতে সন্ত্রাসীদেরকে পুনর্গঠিত করে দায়েশ (আইএসআইএল),জাবহাতুন নুসরা, জাইশ আহরার আশ শাম ইত্যাদির মতো কলিজা হৃদপিণ্ড ভক্ষণকারী জঘন্য সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে।
আর এসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ইরাক,সিরিয়া,ইয়েমেন,লেবানন,মিসর,লিবিয়ায় বোমা হামলা চালিয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিককালে সৌদী আরবের শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলোয় আইএসআইএস (দায়েশ) সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালিয়ে বেশ কিছু শিয়া মুসলমানকে শহীদ করেছে। এছাড়া কিছুদিন আগে এ গোষ্ঠীটি ইয়েমেন সীমান্তবর্তী এক সৌদী সেনা ছাউনিতে বোমা হামলা চালিয়ে বেশ কিছু সৌদী সেনাকে হত্যাকরেছিল।
আসলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল,বৃটেন ও আমেরিকা এবং তাদের তাবেদার সৌদি-কাতারি-আমিরাতি-জর্দানি-তুর্কি-মিসরিয় শাসকগোষ্ঠীদের সহায়তায় এক অতি অদ্ভুত জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যা প্রচলিত পদ্ধতিতে সমাধান করা মোটেও সম্ভব নয়।
তাই আবারও চলে আসে হুসাইনি আদর্শের কথা। একমাত্র হুসাইনি আদর্শ যা ইমাম খোমেনীর ভাষায় নির্ভেজাল খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলাম সেই আদর্শের দিকে উম্মাহর প্রত্যাবর্তন ও তার অনুসরণ পারে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা সৃষ্ট এ জটিল সমস্যা ও পরিস্থিতির সমাধান করতে।
আসলে সুমহান এ হুসাইনি আদর্শ যে এতসব কল্যাণ ও বরকত বয়ে এনেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও তাদের জন্য যারা এ আদর্শের অনুসারী অত্র অঞ্চলে যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলন এসব কিছু আসলে সম্ভব হয়েছে এ আদর্শের সাথে এর অনুসারীদের যৌক্তিক-বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগাপ্লুত আত্মিক-আধ্যাত্বিক সম্পর্ক থাকার কারণে।
আর বেহেশতের যুবকদের নেতা ও আহলে বাইতের করুণ হৃদয়বিদারক শাহাদতের স্মরণে মুহররম সফর মাসের শোকানুষ্ঠান পালন, আরবাইনের জিয়ারত ইত্যাদি কেবল পারে শহীদ ইমাম হোসাইন এবং তাঁর সুমহান আদর্শ ও আন্দোলনের সাথে শোকপালনকারী যৌক্তিক ও আত্মিক বন্ধন রচনা করতে।
এ শোকানুষ্ঠান পালন অব্যাহত রাখার কারণে চির-অটুট,শক্তিশালী ও অপরিবর্তনশীল থাকবে তাদের সাথে সম্পর্কের বন্ধনের বিষয়টি। আর চির-অটুট ও অপরিবর্তনীয় এ সম্পর্ক ও বন্ধন ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর আদর্শের প্রতি আজাদারী অনুসারীর ভালোবাসা,মহব্বত,ভক্তি ও জ্ঞানের উন্মেষ ঘটায় ও তা বৃদ্ধি করে।
আর তা হলে মহানবী (স.) ,ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আহলুলে বাইত (আ.) এবং তাদের আদর্শ অর্থাৎ খাঁটি মুহম্মদি ইসলামের প্রতি ভক্ত অনুসারী নিষ্ঠাবান,নিবেদিত ও অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে এবং সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এমনকি এক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন (আ.) র পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজের জান,মাল এবং আপনজনদেরকেও উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
আর সেই সাথে ইমাম হোসাইন (আ.) র দুশমন তথা মহানবী (স.),তাঁর আহলে বাইত (আ.) এবং ইসলামের সকল শত্রু বিশেষ করে এ যুগের ইয়াজিদ-শিমারদের ঘৃণাবোধ জন্মাবে। আজ ইসরাইল, আমেরিক,পাশ্চাত্য এবং অত্র অঞ্চলে (মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা) তাদের ধামাধরা প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র, সৌদী রাজবংশ (আলে সউদ) ,আলে-খলিফা (বাহরাইনের রাজবংশ) ,কুয়েত-কাতার-আরব আমিরাতের রাজতন্ত্রী শাসকচক্র চক্ররাই আজকের শিমার হিসেবে পরিচিত। তাদের প্রতি ঘৃণাবোধ জন্মাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম করার স্পৃহা ও আকাঙ্খারও উন্মেষ ঘটবে।
বর্তমানে ইরাকে প্রতি বছর ২০ মিলিয়নের অধিক জিয়ারতকারীর অংশগ্রহণের মধ্য ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে মজলুম ইমাম হোসাইন এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের শাহাদতের চেহেলাম বা আরবাইন দিবস পালিত হচ্ছে। সৌদী আরব,কাতার,আমিরাত,তুরস্ক, ইসরাইল ও ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ওহাবী-সালাফী-তাকফীরীদের আক্রমণের হুমকি ও ভয় থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.) ’র আরবাইনেরই জিয়ারতকারীদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্নদেশ ও অঞ্চল থেকে ইমাম হোসাইন (আ.) ’র ভক্ত আশেকানরা প্রতিবছর আরবাইন পালন করার জন্য কারবালায় যাচ্ছেন। ইরাকের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কোটি কোটি ভক্ত অনুরক্ত শহীদ মজলুম ইমামের প্রতি হৃদয়ের গভীর ভক্তি ও ভালোবাসার টানে শত শত মাইল পথ পায়ে হেটে প্রতিবছর ২০ সফর ইমাম হোসাইনের চেহেলাম পালন করার জন্য কারবালায় উপস্থিত হন।
পায়ে হেঁটে পথ চলার ক্লান্তি ও ধকল এসব ভক্তকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো থেকে বিরত রাখতে পারে না। আশুরার অপরাহ্নে যখন সব সঙ্গী-সাথী শাহাদত বরণ করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুহাইর,হাবীব,মুসলিম ইবনে আওসাজা,হোর,আলী আকবর,আওন,কাসেম। তারা সবাই শহীদ হয়ে গেছেন। ইমাম তখন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ একা শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায়। তখন তাঁবুতে চিলেন কেবল অসুস্থ ইমাম জয়নুল আবেদীন এবং আহলুল বাইতের কয়েকজন অসহায় তৃষ্ণার্ত নারী,কিশোরী ও শিশু মেয়ে।
ইমাম হোসাইন (আ.) তখন বললেন, কোন সাহায্যকারী আছে কি যে আমাকে সাহায্য করবে। কেউ কি আছে যে দুশমনদেরকে রাসূলে খোদার পবিত্র হারাম থেকে তাড়িয়ে দেবে...এক আল্লাহর পূজারী কেউ আছে কি যে আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে...কেউ আছে কি যে আল্লাহর জন্যই আমাদেরকে সাহায্য করবে...। এই ধ্বনি কালের গণ্ডি ভেদ করে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মের সব ইমাম হোসাইন প্রেমিকের অন্তরকর্ণে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আর সেই চিরন্তন আহ্বানে সাড়া দিয়েই এ সব জিয়ারতকারী মজলুম শহীদ ইমামের চেহলামের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মহাযাত্রা করে। আর এই মহাযাত্রার জিয়ারতকারীদের জন্য অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে খেদমত,আপ্যায়ন ও সেবায় নিজেদের সকল সহায়, সম্পদ নিয়োজিত নিয়ে হাজির হন দক্ষিণ ইরাকের সবচেয়ে দূরবর্তী শহর ও জনপদ থেকে শুরু করে কারবালা পর্যন্ত সকল গ্রাম,জনপদ এবং শহরের অধিবাসীরা।
সত্যি এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য যা কল্পনা করা সম্ভব নয়। আর নিঃসন্দেহে এটা হচ্ছে এক মহাঘটনা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর উপর যার ব্যাপক গভীর সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিবাচক গঠনমূলক প্রভাব পড়ছে। এ অবিস্মরণীয় ঘটনায় বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ ইমাম হোসাইন (আ.) ’র জীবনী,কর্মকাণ্ড,আদর্শের সাথে পরিচিত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হতে থাকবে। এরফলে তাদের ভেতরকার বিভেদ ও বিভক্তি হ্রাস পাবে এবং পারস্পরিক পরিচিতি ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে। এর মাধ্যমে বৃহত্তর সামাজিক,রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ঐক্যের পথ প্রশস্ত হবে।
এমনকি বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত জাতিগুলোর মধ্যেও মজলুম ইমামের আদর্শের সাথে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ দেখা দিবে যা তাদেরকে জালিমদের কাছ থেকে হারানো ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবার সংগ্রামে উদ্বুগ্ধ করবে।
শুধু তাই নয় শাহাদাতের চেহলামের সবচেয়ে বড় এ মানব সমাবেশ বিশ্বব্যাপী ইমাম মাহদী (আ.) র শুভ আবির্ভাবের পটভূমি ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ব্যাপারেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা উপেক্ষা করা যায় না তা হচ্ছে যে, হজ হচ্ছে ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভসমুহের একটি। হজ এমন এক ইবাদত যার আধ্যাত্বিক দিক ও কল্যাণের পাশাপাশি সামাজিক,রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে।
হজ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন ও সমাবেশ। তাই হজ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর শক্তি ও ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ।
মধ্যযুগীয় ধাঁচের রাজতান্ত্রিক সংকীর্ণ কূপমুণ্ডক ওহাবি সৌদি প্রশাসনের কবলে পড়ে আজ পবিত্র মক্কা ও মদিনা এবং হজ অনুষ্ঠান ইসলাম নির্দেশিত সে সব দিক ও তাৎপর্য হারিয়ে একটা নিষ্প্রাণ আচারসর্বস্ব অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ইব্রাহিমি-মুহাম্মদি হজ যা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য,সংহতি,স্বার্থ-কল্যাণ,কিয়াম ও জাগৃতির প্রতীক। যে পবিত্র মক্কা নগরীতে পবিত্র কোরানের ভাষায় বহিব়াগত ও স্থানীয় বাসিন্দা একসমান। যে পবিত্র মক্কা নগরী হচ্ছে শান্তির নগরী,যে মক্কা নগরী ও হজে বিশ্ব-মুসলিম উম্মাহর সমস্যা সমাধান এবং উন্নতি ও প্রগতির কথা আলোচিত হওয়া উচিৎ সেখানে আজ তার কিছুই হচ্ছে না। হজ অনুষ্ঠানে আজ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, স্বার্থ কল্যাণ, তাদের সমস্যা সমাধান এবং তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির কার্যকর বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয় না। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। ঐক্যের পরিবর্তে বস্তাপচা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক ওহাবি- সালাফি- তাকফিরি মতবাদ যা এ অঞ্চল ও মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্য বিশেষ করে ইঙ্গ-মার্কিন ও সৌদী রাজতন্ত্রের স্বার্থ সংরক্ষণকারী মতবাদ এখানে চালু করা হয়েছে। ইমাম খোমেনী একে আমেরিকান বা দরবারি ইসলাম নামে অভিহিত করেছিলেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল থেকে আগত হাজিদেরর মধ্যে তাকফিরি-সালাফি মতবদা প্রচার করে মুসলিম বিশ্বের প্রকৃত ঐক্য বিনষ্ট করা হচ্ছে। আজ হজ পালনকরতে আসা হাজীরা সৌদী প্রশাসনের খামখেয়ালী,হটকারি,কর্তব্যহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন,অদক্ষ এবং দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যাবস্থাপনার আওতায় যে নিরাপদ নন তার প্রমাণ হচ্ছে এ বছর মিনায় ১০ জিলহজ হাজার হাজার নিরীহ হাজি শাহাদত বরণ করেছেন। অথচ এ বছর হাজীর সংখ্যা ছিল বেশ কম (প্রায় আড়াই মিলিয়ন) । বিগত বছরগুলোতে মিনা ও মক্কায় এ ধরণের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিলো তবে সেগুলোর কোনটি এবছরের ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায় নি।
অথচ ২০ সফর প্রতিবছর পবিত্র মক্কা নগরীর চেয়ে আকার-আয়তনে ছোট শহর হওয়া সত্ত্বেও কারবালায় ওহাবি সালাফি দায়েশি আল-কায়দা তাকফিরিদের সন্ত্রাসী হামলার ভয়ংকর হুমকি ও ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, সেখানে আজ পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেনি। যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতবিক্ষত ও বিধ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও ইমাম হোসাইন (আ.) র আরবাইন উপলক্ষে ২০ মিলিয়নের অধিক জিয়ারতকারীর মহাসমাবেশে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নি।