বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য- (৩য় পর্ব)
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য- (৩য় পর্ব)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মহাকবি আলাওল ১৬৬৯-এ সৈয়দ মুসার আদেশে লিখেন, ‘সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল’। এ গ্রন্থে ‘এজিদ প্রকৃতি’ (বাংলায় ‘মীর জাফর’ শব্দ যেমন শুধু চক্রান্তকারী ও বিশ্বাসঘাতক অর্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনি নরাধম বুঝানোর জন্য কবি ব্যবহার করেছেন ‘এজিদ প্রকৃতি’। চিরকালের ধিকৃত, ঘৃণিত স্বভাবের এজিদের প্রসঙ্গ এনেছেন কবি সেই ‘দাশির নন্দন’ সম্পর্কে বলতে, যে তাঁর বহু দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্ছনার মূলে কলকাঠি নেড়েছিল।) এর ফলে তাঁর লাঞ্ছিত জীবনের কথায় বলেন, ‘বহুল যন্ত্রণা দুঃখ পাইলাম ক্লেশ।’
কাব্যের কতিপয় পঙ্ক্তিতে আলাওলের কথা :
“এজিদ প্রকৃতি সেই দাশির নন্দন
মিথ্যা কহি কথা লোক করাইল বন্ধন ॥
আয়ু মুক্ত সব নষ্ট পড়িল অস্থান
পাপরাশি ধর্ম্মনাশি মৈল শালসান ॥
অক্ষরেহ অপরাধ দিল পাপাচারে
না পাইয়া বিচার পড়িলুম কারাগারে ॥
বহুল যন্ত্রণা দুঃখ পাইলাম ক্লেশ
গর্ভবাস আছিলাম পঞ্চাশ দিবস
আয়ু লেশ আত্মা ছিল রাখে বিধাতাএ
সবে ভিক্ষা জীব রক্ষা ক্লেশে দিন যাএ ॥”
মানবাধিকার-বঞ্চিত মানুষ ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেয় ; রাজরোষের তো প্রশ্নই আসে না-রাজত্ব এবং রাজা-প্রজার বিষয়টি মানুষের সকল অধিকার হরণের সর্বোচ্চ মাধ্যম, ‘মিথ্যাবাদ’-এ বিচার-বঞ্চিত জীবনও কোন অধিকারের হিসেবেই উতরানোর নয়। মহাকবি আলাওলের জীবনের বিপর্যয় প্রসঙ্গ তাঁর কাব্যে :
“আপনার দোষ হোন্তে পাএ অবসাদ
এক পাপী আমারে দিল মিথ্যাবাদ।
কারাগারে পৈলুঁ আমি না পাই বিচার
যত ইতি বসতি হৈল ছারখার।
...
মন্দ কৃতি ভিক্ষাবৃত্তি জীবন কর্কশ
পুত্র দারা সঙ্গে মুঞিঁ হৈলুঁ (অঙ্গ হৈল) পরবশ।”
অতঃপর উদ্ধার প্রসঙ্গ :
“গুণহেতু মহাজনে করন্ত আদর
ভিক্ষা করি দেয় পুত্র দারা রাজকর।”
আলাওলের উত্তরণ :
“মধুর বচন মোর শুনিয়া রসদ
সাদরে আনিয়া আমা কৈল সভাসদ।”
প্রতিভার স্বীকৃতি পেলেন কবি এবং তা সেদিনের রাজকীয় অবস্থান থেকেই :
“অন্নে বস্ত্রে তুষিয়া পোষন্ত নিরন্তর
তান দানে সুসময়ে শুধি রাজকর।” (সেকান্দরনামা)
মানবাধিকার দু’টি ধারায় প্রাপ্তিযোগ্য মনে করা হয়। মানুষের প্রতি মানবিক সহমর্তিতা, দয়া, দান আনুকূল্য-সে ধর্মীয় দৃষ্টিতে হোক বা নিছক নৈতিক মূল্যবোধজনিত তাকিদে হোক-এর একটি ধারা। এখানে প্রদাতার ইচ্ছাটাই সব। তবে ধর্মীয় বিধিবিধানের আওতায় তা যদি ইসলামী মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ উৎসারিত হয়, কোন অবস্থায়ই তখন প্রদাতার মর্জি-মাফিক হওয়ার কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যাকাতের নির্দিষ্ট খাত আছে, পরিমাণ আছে, দান-সদকার পুঙ্খানুপুঙ্খ নীতিমালা আছে। এখানে মানুষের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যকে কৃপা-অনুগ্রহ নয়; পবিত্র কোরআনে উক্ত ‘অধিকার’-এর দৃষ্টিতে দেখতে হয়; দেখা হয় এবং তা চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই হবে।
‘নৈতিক মূল্যবোধ’-উদ্বুদ্ধ মানবাধিকার প্রদান ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ঔদার্যই সব ; ব্যক্তির ইচ্ছাই মানুষের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার দিকটি নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে কোন অলৌকিক নিয়ন্ত্রণ বা বাধ্যবাধকতা নেই যা ইসলামের সমাজ ব্যবস্থায় অবলম্বনীয়। শ্রেণী সংগ্রামোত্তর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানবাধিকার হচ্ছে অন্য ধারা, যেখানে বাধ্যবাধকতাকে সম্মিলিত গণপ্রশাসনের আওতায় বাস্তবায়িত করার কথা। এখানে ব্যক্তিগত দায় আনুকূল্যের কিছু নেই ; রাষ্ট্রই গণঅধিকার নিশ্চিত করার কথা।
আলাওলের যুগ ছিল আমাদের প্রথমোক্ত ধারাটির যুগ। (প্রশাসনিক অর্থে নয়, শুধু ব্যক্তিগতভাবে আনুকূল্যের অর্থে। কারণ ইসলামী নীতি রাষ্ট্রীয়ভাবে ছিল অনুপস্থিত।) এই অর্থে যে, ব্যক্তিগতভাবে মানুষ তখন দান-দয়া, পরোপকার অবলম্বন করে মানবাধিকারের শিথিল অনুসৃতিতে নিয়োজিত ছিল।
আলাওল ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা ও মাগন চরিত্র চিত্রণে বলেন :
“ভাগ্যোদয় হৈল মোর বিধি অবসানে
দুঃখ নাশ হেতু তান সঙ্গেত মিলনে।
অনেক আদর করি বহুল সম্মানে
সতত পোষন্ত মোরে অন্ন বস্ত্র দানে।” (পদ্মাবতী)
তাঁর কাব্যে দানবীর মাগন :
“দানকালে শত্রু মিত্র এক নাহি চিন
সকলকে দেয়ন্ত আপনা কিবা ভিন।”
অকৃপণ মাগন :
“ধর্মভাব সদাচার মধুর আলাপ
না জানন্তে কৃপণতা অধির্মতা পাপ।”
পরোপকারী ও দয়ালু মাগন :
“পর উপকার অতি দয়াল হৃদয়
হিংসা করি না করেন্ত লোক অপচয়।” (পদ্মাবতী)
মাগনকে উপলক্ষ করে মহাকবি আলাওলের এ কাব্যভাষণ বাংলা কাব্যে মানবতারই বিজয় ঘোষণা। আলাওল হাদীসের বাণী জানতেন :
“কৃপণতা ও অসদ্ব্যবহার মুসলিম চরিত্রে স্থান পেতে পারে না।”
সেজন্য ‘কৃপণতা’কে ‘অধর্মিতা পাপ’ বলেছেন।
আলাওল জানতেন, শত্রু-মিত্র বিবেচনা করে দান করতে নেই। দানের যোগ্য পাত্র হলে তা করতে হবে নির্বিশেষে। অভাবী ভূখা-ফাকা মানুষই দান-খয়রাতের হকদার। এ জন্যই মাগন চরিত্র মূল্যায়নে এই নির্বিশেষ দান-সদকার প্রশস্তি গেয়েছেন।
পবিত্র হাদীস অনুসারে হিংসা সাওয়াবকে জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দেয়। কবি বলেছেন, মাগন হিংসা করে লোক অপচয় করেন না। এখানে নরহত্যার ইঙ্গিত এসেছে। পবিত্র কোরআনে নিরীহ মানুষ হত্যাকে বিশ্বমানব হত্যার শামিল বলা হয়েছে। সুতরাং লোক অপচয়ে মাগন নেই, এ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা-মানবাধিকারের সর্বোচ্চ বিষয়টির প্রতি সাহিত্যের প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রয়েছে।
আলাওলের ‘তোহফা’ (১৬৬৩-৬৪) ইরানের কবি ইউসুফ গাদার ‘তোহফা’ গ্রন্থের ভাবানুবাদ। ‘তোহফা’ মানে উপহার। এতে রয়েছে হিতোপদেশ-তত্ত্ব উপদেশ। সংখ্যা-সংকেত থেকে অনুমিত হয়, আলাওল ২৭৮ বছর পর এটি বাংলায় ভাবানুবাদ করেন। এতে রয়েছে হাম্দ, নাত, ঈমান, গোর সওয়াল, বিদ্যাশিক্ষা। ‘তোহফা’র সপ্তম অধ্যায়ে ‘জাকাতের ফজিলত’ থেকে :
“জাকাত না দেয় যে বা না করে নামায
না পাইব রত্ম টুঙ্গী বেহেস্তের মাঝ ॥
খয়রাত করিব যে পবিত্র নিজ ধনে
পরিতে জাকাত ধন না লৈব সুজনে ॥
অপবিত্র ধনে দান পুণ্য নাহি রতি
যদি পুণ্য আশা করে পাপ বাড়ে অতি ॥
আমার বচন যদি অপ্রত্যয়ে মন
কিতাব তোহফাখানি কর নিরীক্ষণ ॥
গুপ্তদানে আয়ু বৃদ্ধি হয় নিরাপদ
খোদায় হইব রাজি, বাড়ায় সম্পদ ॥
দানে ব্যাধি নাশ হয়, খণ্ডে বিঘ্নদোষ
ঈশ্বরের রোষ খণ্ডি জন্মায় সন্তোষ ॥”
যাকাত ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। প্রশাসনের আওতায় তার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটলে সমাজে অভাবী দরিদ্র থাকার কথা নয়। পবিত্র কোরআনে যাকাত ও নামাযের নির্দেশ রয়েছে এভাবে :
“এবং তোমরা নামায কায়েম কর ও যাকাত দাও...।”১
আল্লাহ্ তায়ালা যাকাত দানের খাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন :
“নিশ্চয়ই যাকাত গরীব, মিসকীন, কাজে (যাকাত সংক্রান্ত) নিয়োজিত কর্মচারী, যাদের মন আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, ক্রীতদাস মুক্ত করা, ঋণগ্রস্তকে দায়মুক্ত করা, আল্লাহ্র পথের পথিক এবং নিঃস্ব মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরয। আর আল্লাহ্ তাআলা সর্বজ্ঞ ও মহান কুশলী।”২
সমাজের অভাবগ্রস্ত দরিদ্র শ্রেণীই সাধারণভাবে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত। এজন্য প্রথম দু’টি ক্ষেত্রই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই এ দু’টির উল্লেখও এ ইঙ্গিত প্রদান করে।
হযরত মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়েমেন পাঠানোর সময় রাসূল (সা.) নির্দেশ দেন :
“সে সমাজের বিত্তবানদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে গরীব-মিসকীনদের তা দিয়ে দেবে।”
হযরত আলী (রা.) বলেন :
“আল্লাহ্তায়ালা বিত্তশালীদের সম্পদে দরিদ্রদের জন্য যে অধিকার নির্ধারিত করেছেন, তা এত যে, তা দিয়ে তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়। যদি তা সত্ত্বেও দরিদ্র লোকেরা ভূখা-নাঙ্গা থাকে এবং তাদের জীবন-যাপন কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে তার কারণ হলো, বিত্তশালীরা নিজের সম্পদ থেকে দরিদ্রদের অধিকার আদায় করে না। আল্লাহ্তায়ালা এ অধিকার রাখেন যে, এ ধরনের সম্পদশালীদের রোজ কিয়ামতে পাকড়াও করবেন এবং তাদের শাস্তি দেবেন। ”
দারিদ্র্য বিমোচনে ওয়াক্ফ, হেবা, অসিয়ত এবং কর্জে হাসানাও সহায়ক, ধর্ম বিধিভুক্ত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পবিত্র কোরআন ও হাদীসে মানব সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ তথা অভাবী মানুষকে শোষণের বড় হাতিয়ার সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
একাদশ অধ্যায়ে ‘বিদ্যা উপার্জন’ :
“শাক অন্ন রুক্ষী শুষ্ক যেই মিলে খাও
স্বাদ হেতু নৃপতির গৃহেতে না যাও ॥
মনেতে করিআ আশা কতক্ষণে খায়
পরগৃহে না থাকিব কুকুরের প্রায় ॥
পরগ্রাস আসে ভাবি না থাকিব বনে
কুকুর সমান তাকে দেখে সর্বজনে ॥”
পরনির্ভরশীলতার বিপরীতে আত্মসম্মানবোধের জাগরণ একান্তই কাম্য। মানুষের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী যে মানবীয় মর্যাদা হারায়, এ মূল্যবান কথাটি কবি বলেছেন।
ভিক্ষাবৃত্তিকে পবিত্র হাদীসে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, পরকালে অপমানজনক চেহারায় ওঠার কথা বলা হয়েছে।
মহানবী (সা.) বলেন :
“যে ব্যক্তি আমার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে, সে কোনদিন ভিক্ষা করবে না, তার জান্নাতের দায়িত্ব আমি নিলাম।”৩
পরানুগ্রহ প্রার্থনা আত্ম অবমাননা-মানবতারই লাঞ্ছনা। কবি এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট, রূঢ় :
“কুকুর সমান তাকে দেখে সর্বজন।”
অবশ্য বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা, যা পুঁজিবাদী চিন্তা-চেতনার বাস্তবতা ; বা সেদিনের সমাজ ব্যবস্থা, যা রাজতন্ত্রের শৃঙ্খলাবদ্ধ-কাউকে এ আত্ম মর্যাদাহীন বৃত্তিতে ঠেলে দিলে তা একান্তই অন্য কথা। ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, চিকিৎসা-বঞ্চিত মানুষের কথা আলাদা। তাদের হাত ‘ওপরের হাত’ না হয়ে ‘নীচের হাত’ই হবে।
চতুর্বিংশ অধ্যায় : নামাজ, রোযা ও খয়রাত
“চতুর্বিশ বাবেতে শুন সাধুরাজ
কেমনে করিব রোজা সদকা নামাজ
নামাজ খয়রাত রোজা কর শুদ্ধ মনে
কেবল ঈশ্বর যদি হএ তেকারণে।”
‘খয়রাত’ প্রয়োজন। বিপন্ন মানুষ, যে শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থা-যা মানুষের ‘উর্বর’ মস্তিষ্কপ্রসূত-এর শিকার; তাকে হাত পাততেই হবে। কারণ ক্রমাগত শোষণ প্রক্রিয়ায় সে অবলম্বনহীন, নিঃশেষিত প্রায়। তাকে ‘খয়রাত’ দিতে হবে অম্লানচিত্তে।
ত্রিংশ অধ্যায়ে : দানের মাহাত্ম্য
“কৃপাভাবে ভিক্ষুকে করিলে এক দৃষ্টি।
তোমা পরে ঈশ্বরে করিব কৃপা বৃষ্টি ॥
নিজ অংগে দুঃখ সহ পর দুঃখ লাগি
তার সম কেহ নহে প্রভু কৃপাভাগী ॥
দ্বারে আসি’ ভিক্ষুক মাগিলে এক রুটি
না দিয়া বোলএ যদি নষ্ট পরিপাটি।
ঈশ্বর বোলএ, আমি গেনুঁ তোর দ্বারে
এক গ্রাস ভক্ষ্য তুমি দিলা না আমারে।
দ্বার হৈতে কেহ যদি মাঙ্গুয়া খেদায়
মোকে খেদাইল হেন বোলএ খোদায় ॥
গ্রাসেক না দিয়া যদি খেদায় ভিক্ষুক।
সহস্র বৎসর দোজখেতে পাইব দুখ ॥”
‘দানের মাহাত্ম্য’-এ সেই হাদীসের কথা, যেখানে মানুষকে স্রষ্টার দায়ী করার প্রসঙ্গ এসেছে যে, প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিয়ে মানুষ স্রষ্টাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে।
কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :
“তোমরা কখনও সওয়াব লাভে সক্ষম হবে না, যতক্ষণ না তোমরা যা ভালবাস তা থেকে (আল্লাহ্র পথে) ব্যয় না করবে।”৪
“আমি তোমাদের যে রিজিক দান করেছি, তোমাদের কারো নিকট মৃত্যু আসার আগেই তা থেকে ব্যয় কর।”৫
“হে ঈমানদারগণ, আমি তোমাদের যা দান করেছি, তা থেকে ব্যয় কর...।”৬
“আপনার কাছে তারা জিজ্ঞেস করে, তারা কি ব্যয় করবে? বলে দিন, যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে, তা হবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অসহায় এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যে সৎ কাজই করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালভাবেই আল্লাহ্র জানা আছে।”৭
ওয়াকীদীর ‘মজমুয়ে ফতুহশ্বাম’-এর বাংলা কাব্যানুবাদ করেছেন ১ম খণ্ড আজিমদ্দিন আহমদ, ২য় খণ্ড তিনি ও জোনাব আলী এবং ৩য় খণ্ড মুহাম্মদ মুসা ও জোনাব আলী। ৪র্থ খণ্ড একক জোনাব আলী।
সিপাহসালারকে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ ‘মজমুয়ে ফতুহ্ শ্বাম’ কাব্যে :
“সকল সময়ে যেন ন্যায়ে লক্ষ্য রয়
খবরদার, অত্যাচার যেন নাহি হয়।
অত্যাচারিগণ কভু শত্রুর উপর
জয়যুক্ত নাহি হয়, জানিবে খবর।
আর এক কথা সদা রাখিবে স্মরণ
শত্রুর উপরে জয়ী হইবে যখন
তাহাদের বাচ্চাদিগে আর বুড়াদিগে
না মারিবে, হবে দায়ী খোদার নজদিগে।
তাহাদের স্ত্রীদিগকে না মারিও আর
খোরমার গাছের কাছে না যাইবে আর
আবাদ ফসল নাহি দিবে জ্বালাইয়া
ফলবতী গাছ নাহি ফেলিবে কাটিয়া।
সন্ধি বা চুক্তিতে যদি আবদ্ধ হইবে
খবরদার, বেওফায়ী কভু না করিবে।”
মুসলিম বিজয় অভিযানের প্রেক্ষিতে ‘মজমুয়ে ফতুহশ্বাম’-এর উল্লিখিত নীতিমালা দ্রষ্টব্য। অতীত যুদ্ধের ইতিহাস, মানুষের অধিকার লুণ্ঠন ও নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। কিন্তু মুসলিম জিহাদ-এ পূর্ববর্তী যুদ্ধধারা অনুসৃত হয়নি। মানবাধিকার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে জাতি বিশ্ববিজয় সম্পন্ন করলো তাদের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এ সাবধান-বাণী পবিত্র কোরআন ও হাদীসের নীতিরই পুনরুচ্চারণ :
‘অত্যাচার যেন নাহি হয়’ এবং বিজয়ের পর ‘বাচ্চাদিগে’ ‘বুড়াদিগে’ ‘স্ত্রীদিগে’ অর্থাৎ শিশু, বৃদ্ধ-নারীকে ‘না মারিবে।’ এমনকি,
“আবাদ ফসল নাহি দিবে জ্বালাইয়া
ফলবতী গাছ নাহি ফেলিবে কাটিয়া।”
মানুষ ও প্রকৃতির সামগ্রিক নিরাপত্তা। এবং যদি সন্ধিচুক্তি হয়, সে ক্ষেত্রে কোনরূপ বিশ্বাসঘাতকতা নয়, চুক্তির খেলাফ নয় :
‘খবরদার বেওফায়ী কভু না করিবে।’
রামানন্দ ঘোষের রামায়ণ কাব্য। আঠারো শতকের সম্ভাব্য আটের দশকের শুরুতে। যৌবনে তিনি ছিলেন সন্ন্যাসব্রতী ; পরে তাঁর এ মোহভঙ্গ হয়। এবং তখন বৈরাগ্যের বিপরীতে তাঁর কাব্যে স্পষ্ট উচ্চারণ :
“শরীর করিনু পণ আমি এ পামর
না হৈল (বস্তু) চর্ম চক্ষের গোচর।
ধনীতে বান্ধয়ে ধন জলে বান্ধে জল
নাহি মিলে কাঙ্গালের কড়ার সম্বল।...
দারা ছাড়ি পাপ ভরা ভরিনু অপার
অস্থি চর্ম সার কইল অভিশাপ তার।
দারা সুত সুতা আর বন্ধু কেহ নাই
অবশেষে কি হইবে নাহি মিলে যাই।”
বৈরাগ্য যে মানুষকে জাগতিকভাবে বঞ্চিত করে, আর্থ-সামাজিক বিপর্যস্থ অবস্থানে ঠেলে দেয়; সামাজিকভাবে অপাংক্তেয় কাঙ্গাল হয়ে অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে হয়; সোজা কথায় স্বেচ্ছায় মানবাধিকার বঞ্চিত হতে হয়; এ সত্যের উপলব্ধি শুধু কবির ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা নয়; পাঠকের জন্য একটি দুর্লভ শিক্ষাও বটে। এ সত্য ও বাস্তবতাকে আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করি। সে যুগে এমন প্রতিবাদ অচিন্ত্যনীয়; অবিশ্বাস্য প্রায়। রামানন্দের শেষ দিককার স্বীকৃতি :
“দারু ব্রহ্ম সেবা করি জেরবার হৈল
বৃথা কষ্ট সেবি কাল কাটা নহে ভাল।
বস্তুহীন বিগ্রহ সেবিয়া নহে কাজ
নিজ কষ্ট দায় আর লোক মধ্যে লাজ।”
‘‘কবিত্বের জন্য ততটা নয়, কিন্তু এক নতুন চেতনার প্রতিভূ হিসেবে রামানন্দ ঘোষ বাঙলা সাহিত্যে সত্যই একক, ভবিষ্যতের আভাস।...”
দামোদর অঞ্চলের, বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্রের জমিদারীর আওতাভুক্ত সেহারা গ্রামের অধিবাসী রমাকান্ত রায়। তিনি ‘ধর্মমঙ্গল’ লিখেন আঠারো শতকের শেষ দিকে। কায়স্থ, চাষী গৃহস্থ পবিবারের কবি বেকার। বলেছেন,
‘মাস ছয় বেকার বসিয়া আছি ঘরে’।
ক্ষেতকৃষির বিকল্প নেই; কিন্তু কবির তা পছন্দ নয়। সেকালের উপার্জনহীন বেকারের কথা তাঁর কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। দ্রষ্টব্য, রামানন্দ ঘোষ যেখানে স্বেচ্ছা বৈরাগ্যের অনর্থে উপার্জনহীন ছিলেন, রমাকান্ত রায় সেখানে বেকার হওয়ার জন্য অনর্থে নিক্ষিপ্ত। এ দু’টি ধারার নিষ্ক্রিয়তা উপার্জনশীল হওয়া, আর্থ-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিপরীত-স্বাভাবিকভাবে সর্বত্রই সমাজে পাওনা মানবাধিকার-বঞ্চিত। রমাকান্ত বলেন :
“দিনে দিনে অধিক হইনু উচাটন
প্রবৃত্তি না দেয় কি সে বিচলিত মন
ধড়ফড় করে প্রাণ অন্তর বিকল
কভু ভাবি মনেতে যাইব নীলাচল।
...
দিবানিশি শয়নে স্বপনে দেখি কত
দিন কুড়ি উচাটন সয় এই মত।
কাহারে না বলি কিছু অন্তর গুমরে
সারাদিন বেড়াই সবার ঘরে ঘরে।
বহুদিন ডানি বাহু ডানি চক্ষু নাচে
ইচ্ছা নাই বচন কহিতে কার কাছে
নিদ্রা নাই নয়নে শর্ব্বরী জাগরণে
উষ্মা হয় যদি কিছু বলে কোন জনে।”
বেকার জীবনের মনস্তাপের এ বর্ণনা কি আজো আমাদের কোটি বেকার তরুণের জীবনের হাহাকারের অবিকল চিত্র নয়?
উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষ দশক পর্যন্ত কবি করিমুন্নেছার জীবনকাল। তাঁর কাব্যে:
“রাজার চিন্তায় রাজা জর্জ্জরিত
ভিখারী অন্নের তরে
ভাবে দিবানিশি মলিন বদন
কে বা সুখ ভোগ করে?”
স্ব স্ব চিন্তা-ধান্ধায় সবাই ব্যস্ত, তাড়িত। রাজা-প্রজা সবাই। এজন্য সুখ-দুঃখ ‘ছায়াবাজি প্রায়’ এবং ‘তাহাতে পদার্থ নাই’ বলেছেন তিনি। এবং এভাবে ‘ভিখারী’র ‘অন্নের তরে’ জর্জ্জরিত থাকাকে তিনি রাজার রাজ্য বিষয়ক চিন্তার সাথে গুলিয়ে একাকার করে ফেলেছেন। এখানে আমরা শুধু পাচ্ছি ‘ভিখারী অন্নের তরে’। কবিকে এ কথাটি বলতে হয়েছে। তবে তিনি মানবাধিকার ও সাম্যের প্রতি যে সুবিচার করেননি, এটি স্পষ্ট।
অন্যত্র তাঁর শ্লেষ-ছড়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে। জমিদারীর ইতিহাস :
“লক্ষীকান্তের কারসাজি
নিল ছয় আনির হাজি
পাঁচ আনির পুণ্যভূমি মাঝে
ছয় আনি হৈল হাজিশূন্য
পাঁচ আনি মানিল ধন্য
জরিপের পুণ্যময় হজ্জে।
কিশোরী কেশরে হায়
প্রলোভনে তালেব ভুলায়
দিয়া নিজ দারা ও সুতায়।”
শরৎচন্দ্র চৌধুরী (১৮৫২-১৯২৬) ‘দেবীযুদ্ধ’ গ্রন্থের জন্য তদানীন্তন বৃটিশ রাজরোষে পড়েন ও চাকুরী ত্যাগ করেন।
“দোকানে দোকানে আতিথ্য বিকায়
ধর্ম, অর্থ, যশঃ বিনা অর্থে নয়
স্নেহ, দয়া, প্রেম, সবে অর্থাধীন
বিনা বিনিময়ে দান নাহি হয়।
...
নামে মাত্র বলে সত্যের দোহাই
মিথ্যার প্রভুত্ব যেখানে সেখানে
মিথ্যার চাতুরী ধরিতে চাহিলে
সত্যের সেবক মজে ধনে প্রাণে।
পথে ঘাটে দস্যু তস্করের ভয়
স্বগৃহে আতঙ্কে কম্পিত অন্তর
মুখ ফুটি’ কেহ সে কথা বলিলে
পড়ে রাজদণ্ড মাথার উপর।
নিরাশ্রয় এবে কৃতজ্ঞতা হায়
কাহারো হৃদয়ে নাহি পায় স্থান
অন্ন-দাস যদি করে শক্তি লাভ
দাতার সে তবে হরে ধন প্রাণ।” (দেবীযুদ্ধ)
শরৎচন্দ্র চৌধুরীর উদ্ধৃত কাব্যাংশে রয়েছে :
ক. অর্থ সবকিছুর মূল চালিকা শক্তি। খ. মিথ্যার জয়-জয়কার, প্রতিবাদী মানবিক উচ্চারণকারী বিপন্ন। গ. বিপন্ন শুধু সমাজের দুষ্টদের কারণে নয়; দুষ্টগুলোর সপক্ষে যে রাজদণ্ড দাঁড়ায়, তার জন্যও। অর্থাৎ অপরাধীরা শাসকের ছত্রছায়ায় অন্যায়-অনাচার চালিয়ে যায়। ঘ. কৃতজ্ঞতা আশ্রয়হীন; অকৃতজ্ঞ শক্তিমান হয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা তো দূরের কথা, ‘দাতার সে তবে হরে ধন-প্রাণ।’ অর্থাৎ যে শাসক অন্যায়কে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে, তার রাজত্বে নেমক হারামেরও জয়জয়কার। ‘দৃষ্টিপাত’-এ বনফুল (বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়) বলেছিলেন, ‘কৃতজ্ঞতা কথাটা আছে ইংরেজের ভাষায়; নেই ইংরেজ চরিত্রে।’ এ ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র চৌধুরীর কাব্যে সেই শাসনকালের জনগণ-মর্মবেদনাই, শোষিত বঞ্চিত উৎপীড়িত মানুষের শৃঙ্খলিত জীবন চিত্রই উন্মোচিত হয়েছে। এ সবের খেসারত দিয়েছেন কবি, যা উল্লিখিত হয়েছে এখানে।
সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ সর্বমানবিক সাম্য ও মানবাধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করে, এটি কোন বিশ্লেষণ সাপেক্ষ তত্ত্বকথা নয় এবং এর চেয়ে উজ্জ্বল সত্য কি হতে পারে, যেখানে খোদ স্রষ্টা ‘ইসলাম আল্লাহ্র কাছে একমাত্র দীন’ বলেও বিশ্বমানবকে ‘এক জাতি’ বলে সবার প্রতি ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। এ প্রেক্ষিতেই মহাকবি কায়কোবাদ (১৮৫৮-১৯৫২) মানবতাবাদী উচ্চারণের কাব্য উপহার দেন :
“সকলি নিয়েছে কৃতান্ত করাল
আছে শুধু কিছু বন্য পশুপাল।
ভাল মন্দ যার, নাহি বুদ্ধি জান
ভাই ভাই মিলি, করিছে সমর
এরা দুই জাতি হিন্দু মুসলমান।” (জাগ রে)
ভারতবাসী সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে বন্দী; পাশাপাশি পুঁজিবাদের সকল অভিশাপ, অমানবিকতার সকল পাশবিকতার অচলায়তনে নিঃশেষিত হচ্ছে। শোষণমুক্ত সমাজ নেই, নেই ধর্মের নামে ভিত্তিহীন পাশবিক উন্মাদনামুক্ত পবিত্র পরিবেশ। সুতরাং তাঁর আহবান :
“হে ভারতবাসী, জাগ একবার
কতকাল রবে ঘুমাইয়া আর?” (জাগরণ সঙ্গীত)
ইসলামের ‘ফরায়েজ’-সম্পত্তি বণ্টন নীতিমালা যথাযথ বাস্তবায়িত হলে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য কমে, এটি সাম্য ব্যবস্থার অন্যতম উপকরণ। মুন্সী দাদ আলী (১৮৫৬-১৯২৭)-এর কাব্য ‘সমাজ শিক্ষণ’ (১৯১০) সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধির উপদেশমালা। তাঁর ‘ফরায়েজ’ কাব্যে মুসলিম স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ভাগের নীতি পবিত্র কোরআন ও হাদীস অনুযায়ী বর্ণিত।
মুন্সী আবদুল করিম (১৮৬৭-১৯২৮) চরকা চালানোয় সমাজের অর্থমুক্তির একটি পথ পেয়েছেন। তিনি বলেন :
“অল্পদিন চলে যদি এরূপ চলন
অনাহারে পথে ঘাটে না হবে মরণ।” (চরকার চক্কর)
জয়নাথ নন্দী মজুমদার (১৮৬৩-১৯৪২) বিশ্বভ্রাতৃভাব কামনায় প্রার্থনা করেন :
“বিশ্বমানবের প্রতি ভ্রাতৃভাব বিশ্বপতি
দাও সদা আমার অন্তরে।” (প্রার্থনা)
মহানবী যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সমাজের অমানবিকতা তাঁর কাব্যে :
“দয়ামায়া নাই হৃদে করিয়া কলহ
করিত ডাকাতি চুরি তারা অহরহ ॥” (হজরত মোহাম্মদ)
“মোক্কাবাসী পাপিষ্ঠের দল হজরতকে কৈল অত্যাচার
শুনিলে দুঃখের কাহিনী বুক ফেটে যাবে তোমার ॥”
...
“বিষয়েতে মত্ত পাপী স্ত্রী পুত্র ধনের তরে
দিনান্তেও জগদীশে ভাবে না অন্তরে ॥” [হজরত মোহাম্মদ (গান)]
“সনাতন সত্যধর্ম্ম হইলে মলিন
পাপ পূর্ণ হয় ধরা কুকর্ম্মেতে লীন ॥
পাপিষ্ঠের অত্যাচারে শিষ্টে কষ্ট পায়
সতীর সতীত্ব যায় করে হায়! হায় ॥
ঈশ্বরের সিংহাসনে বসে শয়তান
তারে পূজে নরনারী যাহারা অজ্ঞান ॥”
সমাজে মানবাধিকার হরণের একটি ধারা ভণ্ডামি। ধর্মের নামে মানুষকে শোষণের হাতিয়ার ভড়ং। সরল ধর্মপ্রাণ মানুষ এতে প্রতারিত হয়। এ বিষয়টিতেই আলোকপাত করেছেন কবি গিরিজা ভূষণ দে (১৮৬৭-১৯৩৬)।
“চাঁদা তুলি ঘুরে ফিরে গয়া বৃন্দাবন
নাহিক ভাবনা আর সদা ফুল্ল মন ॥
মহানন্দে মশগুল হৈল নির্ব্বাণ
পেটাগুণ নিভে গেল মুস্কিলে আসান ॥” (বিড়াল তপস্বী)
কবি মতিয়র রহমান খান (১৮৭২-১৯৩৭)। শেখ আবদুর রহিম সম্পাদিত ‘মিহির ও সুধাকর’-এ তাঁর ‘এজিদ বধ’ কাব্যের প্রথম অংশ ধারাবাহিক বেরোয়। এটি সম্পূর্ণ হয়নি। ১৩০৮-এ ‘মাসিক প্রচারক’-এ তাঁর ‘মোছলেম বধ’ খণ্ড-কবিতা প্রকাশিত হয়। কবির অপ্রকাশিত ‘এমাম বধ’ কাব্যের অংশবিশেষ ‘মোছলেম বধ’ বলে মনে করা হয়। তাঁর কাব্য থেকে :
“পুনঃ পুনঃ কলেমা পড়িয়া মহাজন
শহীদ সম্পদ পাই ত্যজিল জীবন।”
তাঁর নীতি-কবিতাংশ :
“রাজত্ববিহীন নৃপে ছাড়ে তার মন্ত্রীগণ
পণ্য স্ত্রী করে না কভু ধনহীনে সম্ভাষণ।”
ধন-সম্পদ ও প্রতিপত্তির আনুগত্যে মানুষ আনত-বিনত, এ বৈষয়িক দিকটির বাস্তবতার প্রতি অঙ্গুলি সংকেত করেছেন কবি রাজত্বহীন রাজা ও ধনহীন স্বামীর প্রসঙ্গ টেনে।
আবুল মোতাকাব্বের আবুল হাসান (১৮৭৯-১৯৪৮)। তাঁর কাব্যবাণী নীতিকথা।
“পুথিগত বিদ্যা আর পরহস্তগত ধন
কার্যকালে কাজে নাহি আসে কদাচন।” (নীতিকথা)
বিদ্যা আয়ত্তকরণ সাপেক্ষ এবং ধন অর্জন সাপেক্ষ। পরহস্তগত ধন যেহেতু কোন কাজে আসার কথা নয়, সেহেতু ধন অর্জনের চিন্তা করা চাই। তার দু’টি পথ : ব্যক্তিগত পরিশ্রম সাপেক্ষ অর্জনধারা এবং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং সবাইকে ‘একই সমতলে’ নিয়ে আসা। সে ক্ষেত্রে ভাল মন্দ যা-ই হোক, সামষ্টিক হবে আর মন্দের প্রশ্ন এজন্যই ওঠে না যে, সমাজে কতিপয় কায়েমী স্বার্থবাদীর হাতে সম্পদের কুক্ষিগতকরণের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে গেলে প্রাপ্ত সম্পদের ভাগ-বাঁটোয়ারায় গণ-মানুষের মৌলিক দাবিগুলো পূরণেরই ব্যবস্থা থাকবে; অহেতুক সম্পদের অপচয় রোধ হওয়ায় দুঃখ-দৈন্যের অবকাশ থাকার কথা নয়। এত কথা যদি কবি না-ও ভেবে থাকেন, আমরা তাঁর কাব্য পাঠে বসে না হয় তা-ও ভাবলাম।
বলেছেন :
“বিহিত বিনয়, ক্ষমা, দান দয়া কর
লিপ্সা, ঈর্ষা, ক্রোধ মন্দ, সদা পরিহর ॥
গর্ব্বে বিলাসিতা আর অপব্যয় ত্যজ
না বলিয়া কাজ করে কর্ম্মবীর সাজ ॥” (জীবনের কর্তব্য)
মুসলিম বিপর্যয় মানবতারই বিপর্যয়। মুসলিম জাতি নীতি-আদর্শচ্যুত হলে এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের নীতি থেকে সরে দাঁড়ালে বিশ্বে অত্যাচারীদেরই রাজত্ব সৃষ্টি হতে পারে। মুসলমানরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজিত অঞ্চলে মানবাধিকার ও সাম্যের যথাসম্ভব প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলিম জীবন ও সমাজ এমনই যে, শাসকরা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী না হলেও তাদের জৈবনিক ও সামাজিক পরিবেশ ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ বিবেচিত হয়েছে, অনেক অধিকারও না চাইতেই দুয়ারে এসে কড়া নেড়েছে। উপাখ্যানের মতো শোনালেও এটিই ছিল বাস্তবতা এবং এজন্য মুসলিম পুনরুজ্জীবন ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র অভিযানের সেই শোর্যবীর্য কবি কল্পনায় কাব্যরূপে এসেছে। কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী সমকালীন অধঃপতিত সমাজের উদ্দেশে লিখেন ‘আক্ষেপ উচ্ছ্বাস’ (১৯০৭) কাব্যগ্রন্থে :
“এই কি সে জাতি হায়, এই কি সে মুসলমান
কর্ম্মে মত্ত, ধর্ম্মে রত, জ্বলন্ত জীবন প্রাণ!
অশ্বপৃষ্ঠে শয্যা যার, সঙ্গী ছিল তরবার
কিবা স্থলে কিবা জলে ঝঞ্ঝাগতি ছিল যার।”
সিরাজীর ‘মহাশিক্ষা’ কারবালার বিষাদময় ঘটনা অবলম্বনে বীররস প্রধান মহাকাব্য।
(চলবে)
তথ্যসূত্র
১. কোরআন মজীদ, সূরা বাকারাহ্ : ৪৩, ১১০
২. পূর্বোক্ত, সূরা তাওবা : ৬০
৩. আবু দাউদ
৪. কোরআন মজীদ, সূরা আলে ইমরান : ৯২
৫. পূর্বোক্ত, সূরা মুনাফিকুন : ১০
৬. পূর্বোক্ত, সূরা বাকারাহ্ : ২৫৪
৭. পূর্বোক্ত, সূরা বাকারাহ্ : ২১৫
(জ্যোতি ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা)