মহৎ গুণাবলির আকর হযরত যয়নাব (আ.)
হযরত যয়নাব (আ.) যখন ভূমিষ্ঠ হলেন তখন তাঁর মা হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) আরবদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী তাঁর নাম রাখার জন্য নিয়ে গেলেন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)-এর কাছে। হযরত আলী (আ.) বললেন, মহানবী (সা.) যেহেতু দূরে আছেন সেহেতু তিনি তাঁকে বাদ রেখে মেয়ের নাম রাখবেন না।
যখন মহানবী (সা.) গৃহে ফিরলেন তখন আমীরুল মুমিনীন নবজাতক সন্তানটিকে কী নামে ডাকা হবে তা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন। মহানবী (সা.) জবাবে বললেন, আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে না জানা পর্যন্ত তিনি কিছু বলতে পারবেন না এবং অপেক্ষা করতে বললেন।
অতঃপর হযরত জিবরাইল (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাছে হাজির হয়ে আল্লাহর শুভেচ্ছা তাঁকে জানালেন এবং বললেন, শিশুর নাম যেন যয়নাব রাখা হয় সেটাই আল্লাহর ইচ্ছা। এই শিশুকে যে একদিন মর্মন্তুদ ঘটনাবলি মোকাবিলা করতে হবে সে তথ্যও জিবরাইল (আ.) মহানবী (সা.)-কে দিলেন। মহানবী (সা.) এই তথ্য অবগত হয়ে বিষণ্ন হলেন এবং বললেন, ‘এই মেয়ের দুঃখে যে কাঁদবে আল্লাহ তাআলা তাকে (ইমাম) হাসান ও হুসাইনের জন্য তাঁর (যয়নাবের) কান্নার অনুরূপই পুরস্কার প্রদান করবেন।’ হযরত যয়নাব (আ.)-এর জন্ম ৫ম, ৬ষ্ঠ অথবা ৭ম হিজরিতে। এ নিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। সৎগুণাবলি, প্রশংসনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং চমৎকার আচরণের মধ্যেই তাঁর নাম বা পদবির সত্যিকার প্রতিফলন ঘটেছে। যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষালাভ না করলেও হযরত যয়নাব (আ.) ইসলামী নীতিমালা ও এর মূল শাখা-প্রশাখা এবং শরীয়ত ও হাদিসশাস্ত্র সম্বন্ধে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বলা যায়, আল্লাহ তাআলাই তাঁকে এগুলো দান করেছিলেন। সহনশীলতা ও দয়া ছিল তাঁর বিশেষ গুণ।
একমাত্র তাঁর মা হযরত ফাতিমা (আ.) ব্যতীত সমসাময়িককালে হযরত যয়নাব (আ.)-ই ছিলেন সবচেয়ে মহীয়সী মহিলা। তিনি এমনকি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি ধার্মিক বা পরহেজগার ছিলেন। তিনি আল্লাহর নবী (সা.)-এর পরিবারের একজন সদস্যা হওয়ার কারণে অনেক অভিজাত আরব পরিবার থেকে তাঁর জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু তাঁর পিতা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর ঐ কথার উপরই অবিচল রইলেন, যেখানে তিনি (মহানবী) বলেছেন, ‘আমাদের কন্যারা আমাদের ছেলেদের জন্য এবং আমাদের ছেলেরা আমাদের কন্যাদের জন্য।’ তিনি তাঁর ভাইয়ের ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের হাতে হযরত যয়নাব (আ.)-কে সমর্পণ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাফর ছিলেন একজন পরহেজগার তরুণ। মহানবী (সা.)-এর বহু হাদীস তিনি স্মরণে রেখেছিলেন। তিনি বেশিরভাগ সময়ই আমীরুল মুমিনীন, ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সান্নিধ্যে থাকতেন। তিনি তাঁর চাচার সঙ্গে জামাল বা উটের যুদ্ধে, সিফফিন ও নাহরাওয়ানের যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি কারবালা যুদ্ধের সময় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সঙ্গী হতে সক্ষম হননি। তিনি তাঁর দুই ছেলেকে ইমামের সফরসঙ্গী করে পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁরা দু’জনই কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন। এই শোকাবহ ঘটনার খবর যখন আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের কাছে পৌঁছে তখন তিনি বলে ঊঠলেন, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ অর্থাৎ আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। তিনি সূরা বাকারার ঐ অংশ পাঠ করতে লাগলেন যাতে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের যারা তাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৫৬)
আক্ষরিক এবং তাত্ত্বিক উভয় অর্থেই এর মানে হচ্ছে আমরা আল্লাহরই এবং তিনিই আমাদের মালিক। সুতরাং তিনি আমাদের জন্য যা কামনা করেন সেটাই মঙ্গলজনক ধরে নিতে হবে এবং শেষ বিচারের দিন প্রতিদান বা পুরস্কার পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে আমরা প্রত্যাবর্তন করব।
হযরত যয়নাব (আ.) ও আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে ছিল। তাঁরা হচ্ছেন মুহাম্মাদ, আওন আকবর, আলী ও আব্বাস এবং উম্মে কুলসুম।
হযরত যয়নাব (আ.) যখনই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর গৃহে যেতেন তখন ইমাম তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন এবং তাঁর নিজের আসনে তাঁকে উপবেশন করতে বলতেন। কোন মহিলার প্রতি এ রকম শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ঘটনা তখন সচারাচর দেখা যেত না। তিনি তাঁর পিতা আমীরুল মুমিনীনের মতোই স্পষ্টভাষী ও বাগ্মী ছিলেন। তা না হলে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর অসুস্থ অবস্থায় তাঁর দায়িত্বভার হযরত যায়নাবের উপর দিয়ে যেতেন না।
দয়া, ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতায় তিনি ছিলেন তাঁর মায়ের মতোই। এ জন্যই তাঁর মা মৃত্যুশয্যায় ভাইদের দেখাশোনার দায়িত্বভার তাঁর হাতেই অর্পণ করে বলেছিলেন, ‘তাদের প্রতি তুমি যত্নবান থাকবে। তাদের দেখাশোনার ব্যাপারে দায়িত্ব পালনে তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হলে।’
ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপারে একমাত্র তাঁর মা হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর সাথেই তাঁর সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি কখনো তাহাজ্জুদের নামায ত্যাগ করেননি। এমনকি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) যেদিন কারবালায় শহীদ হলেন সেদিনও তিনি তাহাজ্জুদের নামায আদায় থেকে বিরত থাকেননি। সেদিনের সেই মর্মান্তিক বিপর্যয়কর অবস্থা, গোলযোগ, সংশয় ও ভীতিকর পরিস্থিতিও তাঁকে তাহাজ্জুদ নামায পড়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘কারবালার চরম পরিস্থিতি ও মর্মান্তিক ঘটনা সত্ত্বেও আমাদের যখন দামেস্ক নিয়ে যাওয়া হলো, আমার ফুফু কখনো মধ্য রাতের নফল নামায বা তাহাজ্জুদ থেকে বিরত থাকেননি।’ হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) যখন বোনের কাছ থেকে শেষ বিদায় নেন তখন তিনি তাকে এ ধরনের নামাজের মাধ্যমেই স্মরণ করতে বলেছিলেন।
তাঁর মতো ধৈর্য, আত্মসংযম, সহনশীলতা, স্থৈর্য কিংবা শান্ত স্বভাব যে কোন মানুষের মধ্যে থাকলে তা তাকে যে কোন ধরনের উত্তেজনা, অন্যায়, দুঃখ-কষ্ট বা জীবন ও সময়ের উত্থান-পতনে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর পূর্ণ আত্মসমর্পণ সম্পর্কে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। যখন তিনি কারবালার প্রান্তরে তাঁর শহীদ ভাই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মস্তকবিহীন লাশের কাছে দাঁড়িয়ে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এই ক্ষুদ্র কুরবানি গ্রহণ কর, যিনি তোমার পথে জীবন উৎসর্গ করেছেন।’ পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ (সূরা সাফফাত : ১০৭-১০৯)
আমাদের নিজেদের ধ্বংসের জন্য নয়; বরং আরো উৎকর্ষ সাধনের জন্য যদি আমরা আত্মবিসর্জন দেই তা হলে আল্লাহ তাআলার কাছে তা হবে অর্থবহ।
(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯২)