হযরত সোলাইমান(আ)-এর সেনাবাহিনী
কোরআন বহু আয়াতে নবীদের ইতিহাস বা ঘটনাপঞ্জীর প্রতি ইঙ্গিত করেছে। নবীদের কাহিনী কিংবা কোনো কোনো গোত্রের কাহিনী বর্ণনার গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর একটি হলো জনগণের সামনে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কেননা কোরআনে বলা হয়েছে কোরআনের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্যে রয়েছে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। আসলে কোরআনে প্রাচীন গোত্রগুলোর ভাগ্য বা পরিণতির কাহিনীগুলো পুন পুন উল্লেখ করার কারণ হলো জনসাধারণকে সাবধান করা অথবা এটা বোঝানো যে তোমাদের পূর্বর্বতীদের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার কারণগুলো থেকে শিক্ষা নাও এবং ইতিহাসের তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করো না।
যাই হোক আমরা গত আসরে কোরআনের গল্পের আঙ্গিক বা গঠন কাঠামো নিয়ে কথা বলছিলাম। মিশরের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও মুফাসসিরে কোরআন সাইয়্যেদ কুতুব কোরআনে কারিমে সাহিত্যিক গবেষণার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। কোরআনের শৈল্পিক কাঠামো নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন কোরআন অসম্ভব শিল্পসুষমাময় ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন-কোরআনে বহু ঘটনাপঞ্জী,কাহিনী, দৃশ্য ইত্যাদিকে এমনভাবে সুবিন্যস্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে যে,পাঠক-শ্রোতার মনে হবে যেন সেই মুহূর্তে তারা তা অনুভব করছে। কোরআনের গল্পের একটা বিশেষ বর্ণনাভঙ্গি আছে,একটা বিশেষ বয়নভঙ্গি আছে যেন একেবারে জীবন্ত। যদি কাহিনীগুলোতে সংলাপ কিংবা কথোপকথন সংযোজন করা হয় তাহলে তাতে কল্পনার সকল উপাদানই লক্ষ্য করা যাবে।
তখন তাকে মনে হবে নাটক। কোরআনের আয়াতের আবৃত্তিকার বা পাঠকদের তখন মনে হবে তারা যেন নাটক দেখছেন। এভাবে তারা বহু শতাব্দী পুরোণো ঘটনাকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করবেন। কোরআনের আয়াতে এমন এমন চিত্রও লক্ষ্য করা যায় যাকে মনে হয় মানুষের জীবনের অনাগত কোনো ঘটনার সম্ভাব্য রেখাচিত্র।
সোলাইমান (আ) এর গল্পের কথাই ধরা যাক। গল্পটির মূল উপজীব্য কাল্পনিক বলে মনে হতে পারে। আসলে এটি অলৌকিক একটি ঘটনা যা ছিল পরম বাস্তব। বিস্ময়কর এই গল্পটি যখনই পড়বেন মনে হবে নতুন-এতোটাই আকর্ষণীয় এবং চিত্ত্বাকর্ষক। এই গল্পে বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। মানুষের বাইরেও অনেক চরিত্র রয়েছে, রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উদাহরণ-যেমন জ্বীন,পশুপাখি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো কাহিনীতে সবাই সবার সাথে সম্পৃক্ত এবং পরস্পরের সহযোগী। গল্পের পটভূমিও রচিত হয়েছে সুন্দর সুন্দর চিত্র সহযোগে। পাখিদের সাথে কথাবার্তা বলা নিশ্চয়ই বিরল ঘটনা। কিংবা জ্বীন বা পাখির সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং মানুষের সাথে তাদের স্বাভাবিক লেনাদেনা খুবই বিরল ঘটনা।
আবার ঘটনাগুলো যে স্থানে সংঘটিত হয় তাও বেশ আকর্ষণীয়। সেইসাথে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যময় ব্যক্তিত্বগুলোর আত্মিক এবং চারিত্র্যিক বর্ণনাও পাঠকদের জন্যে দেওয়া হয়েছে যা একজন পাঠককে সহজেই বুঝে উঠতে সহযোগিতা করবে। কোরআনে বর্ণিত সোলাইমান (আ) এর কাহিনীতে পিঁপড়ার সাথে এবং হুদহুদ পাখির সাথে সোলাইমান (আ) এর সম্পর্ক আবার বিলকিসের সাথে তার সম্পর্কের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই গল্পটির মূলরূপ কিন্তু কথোপকথনধর্মী। এই পদ্ধতিতে একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে ঘটতে গল্প এগিয়ে যায় এবং মানুষের মনের ভেতর গোপনীয় সবকিছুই বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়ে ওঠে।
প্রথম কাহিনীটি হলো সোলাইমান (আ) এর সৈন্যবাহিনীদের নিয়ে। তাঁর সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে জ্বীন,পাখি এবং মানুষের সমন্বয়ে। গল্পের প্রথম দৃশ্যটি শুরু হয় এভাবেঃ সোলাইমান (আ) এর সেনাবাহিনী তাঁর কাছে সমবেত হয়। তাদের সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে,একত্রিত হবার জন্যে সবাইকে থামতে হলো। যখন তারা পিঁপড়াদের ভূখণ্ডে গিয়ে পৌঁছলো,একটা পিঁপড়া বলে উঠলো : হে পিঁপড়ারা! তোমরা নিজ নিজ বাসায় চলে যাও যাতে সোলাইমান এবং তার বাহিনী তোমাদেরকে তাদের অজান্তে পদদলিত করতে না পারে। সোলাইমান (আ) পিঁপড়ার কথা শুনে মুচকি হাঁসি হেঁসে বললেন : হে আল্লাহ! আমার এবং আমার বাবা-মায়ের প্রতি তুমি তোমার যে নিয়ামত দান করেছো, তোমার দেওয়া সেই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার সামর্থ আমাকে দান করো। আমি যেন তোমার পছন্দনীয় কাজ করে তোমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি সেই তৌফিক তুমি আমাকে দান করো এবং আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত হবার সৌভাগ্য দান করো।
এ গল্পের অপর একটি দৃশ্য এ রকম : হুদহুদ নামে একটি পাখি বিলকিস নামক এক মহিলার ব্যাপারে সোলাইমান (আ) কে খবর দেয়। গল্পের শুরুটা এরকমঃ সোলাইমান (আ) হুদহুদ নামক পাখিটিকে খুঁজে বেড়ায়। তারপর বলে-হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? তার অনুপস্থিতির ব্যাপারে যদি সে যথার্থ কারণ দর্শাতে না পারে তাহলে তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে অথবা তাকে জবাই করে ফেলা হবে। এর কিছুক্ষণ পরই হুদহুদ এসে হাজির হয় এবং বলে-আমি এমন একটা জিনিস সম্পর্কে জেনে এসেছি যে ব্যাপারে আপনি অনবিহত। আমি আপনার জন্যে সাবা ভূখণ্ডের নিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি। এক রমনীকে দেখলাম ঐ ভূখণ্ডের ওপর রাজত্ব করছে এবং তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এমনকি তার একটা বিশাল সিংহাসন রয়েছে। সে এবং তার জনগণকে দেখলাম এক আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের আমলকে তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দিয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রেখেছে। অতএব তারা সৎপথ পাচ্ছে না।
হুদহুদের কথায় সোলাইমান (আ) এর সন্দেহ হলো। তিনি বিলকিসের কাছে একটি চিঠি লেখেন এবং হুদহুদকে বলেন চিঠির ব্যাপারে তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে। বিলকিস চিঠিটা গোত্রপতিদের সামনে পড়েন এবং এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে চান। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়। বিলকিস সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহা মূল্যবান উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে চেষ্টা করলো সোলাইমানকে তাদের ভূখণ্ডের ওপর হামলা করা থেকে বিরত রাখতে। কিন্তু সোলাইমান (আ) অলৌকিক এক পন্থার আশ্রয় নিয়ে তাঁর শক্তিমত্তা প্রদর্শন করলেন এবং বিলকিস আর তার সাম্রাজ্যের অধিবাসীদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার আহ্বান জানান। বিলকিস শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নবীর কাছে আত্মসমর্পন করেন এবং তাঁরি ধর্মে দীক্ষিত হন।
গল্পের শিল্পগত কাঠামো বিচার করলে দেখা যাবে সেখানে এমন কিছু চরিত্রের উপস্থিতি আছে যারা মানুষ নয়। পিঁপড়া এবং হুদহুদ পাখি এমন এক ভাষায় কথা বলে যে গল্পের মূল চরিত্র হযরত সোলাইমান (আ) সে ভাষা বোঝেন। এর মাধ্যমে সোলাইমান (আ) এর জ্ঞানের বিস্ময়কর পর্যায়কে পরিমাপ করা যায়। যাই হোক সোলাইমান (আ) এর গল্পটি শুরু হয়েছে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশের দৃশ্য দিয়ে। বিশাল ঐ সেনাসমাবেশে জ্বিন,মানুষ এবং পাখিও ছিল। এই গল্প-সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোতে সামগ্রিকভাবে শিল্পসম্মত শব্দাবলী ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থঘন স্বল্পভাষণের মাধ্যমে যে চিত্র আঁকা হয়েছে সেই চিত্র পাঠকের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। আধুনিক গল্পেরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো সংক্ষিপ্তি। গল্পের বাক্যগঠন হবে ছোট্ট এবং বাহুল্য বর্জিত। ঠিক মূল্যবান পাথরের মালার মতো গল্পকারও শব্দের মালা গাঁথবেন।
চমৎকার কিছু দৃশ্যও রয়েছে সোলাইমান (আ) এর গল্পে। হুদহুদ পাখিকে খুঁজে বের করার চিত্র,বিশাল একটি গোত্রের ওপর একজন রমনীর আদেশের চিত্র,বিলকিসের বিশাল সিংহাসনের দৃশ্য,সোলাইমান (আ) এর দরবারে বিলকিসের আগমনের নজিরবিহীন দৃশ্য ইত্যাদি। চমক দেওয়ার ব্যাপারটা সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করা হয়েছে এ গল্পে। কেননা বিলকিস জানতোই না যে তার রাজ সিংহাসনটি সোলাইমানের দরবারে নিয়ে আসা হবে,সেজন্যে বিলকিস তার সিংহাসনটি দেখেই চমকে উঠেছিলেন। আরো বেশি চমৎকৃত হয়েছিলেন সোলাইমানের জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল প্রাসাদ দেখে। রহস্যময় কৌতূহল সৃষ্টি করা আধুনিক গল্পকারদের একটি গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক। এই টেকনিক প্রয়োগের ফলে তারপর কী ঘটতে যাচ্ছে-এরকম একটা কৌতূহল পাঠকদের মনে জেগে ওঠে।
সোলাইমান (আ) এর গল্পে এই টেকনিকটি সুন্দরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। হুদহুদের আগমের জন্যে সোলাইমানের অপেক্ষা, বিলকিসের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা, সোলাইমান বিলকিসের পাঠানো উপহার সামগ্রী গ্রহণ করলো না কি করলো না-তা জানার অপেক্ষা ইত্যাদি এ গল্পে ব্যবহৃত কৌতূহল সৃষ্টির নান্দনিক উদাহরণ। গল্পটির উপজীব্য যদিও বিস্ময়কর ঘটনাকে ঘিরে ,তারপরও তাতে উচ্চতর মর্মার্থ এবং মূল্যবান যে বার্তা রয়েছে তা পাঠকদেরকে অনুপ্রাণিত করে,প্রভাবিত করে।(রেডিও তেহরান)
যাই হোক আমরা গত আসরে কোরআনের গল্পের আঙ্গিক বা গঠন কাঠামো নিয়ে কথা বলছিলাম। মিশরের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও মুফাসসিরে কোরআন সাইয়্যেদ কুতুব কোরআনে কারিমে সাহিত্যিক গবেষণার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। কোরআনের শৈল্পিক কাঠামো নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন কোরআন অসম্ভব শিল্পসুষমাময় ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন-কোরআনে বহু ঘটনাপঞ্জী,কাহিনী, দৃশ্য ইত্যাদিকে এমনভাবে সুবিন্যস্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে যে,পাঠক-শ্রোতার মনে হবে যেন সেই মুহূর্তে তারা তা অনুভব করছে। কোরআনের গল্পের একটা বিশেষ বর্ণনাভঙ্গি আছে,একটা বিশেষ বয়নভঙ্গি আছে যেন একেবারে জীবন্ত। যদি কাহিনীগুলোতে সংলাপ কিংবা কথোপকথন সংযোজন করা হয় তাহলে তাতে কল্পনার সকল উপাদানই লক্ষ্য করা যাবে।
তখন তাকে মনে হবে নাটক। কোরআনের আয়াতের আবৃত্তিকার বা পাঠকদের তখন মনে হবে তারা যেন নাটক দেখছেন। এভাবে তারা বহু শতাব্দী পুরোণো ঘটনাকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করবেন। কোরআনের আয়াতে এমন এমন চিত্রও লক্ষ্য করা যায় যাকে মনে হয় মানুষের জীবনের অনাগত কোনো ঘটনার সম্ভাব্য রেখাচিত্র।
সোলাইমান (আ) এর গল্পের কথাই ধরা যাক। গল্পটির মূল উপজীব্য কাল্পনিক বলে মনে হতে পারে। আসলে এটি অলৌকিক একটি ঘটনা যা ছিল পরম বাস্তব। বিস্ময়কর এই গল্পটি যখনই পড়বেন মনে হবে নতুন-এতোটাই আকর্ষণীয় এবং চিত্ত্বাকর্ষক। এই গল্পে বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। মানুষের বাইরেও অনেক চরিত্র রয়েছে, রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উদাহরণ-যেমন জ্বীন,পশুপাখি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো কাহিনীতে সবাই সবার সাথে সম্পৃক্ত এবং পরস্পরের সহযোগী। গল্পের পটভূমিও রচিত হয়েছে সুন্দর সুন্দর চিত্র সহযোগে। পাখিদের সাথে কথাবার্তা বলা নিশ্চয়ই বিরল ঘটনা। কিংবা জ্বীন বা পাখির সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং মানুষের সাথে তাদের স্বাভাবিক লেনাদেনা খুবই বিরল ঘটনা।
আবার ঘটনাগুলো যে স্থানে সংঘটিত হয় তাও বেশ আকর্ষণীয়। সেইসাথে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যময় ব্যক্তিত্বগুলোর আত্মিক এবং চারিত্র্যিক বর্ণনাও পাঠকদের জন্যে দেওয়া হয়েছে যা একজন পাঠককে সহজেই বুঝে উঠতে সহযোগিতা করবে। কোরআনে বর্ণিত সোলাইমান (আ) এর কাহিনীতে পিঁপড়ার সাথে এবং হুদহুদ পাখির সাথে সোলাইমান (আ) এর সম্পর্ক আবার বিলকিসের সাথে তার সম্পর্কের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই গল্পটির মূলরূপ কিন্তু কথোপকথনধর্মী। এই পদ্ধতিতে একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে ঘটতে গল্প এগিয়ে যায় এবং মানুষের মনের ভেতর গোপনীয় সবকিছুই বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়ে ওঠে।
প্রথম কাহিনীটি হলো সোলাইমান (আ) এর সৈন্যবাহিনীদের নিয়ে। তাঁর সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে জ্বীন,পাখি এবং মানুষের সমন্বয়ে। গল্পের প্রথম দৃশ্যটি শুরু হয় এভাবেঃ সোলাইমান (আ) এর সেনাবাহিনী তাঁর কাছে সমবেত হয়। তাদের সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে,একত্রিত হবার জন্যে সবাইকে থামতে হলো। যখন তারা পিঁপড়াদের ভূখণ্ডে গিয়ে পৌঁছলো,একটা পিঁপড়া বলে উঠলো : হে পিঁপড়ারা! তোমরা নিজ নিজ বাসায় চলে যাও যাতে সোলাইমান এবং তার বাহিনী তোমাদেরকে তাদের অজান্তে পদদলিত করতে না পারে। সোলাইমান (আ) পিঁপড়ার কথা শুনে মুচকি হাঁসি হেঁসে বললেন : হে আল্লাহ! আমার এবং আমার বাবা-মায়ের প্রতি তুমি তোমার যে নিয়ামত দান করেছো, তোমার দেওয়া সেই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার সামর্থ আমাকে দান করো। আমি যেন তোমার পছন্দনীয় কাজ করে তোমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি সেই তৌফিক তুমি আমাকে দান করো এবং আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত হবার সৌভাগ্য দান করো।
এ গল্পের অপর একটি দৃশ্য এ রকম : হুদহুদ নামে একটি পাখি বিলকিস নামক এক মহিলার ব্যাপারে সোলাইমান (আ) কে খবর দেয়। গল্পের শুরুটা এরকমঃ সোলাইমান (আ) হুদহুদ নামক পাখিটিকে খুঁজে বেড়ায়। তারপর বলে-হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? তার অনুপস্থিতির ব্যাপারে যদি সে যথার্থ কারণ দর্শাতে না পারে তাহলে তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে অথবা তাকে জবাই করে ফেলা হবে। এর কিছুক্ষণ পরই হুদহুদ এসে হাজির হয় এবং বলে-আমি এমন একটা জিনিস সম্পর্কে জেনে এসেছি যে ব্যাপারে আপনি অনবিহত। আমি আপনার জন্যে সাবা ভূখণ্ডের নিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি। এক রমনীকে দেখলাম ঐ ভূখণ্ডের ওপর রাজত্ব করছে এবং তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এমনকি তার একটা বিশাল সিংহাসন রয়েছে। সে এবং তার জনগণকে দেখলাম এক আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের আমলকে তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দিয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রেখেছে। অতএব তারা সৎপথ পাচ্ছে না।
হুদহুদের কথায় সোলাইমান (আ) এর সন্দেহ হলো। তিনি বিলকিসের কাছে একটি চিঠি লেখেন এবং হুদহুদকে বলেন চিঠির ব্যাপারে তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে। বিলকিস চিঠিটা গোত্রপতিদের সামনে পড়েন এবং এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে চান। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়। বিলকিস সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহা মূল্যবান উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে চেষ্টা করলো সোলাইমানকে তাদের ভূখণ্ডের ওপর হামলা করা থেকে বিরত রাখতে। কিন্তু সোলাইমান (আ) অলৌকিক এক পন্থার আশ্রয় নিয়ে তাঁর শক্তিমত্তা প্রদর্শন করলেন এবং বিলকিস আর তার সাম্রাজ্যের অধিবাসীদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার আহ্বান জানান। বিলকিস শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নবীর কাছে আত্মসমর্পন করেন এবং তাঁরি ধর্মে দীক্ষিত হন।
গল্পের শিল্পগত কাঠামো বিচার করলে দেখা যাবে সেখানে এমন কিছু চরিত্রের উপস্থিতি আছে যারা মানুষ নয়। পিঁপড়া এবং হুদহুদ পাখি এমন এক ভাষায় কথা বলে যে গল্পের মূল চরিত্র হযরত সোলাইমান (আ) সে ভাষা বোঝেন। এর মাধ্যমে সোলাইমান (আ) এর জ্ঞানের বিস্ময়কর পর্যায়কে পরিমাপ করা যায়। যাই হোক সোলাইমান (আ) এর গল্পটি শুরু হয়েছে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশের দৃশ্য দিয়ে। বিশাল ঐ সেনাসমাবেশে জ্বিন,মানুষ এবং পাখিও ছিল। এই গল্প-সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোতে সামগ্রিকভাবে শিল্পসম্মত শব্দাবলী ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থঘন স্বল্পভাষণের মাধ্যমে যে চিত্র আঁকা হয়েছে সেই চিত্র পাঠকের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। আধুনিক গল্পেরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো সংক্ষিপ্তি। গল্পের বাক্যগঠন হবে ছোট্ট এবং বাহুল্য বর্জিত। ঠিক মূল্যবান পাথরের মালার মতো গল্পকারও শব্দের মালা গাঁথবেন।
চমৎকার কিছু দৃশ্যও রয়েছে সোলাইমান (আ) এর গল্পে। হুদহুদ পাখিকে খুঁজে বের করার চিত্র,বিশাল একটি গোত্রের ওপর একজন রমনীর আদেশের চিত্র,বিলকিসের বিশাল সিংহাসনের দৃশ্য,সোলাইমান (আ) এর দরবারে বিলকিসের আগমনের নজিরবিহীন দৃশ্য ইত্যাদি। চমক দেওয়ার ব্যাপারটা সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করা হয়েছে এ গল্পে। কেননা বিলকিস জানতোই না যে তার রাজ সিংহাসনটি সোলাইমানের দরবারে নিয়ে আসা হবে,সেজন্যে বিলকিস তার সিংহাসনটি দেখেই চমকে উঠেছিলেন। আরো বেশি চমৎকৃত হয়েছিলেন সোলাইমানের জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল প্রাসাদ দেখে। রহস্যময় কৌতূহল সৃষ্টি করা আধুনিক গল্পকারদের একটি গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক। এই টেকনিক প্রয়োগের ফলে তারপর কী ঘটতে যাচ্ছে-এরকম একটা কৌতূহল পাঠকদের মনে জেগে ওঠে।
সোলাইমান (আ) এর গল্পে এই টেকনিকটি সুন্দরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। হুদহুদের আগমের জন্যে সোলাইমানের অপেক্ষা, বিলকিসের কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা, সোলাইমান বিলকিসের পাঠানো উপহার সামগ্রী গ্রহণ করলো না কি করলো না-তা জানার অপেক্ষা ইত্যাদি এ গল্পে ব্যবহৃত কৌতূহল সৃষ্টির নান্দনিক উদাহরণ। গল্পটির উপজীব্য যদিও বিস্ময়কর ঘটনাকে ঘিরে ,তারপরও তাতে উচ্চতর মর্মার্থ এবং মূল্যবান যে বার্তা রয়েছে তা পাঠকদেরকে অনুপ্রাণিত করে,প্রভাবিত করে।(রেডিও তেহরান)