বাংলা সাহিত্যে মহররম
মনসুর আহমদ : ইতিহাসের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, মুসলমান বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতার কল্যাণেই বাংলাভাষা মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ বিদ্যোৎসাহী ও ন্যায়বিচারক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। খুব সম্ভবতঃ তিনি বাংলা ভাষায় রামায়ন রচয়িতা কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের অনুপ্রেরণায় শাহ মোহাম্মাদ সগীর বাংলা ভাষায় ‘ইউসুফ জোলায় খা' নামক কাব্য রচনা করেন। শাহ মুহম্মদ সগীর ও আলাওল বাঙালি মুসলিম সহিত্যেও দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। হুসেন শাহ আরবী ও ফারসী সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। হোসেন শাহের নাম বাংলা সাহিত্যের স্ফুরণে অমর হয়ে আছে। অবশ্য এ আমলের পূর্বেও মুসলমানদের লেখা বাংলা কিতাব পাওয়া যায়। মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যান মূলক শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য রচিত হয়। হিন্দু লেখকদের সহায়তায় বাংলা ভাষায় হিন্দু শাস্ত্র চর্চা এমন ভাবে শুরু হয়ে যায় যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হিন্দু ভাবধারা ও হিন্দুয়ানী শব্দে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমনি অবস্থায় কয়েকজন মুসলমান কবির মনে ইসলামের বিজয়গাঁথা নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির ইচ্ছা জাগে। বৈষ্ণববাদের প্রভাবে ইসলামী সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখবার প্রচেষ্টা তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত। সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের আমলের (১৪৪৭-৮১খৃ) শক্তিশালী কবি জৈনুদ্দীন তাঁর রসূল বিজয় কাব্য রচনা করেন।
বাংলা সাহিত্যে মহররম আলোচনা করতে গেলে প্রথমে আলোচনা করতে হয় পুঁথি সাহিত্যের। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের বিরাট অংগ জুড়ে রয়েছে পুঁথি সাহিত্য। মুসলিম কবি ও সাহিত্যিকগণ ইসলামকে কেন্দ্র করে পুঁথি সাহিত্য রচনা করেন। পুঁথি সাহিত্যে ‘মহররম' বেশ গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৬) রচনা করেছেন ‘মকতুল হোসেন', মুহম্মদ হোসেন সপ্তদশ শতাব্দীতে-‘মকতুল হোসেন', আবদুল হাকিম সপ্তাদশ শতাব্দীতে (১৬২০-১৬৯০) ‘কারবালা', ইয়াকুব ‘মুক্তল হোসেন', হায়াত মাহমুদ ‘মহর্রম পর্ব', গরীব উল্লা ‘মুক্তল হোসেন', আকিল মুহম্মদ (১৭৮২-১৭৮৯) ‘জঙ্গ নামা' রচনা করেছেন। শপ্তদশ শতাব্দীতে শাহ্ গরীবুল্লাহ ‘জঙ্গ নামা' পুঁথি রচনা করেন। একই শতাব্দীতে ২৪ পরগণার মোহাম্মাদ ইয়াকুব ‘জঙ্গ নামা' লেখেন। মুহম্মদ খানের ‘মুক্তল হোসেন' কারবালার কাহিনী নিয়ে লেখা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ‘জঙ্গ নামা'।' রচনা কাল ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ। রাধারমণ গোপ নামক জনৈকি হিন্দু কবির 'ইমামের জঙ্গ' নামক একটি পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায়। পুঁথিখানা সম্ভবত আঠারো শতকের শেষ দিকে লেখা। ‘জঙ্গনামা' পর্যায়ের সর্বশেষ রচনা সাদ আলী ও আবদুল ওহাবের ‘শহীদে কারবালা।' গরীবুল্লাহ্র ‘জঙ্গ নামা' (মুহম্মদ ইয়াকুব আলীর নামে প্রচলিত) কাব্যে লেখা হয়েছে ঃ
ইমামের লহু গেল আসমানের উপরে।
আসমান উপরে লহু ছিটকায় লাগিল
সিন্দুরিয়া মেঘ হইয়া আসমানে রহিল।
আজি তক সেই মেঘ উঠে যে আসমানে
পুঁথি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ ‘‘মকতুল হোসেন’’, ‘‘জঙ্গনামা’’, ‘‘শহীদে কারবালা’’ ইত্যাদি মহররমকে কেন্দ্র করে রচিত।
পুঁথি সাহিত্যের পরে ‘মহররম'কে কেন্দ্র করে লেখা গ্রন্থের মধ্যে প্রথমে নাম করতে হয় ‘বিষাদ-সিন্ধু'র (১৮৮৫-১৮৯১)। ‘বিষাদ সিন্ধুর' আখ্যায়িকা ডাল পালা মেলেছে ‘মকতুল হোসেন', ‘জঙ্গ নামা' পুঁথির উপর ভিত্তি করে। মীর মোশাররফ হোসেন তার সুবিখ্যাত সদ্য গ্রন্থ ‘বিষাদসিন্ধুর' কাহিনী শাহ্ গরীবুল্লাহ ও মুহম্মদ ইয়াকুবের ‘জঙ্গ নামা' থেকে গ্রহণ করেছেন। সমগ্র বাংলা গদ্য সাহিত্যে ‘বিষাদসিন্ধুর' মতো সৃষ্টি খুব কম পাওয়া যায়। ইসলামের ইতিহাসের বিয়োগান্ত ঘটনা কারবালার করুণ কাহিনী নিয়ে ‘বিষাদসিন্ধু' রচিত হলেও তার শিল্প রীতিতে মুসলিম ঐতিহ্য ও পরিবেশের ও প্রকৃত ঘটনার পূর্ণ রূপায়ন ঘটেনি বরংচ অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। নিছক ধর্মমূলক কবিতা ছাড়া মীর মোশাররফ হোসেনের হাতে কোন কাব্যকৃতিত্বেই মুসলিম ঐতিহ্যের কোন পরিচয় নেই-রচনার ভাষা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা কিংবা আঙ্গিক-এর কোন দিক থেকেই নয়।
মীর মোশাররফ হোসেনের পরে আবুল মা' আলী মহম্মদ আলী (১৮৭৪-?) পুঁথি কাব্যের উপর নির্ভর করে রচনা করেছেন ‘কাসেম বধ' ও জয়নলোদ্ধার' কাব্য। তা প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ১৯০৬ ও ১৯০৯ সালে। তিনি মধ্য যুগের মুসলিম কবিদের কাব্য ধারা থেকেই আদর্শ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। আপন ঐতিহ্যমন্ডিত এবং মুসলিম-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাব্য-বিষয় আহরণের প্রেরণা তিনি দীনেশচন্দ্র সেন এবং রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য থেকেও পেয়েছিলেন। ‘কাসেম বধ' কাব্যের ভূমিকায় হামিদ আলী লিখেছেন : ‘‘১৩১০ সালের ৪ঠা অগ্রহায়ণের ‘মিহির ও সুধাকরে' বাবু দীনেশচন্দ্র সেনের ‘মাতৃভাষা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি লিখিয়াছেন: মুসলমানগণ- হিন্দু সাহিত্য পাঠে হিন্দু আচার ব্যবহার শিক্ষায় ক্রমেই হিন্দু-ভাবাপন্ন হইয়া পড়িবে; তাই বাঙ্গালা সাহিত্য সম্বন্ধে উদাসীন থাকা মুসলমানদের উচিত নহে।’’ এভাবেই অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম বৈশিষ্ট্য মন্ডিত এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য- বিষয় সম্ভার নিযে হামিদ আলী কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তার ভাষার রূপ নির্মাণে পূর্বসূরীদের ধারা অনুসরণ করেছেন। যেমন :
মাবিয়া নন্দন
মুদিলা নয়ন- দ্বয় চিরতরে ক্রোড়ে
হানিফার। তা দেখিয়া স্বাধীনতা লক্ষ্মী
জয়-মাল্যে মহামতি জয়নলাবেদীনে
করিলা বরণ। ভাগ্যলক্ষ্মী অচিরাৎ
জয়নবের পানে প্রীতিপূর্ণ চাহনিতে
চাহিলা, হাসিলা মৃদু। বিজয়-দুন্দুভি
বাজিলা উঠিল ত্বরা কাপায়ে দামেস্ক;
‘জয় জয়' রবে বিশ্ব পুরিল মুহূর্তে। [‘জয়নলোদ্ধার কাব্য']
হামিদ আলীর ‘কাশেমবধ', ‘জয়নলোদ্ধার কাব্য', ‘সোহরাব বধ কাব্য' সবগুলোই পুঁথি নির্ভর। ‘কাব্যের স্বাতন্ত্রমূলক ও মুসলিম-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপজীব্য গ্রহণের কৈফিয়ৎ প্রসঙ্গে হামিদ আলী লিখেছেন : ‘‘রাম-রাবণের যুদ্ধের অনেকগুলো ঘটনা হইতে একটি প্রধান ঘটনা অবলম্বনে যেমন ‘মেঘনাদ বধ' লিখিত, সেইরূপ এজিদ ও ইমামদিগের মধ্যে যে সকল যুদ্ধাদি হয় তাহার অনেক গুলি হইতে একটি ঘটনা অবলম্বনে এই কাব্য লিখিত। ‘মেঘনাদ বধ' ও ‘বৃত্তসংহারের' মতো এই কাব্যের উপকরণ পূর্ব হইতে সংগৃহীত ছিল না। মহরম ঘটনা আরও অনেকে লিখিয়াছেন; কিন্তু আমি স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করিয়াছি।’’ মহরম ঘটনা যে মহাকাব্য রচনার পক্ষে একটি অত্যন্ত উপযোগী বিষয় সে সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদনও সচেতন ছিলেন। মধুসূদনের ভাষায় : ‘মহাকাব্য লিখিবার উপযোগী একটি বিষয় রহিয়া গেল- সে মুসলমানদের মহরম। জগতে এমন করুণ রসাত্মক বিষয় আর নাই। হিন্দুদের মহাভারতে ‘অভিমন্যু-বধ' যেমন একটি করুণ রসের প্রশ্রবণ, মুসলমানদের মহরম তদপেক্ষা আরো অধিকতর করুণ- রসের মহাসমুদ্র। যদি কেহ লিখিতে পারেন, পরম উপাদেয় হইবে।'
মধুসূদনের এ ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে মুসলমান লেখকদের মাঝে। এগিয়ে এলেন হামীদ আলী ও আরো অনেকে। হামিদ আলীর কাব্যের কাহিনী-সংগঠন ও পরিকল্পনা (theme) সম্পর্কে আবদুল কাদির বলেছেন ঃ ‘‘তিনি তাঁহার এই দুইখানি কাব্যের পরিকল্পনা প্রস্তুত করিয়াছেন মীর মোশাররফ হোসেনের' বিষাদ সিন্ধু' অবলম্বনে।
মহররমের উপর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে খয়রাতুল্লার ‘কারবালা' (১৯০৬), মোহাম্মদ উদ্দীন আহমদের ‘মোহররম কান্ড' (১৯১২), মোহাম্মদ আবদুল বারীর (১৮৭২-১৯৪৪) ‘কারবালা' (১৯১৩), ফজলুর রহিম চৌধুরীর ‘মহরমচিত্র' (১৯১৭), আমীর হোসেন আল কাদেরীর ‘কারবালার যুদ্ধ' (১৯৩৬), খান বাহাদুর আবেদআলীর ‘মহরম পর্ব', আবদুল গফুর সিদ্দীকির ‘বিষাদ সিন্ধুর ঐতিহাসিক পটভূমি', ডক্টর গোলাম সাকলায়েনের ‘কারবালা কাহিনী', মুহম্মদ বরকত উল্লাহ'র কারবালার যুদ্ধ ও নবী বংশের ইতিবৃত্ত' (১৯৫৭) এবং ‘কারবালা ও ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত' (১৯৬৫)।
মহররমের উপর কবিতা লেখা হয়েছে বেশ। কবি শাহাদৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩) রচনা করেছেন ‘‘মহরম’’ (কলিকাতা, ১৩২৭), ‘‘শহীদে কারবালা’’ (কলিকাতা, ১৩২৭) কবিতা। ‘‘শহীদে কারবালা’’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
ও কে বীর ধেয়ে যায় ফোরাতের কুলেতে
উন্মাদ পিপাসায় কর চাপি বুকেতে?
মণি-দীপ ও যে গো হযরত বংশের
দুশমনে খেদায়ে করে ধরি শমশের-
..........................
ওই শোন্ ক্রন্দনে বেজে ওঠে দুনিয়া-
হায়! হায়! হা হোসেন! আসমান চুনিয়া-
খুন ঝরে প্রান্তরে জান্নাত নিঙাড়ি,
কল্লোলে কাঁদে নদী সৈকতে আছাড়ি। ..
মহরম কবিতায় তিনি লিখেছেন :
রুদ্র দুপুর চলে আফতাব শিরে ঝলে
ছুটে জ্বালা চৌদিকে ইঙ্গিত মৃত্যুর,
কোন্খানে নাহি চিন্ পানি এক বিন্দুর।
মরু-বালু ঝলকায়
উন্মনা ছুটে চলে বাতাসের হলকায়।
............................
এই সেই মহরম সে-দিনের সেই গম
ভুলেছ কি মুসলিম? ‘দীন' তবে ইসলাম,
সত্যের উপাসক তুমি ‘ন্যায় পয়গাম'
মুক্তির পন্থায়-
ছুটে চলো নাশি এই মিথ্যা ও অন্যায়।
শাহাদত হোসেনের ‘‘শহীদে কারবালা’’ কবিতায় নজরুলের প্রতিধ্বনিময়তায় কবির বেদনা ডানা মেলতে পারেনি; কিন্তু দীর্ঘ অসামান্য ‘কারবালা', (মোহাম্মদী, মাঘ, ১৩৫০) কবিতায় কাব্য ভাষা কবির একান্ত নিজস্ব কণ্ঠস্বরে বিকীর্ণ। কবিতাটির শেষ অংশে হযরত হোসাইনের শাহাদতের দৃশ্য বর্ণনা করতে কবি লিখেছেন :
শাণিত খঞ্জর হাতে ছুটিল ঘাতক
মৃত্যুঘাত হানিল হলকুমে-
আচম্বিতে দিক-দশ আকাশ ভুবন
আর্ত আহাজারি রোলে উঠিল কাঁপিয়া।
শূন্য-ব্যোম-বায়ুস্তরে করুণার আকুল ক্রন্দন
কাঁদে জীন, হুর-পরী কাঁদে মিকাইল
আকাশের অন্তরালে শিঙ্গা-হাতে কাঁদে এস্রাফিল
দিগন্ত জাহান ভরি কান্না-উতরোল
রোনাজারি খিন্ন হায়! হায়!
নূরনবী মোস্তফার নয়নের মণি নিভে যায়।
সে-কান্নার চিরন্তন করুণার রোল
অজিও গুমরি ফেরে নিখিলের শূন্য বিয়াবানে
অনন্তের প্রান্তর-পাথারে
বৃথায় খুঁজিয়া মরে মদিনার সিংহ-শহীদেরে।
মহররমের উপর কলম ধরেছিলেন ইসমাইল হোসেন শিরাজী। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর (১৮৭৯-১৯৩১) ‘মহাশিক্ষা' কাব্য ‘আল ইসলাম' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল। ‘মহাশিক্ষা' কারবালার ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। ঘটনার ক্ষেত্রে কবির উপাদান ছিল ‘বিষাদসিন্ধু'। এবং সে কারণেই এতে যথেষ্ট অনৈতিহাসিক ঘটনার অন্তর প্রবেশ ঘটেছে। কবি তার কাব্যখানির উপসংহার টেনেছেন এভাবে :
‘‘অনন্তর আলীজাদা সুশৃক্মখল করি
বিশৃক্মখলা সাম্রাজ্যের বিপুল ঘটায়
জয়নাল নগিনা তরে আনন্দ উল্লাসে
বাঁধি পরিণয় পাশে ফিরিল স্বরাজে
ভাসিয়া আখির নীরে' হা হোসেন' বলি।
অভাগা বঙ্গের কবি শোকার্ত শিরাজী
অনাহারে অনিদ্রায় সহি নানা ক্লেশ
সুদীর্ঘ দ্বাদশ বর্ষে বিধি কৃপা বলে
এই খানে মহাশিক্ষা করিলেক শেষ।’’
কবি কায়কোবাদ যার কাব্য জীবনের সর্বশেষ অধ্যায়ের ব্যাপ্তিকাল ১৯১৫ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত, তিনি ‘মহরম শরীফ' গ্রন্থ রচনা করেন ১৯৩৩ সালে। ‘মহরম শরীফে' কবি সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিকের মত প্রচলিত ইতিহাসের সংশোধন করেছেন, এবং যথার্থ সত্যকে অবলম্বন করার চেষ্টা করেছেন।
মুসলিম ঐতিহ্যের কবি নজরুল ইসলাম মহররমকে ঘিরে কবিতা ও গান রচনা করেছেন প্রচুর। মহররম প্রসঙ্গে কবির রচিত ‘ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়, তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি', ‘ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে অঝোর নয়নেরে' ‘মহররমের চাঁদ এলো ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়', ‘মহররমের চাঁদ ওঠারত আজিও অনেক দেরী', ‘নীলসিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া' ও ‘এলো শোকের সেই মহররম' প্রভৃতি গান। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘মহররম' মোসলেম ভারতে প্রথম প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তীতে অগ্নি-বীণা কাব্যে (১৯২২) ছাপা হয়। ভাষা, বিষয় ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার স্বাতন্ত্র্যে রচনাটি পুঁথি সাহিত্যের আধুনিক বিবর্তিত রূপ। যেমন :
আসমান জমিন আদি পাহাড় বাগান।
কাঁদিয়া স্থির কৈল কারবালা ময়দান। ।
আফতাব মাহতাব আদি কালা হইয়া গেল
জানওয়ার হরিণ পাখি কাঁদিতে লাগিল। ।
০ ০ ০ ০ ০
যত মোছলমান ছিল এজিদ-লস্করে।
জার জার হইয়া কাঁদে এমাম খাতেরে। ।
শোকেতে কাতর হইল যত মুসলমান।
দেলেতে হইল খুশী যত কোফরান। [জঙ্গনামা, মুহম্মদ এয়াকুব]
পুঁথির এই মর্মান্তিক ট্রাজেডি নজরুলের হাতে আধুনিকতায় বাঙময় হয়ে উঠেছে এইভাবে :
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া।
আম্মা! লাল তেরি খুনকিয়া খুনিয়া
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সে কাঁদনে আসু আনে সীমারের ছোরাতে
০ ০ ০ ০ ০
ফিরে এল আজ সেই মহররম মাহিনা,-
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।
উষ্ণিষ কোরানের, হাতে তেগ আরবীর
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,-
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা!
শমসের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নকীবের তুর্য
হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য!
জাগো, ওঠো মুসলিম, হাঁকো হায়দরী হাঁক
শহীদের খুনে সব লালে লাল হয়ে যাক! ....
এই কবিতায় নজরুল ইসলাম একদিকে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামের আসল রূপ অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে কবিতাটিতে আরবী-ফার্সি শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি অভিধানে লুকিয়ে থাকা অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দকে বাংলায় পরিচিত অর্থে ব্যবহার করে মুন্শিয়ানা দেখিয়েছেন। যেমন ‘ক্রন্দসী' শব্দটির অভিধানে অর্থ লেখা হয়েছে আকাশ-পাতাল। শব্দটি বেদে আছে। অথচ লৌকিক সংস্কৃতে প্রয়োগ নেই বলে সংস্কৃত অভিধানে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাশ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘উর্বশী' কবিতায়-‘ওই শুন দিশে দিশে তব লাগি কাঁদিছে ক্রন্দসী।' কিন্তু নজরুল এই অপ্রচলিত ‘ক্রন্দসী' শব্দটিকে অন্তরের মাধুরী মিশিয়ে ‘মহররম' কবিতায় ‘ক্রন্দনমান নারী' অর্থে স্বার্থক ব্যবহার করেছেন। এমনটি নজরুল একা করেননি। রবীন্দ্রনাথও তাঁর অনেক কবিতায় প্রচলিত অর্থের প্রচুর শব্দকে ভিন্ন অর্থে যেমন-নীলাঞ্জন (তুঁতে) কে ‘নীল মেঘ' অর্থে-‘নীলাঞ্জনা ছায়া ... ‘স্বার্থক ব্যবহার করেছেন।
স্বার্থের দ্বন্দ যখন আরব বদ্বীপ ছাড়িয়ে গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশের মুসলিম সমাজও এই আত্মকলহের শিকার হয়ে পড়ে, তখন কবি রচনা করেন ‘মহররম' নামক দ্বিতীয় কবিতাটি। এ কবিতাটি ‘শেষ সওগাতে' প্রকাশিত হয়, লেখা হয়েছিল ১৯৪০-৪১ সালে। দ্বনদ্ব ও আত্মকলহের চিত্র আকতে গিয়ে কবি লেখেন :
ওরে বাঙলার মুসলিম তোরা কাঁদ
এনেছে এজিদী বিদ্বেষ পুনঃ মহররমের চাঁদ।
এক ধর্ম ও এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে
তখতের লোভে এসেছি এজিদ কমবখতের বেশে
এসেছে ‘‘সীমার’’ এসছে ‘কুফার' বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে, লোভের প্রবল নির্মমতা!
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,
কাঁদে আসমান জমিন কাঁদিছে মহররমের চাঁদ।
০ ০ ০ ০ ০
এরাই আত্মপ্রতিষ্ঠা-লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে।
ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য, এরা তাহা দেয় ভেঙ্গে
ফোরাত নদীর কূল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে
এই ভোগীদের জুলুমে! ইহারা এজিদী মুসলমান,
এরা ইসলামী সাম্যবাদের করিয়াছে খান খান!
এক বিন্দুও প্রেম-অমৃত নাই ইহাদের বুকে
শিশু আসগরে তীর হেনে হাসে পিশাচের মত সুখে।
কবি নজরুল ইসলামের পরে সৈয়দ আলী আহসান ইসলামী ভাবাবহ প্রধান কবিতা নিয়ে আগমন করেন। তিনি ‘মহররম' নামে একটি কবিতা রচনা করেন।
আমার মনে হয় ইসলামের ইতিহাসের মহররম নিয়ে সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত যত লেখা রচিত হয়েছে দ্বিতীয় এমন কোন বিষয় নিয়ে এত লেখা ছাপা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। (সংগৃহীত)
বাংলা সাহিত্যে মহররম আলোচনা করতে গেলে প্রথমে আলোচনা করতে হয় পুঁথি সাহিত্যের। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের বিরাট অংগ জুড়ে রয়েছে পুঁথি সাহিত্য। মুসলিম কবি ও সাহিত্যিকগণ ইসলামকে কেন্দ্র করে পুঁথি সাহিত্য রচনা করেন। পুঁথি সাহিত্যে ‘মহররম' বেশ গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৬) রচনা করেছেন ‘মকতুল হোসেন', মুহম্মদ হোসেন সপ্তদশ শতাব্দীতে-‘মকতুল হোসেন', আবদুল হাকিম সপ্তাদশ শতাব্দীতে (১৬২০-১৬৯০) ‘কারবালা', ইয়াকুব ‘মুক্তল হোসেন', হায়াত মাহমুদ ‘মহর্রম পর্ব', গরীব উল্লা ‘মুক্তল হোসেন', আকিল মুহম্মদ (১৭৮২-১৭৮৯) ‘জঙ্গ নামা' রচনা করেছেন। শপ্তদশ শতাব্দীতে শাহ্ গরীবুল্লাহ ‘জঙ্গ নামা' পুঁথি রচনা করেন। একই শতাব্দীতে ২৪ পরগণার মোহাম্মাদ ইয়াকুব ‘জঙ্গ নামা' লেখেন। মুহম্মদ খানের ‘মুক্তল হোসেন' কারবালার কাহিনী নিয়ে লেখা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ‘জঙ্গ নামা'।' রচনা কাল ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ। রাধারমণ গোপ নামক জনৈকি হিন্দু কবির 'ইমামের জঙ্গ' নামক একটি পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায়। পুঁথিখানা সম্ভবত আঠারো শতকের শেষ দিকে লেখা। ‘জঙ্গনামা' পর্যায়ের সর্বশেষ রচনা সাদ আলী ও আবদুল ওহাবের ‘শহীদে কারবালা।' গরীবুল্লাহ্র ‘জঙ্গ নামা' (মুহম্মদ ইয়াকুব আলীর নামে প্রচলিত) কাব্যে লেখা হয়েছে ঃ
ইমামের লহু গেল আসমানের উপরে।
আসমান উপরে লহু ছিটকায় লাগিল
সিন্দুরিয়া মেঘ হইয়া আসমানে রহিল।
আজি তক সেই মেঘ উঠে যে আসমানে
পুঁথি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ ‘‘মকতুল হোসেন’’, ‘‘জঙ্গনামা’’, ‘‘শহীদে কারবালা’’ ইত্যাদি মহররমকে কেন্দ্র করে রচিত।
পুঁথি সাহিত্যের পরে ‘মহররম'কে কেন্দ্র করে লেখা গ্রন্থের মধ্যে প্রথমে নাম করতে হয় ‘বিষাদ-সিন্ধু'র (১৮৮৫-১৮৯১)। ‘বিষাদ সিন্ধুর' আখ্যায়িকা ডাল পালা মেলেছে ‘মকতুল হোসেন', ‘জঙ্গ নামা' পুঁথির উপর ভিত্তি করে। মীর মোশাররফ হোসেন তার সুবিখ্যাত সদ্য গ্রন্থ ‘বিষাদসিন্ধুর' কাহিনী শাহ্ গরীবুল্লাহ ও মুহম্মদ ইয়াকুবের ‘জঙ্গ নামা' থেকে গ্রহণ করেছেন। সমগ্র বাংলা গদ্য সাহিত্যে ‘বিষাদসিন্ধুর' মতো সৃষ্টি খুব কম পাওয়া যায়। ইসলামের ইতিহাসের বিয়োগান্ত ঘটনা কারবালার করুণ কাহিনী নিয়ে ‘বিষাদসিন্ধু' রচিত হলেও তার শিল্প রীতিতে মুসলিম ঐতিহ্য ও পরিবেশের ও প্রকৃত ঘটনার পূর্ণ রূপায়ন ঘটেনি বরংচ অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। নিছক ধর্মমূলক কবিতা ছাড়া মীর মোশাররফ হোসেনের হাতে কোন কাব্যকৃতিত্বেই মুসলিম ঐতিহ্যের কোন পরিচয় নেই-রচনার ভাষা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা কিংবা আঙ্গিক-এর কোন দিক থেকেই নয়।
মীর মোশাররফ হোসেনের পরে আবুল মা' আলী মহম্মদ আলী (১৮৭৪-?) পুঁথি কাব্যের উপর নির্ভর করে রচনা করেছেন ‘কাসেম বধ' ও জয়নলোদ্ধার' কাব্য। তা প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ১৯০৬ ও ১৯০৯ সালে। তিনি মধ্য যুগের মুসলিম কবিদের কাব্য ধারা থেকেই আদর্শ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। আপন ঐতিহ্যমন্ডিত এবং মুসলিম-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাব্য-বিষয় আহরণের প্রেরণা তিনি দীনেশচন্দ্র সেন এবং রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য থেকেও পেয়েছিলেন। ‘কাসেম বধ' কাব্যের ভূমিকায় হামিদ আলী লিখেছেন : ‘‘১৩১০ সালের ৪ঠা অগ্রহায়ণের ‘মিহির ও সুধাকরে' বাবু দীনেশচন্দ্র সেনের ‘মাতৃভাষা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি লিখিয়াছেন: মুসলমানগণ- হিন্দু সাহিত্য পাঠে হিন্দু আচার ব্যবহার শিক্ষায় ক্রমেই হিন্দু-ভাবাপন্ন হইয়া পড়িবে; তাই বাঙ্গালা সাহিত্য সম্বন্ধে উদাসীন থাকা মুসলমানদের উচিত নহে।’’ এভাবেই অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম বৈশিষ্ট্য মন্ডিত এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য- বিষয় সম্ভার নিযে হামিদ আলী কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তার ভাষার রূপ নির্মাণে পূর্বসূরীদের ধারা অনুসরণ করেছেন। যেমন :
মাবিয়া নন্দন
মুদিলা নয়ন- দ্বয় চিরতরে ক্রোড়ে
হানিফার। তা দেখিয়া স্বাধীনতা লক্ষ্মী
জয়-মাল্যে মহামতি জয়নলাবেদীনে
করিলা বরণ। ভাগ্যলক্ষ্মী অচিরাৎ
জয়নবের পানে প্রীতিপূর্ণ চাহনিতে
চাহিলা, হাসিলা মৃদু। বিজয়-দুন্দুভি
বাজিলা উঠিল ত্বরা কাপায়ে দামেস্ক;
‘জয় জয়' রবে বিশ্ব পুরিল মুহূর্তে। [‘জয়নলোদ্ধার কাব্য']
হামিদ আলীর ‘কাশেমবধ', ‘জয়নলোদ্ধার কাব্য', ‘সোহরাব বধ কাব্য' সবগুলোই পুঁথি নির্ভর। ‘কাব্যের স্বাতন্ত্রমূলক ও মুসলিম-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপজীব্য গ্রহণের কৈফিয়ৎ প্রসঙ্গে হামিদ আলী লিখেছেন : ‘‘রাম-রাবণের যুদ্ধের অনেকগুলো ঘটনা হইতে একটি প্রধান ঘটনা অবলম্বনে যেমন ‘মেঘনাদ বধ' লিখিত, সেইরূপ এজিদ ও ইমামদিগের মধ্যে যে সকল যুদ্ধাদি হয় তাহার অনেক গুলি হইতে একটি ঘটনা অবলম্বনে এই কাব্য লিখিত। ‘মেঘনাদ বধ' ও ‘বৃত্তসংহারের' মতো এই কাব্যের উপকরণ পূর্ব হইতে সংগৃহীত ছিল না। মহরম ঘটনা আরও অনেকে লিখিয়াছেন; কিন্তু আমি স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করিয়াছি।’’ মহরম ঘটনা যে মহাকাব্য রচনার পক্ষে একটি অত্যন্ত উপযোগী বিষয় সে সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদনও সচেতন ছিলেন। মধুসূদনের ভাষায় : ‘মহাকাব্য লিখিবার উপযোগী একটি বিষয় রহিয়া গেল- সে মুসলমানদের মহরম। জগতে এমন করুণ রসাত্মক বিষয় আর নাই। হিন্দুদের মহাভারতে ‘অভিমন্যু-বধ' যেমন একটি করুণ রসের প্রশ্রবণ, মুসলমানদের মহরম তদপেক্ষা আরো অধিকতর করুণ- রসের মহাসমুদ্র। যদি কেহ লিখিতে পারেন, পরম উপাদেয় হইবে।'
মধুসূদনের এ ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে মুসলমান লেখকদের মাঝে। এগিয়ে এলেন হামীদ আলী ও আরো অনেকে। হামিদ আলীর কাব্যের কাহিনী-সংগঠন ও পরিকল্পনা (theme) সম্পর্কে আবদুল কাদির বলেছেন ঃ ‘‘তিনি তাঁহার এই দুইখানি কাব্যের পরিকল্পনা প্রস্তুত করিয়াছেন মীর মোশাররফ হোসেনের' বিষাদ সিন্ধু' অবলম্বনে।
মহররমের উপর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে খয়রাতুল্লার ‘কারবালা' (১৯০৬), মোহাম্মদ উদ্দীন আহমদের ‘মোহররম কান্ড' (১৯১২), মোহাম্মদ আবদুল বারীর (১৮৭২-১৯৪৪) ‘কারবালা' (১৯১৩), ফজলুর রহিম চৌধুরীর ‘মহরমচিত্র' (১৯১৭), আমীর হোসেন আল কাদেরীর ‘কারবালার যুদ্ধ' (১৯৩৬), খান বাহাদুর আবেদআলীর ‘মহরম পর্ব', আবদুল গফুর সিদ্দীকির ‘বিষাদ সিন্ধুর ঐতিহাসিক পটভূমি', ডক্টর গোলাম সাকলায়েনের ‘কারবালা কাহিনী', মুহম্মদ বরকত উল্লাহ'র কারবালার যুদ্ধ ও নবী বংশের ইতিবৃত্ত' (১৯৫৭) এবং ‘কারবালা ও ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত' (১৯৬৫)।
মহররমের উপর কবিতা লেখা হয়েছে বেশ। কবি শাহাদৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩) রচনা করেছেন ‘‘মহরম’’ (কলিকাতা, ১৩২৭), ‘‘শহীদে কারবালা’’ (কলিকাতা, ১৩২৭) কবিতা। ‘‘শহীদে কারবালা’’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
ও কে বীর ধেয়ে যায় ফোরাতের কুলেতে
উন্মাদ পিপাসায় কর চাপি বুকেতে?
মণি-দীপ ও যে গো হযরত বংশের
দুশমনে খেদায়ে করে ধরি শমশের-
..........................
ওই শোন্ ক্রন্দনে বেজে ওঠে দুনিয়া-
হায়! হায়! হা হোসেন! আসমান চুনিয়া-
খুন ঝরে প্রান্তরে জান্নাত নিঙাড়ি,
কল্লোলে কাঁদে নদী সৈকতে আছাড়ি। ..
মহরম কবিতায় তিনি লিখেছেন :
রুদ্র দুপুর চলে আফতাব শিরে ঝলে
ছুটে জ্বালা চৌদিকে ইঙ্গিত মৃত্যুর,
কোন্খানে নাহি চিন্ পানি এক বিন্দুর।
মরু-বালু ঝলকায়
উন্মনা ছুটে চলে বাতাসের হলকায়।
............................
এই সেই মহরম সে-দিনের সেই গম
ভুলেছ কি মুসলিম? ‘দীন' তবে ইসলাম,
সত্যের উপাসক তুমি ‘ন্যায় পয়গাম'
মুক্তির পন্থায়-
ছুটে চলো নাশি এই মিথ্যা ও অন্যায়।
শাহাদত হোসেনের ‘‘শহীদে কারবালা’’ কবিতায় নজরুলের প্রতিধ্বনিময়তায় কবির বেদনা ডানা মেলতে পারেনি; কিন্তু দীর্ঘ অসামান্য ‘কারবালা', (মোহাম্মদী, মাঘ, ১৩৫০) কবিতায় কাব্য ভাষা কবির একান্ত নিজস্ব কণ্ঠস্বরে বিকীর্ণ। কবিতাটির শেষ অংশে হযরত হোসাইনের শাহাদতের দৃশ্য বর্ণনা করতে কবি লিখেছেন :
শাণিত খঞ্জর হাতে ছুটিল ঘাতক
মৃত্যুঘাত হানিল হলকুমে-
আচম্বিতে দিক-দশ আকাশ ভুবন
আর্ত আহাজারি রোলে উঠিল কাঁপিয়া।
শূন্য-ব্যোম-বায়ুস্তরে করুণার আকুল ক্রন্দন
কাঁদে জীন, হুর-পরী কাঁদে মিকাইল
আকাশের অন্তরালে শিঙ্গা-হাতে কাঁদে এস্রাফিল
দিগন্ত জাহান ভরি কান্না-উতরোল
রোনাজারি খিন্ন হায়! হায়!
নূরনবী মোস্তফার নয়নের মণি নিভে যায়।
সে-কান্নার চিরন্তন করুণার রোল
অজিও গুমরি ফেরে নিখিলের শূন্য বিয়াবানে
অনন্তের প্রান্তর-পাথারে
বৃথায় খুঁজিয়া মরে মদিনার সিংহ-শহীদেরে।
মহররমের উপর কলম ধরেছিলেন ইসমাইল হোসেন শিরাজী। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর (১৮৭৯-১৯৩১) ‘মহাশিক্ষা' কাব্য ‘আল ইসলাম' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল। ‘মহাশিক্ষা' কারবালার ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। ঘটনার ক্ষেত্রে কবির উপাদান ছিল ‘বিষাদসিন্ধু'। এবং সে কারণেই এতে যথেষ্ট অনৈতিহাসিক ঘটনার অন্তর প্রবেশ ঘটেছে। কবি তার কাব্যখানির উপসংহার টেনেছেন এভাবে :
‘‘অনন্তর আলীজাদা সুশৃক্মখল করি
বিশৃক্মখলা সাম্রাজ্যের বিপুল ঘটায়
জয়নাল নগিনা তরে আনন্দ উল্লাসে
বাঁধি পরিণয় পাশে ফিরিল স্বরাজে
ভাসিয়া আখির নীরে' হা হোসেন' বলি।
অভাগা বঙ্গের কবি শোকার্ত শিরাজী
অনাহারে অনিদ্রায় সহি নানা ক্লেশ
সুদীর্ঘ দ্বাদশ বর্ষে বিধি কৃপা বলে
এই খানে মহাশিক্ষা করিলেক শেষ।’’
কবি কায়কোবাদ যার কাব্য জীবনের সর্বশেষ অধ্যায়ের ব্যাপ্তিকাল ১৯১৫ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত, তিনি ‘মহরম শরীফ' গ্রন্থ রচনা করেন ১৯৩৩ সালে। ‘মহরম শরীফে' কবি সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিকের মত প্রচলিত ইতিহাসের সংশোধন করেছেন, এবং যথার্থ সত্যকে অবলম্বন করার চেষ্টা করেছেন।
মুসলিম ঐতিহ্যের কবি নজরুল ইসলাম মহররমকে ঘিরে কবিতা ও গান রচনা করেছেন প্রচুর। মহররম প্রসঙ্গে কবির রচিত ‘ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়, তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি', ‘ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে অঝোর নয়নেরে' ‘মহররমের চাঁদ এলো ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়', ‘মহররমের চাঁদ ওঠারত আজিও অনেক দেরী', ‘নীলসিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া' ও ‘এলো শোকের সেই মহররম' প্রভৃতি গান। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘মহররম' মোসলেম ভারতে প্রথম প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তীতে অগ্নি-বীণা কাব্যে (১৯২২) ছাপা হয়। ভাষা, বিষয় ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার স্বাতন্ত্র্যে রচনাটি পুঁথি সাহিত্যের আধুনিক বিবর্তিত রূপ। যেমন :
আসমান জমিন আদি পাহাড় বাগান।
কাঁদিয়া স্থির কৈল কারবালা ময়দান। ।
আফতাব মাহতাব আদি কালা হইয়া গেল
জানওয়ার হরিণ পাখি কাঁদিতে লাগিল। ।
০ ০ ০ ০ ০
যত মোছলমান ছিল এজিদ-লস্করে।
জার জার হইয়া কাঁদে এমাম খাতেরে। ।
শোকেতে কাতর হইল যত মুসলমান।
দেলেতে হইল খুশী যত কোফরান। [জঙ্গনামা, মুহম্মদ এয়াকুব]
পুঁথির এই মর্মান্তিক ট্রাজেডি নজরুলের হাতে আধুনিকতায় বাঙময় হয়ে উঠেছে এইভাবে :
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া।
আম্মা! লাল তেরি খুনকিয়া খুনিয়া
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সে কাঁদনে আসু আনে সীমারের ছোরাতে
০ ০ ০ ০ ০
ফিরে এল আজ সেই মহররম মাহিনা,-
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।
উষ্ণিষ কোরানের, হাতে তেগ আরবীর
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,-
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা!
শমসের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নকীবের তুর্য
হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য!
জাগো, ওঠো মুসলিম, হাঁকো হায়দরী হাঁক
শহীদের খুনে সব লালে লাল হয়ে যাক! ....
এই কবিতায় নজরুল ইসলাম একদিকে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামের আসল রূপ অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে কবিতাটিতে আরবী-ফার্সি শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি অভিধানে লুকিয়ে থাকা অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দকে বাংলায় পরিচিত অর্থে ব্যবহার করে মুন্শিয়ানা দেখিয়েছেন। যেমন ‘ক্রন্দসী' শব্দটির অভিধানে অর্থ লেখা হয়েছে আকাশ-পাতাল। শব্দটি বেদে আছে। অথচ লৌকিক সংস্কৃতে প্রয়োগ নেই বলে সংস্কৃত অভিধানে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাশ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘উর্বশী' কবিতায়-‘ওই শুন দিশে দিশে তব লাগি কাঁদিছে ক্রন্দসী।' কিন্তু নজরুল এই অপ্রচলিত ‘ক্রন্দসী' শব্দটিকে অন্তরের মাধুরী মিশিয়ে ‘মহররম' কবিতায় ‘ক্রন্দনমান নারী' অর্থে স্বার্থক ব্যবহার করেছেন। এমনটি নজরুল একা করেননি। রবীন্দ্রনাথও তাঁর অনেক কবিতায় প্রচলিত অর্থের প্রচুর শব্দকে ভিন্ন অর্থে যেমন-নীলাঞ্জন (তুঁতে) কে ‘নীল মেঘ' অর্থে-‘নীলাঞ্জনা ছায়া ... ‘স্বার্থক ব্যবহার করেছেন।
স্বার্থের দ্বন্দ যখন আরব বদ্বীপ ছাড়িয়ে গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশের মুসলিম সমাজও এই আত্মকলহের শিকার হয়ে পড়ে, তখন কবি রচনা করেন ‘মহররম' নামক দ্বিতীয় কবিতাটি। এ কবিতাটি ‘শেষ সওগাতে' প্রকাশিত হয়, লেখা হয়েছিল ১৯৪০-৪১ সালে। দ্বনদ্ব ও আত্মকলহের চিত্র আকতে গিয়ে কবি লেখেন :
ওরে বাঙলার মুসলিম তোরা কাঁদ
এনেছে এজিদী বিদ্বেষ পুনঃ মহররমের চাঁদ।
এক ধর্ম ও এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে
তখতের লোভে এসেছি এজিদ কমবখতের বেশে
এসেছে ‘‘সীমার’’ এসছে ‘কুফার' বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে, লোভের প্রবল নির্মমতা!
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,
কাঁদে আসমান জমিন কাঁদিছে মহররমের চাঁদ।
০ ০ ০ ০ ০
এরাই আত্মপ্রতিষ্ঠা-লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে।
ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য, এরা তাহা দেয় ভেঙ্গে
ফোরাত নদীর কূল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে
এই ভোগীদের জুলুমে! ইহারা এজিদী মুসলমান,
এরা ইসলামী সাম্যবাদের করিয়াছে খান খান!
এক বিন্দুও প্রেম-অমৃত নাই ইহাদের বুকে
শিশু আসগরে তীর হেনে হাসে পিশাচের মত সুখে।
কবি নজরুল ইসলামের পরে সৈয়দ আলী আহসান ইসলামী ভাবাবহ প্রধান কবিতা নিয়ে আগমন করেন। তিনি ‘মহররম' নামে একটি কবিতা রচনা করেন।
আমার মনে হয় ইসলামের ইতিহাসের মহররম নিয়ে সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত যত লেখা রচিত হয়েছে দ্বিতীয় এমন কোন বিষয় নিয়ে এত লেখা ছাপা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। (সংগৃহীত)