ইমাম মাহদী (আ.)
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর তিরোধনের পর মুসলমানগণ দুই দলে বিভক্ত হয়ে পরে এক দল বিশ্বাস করে যে নবী (সা.) তার কোন প্রতিনিধি নিয়োগ করে যাননি । এ গুরু দায়িত্ব তার উম্মতদের উপর অর্পন করে গেছেন। আর অন্য দল বিশ্বাস করে যে তিনি তার প্রতিনিধি বা ইমাম নিযুক্ত করে গেছেন। এই ইমামদের সংখ্যা হচ্ছে বারোজন, যাদের প্রথম হচ্ছেন হযরত আলী (আ.) আর শেষ হযরত মাহদী (আ.)। এই বারো ইমাম সর্ম্পকে বিভিন্ন হাদীস ও রেওয়াযেত বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহ হচ্ছে সহীহ আল বুখারী, সহীহ আল মুসলিম, সহীহ আত তিরমিযি, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ। ইমামত নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলে ও হযরত মাহদী (আ.) যে শেষ ইমাম এবং শেষ যামানায় তার আবির্ভাব ঘটবে তার ইমামত সম্পর্কে কারো মধ্যেই কোন মতভেদ নেই। অবশ্য বাহাই সম্প্রদায় এ সর্ম্পকে ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করে থাকে। শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই নয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ও তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীর শেষ যুগে একজন ত্রাণকর্তা ও মুক্তির দূত আসবেন-যিনি সমস্ত দুনিয়াকে অন্যায়-অবিচার-জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতনের কবল হতে মুক্ত করবেন। তিনি বিশ্বব্যাপি ইসলামী হুকুমাত ও ন্যায়বিচার কায়েম করবেন এবং পৃথিবীর বুক থেকে অসত্য এবং শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। তার আগমন অবশ্যম্ভাবী এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। তার আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবেনা।
ইমাম মাহদী (আ.) কে ? তিনি কোথায় অবস্থান করছেন ?
নাম ও উপনাম :- এই মহান ব্যক্তির নাম সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার নাম ও উপনাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নামেই।
নাম :- মুহাম্মদ ।
উপনাম : আবুল কাসেম। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন “মাহদীর নাম আমার নামেই” অনুরূপ ভাবে হযরত আলী (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে “মুহাম্মদ” মাহদীর নাম। (বোরহান ফি আলামতে মাহদী আখেরী যামান, মুত্তাকী হিন্দি, ৩য় অধ্যায় হাদিস নং ৮,৯।)
উপাধী :-তার বিভিন্ন উপাধীর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছে মাহদী, কাসেম, সাহেবুজ্জামান, সাহেবুল আমর , মুনতাজার ও হুজ্জাত । তবে তিনি মাহদী নামেই অধিক পরিচিত। এটি তার সু প্রসিদ্ধ নাম। তাকে ‘মাহদী’ বলা হয়েছে এ কারণে যে, তিনি নিজে হেদায়েত প্রাপ্ত এবং অন্যদেরকে সঠিক পথে হেদায়েত দান করবেন। তাকে ‘কায়েম’ বলা হয়েছে কেননা তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। তাকে ‘মুনতাজার’ বলা হয়েছে কেননা সকলেই তার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তাকে ‘বাকিয়াতুল্লাহ’ বলা হয়েছে কেননা তিনি হচ্ছেন আল্লাহর হুজ্জাত। হুজ্জাত অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর স্পষ্ট দলিল ।
বংশ পরিচয় :-তিনি নবী পরিবারের বারোতম পুরুষ, ইমাম হোসাইন (আ.) এর নবম বংশধর, পিতা ১১ তম ইমাম হযরত হাসান আসকারী (আ.), মাতা নারজেস।
জন্ম :-হযরত মাহদীর (আ.) জন্ম ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। যা মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। হযরত হাসান আসকারী (আ.) ইরাকের সামেরায় জীবন যাপন করতেন। ইমামকে আব্বাসী খলিফা মুতাওয়াক্কেল নজর বন্দী করে রাখত। মাঝে মধ্যেই খলিফার কর্মচারীরা ইমামের বাড়ী হানা দিত। তাকে খলিফার দরবারে জোর করে নিয়ে যেত এবং বিভিন্নভাবে তার উপরে নির্যাতন চালাত। (বিহারুল আনওয়ার, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং-৯৩।)
ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম সম্পর্কে ঐ সময়ের মুসলমানরা এমনকি শাসকরা পর্যন্ত জানতো যে, ইমাম আসকারী (আ.) এর ঔরসে এক মহামানব জন্ম গ্রহন করবেন। যিনি সমস্ত অন্যায়, অবিচার জুলুম অত্যাচারকে সমুলে উপড়ে ফেলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এই কারণে তারা ইমামের উপর বিভিন্ন কঠোরতা, অবরোধ আরোপ করে। যেন তাকে নিঃশেষ করে ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম ও ইমামতের ধারাকে রুখতে পারে। (শেখ তুসি, কিতাবুল গেইবাত, পৃ. ২৩১।)
ইমাম আসকারী (আ.) তার ঘনিষ্ঠ জনদেরকে তার পরবর্তী ইমামের দুনিয়ায় আগমনের সংবাদ দিয়ে বলতেন শিঘ্রই আল্লাহ আমাকে একজন সন্তান দান করবেন এবং আমাকে তার দয়া ও অনুকম্পার অন্তর্ভুক্ত করবেন। আরও বলতেন যে, কোন শক্তিই কোন ষড়যন্ত্রই মহান আল্লাহ তা’আলার এই ইচ্ছাকে রুখতে পারবেনা। আল্লাহর অঙ্গিকার পূর্ণ হবেই। অন্যদিকে শত্রুরাও তাদের সমস্ত শক্তি সামর্থ নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। যেন আল্লাহর এই অঙ্গিকার পূর্ণতা না পায়। তারা ইমামকে সম্পূর্ণ নজর বন্দী করে রাখে, এমনকি তার বাড়িতে তার সঙ্গী-সাথী, আত্মীয় স্বজন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের যাওয়া আসা ও নিয়ন্ত্রন করতো । কিছু কর্মচারীকে শুধুমাত্র এই কারণে নিযুক্ত করে রেখেছিল যে, যদি কোন ছেলে সন্তানকে ইমামের বাড়িতে ভূমিষ্ট হতে দেখে তাহলে যেন তাকে হত্যা করে। (ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ, হাফিজ সুলাইমান,পৃ. ৪৫৫।) এত কিছুর পরে ও নারজেস খাতুন গর্ভবতী হন, শুধুমাত্র ইমাম এবং তার বিশেষ কিছু সঙ্গী সাথী ও নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ এ খবর জানতো না ।
অবশেষে এই মহান ব্যক্তি ১৫ ই শাবান ২৫৫ হিজরী ইরাকের সামেরা শহরে জন্ম গ্রহন করেন। যারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার আহলে বাইত (ইমামদের) থেকে ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ মুতাওয়াত্তির হাদীসের প্রতি ইমান রাখে, তাদের জন্য মাহদী (আ.) ও তার জন্মের ব্যপারে ইমান রাখা ও স্বীকার করা ওয়াজিব। এটা অসম্ভব ব্যপার, যে ইমাম মাহদী (আ.) এখন ও দুনিয়াতে আসেননি । হাদীসে এসছে নবী (সা.) বলেছেন “ দ্বীন ইসলাম ধ্বংস হবেনা কিয়ামত পর্যন্ত অথবা বারোজন খলিফার আগমন পর্যন্ত তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছেন আলী ইবনে আবি তালিব অত:পর হাসান তারপর হোসাইন (আ.) তারপর মুহাম্মদ ইবনে আলী , আলী ইবনে মুহাম্মদ, হাসান ইবনে আলী এবং তাদের সর্ব শেষ হচ্ছেন আল মাহদী (আ.) ”। (সহীহ মুসলিম,৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩-৪ ; সহীহ আল বুখারী ৪র্থ খণ্ড , পৃ. ১৫৬; ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৯ ; সহীহ আত তিরমিযি ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪২; সুনানে আবু দাউদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০২; কানযূল উম্মাল; ১২তম খণ্ড,পৃ. ১৬৫।)
এটা ও সত্য এবং প্রমানিত যে, ইমাম আসকারী (আ.) বিষাক্রান্ত হয়ে দুনিয়া থেকে চলে যান। তার দাফন কাফন ও জানাযায় হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহন করেছিল এবং জনগনের সম্মুখেই তাকে কবর দেয়া হয়। ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম হয়েছে এ কথা মেনে নেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কেননা এটা অসম্ভব ব্যপার যে, তার পিতা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন অথচ তার জন্ম হয়নি অথবা তার পিতার মৃত্যুর সময় তিনি মাতৃগর্ভে ছিলেন এবং পিতার মৃত্যূর কিছু কাল পর ভুমিষ্ট হয়েছেন। কেননা এটা কখোনই সম্ভব নয় যে, একজন মানুষ মারা যাবে আর তার সস্তান যে তার রক্ত মাংশে মিশে আছে শত শত বছর পর জন্ম নিবে। নিঃসন্দেহে ইমাম মাহদী (আ.) ভুমিষ্ট হয়েছেন এতে কোন সন্দেহ, সংশয় নেই এবং তিনি এখন পর্যন্ত জীবিত আছেন এবং আল্লাহর নির্দেশে লোক চক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপন করে আছেন। এটা ও সম্ভব পর নয় যে, তিনি আত্মপ্রকাশের পূর্বেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন।
ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও মহামানব রাসূল (সা.) এর সাথে ইমাম মাহদীর বেশ কিছু বিষয়ে চমৎকার মিল পাওয়া যায়। মহানবী (সা.) যেমন সর্বশেষ নবী তেমনি ইমাম মাহদী ও সর্বশেষ ইমাম। মহানবী (সা.) এর শুভাগমন সম্পর্কে যেমন পূর্ববর্তী নবী বা রাসূলগণ ভবিষ্যৎ বাণী করে গেছেন, তেমনি ইমাম মাহদী (আ.) এর আগমন সম্পর্কেও মহানবী (সা.) এবং পূর্ববর্তী ইমামগণ বাণী রেখে গেছেন।
প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদীকে সাধারণত : ‘ইমামুল আসর’ বা নির্দিষ্ট সময়ের ইমাম এবং সাহিবুজ্জামান বা জামানার নেতা বলা হয়। জন্মের পর মহানবী (সা.) এর নামেই তার নাম রাখা হয়। তিনি জন্মের পর থেকে তার শ্রদ্ধেয় পিতা ইমাম আসকারী (আ.) এর প্রত্যক্ষ ও বিশেষ তত্ত্বাবধানে ছিলেন। স্বৈরশাসকের হুমকীর কারণে ইমামে মাহদীর (আ.) জন্মের খবর গোপন রাখা হয়েছিল। কারণ আব্বাসীয় শাসকরা ইমামের বংশ ধারকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে হন্যে হয়ে খুজছিল। বাড়ি বাড়ি তল্লাশী করে খুজে বের করার জন্য ওরা গোপন ঘাতক বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল। তাই স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা শিশু ইমামকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা ও সুরক্ষিত রেখেছিলেন।
ইমামের এই জন্ম রহস্য কি স্বাভাবিক না অলৌকিক
শেখ তুসী বলেন এটা একটা মামুলী এবং সাধারণ ব্যাপার। এই ঘটনা প্রথম এবং শেষ নয় মানব জীবনের দীর্ঘ ইতিহাসে এর অনেক নমুনা রয়েছে। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর জন্ম নমরুদের চোখের অন্তরালে, হযরত মুসা (আ.) এর জন্ম ফেরাউনের চোখের আড়ালে, হযরত ঈসা (আ.) এর জীবিত থাকা। (শেখ তুসি , কিতাবুল গেইবাত, পৃ. ২৩৭।) যখন ইমাম মাহদী (আ.) এর ভুমিষ্ঠ হবার সংবাদ তার পিতা ইমাম হাসান আসকারীর নিকট পৌছাল তিনি অত্যান্ত খুশী হলেন শুধু তিনিই নয় এ ধরনী যেন আনন্দে মেতে উঠল। আসকারী (আ.) নবজাতককে কোলে নিলেন এবং তার ডানকানে আজান ও বাম কানে এক্বামত দিলেন। সর্বপ্রথমে যে ধ্বনী নবজাতকের কানে পৌছল তা “আল্লাহু আকবার” ও “লা ইলাহা ইল্লাললাহু ছিল” । এই ভাবে বান্দাদের জন্য আল্লাহর ওলী তৎকালীন জালেম শাসকের প্রতিবন্ধকতা সত্বেও, যারা তাকে পেলে হত্যা করতো, জন্মগ্রহন করলেন। হাকিমা ইমাম আসকারী (আ.) এর ফুফু তাকে কোলে তুলে নিলেন এবং চুমু দিলেন তিনি বলেন আমি তার থেকে এমন এক সুগন্ধ পাচ্ছিলাম যা আগে কখোন অনুভব করিনি। ইমাম আসকারী (আ.) পুণরায় তাকে হাকিমার কোল থেকে নিলেন। এবং বললেন তোমাকে এমন এক জনার আশ্রয়ে রাখবো যার আশ্রয়ে হযরত মুসা (আ.) এর মাতাও তার সন্তানকে রেখেছিলেন। তুমি সর্বক্ষণ আল্লাহর হেফাজতে থেকো। অতপর হাকিমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন : “এই ফুফু তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দাও এবং এই নবজাতকের সংবাদ কাউকে দিওনা গোপন রাখ যতক্ষন না উপযুক্ত সময় আসে”। (বিহারুল আনওয়ার, ১৩তম খণ্ড, পৃ.৭।)
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন
হযরত আসকারী (আ.) তার সন্তানের জন্মের পর তার ঘনিষ্ঠ জনদের একজনকে কিছু পরিমান মাংস ও রুটি কিনে সামেরা শহরের গরীব দুখীদের মাঝে বন্টন করার নির্দেশ দিলেন। অনুরূপ ভাবে সত্তরটি দুম্বা আকিকা করলেন। এই মহামনবের জন্ম নবী পরিবারের অনুসারীদের সকল কেন্দ্রকে আনন্দ উৎসবে ভরিয়ে তুলল। সমাজের নেতৃস্থানিীয় সকল ব্যক্তিরা দলে দলে ইমাম আসকারী (আ.) এর খেদমতে আসতে লাগলেন এবং ইমামকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেন।
আজো নবী পরিবারের অনুসারী অর্থাৎ শিয়ারা এ দিনটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে। এ দিনটি যেন আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে। প্রতিটি মহল্লায় মসজিদে বিভিন্ন বাড়িতে দোয়া ও মাহাফিলের আয়োজন করা হয়। মানুষের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। পথে ঘাটে আলোক সজ্জা করা হয় । একে অপরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে।
হযরত ইমাম মাহদী (আ.) থেকে বর্ণিত হাদীস
তিনি বলেন :- “আমি মাহদী আমি যুগের নেতা, আমি সেই ব্যক্তি আমি পৃথিবীকে ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ করবো যেভাবে অন্যায় অবিচার ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আল্লাহর দুনিয়া কখোন আল্লাহর (হুজ্জাত) অকাট্য প্রমান থেকে খালি থাকবেনা এবং মানুষ ও বঞ্চিত থাকবেনা। এটা এমন একটা অমানত যা তোমার ভাইদের ছাড়া অন্য কাউকে বলনা ”। (কামাল আদ দীন, পৃ: ৪৪৫।)
“আমি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বংশধর, আমি শেষ যুগে এই তরবারী নিয়ে কিয়াম করব। (তরবারীর দিকে ইশারা করলেন) এবং পৃথিবীকে ন্যায় বিচারে পূর্ণ করব যেভাবে অন্যায় অবিচারে পূর্ণ হয়েছে ”।( বিহারুল আনওয়ার, ৫২ তম খণ্ড,পৃ. ৪১।)
“আমি অদৃশ্য থাকার সময় মানুষজন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূর্য থেকে যেভাবে লাভবান হয় আমার থেকে ঠিক সেভাবে লাভবান হবে” । (কামাল আদ দীন, পৃ. ৪৮৫।)
“এ পৃথিবী আল্লাহর অকাট্য দলিল থেকে কখনো খালি থাকবেনা আর সেই দলিল প্রকাশ্য ও হতে পারে আবার অপ্রকাশ্য ও হতে পারে।”(কামাল আদ দীন, পৃ. ৫১১।)
“যখন আল্লাহ আমাকে কথা বলার অনুমতি দিবেন তখন সত্য প্রকাশিত হবে এবং মিথ্য ধংস হবে”। (বিহারুল আনওয়ার, ৫৩তম খণ্ড,পৃ.৪।)
ইমাম মাহদীর আবির্ভাব সম্পর্কে হাদীসের ভাষ্য
ঐশি গ্রন্থ পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.) এর জন্য চিরন্তন মুজিযা এবং সব যুগে সকল প্রজন্মের জন্য তা নতুন। এতদসত্ত্বেও ইসলাম ধর্মীয় চির জীবন্ত অকাট্য দলিল বা মুজিযা সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মহানবী (সা.) কর্তৃক বর্ণিত ঐসব হাদীস ও রেওয়ায়েত- যেখানে ইসলাম ধর্মের প্রতিশ্রুত পূনর্জাগরণের সময়কাল পর্যন্ত মানবজাতির ভবিষ্যৎ জীবন এবং ইসলাম ধর্মের ভবিষ্যৎ গতিধারা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। পূনর্জাগরণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ভূলন্ঠিত বিশ্ব-মানবতার মুক্তি। মানবজীবন ফিতনা, ফ্যাসাদ এবং ধ্বংস থেকে পরিত্রাণ লাভ করে আলো ও সৌভাগ্যের পানে ধাবিত হওয়ার চিন্তাধারা কেবল মুসলমানরাই পোষণ করেনা বরং অন্যান্য আসমানী ধর্মেও মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। কোরআনে মজীদেও এই বিজয়ের চুড়ান্ত ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনের ভাষায় :
وَنُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ
অর্থাৎ এবং অমরা ইচ্ছা করলাম যাদেরকে পৃথিবীর বুকে (বঞ্চিত) হীনবল করা হয়েছিল তাদের কে নেতৃত্ব দান করতে এবং উত্তরাধিকারী করতে (সূরা কাসাস, আয়াত নং-৫) ।
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন বঞ্চিত বা হীন বল বলতে রাসূল (সা.) এর আহলে বাইতকে বোঝানো হয়েছে অনেক প্রচেষ্টা ও কষ্টের পর আল্লাহ এই বংশের মাহদী কে প্রেরণ করবেন এবং তাকে উচ্চ মর্যদা দান করবেন এবং শত্রুদের চরম ভাবে লাঞ্চিত করবেন (গেইবাতে শেখ তুসী,পৃ.১৮৪,হাদীস নং-১৪৩)।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যারা (আল্লাহর ওপর) ইমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে, তাদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তিনি পৃথিবীতে তাদের নেতৃত্ব (খেলাফত) দান করবেন,যেমনি ভাবে তাদের পূর্ববর্তী লোকদের দান করে ছিলেন। (সূরা নূর, আয়াত নং-৫৫)
পবিত্র কোরআনে এসেছে:
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُو
অর্থাৎ নিশ্চয় অমরা তৌরাতের পর যাবুরে উল্লেখ করেছি যে, যোগ্যতা সম্পন্ন বান্দারা পৃথিবীর বুকে । আমাদের উত্তরাধিকারী হবে। (সূরা আম্বিয়া আয়াত নং-১০৫)
উপরিউক্ত আয়াত সমূহে এ সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, পৃথিবীর বুকে কল্যাণময় শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, যার কর্ণধার হবেন আল্লাহর নেক বান্দা। আল্লাহর প্রিয় সেই বান্দাগণের মধ্যে ইমাম মাহদী (আ.) হলেন অন্যতম।
শিয়া-সুন্নী উভয় সম্প্রদায় এ ব্যাপারে ঐক্যমত্য পোষণ করে যে, নবী করীম (সা.) ইমাম মাহদীর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন। প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য শিয়া-সুন্নী হাদীস গ্রন্থসমূহে মহানবী (সা.) থেকে এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে,“দুনিয়া ধ্বংস হতে যদি মাত্র একদিনও অবশিষ্ঠ থাকে তবে মহান আল্লাহ (ঐ একদিনের মধ্যেই) আমাদের (আহলে বাইতের) মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই প্রেরণ করবেন, যিনি এ পৃথিবী যেভাবে অন্যায়-অবিচারে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, ঠিক সেভাবে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে তা পূর্ণ করে দিবেন”। (মুসনাদ-ই-আহমদ ইবনে হাম্বল, ১ম খণ্ড;পৃষ্ঠা: ৯৯, বৈরুত, দারুল ফিকর কর্র্তৃক প্রকাশিত) তিনি এ মর্মে সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন যে, শেষ যামানায় মাহদীর আগমন হবে। নবীজি এরশাদ করেন যে, আমার নামে আমার বংশের একজন লোক পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব না করা পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবেনা (সহীহ তিরমিযি, ২য় খণ্ড / ৪৬ পৃষ্ঠার বরাতে মুন্তাখাবুল আছর ২য় অধ্যায়, পৃ. ১৪২ ; তিরমিযি, বৈরুত, কিতাবুল ফিতান ৫২ তম অধ্যায়, পৃ. ৬১১, হাদীস নং : ২২৩০।)।
সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলিহি ওয়া সাল্লাম হুজাইফা বিন ইয়ামানকে এরশাদ করেছেন,“হে হুযাইফা ! এ দুনিয়া ধ্বংস হতে মাত্র একদিনও যদি অবশিষ্ঠ থাকে তাহলে মহান আল্লাহ তা’আলা সেই দিনকেই এতো বেশী দীর্ঘায়িত করবেন যাতে আমার আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত এক ব্যক্তি বিশ্বের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়, যার মাধ্যমে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও যুদ্ধ সংঘটিত হবে এবং ইসলাম ধর্ম বিজয়ী হবে। মহান আল্লাহ তার ওয়াদা ভঙ্গ করেন না এবং তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী বটে”।(ইকদুদ দুরার, আবু নাঈম ইসফাহানী প্রণীত সিফাতুল মাহদী)।
মহানবী (সা.) বলেন,“আমার আহলে বাইতের এক ব্যক্তি ঐ দিন উত্থান করবেন। তার নাম হবে আমার নামে, তার পিতার নাম হবে আমার পিতার নামে, জুলুম ও পাপে পূর্ণ হওয়ার পর তিনি পৃথিবীকে ন্যায় ও ইনসাফে পরিপূর্ণ করবেন।(সুনানে আবু দাউদ, ২য় খণ্ড;পৃষ্ঠা. ৪২২।)।
সুনানে ইবনে মাযায় বর্ণিত, রাসূলে খোদা (সা.) এরশাদ করেন, “আমার সেই পাক পরিবারের অন্তর্ভূক্ত আল্লাহ তা’আলা যাদের জন্য দুনিয়ার পরিবর্তে আখেরাতকে বাছাই করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আমার আহলে বাইত আমার পরে নানা দু:খ দূর্দশার শিকার হবে। শেষ পর্যন্ত পূর্বদিক থেকে একটি সম্প্রদায়ের উত্থান হবে, যাদের হাতে কালো পতাকা থাকবে এবং কল্যাণের প্রার্থী হবে যা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অত:পর তারা লড়াই করবে এবং বিজয়ী হবে। তারা যা চাইবে, তা তাদের দেওয়া হবে। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা গ্রহণ করবে না, যতক্ষণ না আমার আহলে বাইতের এক লোকের হাতে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। তিনি পৃথিবী জুলুম ও পাপাচারে পূর্ণ হওয়ার পর পুণরায় ইনসাফে পরিপূর্ণ করবেন। সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হযরত রাসুলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন, “মাহদী আমাদের আহলে বাইতের লোক। মাহদী ফাতেমারই সন্তান। তিনি বলেন, মাহদী আমার উম্মতের মধ্যে আসবে। তার শাসনকাল যদি সংক্ষিপ্ত হয় তবুও সাত অথবা নয় বছরের কম হবেনা। তার শাসনকালে আমার উম্মত এতো সুখী জীবন যাপন করবে এবং আল্লাহর নেয়ামতসমূহ এতবেশী পরিমানে ভোগ করবে যে, অতীতে যার কোনো তুলনা নাই। নেয়ামতরাজীর আধিক্য হবে। সম্পদের ভান্ডার গড়ে উঠবে। এটা এমন পর্যায়ে পৌছাবে যে , কেউ এসে বলবে, হে মাহদী , আমাকে দিন। তিনি বলবেন, নিয়ে যাও”(সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খণ্ড, হাদীস নং- ৪০৮৬।)।
ইমাম বোখারী তার সহীহ হাদীসে বলেন, রাসুলে খোদা (সা.) এরশাদ করেন, সেদিন তোমাদের অবস্থা কিরূপ হবে, যখন মরিয়ম পূত্র তোমাদের মাঝে অবতরণ করবে এবং তোমাদের ইমাম তোমাদের মাঝ থেকে হবে (সহীহ বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪৩।)।
ফতহুল বারীতে হাফেজ বলেন, এ হাদীসটি মুতাওয়াতের পর্যায়ে পৌছেছে যে, মাহদী এই উম্মতেরই অন্তর্ভূক্ত এবং ঈসা ইবনে মরিয়ম অবতরণ করে তার পিছনে নামাজ আদায় করবেন (ফতহুল বারী, ৫ম খণ্ড,পৃ:৩৬২)।
ইসলামী গবেষক ও আলেমদের মতে, আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসগণ মহানবী (সা) এর তেত্রিশ জন সাহাবী থেকে ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত হাদীস তাদের নিজ নিজ হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এক শত ছয় জন প্রখ্যাত সুন্নী আলেম গায়েব (অদৃশ্য) ইমাম মাহদীর (আ.) আবির্ভাব সংক্রান্ত হাদীস নিজ নিজ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। বত্রিশ জন প্রসিদ্ধ আলেম ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন।
বস্তুত ইমাম মাহদীর আবির্ভাব সম্পর্কিত বর্ণনা ও আকিদার ব্যাপারে বিদ্যমান সকল মযহাবের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে যে ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে, তাহলো তার জন্ম বা জন্মের সময়কাল সম্পর্কিত। আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ অনুসারী বিশ্বাস করেন যে, তিনি এখনো জন্মগ্রহণ করেননি বরং বিশ্বের বুকে খোদায়ী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবির্ভাবের পূর্বেই তার জন্ম হবে। কিন্তু শিয়া সম্প্রদায় ও আহলে সুন্নাতের কিছু লোকের বিশ্বাস হলো, ইমাম মাহদী সামেরায় ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান জন্মগ্রহণ করেছেন। আহলে সুন্নাতের কিছু সংখ্যক লোক তার জন্মের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।(মাতালেবুস সোয়াল, আল্লামা কামাল উদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে তালহা আশ-শামী আশ-শাফেয়ী, পৃ. ৮৯। ওয়াফিয়াতুল আইয়ান, আল্লামা ইবনে খালদুন, ১ম খণ্ড,পৃ. ৫৭১,মিশরের ছাপা)।
বস্তুত: আহলে সুন্নাতের অনেক আলেম হযরত মাহদী (আ.) এর জন্মগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। ইমাম মাহদীর হায়াত দীর্ঘায়িত হওয়া কিভাবে সম্ভব ? এর জবাবে বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসা (আ.), হযরত খিজির (আ.) ও হযরত নূহ (আ.) ও অন্যরা যেভাবে দীর্ঘজীবি হয়েছেন এবং তাদের কেউ কেউ এখনো জীবিত আছেন, হযরত মাহদী (আ.) এর দীর্ঘ জীবনের বিষয়টিও অনুরূপ। কোরআন মজীদে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনার অনেক উদাহরণ আছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা হযরত ওজাইর (আ.) কে পৃথিবী থেকে নিয়ে যান এবং পুনরায় জীবিত করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) একটি পাখি টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন পাহাড়ে রেখে আসেন। পরে আল্লাহর হুকুমে ঐ পাখিকে আহবান করলে তা উড়ে আসে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর জন্য আগুন অদাহ্য ও আরামদায়ক হয়ে যায়। হযরত ঈসা (আ.) পিতাবিহীন জন্মগ্রহণ করেন এবং এখনো পর্যন্ত তিনি জীবিত অবস্থায় আছেন, তিনিই আবার মৃত লোকদের জীবিত করতেন। হযরত মুসা (আ.) এর হাতের লাঠি অজগর সাপে পরিণত হয়, পাখি ও পিপিলিকার সাথে হযরত সোলাইমান (আ.) কথা বলেন, হযরত খিজির (আ.) আজ অবধি জীবিত আছেন। এসব বিষয় মুসলমানরা বিশ্বাস না করে পারেনা। একজন বিশ্বাসী তথা আত্ম সমর্পিত ব্যক্তি অর্থাৎ একজন মোমিন বিনা বাক্য ব্যয়ে এ ঘটনাগুলোকে বিশ্বাস করে। কাজেই ইমাম মাহদী (আ.) এখনো জীবিত থাকার ব্যাপারে বিস্মিত ও অবাক হওয়ার মতো কিছু নাই।
বিভিন্ন গবেষণায় নিশ্চিত হয়ে বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, “বার্ধক্যে উপনীত হওয়া যা মূলত: এক ধরনের রোগ। আর বয়স কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে সঠিক খাদ্যের অভাব, দুষিত বায়ু সেবন, মানসিক অশান্তি বা এক কথায় মানুষের জীবন ধারণের মানবিক ও বস্তুগত পরিবেশের ধরণ ও প্রকৃতি। কাজেই পরিবেশের পরিবর্তন সাধন করে কারো দীর্ঘ জীবন লাভ করা সম্ভবপর বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। জার্মানী ডাক্তার হাভার্ট লিখেছেন যে, বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞান খাদ্য বিজ্ঞানের সহায়তায় বয়সের সীমা এর চেয়ে আরো অধিক দীর্ঘ করতে পারে।
মিশরীয় ম্যাগাজিন ‘আল মুকতাতাফ’ ১৯৮০ সালের তৃতীয় সংখ্যায় লিখেছে, বিশ্বস্ত মনীষিরা লিখেছেন, প্রাণীর দেহের পুরো কাঠামো এতখানি স্থায়িত্বের অধিকারী যে, মানুষ কোনো উপসর্গের আঘাত না আসলে হাজার হাজার বছর জীবিত থাকতে পারে। কাজেই বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার বিষয়টি সম্ভব।
ইমামত
ইমাম আসকারী (আ.) এর মৃত্যূর সময় ইমাম মাহদী (আ.) এর বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। অর্থাৎ ৫ বছর বয়স থেকেই তিনি ইমামত প্রাপ্ত হন। দেশের মারাত্মক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাকে জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়। তখন তিনি আল্লাহর হুকুমে অদৃশ্য অবস্থানে (গায়েব) চলে যান। তার ফলে আব্বাসীয়রা তাকে খুজে বের করে হত্যা করতে পারেনি। গায়েব অবস্থায় ইমাম মাহদী তার কতিপয় বিশিষ্ট প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের জন্য নিজের বাণী প্রকাশ করেন। জনসাধারণকে ধর্মবাণী ও উপদেশ প্রদানের জন্য ইমাম তার পিতা ও পিতামহের এককালীন ঘনিষ্ঠ সহচর উসমান ইবনে সাঈদ আল আমরীকে নিজের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। তার মাধ্যমেই ধর্মপ্রাণ অনুসারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব ও সমস্যার সমাধান দেয়া হতো। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মুহাম্মদ ইবনে উসমান আল আমরী ডেপুটির দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এভাবে পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন আবুল কাসিম আল হোসাইন ইবনে রুহ আল নওবখতি, আলী ইবনে মুহাম্মদ আস সামুরী। ৩২৯ হিজরীতে আস সামুরীর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে গায়েব অবস্থান থেকে ইমাম মাহদী এক ঘোষণা প্রদান করেন যে, ছয় দিনের মধ্যে আস সামুরী মারা যাবেন এবং সেই সাথে ইমামের প্রতিনিধিত্ব স্থগিত হয়ে যাবে। এখন হতে ইমাম আবার অদৃশ্য অবস্থানে চলে যাবেন।
ইমাম মাহদীর (আ.) গায়িব (অন্তথর্ধান) দু’ভাগে বিভক্ত
১. গায়িবাতে সুগরা (স্বল্পকালীন অন্তর্ধান) : প্রথম গায়িব অবস্থার শুরু হয় ২৬০ হিজরীর (৮৭২ খ্রি.) রবিউল আউয়াল মাসে এবং তা শেষ হয় ৩২৯ হিজরীতে (৯৩৯ খ্রি.)শাওয়াল মাসে। প্রথম গায়িব সময়কাল ছিল ৭০ বছর।
২. গায়িবাতে কুবরা (দীর্ঘকালীন অন্তর্ধান) : দ্বিতীয় প্রধান গায়িব শুরু হয় ৩২৯ হিজরীতে এবং আল্লাহর যতদিন ইচ্ছা ততদিন এ অবস্থানকে বলবৎ রাখবেন। নির্ভর যোগ্য বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, মহা নবী (সা.) বলেছেন- “এ বিশ্বজগত ধ্বংস হওয়ার জন্য যদি একটি দিনও অবশিষ্ট থাকে, তাহলে মহান আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই সে দিনটিকে এতবেশী দীর্ঘায়ীত করবেন, যাতে আমার সন্তান মাহদী (আ.) আত্মপ্রকাশ করতে পারে এবং অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ এ পৃথিবীতে সম্পূর্ণরূপে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।” (বিহারুল আনওয়ার, ৫১তম খণ্ড, পৃ. ৩৬০ থেকে৩৬১। শেখ তুসি, কিতাবুল গেইবাত, পৃ. ২৪২।)
উপসংহার:
وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى * وَالنَّهَارِ إِذَا تَجَلَّى অর্থাৎ “রাতের শপথ যখন অন্ধকার ছেয়ে যায় এবং দিনের শপথ যখন আলোকোজ্জ্বল হয়” (সুরা লাইল, আয়াত১-২)। মোহাম্মদ বিন মুসলিম হযরত ইমাম মোহাম্মদ বাকের (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ফরমায়েছেন, ‘রাত যখন ছেয়ে যায়’ দ্বারা হযরত আলী বিন আবি তালিব (আ.) কে বুঝানো হয়েছে। যে অন্যায়ের রাজত্বে তিনি নিহত হয়ে গেলেন এবং ভীষণ ধৈয্যের প্রমাণ দিলেন, আর দিনের আলো যখন উজ্জ্বল হয় দ্বারা হযরত ইমাম মাহদী (আ.) কে বুঝানো হয়েছে। যখন তার আবির্ভাব ঘটবে তখন তিনি বাতিল রাজত্বের ওপর জয়ী হবেন।(তাফসীরে কুমী, ২য় খণ্ড ,পৃ: ৪২৫; বয়ানুস সায়াদাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ:২৫৯)
আল্লাহর রাসূল (সা.) যিনি শানিত দয়া ও হেদায়াতের বাণী নিয়ে এসেছেন, অসংখ্য রেওয়ায়েতে নিজের বংশধরের নাম, তাদের উপাধি এবং মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে অনেক রেওয়ায়েত বিশেষভাবে এবং সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা কয়েকটি হাদীস ও কুরআনের আয়াত বর্ণনা করেছি। হযরত যাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী বর্ণনা করেছেন যখন কুরআনের সুরা নেসার ৫৯ নম্বর আয়াত :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
অর্থাৎ “হে ইমানদার লোক সকল তোমরা আল্লাহকে অনুসরণ কর, অনুসরণ কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উলিল আমরের”। নাযিল হলো তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমরা আল্লাহর এবং তার রাসূলকে চিনেছি এবং উলিল আমর যার অনুসরণকে আল্লাহ নিজের এবং নিজের পয়গাম্বরের অনুসরণ বলে ঘোষণা করেছেন তারা কারা ? তিনি এরশাদ করলেন, তারা আমার স্থলাভিসিক্ত এবং আমার পর মুসলমানদের ইমাম। তাদের প্রথম হলেন ইমাম আলী বিন আবি তালিব, তার পর হাসান ইবনে আলী মুজতাবা, তার পর আল হোসাইন ইবনে আলী সাইয়্যেদুশ শুহাদা,তার পর আলী ইবনে আল হোসাইন (জয়নুল আবেদীন) তার পর মোহাম্মদ ইবনে আলী আল বাকের। (হে যাবির! তুমি তার দেখা পাবে, যখন তুমি তার সাক্ষাৎ পাবে তখন তাকে আমার সালাম বলবে)। তার পর জাফর ইবনে মোহাম্মদ আস সাদিক, তার পর মুসা ইবনে আল কাজিম, তার পর আলী ইবনে মুসা আর রেজা, তার পর মোহাম্মদ ইবনে আলী জাওয়াদ (আত্ তাকী) তার পর আল ইবনে মোহাম্মদ আল হাদী (আল নাকী), তার পর আল হাসান আল আসকারী এবং সর্বশেষ আমার নাম ও উপাধি বহনকারী যে জগতে খোদার প্রমাণ এবং আল্লাহর অস্তিত্বের চিহ্ন বহন করবে। আল্লাহ তা’আলা তার মাধ্যমে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম জয় নিশ্চিত করবেন। তিনি নিজের ভক্ত ও বন্ধুদের হতে অদৃশ্য হয়ে যাবেন কিন্তু তার অদৃশ্য চিরস্থায়ী নয় এবং তার ইমামতের ওপর তারাই দৃঢ় থাকবে যাদের হৃদয়কে আল্লাহ তা’আলা ঈমানের জন্য পরীক্ষা করেছেন । তার পবিত্র নাম হবে “মোহাম্মদ আল মাহদী।” যাবির বর্ণনা করেছেন যে, আমি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে রাসূলুল্লাহ! তার অদৃশ্য থাকাকালীন তার অস্তিত্ব দ্বারা তার ভক্তরা কি লাভবান হবে’? তিনি উত্তরে এরশাদ করেন,‘ ঐ আল্লাহর কসম যিনি আমাকে নবুয়্যত দিয়ে পাঠিয়েছেন, সে তোমাদেরকে নিজের নূর দ্বারা আলোকিত করবে, নিজের বেলায়েত দ্বারা তোমাদের উপকার করবে যেমন সূর্য দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। যখন সূর্য মেঘের আড়ালে থাকে, হে যাবির! এটা আল্লাহ তা’আলার রহস্য, ভেদ ও গুপ্ত বিদ্যা, এটা সকলের কাছে প্রকাশ করো না। কিন্তু যারা যোগ্য তাদের কাছে অবশ্যই প্রকাশ করো’।