বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য – ২য় পর্ব
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য – ২য় পর্ব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এক
‘বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য’ প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিত-পরিবেশ সন্ধানে আমরা দু’টি বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি দিতে পারি। প্রথমত বাংলা ভাষী অঞ্চলে ইসলামের আগমন। এটি নীতি-দর্শনের দিক। দ্বিতীয়ত মুসলিম বিজয় এবং প্রশাসনে আংশিক হলেও ইসলামী জীবন-দর্শনের প্রতিফলন। স্বীকার্য যে, মুসলমানরা পৃথিবীর যেখানেই গেছে, তা ধর্ম প্রচারের জন্য হোক বা কোন অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে হোক, মানবাধিকার ও সাম্যের আদর্শকে তারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে-যথাসম্ভব বাস্তবায়িত করেছে। পবিত্র কোরআনে যেখানে ‘লাকাদ কার্রামনা বানী আদামা’ ঘোষিত (খোদ স্রষ্টা মানুষের মর্যাদার কথা বলেছেন), যেখানে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে মানবতা, মানবাধিকার ও সাম্য সর্বোচ্চ মর্যাদা পেয়েছে, যেখানে প্রশাসনিক ছায়া না থাকলেও ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মানবাধিকার রক্ষা ও সাম্যভিত্তিক চিন্তা-চেতনার অনুসৃতি অবশ্য কর্তব্য; সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের বিস্তৃতি ও মুসলিম সমাজ গঠনের চলমান প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার ও সাম্য লালিত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক কোন সংকীর্ণ মানবীয় চিন্তা-প্রসূত কৃত্রিম ভেদরেখা ও বিভাজন ইসলামের অগ্রযাত্রাকে আড়ষ্ট বা স্থবির করতে পারে নি। মুসলিম জীবনের মানবাধিকার ও সাম্যনীতি প্রশাসনিকভাবে হলে তো সোনায় সোহাগা, এর অনুপস্থিতি ঘটলেও এ নীতির সুফল যেমন পেয়েছে মুসলিম সমাজ, তেমনি অমুসলিমরাও এ থেকে উপকৃত হয়েছে। তারা ইসলামের প্রশাসনিক ছায়ায় তাদের অধিকার ভোগ করতে পেরেছে স্বচ্ছন্দে। মানবাধিকার ও সাম্যের এই অনুপম আদর্শে তাদের চিন্তাধারা প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে এবং অনুপম হৃদ্যতার সম্পর্কের চিন্তা-সৌধ পুনঃনির্মাণ করেছে তারা।
খ্রিস্টীয় তেরো শতকের সূচনায় বঙ্গে মুসলিম বিজয় ঘটে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে। বর্ণাশ্রম সমাজ ব্যবস্থায় তখন বাংলার জনজীবনে প্রচণ্ড বৈষম্য। ধর্মীয় কোন গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্বের আত্মাভিমান বা সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ধনিক-বণিকের আর্থ-সামাজিক বনেদিয়ানা ইসলাম সমর্থন করে না বলে এর অনুসারীরা নীতিগতভাবেই এর বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন।
শুধু সমর্থন বা বিরূপতার মানদণ্ডেই এটি বিচার্য নয় এ জন্য যে, ইসলাম নীতিগতভাবে যেমন মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের আহবান জানিয়েছে, কঠোর ভাষায় মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির যে কোন মানসিকতা পরিহারের বিধান জারি করেছে; তেমনি এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য কর্ম-প্রচেষ্টাকে সর্বজীবনের অবশ্য কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। পাশাপাশি মানব সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের নীতিগত এই অবস্থান থেকে সংগ্রামে অংশ গ্রহণ না করাকে ধর্ম-বিবর্জিত জীবনরূপে চিহ্নিত করেছে-ইহকালীন লাঞ্ছনা ও পরকালীন শাস্তির সাবধান-বাণীও উচ্চারণ করেছে। এ জন্য বিশ্বের ধর্মীয়-ইতিহাসে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা কালের সংগ্রাম ও এর আন্তরিক আহবানের আবেদন ব্যতিক্রমী, একক। সম্পূর্ণত মানবিক এই অবলম্বনীয় জীবন-বিধান মানুষকে উপহার দিয়েছে মানবীয় অখণ্ড পরিচয়ের সর্বোচ্চ যোগসূত্র আদি পিতা আদম (আ.)।
এমনি একক জীবন-ব্যবস্থার আগমন স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ও বঙ্গদেশ অঞ্চলে জীবনের ন্যূনতম অধিকার-বঞ্চিত, শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের জীবনে প্রত্যাশার নতুন সুপ্রভাত নিয়েই আবির্ভূত হয়, অভিনন্দিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় মুসলিম শাসক ও মুসলিম জনগণের জীবনে ইসলামের মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ ও প্রতিফলন প্রতিবেশী সমাজের অনেকের কাছে অনুসরণীয় মহান আদর্শ রূপেই প্রতিভাত হয়। ইতিহাসের বাস্তবতা, এ দেশের মানুষের সামাজিক স্তর নির্বিশেষে, বিশেষ করে নিম্নবর্ণের অপাংক্তেয় গণমানুষের কাছে ভ্রাতৃত্ব ও আপনবোধের মহিমা অপার্থিব সুবাস ছড়ায়, তারা ভীড় জমায় এর আঙিনায়। এ ক্ষেত্রে কতিপয় নিরপেক্ষ উদ্ধৃতি পেশযোগ্য :
“ব্রাহ্মণ শাসকদের দ্বারা নিপীড়িত জাঠ ও অন্যান্য কৃষিজীবীদের সক্রিয় সহযোগিতায় মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করলেন। আর তারপরেই তিনি অনুসরণ করলেন প্রথম আরব বিজেতাদের রাজ্যশাসন পদ্ধতি।”
এ বক্তব্যের সাথে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি এসেছে Iliot এর History of India থেকে :
“তিনি ব্রাহ্মণদের উপর করলেন বিশ্বাস স্থাপন, আর দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার ভার দিলেন তাদেরই উপরে, তাদেরই দিলেন তাদের মন্দিরাদি মেরামতের অবাধ স্বাধীনতা আর আগের মতোই আপনার ধর্ম-চর্চা করার পূর্ণ অধিকার, রাজস্ব সংগ্রহের ভার রইল তাদেরই হাতে আর স্থানীয় আদিম শাসন পদ্ধতি চালিয়ে যাবার জন্য তাদেরই করলেন নিযুক্ত।”
এসেছে হ্যাভেল সাহেবের অৎুধহ Aryan Rule in India -এর উদ্ধৃতি :
এমনকি ভয়ঙ্কর রকমের উগ্র মুসলিম বিরোধী হ্যাভেল সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করেছেন :
...“শূদ্রকে এ দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার... মোটের উপর এরই ফলে গড়ে উঠলো বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা।”১
সুতরাং এ সব ঐতিহাসিক মূল্যায়ন থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিজিত অঞ্চলে দু’টি ধারায় মানবিকতার লালন ও বিকাশ ঘটেছে। প্রথমত সম্প্রদায়গত ভাবে তথা সম্প্রদায় নির্বিশেষে অভিন্ন মানবিক সম্পর্ক স্থাপনে। দ্বিতীয়ত আর্থ-সামাজিক স্তরগতভাবে তথা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে অভিন্ন মানবিকতার প্রতিষ্ঠায়। প্রথম ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের ‘তাদের মন্দিরাদি মেরামতের অবাধ স্বাধীনতা আর আগের মতোই আপনার ধর্মচর্চা করার পূর্ণ অধিকার’ ইসলামের এবং মুসলমানদের সম্প্রদায়গত সহনশীলতার উজ্জ্বল উদাহরণ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘নিপীড়িত জাঠ ও অন্যান্য কৃষিজীবীদের’ বা ‘শূদ্রে’র পাওয়া ‘মুক্ত মানুষের অধিকার’ও সেই ইসলামী ভেদ-বৈষম্যমুক্ত ভ্রাতৃসমাজ প্রতিষ্ঠার মর্মবাণী ও ইসলামের ইতিহাসে দেশে দেশে এর বাস্তবায়নের ঐতিহ্যের সাথে পূর্ণাঙ্গ সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভারতবর্ষে এ চেতনা নতুন ; মানবাধিকার ও সাম্যের এ চিন্তাধারা বৈপ্লবিক। এ জন্য কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার অন্যতম তাত্ত্বিক কমরেড এম. এন. রায়ও হ্যাভেল সাহেবের অনীহ কিন্তু সত্য উচ্চারণের সাথে সুর মিলিয়ে (এম. এন. রায় বলেছেন, ‘হ্যাভেল সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হয়েছেন’) “এরই ফলে গড়ে উঠলো বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা।”
ভারতবর্ষীয় প্রেক্ষিত থেকে এগিয়ে আমরা বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রতি দৃষ্টি দিতে পারি। মুসলিম বিজয় এখানে আশীর্বাদস্বরূপ বিবেচিত হয়েছে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা পৃথিবীতে বিজয়ী অনেক শাসকের দ্বারা সংঘটিত হলেও মুসলিম বিজেতা ও শাসকদের ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন-ভ্রাতৃত্বসুলভ, মানবিক। উদারতা ও সহনশীলতা যাদের মর্মে গাঁথা, যাদের জীবন-বিধান কোরআন ‘তাদের দেবতাকে গালি দিও না’ বলে অনুসারীদের সাবধান করে দেয়, তারা পৃথিবীর যেখানেই গেছে, ধর্মের এই মানবিক আহবানকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে মানবিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন রচনা করেছে অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের সাথে ; এ অঞ্চলের অনুসৃতিও এ থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না।
স্টুয়ার্ট বলেন,
“অধিকাংশ আফগানই তাঁহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুদের হাতে ছাড়িয়া দিতেন।... এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্তই ধনশালী হিন্দুরা পাইতেন এবং ইহারাই ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন।”২
ড. সুকুমার সেন বলেন,
“রাজ্যশাসনে ও রাজস্ব ব্যবস্থায় এমনকি সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।”
স্টুয়ার্ট ও ড. সুকুমার সেনের বর্ণনা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে, কৌশলগত কারণে কারো কারো কাছে ক্ষেত্র বিশেষে অবাঞ্ছিত ঠেকলেও মুসলিম শাসকরা উদার নীতি অবলম্বন করেছেন, ধর্মানুসরণ নির্বিশেষে অন্যদের সুযোগ-সুবিধা অবারিত রেখেছেন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হিন্দুদের যথাযোগ্য নিয়োগ দান করেছেন এবং সহযোগিতা নিয়েছেন। এর চেয়ে সুন্দর মানবতার উদাহরণ ইতিহাসে পাওয়া কঠিন। যদি উজ্জ্বলতর কোন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য না পাওয়াই যায়, তবে আমরা ‘কঠিন’ শব্দের স্থলে ‘অসম্ভব’ই বলছি। আমাদের প্রত্যয়ে ‘অসম্ভব’টাই বাস্তবতা।
এ প্রসঙ্গে আরো দু’টি মূল্যায়ন :
“বাঙ্গালা দেশে পাঠান প্রাবল্যের যুগ এক বিষয়ে বাঙ্গলার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয়, হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশের সভ্যতার যে শ্রী ফুটিয়াছিল, এই পরাধীন যুগে সেই শ্রী শত গুণে বাড়িয়া গিয়াছিল।”
...
“এই পাঠান-প্রাধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল, এই স্বাধীনতার ফলে বাঙ্গলার প্রতিভার যে রূপ অদ্ভুত বিকাশ পাইয়াছিল, এ দেশের ইতিহাসে অন্য কোন সময়ে তদ্রƒপ বিকাশ সচরাচর দেখা যায় নাই।”৩
মানুষের মাহাত্ম্য, মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনবোধ সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়। ইতোপূর্বে সাহিত্যে দেব-দেবীর লীলা ছাড়া মানবীয় জীবনচিত্র পাওয়া ছিল সুকঠিন। উপর্যুক্ত প্রেক্ষিত-পরিবেশে মুসলিম বিজয়োত্তর বাংলাদেশে সাহিত্যকর্ম লাভ করে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য, প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা। বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়, সাহিত্য পায় নবতর দিক এবং গতি। মানুষের জীবন হয় সাহিত্যের প্রতিপাদ্য। আমরা সেদিনের অবস্থানকে মানবাধিকার ও সাম্যের ‘সূচক বিজয়’ মনে করতে পারি। মানব জীবন যখন সাহিত্যের অবলম্বন হয়েছে, তার সুখ-দুঃখ যখন বিবেচনায় এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই এর গতিপথে এ বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। কমরেড মানবেন্দ্র নাথ রায় থেকে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন পর্যন্ত সবারই সাক্ষয মানবতার এই কাল ও পরিবেশ-প্রেক্ষিতকে অবলম্বনে উজ্জ্বলতর সম্ভাবনার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে-ইতিহাস পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে প্রশংসামুখর সাক্ষয।
আলোচ্য বিষয়ে আগের সংখ্যায় আমরা কিছু দূর অগ্রসর হয়েছিলাম। আলোচনা পরবর্তীতে ও অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এ সংখ্যায় উৎসের প্রেক্ষিত সংযোজন প্রয়োজন বিবেচনায় সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো। এ দিকটি প্রিয় পাঠকের স্মরণে থাকলে সহায়ক হবে।
দুই
‘মানবাধিকার ও সাম্য’ প্রসঙ্গে আলোচনায় আমরা ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ মর্মান্তিক কারবালার ঘটনার প্রতি দৃষ্টি দেব। খিলাফত ধ্বংসের সেই অশুভ চক্রান্ত ও ধ্বংসকাণ্ডের সাথে মানব জাতির পরবর্তী ইতিহাসের গতিধারা সংশ্লিষ্ট। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রতিষ্ঠিত খিলাফত ছিল মানবাধিকার ও সাম্যের সর্বোচ্চ রক্ষা কবচ। ইতিহাসকে যে ভাবেই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, ইসলামের স্বর্ণযুগে মানবীয় মর্যাদার সর্বোচ্চ বিকাশ ও আর্থ-সামাজিক স্তর-বঞ্চনামুক্ত অভেদ সাম্য প্রতিষ্ঠার সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। আদৌ কারো কোন বিরূপ বক্তব্য থাকলে তা হবে নিছক অজ্ঞতাপ্রসূত বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ; যদি ‘বিদ্বেষ-প্রসূত’ শব্দটি ব্যবহার না-ও করা হয়।
সুতরাং বাংলা সাহিত্যে যে কবিরা কারবালার মহান শহীদানের কথা, বিশেষ করে রাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে অসম জিহাদে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত লাভের বিষয় অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছেন, তাঁরা শুধু সেই অনন্ত বিষাদের কথাই বাক্যময় করেন নি ; ব্যক্ত বা অব্যক্ত ভাষায় মানবাধিকার ও সাম্যের চিরন্তন সংগ্রামের আহবানই জানিয়েছেন।
“মুহম্মদ খান আমাদের সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় নাম। তিনি প্রখ্যাত ‘মক্তুল হোসেন’ তথা ‘হোসেন বধ’ কাব্যের রচয়িতা।”
...
“বাঙলায় মক্তুল হোসেন বা জঙ্গনামা কিংবা শহীদ-ই-কারবালার আদি কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (ষোল শতক), দ্বিতীয় কবি মীর বা শেখ ফয়জুলল্লাহর(ষোল শতক) রচিত চৌতিশায় যয়নাবের বিলাপ পাওয়া গেছে। তৃতীয় কবি আমাদের আলোচ্য মুহম্মদ খান। এর পরে যাঁরা জঙ্গনামা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে হায়াত মাহমুদ, জাফর, জিন্নত আলী, আলী মুহম্মদ, আবদুল ওহাব, হামিদুলল্লাহ খান, ফকির গরীবুলল্লাহ, ইয়াকুব, সাদ আলী, রাধাচরণ গোপ, মুনশী মুহম্মদ জনাব আলী ও আবদুল হামিদের নাম উল্লেখযোগ্য।”৪
দৌলত উজির বাহরাম খান তাঁর বংশ পরিচয় প্রসঙ্গে গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহ্র কথাও বলেন :
“পূর্ব্বকালে নরপতি ভুবন-বিখ্যাত অতি
আছিল হোসেন শাহ-বর।
তাঁর রত্ম-সিংহাসন মায়াময় বিলক্ষণ
গৌড়েতে শোভিত মনোহর ॥
প্রধান উজির তান নাম মোহাম্মদ খান
তাঁহার গুণের অন্ত নাই।
অন্নশালা স্থানে স্থানে মসজিদ সুনির্ম্মাণে
পুষ্করিণী দিল ঠাঁই ঠাঁই।”
হোসেন শাহ-এর পুত্র নসরত শাহ ষোল শতকে চট্টগ্রাম আবার জয় করেন। বাহরাম খানের কাব্য-কথা :
“আদেশিলা গৌড়েশ্বরে উজির হামিদ খাঁ-রে
অধিকারী হৈল চট্টগ্রাম
আদ্যরূপ দান ধর্ম্ম করিলা পুণ্যের কর্ম্ম
আনন্দে রহিলা সেই ধাম।”
এখানে “অন্নশালা স্থানে স্থানে/মসজিদ সুনির্ম্মাণে/ পুষ্করিণী দিল ঠাঁই ঠাঁই” এবং “আদ্যরূপ দান ধর্ম্ম/করিলা পুণ্যের কর্ম্ম/ আনন্দে রহিলা সেই ধাম”-শাসকের কর্তব্যের কথা, ধর্মীয় মানবিক দায়িত্বের কথা উচ্চারিত হয়েছে। এ সব সাম্যের কোন ঈপ্সিত চিত্র নয়, দয়া-দাক্ষিণ্য আনুকূল্যের কথা। সে সময়ে সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য সংগ্রামী চেহারায় আবির্ভূত হয় নি। তবে মানবিকতার বিকাশের এ পথযাত্রাকে আমরা ইতিবাচক বিবেচনা করি।
হোসেন শাহের অন্যতম অমাত্য হামিদ খানের বংশে কবি বাহরাম খানের জন্ম, ‘দৌলত উজির’ তাঁর রাজকীয় খেতাব। অনুমিত হয়, কবি বাহরাম খান ১৫৪৫ থেকে ১৫৭৬ সনের মধ্যে তাঁর কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য ‘লায়লী মজনু’ রচনা করেন। কাব্য বিচারে ভিন্ন মতে, কালের হিসাবে তাঁর পিতা মোবারক খান হোসেন শাহ-এর কয়েক প্রজন্ম পরের। ইরানের বিশ্ববিখ্যাত কবি মাওলানা আবদুর রহমান জামীর ‘লায়লী মজনু’ নামক কালজয়ী প্রেমকাব্য অবলম্বনে বাঙলার পরিবেশে ‘লায়লী মজনুঁ’ রচনা করেন। জৈবিক প্রেমের আধ্যাত্মিক উত্তরণের কথা বিয়োগান্তক এ কাহিনীতে উপস্থাপিত।
কবি শেখ ফয়জুলল্লাহর ‘জয়নবের চৌতিশা’ করুণ রসাত্মক কাব্য। ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাতে তাঁর বোন জয়নবের শোক বর্ণিত এ গ্রন্থ। বলা বাহুল্য, ইমাম হাসান (আ.)-এর এ শাহাদাত ছিল ইমাম আলী (আ.)-এর মানব কল্যাণে শাহাদাতের উত্তরাধিকারের অবিচ্ছিন্ন ধারা ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পূর্বসূরি। সব ক্ষেত্রেই মানবাধিকার ও সাম্য রক্ষার ইসলামী নীতি সংরক্ষণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
জয়নবের চৌতিশায় কবির ভণিতা :
“শেক ফয়জুল্লা কহে জয়নব কথন।
স্বর্গে কান্দে হুরপরি কান্দে সখীগণ ॥
শুন সংসারের লোক শুন মুসলমান
শোকে আকুলিত বিবি হাছন কারণ ॥”
‘জয়নবের চৌতিশা’ চৌত্রিশ স্তবক বিশিষ্ট। ‘ক’ অক্ষর দ্বারা সূচিত স্তবক :
“কান্দে বিবি জয়নবে যে হাছনের শোকে।
কালিনী-সমুদ্র মাঝে ডুবাইল মোকে ॥
কোকিলা কুহরে যেন বসন্ত সমএ।
কুলিম আঁখির জলধারা রূপে বএ ॥”
আমরা বিগত সংখ্যার আলোচনায় মহাকবি সৈয়দ সুলতান প্রসঙ্গে তাঁর প্রিয়ভাজন মুরীদ কবি মুহম্মদ খানের কাব্যোদ্ধৃতি পেশ করেছি। এখানে কবি মুহম্মদ খান প্রসঙ্গ। তাঁর রচনা ‘মক্তুল হোসেন’ তথা ‘হোসেন বধ’ কাব্য। ‘সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ’ও তাঁর নীতি-শিক্ষামূলক রূপক কাব্য। তিনিও পীর ছিলেন বলে জানা যায়। আঠারো-ঊনিশ শতকের কবি মুহম্মদ চুহর কবি প্রণামে তাঁকে ‘পীর কবি’ বলে উল্লেখ করেছেন :
“আদ্যগুরু কল্পতরু ছৈদ সুলতান
কবি আলাওল পীর মোহাম্মদ খান।”
সৈয়দ সুলতান ‘ওফাত-ই-রছুল’ পর্যন্ত রচনা করেন। মুহম্মদ খান এ বিষয়ের সমাপ্তি টানেন ‘মক্তুল হোসেন’ রচনার মাধ্যমে।
“সৈয়দ সুলতান ষোল শতকের সাহিত্য, ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একজন দিকপাল। অতএব, কবি মুহম্মদ খান ছিলেন সতেরো শতকের চট্টগ্রামের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুখ্য ব্যক্তিদের অন্যতম।”৫
মুহম্মদ খান বলেন,
“ ‘নবীবংশ’ রচিছিলা পুরুষ প্রধান
আদ্যের উৎপন্ন যত করিলা বাখান।
রসুলের ওফাত রচি আর না রচিলা
অবশেষে রচিবারে মোক আজ্ঞা দিলা।”
এগারো পর্বে সমাপ্ত ‘মক্তুল হোসেন’। এতে ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ে, দুই ভাইয়ের জন্ম, চারি আসহাবের কথা, হাসানের বাণী, বিয়ে, মুসলিম, যুদ্ধ, হোসেন পর্ব, স্ত্রী পর্ব, দূত পর্ব, ওলিদ পর্ব, এজিদ পর্ব, প্রলয়, দজ্জাল, ঈসা (আ.), মোহাম্মদ হানিফা, এয়াজুজ মাজুজ প্রসঙ্গ। একাদশ পর্ব পৃথক পুস্তিকাও ছিল। ‘এজিদ পর্ব’ ও ‘হানিফার লড়াই’ নামে ছিল।
কারবালার মহান শাহাদাতের বেদনার সিন্ধু-প্রতিম কাব্যকথা মুহম্মদ খানের :
“স্বর্গমর্ত্য পাতালে উঠিল হাহাকার
কান্দন্ত ফিরিস্তা সব গগন মাঝার।
বিলাপন্ত যথেক গন্ধর্ব বিদ্যাধর
আর্শ কুর্সি লওহ আদি কাঁপে থরথর।
অষ্ট স্বর্গবাসী যথ করন্ত বিলাপ
ধিক ধিক কুফি সৈন্য অধার্ম্মিক পাপ।
এ সপ্ত আকাশ হৈল লোহিত বরণ
কম্পমান সূর্য দেখি হোসেন নিধন।
ক্ষীণ হৈল নিশাপতি আমীরের শোকে
মঙ্গল অরুণ বর্ণ রক্ত মাখি মুখে।
বুধে বুদ্ধি হারাইল গুরু এড়ে জ্ঞান
শনি এলা বস্ত্র পিন্দে পাই অপমান।
জোহরা নক্ষত্র কান্দে ত্যজি নাট গীত
ফাতেমা জোহরা কান্দে শোকে বিষাদিত।
সমুদ্রে উঠিল ঢেউ পরশি আকাশ
কম্পিত পর্ব্বত ছাড়ে সঘন নিঃশ্বাস।
কম্পমান পৃথিবী যতেক চরাচর
হইল লোহিত বর্ণ দিগ্দিগন্তর।
জল ত্যজে মীনগণে পক্ষী ত্যজে বাসা
সব কান্দে হাসএ ইবলিস অনা-আশা।”
বিশ্বজগৎ-জীবন ও প্রকৃতি সমস্বরে হাহাকারে মাতমে আকুল। সাহিত্যে এ অনুপম কাব্য-কথার কবি মুহম্মদ খানের এ করুণ গাথার সাথে চিরকালের বঞ্চনার কথা, মানুষের অধিকার লুণ্ঠনের কাহিনী, মানবতা ও সাম্যের চিরকালীন ও বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাতে নির্মম পাশবিকতার প্রসঙ্গই বিধৃত।
“কিন্তু আজো সেই ক্রুরতা মানুষের ঘৃণা উদ্রেক করে, হোসেনের আত্মসম্মানবোধ, সত্যনিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, নির্ভীকতা, আত্মত্যাগ আজো মানুষকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধান্বিত করে ; আজো তাঁর বীরত্ব, মহত্ত্ব ও স্বাধীনতাপ্রীতি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’-এই ছিল হোসেনের বক্তব্য। অন্যায় ও জুলুমের কাছে আত্মসমর্পণ করে অনুগৃহীতের সুখ তাঁর কাম্য ছিল না। জানের চেয়েও মান বড়, তার চেয়েও বড় স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে ইয়াযীদের কৃপাজীবীর নিশ্চিন্ত জীবন তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। তাই মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি তাঁর মর্যাদা ও আদর্শ রক্ষা করলেন। সংগ্রামের ভেতরেই জীবনের সার্থকতা খুঁজলেন, মুজাহিদের জীবন এবং শহীদের মৃত্যুই তাঁর লক্ষ্য হলো। শহীদ হয়েও যিনি মনুষ্য স্মৃতিতে অমর গাজীর গৌরব নিয়ে বেঁচে রইলেন ; সেই হোসেনের সংগ্রামের কথা, শাহাদাতের কথা আজো এবং চিরকাল স্মরণীয় থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কি? বিশেষ করে, রাসূলের দৌহিত্রের হৃদয়-বিদারক কাহিনী সাড়ে তেরো শ’ বছর ধরে মুসলমানের চক্ষু অশ্রুসিক্ত রাখছে, কেয়ামত তক এমনি অশ্রু ঝরবে তাদের দু’ চোখের কোণ বেয়ে, যখন মুহম্মদ খানের লেখা-চিত্র তারা মানস চক্ষে প্রত্যক্ষ করবে।”৬
ইতোপূর্বেকার আলোচনায় মহাকবি আলাওলের প্রসঙ্গ এসেছে। তা ছিল কোরেশী মাগন প্রাসঙ্গিক। আলাওলের অবদান আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায়, মধ্যযুগের এই কবি মানুষের
দুঃখ-ব্যথা অবলম্বন করে কাব্য রচনা করলেন।
“সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আলাওল। সৈয়দ আলাওল পূর্ববঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। সুদূর অতীত হইতে আজ পর্যন্ত এই ভূভাগে যাঁহারা বাঙলা ভাষায় কাব্য লিখিয়া যশস্বী হইয়াছেন আলাওল তাঁহাদের শীর্ষস্থানীয়।”৭
“মধ্যযুগীয় বঙ্গ সাহিত্যে তিনি মধ্যাহ্ন ভাস্করবৎ দেদীপ্যমান। তাঁহার প্রতিভার ভাস্করদ্যুতিতে সমগ্র বঙ্গসাহিত্য আলোকিত হইয়া রহিয়াছে। তিনি একদিকে মুসলমান জাতিটির মধ্যে মহাকবির স্বর্ণ সিংহাসনে সমাসীন; অপরদিকে সমসাময়িক হিন্দু কবিকুলেও তাঁহার আসন অতি উচ্চে। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি যেমন অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন, আরবী ও ফারসী ভাষায়ও তিনি অসামান্য ব্যুৎপন্ন ছিলেন। একদিকে হিন্দু শাস্ত্র ও সাহিত্য এবং অপরদিকে মুসলমান শাস্ত্র ও সাহিত্যে তাঁহার যেরূপ পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি কোন মুসলমান কবির মধ্যে পাওয়া যায় না।”৮
ভিন্ন মূল্যায়নে আলাওল :
“রোসাঙ্গের রাজসভায় দৌলত কাজীর পরেই উদিত হন কবি আলাওল। তিনিই সে সভার শ্রেষ্ঠ কবি।... কিন্তু বাঙলা সাহিত্যে আলাওল তথাপি বৃহত্তর প্রতিভা। সে প্রতিভা বহুমুখী-সঙ্গীতে, নৃত্যে, দর্শনে... বহু বিষয়ে তা স্বচ্ছন্দ ; ভাবৈশ্বর্যেও তাঁর কাব্য গভীর ; সূফী প্রেমোন্মাদনার ও রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার সংযোগে তা চিত্তস্পর্শী। তাঁর কবিকৃতি ও বাণী রচনাও অকৃত্রিম ; বাঙলা কাব্যের সীমান্ত তিনি ক্লাসিক ধর্ম বা শিষ্ট বাণীরূপে মার্জিত করে যান। সর্বোপরি ধর্ম সঙ্কীর্ণতা-মুক্ত মানবিকতার এমন একটি ভাবলোক আলাওল সৃষ্টি করেছেন, যা মধ্যযুগে দুর্লভ। তাই কবি কঙ্কনের মতো মানব চরিত্র রসিক না হলেও, কিংবা পদাবলীর কবিদের মতো সুতীব্র হৃদয়াবেগের অধিকারী না হলেও আলাওলই একমাত্র কবি যিনি সেই মধ্যযুগের পর থেকে তাঁর উদার মানবিকতায় কতকাংশে স্মরণ করিয়ে দেন এ যুগের রবীন্দ্রনাথকে।”
“শেষ কথা এবং সর্বাপেক্ষা বড় কথা, আলাওল বাংলার জাতীয় সাহিত্যের প্রথম ভিত্তি স্থাপয়িতা।... বাংলার নিম্নবর্ণের মধ্যে বহু পূর্বেই হিন্দু মুসলমানের মিলিত জীবন গঠিত হয়ে উঠেছিল, তা আমরা জানি।...
এমনি সময়ে রোসাঙ্গের রাজসভায় ধর্ম-সংশয়মুক্ত সূফী ও হিন্দু আধ্যাত্মিক সাধনার স্বাভাবিক সম্মেলন হয়ে উঠল। অন্যদিকে সেখানে লৌকিক প্রণয়কাহিনীর অনুশীলনে ধর্ম সংস্কার-মুক্ত মানবতার ধারণাও জন্মলাভ করছিল।” এক্ষণে আলাওলের মত পণ্ডিত বিদগ্ধ”...৯
এখানে গোপাল হালদারের কতিপয় উদ্ধৃতি থেকে আলাওলের বিরাটত্বের একটি ধারণা আমরা পাই। পাশাপাশি মূল্যায়নের দৃষ্টিকোণগত কিছু দিক আসে। উদ্ধৃতিতে রয়েছে :
“ধর্ম সঙ্কীর্ণতা-মুক্ত মানবিকতার এমন একটি ভাবলোক আলাওল সৃষ্টি করেছেন”, “ধর্ম সংস্কার-মুক্ত মানবতার ধারণাও জন্মলাভ করছিল।” গোপাল হালদার ধর্ম সম্পর্কে সম্ভবত একটি নেতিবাচক ধারণা থেকেই এ কথাগুলো বলেছেন। আমরা এটিকে অমূলক মনে করি। ‘ধর্ম সঙ্কীর্ণতা-মুক্ত’ বা ‘ধর্ম সংস্কার-মুক্ত’ ‘মানবিকতা’ বা ‘মানবতা’ আমরা ভাবতে পারি না এজন্য যে, ‘সঙ্কীর্ণতা’ বা ‘সংস্কার’ থেকে মুক্ত হয়েই মানুষকে ধর্মে প্রবেশ করতে হয়, অন্তত ইসলামে এবং ইসলামকে যারা প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হয়ে কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সংকলন বলে ভাবেন, ভুল করেন। ইসলাম ধারণ করে মানুষের সামগ্রিক জীবন ও সমাজ এবং পাশাপাশি নির্বিশেষে সকল মানুষের মর্যাদা ও সম্মান তথা মানবাধিকারকে করে সমুন্নত। অনভ্যস্ত চোখে এ সর্বোচ্চ বিস্ময়কর অবস্থান বটে, যেখানে কমরেড এম. এন. রায়ও সশ্রদ্ধ প্রশংসা-বাণী নিবেদন করেছেন। সুতরাং আলাওল বা নজরুলকে বংশ ও জাতীয় ‘উদার’ দৃষ্টিকোণ দিয়েই বিচার যৌক্তিক হবে। না হলে আলাওল-নজরুলের মূল্যায়নে মানবীয় মর্যাদার পতাকাবাহী ধর্ম-চেতনাকে অহেতুক অবমূল্যায়নের শিকার হতে হবে। আমরা এ অবস্থান থেকেই বলছি, মানবাধিকারের চিন্তা-চেতনা হোক কিংবা সম্প্রদায়গত বিভাজন-মুক্ততা হোক, এগুলো সম্ভবই হয়েছে শুধু এমন একটি ধর্ম-উৎসের আওতায় তাঁদের পিতৃপুরুষ থেকে অধিবাস ছিল বলেই।
(চলবে)
তথ্যসূত্র
১. প্রবন্ধ : ভারতবর্ষ ও ইসলাম, ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, কমরেড এম. এন. রায় The Historical Role of Islam -এর মুহম্মদ আবদুল হাই কৃত অনুবাদ)
২. বাঙলার ইতিহাস, স্টুয়ার্ট।
৩. বৃহৎ বঙ্গ, ড. দীনেশ চন্দ্র সেন।
৪. প্রবন্ধ : ‘কবি মুহম্মদ খান ও তাঁর কাব্য’, জীবনে-সমাজে-সাহিত্যে, আহমদ শরীফ, আদিল ব্রাদার্স এণ্ড কোং, ডিসেম্বর ১৯৭৪ (২য় মু) পৃ. ১৬১-১৬২
৫. ঐ, পৃ. ১৬২
৬. ঐ, পৃ. ১৬৭
৭. বাংলা কাব্যে মুসলিম সাধনা, আবদুল কাদির, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, মার্চ ১৯৮৭, পৃ. ৫৮ ও ৭৪
৮. আরাকান রাজসভায় বঙ্গ সাহিত্য, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও মুহম্মদ এনামুল হক, পৃ. ৫৪
৯. বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা, গোপাল হালদার, মুক্তধারা, বৈশাখ ১৩৮১/এপ্রিল ১৯৭৪, পৃ. ১৬৪, ১৭০ ও ১৭১
(জ্যোতি ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা)