বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য -১ম পর্ব
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য
আবদুল মুকীত চৌধুরী
গবেষক, লেখক, সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।“শুনহ মানুষ ভাই - সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
কবি চণ্ডীদাসের এ কাব্যপংক্তি দু’টি কালজয়ী। এ বাণীর শক্তিমত্তা, যৌক্তিকতা ও সর্বগ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। ফলে এটি শুধু সাহিত্যের আলোচনায় সীমিত নেই, এর উচ্চারণ আমাদের সমাজ জীবনে বহুল রূপ নিয়েছে। এ বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে একটি নির্বিশেষ ও সর্বজনীন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এখানে ঘোষিত। সৃষ্টিজগতের সবার ওপরে মানুষের স্থান, মনুষ্যত্বের মর্যাদা। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। এ মর্যাদাকে একপেশে ভাবে কোন বিশেষ শ্রেণী-গোষ্ঠীর পক্ষে দেখারও আদৌ সুযোগ নেই। আমাদের সমাজ পরিবেশে আর্থ-সামাজিক ভেদ-বৈষম্যের যে প্রাচীর ঔদ্ধত্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শত শত বছর ধরে, যে অর্থ-ব্যবস্থা মানবীয় চিন্তার সীমাবদ্ধতার তিক্ত উদাহরণ হিসেবে শোষণ-বঞ্চনার ধারা অব্যাহত রেখেছে, সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষকে সম্পদের ভাণ্ডার কুক্ষিগত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এবং বৃহত্তর গণমানুষকে ঠেলে দিয়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের আবর্তে -সে ভেদ-বৈষম্য শোষণ প্রক্রিয়ার সপক্ষে কথা বলার কোন যুক্তি নেই। এটি নিছক সত্য-বিচ্যুতি ও মানবিক বোধ-বিচ্ছিন্ন উচ্চারণ বলেই বিবেচিত হবে। বিষয়ের নেতিবাচক দিক এটি। অন্যদিকে এ ধারার বিপরীতে উচ্চারিত কাব্যধারাকে আমরা মানবতাঋদ্ধ বলবো। ইতিবাচক মূল্যবোধের জন্য শুধু নয়, মানবীয় সমাজ-সংহতির জন্য অনেকটা পূর্বশর্তস্বরূপ আর্থ-সামাজিক সাম্যের বাণী জনমানসে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বশীল কর্ম সম্পাদনের জন্যও। সমাজের নির্যাতিত ও শোষিত মানুষের জীবন-যন্ত্রণার চিত্র বহন করবে যে কাব্য, আরো এগিয়ে তাকেই উচ্চারণ করতে হবে সমাজ ভাঙার গান - শোষণমুক্ত সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজ-বিপ্লবের গান।
বাংলা কাব্যধারার এ চরিত্র ও পর্যায়ে পৌঁছতে আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
কবি বিদ্যাপতির প্রার্থনায় এসেছে :
“যতনে যতেক ধন পাপে বটোরলোঁ
মিলিমিলি পরিজন খায়
মরণক বেরি বেরি কোই ন পুছত
করম সঙ্গে চলি যায় ॥
এ হরি বন্দেণ তুয় পদ নায়।”
পাপের ধন অর্জন, সঞ্চয়, পরিবার পরিজন তা খায়। কিন্তু মৃত্যুর সময় কেউ আর জিজ্ঞেস করে না, কর্মই সঙ্গে যায়। সহায়-সম্পদ প্রতিপত্তির অসারতা এখানে ব্যক্ত করেছেন কবি। তবে সম্পদ অর্জন, কুক্ষিগতকরণ প্রসঙ্গও এখানে এসেছে। বিদ্যাপতি বলেছেন :
“তুঁহু জগতারণ দীন দয়াময়
অতয়ে তোহারি বিশোয়াসা।”
‘দীনদয়াময়’-এর প্রতি বিশ্বাস তাঁর অবলম্বন, পাথেয়।
মধ্যযুগের কাব্যে মানবতা ও সাম্যের বাণী অনুপস্থিত নয়। ধর্ম-চিন্তা চেতনার মধ্যে অল্প হলেও সে আহবান ছন্দিত হয়েছে। সে যুগের কাব্যে অপাঙ্ক্তেয় মানুষের সংগ্রাম ও আত্ম-প্রতিষ্ঠার বাণী রূপলাভ করেছে। মঙ্গলকাব্যে অত্যাচারের বিপরীতে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী চেতনা বিদ্যমান। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাংলা কাব্যে সাম্য-ভাবনা লালিত হয়েছে মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে।
আমাদের প্রতিপাদ্য ‘বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য’। মানুষের ওপর শোষণ-বঞ্চনা-প্রাসঙ্গিক এবং অধিকার ও সাম্য বিষয়ক বাণী সম্বলিত কাব্য ও সংশ্লিষ্ট কবিদের কথা। অনেকটা পথ অগ্রসর হলে পরে আমরা শ্রেণী-চেতনা উদ্ভূত সংগ্রামের আহবান শুনতে পাবো। তার আগে ধনী-দরিদ্রের তথা শোষক ও শোষিতের জীবনের ব্যবধান, মানবিক সহমর্মিতা ও ক্ষেত্রবিশেষে সাম্যের সাক্ষাৎ পেতে পারি। উল্লেখ্য, এ প্রয়াসের সীমাবদ্ধতা আমি শুরুতেই স্বীকার করছি। এটি কোন সামগ্রিক তথ্যচিত্র নয় ; ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে যথাসম্ভব একটি ধারাবাহিকতা উপস্থাপনের চেষ্টা মাত্র। এ ব্যাপারে সম্মানিত গবেষকদের কবি ও কাব্যধারা সংযোজনের শুধু অবকাশই নয়, প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮২ খৃ.) বিদ্যোৎসাহী ও উদার ছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু ভাগবত গীতার ১০ম ও ১১শ অধ্যায়ের স্কন্ধ অনুসরণে ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ কাব্য লেখেন। ‘গুণরাজ খান’ ও তাঁর পরিচয়। সমাজের অপাঙ্ক্তেয় নিম্নশ্রেণীর মধ্যে ভাগবত-বাণী প্রচারের লক্ষ্য ছিল তাঁর। মালাধর বসুর কাব্য-পংক্তিতে ধর্মচর্চা ও মানবাধিকার প্রসঙ্গ উচ্চারিত :
“পুরাণ পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার
পাঁচালী পড়িয়া তর এ ভব সংসার।”
পনেরো শতকের অন্যতম কবি মুরারী গুপ্ত। শ্রী চৈতন্যের বড় ভাই বিশ্বরূপের সহপাঠী ও চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সহচর তিনি। তাঁর রচিত ‘মুরারী গুপ্তের কড়চা’ অবলম্বনে ‘শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত’ লেখা হয়। বর্ণবাদ ও জাতপাতের বিপরীতে বৈষ্ণব সাহিত্যের কাব্যধারায় পংক্তিমালা। ‘জীবে দয়া’র বাণীর প্রচারক মুরারী গুপ্ত : “নামে সবি জীবে দয়া, বৈষ্ণব সেবন
এহা সম ধর্ম্ম নাই, শোন সনাতন।”(শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত)
চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খৃ.) প্রচারিত প্রেমধর্ম বৈষ্ণব মতবাদ। তাঁর বাণী, “চণ্ডালোহপি দ্বিজ শ্রেষ্ঠো হরিভক্তি পরায়ণা” - “হরিভক্তিপরায়ণ চণ্ডালও ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।”
“যে পাপিষ্ঠ বৈষ্ণবের জাতি বৃদ্ধি করে
জন্ম জন্ম অধম যোনিতে ডুবে মরে।” (চৈতন্য ভাগবত-মধ্যখণ্ড)
চৈতন্যের ধর্মে প্রেমের প্রাধান্য, বর্ণাশ্রমের বিভাজন নেই, অস্বীকৃত। উচ্চবর্ণের সমাজের কথা :
“মহা চাষা বেটা ভাতে পেট নাহি ভরে।
ক্ষুধায় ব্যাকুল হৈয়া রাত্রি জাগি মরে ॥
কোন জপ কোন তপ কোন যজ্ঞ দান
তাহা না করিয়া শুধু কীর্ত্তনের সং ॥
চাল কলা মুগ দধি একত্র করিয়া
জাতি নাশ করি খায় একত্র হইয়া ॥”
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম সম্পর্কে গোপাল হালদার বলেন :
“ষোড়শ শতাব্দীর বাঙালীর এমন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস আর নেই। কিছুই কবির চোখ এড়ায় নি, অরাজকতার দিনে জুলুম করে জমির ‘পণ্যের কাঠায় কুড়া’ মাপা হয়, ‘খিল ভূমি করে লাল’, জোতদার ‘তঙ্কায় আড়াই আনা কম’ দেয়, মহাজনের অত্যাচারের শেষ নেই, কোটাল ‘কড়ির কারণে বহু মারে’, প্রজা যখন সব বিক্রি করছে, ‘ধান্য গরু কেহ নাহি কিনে’ - টাকার জিনিস তখন আবার দশ আনায় বিকোয়, অথচ গ্রাম ত্যাগ করে পালাবারও পথ সহজে পায় না মানুষ। পথ অবশ্য তবু পায় ; তাই বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয় না।...”
“স্বভাবতঃই এর সঙ্গে তুলনা হয় ইংরেজ কবি চসারের। কিন্তু চসার ইউরোপীয় ‘রিনায়েন্সে’র বিদগ্ধ, সুরসিক কবি ; আর মুকুন্দরাম মধ্যযুগের কবি, বাঙালীর পল্লী সভ্যতার কবি। যতটুকু মানবনিষ্ঠা, মানব চরিত্রবোধ, মানবতা ও সাধারণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা তাঁর কাব্যে আমরা পাই, সে যুগের তুলনায় তা একটি অপরিমিত বিস্ময়।”১
তাঁর
চণ্ডীমঙ্গল-এ বাঙালী জীবনচিত্র :
“মোল্লা পড়ায় নিকা দান পায় সিকা সিকা
দশ গণ্ডা দান পায় কড়ি
দান পায় কড়ি ছয় কুড়ি ॥’’
অবশ্য মুকুন্দরাম ‘অরাজকতা’কে ‘প্রজার পাপের ফল’ মনে করেন। উপর্যুক্ত কাব্যাংশে ধর্মবিদদের বিনিময় প্রসঙ্গ এসেছে।
মহাকবি সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮ খৃ.)-এর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘নবীবংশ’। সে যুগে বাংলা ভাষায় কোরআন হাদীস-এর বাণী অনুবাদ বা এ প্রসঙ্গের অবতারণা কবির ঐতিহাসিক সংযোজন। স্রষ্টার সৃজন ও পালন প্রসঙ্গ এবং ‘সংসার পালয়ে’র মধ্যে জীবজগতকে খাওয়া পরানোর ‘রবুবিয়াত’ বা ‘পালনবাদ’-এর শিক্ষা ‘মানব সংসার’ পালনের কল্যাণ ধর্ম :
“রজগুণ ধরি প্রভু সংসার সৃজয়ে
স্বত্বগুণ ধরি প্রভু সংসার পালয়ে।” (নবীবংশ)
মহাকবি সৈয়দ সুলতান সম্পর্কে কবি মুহম্মদ খান বলেন :
“ইমাম হোসেন বংশে জন্ম গুণনিধি, / সর্বশাস্ত্রে বিশারদ নবরস ‘দধি’।
শ্যাম নব জলধর সুন্দর শরীর ; / দানে কল্পতরু, পৃথিবী সম স্থির।
পূর্ণ চন্দ্রাধিক মুখ কমল লোচন, / মন মন্দ মধু হাসি মধুর বচন।
শাহ সুলতান পীর কৃপার সাগর / সেবকবৎসল প্রভু গুণে রত্মাকর। (কেয়ামতনামা)
ডক্টর আহমদ শরীফ বলেন : “দান, দয়া ও ভক্ত বাৎসল্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়।”২
এখানে আমরা কবি মুহম্মদ খানের কবিতাংশ বা আহমদ শরীফের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করছি এজন্য যে, ‘দানে কল্পতরু’ ‘কৃপার সাগর’ বা দান, দয়া ও ভক্ত বাৎসল্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয় - এসব কাব্য-কথা এখানে পাচ্ছি। সে যুগে বাংলা কাব্যে কৃপা-অনুগ্রহ বা দানের আনুকূল্যই ছিল মানবিকতার চূড়ান্ত বাস্তবতা। প্রাসঙ্গিক এ কথাটিও সত্য যে, ‘নবীবংশে’র কবি নিজে যেমন ছিলেন মানবিকতার ছবি, তাঁর কাব্য সেই মানবতার উজ্জীবনে অবদানশীল। সে দিনের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ ও সমাজে সাহসী কাব্য যুগান্তকারী সংযোজন। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব মহাকবি সৈয়দ সুলতান।
আহমদ শরীফ বলেন :
“সৈয়দ সুলতান ধর্মের ক্ষেত্রে যুগপুরুষ ও যুগন্ধর। কেননা তাঁর সাহিত্যিক প্রচেষ্টার পেছনে রয়েছে ঐতিহ্য-সচেতন করে মুসলমানদেরকে ধর্মবুদ্ধি দান করার উদ্দেশ্য, যাতে ইবলিসের তথা পাপের পথ পরিহার করে ন্যায় ও সততার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম তার ইহলৌকিক নিরাপত্তা ও পারলৌকিক জীবনে শান্তি সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারে। সৈয়দ সুলতান নীতিধর্মের ধারক, বাহক ও প্রচারক। তাঁর ‘নবীবংশে’র উদ্দিষ্ট তত্ত্ব হচ্ছে : শয়তান অন্যায় ও অপকর্মের প্রতীক তথা দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের উৎস। রিপুরূপেই শয়তান মানুষের জীবনে আবির্ভূত হয়। অতএব, রিপুর উত্তেজনাই শয়তানের প্রভাবের সাক্ষ্য। মানুষের মনুষ্যত্বের অরি হচ্ছে শয়তান তথা EVIL FORCE । এর সঙ্গে অনবরত সংগ্রাম করে জয়ী হওয়া তথা অন্যায় অপকর্ম থেকে বিরত থাকার সাধনাই মনুষ্য সাধনা। এ সংগ্রাম আদম থেকে মুহাম্মদ অবধি কিভাবে সার্থকভাবে পরিচালিত হয়েছে তার ইতিহাসই নবীবংশে বিধৃত।”
...“উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ্য রাখলে স্বীকার করতে হবে যে, ‘নবীবংশ’ নীতিধর্ম প্রচারোদ্দেশ্যেই রচিত। অতএব, পীর, মীর ও সূফী মরমী কবি এই গ্রন্থ রচনা করে তাঁর সামাজিক কর্তব্য ও মুমিনের দায়িত্বই পালন করেছেন।”৩
অধ্যাপক কবি আফজাল চৌধুরী বলেন :
“মুসলিম উচ্চ মার্গীয় চিত্তের এইরূপ উদারতার ফলশ্রুতি যে আপন সমাজের আপামর শ্রেণীর জন্য আত্মস্বাতন্ত্র্য বিস্মৃতির নামান্তর, এই সত্যের মারাত্মক উপলব্ধি প্রথম যে ব্যক্তিকে সে সময়েই প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে, তিনি তরপ রাজ্যের অন্যতম সামন্ত শ্রীহট্ট বিজয়ী বীর নাসিরুদ্দীন সিপাহসালারের (১৩০০-১৪০০ খৃ.) অধঃস্তন পুরুষ সৈয়দ সুলতান ওরফে মিনা (১৫৫০-১৬৪৮ খৃ.)।”৪
গবেষক অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর পর্যবেক্ষণ :
“বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার ভিত্তিতে মধ্যযুগের মুসলমান সমাজে নবজাগরণ ঘটানোর অগ্রদূত ছিলেন তিনি এবং তাঁর লক্ষ্যের প্রতি তিনি যে সর্বাবস্থায় সচেতন ছিলেন, সে ব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই।”৫
বাংলা কাব্যে মানবিকতার ধারাপথে সে যুগের কবিশ্রেষ্ঠ সৈয়দ সুলতান সম্পর্কে উপযুক্ত মূল্যায়নগুলো সামগ্রিকতার প্রয়োজনে উপস্থাপিত হলো। আমরা দারিদ্র্য-পীড়িত সমাজের কাব্যচিত্রের দিকে দৃষ্টি ফিরাচ্ছি। প্রাসঙ্গিক উল্লেখ্য, প্রাচীন মহিলা কবিদের মধ্যে রানী ধোবানী, মাধবী সাসী, চন্দ্রাবতী, আনন্দময়ী, গঙ্গামনি ও রহিমুন্নেছা বিশিষ্ট। চন্দ্রাবতী শীর্ষস্থানীয়া। তাঁর জন্মের সময় সম্ভবত ১৫৫০ খৃ.। তাঁর পিতা দ্বিজ বংশীদাস খ্যাতনামা কবি। চন্দ্রাবতীর শ্রেষ্ঠ কাব্য রামায়ণ :
“দ্বিজ বংশী পুত্র হৈলা
মনসার বরে।
ভাসান গাহিয়া যিনি
বিখ্যাত সংসারে ॥
ঘরে নাই ধান চাল
চালে নাই ছানি।
আকর ভেদিয়া পড়ে
উছিলার পানি ॥
ভাসান গাহিয়া পিতা
বেড়ান নগরে।
চাল কড়ি যাহা পান
আনি দেন ঘরে ॥
বাড়ীতে দারিদ্র জ্বালা
কষ্টের কাহিনী
তার ঘরে জন্ম লৈলা
চন্দ্রা অভাগিনী
সদাই মনসাপদ
পূজে ভক্তি ভরে
চাল কড়ি পান কিছু
মনসার বরে।”
এই দারিদ্র্য মানব রচিত সমাজ-ব্যবস্থার ফল। এখানে প্রতিবাদী চিত্র না থাকলেও বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। সেকালের অভাব-অনটনের করুণ মর্মস্পর্শী ছবি মূর্ত হয়েছে চন্দ্রাবতীর কাব্যে। লক্ষণীয়, এখানে সংগ্রামের কোন চিন্তা নেই, যা আছে, তা দেব-দেবী মাহাত্ম্য-কথা।
শ্রী চৈতন্যের প্রায় সমসাময়িক কবি শঙ্করদেব। তাঁর জীবনকাল ষোড়শ শতকের ষষ্ঠ দশক বলে অনুমিত হয়। কায়স্থ সন্তান, কৃষ্ণ নাম প্রচারে নিবেদিত শূদ্র তথা সমাজের নীচুতলার মানুষের মাঝে। উচ্চবর্ণের বিরোধিতার মধ্যে তাঁর কর্মকাণ্ড, যেহেতু তিনি অনেক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তাঁর কাব্যপংক্তিমালা :
“কৈবর্ত কোলতা কোচ ব্রাহ্মণ সমস্ত
এক লগে খায় দুধ চিড়া ফল যত।”
এখানে একই সমতলের বাসিন্দা সবাই। কবি-ভাবনায় উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ মুছে গেছে।
ষোড়শ সপ্তদশ শতক মুসলিম পুঁথিকারদের পুঁথি সাহিত্যের যুগ। সাধারণ মানুষের কাহিনী নিয়ে কাব্য সৃষ্টি হয়, মানুষের গল্প রচিত হয়। পুঁথি সাহিত্যের যুগ বাংলার নবযুগ হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়।
কবি মরদান তাঁর ‘নছিবনামা’ কাব্য সমাপ্ত করেন ১৬২২-১৬৩৮ খৃ.-এর মধ্যে। শুরুতে তিনি রাজপ্রশংসা করেন :
“বৃহস্পতি সম বুদ্ধি দানে কর্ণসম।
রণে মোহাবির সেজে বিশাল বিক্রম।”
গ্রন্থটির নাম নিয়ে গবেষকদের মতভেদ রয়েছে। কবিদত্ত নামটি কীটদষ্ট হওয়ায় ‘নছিবনামা’ বা ‘নছিবানামা’ বলা হয়। নিয়তির কথাই যেহেতু প্রতিপাদ্য ; সেজন্য ‘নছিবনামা’ বা ‘নসিবনামা’ হওয়াই যৌক্তিক। সে কালের সাহিত্যে অদৃষ্টবাদ গুরুত্বপূর্ণ। ‘নছিবনামা’য় মরদান বলেন :
“দেখ দেখ জার জেই আছে কর্ম্মভোগ
সেই মতে কর্ম্মফলে ভুঞ্জে সুখ দুখ ॥”
অদৃষ্টবাদ শোষক সমাজকে চেনার অন্তরায় এবং এজন্য শ্রেণী-চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। অবশ্য সে সময়কালের বিবেচনায় এমন চিন্তা-ভাবনা পর্যন্ত কবিরা পৌঁছেন নি। কবি মরদান কিন্তু ধনী-গরীবের পার্থক্য, ধনগর্ব ও দারিদ্র্যের লাঞ্ছনা অপমান সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তাঁর কাব্যে ধনগর্বী আবদুন নবী অতীতের বন্ধু গরীব আবদুল করিমকে অবাঞ্ছিত দুর্ব্যবহার করে। আবদুল করিমের পোশাক সম্পর্কে কবি বলেন :
‘‘মৈলান বসন পরি ভাঙ্গা টুপি শিরে
ভাঙ্গা ছাতি তুলে লইয়া কান্দের উপরে ॥
লটিগুটি লই হাতে জাএ ধীরে ধীরে।
প্রবেসিলা আবদুন নবী সাদুর ঘরে ॥
ছেলাময়ালেক দিয়া নিকটেত গিয়া।
খাটের নিকটে গিয়া রহিল বসিয়া ॥”
অপমান ভৎসনায় ধনী বন্ধু তাকে লাঞ্ছিত করে। এর সাথে যোগ দেয় তার পারিষদরা :
“চারিভিতে বসিয়াছে সাধু সদাগর
তা সবাএ গঞ্জিবারে লাগিয়া বিস্তর ॥
আরে রে বর্ব্বর সাধু নিরবুধিতো চিত
সাধু বেহাইয়ালা করে তোহার সহিত ॥”
ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান, অবাঞ্ছিত বিভেদের সম্পর্ক এবং গরীবের পোশাক-আশাক ও অপমানের এক করুণ তথ্যচিত্র মরদানের এ লেখা। মধ্যযুগে এমন কাব্যের অভাব।
মহাকবি আলাওলের রচনায় রাজ-অমাত্য মাগন ঠাকুর বা কোরেশী মাগন সম্পর্কে উচ্চ ধারণা উপস্থাপিত হয়েছে। ধনে, মানে, জ্ঞানে ও যশে রোসাঙ্গ রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পুরুষ তিনি। মহৎ ও উদারচেতা এই কবি সম্পর্কে আলাওলের কাব্য পংক্তিমালা :
‘‘নৃপক্রোধে যত লোক হয় ছত্রাকার
তাহান স্মরণে আসি হয়েন্ত উদ্ধার।
ওলামা সৈয়দ শেখ যত পরবাসী।
পোষন্ত আদর করি মনে স্নেহ বাসি ॥
কাহাকে খতিব, কাকে করন্ত ইমাম
নানাবিধ দানে সবে পুরে মনস্কাম ॥’’ (পদ্মাবতী)
এতে মাগন ঠাকুর বা কোরেশী মাগনের মানবিক শ্রেষ্ঠত্বের দিকটি উদ্ভাসিত হয়েছে। মানুষের কল্যাণে তাঁর ভূমিকা, বিশেষ করে রাজ-অমাত্যের অবস্থান থেকে সাহায্য সহযোগিতার কথা শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে :
“অনেক আদর করি বহুল সম্মানে।
সতত পোষন্ত মোরে অন্ন বস্ত্র দানে।” (পদ্মাবতী)
অকৃপণ দানবীর পরোপকারী কোরেশী মাগন :
“দানকালে শত্রুমিত্র এক নাহি চিন
সকলকে দেয়ন্ত আপনা কিম্বা ভিন।
...
ধর্মভাব সদাচার মধুর আলাপ
না জানন্তে কৃপণতা অধর্ম্মিতা পাপ।
...
পর উপকারী অতি দয়াল হৃদয়
হিংসা করি না করেন্ত লোক অপচয়।
মহাজ্ঞানী মহাদানী মহাসাহসিক
অহিংসুক আত্মশূন্য মর্যাদা অধিক।” (পদ্মাবতী)
গবেষক দেওয়ান মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী কোরেশী মাগনের চন্দ্রাবতীতে মাওলানা রুমীর মসনবীর তাওহীদী সুর সম্পর্কে বলেন :
“সূফী-সম্রাট মাওলানা রুমীর মসনবীর মূল সূর একত্ববাদের প্রকাশ চন্দ্রাবতীতে বিদ্যমান। বাংলা সাহিত্যে রূপক রচনা - তাও আবার দেশীয় উপকরণের মাধ্যমে মৌলিক রচনা - মাগনের মত বিরল প্রতিভা মহাজ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভবপর হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে রূপক রচনার পথিকৃৎও কোরেশী মাগন। রূপক রচনার মাধ্যমে তাসাউফ প্রচার মাগনের এই মননধারা অনুসরণে দৌলত কাজী, মোহাম্মদ সগীর, আলাওল প্রমুখ কবি বিদেশী ভাষায় রচিত রূপক কাব্যের অনুবাদ শুরু করেন। তাঁদের অনেকেই অনুবাদ বিশেষ করে দৌলত কাজী, মোহাম্মদ সগীর ও আলাওলের অনুবাদ মৌলিক রচনার কৃতিত্বের দাবীদার।’’৬
মহাকবি আলাওলের রচনায় কোরেশী মাগন সম্পর্কে আমরা যে স্বচ্ছ ধারণা পাই, তা হলো, তিনি এক মহান মানবতাবাদী। মানুষকে মানবীয় মর্যাদা সম্মান দানে এবং তার হিত সাধনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে কোরেশী মাগনের একত্ববাদী চেতনা-বিধৃত যে কাব্য প্রসঙ্গ, তাসাউফ প্রচারের চিন্তাধারার যে মূল্যায়ন এসেছে আমরা দেখবো, তা কোন ক্রমেই মানবিকতার প্রতিচ্ছবি একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক তো নয়ই, বরং পূর্ণাঙ্গ সাযুজ্যপূর্ণ। একজন খোদাপ্রেমিক যে মানবপ্রেমিক হবেন, তা সকল বিতর্কের ঊর্দ্ধে। এ আলোচনার এক পর্যায়ে আমরা সে বিশ্লেষণে পৌঁছতে পারি। কারণ মানবিক চেতনা নয়, কট্টর শ্রেণী-চেতনার বিশেষ কোন দর্শন আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার করার দিকে অগ্রসর হবে এবং মানব মুক্তিতে (আর্থ-সামাজিক) একে অপ্রাসঙ্গিক, অবান্তর বা চূড়ান্ত বিশ্লেষণে প্রতিবন্ধক ভাববে। আমাদের দৃষ্টিকোণ স্বচ্ছ, স্রষ্টার পালনবাদে যাঁরা বিশ্বাসী ও সেভাবে জীবন পরিচালনায় অভ্যস্ত, তাঁরা কখনো মানব কল্যাণের বিপরীতে দাঁড়াতে পারেন না, বরং তাঁদের দ্বারাই মানব মস্তিষ্ক প্রসূত সংঘাতের মতাদর্শের বিচ্যুতি-মুক্ত অনন্য ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়ে উঠতে পারে। পূর্বশর্ত একটিই, বর্তমান শোষণ-সর্বস্ব নির্যাতনবাদী সমাজটিকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়তে হবে ; কিন্তু আলোচনায় আমরা বাংলা কাব্যের তেমন সংঘাত-ক্ষেত্রে এখনো পৌঁছি নি। এখনো আমাদের প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে শুধু নিছক কল্যাণের বাণী, সেটি শ্রেণী-চিন্তা তথা সংগ্রামের নয়, ভাঙনের তো নয়ই।
বিশিষ্ট কবি শাহ মোহাম্মদ সগীরের বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক কবি তিনি। তাঁর আবির্ভাব ও রচনাকাল সম্পর্কে গুণীজনের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাঁর সৃষ্টিকাল চতুর্দশ শতকের শেষ থেকে ষোড়শ শতকের শেষ পর্যন্ত প্রায় দু’ শতকের দীর্ঘ সময় পরিসরে ভিন্ন-ভিন্ন গবেষকের গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে। যা হোক, আমরা তাঁর কাব্যে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক ও প্রজাসাধারণের প্রতি রাজার পালন-নীতি লক্ষ্য করবো। ড. মুহম্মদ এনামুল হক উপস্থাপিত তাঁর কাব্য-পাঠ এ রকম : “করুণা হৃদয় রাজা পুণ্যবন্ত তর
সব গুণে অসীম অতুল মনোহর।
ভকতবৎসল নৃপ বিপক্ষ বিনাশ
প্রজার পালন কঁরে সেহ্ন হাবিলাস।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ থেকে :
“বলি কর্ম্ম ময়দানে নৃপ সুচরিত
তাহান তুলনা রাজা নাহি পৃথিবীত ॥
লোকেতঃ ভকতবর বিনএ বেভার
হিন জন প্রতি য়তি সদয় অপার ॥
পাত্র মিত্র পুত্রতুল্য করন্ত পালন।
জার জেই শ্রদ্ধাএ সন্তোস করে মন ॥
করুণা হৃদএ রাজা পুণ্য ততপর
সর্ব্বগুণে অসীম অতুল মনোহর ॥
...
ভকতবৎসল নৃপ বিপৈক্ষ বিনাস
প্রজার পালন করে জেহ্ন হভিলাস।’’
এ কাব্যের মানবিকতা ও মানুষের অধিকার প্রসঙ্গকে সে কালের প্রেক্ষিতেই মূল্যায়ন করতে হবে। রাজা-প্রজার যুগ ; শাসক-শাসিতের মধুর বা তিক্ত সম্পর্কের কথা আসবে। সে সময় শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি রাজ-আনুকূল্যের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল বলে প্রজাবৎসল রাজাই কাম্য ছিল একজন মানবতাবাদী কবির। এ দৃষ্টিকোণেই সে কাব্যের আবেদন বিচার করতে হবে, সংগ্রামের নিরিখে নয়। সেজন্য ‘করুণা হৃদয় রাজা’, ‘ভকতবৎসল নৃপ’ ‘প্রজার পালন’ ‘হিন জন প্রতি য়তি সদয় অপার’ ‘পাত্রমিত্র পুত্রতুল্য করন্ত পালন’ ‘করুণা হৃদএ রাজা’ - এ সবই আমাদের খুঁজতে হবে। কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর শাসিত জনসাধারণের প্রতি একজন শাসকের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করে মানবতার জয়গানই গেয়েছেন, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এবং উত্তরকালের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের ফল-ফসলের চিত্র কবির কাব্যে চমৎকার রূপ নিয়েছে। ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যের ‘বারমাসী’তে ফসল-কথা :
“আম জাম শুফলিত তরু সব শুললিত
দুলিত লম্বিত ফল ভরে।
...
অঘ্রাণ আইল রিত নব সালি সমুদিত
শুগন্দি সৌরব জাএ দূর
সারি একে করে রোল নানা বর্ণ ধান্য ফুল
বিকসিত সব ক্ষিতিপুর।
ঘরে ঘরে ধান্যরাসি নব পষুগণ হাসি
গগন রূচিত পরকাশ
রাজা-প্রজা উল্লাসিত প্রবাস বাঞ্চিত রিত
মোর লৈক্ষে জেন বসবাস।”
‘ধর্মমঙ্গলে’র কবি রামদাস আদক। তিনি কৈবর্ত। তাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৬৬২ খৃ.। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, পৌষের কিস্তি দিতে না পারায় জমিদারের কর্মচারী তাঁকে আটক করে। কোনভাবে মুক্তি পেয়ে মামার বাড়িতে পলায়ন করেন তিনি। পথে সিপাহী আসছে দেখে ভয়ে প্রাণ উড়ে যায় :
“দেশে খাজনার তরে পলাইয়া যাই
বিদেশে বেগারী বুঝি ধরিল সেপাই!”
এ চিত্র শোষিত গণমানুষের।
সপ্তদশ শতকের অন্যতম কবি হৃদয়ানন্দ - ষষ্ঠীবর দত্ত।
তাঁর কাব্য ভাষায় হতদরিদ্র জীবনের কথা :
“অগ্রহায়ণ মাসেতে মাও সকল ঘরে ধান
মোর ঘরে মা নাই যে কিছু রাখিবারে প্রাণ ॥
পৌষ না মাসেতে প্রতি ঘরে পিঠা-চিড়া
সব ছাওয়াল আনন্দে নাচে আমার কপাল পুড়া ॥
মাঘ না মাসেতে শীতে অধৈর্য সকল
সর্ব লোকের আছে বস্ত্র আমার যে বাকল ॥ (দুর্গার বারমাসী)
কবি জয়নুদ্দীনের কাব্যে দানের মাহাত্ম্য ঘোষিত :
“দানে ধর্ম্ম হরিশচন্দ্র মান্য গুরু সম ইন্দ্র
রাজরত্ন মহিমা প্রধান।
শ্রীযুত ইছুপ খান আরতি কারণ জান
বিরচিলুম পাঞ্চলী সন্ধান ॥’’
কবি দৌলত কাজীও রোসাঙ্গ রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত। তাঁর কাব্যেও অদৃষ্টবাদ রয়েছে :
‘‘যাহার নিবন্ধ যেই না যাএ খণ্ডন।’’
দৌলত কাজী তাঁর কাব্যের শুরুতে রোসাঙ্গরাজ শ্রী সুধর্ম্মা ও তাঁর লস্কর উজির আশরাফ খাঁর প্রশংসা করেন :
‘‘প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভূবন।
পুত্রের সমান করে প্রজার পালন ॥
পুণ্যফলে দেখে যদি রাজার বদন।
পারকিথ স্বর্গপাত্র সাফল্য জীবন।’’
দৌলত কাজী সুধর্ম্মার রাজত্বকালে (১৬২২-১৬৩৮ খৃ.) আশরাফ খানের আদেশে ‘সতী ময়না’ লিখতে শুরু করেন। ১৬৪০-এর পর তাঁর জীবিত থাকার তথ্য নেই। ‘লোর চন্দ্রানী ও সতী ময়না’র গল্পে স্বামী পরিত্যক্তা ময়নামতীকে মালিনী বোঝায় :
‘‘ধন নষ্ট হৈলে পুনি উপার্জ্জনে পাএ
অগ্নি শেষ হৈলে পুনি পাথরে জন্মাএ।
চন্দ্র সূর্য অস্ত গেলে পুনি উগি যাএ
যৌবন চলিয়া গেলে পলটি ন পাএ ॥’’
ধন উপার্জনের ব্যাপার। অগ্নি জ্বলবে, সূর্য চন্দ্র আবার আসবে। কিন্তু যৌবন ফিরে না। এখানে উত্তরাধিকারের সম্পদ নয়, অর্জনের সম্পদের কথা বলা হয়েছে। কবির মূল উদ্দেশ্য যৌবন হলেও সম্পদ উপার্জনের প্রসঙ্গ এসেছে এবং সে সূত্রে শ্রমের বিষয়টি অনুচ্চারিত হলেও ভাবনায় আসে।
দৌলত কাজীর কাব্যকথা :
“অনুমতি দেও মোকে সেবক বৎসল।” (সতীময়না)
“মসজিদ পুষ্কর্ণী দিলা বহুল বিধান
নানা দেশে গেল তান প্রতিষ্ঠা বাখান।” (ঐ)
“লোকেরে সাদর করি পালিবা অবশ্য।” (ঐ)
“কিরানর দুঃখ করি দেও দূর।” (রংগমালা, সিলেট গীতিকা)
দ্রষ্টব্য ‘সেবকবৎসল’, ‘মসজিদ পুষ্কর্ণী দিলা’, ‘লোকেরে সাদর করি পালিবা অবশ্য’, ‘কিরানর দুঃখ করি দেও দূর’ - এগুলো মানবিক সহমর্মিতা, সমাজসেবা, জনগণের অধিকার দান ও নিম্নশ্রেণীর প্রতি মানবিক কর্তব্যের কথা ও আহবানবিধৃত কাব্যপংক্তি।
রোসাঙ্গ রাজসভার জনৈক অমাত্যের অনুরোধে ফার্সী ‘দুলাক্ক মজলিস’ বাংলা কাব্যানুবাদ করেন কবি আবদুল করিম খোন্দকার। তাঁর কাব্যে :
“বড় বড় মোছলমান তথাত নিবাস
নৃপ সঙ্গে কহে কথা করি পরিহাস ॥
দরিদ্র দুঃখিত যদি আইসে দুয়ারে
সুন হস্তে কেহ ন ফিরাএ পুনর্বারে ॥’’
নৃপতি ‘দরিদ্র দুঃখিত’কে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন না, দেবেন না - এ বাণী বহন করছে এ পংক্তিমালা।
(চলবে)
তথ্যসূত্র
১. গোপাল হালদার, বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা, প্রথম খণ্ড [প্রাচীন ও মধ্যযুগ], মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৭৪ ইং, পৃ. ১২০-১২১।
২. আহমদ শরীফ, সৈয়দ সুলতান : তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ, পৃ. ৫৮।
৩. আহমদ শরীফ, সৈয়দ সুলতান : তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম সং, নভেম্বর ১৯৭২, পৃ. ২০০।
৪. আফজাল চৌধুরী, আমাদের স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্যচিন্তা এবং রসূল প্রশস্তি, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৭৯, পৃ. ১০।
৫. মুহম্মদ আসাদ্দর আলী, মহাকবি সৈয়দ সুলতান, মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, সুলতানশী হাভেলী, হবিগঞ্জ, অক্টোবর ১৯৯০, পৃ. ২৯।
৬. দেওয়ান মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ কোরেশী মাগন, বন্ধন প্রকাশনী, ফেব্র“য়ারী ১৯৯১, পৃ. ৪৯।
(জ্যোতি বর্ষ ১ সংখ্যা ৩)