ইমাম জা’ফর সাদিক(আ.): ইসলামের অনন্য নক্ষত্র
সঠিক ও অবিচ্যুত ইসলামকে যাঁরা সংরক্ষণ করেছেন নানা ভয়ানক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, যাঁরা ছিলেন প্রত্যেক যুগে ভুল পথে চলা মানুষের জন্য সত্য ও সঠিক পথের দিশারী, যাঁরা তুলে ধরেছেন মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষের স্বরূপ, যাঁরা ছিলেন জালিম ও ইসলামের তকমা ব্যবহারকারী শাসকদের মোকাবেলাসহ সবক্ষেত্রে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)'র নিষ্কলুষ অনুসারী এবং যাঁদের উচ্চ মানসম্পন্ন জ্ঞান ও ফজিলত ছিল মুসলিম উম্মাহর গৌরবময় সৌভাগ্যের পথনির্দেশনা বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হযরত জাফর সাদিক(আ.)ছিলেন সেই সব মহামানবদের মধ্যে অন্যতম।
খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের রূপকার ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য।বক্তব্যের সত্যতার কারণে তিনি "সাদেক" বা সত্যবাদী নামে খ্যাত হন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরা ( মহান আল্লাহ তাঁদের দান করুন অপার ও অসীম প্রশান্তি ) নিজেদের রক্ত দিয়ে নবী (সা.)'র রেখে যাওয়া পথকে অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা কেবল বক্তব্য নয়, বরং মূলত নিজেদের আমল ও আখলাকের মাধ্যমে কুরআন ও তৌহিদের শিক্ষাকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা ছিলেন ইতিহাস বিকৃতকারীদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষার সর্বোত্তম মাধ্যম। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুদের ও জাহিল ধর্মহীন শাসকদের নিক্ষিপ্ত প্রতিটি পাথরের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই মহান ইমামগণ যাতে ইসলামের কোনো বিপর্যয় বা ক্ষতি না হয় ।
নবী বংশের যোগ্য উত্তরসূরি ও ইমামতের আকাশে অন্যতম প্রদীপ্ত সূর্য হযরত ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.) খোদায়ী জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলামকে এমন আলোকময় করেছেন ঠিক যেভাবে হযরত ইমাম হুসাইন(আ.) তাঁর প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, বীরত্ব ও রক্ত দিয়ে ইসলামকে পবিত্র রেখেছিলেন। কেউ যদি মুহাম্মাদী ইসলামের বা প্রকৃত ইসলামের খাঁটি শিক্ষাগুলোর নির্মল ঝর্ণায় অবগাহন করতে চায় তাহলে হযরত ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)'র রেখে-যাওয়া ইসলামী শিক্ষার অমূল্য বিদ্যানিকেতনে তাকে প্রবেশ করতেই হবে। মুমিনদের ওপর তিনি ঠিক সেরকম অধিকার রাখেন যেমনিভাবে আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.)'র জিহাদ, হযরত হাসান (আ.)'র সন্ধি-চুক্তি, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র শাহাদতের রক্ত, খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমা ও জয়নাব (সা.)'র অশ্রুজল আমাদের ওপর অধিকার রাখে।
মহান ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষার দিগন্তকে এত উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের কোনো অপচেষ্টাই তাঁর প্রস্ফুটিত অন্তর্দৃষ্টির নূরের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন এতটা সুদূর প্রসারী হয়েছিল যে কারাবালায় নবীবংশের ওপর জালেম শাসকচক্রের চরম দমন-পীড়ন সত্ত্বেও এর প্রায় শত বর্ষ পর সেই একই বংশের তথা মহানবী(সা.)'র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম আলী বিন মূসা রেজা (আ.) যখন ইরানের নিশাপুরে আসেন তখন সেখানে আহলে বাইতের প্রেমিক হাজার হাজার মানুষ নীরব অবস্থায় দাড়িয়ে ছিল তাঁর বক্তব্য শুনতে। ইতিহাসে এসেছে চব্বিশ হাজার মানুষ ইমামের কথাগুলো হাদীস হিসেবে লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল সেদিন।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)মুসলমানদের সব মাজহাবের কাছেই বরেণ্য ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাঁর আদর্শ হতে পারে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সূত্র। চারজন সুন্নি ইমামের মধ্যে একজন তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র এবং আরো দুই জন সুন্নি ইমাম তাঁর পরোক্ষ ছাত্র ছিলেন। উল্লেখ্য শিয়া মাযহাব ইমাম জাফর সাদেক(আ) এর জ্ঞান থেকে বিরতিহীনভাবে গ্রহণ করে হৃষ্টপুষ্ট ওসমৃদ্ধ হয়েছে,যে কারণে শিয়া মাযহাব 'জাফরি মাজহাব' হিসেবেও খ্যাত।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রথম ইমাম আবু হানিফা ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)'র কাছে দুই বছর শিক্ষা অর্জন করায় নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তিনি এই দুই বছরকে ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার জ্ঞান অর্জনের মূল চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেছেন, যদি ওই দুই বছর না থাকত তবে নোমান তথা আবু হানিফা ধ্বংস হয়ে যেত।
তিনি আরো বলেছেন, "আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের (তথা ইমাম জা'ফর আসসাদিক আ.) চেয়ে বড় কোনো ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তি দেখিনি। তিনি মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।"
মালিকি মাজহাবের ইমাম মালেক বিন আনাস ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.) সম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহর শপথ! মানুষের কোনো চোখ সংযম সাধনা, জ্ঞান, ফজিলত ও ইবাদতের ক্ষেত্রে জা'ফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় কাউকে দেখেনি, কোনো কান এসব ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে বড় কারো কথা শুনেনি এবং কোনো হৃদয়ও তা কল্পনা করেনি।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.) এমন এক যুগে জীবন যাপন করতেন যখন ইহুদি, খ্রিস্টান ও গ্রীক পণ্ডিতরা সৃষ্টির উতস, তৌহিদ বা একত্ববাদ, পরকাল ও নবুওত সহ মুসলমানদের মৌলিক ঈমান-আকিদাসহ প্রধান চিন্তাধারার মধ্যে নানা সন্দেহ বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। আর মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যেও ছিল নানা বিচ্যুত ধারা। এইসব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সঠিক যুক্তি ও চিন্তাধারা তুলে ধরে ইসলামের সংরক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই মহান ইমাম। এ ছাড়াও মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়া নানা কুসংস্কার ও কুপ্রথা উচ্ছেদের জন্য ইসলাম এবং কুরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)।
উমাইয়া খেলাফতের শেষের দিকে ও আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকে তারা উভয় পক্ষ একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল থাকায় ইমাম সাদিক(আ.)'র হাতে ছিল মুক্ত সময়। এ সময় ইমামের জ্ঞান-আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা পালন করে এবং মদীনার আলেমরাসহ হাজার হাজার মানুষ নানা বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করতে থাকে। চার হাজার ছাত্র নানা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল এই মহান ইমামের কাছ থেকে। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদ ও গণিতবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'রই ছাত্র। ইমামের জ্ঞান কেবল দ্বীনী বিষয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল না। তিনি রসায়ন,পদার্থ, জ্যোতির্বিদ্যা,চিকিৎসা,পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়েও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে মালেক বিন আনাস বলেছেন, তিনি হয় সর্বদা রোজা রাখতেন, অথবা নামাজ পড়তেন অথবা আল্লাহর জিকির করতেন। প্রচুর হাদিস বলতেন ও বৈঠকের কর্ণধার ছিলেন। ইমামের সামনে বিশ্বনবী (সা.)'র নাম উচ্চারিত হলে তাঁর চেহারার রং পাল্টে যেত। একবার তাঁর সঙ্গে হজ্ব করতে গিয়েছিলাম। ইহরাম বাধার পর ইমাম আল্লাহর ভয়ে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক শীর্ষক তালবিয়া উচ্চারণকে ঔদ্ধত্য বলে মনে করছিলেন।
নবী-রাসূলদেরকে যেমন অশেষ দুঃখ-দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে ইসলামের বাণী প্রচারের দায়ে, তেমনিতাদের উত্তরসূরি মহান ইমামদেরকেও একই অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র ইমামতের প্রভাব ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল আব্বাসিয় জালিম শাসক মনসুর দাওয়ানেকি। দাওয়ানেকি বলেছিল:"জাফর ইবনে মুহাম্মাদ যদিও তরবারি দিয়ে সংগ্রাম করছেনা, কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো আমার কাছে একটি অভ্যুত্থানের চেয়েওগুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন বলে মনে হয়।"
দাওয়ানেকির নির্দেশে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করা হয় ইসলামের এই চিরপ্রদীপ্ত সূর্য ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)কে। কিন্তু শাহাদাতের পর ইমামের নুরানি ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য বরং আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। ৬৫ বছর বয়স্ক ইমামের লাশ দাফন করার সময় ইমাম-প্রেমিক আবু হুরাইরা আজালি নিজেকে বলছিলেন: তুমি কি জান কোন মহামানবের লাশ নিয়ে যাচ্ছ মাটি দিতে? তাঁর আগে ও পরে যদি ইমাম না থাকত তাহলে অবশ্যই বলতাম, কাল কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবী এমন মহামানব তৈরিতে অপারগ।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)'রদু'টি অমূল্য বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা: যারা নামাজকে গুরুত্বহীন মনে করবে আমাদের তথা বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের শাফায়াত তাদের ভাগ্যে জুটবে না।
ইমাম বলেছেন, কোনো বান্দাই পরিপূর্ণভাবে প্রকৃত ঈমানে পৌঁছাতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে: পুরোপুরি ধর্মকে বুঝতে পারা, সঠিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করা এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা।
তিনটি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এ তিন ক্ষেত্রে: রাগের মুহূর্তে ধৈর্যের পরিচয়, যুদ্ধের সময় বীরত্বের পরিচয় ও অভাবের সময় ভাইয়ের পরিচয়।(রেডিও তেহরান)
খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের রূপকার ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য।বক্তব্যের সত্যতার কারণে তিনি "সাদেক" বা সত্যবাদী নামে খ্যাত হন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরা ( মহান আল্লাহ তাঁদের দান করুন অপার ও অসীম প্রশান্তি ) নিজেদের রক্ত দিয়ে নবী (সা.)'র রেখে যাওয়া পথকে অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা কেবল বক্তব্য নয়, বরং মূলত নিজেদের আমল ও আখলাকের মাধ্যমে কুরআন ও তৌহিদের শিক্ষাকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা ছিলেন ইতিহাস বিকৃতকারীদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষার সর্বোত্তম মাধ্যম। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুদের ও জাহিল ধর্মহীন শাসকদের নিক্ষিপ্ত প্রতিটি পাথরের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই মহান ইমামগণ যাতে ইসলামের কোনো বিপর্যয় বা ক্ষতি না হয় ।
নবী বংশের যোগ্য উত্তরসূরি ও ইমামতের আকাশে অন্যতম প্রদীপ্ত সূর্য হযরত ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.) খোদায়ী জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলামকে এমন আলোকময় করেছেন ঠিক যেভাবে হযরত ইমাম হুসাইন(আ.) তাঁর প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, বীরত্ব ও রক্ত দিয়ে ইসলামকে পবিত্র রেখেছিলেন। কেউ যদি মুহাম্মাদী ইসলামের বা প্রকৃত ইসলামের খাঁটি শিক্ষাগুলোর নির্মল ঝর্ণায় অবগাহন করতে চায় তাহলে হযরত ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)'র রেখে-যাওয়া ইসলামী শিক্ষার অমূল্য বিদ্যানিকেতনে তাকে প্রবেশ করতেই হবে। মুমিনদের ওপর তিনি ঠিক সেরকম অধিকার রাখেন যেমনিভাবে আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.)'র জিহাদ, হযরত হাসান (আ.)'র সন্ধি-চুক্তি, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র শাহাদতের রক্ত, খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমা ও জয়নাব (সা.)'র অশ্রুজল আমাদের ওপর অধিকার রাখে।
মহান ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষার দিগন্তকে এত উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের কোনো অপচেষ্টাই তাঁর প্রস্ফুটিত অন্তর্দৃষ্টির নূরের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন এতটা সুদূর প্রসারী হয়েছিল যে কারাবালায় নবীবংশের ওপর জালেম শাসকচক্রের চরম দমন-পীড়ন সত্ত্বেও এর প্রায় শত বর্ষ পর সেই একই বংশের তথা মহানবী(সা.)'র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম আলী বিন মূসা রেজা (আ.) যখন ইরানের নিশাপুরে আসেন তখন সেখানে আহলে বাইতের প্রেমিক হাজার হাজার মানুষ নীরব অবস্থায় দাড়িয়ে ছিল তাঁর বক্তব্য শুনতে। ইতিহাসে এসেছে চব্বিশ হাজার মানুষ ইমামের কথাগুলো হাদীস হিসেবে লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল সেদিন।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)মুসলমানদের সব মাজহাবের কাছেই বরেণ্য ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাঁর আদর্শ হতে পারে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সূত্র। চারজন সুন্নি ইমামের মধ্যে একজন তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র এবং আরো দুই জন সুন্নি ইমাম তাঁর পরোক্ষ ছাত্র ছিলেন। উল্লেখ্য শিয়া মাযহাব ইমাম জাফর সাদেক(আ) এর জ্ঞান থেকে বিরতিহীনভাবে গ্রহণ করে হৃষ্টপুষ্ট ওসমৃদ্ধ হয়েছে,যে কারণে শিয়া মাযহাব 'জাফরি মাজহাব' হিসেবেও খ্যাত।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রথম ইমাম আবু হানিফা ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)'র কাছে দুই বছর শিক্ষা অর্জন করায় নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তিনি এই দুই বছরকে ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার জ্ঞান অর্জনের মূল চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেছেন, যদি ওই দুই বছর না থাকত তবে নোমান তথা আবু হানিফা ধ্বংস হয়ে যেত।
তিনি আরো বলেছেন, "আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের (তথা ইমাম জা'ফর আসসাদিক আ.) চেয়ে বড় কোনো ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তি দেখিনি। তিনি মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।"
মালিকি মাজহাবের ইমাম মালেক বিন আনাস ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.) সম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহর শপথ! মানুষের কোনো চোখ সংযম সাধনা, জ্ঞান, ফজিলত ও ইবাদতের ক্ষেত্রে জা'ফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় কাউকে দেখেনি, কোনো কান এসব ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে বড় কারো কথা শুনেনি এবং কোনো হৃদয়ও তা কল্পনা করেনি।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.) এমন এক যুগে জীবন যাপন করতেন যখন ইহুদি, খ্রিস্টান ও গ্রীক পণ্ডিতরা সৃষ্টির উতস, তৌহিদ বা একত্ববাদ, পরকাল ও নবুওত সহ মুসলমানদের মৌলিক ঈমান-আকিদাসহ প্রধান চিন্তাধারার মধ্যে নানা সন্দেহ বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। আর মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যেও ছিল নানা বিচ্যুত ধারা। এইসব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সঠিক যুক্তি ও চিন্তাধারা তুলে ধরে ইসলামের সংরক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই মহান ইমাম। এ ছাড়াও মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়া নানা কুসংস্কার ও কুপ্রথা উচ্ছেদের জন্য ইসলাম এবং কুরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)।
উমাইয়া খেলাফতের শেষের দিকে ও আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকে তারা উভয় পক্ষ একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল থাকায় ইমাম সাদিক(আ.)'র হাতে ছিল মুক্ত সময়। এ সময় ইমামের জ্ঞান-আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা পালন করে এবং মদীনার আলেমরাসহ হাজার হাজার মানুষ নানা বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করতে থাকে। চার হাজার ছাত্র নানা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল এই মহান ইমামের কাছ থেকে। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদ ও গণিতবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'রই ছাত্র। ইমামের জ্ঞান কেবল দ্বীনী বিষয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল না। তিনি রসায়ন,পদার্থ, জ্যোতির্বিদ্যা,চিকিৎসা,পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়েও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে মালেক বিন আনাস বলেছেন, তিনি হয় সর্বদা রোজা রাখতেন, অথবা নামাজ পড়তেন অথবা আল্লাহর জিকির করতেন। প্রচুর হাদিস বলতেন ও বৈঠকের কর্ণধার ছিলেন। ইমামের সামনে বিশ্বনবী (সা.)'র নাম উচ্চারিত হলে তাঁর চেহারার রং পাল্টে যেত। একবার তাঁর সঙ্গে হজ্ব করতে গিয়েছিলাম। ইহরাম বাধার পর ইমাম আল্লাহর ভয়ে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক শীর্ষক তালবিয়া উচ্চারণকে ঔদ্ধত্য বলে মনে করছিলেন।
নবী-রাসূলদেরকে যেমন অশেষ দুঃখ-দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে ইসলামের বাণী প্রচারের দায়ে, তেমনিতাদের উত্তরসূরি মহান ইমামদেরকেও একই অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)'র ইমামতের প্রভাব ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল আব্বাসিয় জালিম শাসক মনসুর দাওয়ানেকি। দাওয়ানেকি বলেছিল:"জাফর ইবনে মুহাম্মাদ যদিও তরবারি দিয়ে সংগ্রাম করছেনা, কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো আমার কাছে একটি অভ্যুত্থানের চেয়েওগুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন বলে মনে হয়।"
দাওয়ানেকির নির্দেশে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করা হয় ইসলামের এই চিরপ্রদীপ্ত সূর্য ইমাম জা'ফর আস সাদিক(আ.)কে। কিন্তু শাহাদাতের পর ইমামের নুরানি ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য বরং আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। ৬৫ বছর বয়স্ক ইমামের লাশ দাফন করার সময় ইমাম-প্রেমিক আবু হুরাইরা আজালি নিজেকে বলছিলেন: তুমি কি জান কোন মহামানবের লাশ নিয়ে যাচ্ছ মাটি দিতে? তাঁর আগে ও পরে যদি ইমাম না থাকত তাহলে অবশ্যই বলতাম, কাল কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবী এমন মহামানব তৈরিতে অপারগ।
ইমাম জা'ফর আস সাদিক (আ.)'রদু'টি অমূল্য বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা: যারা নামাজকে গুরুত্বহীন মনে করবে আমাদের তথা বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের শাফায়াত তাদের ভাগ্যে জুটবে না।
ইমাম বলেছেন, কোনো বান্দাই পরিপূর্ণভাবে প্রকৃত ঈমানে পৌঁছাতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে: পুরোপুরি ধর্মকে বুঝতে পারা, সঠিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করা এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা।
তিনটি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এ তিন ক্ষেত্রে: রাগের মুহূর্তে ধৈর্যের পরিচয়, যুদ্ধের সময় বীরত্বের পরিচয় ও অভাবের সময় ভাইয়ের পরিচয়।(রেডিও তেহরান)