ইমাম বাকের (আ) এর জন্মবার্ষিকী
![আল হোসাইন (আ.)](http://alhassanain.org/bengali/images/my_resize.jpg)
ইমাম বাকের (আ) ৫৭ হিজরীতে মদীনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম সাজ্জাদ (আ)।তাঁর জন্মের বহু বছর আগে নবীজী জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী নামে তাঁর এক সঙ্গীকে বলেছিলেন-'হে জাবের! তুমি আমার পরে জীবিত থাকবে এবং আমার এক উত্তর প্রজন্ম দেখতে ঠিক আমার মতো হবে,তার নামও হবে আমার নামে,তুমি তাকে দেখতে পাবে। যেখানেই তুমি তাকে দেখতে পাও আমার সালাম পৌঁছে দিও।' বহু বছর পর জাবের শেষ পর্যন্ত ইমাম বাকের (আ) এর খেদমতে হাজির হয়ে রাসূলে খোদার সালাম তাঁকে পৌঁছে দেন।
হিজরী প্রথম শতাব্দির শেষের বছরগুলোতে একদিকে উমাইয়া শাসকদের অত্যাচার, জুলুম নিপীড়ন এবং অন্যদিকে তাদের বিরোধীদের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। এ কারণে জনগণ দ্বীনি জ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারছিলো না ঠিকমতো।
ইতিহাসের পাতায় এমন বহু প্রমাণপঞ্জী রয়েছে যে তখন বহু মানুষ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কেও জানতো না। যেমন কীভাবে নামায পড়তে হয় জানতো না। হজ্বের ব্যাপারেও তারা ছিল উদাসীন। খেলাফত ব্যবস্থা এ সময় দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতরো এবং অক্ষম থেকে অক্ষমতরো হয়ে পড়ছিলো। নবীজীর আহলে বাইতের সম্মানিত ইমামগণ হলেন মুসলমানদের নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত ও যোগ্যতম। তাঁদের উপস্থিতি সত্ত্বেও সে সময় মানুষ খেলাফত এবং শাসনকার্য সংক্রান্ত বিষয়ে মতপার্থক্যে ভুগছিল। কেউ কেউ খেলাফতকে উমাইয়াদের অধিকার বলে মনে করতো,আবার অনেকেই আহলে বাইতের অবস্থান ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বক্র চিন্তা তথা অনেকটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ভাবতো।
এ রকম একটি সময়ে উজ্জ্বল সর্যের মতো আবির্ভূত হন ইমাম বাকের (আ)। তাঁর আগমনে অজ্ঞতার আঁধারের সকল পর্দা সরে যায়। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার আলোকে তিনি মুসলমানদেরকে ইসলামের সঠিক পথ দেখান এবং সর্বপ্রকার বক্র চিন্তা,কু-সংস্কার আর অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুসলমানদেরকে মুক্তি দেন। নবীজীর আহলে বাইতের মর্যাদা এবং ইমামতের অবস্থান সম্পর্কে তিনি জনগণকে সচেতন করে তোলেন। রাসূলে খোদার পর আহলে বাইতের নেতৃত্বকেই ইসলামী উম্মাহর মুক্তির সবচেয়ে উত্তম পথ বলে তিনি মনে করতেন। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন,বিশ্বাস ও চিন্তাগত বিভিন্ন বিষয়ে সমাধান দেওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র আহলে বাইতই হলো সবচেয়ে উপযুক্ত। তিনি বলেছেন-রাসূলে খোদার সন্তানেরা হলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে ঐশী জ্ঞানের দরোজা এবং জান্নাতের দিকে আহ্বানকারী।
জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উন্নতি এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে ইমাম বাকের (আ) শিক্ষা ও সংস্কৃতির বহু কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁর পরে তাঁরি উত্তরসূরি স্বীয় সন্তান ইমাম সাদেক (আ) বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। হিজরী প্রথম শতাব্দির শেষের দিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইমাম বাকের (আ) এর চেষ্টা-প্রচেষ্টা সত্যিকার অর্থেই জনগণের মাঝে ইসলামী চিন্তা ও মূল্যবোধের প্রাণ সঞ্চারের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। জাবের ইবনে ইয়াযিদ যোড়ফি ইমাম বাকের (আ) এর একজন ছাত্র ছিলেন। তিনি ইমামের কাছ থেকে অন্তত সত্তুর হাজার হাদিস বর্ণনা করেছেন। জাবের বলেছেন-আঠারো বছর ইমাম বাকের (আ) এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। যখন তাঁর কাছ থেকে চলে আসতে চেয়েছি,তাঁকে বলেছি, হে রাসূলের সন্তান! আমাকে জ্ঞানে পরিতৃপ্ত করুন! ইমাম বাকের (আ) বললেন-'হে জাবের! আঠারো বছর পরও কি তুমি জ্ঞানে পরিতৃপ্ত হও নি? বললাম-আপনি হলেন অসীম এক ঝর্ণাধারা, এই ঝর্ণাধারার তো শেষ নেই।'
ইমাম বাকের (আ) এর অস্তিত্ব ঝর্ণার জলের মতো ইসলামী চিন্তাবিদদের এমনকি ধর্মের অনুসারীদেরও আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটাতো। জ্ঞানের ভাণ্ডার হবার কারণে বহু অজানা বিষয়ে জানার জন্যে ইমামের কাছে ভিড় করতো জ্ঞান অন্বেষীগণ। যারা তাঁর কাছে আসতো তারা ইমামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে হাজার হিসামি ইমাম বাকের (আ) এর জ্ঞান,চরিত্র , অন্তরের পবিত্রতা এবং আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগির ক্ষেত্রে তাঁর একাগ্রতার উল্লেখ করে বলেন- তিনি যতোটা উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাঁর সেই ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করা এবং তাঁর প্রশংসা করার যোগ্যতা অনেকেরই নেই।
অত্যাচারী এবং তাদের অনুসারীদের প্রসঙ্গে ইমামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণী ছিল এ রকম-জুলুম-নির্যাতনকারী নেতৃবৃন্দ এবং তাদের অনুসারীরা আল্লাহর দ্বীনের বাইরে অবস্থান করে।
ইমাম বাকের (আ) এর জীবনের শেষ এগারোটি বছরে উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আব্দুল মালেকের শাসন চলছিল। হিশাম ছিল বখিল,রূঢ় এবং নির্যাতনকারী শাসক। তার শাসনকালে মানুষের জীবন একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। সেজন্যে জনগণ আগের তুলনায় আরো বেশি ইমামের শরণাপন্ন হতে লাগলো। হিশাম এমনিতেই ইমামের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে সবসময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতো। তাই চেষ্টা করতো তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে। একবার হজ্জ্বের সময় ইমাম বাকের (আ) এবং তাঁর সন্তান ইমাম সাদেক (আ) এর প্রতি জনগণের ব্যাপক আকর্ষণ ও শ্রদ্ধাবোধ দেখে হিশাম উদ্বিগ্ন ও রুষ্ট হয়ে পড়ে। তাই হজ্জ্ব থেকে ফেরার পর তাঁদের দু'জনকেই মদীনা থেকে সিরিয়ায় তলব করা হয়। কিন্তু এই ঘটনায় জনগণের কাছে তাঁদের জনপ্রিয়তা তো কমেই নি বরং মুসলমানদের মাঝে বিশেষ করে সিরিয়াবাসীদের কাছে নবীজীর সন্তান হিসেবে তাঁদের পরিচিতি আরো বৃদ্ধি পায়। উপায়ন্তর না দেখে হিশাম তাঁদেরকে পুনরায় মদীনায় ফেরৎ পাঠায়।
ইমাম বাকের (আ) ছিলেন একজন দানবীর ও পরোপকারী। তিনি নিজের জমিজমাতে নিজেই চাষবাস করতেন এবং উৎপাদিত পণ্য সামগ্রি দিয়ে গরীবদের সাহায্য করতেন। আসওয়াদ ইবনে কাসির নামে এক ব্যক্তি বলেছেন-আমি আমার অভাব-অনটন এবং আমার ভাইয়ের নির্দয়তার কথা ইমামকে জানাই। ইমাম তখন বলেন-সক্ষমতা এবং ধন-সম্পদ থাকাকালে যে তোমার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখে অথচ অভাব-অনটনের সময় তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়,এই ভ্রাতৃত্ব একেবারেই হীন ও মন্দ। এটা বলে তিনি আমাকে সাতশ দিরহাম দেওয়ার আদেশ দিয়ে বললেন-এটা তুমি খরচ করো এবং যখনি প্রয়োজন পড়বে আমাকে তোমার অবস্থা সম্পর্কে জানাবে।
আজকের আলোচনা শেষ করার আগে ইমামের আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাণীর উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
ইমাম বাকের (আ) বলেছেন, সর্বোৎকৃষ্ট পুঁজি হলো আল্লাহর ওপর বিশ্বাস।
তিনি আরো বলেছেন,সর্বোৎকৃষ্ট পূর্ণতা হলো দ্বীন সম্পর্কে জানা ও সচেতন হওয়া,দুঃসময়ে ধৈর্য ধারণ করা এবং জীবন যাপনে শৃঙ্খলা বিধান করা।