আল হাসানাইন (আ.)

পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষ-(১ম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সার সংক্ষেপ

আল কুরআনের আলোকে উদ্বুদ্ধ মানুষ জ্ঞান ও পরিচিতিবিদ্যা (Epistemology) এবং অস্তিত্ববিদ্যার (Ontology) দৃষ্টিকোণ থেকে ঐশী প্রত্যাদেশের (ওহী) স্বচ্ছ আয়নায় নিজের অস্তিত্ব ও সত্তাকে অনুসন্ধান করে। তার আত্মপরিচিতির শুরু ‘আল্লাহ্ থেকে’ এবং শেষ হলো ‘আল্লাহ্য়’। তার যাত্রার উদ্দেশ্যও হলো আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ এ অর্থে যে, এ ধরনের মানুষ ঐশী প্রকৃতি, একত্ববাদী প্রবণতা ও স্বর্গীয় সত্তার অধিকারী। তাই কুরআনী মানুষ খোদা প্রত্যাশী ও ঐশী চিন্তার অধিকারী জীবিত সত্তা এবং সৃষ্টিগত (তাকভীনী বা বাধ্যতামূলকভাবে) ও বিধানগত (তাশরিয়ী বা স্বাধীনভাবে) উভয় ক্ষেত্রে সত্তাগত পূর্ণতাকামী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সে অভ্যন্তরীণ ও বহির্জগতকে একই সঙ্গে পর্যায়ক্রমে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করে। কারণ, সে আল্লাহর খলিফা (প্রতিনিধি), ঐশী আমানতের রক্ষক এবং ঐশী সৌন্দর্য ও শক্তিমত্তার নামকে ধারণ ও বহন করে। তাই সে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শরীয়তের রশ্মিতে নিজেকে আলোকিত করে ও সকল অন্ধকার থেকে নিজেকে সংরক্ষিত রাখে। সে ওহী ও বুদ্ধিবৃত্তির অনুমোদিত পথে সার্বক্ষণিকভাবে নিজেকে গঠনের পথে নিয়োজিত রাখে যাতে ঐশী চরিত্র ও কুরআনী বৈশিষ্ট্যে নিজেকে অলংকৃত করতে পারে।

এ ধরনের মানুষ চিন্তাপ্রবণ, বুদ্ধিনির্ভর, আত্মসচেতন, আত্মগঠিত, চিরন্তন পবিত্র জীবনের অধিকারী, স্রষ্টার উপাসক ও তাঁর প্রতি নিবেদিত, সঠিক জ্ঞানের অধিকারী, সৎ, উপযুক্ত, কর্মশীল এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের সকল দিকে ভারসাম্য রক্ষাকারী।

আলোচ্য প্রবন্ধটি কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের সত্তাগত পরিচয় তুলে ধরেছে, এ ধরনের মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ও তার কেন্দ্রীয় কাঠামোকে কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে যাতে করে মানুষের পরিচয়, পূর্ণতাকামিতা, নৈতিকতা ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ দিকসমূহ ওহীর আলোকে সকলের সামনে স্পষ্ট হয় এবং তার ভিত্তিতে সচেতন ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ সর্বোত্তম সৃষ্টি ব্যবস্থায় তার প্রকৃত অবস্থান ও পথ খুঁজে পায় ও নিজেকে সেভাবে আলোকিত করতে পারে ।

 

ভূমিকা

কুরআনী চিন্তাধারা অনুসারে মানুষ শারীরিক ও আত্মিক উভয় দিক দিয়ে সর্বোত্তম আকৃতি ও গঠনে সৃষ্ট। (সূরা তীন : ৪) স্বয়ং স্রষ্টা তাঁর ঐশী হাতে (সূরা সাদ : ৭৫) তার রূপ দিয়েছেন যাতে সে তাঁর সকল সৌন্দর্য ও শক্তিমত্তার নাম ও গুণবাচক বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে। মানুষ ব্যতীত সকল সৃষ্টি, যেমন স্থায়ী ও অস্থায়ী জগৎ (পরজগৎ ও ইহজগৎ), ফেরেশতা ও বস্তুজগৎ, দৃশ্য ও অদৃশ্য জগৎ সকল কিছু তার (মানুষের) উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রকৃতি ও অতি প্রাকৃতিক, ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয়, বস্তু ও অবস্তু জগতের প্রতিফলন তার মধ্যে ঘটেছে। তুচ্ছ কাদা মাটি থেকে ঐশী আত্মার সমন্বয় মানুষের অস্তিত্বে ঘটেছে। আল্লাহ্ বলেন : ‘অতঃপর যখন তার গঠন কার্য সুসম্পন্ন করি তখন নিজের আত্মা থেকে তাতে ফুঁকে দেই’ (সূরা হিজর : ২৯ ও সূরা সাদ : ৭২) যাতে মানুষ তার সত্তাগত পূর্ণতায় পৌঁছার মাধ্যমে ঐশী সত্য ও বাস্তবতাকে ধারণের যোগ্যতা লাভ করে। এরূপ ঐশী সম্পদ লাভের কারণে মানুষ সৃষ্টির মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক অবস্থানে পৌঁছায়। তখন সে সৃষ্টজগতের সকল রহস্য অনুধাবন ও সকল নাম আল্লাহর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করে- ‘তিনি আদমকে সকল নাম শিক্ষা দান করলেন।’ (সূরা বাকারা : ৩১)। মানুষ একদিকে ওহীর মাধ্যমে তার অস্তিত্বের রূপকে চিনতে পারে অন্যদিকে এমন এক প্রকৃতির (ফিতরাতের) অধিকারী যা অদ্বিতীয় ও অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন । এ দুই ব্যতিক্রমী ও অতি প্রাকৃতিক সম্পদ কেবল মানুষকেই দেয়া হয়েছে । কুরআন মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি ও তার আমানতের সংরক্ষক হিসাবে পরিচিত করিয়েছে যাতে মানুষ তার প্রকৃত মর্যাদাকে যথার্থ ও গভীরভাবে অনুধাবন করে । পবিত্র কুরআন মানব-পরিচিতি ও মানুষ তৈরির পূর্ণতম গ্রন্থ যা সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে (সূরা মুমিনূন : ১৪) ব্যাখ্যা করা, শিক্ষা দান ও প্রশিক্ষিত করার সর্বোত্তম বাণী (সূরা যুমার : ২৩) নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে । এ গ্রন্থে সর্বাপেক্ষা সুদৃঢ় পথনির্দেশনা (সূরা বনি ইসরাইল : ৯) সুন্দরতম গঠনের সৃষ্টির জন্য বর্ণিত হয়েছে । এ মানুষের মধ্যে যেমন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বিষয় (পবিত্র কুরআনের মুহকাম বা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াতের ন্যায়) রয়েছে তেমনি তার মধ্যে অস্পষ্ট বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যামূলক বৈশিষ্ট্যও (কুরআনের মুতাশাবিহ আয়াতের ন্যায়) রয়েছে। মানুষের অস্তিত্বের প্রাকৃতিক ও প্রবৃত্তিগত (জৈবিক) দিক যা তার অস্পষ্ট ও বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যাকারী দিক তাকে তার অস্তিত্বের সুদৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীন ঐশী প্রকৃতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে ওহীর ভিত্তিতে মানুষকে চেনার ক্ষেত্রে কোনো রূপ শূন্যতা, অস্পষ্টতা ও ঘাটতি না থাকে । মানুষ কুরআনের আলোতে তার করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়কে জানবে এবং তার সত্তাগত রূপ ওহীর মধ্যে অনুসন্ধান করবে । কারণ, মানুষের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ব্যাখ্যা কুরআনের আলোয় বাস্তবরূপে আবির্ভূত হয়।’

মানুষের পরিবর্তন, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও পূর্ণতার উপকরণসমূহ সম্পর্কে জানতে চাইলে মানুষের সত্তাগত পরিচয় ও অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে জানতে হবে । কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত না জানব যে, মানুষ কী এবং তার অস্তিত্ব ও সত্তাগত পরিচয় কী, ততক্ষণ তার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রবণতা ইত্যাদির প্রকৃতি ও ধরন নির্ধারণে সক্ষম হবো না । মোট কথা, মানুষের জ্ঞান, কর্ম ও ব্যবহারিক বিকাশ ও আত্মগঠনের জন্য তার পরিচয় লাভ অপরিহার্য । বর্তমান পৃথিবীতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যে বিভিন্নতা (চিন্তাগত, কাঠামোগত ও পরিকল্পনাগত রূপে) লক্ষ্য করা যায় তার মূলে রয়েছে মানুষ সম্পর্কে প্রত্যেক চিন্তাধারার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। তাই এক্ষেত্রে সর্বোত্তম হলো মানুষের পরিচয়কে তার সৃষ্টিকর্তার বাণী থেকে উদ্ঘাটন করা । এ উদ্দেশ্যেই মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রতি বিশ্বাসীদের উদ্দেশে বলেছেন : ‘হে যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের নিজেদের (সম্পর্কে জানা ও আত্মগঠনের) দায়িত্ব তোমাদের ওপরই ন্যস্ত’ (সূরা মায়েদা : ১০৫)। অর্থাৎ তোমাদের অস্তিত্বের গভীরে অনুসন্ধান কর এবং নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞানগত ধারণা অর্জন ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে স্বীয় বাস্তব রূপকে দর্শন কর যাতে তোমাদের সঠিক দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হতে পার । এ কারণেই কোনো কোনো মনীষী বলেছেন : ‘আত্মপরিচিতি সবচেয়ে কল্যাণকর জ্ঞান।’ পূর্ণতা ও বিকাশ লাভ এবং আত্মপরিশুদ্ধির পথকে মসৃণ করার উপকরণ হলো আত্মপরিচিতি । আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলীর ভাষায় : ‘এ জ্ঞান (আত্মপরিচিতির জ্ঞান) একদিকে চিন্তাগত ও তাত্ত্বিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করে অন্যদিকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিশুদ্ধতা দান করে।’

অতএব, মানুষের সর্বোত্তম পরিচয় দানকারী হলো পবিত্র কুরআন এবং তার সর্বোত্তম প্রশিক্ষক ও পূর্ণতা বিধায়ক হলো ‘পূর্ণ মানব’ যিনি ঐশী প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত । যদি মানুষ নির্বাক কুরআন (ঐশী গ্রন্থ) এবং সবাক কুরআনের (পূর্ণ মানব) মাধ্যমে নিজেকে চিনে ও তাদের নির্দেশিত পথে চলে তবে সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভ করবে । কারণ, পবিত্র কুরআন ও পূর্ণ মানব (ইনসানে কামেল) মানুষের পূর্ণতা ও বিকাশের সহযোগী (প্রভাবক) ও প্রতিবন্ধক উপাদানসমূহ, তার উত্থান ও পতন এবং পথপ্রাপ্তি ও বিচ্যুতির কারণসমূহকে সর্বোত্তমরূপে বর্ণনা করেছে। কুরআনী পরিচয়ে মানুষ হলো ঐশী চিন্তাশীল জীবন্ত সত্তা । আরো যথার্থভাবে বলা যায় যে, সে হলো খোদাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন (চিন্তাশীল) প্রাণী । আল্লামা জাওয়াদী আমুলী মানুষ সম্পর্কিত তাঁর এ সংজ্ঞাকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন এভাবে : ‘এ সংজ্ঞার ভিত্তিতে মানুষের জাতি (Genus) হলো বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী (যদিও প্রচলিত সংজ্ঞায় মানুষের জাতি ‘প্রাণী’ এবং উপজাতি বা Species ‘বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন বা চিন্তাশীল সত্তা’ ধরা হয়ে থাকে; কিন্তু এ সংজ্ঞায় এ দুটি জাতির অন্তর্ভুক্ত গণ্য হয়েছে) যার মধ্যে মানুষ, স্বেচ্ছায় চলনশক্তির অধিকারী প্রাণীসমূহ ও উদ্ভিদ এ তিন সত্তার সমন্বয় ঘটেছে । এ সংজ্ঞায় মানুষের উপজাতি হলো ‘খোদাকাঙ্ক্ষী বা প্রত্যাশী’ অর্থাৎ তার মধ্যে (সত্তায়) খোদা পরিচিতি ও খোদার মধ্যে বিলীন হওয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাকে খোদাপ্রেমিকে পরিণত করেছে । পবিত্র কুরআন বুদ্ধিবৃত্তিকে মানুষের চূড়ান্ত ও পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে না যদিও তার জন্য এ বৈশিষ্ট্যটি অপরিহার্য কিন্তু তা মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, কোনো মানুষ যদি রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত কলা-কৌশল ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শৈল্পিক ও সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী হয়, কিন্তু তার এ জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা তার প্রবৃত্তির সেবায় রত হয় তবে সে (হয়) চতুষ্পদ নিরীহ প্রাণী, (অথবা) চতুষ্পদ হিংস্র প্রাণী অথবা প্রাণীরূপী শয়তান (এ অবস্থায় সে প্রাণী থেকেও নিকৃষ্ট ও নিকৃষ্টতম সৃষ্টি)। সুতরাং সাধারণত যে মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন বা চিন্তাশীল প্রাণী হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় এ সংজ্ঞা এ দু’টি বৈশিষ্ট্য একত্রে তার জাতির (Genus) অন্তর্ভুক্ত ও খোদামুখিতা হলো প্রকৃতপক্ষে অন্য উপজাতি থেকে স্বতন্ত্রকারী বৈশিষ্ট্য।‘

যদি ইসলামী জ্ঞান বিদ্যার (Epistemology) দৃষ্টিতে মানুষের প্রকৃত পরিচয় এটিই হয় তবে সেক্ষেত্রে তার শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং পূর্ণতা ও বিকাশের পদ্ধতি যা তাকে কল্যাণ, সফলতা ও সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যাবে তা কি ভিন্নতর হবে ? কুরআনের দৃষ্টিতে যদিও মানুষ আল্লাহর খলিফা, ঐশী আমানতের রক্ষক ও স্রষ্টার আত্মা থেকে জীবন লাভ করেছে, কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যগুলো তার সত্তাগত নয়; বরং স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলক ও প্রকাশস্থল মাত্র । কুরআনের আলোকে আলোকিত মানুষের অস্তিত্বের স্বরূপ সম্পূর্ণরূপে ঐশী এবং তাকে মৌলিক বৈশিষ্ট্যের- আল্লাহর সত্তাকে প্রকাশকারী- বিকিরণকারী এক সূর্য রূপে চিত্রায়িত করা যায়।

কুরআনী দৃষ্টিতে খোদাকাঙ্ক্ষী চিন্তাশীল সত্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ

১. আল্লাহর প্রতিনিধি (খলিফা)- (সূরা বাকারা : ৩১)

২. আল্লাহর আমানতের রক্ষক- (সূরা আহযাব : ৭২)

৩. আল্লাহর দিকে যাত্রাশীল- (সূরা ইনশিকাক : ৬)

৪. এমন ঐশী প্রকৃতির অধিকারী যা কখনই পরিবর্তনশীল নয়- (সূরা রূম : ৩০)

৫. স্বাধীনভাবে তার পথ বেছে নিতে পারে তাই সে দায়িত্বশীল- (সূরা দাহর : ৩)

৬. মহান আল্লাহর সৌন্দর্যময় ও শক্তিমত্তার সকল নাম তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে-(সূরা হিজর : ২৯ ও সূরা সাদ : ৭২)

৭. প্রশিক্ষণ ও বিকাশ লাভের যোগ্যতাসম্পন্ন- (সূরা দাহর : ৩ ও সূরা জুমআ : ২)

৮. অস্তিত্ব ও সৃষ্টিগত মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী- (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০)

৯. বিশ্বকে তার পদানত করা হয়েছে অর্থাৎ তার সেবায় নিয়োজিত রয়েছে (সূরা ইবরাহীম: ৩৩, সূরা নাহল : ১৪, সূরা লুকমান : ২০, সূরা জাসিয়া : ১২ ও ...)

১০. ফেরেশতাগণ তার জন্য সিজদারত- (সূরা বাকারা : ৩৪)

কুরআনের আলোকে উদ্বুদ্ধ মানুষ হলো স্রষ্টায় বিশ্বাসী, নবুওয়াতের চিন্তাধারায় পুষ্ট, কুরআনমুখী, নিষ্পাপ ইমামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, আখেরাতের উদ্দীপনায় কাজ করে, কুরআনের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত। এ মানুষ তার জীবন পদ্ধতিতে যে উপাদানগুলো ব্যবহার করে ও যে বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করা নিজের জন্য অপরিহার্য জ্ঞান করে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা এখানে উপস্থাপন করছি।

কুরআনের আলোকে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যসমূহ

ধর্মীয় বুদ্ধিবৃত্তি : মানুষ তার অস্তিত্বের সত্তা ও সার নির্যাস অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে অবহিত এবং একে তার জ্ঞানগত ও ব্যবহারিক জীবনে পূর্ণতার জন্য ভিত্তি ও চালিকা শক্তি হিসাবে গ্রহণ করেছে।

ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানই হলো মূল । বুদ্ধিবৃত্তির প্রমাণের বিষয়টি ইসলামে প্রমাণিত একটি বিষয় । কুরআন বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তিকে একদিকে ইতিবাচকভাবে সমর্থন দিয়ে এর ওপর পুনঃপুনঃ তাগিদ করেছে, অন্যদিকে যারা তাদের কথা, কর্ম ও পদক্ষেপে বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তিকে ব্যবহার করে না তাদেরকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে ও তিরস্কার করেছে । এমনকি যারা বিচার-বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে না তারা আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব বলে বিবেচিত হয়েছে (সূরা আনফাল : ২২)। সুতরাং কুরআন অনুসরণকারী মানুষ সৃষ্টিশীল চিন্তা ও বিকশিত বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী এবং সে জ্ঞানগত ও নৈতিক বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিকে সঠিক ও ভুল, সত্য ও মিথ্যা এবং সুন্দর ও অসুন্দরকে বিবেচনার জন্য ব্যবহার করে । তার জীবনরূপ প্রতিষ্ঠান ও চিন্তার কাঠামোতে বুদ্ধিবৃত্তির উচ্চতর অবস্থান রয়েছে । ইসলামী শিক্ষা বিশ্বপরিচিতি ও মানবপরিচিতি অর্জনে বুদ্ধিবৃত্তিকে অত্যন্ত মূল্যবান জ্ঞান করে । আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলীর ভাষায় :

‘বুদ্ধিবৃত্তি সাধারণ ও সার্বিক জ্ঞান (দার্শনিক জ্ঞান) এবং বিশেষ ও বস্তুনির্ভর জ্ঞান (অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান) অর্জনের মাধ্যম হিসাবে ইসলামী শরীয়তের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল এবং চিন্তাগত কাঠামোতে ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা, বিধি- বিধান ও আইনের অন্যতম উৎস বলে গণ্য। কুরআন ও হাদীসভিত্তিক দলিলের ন্যায় বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে। তাই বুদ্ধিবৃত্তি কখনও ধর্মের বিপরীত অবস্থানে থাকতে পারে না।’ তিনি অন্যত্র বলেন :

‘জ্ঞানের সঠিকতা যাচাইয়ের একমাত্র মানদণ্ড হলো বুদ্ধিবৃত্তি। প্রথম শ্রেণীর (স্বতঃসিদ্ধ) সকল জ্ঞান এবং অন্য যে সকল জ্ঞানের প্রত্যাবর্তন প্রথম পর্যায়ের জ্ঞানে ঘটে অর্থাৎ তার ওপর নির্ভরশীল সেগুলোর ভিত্তিও হলো বুদ্ধিবৃত্তি। কারণ, ঐ জ্ঞানগুলোও ইন্দ্রিয়, অভিজ্ঞতা, বর্ণনা ও শ্রবণের মাধ্যমে অর্জিত হয় না; বরং তাকে বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে অনুধাবন করতে হয় । সুতরাং সত্য জ্ঞান পরিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় যে বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে কল্পনা, ঝোঁকপ্রবণতা ও সন্দেহের লেশমাত্র নেই । ইবনে সিক্কিত ইমাম রেযা (আ.)-কে যখন প্রশ্ন করেন : বর্তমানে সৃষ্টির ওপর আল্লাহর হুজ্জাত (সুস্পষ্ট প্রমাণ) কী ? তখন ইমাম বলেন : আকল (বুদ্ধিবৃত্তি) যার মাধ্যমে কে আল্লাহর বিষয়ে সত্য বলছে বোঝা যায় ও তাকে তা (আকল) সত্যায়ন করে এবং কে আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করছে তার মাধ্যমে তা বোঝা ও মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা যায়।’ তিনি আরো বলেন : দীনী দায়িত্বের মানদণ্ড হলো বুদ্ধিবৃত্তি (আকল)।’

অতঃপর আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী মহানবী (সা.) ও পবিত্র ইমামদের নিকট থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ থেকে বুদ্ধিবৃত্তির একশ তেত্রিশটি কল্যাণকর প্রভাব এবং বুদ্ধিবৃত্তির অনুপস্থিতির উনত্রিশটি মন্দ প্রভাব উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করেছেন।

ইসলাম ও কুরআনের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত মানুষ নিশ্চিত জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি (সূরা ইউসুফ : ১০৮), গভীর বুৎপত্তি (সূরা তাওবা : ১২২) ও সর্বাঙ্গীন চিন্তা দ্বারা সকল কিছুকে অনুধাবন করে এবং ধর্মীয় বিষয়কে বুঝতে ও বুদ্ধিমত্তাকে উৎস ও বিশ্লেষক হিসাবে ব্যবহার করে অর্থাৎ তার ধর্মীয় জ্ঞান-চিন্তাভাবনাও বুদ্ধিবৃত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, শ্রবণ ও অনুকরণের ওপর নির্ভরশীল নয় । হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘(শ্রেষ্ঠ মানুষের বৈশিষ্ট্য এমন যে) তারা দীনকে বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তি দিয়ে অনুধাবন করেছে ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করেছে (পালন করেছে), শুধু শ্রবণ করে ও অন্যের বর্ণনার ওপর নির্ভর করে দীনকে গ্রহণ করেনি । নিশ্চয়ই জ্ঞানের বর্ণনাকারী অধিক, কিন্তু গভীরভাবে তা অনুধাবনকারী ও পালনকারীর সংখ্যা স্বল্প।’ মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘মানুষের ভিত্তি হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি। যার বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তি নেই তার কোনো ধর্ম নেই।’১০

সুতরাং কুরআনের আলোকে গঠিত মানুষ বিশ্বের সকল সৃষ্টি ও তাতে সংঘটিত সকল ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া এবং ঘটনাপ্রবাহকে বিশ্লেষণে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগায় এবং বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন ও প্রশিক্ষণকে তার দায়িত্ব বলে জ্ঞান করে । সুতরাং মানুষের বিশ্ব, মানুষ ও ইসলামের পরিচিতির মানদণ্ড হলো বুদ্ধিবৃত্তি (বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ)। কুরআন দ্বারা পরিচালিত মানুষ হলো চিন্তানির্ভর । তাই কখনই সে নিজেকে এ ঐশী নিয়ামত-যা অভ্যন্তরীণ নবী ও দিক-নির্দেশক-থেকে বঞ্চিত করতে চায় না; বরং তার অভ্যন্তরীণ এ প্রদীপ ও আলোকবর্তিকা সবসময় জ্বালিয়ে রাখে ও এর আলোকরশ্মিতেই জ্ঞান ও নৈতিকতাকে অন্বেষণ করে । এ অভ্যন্তরীণ দিশারীই তাকে ঐশী প্রত্যাদেশের (ওহীর) দিকে পরিচালিত করে এবং বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহারকে ওহী ও ধর্মীয় বুদ্ধিবৃত্তির অধীনে পরিচালিত করার মাধ্যমে ঐশী অভিভাবকত্ব ও কর্তৃত্ব স্বীকার করে ও মেনে নিতে বাধ্য করে এবং প্রতারক ও মন্দকর্মপ্রবণ আত্মাকে বুদ্ধিবৃত্তির অধীনে নিয়ে আসে । এক্ষেত্রে যেমন বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞানের জন্য বিসর্জন দেয় না, তেমনি জ্ঞানকেও বুদ্ধিবৃত্তির খাতিরে পরিত্যাগ করে না । ইসলামে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকে ওহীর জন্য বিসর্জনের কোনো প্রশ্নই উত্থাপিত হয় না । কারণ, ইসলামের দৃষ্টিতে কুরআন ও সুন্নাত (রাসূল ও নিষ্পাপ ইমামদের বাণী, কর্ম ও নীরবতাসূচক অনুমোদন) যেমনভাবে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলক, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক বিচার, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ (যার মধ্যে কল্পনা, ঝোঁক প্রবণতা, প্রবৃত্তিগত চাওয়া-পাওয়ার অনুপ্রবেশ ঘটেনি) ঐশী ইচ্ছা ও বিধানের প্রকাশক । অর্থাৎ কোনো কোনো বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তি স্বতন্ত্রভাবে শরীয়তের বিধান প্রণয়ণের অধিকার রাখে ও ইসলামী বিধি-বিধানের অন্যতম মাধ্যম বলে গণ্য হয় । অর্থাৎ যুক্তিনির্ভর বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত যে কোনো নির্দেশ কুরআন ও হাদীসের বাণীর ন্যায় ইসলামী বিধানের স্বতন্ত্র উৎস বলে বিবেচিত । এ বুদ্ধিবৃত্তিই শক্তিশালী যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে সার্বিকভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্বকে প্রমাণ, ওহী ও নবুওয়াতের প্রয়োজনীয়তা ও কিয়ামতের অপরিহার্যতাকে প্রমাণে সক্ষম । এটা স্পষ্ট যে, এরূপ বুদ্ধিবৃত্তি নিজেকে ওহীর অনুগত জ্ঞান করে এবং ওহীর পরিপন্থী সকল চিন্তাকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে । বুদ্ধিবৃত্তি নিজেই স্বীকার করে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা বুদ্ধিবৃত্তির ঊর্ধ্বের বিষয় । এক্ষেত্রে স্বয়ং বুদ্ধিবৃত্তি এমন বিষয়ের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে যদিও তার স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত নয় । কুরআন দ্বারা পরিচালিত মানুষ স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী । কুরআনী পরিভাষায় তাকে ‘উলুল আলবাব’ (বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তৃত্বের অধিকারী) বলে অভিহিত করা হয়েছে-যে বুদ্ধিবৃত্তি নিরঙ্কুশ সত্তার কাছে মানুষকে আত্মসমর্পিতও অনুগত করে । এ বুদ্ধিবৃত্তি বস্তুর বন্ধনমুক্ত । খোদা অভিমুখী এ সত্তা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাতে ভুল করে না, তার চিন্তা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বচ্ছ ও নির্মল সরোবরে পৌঁছেছে এবং এ সরোবর থেকে পান করে নিজের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিককে সতেজ ও প্রাণবন্ত করেছে । সে পূর্ণতার ধাপগুলোকে একের পর এক অতিক্রম করেছে অর্থাৎ তার সুপ্ত বুদ্ধিবৃত্তি বিকশিত হয়ে কার্যকর বুদ্ধিবৃত্তিতে (لاعف لقع) পরিণত হয়েছে এবং সে সমগ্র সৃষ্টিজগতকে তার প্রকৃতরূপে প্রত্যক্ষ করার যোগ্যতা লাভ করেছে, সকল কিছুর (দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগতের) বাস্তবতা তার সামনে ফুটে উঠেছে । ‘আমরা এভাবে ইবরাহীমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালনা ব্যবস্থা দেখাই যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’ (সূরা আনফাল : ৭৫) কুরআন দ্বারা পরিচালিত মানুষের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তি কখনও অস্তমিত হয় না, কখনও তার গ্রহণ (Eclipse) হয় না ও অন্ধকার তার ওপর ছায়া ফেলে না; বরং তার জীবনে বুদ্ধিবৃত্তির সূর্য সবসময়ই আলো বিচ্ছুরণ করে এবং তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, বস্তুগত, নৈতিক, পার্থিব, অপার্থিব, আধ্যাত্মিক সকল জীবনের ওপর তার কিরণ পতিত হয় । মোটকথা, তার সমগ্র জীবনে বুদ্ধিবৃত্তির উপস্থিতি লক্ষণীয় ।

আত্মপরিচিতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ

এরূপ মানুষ ওহী ও বুদ্ধিবৃত্তির আলোতে স্বীয় সত্তার পরিচয় লাভ করে এবং নিজের সত্তার দিকে প্রত্যাবর্তন করে । যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পেয়েছে ও নিজের পরিচয় লাভ করেছে এবং এ পরিচয়ের আলোকে আত্মগঠন ও পূর্ণতা লাভের প্রচেষ্টায় রত সে মহান আল্লাহর এ নির্দেশ- ‘হে যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের নিজেদের (সম্পর্কে জানা, আত্মগঠন ও আত্মরক্ষার) দায়িত্ব তোমাদের ওপরই ন্যস্ত’- অনুযায়ী কাজ করেছে । এমন ব্যক্তি কখনও নিজের সত্তার বিষয়ে উদাসীন নয়, তার সত্তাকে সে কখনও ভুলে যায় না; ফলে সে আত্মপ্রবঞ্চনা, আত্মবিস্মৃতি ও স্বার্থপরতার শিকার হয় না । কখনই সে আত্মপ্রশংসা ও আত্মগর্বে রত হয় না; বরং সে মহান আল্লাহর এ বাণীকে স্মরণ রাখে : ‘অতএব, তোমরা নিজেদেরকে পবিত্র জ্ঞান কর না । তিনি তাকে সবচেয়ে ভালোভাবে জানেন যে তাকওয়া অবলম্বন করে (আল্লাহর ভয়ে নিজেকে সংযত রাখে)’ (সূরা নাজম : ৩২)। পবিত্র কুরআন হযরত ইউসুফের ভাষায় বলেছে : ‘এবং আমি আমার সত্তাকে ত্রুটিমুক্ত মনে করি না- নিশ্চয় প্রবৃত্তি মন্দ কাজের আদেশ প্রদানে অত্যন্ত তৎপর - কেবল ঐ ব্যক্তি ব্যতিরেকে যার ওপর আমার প্রভু অনুগ্রহ করেছেন । নিশ্চয় আমার প্রভু অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়াময় । (সূরা ইউসুফ : ৫৩) অর্থাৎ যে তার সৎ গুণাবলীকে ঐশী অনুগ্রহ বলে বিশ্বাস করে সে আত্মপরিশুদ্ধি ও আত্মগঠনের প্রচেষ্টায় রত যাতে সফলকাম হতে পারে। ‘সে-ই সফলকাম যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে।’ (সূরা শামস : ৯) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কুরআন দ্বারা উদ্বুদ্ধ মানুষ আত্মপরিচিতির মাধ্যমে খোদা পরিচিতিতে পৌঁছেছে । অর্থাৎ তার ঐশী মানবীয় অবস্থানকে চিহ্নিত করে আল্লাহর প্রনিনিধিত্বের দিকে ধাবমান এবং প্রতি মুহূর্তে ঐশী আমানতকে রক্ষা ও তার সংরক্ষণে তৎপর । সে তার এ অনুপম মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে কখনই হাতছাড়া করতে রাজী নয় । তাই কখনই এমন কর্মে লিপ্ত হয় না যা তাকে এ স্থান থেকে বিচ্যুত করে।

এ মানুষ আত্মপরিচিতি, আত্মসমালোচনা ও আত্মসিদ্ধির মাধ্যমে নিষ্পাপ ফেরেশতাদের চরিত্র লাভ করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং সে আল্লাহর পরিচয়, ভালোবাসা ও ইবাদাতের ছায়ায় আল্লাহতে বিলীন (ফানাফিল্লাহ্) ও স্থায়িত্ব (বাকাবিল্লাহ্) লাভ করে আল্লাহর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েছে।

আল্লামা তাবাতাবায়ী সূরা হাশরের ১৮ নং আয়াত- ‘হে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং প্রত্যেকেরই চিন্তা করে দেখা উচিত যে, আগামীকালের জন্য সে অগ্রে কি প্রেরণ করেছে এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো, তোমরা যে কর্মই করো সে সম্পর্কে নিশ্চয় আল্লাহ্ সবিশেষ অবগত আছেন’ এবং সূরা হুজুরাতের ১নং আয়াতের- ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সামনে তোমরা কোনো বিষয়ে অগ্রবর্তী হয়ো না’- তাফসীরে বলেছেন : ‘এখানে যে ঈমানদারদের কথা বলা হয়েছে তারা বিশেষ শ্রেণীর মুমিন এবং তাদের সংখ্যা খুবই কম । কারণ, অধিকাংশ ঈমানদারই পার্থিব প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকায় নিজের সত্তার দিকে তাকানোর অবকাশ পায় না ও নিজেকে খতিয়ে দেখে না যে, ভবিষ্যতের চিরন্তন জীবনের জন্য কী প্রেরণ করেছে । তাই এ আয়াতে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে । সূরা হুজুরাতের আয়াতে উল্লিখিত ব্যক্তিরা সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত অর্থাৎ তারা আল্লাহর দাসত্বের জন্য নিজেদেরকে নিবেদিত ও সমর্পিত করেছে এবং সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও বেলায়াতের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে । তারা তাদের ইচ্ছা শক্তিকে আল্লাহর ইচ্ছার অধীন করেছে যেমনি সূরা দাহরের ২৯ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে ; ‘আল্লাহ্ যা চান তোমরা তা ব্যতীত কিছুই চাও না’ ফলে একমাত্র আল্লাহ্ তাদের অভিভাবক, ‘আল্লাহ্ই হলেন মুমিনদের অভিভাবক’ (সূরা আলে ইমরান : ৬৮) এবং ‘আল্লাহ্ই হলেন মুত্তাকীদের অভিভাবক’ (সূরা জাসিয়া : ৪৫)১১

সুতরাং কুরআনের আলোকে উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত মানুষ তার উৎসের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে তার ও তার স্রষ্টার মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধানকে ঘুচিয়েছে এবং সে তার স্রষ্টার প্রতি মুখাপেক্ষিতার স্বরূপকে উন্মোচন করেছে ও বুঝতে পেরেছে যে, তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলই শুধু নয়, এমনকি তার বিদ্যমানতা তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা ব্যতীত কিছু নয় । যে মানুষ নিজের এ পরিচয় লাভ করে প্রকৃতপক্ষে সে ঐশী সত্তার বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলক, তখন সে তার বর্তমান ও স্থিতির অবস্থায় থাকতে পারে না; সে গতিশীল এক সত্তায় পরিণত হয় যার যাত্রার লক্ষ্য পূর্ণতা- কখনই অবক্ষয় নয়, উত্তরণ- কখনই পতন নয়, আরোহণ- কখনই অবতরণ নয়, তার গন্তব্যস্থল স্থায়ী অবিনশ্বর বাসস্থান- অস্থায়ী ও নশ্বর বাসস্থান নয়, সে সকল প্রেমের আধার পরম প্রেমাস্পদ অসীম সত্তার ভালোবাসা ও তার সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষী ও এতে পৌঁছতে সে সকল প্রকার প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে ও সকল কিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত । তাই তার চিন্তা তাঁকে (স্রষ্টাকে) কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। কুরআনী মানুষ খোদাপ্রেম ও ঐশী অভিভাবকত্বের সামনে নিজেকে নিবেদিত করেছে । সে নিজের গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে আল্লাহর দাস ও বান্দা হওয়া এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভ বলে মনে করে । যে মানুষ এরূপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয় আল্লামা হাসানযাদে আমুলীর ভাষায় ‘এমন ব্যক্তি বাকশক্তি সম্পন্ন প্রাণী বৈ কিছু নয়... মানুষ হলো সে-ই যে আল্লাহর খলিফা ও প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে।’

আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলীর মতে পবিত্র কুরআনের সৃষ্টি সম্পর্কিত এবং মানুষের ঐশী প্রতিনিধিত্বের ধারণাবাহী আয়াতসমূহ এ উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে যে, মানুষ এর মাধ্যমে স্বীয় পরিচয় লাভ করবে এবং কীভাবে এ পৃথিবীতে তার উৎপত্তি সে সম্পর্কে জানবে । আর যখন সে এ জ্ঞান লাভ করবে তখন ঐশী প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব কীভাবে পালন করবে ও কীভাবে স্রষ্টায় পৌঁছবে সে সম্পর্কে অবহিত হবে । এ কারণেই আত্মপরিচিতি সকল মর্যাদার উৎস এবং সকল জ্ঞানের মূল ।#অনুবাদ : এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর

(চলবে)

তথ্যসূত্র

১. তাফসীরে ইনসান বে ইনসান, আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী, পৃ. ২২-২৪, মারকাযে নাশরে ইসরা প্রকাশনী, কোম, ১৩৮৪ ফারসি সাল;

২. শারহে গুরারুল হিকাম, মুহাম্মাদ জামালুদ্দীন খুনসারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৪৮, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ১৩৬৬ ফারসি সাল;

৩. তাফসীরে ইনসান বে ইনসান, পৃ. ৬৫;

৪. তাফসীরে মওজুয়ী, আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী, ১৫তম খ-, পৃ. ১৫-২০ এবং ৩৯-৬৫, মারকাযে নাশরে ইসরা প্রকাশনী, ১৩৮৩ ফারসি সাল;

৫. তাফসীরে ইনসান বে ইনসান, পৃ. ৩২;

৬. আলী ইবনে মূসা আর রিযা ওয়াল ফালসাফাতুল ইলাহিয়া, আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী আমুলী, ১ম খ-, পৃ. ১০, নাশরে ইসরা, ১৩৭৪ ফারসি সাল;

৭. প্রাগুক্ত, ২য় খ-, পৃ. ২৫;

৮. তাফসীরে ইনসান বে ইনসান, পৃ. ২৬-৭০;

৯. নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ২৩৯;

১০. নাহজুল ফাসাহা, ২য় খ-, পৃ. ৬১১;

১১. আল মিজান ফি তাফসীরিল কুরআন, আল্লামা মুহাম্মাদ হুসাইন তাবাতাবায়ী, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ৩৭৫-৩৭৭, ১৮তম খ-, পৃ. ৪৫৫-৪৫৮, কোম, মুয়াসসাসায়ে মাতবুয়াতে ইসমাঈলীয়ান, ১৪২২ হিজরী।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)