মানব জাতির পরিপূর্ণ আদর্শ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)
প্রতিটি মানুষের অন্তরে বড় হবার আকাঙ্ক্ষা লুক্কায়িত থাকে। মানুষের জীবনের একটি লক্ষ্য থাকে যেখানে সে পৌঁছতে চায়। বড় হবার আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে একটি কাল্পনিক আদর্শ মানুষের মনে দানা বাঁধে। সে স্বভাবত কোনো অনিশ্চিত অবস্থার দিকে অগ্রসর হতে পছন্দ করে না বলেই তার রুচি অনুযায়ী অন্য কোনো যোগ্য মানুষকে আদর্শ হিসেবে বেছে নেয় এবং তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে অগ্রসর হয়।
যেমন কোনো তরুণ ডাক্তার একজন ভালো ডাক্তারকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। অর্থনীতির একজন ছাত্র একজন বড় অর্থনীতিবিদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। এভাবে দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ ঠিক করে নেয়। কিন্তু সৃষ্টির উদ্দেশ্য অনুযায়ী একজন মানুষের যখন পূর্ণ মানব হিসেবে গড়ে ওঠার প্রশ্ন সেখানে এমন খণ্ডিত আদর্শ মানুষের পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আদর্শ নির্ধারণ করার বিষয়টি এজন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আদর্শের বিষয়টি একটি মাত্র জায়গায় কেন্দ্রীভূত থাকে না। এটা বিস্তৃত হয়ে পড়ে। মানুষ আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিকে প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্ধের মতো অনুকরণ ও অনুসরণ করতে থাকে। তার চলাফেরা, কথা বলার ধরন, আচার-ব্যবহার, এমনকি তার খাবারের মেনু, খাবার গ্রহণের স্টাইল ইত্যাদিও অনুসরণের বিষয় হয়ে পড়ে।
কিন্তু আদর্শ মানুষের অন্ধ অনুসরণ মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। একজন ডাক্তার, ডাক্তার হিসেবে আদর্শ হতে পারেন, কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে তিনি আদর্শ নাও হতে পারেন, আবার একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ পারিবারিক দিক দিয়ে আদর্শ নাও হতে পারেন। এমনকি কোনো এক ক্ষেত্রের আদর্শ ব্যক্তি অন্য একটি বিষয়ে ঘৃণ্যও হতে পারেন। আর বিপদটা আসে এখানেই। যখন কোনো ব্যক্তিকে আদর্শ মেনে নেয়া হয়, তখন তার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয় এবং এ ভালোবাসা আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিত্বের খারাপ দিকগুলোকে উপেক্ষা করতে শেখায় অথবা সেগুলোকে বৈধতা দেয়ার জন্য বা সেগুলোকে ভালো কাজ বলে গ্রহণ করার জন্য মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
আমাদের দেশে অগণিত মানুষ আদর্শ হিসেবে মানছে হয়তো শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক বা তথাকথিত মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বকে। তাঁরা যা বলেছেন, এরা তা অবলীলায় মেনে নিচ্ছে। যেমন ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের কলম চলে না, তাঁরা বাকরুদ্ধ। এর বিপরীতে ইসরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন তাদের দৃষ্টিতে হলো সহিংসতা। তাঁদেরকে যারা আদর্শ বলে মেনে নিয়েছে, তাদেরও একই সুর।
আবার নারী জাতিকে প্রকৃত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা নয়; বরং নারীকে বেপর্দা করাই তাঁদের দৃষ্টিতে নারীমুক্তি। তাঁদের আদর্শের অনুসারীদের কাছেও তাই নারীমুক্তির সংজ্ঞা হলো বেপর্দা হওয়া।
এভাবে আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তির অযৌক্তিক কাজ বা কথাকে তাঁদের অনুসারীরা ভালো বলে গ্রহণ করতে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে জীবনের সকল ক্ষেত্রে একজন আদর্শ ব্যক্তি পাওয়া নিঃসন্দেহে খুব কঠিন বিষয়। কারণ, মানুষের জীবনের পরিব্যাপ্তি এত ব্যাপক যে, এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে। আবার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আদর্শ স্থাপন করা আরো কঠিন।
পারিবারিক জীবনে একজন মানুষকে অসংখ্য সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়। পরিবারে কখনো সে সন্তান, কখনো পিতা বা মাতা, কখনো ভাই বা বোন, কখনো স্বামী বা স্ত্রী। এভাবে সমাজে নানা রকম সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ভূমিকাও ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রতিটি ভিন্ন অবস্থানে নিজেকে আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব?
একজন প্রতিবেশী হিসেবে সমাজের জন্য কতটুকু আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? মানুষের সাথে লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজের আইন-কানুন মেনে চলা, ওয়াদা পালন, সমাজে নেতৃত্ব দান বা কারো আনুগত্য পালন এত বিস্তৃত ক্ষেত্রে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয় কি?
যদি রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, সন্ধি, যুদ্ধ ঘোষণা, আন্তর্জাতিক নীতি মেনে চলা– প্রতিটি বিষয়ে মানুষ কতটুকু সচেতন হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আদর্শ হতে পারে? এগুলো অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন।
উপরিউক্ত বিষয়গুলোর কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও প্রতিটি বিষয় সম্বলিত পরিপূর্ণ আদর্শ হওয়া কি সম্ভব? অথচ মানব জীবনের পূর্ণতার প্রশ্নে এমন ব্যক্তিই তো আদর্শ হবেন যার মধ্যে পূর্ণতার সবগুলো দিক সমন্বিত হয়েছে। তিনি একদিকে আদর্শ রাজনীতিবিদ, আদর্শ আইনপ্রণেতা, আদর্শ সেনাপতি, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক, আদর্শ সংস্কারক, আদর্শ অর্থনীতিবিদ, অন্যদিকে আদর্শ মানবতাবাদী, আদর্শ প্রতিবেশী এবং আদর্শ গৃহকর্তাও।
কে এমন ব্যক্তি যিনি এ সবগুলো গুণের আধার হতে পারেন? আসলেই কি সম্ভব এমন ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া? এটা কখনই সম্ভব নয় যদি এর পেছনে মহান আল্লাহর সাহায্য না থাকে। পৃথিবীতে যাঁরাই এমন আদর্শ হয়েছেন তাঁরাই মহান আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায়ই এমন হয়েছেন। অবশ্য আল্লাহর এ বিশেষ ব্যবস্থাপনার আওতায় নিজেকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা তাঁদেরকে করতে হয়েছে, আর আল্লাহ তাঁদের কবুল করেছেন।
আমাদের আদর্শ তাই আল্লাহ তা‘আলার সেসব বান্দা যাঁরা তাঁর বিশেষ রহমতের ছায়ায় স্থান পেয়েছেন। তাঁরা হলেন নবী-রাসূল ও ইমামগণ। আর তাঁদের শীর্ষস্থানীয় হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)।
মহানবী (সা.) ব্যতীত অন্যান্য নবী-রাসূলগণও আমাদের আদর্শ। কিন্তু তাঁদের পূর্ণাঙ্গ জীবনেতিহাস আমাদের মাঝে নেই। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সবচেয়ে বেশি বর্ণনা করেছেন মূসা (আ.)-এর ঘটনা। এ বর্ণনাগুলো থেকে আমরা মূসা (আ.)-এর সাহস, তাঁর সংগ্রামী জীবন, ফিরআউনের সাথে তাঁর বিতর্ক সম্পর্কে জানতে পারি। তাঁর জন্ম ও ফিরআউনের গৃহে আশ্রয় লাভের কিছু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ছাড়া তাঁর জীবনযাপন প্রণালী এবং অন্যান্য দিক আমাদের নিকট অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
হযরত নূহ (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত ঈসা (আ.) সবার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। বিভিন্ন বর্ণনা যা আমাদের কাছে পৌঁছেছে তারও অনেকাংশ বানোয়াট ও বিকৃত কাহিনীতে ভরা। কেবল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ জীবনী আমরা জানতে পারি। আর এর মধ্যেই আমরা পূর্ণতায় পৌঁছানো এক অসাধারণ সত্তাকে খুঁজে পাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে যাঁকে উদ্দেশ্য করে বলছেন:
﴿إِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ﴾
‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা কালাম: ৪)
অন্যদিকে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মানব জাতির উদ্দেশ্যে বলছেন:
﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ﴾
‘নিশ্চয়ই রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহযাব: ২১)
উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের আদর্শের ঠিকানা পেয়ে যাচ্ছি।
অন্যান্য নবী-রাসূলে জীবনে কোনো কোনো দিক প্রকাশিত হয়েছিল অধিক মাত্রায়। কিন্তু রাসূলের মধ্যে মানব জীবনের প্রতিটি দিকের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটেছিল। যেমন বলা হয়েছে: হযরত নূহ (আ.)-এর জীবন ছিল কুফর ও নাস্তিকতার বিরুদ্ধে আন্তরিক ঘৃণা, সীমাহীন ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জীবনে দেখা যায় অলীক উপাস্য ও দেবতাগণের উচ্ছেদ এবং প্রতিমার ধ্বংস সাধন করার মহান দৃশ্য। হযরত মূসা (আ.)-এর জীবন নির্ভিকতা, ন্যায়ের খাতিরে সংগ্রাম এবং আল্লাহর আইন-কানুন প্রচলন করার দৃষ্টান্ত। হযরত ঈসা (আ.)-এর জীবন নম্রতা, ক্ষমা, ধৈর্যধারণ এবং কৃচ্ছ্র সাধনার উত্তম শিক্ষা। হযরত সোলাইমান (আ.)-এর জীবন বাদশাহী শান-সওকত এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মনোরম ক্ষেত্র। হযরত আইউব (আ.)-এর জীবন সহনশীলতা, ধৈর্য ও শুকরিয়ার নমুনা। হযরত ইউনুসের জীবন অনুশোচনা, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণের দৃষ্টান্ত। কিন্তু এ সকল নবীর গুণাবলী সবই রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে। আর এসব গুণের সর্বোচ্চ প্রকাশস্থলই হচ্ছেন তিনি।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বলেছেন: ‘মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন শৈশবে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম এবং বয়স্কাবস্থায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র। তিনি ছিলেন স্বভাব-চরিত্রে পবিত্র ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র।’১
খতীব বাগদাদী আত তারিখুল জামে গ্রন্থে একটা যাইফ (দুর্বল) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করে লিখেছেন, প্রিয় নবীর জন্মের পরই একটি গায়েবী আওয়াজ এসেছিল যে, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহকে নিয়ে সমগ্র পৃথিবী পরিভ্রমণ করো, তাঁকে সমুদ্রের অতল তলে, প্রত্যেক জঙ্গল-প্রান্তরে, পর্বতসমূহের গুহায় নিয়ে যাও যাতে পৃথিবীর জ্বীন, ইনসান, জীবজন্তু, পশুপাখি, উদ্ভিদ এবং প্রস্তর কাঁকর সবকিছু তাঁকে চিনে নেয় এবং তারা অবহিত হয় যে, পৃথিবীতে শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর আবির্ভাব হয়েছে এবং তাঁর মধ্যে সব সৎ গুণের সমাবেশ বিদ্যমান। অতঃপর বিশ্বনিয়ন্তা মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন যে, আদমের স্বভাব, নূহের সৌর্য, শিশের দিব্যজ্ঞান, ইবরাহীমের প্রেম, ইসমাইলের ত্যাগ, ইসহাকের তুষ্টি, সালেহের সুভাষণ, লূতের বিবেক, মূসার দৃঢ়তা, আইউবের ধৈর্য, ইউনুসের আত্মসমর্পণ, ইউশার সংগ্রাম, দাউদের মধুস্বর, দানিয়ালের ভালোবাসা, ইলইয়াসের সৌম্য, ইয়াহইয়ার পবিত্রতা এবং ঈসার তপস্যা একত্র করে তাকে এসব চরিত্রের মধ্যে ডুবিয়ে তোল।
অনেক আলেম এ হাদীস নিজেদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন, যদিও তা দুর্বল। তাঁদের উদ্দেশ্য শুধু এটা বলা যে, সব নবীর গুণের পূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে।২
আর বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে পরিচিত করানোর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তাঁর জন্মের আবির্ভাবের সংবাদ প্রদানকেই এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
অন্যান্য নবী যেসব সৎ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন, শেষনবী (সা.)-এর মধ্যে তার সবগুলোই একসঙ্গে সন্নিবেশিত হয়েছে। সাধারণ মানব জীবনে এক ব্যক্তির মধ্যে একই সময় এতগুলো পরস্পর বিরোধী গুণের সমাবেশ হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। তিনি এমন একটি রাষ্ট্রের অধিপতি ছিলেন যেখানে একদিকে রাশি রাশি ধনদৌলত উট বোঝাই হয়ে তাঁর দরবারে স্তূপীকৃত হচ্ছিল, অপরদিকে তিনি এত অভাবগ্রস্ত যে, দিনের পর দিন তাঁর বাড়িতে চুলায় আগুন জ্বলেনি এবং তাঁর ঘরে অনাহার-অর্ধাহার চলছিল। তিনি এমন রণবিশারদ যে অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে বিপুল অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত বিরাট বাহিনীর সাথে সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি এত শান্তিপ্রিয় ছিলেন যে, হাজার হাজার প্রাণ উৎসর্গকারী পরাক্রান্ত বীর বাহিনী সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও বিনা দ্বিধায় সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দান করেছিলেন। তিনি এত নির্ভীক ও সাহসী ছিলেন যে, শত-সহস্র সৈনিকের মোকাবিলায় একাই অটল ও অবিচলভাবে দণ্ডায়মান থাকতেন। তিনি এত দয়ার্দ্র ছিলেন যে, সারা জীবনে কাউকে তিনি নিজের কারণে ধমকও দেননি। তিনি দায়িত্ববোধে এমন সজাগ ছিলেন যে, সারা দেশের তুচ্ছ-বৃহৎ ঘটনা ও সমস্যার খবর রাখতেন এবং তার প্রতিকার ও সমাধানের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। তিনি একদিকে এতটা সম্বন্ধহীন ছিলেন যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো সাথে সম্পর্ক রাখতেন না। অপরদিকে এত ঘনিষ্ঠ যে, স্ত্রী-পরিজনের খেয়ালে, প্রতিবেশীর চিন্তায়, গরীব-দুঃখীদের ভাবনায় এবং দুনিয়ার সকল ভ্রান্ত মানবের মুক্তির উৎকণ্ঠায় বিভোর হয়ে থাকতেন। তিনি এত দয়ালু যে, নিজের পরম শত্রুদের সাথে গলাগলি এবং তাদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেছেন এবং সেজন্য নিজেও অজস্র অশ্রুধারা প্রবাহিত করেছেন। যখন তিনি একজন বিজয়ী তখনও তিনি রাত্রি জাগরণকারী তপস্বী। যখন তাঁর আরব সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার সময়, তখন তিনি খেজুর গাছের ছাল ভরা বালিশে ভর দিয়ে খসখসে চাটাইয়ের ওপর উপবেশনকারী ফকিররূপে বিরাজমান। যখন সমগ্র আরব তাঁর করায়ত্তে তখন তাঁর ঘরে একটি পানির মশক, কয়েকটি কাঠের পাত্র ও কয়েক মুঠি যব মাত্র সম্বল। তাঁর এ জীবনধারা দেখে হযরত উমরও বিস্মিত হয়ে বলেন: ‘কায়সার ও কিসরা দুনিয়ার মজা লুটছে, আর আপনি নবী হয়ে এত অভাব-অনটনের মধ্যে আছেন?’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন: ‘হে উমর! তুমি কি এতে রাজি নও যে, তারা দুনিয়ার অস্থায়ী সুখ উপভোগ করুক আর আমরা আখেরাতের অফুরন্ত চিরস্থায়ী সৌভাগ্য ও সম্মান লাভ করি?’৩
যা হোক মহানবী (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের জন্য আদর্শ রয়েছে। রাসূলের জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত আদর্শ জীবনের বর্ণনা সংক্ষেপে এখানে উপস্থাপন করা হলো।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মগ্রহণের পরপরই তাঁর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। যেমন যখন তিনি দুধ মায়ের দুধ পান করেছেন তখন একটি স্তন তাঁর দুধ ভাইয়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এটি অবশ্যই একটি অলৌকিক বিষয় এবং মহান আল্লাহর বিশেষ বিষয়। এখানে আসলে বলার কিছু নেই। কিন্তু বালক বয়স থেকেই রাসূল (সা.)-এর কর্মকাণ্ড ছিল আদর্শ। সবাই যখন এ বয়সে খেলাধুলায় লিপ্ত তখন তিনি অন্য চিন্তায় মশগুল। তাঁর আচরণ অন্য বালকদের মতো নয়। বালক বয়সেই বড়-ছোট, ধনী-দরিদ্র, দাস, ইয়াতীম সবার সাথে তাঁর আচরণের কারণে তিনি সকলের স্নেহভাজন হয়েছিলেন। সেই বয়সেই সত্যবাদিতার কারণে তিনি ‘আস-সাদিক’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
যুবক বয়সে হিলফুল ফুযুলে যোগ দিয়ে তিনি সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বিশ্বস্ততা ও আমানতদারীর কারণে তিনি ‘আল-আমীন’ উপাধিতে ভূষিত হন। জাহেলিয়াতের যুগের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিলেন। কোনো অশ্লীলতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি কোনোদিন মূর্তির সামনে মাথা নত করেননি। উজ্জ্বল কর্মকাণ্ডের জন্য ইয়াতীম হয়েও তিনি সমাজের সকল শ্রেণির মধ্যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। হাজরে আসওয়াদ স্থাপনে তাঁর রায় সবাই সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছিল।
যুবক বয়সে তিনি বিয়ে করেন একজন বিধবা নারীকে। যখন নারীদের মানুষ বলে গণ্য করা হতো না, সে সময় তিনি নারী জাতির মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। নারীকে যথাযথ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। পরিবারের মধ্যে রাসূল একজন আদর্শ স্বামী। স্ত্রীদের মধ্যে সমতা বিধানে তিনি আদর্শ ছিলেন।
তিনি ছিলেন আদর্শ পিতা। যে সময় কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো সেসময় তিনি হযরত ফাতেমা (আ.)-এর প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন তাতে সন্তান হিসেবে কন্যার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হযরত ফাতিমার প্রতি আচরণের মাধ্যমে একজন কন্যার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.) তা দেখিয়েছেন।
প্রতিবেশী হিসেবে রাসূল (সা.) ছিলেন অতুলনীয়। যে বৃদ্ধা তাঁর পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো তার অসুস্থতায় তিনি তার শিয়রে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবেশীর আনন্দে অংশগ্রহণ করা, শোকে সান্তনা দেয়া, বিপদে সাহায্য করা, অসুস্থতায় দেখতে যাওয়া, জানাযায় অংশগ্রহণ করাকে তিনি প্রতিবেশীর হক (অধিকার) বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেশী পরামর্শ চাইলে সৎ পরামর্শ দান, দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্য ধার চাইলে ধার দেয়া, ধার দিতে অক্ষম হলে সহানুভূতি প্রদর্শন করাকে তিনি প্রতিবেশীর কর্তব্য হিসেবে নির্ধারিত করেছেন। তিনি যেমন প্রতিবেশীর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন তেমনি তাদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য তিনি তাঁর উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِيْ يَشْبَعُ وَ جَارُهُ جَائِعُ إِلَى جَنْبِهِ
‘যে ব্যক্তি তার নিকটবর্তী প্রতিবেশীকে ভূখা রেখে নিজে পেট পুরে খায় সে মুমিন নয়।’৪
আবার তিনি তিনবার আল্লাহর কসম দিয়ে বলেছেন:
لَا يُؤْمِنُ الَّذِيْ لَا يَأْمَنُ جَارٌ بِوَائِقِهِ
‘যার দৌরাত্ম্যে প্রতিবেশী শান্তি পায় না, সে মুমিন নয়।’৫
রাষ্ট্রীয় জীবনে রাসূল (সা.) তাওহীদী আদর্শের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করেন। দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি এমন আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সুষম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। মজুরী প্রদানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন: ‘মজুরের ঘাম শুকিয়ে যাবার আগেই তার পারিশ্রমিক মিটিয়ে দাও।’৫ যাকাত, খুমসের বিধানের মাধ্যমে সমাজে ধনী-দরিদ্রদের সম্পদের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পদের অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করেছেন। মজুতদারীর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
যুদ্ধের ময়দানে রাসূল একজন আদর্শ সেনাপতি। বিপক্ষ আক্রমণ না করা পর্যন্ত তিনি আক্রমণ করতেন না। সাধারণ নাগরিক, নারী, শিশু, বৃদ্ধ, ফসলের জমি, ফলবান বৃক্ষ, জীব-জন্তুর ওপর হামলা করা নিষিদ্ধ করেছিলেন। সন্ধির ক্ষেত্রে রাসূল এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। অপর পক্ষ সন্ধি ভঙ্গ না করলে তিনি সন্ধির শর্ত মেনে চলতেন।
মহানবী (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি পর্যায় যেমন আমাদের জন্য আদর্শ তেমনি তাঁর ইবাদাত-বন্দেগী এবং প্রতিটি কর্মও আমাদের জন্য আদর্শ। তাঁর চলা, বলা, ওঠা, বসা, খাওয়া, শোয়া, মেলা-মেশা, শাসন, রাগ-অনুরাগ সবকিছুই এত আদর্শস্থানীয় যে, প্রতিটি মানুষকে তা আকৃষ্ট করে।
ইবাদাত-বন্দেগী: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইবাদাত-বন্দেগী সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত ব্যাপকভাবে যা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। তবে ইসলামের প্রধান দু’টি রুকন নামায ও রোযার ব্যাপারে সামান্য ইঙ্গিত এখানে দেয়া হলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যধিক নামায পড়তেন। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর দু’পা ফুলে যেতো। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেন: ‘আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ ও নিশ্চয়তা দেয়ার পরও রাসূলুল্লাহ্ এত অধিক নামায পড়তেন যে, তিনি ক্লান্ত হয়ে যেতেন।’ তিনি নিয়মিত রোযা রাখতেন। তিনি রমযান মাসের রোযার আগে রজব ও শাবান এ দু’মাস একটানা রোযা রাখতেন।
জীবন যাপন প্রণালী: রাসূল (সা.) কখনই পেট পুরে খেতেন না। খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে তিনিই বলেছেন: মুমিনরা খায় একটি উদর পূর্ণ করে। আর কাফেররা খায় সাত উদরে। তিনি অযথা শরীরের কোনো অংশ বের করে রাখতেন না। তিনি কখনই নরম বিছানায় শুতেন না, চাটাইয়ের বিছানা ও ভেতরে খেজুরের ছাল দিয়ে চামড়ার বালিশ তৈরি করে ব্যবহার করতেন।৭
রাসূলের আচার-ব্যবহার: রাসূলুল্লাহ (সা.) ধীরে ধীরে থেমে থেমে কথা বলতেন যাতে সবাই বুঝতে পারে। যখন তিনি কথা বলতেন তখন তাঁর মধুর কণ্ঠ শুনে সকলে অভিভূত হয়ে যেত। যখন তিনি ভাষণ দিতেন তখন লোকজন অশ্রু সংবরণ করতে পারত না। কারো দিকে ফিরে কথা বললে যতক্ষণ সে মুখ ফিরিয়ে না নিত ততক্ষণ তিনি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না। পাশে তাকাবার সময় তিনি পুরো শরীর ঘুরিয়ে তাকাতেন। তাঁর সাথে যদি কেউ মুসাফাহা করতো তাহলে যতক্ষণ সে তার হাত টেনে না নিত তিনি তাঁর হাত টেনে নিতেন না। তিনি কখনই মুচকী হাসি ছাড়া হাসতেন না। দাসদাসীদের সাথে কোমল আচরণ করতেন। হযরত আনাস দশ বছর রাসূলের খেদমত করেছেন। তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনোদিন কোনো বিষয়ে উহ্ পর্যন্তও বলেননি। কিংবা বলেননি যে, ‘কেনো তুমি এরূপ করলে বা কেনো এরূপ করলে না।’ তিনি সাহাবীদের সাথে সব রকম কাজে শরিক হতেন। এমনকি সবচেয়ে কঠিন কাজটি তিনিই বেছে নিতেন।
এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পুরো জীবনটাই মানুষের জন্য আদর্শ। শুধু তত্ত্বগতভাবে নয়, বরং প্রতিটি কর্মের ক্ষেত্রে তিনি বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে। যদি আমরা তাঁর আদর্শ থেকে শিক্ষা না নিয়ে কেবল তাঁর আদর্শের প্রশংসা করি তাহলে আমাদের অবস্থা হবে ঐ সব অমুসলিম বিখ্যাত ব্যক্তির মতো যাঁরা শুধু তাঁদের কথায় বা লেখনীতে রাসূলকে আদর্শ বলেছেন, অথচ নিজেদের জীবনে তা মেনে চলার প্রয়োজন বোধ করেননি। আমাদের অবস্থা যেন তাঁদের মতো না হয় সে ব্যাপারে আমাদেরকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।(সূত্র : আল বাসাইর)
সংকলন: মিকদাদ আহমেদ