`নাহজুল বালাগাহ্’ : এক বিস্ময়কর গ্রন্থ
শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মুতাহ্হারী
মো. মুনীর হোসেন খান কর্তৃক অনূদিত
‘নাহজুল বালাগাহ্’ নামের যে সুন্দর ও মনোজ্ঞ সংকলনটি আমাদের সামনে বিদ্যমান এবং কালের আবর্তনে যা পুরনো হয়ে যায় নি, আর সময়ের উত্তরণ ও নব নব আলোকিত চিন্তাধারার আবির্ভাব যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো বৃদ্ধি করেছে তা খোদাভীরু বান্দাদের নেতা ইমাম আলী (আ.)-এর নির্বাচিত ভাষণ, দোয়া, অসিয়ত, পত্র ও সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহের সমষ্টি যা সাইয়্যেদ রাযী (রহ.) কর্তৃক এক হাজার বছর পূর্বে সংকলিত হয়েছে।
এ কথাটি সন্দেহাতীতভাবে সত্য, যেহেতু ইমাম আলী (আ.) বাগ্মী ছিলেন সেহেতু তিনি অনেক ভাষণ রচনা করেছেন, বিভিন্ন উপলক্ষে অগণিত সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী তাঁর থেকে শ্রুত হয়েছে; আর একইভাবে তিনি বিশেষ করে তাঁর খেলাফতকালে প্রচুর চিঠি-পত্রও লিখেছিলেন। পরবর্তীতে মুসলমানগণ তাঁর ভাষণ, বাণী ও পত্রাদি সযত্নে সংরক্ষণ করার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ ও মনোযোগ দেখিয়েছে।
আল্লামাহ্ মাসউদী যিনি সাইয়্যেদ রাযীরও প্রায় এক শ’ বছর পূর্বে জীবিত ছিলেন (হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে ও হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম দিকে) তিনি ‘মুরাওওয়াজুয্ যাহাব’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডে ‘তাঁর বাণী, হাদীস ও যুহ্দের (পার্থিবতা ও বস্তুবাদিতার বিপক্ষে সর্বদা সংগ্রাম রত) কতিপয় আলোকিত উদাহরণের উল্লেখ’ শিরোনামে লিখেছেন, “জনগণ বিভিন্ন উপলক্ষে ইমাম আলী প্রদত্ত ভাষণসমূহ সংরক্ষণ করেছে যা ৪৮০-এরও অধিক।” হযরত আলী (আ.) এসব ভাষণ পূর্বলিখিত খসড়া ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যৎপন্নমতিত্বের সাথে রচনা করেছিলেন। আর জনগণও ঐ সব ভাষণ হৃদয়ঙ্গম করেছে এবং কার্যত এগুলো থেকে উপকৃত হয়েছে।
আল্লামাহ্ মাসউদীর মত পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, হযরত আলীর ভাষণ কত বেশি ছিল! নাহজুল বালাগায় ২৩৯টি ভাষণ উদ্ধৃত হয়েছে, অথচ মাসউদী ৪৮০টিরও অধিক ভাষণের কথা উল্লেখ করেছেন। অধিকন্তু মুসলিম সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী হযরত আলীর বাণীসমূহ মুখস্থ ও সংরক্ষণ করার ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছেন ও অপার আগ্রহ প্রদর্শন করেছেন।
সাইয়্যেদ রাযী ও নাহজুল বালাগাহ্
সাইয়্যেদ রাযী (নাহজুল বালাগার সংকলক) ব্যক্তিগতভাবে হযরত আলীর বাণীর প্রেমিক, ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন। তিনি উঁচু মানের সাহিত্যিক, কবি ও সাহিত্য সমালোচক ছিলেন। সায়ালেবী যিনি তাঁর সমসাময়িক ছিলেন তিনি তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, “তিনি এ কালের সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব এবং ইরাকের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত সাইয়্যেদদের অন্যতম। উচ্চ বংশমর্যাদা ছাড়াও তিনি উন্নত শিষ্টাচার ও চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। তিনি আবু তালিবের বংশধর সকল কবির চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যদিও এ বংশে অনেক বড় বড় প্রতিভাবান কবি রয়েছেন। আর যদি বলি, সকল কুরাইশ গোত্রে কোন কবি তাঁর কাব্য প্রতিভার পর্যায়ে পৌঁছে নি, তাহলে আমি অসত্য কিছু বলি নি।”
সাইয়্যেদ রাযী যেহেতু সার্বিকভাবে সাহিত্য ও ইমাম আলীর বাণীসমূহের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, তাই তিনি ভাষার প্রাঞ্জলতা, বাক-অলংকার, সুন্দর বাচনভঙ্গি ও সাহিত্যিক মানের দৃষ্টিতে ইমাম আলীর বাণীসমূহ বেশি বেশি মূল্যায়ন করেছেন। এ কারণেই তিনি আলী (আ.)-এর বাণীসমূহ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে এ বিশেষত্বটি বিবেচনায় এনেছেন। অর্থাৎ হযরত আলীর ঐ সকল বাণী রাযীর দৃষ্টি বেশি বেশি আকর্ষণ করেছে যা বিশেষ বাক-অলংকার, সুন্দর বাচনভঙ্গি ও প্রাঞ্জলতার অধিকারী। এ কারণেই সাইয়্যেদ রাযী উক্ত সংকলনটির নাম ‘নাহজুল বালাগাহ্’ (বাগ্মিতার চূড়ান্ত সৌকর্য) রেখেছেন। আর এজন্যই তিনি বাণীসমূহের সূত্র, দলিল ও সনদ উল্লেখ করেন নি। তবে কিছু কিছু খুতবা ও বাণীর ক্ষেত্রে কোন বিশেষ কারণে যে পুস্তক ও গ্রন্থে উক্ত খুতবা ও বাণীটি বর্ণিত হয়েছিল তা উল্লেখ করেছেন।
ঐতিহাসিক গ্রন্থ বা হাদীসশাস্ত্র সংকলনের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে তার সনদ ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণপঞ্জী বিদ্যমান থাকা বাঞ্ছনীয়। তা না হলে ঐ ঐতিহাসিক বর্ণনা বা হাদীস সংকলনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। কিন্তু কোন সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মূল্য উক্ত সাহিত্যকর্মটির রূপ-রস, সৌন্দর্য, শোভনতা, মাধুর্য, সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আর এও বলা সম্ভব নয় যে, সাইয়্যেদ রাযী এ মহান সাহিত্যকর্মের ঐতিহাসিক ও অন্যান্য গুরত্বের প্রতি উদাসীন ছিলেন এবং তিনি কেবল এর সাহিত্যিক মানের দিকেই মনোনিবেশ করেছিলেন।
সৌভাগ্যবশত পরবর্তী যুগসমূহে বেশ কিছু ব্যক্তি নাহজুল বালাগার সূত্র, সনদ ও দলিল-প্রমাণ সংগ্রহ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর এ ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে ব্যাপক যে গ্রন্থটি রয়েছে তার নাম ‘নাহজুস্ সায়াদাহ্ ফী মুসতাদরাকে নাহজিল বালাগাহ্’। এ গ্রন্থটি মুহাম্মদ বাকের মাহমুদী নামের একজন ইরাকী গবেষক আলেমের তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ হয়েছে। মূল্যবান এ গ্রন্থে ইমাম আলীর ভাষণ, আদেশ-নিষেধ, চিঠি-পত্র, অসিয়ত, প্রার্থনা, সংক্ষিপ্ত বাণী নির্বিশেষে সকল বাণীই সংগ্রহ করা হয়েছে। এ গ্রন্থে বর্তমান ‘নাহজুল বালাগাহ্’ ও আরো অন্যান্য অংশ রয়েছে যা সাইয়্যেদ রাযী মনোনীত করেন নি অথবা তাঁর হাতের নাগালে ছিল না। বাহ্যত কিছু সংক্ষিপ্ত বাণী ব্যতীত হযরত আলীর সকল বাণীর প্রামাণ্য তথ্যসূত্র, সনদ ও নির্ভরযোগ্য দলিল-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এ গ্রন্থের ৪টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। ১
এখানে স্মর্তব্য, হযরত আলীর বাণীসমগ্র সংগ্রহ ও সংকলন কেবল সাইয়্যেদ রাযীর সাথেই সংশ্লিষ্ট নয়, অন্যান্য ব্যক্তিও এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আমেদী সংকলিত ‘গুরার ও দুরার’। প্রসিদ্ধ গবেষক জামালুদ্দীন খানসারী ফার্সী ভাষায় এ গ্রন্থটির একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন এবং তা বিশিষ্ট গবেষক ও আলেম মীর জালালুদ্দীন মুহাদ্দিস উরুমাভীর প্রচেষ্টায় তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন আলী আল-জুনদী ‘আলী ইবনে আবি তালিব : তাঁর কবিতা ও জ্ঞানগর্ভমূলক বাণীসমূহ’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় হযরত আলীর বাণীসমগ্রের বিভিন্ন সংকলন গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির উল্লেখ করেছেন। স্মর্তব্য, এসব সংকলন গ্রন্থের মধ্যে বেশ কয়েকটি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি আকারেই রয়ে গেছে যা এখনো প্রকাশিত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ:
১. দস্তুরু মাআলিমিল হিকাম, কুযাঈ কর্তৃক হস্তলিখিত।
২. নাসরুল লাআলী : এ গ্রন্থটি একজন রুশ প্রাচ্যবিদ কর্তৃক একটি বৃহৎ গ্রন্থাকারে রুশ ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
৩. হুকমু সাইয়্যেদিনা আলী : এ গ্রন্থের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিটি দারুল কুতুব আল মিসরীয়াহ্তে সংরক্ষিত আছে।
দু’টি বৈশিষ্ট্য
অতি প্রাচীনকাল থেকেই হযরত আলীর বাণীসমূহ সর্বদা দু’টি বিশেষত্বের অধিকারী এবং এ দু’টি বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্বের মাধ্যমে তাঁর বাণীসমূহকে শনাক্ত করা হয়েছে। এ দু’টি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে (১) প্রাঞ্জল ও সুন্দর বাচনভঙ্গি (بلاغت و فصاحت) এবং (২) বহুমাত্রিক অর্থাৎ বহু দিক ও মাত্রার অধিকারী হওয়া; এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যে কোন একটি বৈশিষ্ট্যই আলী (আ.)-এর বাণীসমূহ মূল্যায়ন করার জন্য যথেষ্ট। তবে ইমাম আলীর বাণীতে এ দু’টি বৈশিষ্ট্যের একত্রে সমাহারের অর্থ হচ্ছে এই যে, বিভিন্ন ধরনের প্রেক্ষাপটে ও ক্ষেত্রে, এমন কি কখনো কখনো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী ক্ষেত্রে ও প্রেক্ষাপটে তিনি বিভিন্ন বাণী ও বক্তব্য প্রদান করেছেন, অথচ সকল ক্ষেত্রেই তাঁর বাণী ও বক্তব্যের প্রাঞ্জলতা, সুন্দর বাচনভঙ্গি, সাবলীলতা ও মাধুর্য সংরক্ষিত থেকেছে। আর এর ফলে তাঁর বাণী, বক্তব্য ও কথা মু’জিযা ও কারামতের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে এবং এ কারণেই তাঁর কথা, বাণী ও বক্তব্য স্রষ্টার বাণী ও সৃষ্টির বাণীর মাঝামাঝি অবস্থানে স্থিতি লাভ করেছে। তাই তাঁর বাণী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :« فوق کلام المخلوق دون کلام الخالق » “তা সৃষ্টি অর্থাৎ মাখলুকের কথার ঊর্ধ্বে এবং স্রষ্টার কথা ও বাণীর চেয়ে নিম্নতর পর্যায়ে”।
সৌন্দর্য
নাহজুল বালাগার এ বৈশিষ্ট্য যাঁরা সাহিত্য সমালোচক এবং বচন বা কথার সৌন্দর্য ও মাধুর্য অনুধাবন করতে সক্ষম তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝাতে হবে না। আসলে সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে হয়-অনুভব করতে হয়। তাই তা ভাষায় প্রকাশ বা ব্যক্ত করা যায় না।
চৌদ্দ শ’ বছর কেটে যাবার পরও নাহজুল বালাগাহ্ আজও সেই সৌন্দর্য, মাধুর্য, আকর্ষণ শক্তি ও (গভীর অর্থ) ধারণক্ষমতার অধিকারী যা হযরত আলীর যুগে বিদ্যমান ছিল- আমরা এ বিষয়টি এখানে প্রমাণ করতে চাচ্ছি না; তবে প্রসঙ্গক্রমে জনগণের মনে এবং আলী (আ.)-এর যুগ থেকে এই একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় ব্যাপক সাধিত হওয়া সত্ত্বেও ইমাম আলীর বাণীর অলৌকিক প্রভাব সংক্রান্ত একটি আলোচনা আমরা অবশ্যই করব। আর স্বয়ং ইমাম আলীর সময় থেকেই আমরা তা আলোচনা করব।
ইমাম আলীর শিষ্যগণ, বিশেষ করে ঐ সকল শিষ্য যাঁরা বক্তৃতা ও ভাষণ দানে সক্ষম ছিলেন তাঁরা সবাই ইমাম আলীর বাণীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ইবনে আব্বাস তাঁদের অন্তর্ভুক্ত। ‘আল বায়ান ওয়াত তিবয়ীন’ গ্রন্থে জাহিয যেমন বর্ণনা করেছেন তদনুযায়ী ইবনে আব্বাস একজন শক্তিশালী বক্তা ছিলেন।২ তিনি ইমাম আলীর বাণীসমূহ শ্রবণ ও উপভোগ করার জন্য তাঁর দুর্নিবার আকাংক্ষা কখনোই গোপন করেন নি। ইমাম আলী যখন তাঁর শিকশিকিয়ার প্রসিদ্ধ ভাষণটি প্রদান করেন তখন ইবনে আব্বাস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইত্যবসরে কুফার এক অধিবাসী ধর্ম বিষয়ক কতগুলো প্রশ্নসম্বলিত একটি চিঠি পড়ার জন্য তাঁর হাতে প্রদান করে। এর ফলে আলী তাঁর ভাষণ বন্ধ করে দেন। আলী (আ.) ঐ চিঠিটি পাঠ করার পর যাতে তিনি এ ভাষণটি সমাপ্ত করেন সেজন্য তাঁর প্রতি ইবনে আব্বাসের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তাঁর অসমাপ্ত ভাষণটি আর সমাপ্ত করেন নি। ইবনে আব্বাস বলতেন, “যতটা আফসোস আমি এ ভাষণটি বন্ধ হয়ে যাবার কারণে করেছি, আমি আমার জীবনে অন্য কোন বাণী ও কথার ক্ষেত্রে তা করি নি।”
ইবনে আব্বাস আলীর একটি সংক্ষিপ্ত পত্র যা তাঁকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছিল সে ব্যাপারে বলেছেন, “রাসূলের বাণীর পরে আলীর এ বাণী থেকে আমি যতটা উপকৃত হয়েছি ততটা অন্য কোন বাণী থেকে উপকৃত হই নি।”৩
মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান যিনি ছিলেন হযরত আলীর সবচেয়ে মারাত্মক শত্রু, তিনিও ইমাম আলীর বাণীর অসাধারণ সৌন্দর্য, প্রাঞ্জলতা ও অলৌকিক সুন্দর বাচনভঙ্গির বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
মুহাক্কান ইবনে আবু মুহাক্কান হযরত আলীর পক্ষ ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার পক্ষে যোগ দেয় এবং আলীর প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ আমীর মুয়াবিয়ার হৃদয়কে সন্তুষ্ট করার জন্য বলেছিল : সবচেয়ে বড় নির্বাক ব্যক্তির কাছ থেকে আমি আপনার কাছে এসেছি।
এ ধরনের চাটুকারিতা এতটাই ঘৃণ্য ছিল যে, স্বয়ং মুয়াবিয়া ঐ ব্যক্তিকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, “তোমার জন্য আক্ষেপ! আলী কি সবচেয়ে নির্বাক ব্যক্তি? আলীর আগে কুরাইশ গোত্র বাগ্মিতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা ও সুন্দর বাচনভঙ্গির সাথে মোটেও পরিচিত ছিল না। আলী কুরাইশ গোত্রকে ভাষার প্রাঞ্জলতা, বাগ্মিতা ও সুন্দর বাচনভঙ্গি শিখিয়েছে।”
প্রভাব
যারা তাঁর (আলীর) মিম্বারের কাছে বসত তারা সবাই তাঁর বাণী, বক্তব্য ও ভাষণ দ্বারা অন্য সকলের চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে। তাঁর উপদেশসমূহ অন্তঃকরণকে তীব্রভাবে আলোড়িত করত এবং নয়নাশ্রু আনয়ন করত। আজও এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যার হৃদয় আলীর উপদেশমূলক ভাষণসমূহ পাঠ করবে অথবা শুনবে কিন্তু তার অন্তর আলোড়িত হবে না। সাইয়্যেদ রাযী ‘আল গাররা’ নামক প্রসিদ্ধ ভাষণটি সম্পর্কে বলেছেন, “ইমাম আলী (আ.) যখন এ ভাষণটি প্রদান করলেন তখন জনগণ কাঁদল এবং তাদের হৃৎকম্পন শুরু হয়ে গেল।”
হুমাম বিন শুরাইহ্ ছিলেন হযরত আলীর একনিষ্ঠ শিষ্য। তাঁর অন্তঃকরণ ছিল খোদার প্রেমে পরিপূর্ণ। তিনি বারবার তাগিদ দিয়ে ইমাম আলীকে অনুরোধ করছিলেন, তিনি যেন মুত্তাকী বান্দাদের চরিত্র ও স্বভাবের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেন। ইমাম আলী যেমন একদিকে চাচ্ছিলেন না হতাশাব্যঞ্জক উত্তর দিতে, আবার অন্যদিকে তিনি ভয় করছিলেন যে, হুমাম এ ধরনের কথা শুনে তা সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন না। এ কারণেই কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বাক্য বলে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। কিন্তু হুমাম এতে পরিতৃপ্ত হলেন না, বরং তাঁর মাঝে আগ্রহের বহ্নিশিখা আরো তীব্রভাবে প্রজ্জ্বলিত হলো। ইমাম আলীকে বলার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিতে লাগলেন। আলী (আ.) শুরু করলেন। তিনি মুত্তাকী বান্দাদের ১০৫টি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পরেও বলে যেতে লাগলেন। আর হুমামের হৃৎস্পন্দন বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তাঁর ব্যাকুল আত্মা আরো ব্যাকুল হয়ে উঠল এবং খাঁচায় বন্দী পাখির মত দেহপিঞ্জিরা ভেঙ্গে বের হয়ে যেতে চাইল। হঠাৎ এক ভয়ানক আর্তনাদ উপস্থিত সকল ব্যক্তির মনোযোগ আকর্ষণ করল। আর আর্তনাদকারী হুমাম ব্যতীত আর কেউ নয়। যখন সকলেই তাঁর শিয়রে পৌঁছল তখন তাঁর আত্মা নশ্বর দেহ ত্যাগ করে মহান আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
আলী (আ.) বললেন, “আমি ঠিক এটিই আশংকা করেছিলাম। আশ্চর্য! বলিষ্ঠ ও দৃঢ় উপদেশাবলী সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন অন্তঃকরণগুলোকে ঠিক এভাবেই প্রভাবিত করে।” আর ঠিক এমনই ছিল ইমাম আলীর বাণীসমূহের প্রতি তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া।
মহানবী (সা.)-এর পর হযরত আলী একমাত্র ব্যক্তি যাঁর বাণী সংরক্ষণ করার ব্যাপারে জনগণ বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে।
লেখক আবদুল হামীদ যিনি সাহিত্য রচনা, লেখা ও গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষেত্রে দিকপাল ও অতুলনীয় উপমা (ছিলেন) এবং হিজরী দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকে জীবিত ছিলেন,৪ তাঁর নিকট থেকে ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “লেখক আবদুল হামীদ বলেছেন : ইমাম আলীর ৭টি খুতবা মুখস্থ করেছি এবং তারপর আমার মস্তিষ্কে তা টগবগিয়ে ফুটেছে তো ফুটেছে।”
আলী আল জুনদীও বর্ণনা করেছেন, আবদুল হামীদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল : কোন্ জিনিসটি আপনাকে বাক-অলংকারশাস্ত্রের এ পর্যায়ে উন্নীত করেছে? তখন তিনি বলেছিলেন, “ঐ টাকবিশিষ্ট ব্যক্তির৫ বাণী মুখস্থকরণ।”
আবদুর রহীম বিন নুবাতাহ্ আরবী ভাষায় বক্তৃতা দানকারীদের মধ্যে কিংবদন্তী ছিলেন। তিনিও স্বীকার করেছেন যে, তিনি তাঁর নিজের চিন্তা ও অভিরুচির খোরাক ইমাম আলী (আ.) থেকে গ্রহণ করেছিলেন। নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যা গ্রন্থের ভূমিকায় ইবনে আবীল হাদীদ বর্ণনা করেছেন, তিনি (আবদুর রহীম বিন নুবাতাহ্) বলেছেন : আমি আলীর বাণীসমূহের এক শ’ অধ্যায় মুখস্থ করেছি এবং স্মরণ রেখেছি। এগুলোই হচ্ছে আমার এমন এক সম্পদ যা কখনো নিঃশেষ হবে না।
জাহিয ছিলেন প্রসিদ্ধ প্রতিভাবান সমালোচক সাহিত্যিক। তিনি হিজরী ৩য় শতকে জীবিত ছিলেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘আল বায়ান ওয়াত তিবয়ীন’ আরবী ভাষা ও সাহিত্যের চার স্তম্ভের অন্যতম বলে গণ্য।৬ জাহিয বহুবার তাঁর গ্রন্থে ইমাম আলীর বাণীর ব্যাপারে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
জাহিযের কথা ও বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়, তখন জনগণের মাঝে ইমাম আলীর প্রচুর বাণী প্রচলিত ও প্রচারিত ছিল (এবং বহুলভাবে সেগুলোর চর্চা করা হতো)।
‘আল বায়ান ওয়াত তিবয়ীন’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডে জাহিয ঐ সব ব্যক্তির আকীদা-বিশ্বাস ও অভিমত বর্ণনা করেছেন যাঁরা বিশুদ্ধতা ও মৌনতাকে প্রশংসা এবং বেশি বেশি কথা বলার নিন্দা করেছেন। জাহিয বলেছেন, “বেশি বেশি কথা যা নিন্দিত হয়েছে আসলে তা হচ্ছে : অনর্থক কথা। কিন্তু উপকারী কথা বা বাণী, অনর্থক কথা বা বাণী নয়। আর যদি তা না হয় (অর্থাৎ উপকারী কথা বা বাণী যদি অনর্থক কথাই হয়), তাহলে ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব ও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসেরও অগণিত বাণী ও কথা রয়েছে।
জাহিয তাঁর গ্রন্থের ১ম খণ্ডে নিম্নোক্ত প্রসিদ্ধ বাণীটি ইমাম আলীর নিকট থেকে উদ্ধৃত করেছেন: প্রত্যেক ব্যক্তির মূল্য যতটুকু সে জানে ঠিক ততটুকু।ﹼ
এরপর জাহিয অর্ধ পৃষ্ঠাব্যাপী ইমাম আলীর এ বাণীটির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, “আমাদের পুরো গ্রন্থটিতে যদি এ বাণী ব্যতীত আর অন্য কিছু না থাকত তাহলে সেটিই যথেষ্ট হতো। এ বাণী হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট যা কলেবরের দিক থেকে ছোট হওয়া সত্ত্বেও বেশি বাণীর প্রয়োজন মিটিয়ে দেয় আর যার অর্থ শব্দের মধ্যে লুকিয়ে না থেকে প্রকাশিত ও স্পষ্ট হয়ে যায়।”
এরপর তিনি লিখেছেন, “মহান আল্লাহ্ এ সংক্ষিপ্ত বাণীকে মহিমার পোশাক পরিধান করিয়েছেন এবং এর কথকের পবিত্র নিয়্যত ও তাকওয়ার সাথে সামঞ্জস্যশীল করে প্রজ্ঞার আলোর পর্দা দিয়ে একে সুশোভিত ও সুসজ্জিত করেছেন।”
জাহিয উক্ত গ্রন্থে সাসাআহ্ বিন সাওহানের বাগ্মিতা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “তাঁর বাগ্মিতার পক্ষে সবচেয়ে বড় দলিল হচ্ছে, ইমাম আলী (আ.) কখনো কখনো তাঁকে বক্তৃতা করতে বলতেন।”
সাইয়্যেদ রাযী ইমাম আলীর বাণী ও বক্তৃতামালার প্রশংসা করতে গিয়ে একটি প্রসিদ্ধ উক্তি করেছেন : আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) ছিলেন বাগ্মিতার উৎস; তাঁর নিকট থেকেই বাগ্মিতার যাবতীয় নিয়ম-কানুন গ্রহণ করা হয়েছে (অর্থাৎ তাঁর কাছ থেকেই বাগ্মিতার লুক্কায়িত রহস্যসমূহ উন্মোচিত ও প্রকাশিত হয়েছে)। প্রত্যেক বাগ্মীই তাঁর অনুসরণ করেছেন। প্রত্যেক ভাষাবিদ, বক্তা ও উপদেশ প্রদানকারী তাঁর কথা ও বাণী থেকে সাহায্য নিতেন, এতদ্সত্ত্বেও তিনি তাঁদের সবার চেয়ে অগ্রগামী এবং তাঁরা সবাই তাঁর থেকে পিছিয়েই থেকেছেন। কারণ তাঁর বাণী ও কথা মহান আল্লাহর জ্ঞানের নিদর্শন এবং এতে মহানবীর বাণীর সৌরভ বিদ্যমান।
ইবনে আবীল হাদীদ হিজরী ৭ম শতাব্দীর একজন মু’তাযিলা মতবাদ অনুসারী আলেম ছিলেন। তিনি একজন দক্ষতাসম্পন্ন সাহিত্যিক এবং অনবদ্য কাব্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি ইমাম আলীর বাণী ও বক্তৃতার প্রতি খুবই অনুরক্ত ছিলেন। তিনি বারবার তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে হযরত আলীর বাণী, বক্তব্য ও বক্তৃতাসমূহের প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “আসলে আলীর বাণী মহান স্রষ্টার বাণীর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের এবং সৃষ্টির বাণী অপেক্ষা উঁচু মানের। সকলেই তাঁর নিকট থেকে বক্তৃতা প্রদানের কৌশল এবং লিখন কার্যক্রম শিখেছে।...” এতটুকুই যথেষ্ট যে, জনগণ ইমাম আলীর বাণী ও বক্তৃতাসমূহের দশ ভাগের এক ভাগ, বরং বিশ ভাগের এক ভাগ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু তারা মহানবী (সা.)-এর আর কোন সাহাবীর বাণী এভাবে এত আগ্রহ সহকারে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে নি যদিও তাঁদের মধ্যে বহু বাগ্মীও ছিলেন। এতটুকু যথেষ্ট যে, ‘আল বায়ান ওয়াত তিবয়ীন’ ও অন্য সকল গ্রন্থে জাহিযের মত ব্যক্তিগণ তাঁর প্রশংসা করেছেন।
ইবনে আবীল হাদীদ মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে মিসরের পতন এবং মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের শাহাদাতের পর আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের কাছে ইমাম আলীর প্রেরিত চিঠির ব্যাখ্যায় বলেছেন, “বাগ্মিতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা ও সাবলীলতা লক্ষ্য করুন, তা কিভাবে নিজের লাগাম ও নিয়ন্ত্রণকে এ ব্যক্তির (আলী) হাতে সোপর্দ করেছে। শব্দসমূহের বিস্ময়কর শৃঙ্খলা প্রত্যক্ষ করুন। সেগুলো একের পর এক আসছে এবং তাঁর ইখতিয়ারেই তা রয়েছে যেন প্রস্রবণ ও ঝরনার মত যা নিজে নিজেই এবং কোন প্রকার বাধা ছাড়াই মাটি থেকে উৎসারিত হয়। সুবহানাল্লাহ্! একজন আরব যুবক পবিত্র মক্কার মত কোন শহরে কোন দার্শনিক ব্যক্তির সাহচর্যে না এসেই তত্ত্বগত প্রজ্ঞা ও দর্শন-এর ক্ষেত্রে তাঁর বাণী, বক্তব্য ও ভাষণ প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের বাণী ও কথার চেয়ে শ্রেষ্ঠ; তিনি বাস্তবায়নযোগ্য প্রজ্ঞা ও দর্শন-এর অনুসারীদের সাথেও বসবাস করেন নি। এতদ্সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে তাঁর বাণী সক্রেটিসের বাণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তিনি সাহসী ও বীরদের মাঝেও প্রতিপালিত হন নি। কারণ পবিত্র মক্কার অধিবাসিগণ ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন ছিল এবং তারা যোদ্ধা ছিল না, এতদ্সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে সাহসী ও সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। কার্যকলাপ থেকে প্রমাণিত হয়, তিনি ধরার বুকে পথ চলেছেন।” খলীল বিন আহমদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল : আলী কি সবচেয়ে সাহসী না আম্বাসাহ্ ও বুসতাম? তখন তিনি বলেছিলেন, “আম্বাসাহ্ ও বুসতামকে মানবমণ্ডলীর সাথে তুলনা করা যায় কিন্তু আলী তো মানবমণ্ডলীর ঊর্ধ্বে (অর্থাৎ কোন মানবীয় বীরের বীরত্বকে আলীর বীরত্বের সাথে তুলনাই করা যায় না)। এ ব্যক্তি (আলী) সুবহান বিন ওয়ায়েল ও কাস বিন সায়েদার চেয়েও প্রাঞ্জলভাষী। আর এটি প্রমাণিত সত্য। অথচ তিনি (আলী) কুরাইশ বংশীয় ছিলেন এবং কুরাইশগণ আবরদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চারুবাক ও প্রাঞ্জলভাষী ছিল না, বরং জুরহুম গোত্র আরবদের মধ্যে বাগ্মিতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা ও সাবলীলতা এবং বাকপটুতার ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্র বলে বিবেচিত ছিল যদিও তারা অতি চালাক ছিল না...।”
বর্তমান যুগের দর্পণে ইমাম আলীর বাণীসমূহ
বিগত চৌদ্দ শ’ বছর থেকে এখন পর্যন্ত এ পৃথিবী হাজার বর্ণ ও রূপ ধারণ করেছে; কৃষ্টি-সভ্যতা পরিবর্তিত হয়েছে এবং সেই সাথে রুচিবোধেও পরিবর্তন এসেছে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, প্রাচীন কৃষ্টি-সভ্যতা ও সেকেলে পুরনো রুচিবোধের কাছে ইমাম আলীর বাণী, কথা ও ভাষণসমূহ পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু আধুনিক রুচিবোধ ও চিন্তাধারায় তা ভিন্নভাবে মূল্যায়িত হবে। তবে আমাদের অবশ্যই জানা থাকা উচিত, কি বাহ্যিক আঙ্গিক, কি অন্ত র্নিহিত অর্থের দৃষ্টিকোণ- কোন দিক থেকে ইমাম আলীর বাণীর স্থান ও কালগত সীমাবদ্ধতা নেই। তাঁর বাণী মানবিক ও বিশ্বজনীন। আমরা এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। তবে এ বিষয়ে অতীতে যে সব মন্তব্য করা হয়েছে সেগুলোর পাশাপাশি আমরা বর্তমান যুগের বিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি এখানে উপস্থাপন করব।
মরহুম শেখ মুহাম্মদ আবদুহু যিনি মিসরের ভূতপূর্ব মুফতী ছিলেন তিনি প্রবাসে অবস্থান কালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই নাহজুল বালাগার সাথে পরিচিত হন। এ পরিচিতি তাঁকে নাহজুল বালাগার একান্ত অনুরাগীতে পরিণত করে। এর ফলে তিনি এ পবিত্র গ্রন্থটি ব্যাখ্যা করেন এবং আরব বিশ্বের আধুনিক যুব প্রজন্মকে এ গ্রন্থটির সাথে পরিচিত করিয়ে দেন।
তিনি নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যার ভূমিকায় লিখেছেন, “সমগ্র আরবী ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বিশ্বাস করে না পবিত্র কোরআন ও মহানবীর বাণীর পরে আলীর বাণী ও কথা সবচেয়ে বিশুদ্ধ, মর্যাদাবান, প্রাঞ্জল-সাবলীল, মাধুর্যমণ্ডিত, গভীর অর্থ ও তাৎপর্যবহ এবং ব্যাপক ও সর্বজনীন।” কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন আলী আল জুন্দী ‘আলী ইবনে আবি তালিব : “শে’রুহু ও হিকামুহু” (আলী ইবনে আবি তালিব : তাঁর কবিতা ও জ্ঞানগর্ভমূলক বাণীসমূহ) নামক গ্রন্থে ইমাম আলীর গদ্য-সাহিত্য সম্পর্কে লিখেছেন, “এ সব বাণী ও কথায় এমন এক বিশেষ ধরনের সংগীতের ঝংকার ও মূর্ছনা (বিদ্যমান) রয়েছে যা আবেগ-অনুভূতির গভীরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। অন্ত্যমিলবিশিষ্ট বা ঝংকারপূর্ণ কবিতা বা (গদ্য) বক্তব্যের মাপকাঠিতে তা এতটা সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলিত যে, তা গদ্যমিশ্রিত পদ্য বা কাব্য বলা যায়।”
তিনি কুদামাহ্ ইবনে জাফর থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, “কেউ কেউ সংক্ষিপ্ত বাণী রচনায় সিদ্ধহস্ত এবং কেউ কেউ দীর্ঘ বক্তৃতা রচনার ক্ষেত্রে পারদর্শী; আর ইমাম আলী (আ.) যেমন সকল ফজীলত ও মর্তবার ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগামী ছিলেন ঠিক তদ্রুপ এ দু’ ক্ষেত্রেও (সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী এবং দীর্ঘ বক্তৃতা রচনার ক্ষেত্রে) সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগামী ছিলেন।”
সমসাময়িক প্রসিদ্ধ মিসরীয় লেখক ও সাহিত্যিক ত্বাহা হুসাইন ‘আলী ওয়া বানুহু’ (আলী ও তাঁর বংশধরগণ) নামক গ্রন্থে এমন এক ব্যক্তির কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যে উটের যুদ্ধ (জঙ্গে জামাল) চলাকালে সংশয়গ্রস্ত হয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেছিল : তালহা ও যুবাইয়েরের মত ব্যক্তিরা কিভাবে ভুল পথে থাকতে পারেন? ঐ লোকটি তার মনের এ কথা আলীর কাছে উত্থাপন করেছিল এবং তাঁকে বলেছিল, “এ ধরনের বিরাট ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিরা কি ভুল পথে যেতে পারেন?” তখন আলী (আ.) তাকে বলেছিলেন, “তুমি মারাত্মক ভুলের মধ্যে আছ (তুমি বিপরীত কাজটিই করেছ; সত্য ও মিথ্যাকে ব্যক্তিসমূহের মর্যাদা ও অপদস্থতার মাপকাঠি বিবেচনা করার পরিবর্তে ব্যক্তিবর্গের মর্যাদা ও হীনতা-দীনতা যা আগে থেকে ধারণা করে রেখেছিলে তা সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি বলে নির্ধারিত করেছ। তুমি সত্যকে কি ব্যক্তিগণের মর্যাদার সাথে তুলনা করে চিনতে চাও? এর বিপরীত আচরণ কর [অর্থাৎ সত্যের মাপকাঠিতে ব্যক্তিদেরকে চেনার চেষ্টা কর]), সর্বাগ্রে সত্যকে চেন, তাহলে সত্যপন্থীদেরকেও চিনতে পারবে। আর মিথ্যাকে চিনতে চেষ্টা কর তাহলে মিথ্যাপন্থীদেরকেও চিনতে পারবে।...” তখন কে সত্যপন্থী ও সত্যের সমর্থক এবং কে মিথ্যাপন্থী ও মিথ্যার সমর্থক তা তোমার কাছে গুরুত্ববহ হবে না। আর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ভুল করা বা ভুলের মধ্যে থাকার বিষয়টিও তোমার কাছে বিস্ময়কর লাগবে না এবং এতে তুমি আর কখনো সংশয়গ্রস্তও হবে না।
ত্বাহা হুসাইন উপরোক্ত বাক্যগুলো উদ্ধৃত করার পর লিখেছেন, “আমি ওহী ও মহান আল্লাহর বাণীর (পবিত্র কোরআন) পর এই উত্তরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত মহিমান্বিত ও বলিষ্ঠ উত্তর প্রত্যক্ষ করি নি এবং জানিও না।”
‘আমীরুল বায়ান’ (বাগ্মিতা ও ভাষণের নেতা) উপাধিতে ভূষিত শাকীব আর্সলান সমসাময়িক কালের অন্যতম প্রতিথযশা আরব সাহিত্যিক ও লেখক। মিশরে তাঁর সম্মানে আয়োজিত এক সভায় একজন আলোচক বক্তব্য প্রদানকালে বলেছিলেন, “ইসলামের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থে কেবল দু’ ব্যক্তি ‘আমীরুল বায়ান’ নামকরণের উপযুক্ত। তাঁদের একজন আলী ইবনে আবি তালিব এবং অপর ব্যক্তি হলেন শাকীব।”
শাকীব আর্সলান এ ধরনের উক্তিতে খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং বক্তৃতা-মঞ্চে গিয়ে তাঁর এ বন্ধু যিনি এ ধরনের একটি তুলনা করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলেন, “আমি কোথায়? আর আলী ইবনে আবি তালিব কোথায়? আমি তো আলীর জুতার ফিতার সমান ও উপযুক্ত নই।”৭
সমসাময়িক লেবাননী খ্রিস্টান লেখক ‘মিখাইল নাঈমাহ্’ প্রখ্যাত লেবাননী খ্রিস্টান লেখক জর্জ জুরদাক প্রণীত ‘আল ইমাম আলী’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “আলী কেবল যুদ্ধের ময়দানেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না, বরং তিনি সকল ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি আন্তরিকতার ক্ষেত্রে, চিত্তের পবিত্রতা, অতীব চিত্তাকর্ষক বাণী ও বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে, প্রকৃত মানবিকতার ক্ষেত্রে, বিশ্বাস বা ঈমানের উত্তাপের ক্ষেত্রে, গৌরবোজ্জ্বল প্রশান্তির ক্ষেত্রে, মজলুমদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে, যে কোন অবস্থায় সত্য ও প্রকৃত বাস্তবতা প্রকাশিত হলে সেই সত্য ও বাস্তবতার প্রতি আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ও সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন।
এখানেই আমরা আমাদের আলোচনার ইতি টানব। আর এর চেয়ে বেশি আলীর প্রশংসায় অন্যদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেব না। ইমাম আলীর বাণীর প্রশংসাকারী আসলে নিজেরই প্রশংসাকারী। কবির ভাষায় : সূর্যের প্রশংসাকারী আসলে নিজেরই প্রশংসাকারী।
আমাদের বক্তব্য এখানে স্বয়ং ইমাম আলীর বক্তব্য ও বাণী দিয়েই শেষ করব। একদিন ইমাম আলীর একজন সাথী একটি ভাষণ দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি ভাষণ দিতে পারলেন না। তাঁর কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আলী (আ.) বললেন, “নিশ্চয়ই কণ্ঠ (ভাষা) ও বাকশক্তি মানুষের একটি অঙ্গ মাত্র এবং তা মন ও অনুধাবন শক্তিরই অধীন। যদি তার মন, অনুধাবন ও স্মরণশক্তি স্ফুটিত না হয় এবং পশ্চাৎগামী হয়ে যায় তখন তার কণ্ঠ, ভাষা ও বাকশক্তি আর কোন কাজেই আসবে না। কিন্তু যখন মানুষের মন, অনুধাবন ক্ষমতা ও স্মরণশক্তি উন্মুক্ত ও প্রস্ফুটিত হবে তখন তা কণ্ঠকে (বাকশক্তিকে) আর সুযোগ দেবে না।” এরপর তিনি বললেন, “নিশ্চয় আমরা (আহলে বাইত) বাণী, ভাষা ও বাগ্মিতার আমীর; ভাষাবৃক্ষের মূল আমাদের মধ্যেই বিস্তার লাভ করেছে, সুগভীরে গ্রোথিত রয়েছে এবং এর ডালপালাকে আমাদের ওপরেই মেলে রেখেছে।”৮
জাহিয তাঁর ‘আল বায়ান ওয়াত তিবয়ীন’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসান ইবনে আলী (আবদুল্লাহ্ মাহ্য নামেও পরিচিত) থেকে বর্ণনা করেছেন : আলী (আ.) বলেছেন : পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমরা অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। উক্ত পাঁচটি বৈশিষ্ট্য : বাগ্মিতা, বাক-অলংকার ও ভাষার প্রাঞ্জলতা-সাবলীলতা, মুখমণ্ডলের (দৈহিক) সৌন্দর্য, ক্ষমা, সাহসিকতা ও বীরত্ব এবং নারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা।৯
এখন আমরা ইমাম আলীর বাণী ও কথার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি অর্থাৎ তাঁর বাণীসমূহের অন্তর্নিহিত অর্থের বহুমাত্রিক হবার বিষয়টি আলোচনা করব। আর এটিই হচ্ছে আমাদের এতদ্সংক্রান্ত প্রবন্ধসমূহের মূল আলোচ্য বিষয়।
শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মসমূহ
প্রতি জাতিরই এমন সব সাহিত্যিক কীর্তি আছে যা শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বলে গণ্য। গ্রীক ও অ-গ্রীক জাতির প্রাচীন শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মসমূহ এবং ইতালি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশ ও জাতির আধুনিক যুগের বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের কথা বাদই দিলাম এবং এগুলোর আলোচনা ঐ সব ব্যক্তির যিম্মায় ন্যস্ত করলাম যারা ঐ সব ভাষা ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত। আর এ সকল সাহিত্যকর্ম, অবদান ও কীর্তিসমূহের বিচার করার যোগ্যতা একমাত্র তাদেরই। আমাদের আলোচনাকে আরবী ও ফার্সী ভাষায় যে সব শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম ও কীর্তি রয়েছে কেবল সেগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। কারণ আমরা কম-বেশি এগুলো বুঝতে ও উপলব্ধি করতে সক্ষম।
অবশ্য আরবী ও ফার্সী ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মসমূহের ব্যাপারে সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ একান্ত ভাবে সাহিত্যবিশারদ ও এ ভাষাদ্বয়ের বিশেষজ্ঞদের সাথেই জড়িত। এ সকল সাহিত্যিক শিল্পকর্ম বিশেষ একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম; তবে সকল দিক থেকে নয়; আর সঠিকভাবে বলতে গেলে, এ সকল শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শিল্পকর্মের রচয়িতাগণ কেবল বিশেষ এক সীমিত ক্ষেত্রে তাঁদের শৈল্পিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন; প্রকৃতপক্ষে তাঁদের শৈল্পিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য সুনির্দিষ্ট ও সীমিত ক্ষেত্র ও বিষয়েই নিবদ্ধ ছিল। আর যদি তাঁরা কখনো তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের গণ্ডী থেকে বের হয়েছেন অমনি যেন আকাশ থেকে ভূ-তলে পতিত হয়েছেন।
ফার্সী ভাষায় মরমী (আধ্যাত্মিক) গযল বা প্রেম-গীতি, সাধারণ গযল, উপদেশমূলক কাব্য, আত্মিক-আধ্যাত্মিক উপমা ও প্রবন্ধনির্ভর কাব্য, বীরত্বগাথা, কাসীদাহ্ (প্রশংসা বা নিন্দাবাচক কবিতা বা শোকগাথা) ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহে অনেক শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ও সাহিত্যিক নিদর্শন রয়েছে। তবে আমাদের জানামতে আমাদের যে সব কবি বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের কেউই সাহিত্যের সকল ক্ষেত্র ও অঙ্গনে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শিল্পকলা ও নিদর্শন রচনা করতে সক্ষম হন নি।
মরমী গযলে হাফিয, উপদেশমূলক কাব্য ও সাধারণ গযল রচনায় সা’দী, বীরত্বগাথা রচনায় ফেরদৌসী, আধ্যাত্মিক অতীন্দ্রিয়বাদী সূক্ষ্মদর্শী চিন্তা ও উপমা প্রবাদনির্ভর কাব্য রচনায় মৌলাভী (মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী), দার্শনিক দুঃখবাদমূলক কাব্যে উমর খৈয়াম, প্রেমোপাখ্যান ইত্যাদি রচনায় কবি নিযামী বিশিষ্ট শৈল্পিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন এবং বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন। আর এ কারণেই এ সব বিষয়ে লিখিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কর্মসমূহের মধ্যে পারস্পরিক তুলনা এবং একটির ওপর আরেকটিকে প্রাধান্য দেয়া সম্ভব নয়। বড়জোর বলা যায় এ সব কবি-সাহিত্যিকের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্র ও অঙ্গনে দিকপাল এবং প্রথম স্থানের অধিকারী। আর এ সব প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে কোন একজনও তাঁর নিজ ক্ষেত্রের গণ্ডী পেরিয়ে কখনো কখনো অন্য কোন অঙ্গনে প্রবেশ করেছেন তখন নতুন ক্ষেত্র ও অঙ্গনে তাঁদের রচিত সাহিত্যকর্ম এবং যে ক্ষেত্রে তাঁরা সিদ্ধহস্ত সে ক্ষেত্রে তাঁদের সাহিত্যকর্মের গুণগত মানে আকাশ-পাতাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে।
কি জাহেলিয়াতের যুগের, কি ইসলামী যুগের-সকল আরব কবির অবস্থাও ঠিক এমনই। নাহজুল বালাগায় বর্ণিত হয়েছে যে, একবার হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করা হলো : আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “এ সকল কবি সবাই সাহিত্যের একই শাখায় কাব্য রচনা করেন নি (সকলে একই ময়দানে অশ্ব চালনা করেন নি) যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে, তাঁদের মধ্য থেকে কোন্ কবি অন্য সকলের চেয়ে অগ্রগামী ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছেন।” এরপর তিনি বললেন, “আর এ ব্যাপারে যদি মন্তব্য করতেই হয় তাহলে বলতে হয় ঐ ভ্রষ্ট বাদশাহ (অর্থাৎ ইমরাউল কায়েস) আরবের সকল কবির চেয়ে অগ্রগামী।”
ইবনে আবীল হাদীদ ‘নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যা’ গ্রন্থে আলী (আ.)-এর উপরোক্ত বাক্যটির উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে সনদসহ নিম্নোক্ত কাহিনীটি বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “হযরত আলী রমযান মাসে প্রতিটি রজনীতে জনগণকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করতেন এবং তাদেরকে মাংসের ব্যঞ্জন খাওয়াতেন। কিন্তু তিনি নিজে ঐ খাবার খেতেন না। নৈশভোজ শেষ হলে তিনি জনগণের উদ্দেশে ভাষণ এবং তাদেরকে উপদেশ দিতেন। এক রাতে আমন্ত্রিত মেহমানগণ নৈশভোজ চলাকালে অতীত কালের কবিদের ব্যাপারে আলোচনায় লিপ্ত হন। ভোজ শেষ হলে হযরত আলী (আ.) আলোচনায় অংশ গ্রহণ করলেন এবং বললেন : তোমাদের কাজ-কর্মের মাপকাঠি (হচ্ছে) ধর্ম। তাকওয়া হচ্ছে তোমাদের রক্ষাকবচ। শিষ্টাচার তোমাদের অলংকার। আর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা হচ্ছে তোমাদের মানসম্মানের দুর্গ। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আবুল আসওয়াদ দু’আলী ছিলেন যিনি ইতোপূর্বে কবিদের ব্যাপারে যে আলোচনা হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে ইমাম আলী বললেন : সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কে ছিলেন- এ ব্যাপারে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর। তখন আবুল আসওয়াদ দু’আলী আবু দাউদ আয়াদীর একটি কবিতা পাঠ করলেন এবং বললেন : আমার অভিমত হচ্ছে এ ব্যক্তি (আবু দাউদ) সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। ইমাম আলী তখন বললেন : তুমি ভুল বললে। আসলে বাস্তবতা এমনটি নয়। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ যখন দেখলেন, যে বিষয়টি ইতোপূর্বে তাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল সে ব্যাপারে ইমাম আলী (আ.) আগ্রহ দেখিয়েছেন তখন তাঁরা সমস্বরে বলে উঠলেন : হে আমীরুল মুমিনীন! এ ব্যাপারে আপনি আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন। আপনার দৃষ্টিতে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কে? আলী (আ.) বললেন : এ ব্যাপারে রায় দেয়া সম্ভব নয়। কারণ যদি তাঁরা (সকল কবি) একই দিকে অর্থাৎ কবিতা ও কাব্যের কোন একটি নির্দিষ্ট শাখায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন তাহলে তখন তাঁদের ব্যাপারে বিচার করে আমরা বিজয়ীর নাম ঘোষণা করতে পারতাম। আর যদি আমাকে অবশ্যই অভিমত ব্যক্ত করতে হয় তাহলে বলতে হবে, যে ব্যক্তি ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে এবং ভয়ে ভীত না হয়ে (বরং কেবল খেয়াল বা কল্পনা শক্তির প্রভাবে এবং কাব্যরসের বশবর্তী হয়ে) কবিতা রচনা করেছে সেই অন্য সবার ওপর অগ্রগামী। তখন সবাই জিজ্ঞেস করল : হে আমীরুল মুমিনীন! সে কে? তখন তিনি বললেন : ভ্রষ্ট বাদশাহ ইমরাউল কায়েস।”
কথিত আছে, প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ (নাহু শাস্ত্র) ইউনুসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল : কে জাহেলিয়াত-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি? তখন ইউনুস বলেছিলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ইমরাউল কায়েস যখন সে অশ্বারোহী (অর্থাৎ যখন তার সাহসিকতা বোধ তাকে উদ্বুদ্ধ করত এবং যখন সে বীরগাথা গাইতে ইচ্ছা করত); অপর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি নাবেগাহ্ আয্-যুবইয়ানী যখন সে ভীত ও শংকিত হয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইত। আর অপর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি যুহাইর ইবনে আবি সালামাহ্ যখন সে কিছু পছন্দ করে তা বর্ণনা করার ইচ্ছা করত। আর অপর একজন সর্বশ্রেষ্ঠ কবি আ’শা যখন সে সংগীতের মূর্ছনায় উদাস ও উন্মত্ত হয়ে পড়ত।”
এ ব্যক্তির একান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ সব কবির প্রত্যেক্যেই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন যোগ্যতাসম্পন্ন ও সিদ্ধহস্ত। আর তাঁরা যে সব শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক নিদর্শন ও শিল্পকর্ম রচনা করেছেন তা তাঁরা সেই সকল ক্ষেত্রেই করেছেন যে সব ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভা ও যোগ্যতা ছিল। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন তাঁর নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিভাবান ও দিকপাল এবং তাঁদের নিজস্ব ক্ষেত্রের বাইরে তাঁরা তাঁদের প্রতিভা প্রয়োগ করেন নি।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ইমাম আলী
আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীসমূহ যা আজ ‘নাহজুল বালাগাহ্’ নামে আমাদের হাতে বিদ্যমান তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট কোন ক্ষেত্র বা বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। ইমাম আলী কেবল একটি ময়দান বা ক্ষেত্রে অশ্ব চালনা করেন নি, বরং তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অশ্ব চালনা করেছেন যা ছিল কখনো কখনো পরস্পর বিপরীতধর্মী। ‘নাহজুল বালাগাহ্’ একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শিল্পকর্ম, তবে তা উপদেশ, বীরত্বগাথা অথবা প্রেমগীতি ও প্রেমোপাখ্যান অথবা প্রশংসা গীত ও ব্যঙ্গ কাব্যের মত নির্দিষ্ট একটি মাত্র বিষয় ও ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিভিন্ন ক্ষেত্র ও বিষয়কে কেন্দ্র করেই রচিত।
যেহেতু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে, তবে যদিও একটি ক্ষেত্র বা বিষয়ে লিখিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম সংখ্যায় খুব বেশি নয়, বরং সীমিত, যা হোক, এতদ্সত্ত্বেও তা আছে। আর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের পর্যায়ে নয়, বরং বিভিন্ন বিষয়ে স্বাভাবিক ও সাধারণ মানগত পর্যায়ে রচিত একক সাহিত্যকর্মের সংখ্যাও প্রচুর। তবে যে বাণী শ্রেষ্ঠ কর্ম এবং কোন একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, বরং সকল ক্ষেত্র ও বিষয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট তা হচ্ছে ‘নাহজুল বালাগাহ্’।
আমরা পবিত্র কোরআনের কথা বাদই দিলাম। কোন শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে কি যা ‘নাহজুল বালাগা’র মত বৈচিত্র্যময়? ভাষা বা কথা আত্মারই প্রতিনিধি। প্রত্যেক ব্যক্তির ভাষা ঐ জগতের সাথে সম্পর্কিত যার সাথে ঐ ভাষা বা বাণীর কথকের আত্মাও জড়িত। স্বভাবতই যে বাণী বা কথা বহু জগতের সাথে জড়িত তা এমন এক মনোবল ও মানসিকতার নির্দেশক যা কোন একটি নির্দিষ্ট জগতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। যেহেতু আলীর আত্মা কোন নির্দিষ্ট জগতের সাথে জড়িত নয়, বরং তা সকল জগতেই উপস্থিত; আর আধ্যাত্মিক সাধকদের পরিভাষায় তাঁর আত্মা ইনসানে কামিল, একটি সামগ্রিক মহাবিশ্ব ও পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্বজগৎ, সকল মাননীয় সত্তাগত গুণের আধার এবং সকল পর্যায় সমন্বিত, সেহেতু তাঁর বাণীও কোন নির্দিষ্ট জগতে সীমাবদ্ধ নয়। ইমাম আলীর বাণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, আমাদের এ যুগের বহুল প্রচলিত পরিভাষা অনুসারে তা বহুমাত্রিক এবং তা একমাত্রিক নয়।
ইমাম আলীর বাণী ও তাঁর আত্মার বহুমাত্রিক হবার বিশেষত্বটি এমন কোন বিষয় নয় যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তা এমনই এক বিষয় যা ন্যূনতম পক্ষে ১০০০ বছর আগে থেকেই বিস্ময়াবোধের সৃষ্টি করেছিল। সাইয়্যেদ রাযী যিনি ১০০০ বছর পূর্বে জীবিত ছিলেন তিনি এ বিষয়টি অনুধাবন করেছেন এবং এ ব্যাপারে তীব্র অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, “আলীর অত্যাশ্চর্যজনক বিষয়াদি যা কেবল তাঁর মাঝেই সীমাবদ্ধ এবং কেউই এ ক্ষেত্রে তাঁর শরীক ও সমকক্ষ নয়, তা হচ্ছে, দুনিয়াবিমুখতা, সদুপদেশ ও সতর্কীকরণ সংক্রান্ত তাঁর যে সব বাণী আছে সেগুলো নিয়ে যদি কেউ স্বতন্ত্র ও গভীরভাবে চিন্তা করে এবং সাময়িকভাবে ভুলে যায় যে, এ বাণীর (নাহজুল বালাগাহ্ গ্রন্থের) রচয়িতা নিজেই এক বিরাট ও সুমহান সামাজিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তাঁর নির্দেশ সকল স্থানে কার্যকর এবং তিনি নিজেই তাঁর যুগের একচ্ছত্র অধিপতি, তাহলে সে মোটেও সন্দেহ করবে না যে, এসব বাণী ঐ ব্যক্তির যিনি তাকওয়া- পরহেজগারী ও দুনিয়াবিমুখতা ব্যতীত আর কিছুই চেনেন না এবং মানেন না, ইবাদত-বন্দেগী ও যিকির করা ব্যতীত যাঁর আর কোন কাজ নেই, যিনি গৃহের কোণ অথবা পাহাড়ের পাদদেশকে একাকী নিভৃতে ইবাদত করার জন্য বেছে নিয়েছেন, যিনি নিজের কণ্ঠ ও স্বরধ্বনি ব্যতীত আর কিছুই শুনতে পান না, নিজ সত্তা ব্যতীত আর কিছুই যাঁর দৃষ্টিগোচর হয় না এবং যিনি সমাজ ও সমাজ জীবনের কোলাহল সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।
কেউ বিশ্বাস করবে না যে, দুনিয়াবিমুখতা, সতর্কীকরণ ও সদুপদেশের ক্ষেত্রে এসব সুন্দর কথা ও বাণী ঐ ব্যক্তির যিনি যুদ্ধের ময়দানে শত্রু সেনাদলের মাঝে অনুপ্রবেশ করেন, রণক্ষেত্রে যাঁর (নাঙ্গা) তলোয়ার ঝিলিক দেয় এবং শত্রুদের মাথা কাটার জন্য প্রস্তুত, যিনি বীরদেরকে ধরাশায়ী করেন, যাঁর তরবারি থেকে শত্রুদের রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে, অথচ ঠিক এ অবস্থায়ই তিনি আবার সাধক পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে ত্যাগী এবং ইবাদতকারী বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইবাদতকারী।” এরপর সাইয়্যেদ রাযী বলেছেন, “আমি এ বিষয়টি বহুবার আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে উপস্থাপন করেছি। আর এভাবে আমি তাদের বিস্ময়ানুভূতির উদ্রেক ঘটিয়েছি।” শেখ মুহাম্মদ আবদুহুও নাহজুল বালাগার এই বিশেষ দিক ও বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ এর বহুমাত্রিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। নাহজুল বালাগায় অন্তরায়সমূহের পরিবর্তন ও বিভিন্ন জগতের দিকে পাঠককে পরিচালিত করার বিষয়টি অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাঁকে বিস্ময়াভিভূত করেছে। তিনি এ বিষয়টি ‘নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যা’-এর ভূমিকায় ব্যক্ত করেছেন।
আলী (আ.)-এর ভাষা ও বাণীসমূহ ছাড়াও সার্বিকভাবে তাঁর আত্মা ব্যাপক, সর্বজনীন ও বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আর এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি সর্বদা প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক, রাত্রি জাগরণকারী, ইবাদতকারী। তিনি ইবাদতের মিহরাবে ক্রন্দন করতেন এবং যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল অকুতোভয় সৈনিক। তিনি ছিলেন দয়ালু ও হৃদয়বান অভিভাবক। তিনি ছিলেন গভীর চিন্তাশীল ও প্রজ্ঞাবান দার্শনিক। তিনি ছিলেন যোগ্য সেনাপতি ও নেতা। তিনি যেমন শিক্ষক ছিলেন তেমনি ছিলেন বক্তা, বিচারপতি, মুফতী, কৃষিজীবী, লেখক অর্থাৎ তিনি ছিলেন ‘ইনসানে কামিল’। মানব জাতির সকল আত্মিক-আধ্যাত্মিক দিক-পর্যায় ও জগৎসমূহ ছিল তাঁর নখদর্পণে। সাফীউদ্দীন হিল্লী (মৃ. ৮ম হিজরী) আলী (আ.) সম্পর্কে বলেছেন,
جمعت في صفاتك الأضداد - ولهذا عزت لك الأنداد
زاهد حاكم حليم شجاع - فاتك ناسك فقير جواد
شيم ما جمعن في بشر قط - ولا حاز مثلهن العباد
خلق يخجل النسيم من اللطف - وبأس يذوب منه الجماد
جل معناك أن تحيط به - الشعر و يحصي صفاتك النقاد
তোমার গুণাবলীর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছে পরস্পর বিপরীতধর্মী বিষয়সমূহ
আর এ কারণেই তোমার প্রতি আকৃষ্ট ও বন্ধু ভাবাপন্ন হয়েছে শত্রুগণ
তুমি ত্যাগী (সাধক), শাসনকর্তা, ধৈর্যশীল, সাহসী
শত্রুনিধনকারী, উৎসর্গকারী, দরিদ্র ও দানশীল
কভু যদি কোন মানবের মাঝে হয় এগুলোর সমাবেশ তাহলে তা হবে কতই না প্রশংসনীয়
এসব বৈশিষ্ট্যের ন্যায় কোন কিছুই কোন মানুষ কভু করে নি অর্জন
তোমার স্বভাব-চরিত্রের কমনীয়তা ভোরের মৃদুমন্দ সমীরণকেও করে লজ্জিত
আর তোমার শক্তি ও সাহসের কাছে কঠিন পাথরও হয় বিগলিত
তোমার মান-মর্যাদা এতটা মহান ও উচ্চ যে, তা কাব্যে করা যায় না প্রকাশ
আর না গণনাকারী তোমার গুণাবলী গণনা করতে সক্ষম।
এ সব কিছু বাদ দিলেও অপর একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এটি যে, আলী (আ.) যদিও আধ্যাত্মিকতা ও অজড় বিষয়াদির ব্যাপারে বক্তব্য রেখেছেন তবুও তিনি ভাষার প্রাঞ্জলতা সাবলীলতা, বলিষ্ঠতা ও মাধুর্যকে পূর্ণত্বের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। মদ, প্রেমাস্পদ, আত্মগৌরব ও এ ধরনের বিষয়সমূহ ইমাম আলী আলোচনা করেন নি যেগুলোর ব্যাপারে কথা বলা ও আলোচনার ক্ষেত্র উন্মুক্ত রয়েছে। অধিকন্তু তিনি কথা বলার জন্য বা নিজের ভাষা ও বাগ্মিতার শৈল্পিক নৈপুণ্য প্রকাশ করার জন্য কথা বলেন নি, বক্তৃতা দেন নি। ভাষা ছিল তাঁর কাছে মাধ্যম; তবে তা উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চাইতেন না এভাবে তাঁর নিজের পক্ষ থেকে একটি শিল্পকর্ম ও একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কীর্তি ও নিদর্শন রেখে যেতে। সর্বোপরি, তাঁর বাণী, কথা ও বক্তব্য সর্বজনীন এবং তা স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর বাণী ও বক্তব্যের উপলক্ষ ‘মানুষ’। আর এ কারণেই তাঁর বক্তব্যের নেই কোন ভৌগোলিক সীমারেখা, নেই কোন কালভিত্তিক সীমাবদ্ধতা। এ সব কিছু (স্থান-কাল-পাত্র) বক্তার দৃষ্টিতে বক্তৃতা ও বক্তব্যের ক্ষেত্রকে সীমিত এবং স্বয়ং বক্তার ওপরেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করে।
পবিত্র কোরআনের শব্দগত আলৌকিকত্বের ক্ষেত্রে প্রধানতম দিকটি হচ্ছে যদিও পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তু ও অন্তর্নিহিত অর্থ পুরোপুরি পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হবার যুগের বহুল প্রচলিত বক্তব্য, বাণী ও কথার বিষয়বস্তু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর তা নব্য সাহিত্য-যুগের শুভ সূচনাকারী এবং ভিন্ন জগৎ ও পরিমণ্ডলের সাথেই বেশি সংশ্লিষ্ট, তথাপি এ গ্রন্থের (পবিত্র কোরআন) ভাষাগত সৌন্দর্য, সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা আলৌকিক। নাহজুল বালাগাহ্ অন্য সকল দিক ও ক্ষেত্রের মত এ ক্ষেত্রেও পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রভাবিত এবং প্রকৃতপ্রস্তাবে এ গ্রন্থটি (নাহজুল বালাগাহ্) পবিত্র কোরআনেরই সন্তান।
‘নাহজুল বালাগা’র আলোচ্য বিষয়বস্তুসমূহ
যে সব বিষয় ‘নাহজুল বালাগা’য় আলোচিত হয়েছে এবং যা এই স্বর্গীয় বাণীসমূহকে বিভিন্ন রং ও বর্ণে সুশোভিত করেছে তা অগণিত। এই অক্ষম বান্দা (প্রবন্ধকার আয়াতুল্লাহ্ মুতাহ্হারী) দাবী করছে না যে, সে ‘নাহজুল বালাগা’ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। কেবল তার একান্ত ইচ্ছা ও অভিলাষ হচ্ছে নাহজুল বালাগাকে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা ও অধ্যয়ন। নিঃসন্দেহে আগামীতে এমন ব্যক্তিবর্গ এ ক্ষেত্রে অগ্রণী হবেন যাঁরা ‘নাহজুল বালাগাহ্’-কে ভালোভাবে বুঝতে এবং এর যথার্থ হক আদায় করতে সক্ষম হবেন।
‘নাহজুল বালাগা’র আলোচ্য বিষয়াদির প্রতি সার্বিক দৃষ্টিপাত
নাহজুল বালাগার আলোচ্য বিষয়বস্তুসমূহ, যার প্রতিটি আলোচনা ও অধ্যয়নের উপযুক্ত তা নিম্নরূপ :
১. স্রষ্টাতত্ত্ব এবং অজড়-অবস্তুগত জগৎ ও বিষয়াদি
২. আধ্যাত্মিক সাধনা ও পরিক্রমণ ও ইবাদত-বন্দেগী
৩. প্রশাসন, সরকার ও ন্যায়বিচার
৪. আহলেবাইত ও খেলাফত
৫. সদুপদেশ ও প্রজ্ঞাময় বাণী
৬. পার্থিব জগৎ, পার্থিব জগতের প্রতি আসক্তি ও বস্তুকেন্দ্রিকতা
৭. বীরত্বগাথা ও সাহস
৮. ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহসমূহ
৯. প্রার্থনা (দোয়া ও মুনাজাত)
১০. সমকালীন যুগের জনগণের সমালোচনা ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
১১. সামাজিক মূলনীতিসমূহ
১২. ইসলাম ও কোরআন
১৩. চরিত্র ও আত্মশুদ্ধি
১৪. ব্যক্তিত্বসমূহ
এবং আরো বহু অগণিত আলোচ্য বিষয়।
এটি স্বতঃসিদ্ধ যে, যেমনভাবে প্রবন্ধসমূহের শিরোনাম১০(সেইরী র্দা ‘নাহজুল বালাগাহ্’ অর্থাৎ ‘নাহজুল বালাগা’য় পরিক্রমণ) থেকে প্রতীয়মান হয়, ঠিক তেমনিভাবে আমি না দাবী করছি যে, উপরোক্ত বিষয়বস্তুসমূহ নাহজুল বালাগায় বর্ণিত সকল বিষয়বস্তুকে শামিল করে আর না আমার দাবী এটি, উপরোল্লিখিত বিষয়বস্তুসমূহ নিয়ে আমি চূড়ান্ত আলোচনা করব আর না আমার এ ধরনের দাবী করার যোগ্যতা আছে। অত্র আলোচনায় আপনারা যা লক্ষ্য করে থাকবেন তা আসলে ‘নাহজুল বালাগা’য় এক ঝলক চোখ বুলানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আশা করা যায় যে, পরবর্তীতে সময় সুযোগ হলে এ বিশাল জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকে আরো অধিক ফল ও কল্যাণ লাভ করা যাবে অথবা অন্যেরা ভবিষ্যতে এ ধরনের তৌফিক ও সামর্থ্য লাভ করবেন (আর তারা এ ব্যাপারে আরো ব্যাপক গবেষণা করার সুযোগ পাবেন এবং অধিক লাভবানও হবেন)। মহান আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ। ইন্নাহু খাইরু মুওয়াফ্ফিক ওয়া মুঈন (অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি শ্রেষ্ঠ তৌফিকদাতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী)।
তথ্যসূত্র
১. প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মরহুম হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মুহাম্মদ দাশ্তী ‘নাহজুল বালাগা’র বক্তৃতা, প্রেরিত পত্র এবং সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহের সূত্রসমূহ নির্ভরযোগ্য শিয়া ও সুন্নী গ্রন্থাবলী থেকে উদ্ধৃত করেছেন- যা জামায়াতুল মুদাররিসীন কোম-এর অধীনস্ত মুআস্সাসাতুন নাশর আল ইসলামী কর্তৃক প্রকাশিত ‘নাহজুল বালাগা’য় সন্নিবেশিত হয়েছে।
২. ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩০।
৩. নাহজুল বালাগাহ্, পত্রাদি সংক্রান্ত অধ্যায়, নং ২২।
৪. তিনি সর্বশেষ উমাইয়্যা খলীফা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের লেখক ছিলেন। তিনি ইরানী বংশোদ্ভূত, পণ্ডিত ইবনে মুকাফ্ফার শিক্ষক এবং প্রসিদ্ধ লেখক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে : আবদুল হামীদের দ্বারা রচনা ও লিখন-কার্য শুরু হয়েছিল এবং ইবনুল আমীদের মাধ্যমে তা শেষ হয়েছে। ইবনুল আমীদ বুওয়াইহ্ বংশীয় শাসকদের মন্ত্রী ছিলেন।
৫. আবদুল হামীদ কার্যত তাঁর (আলী) গুণাবলী ও পূর্ণতা স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও উমাইয়্যা প্রশাসনের সাথে তার জড়িত থাকার কারণে কৌতুক ও রসিকতাচ্ছলে হযরত আলীর নাম এভাবে উল্লেখ করেছে।
৬. অন্য তিন স্তম্ভ : (ক) ইবনে কুতাইবাহ্ প্রণীত ‘আদাবুল কাতেব’ (খ) মুবাররাদ প্রণীত গ্রন্থ ‘আল কামিল’ এবং (গ) আবু আলী ক্বালী প্রণীত ‘আন নাওয়াদির’
৭. সমসাময়িক কালের একজন লেবাননবাসী আলেম জনাব মুহাম্মদ জাওয়াদ মুগনিয়াহ্ তাঁর সম্মানে ইরানের পবিত্র মাশহাদ নগরীতে কয়েক বছর পূর্বে যে কনফারেন্সের আয়োজন করেছিলেন সেখানে তিনি এ কাহিনীটি বলেছিলেন।
৮. নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা অংশ।
৯. ৯.ইসলাম রাসূল (সা.)-এর মাধ্যমে নারীর প্রতি জাহেলিয়াতের সমস্ত কুসংস্কার ও অনাচার দূর করে নারীকে প্রকৃত মর্যাদায় সমাসীন করেছে। রাসূলের পর আহলেবাইত এই আচরণের প্রবক্তা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ কারণে নারীদের মধ্যে আহলে বাইতের জনপ্রিয়তা ছিল।
(জ্যোতি বর্ষ ১ সংখ্যা ৩)