২১ রমজান- হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী
২১ রমজান আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী। ৪০ হিজরির এই তারিখে সোমবার ৬৩ বছর বয়সে ইরাকের কুফায় তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এর আগে ১৯ রমজান কুফার মসজিদে ফজরের নামায আদায়কালে এক বিষমাখানো ছোরা দিয়ে তাঁর ওপর মারণাঘাত হানা হয়। ইরাকের নাযাফ শহরে তাঁকে দাফন করা হয়।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর মূল নাম ছিল আলী। তাঁর অন্যতম উপাধি ছিল আল-মুরতাজা এবং ডাক নাম ছিল আবুল হাসান। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা হযরত আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব ছিলেন তাঁর পিতা এবং ফাতেমা বিনতে আসাদ ছিলেন তাঁর মাতা। পৈতৃক দিক থেকে হযত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর আপন চাচাত ভাই। পরবর্তীকালে মহানবী (সা.) স্বীয় কন্যা ফাতেমা আয-যাহরা (আ.)-কে হযরত আলীর সাথে বিবাহ দেন। সেই সুবাদে তিনি তাঁর জামাতা।
হযরত আলী (আ.) ছিলেন ইসলামের ইমামতি ধারার প্রথম ইমাম। মহানবী (সা.) জীবদ্দশায় তাঁর বারোজন উত্তরসূরির ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যাঁদের প্রথম হলেন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)। তাঁর জন্ম হয়েছিল পবিত্র কাবাঘরে। জন্মের সময় তাঁর চক্ষু চিল মুদিত এবং শরীর ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদাবনত।
শৈশবে হযরত আলী গড়ে ওঠেন সরাসরি মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতী মিশন শুরুর আগে। যখন তাঁর বয়স ছয় বছর তখন মক্কা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় বিরাজ করছিল দুর্ভিক্ষ। মহানবী (সা.) তখন তাঁকে পিতার বাড়ি তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। হযরত আলী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অভিভাবকক্তে ও হেফাজতে ন্যস্ত হন। হযরত আলী (আ.) নিজেই বলেছেন, মহানবী (সা.) নিজে আমাকে কোলে করে গড়ে তুলেছেন এবং নিজের মুখের গ্রাস থেকে আমাকে খাইয়েছেন। তিনি যেখানেই গেছেন একটি উটের বাচ্চা যেমনি তার মাকে অনুসরণ করে আমি তেমনিই সেখানেই গিয়েছি। প্রতিদিনই এই মহান ব্যক্তির চরিত্রের নতুন নতুন দিক উদ্ভাসিত হয়েছে এবং সেগুলোকে এক একটি আহকাম হিসাবে আমি অনুসরণ করেছি।
মহানবী (সা.)-এর সাথে হযরত আলী (আ.)-এর সাহচর্য তাঁকে চরিত্র, জ্ঞান, আত্মত্যাগ, সহনশীলতা, সাহসিকতা, দয়ার্দ্রতা, মহানুভবতা, বাগ্মিতা ও সৌন্দর্য-সৌকর্যের দিক থেকে মহানবীর ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য করে তোলে। বাল্যকাল থেকেই তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে নামায আদায় করতেন। ইমাম আলী স্বয়ং বলেছেন, ‘আমিই প্রথম মহানবীর সাথে নামায আদায় করেছি।’
মহানবী (সা.) হেরা পর্বতের গুহায় যেদিন খোদার তরফ থেকে নবুওয়াতের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভ করেন এবং তাঁর ওপর প্রথম অহী নাযিল হয় সেদিন হেরা গুহা থেকে বাড়ি ফেরার পথে হযরত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মহানবী (সা.) হযরত আলীর কাছে ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি এই নতুন ধর্মবিশ্বাসকে গ্রহণ করে নেন। তাছাড়া মহানবী তাঁর সমস্ত আত্মীয়-স্বজনকে একত্র করে তাঁর ধর্ম গ্রহণ করার আহ্বান জানালে সেদিন একমাত্র আলী (আ.) তা গ্রহণ করেন। তাই হযরত আলীই হলেন ঈমান গ্রহণ করে ইসলামে প্রবেশ করার প্রথম ব্যক্তি।
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পূর্ব পর্যন্ত হযরত আলী সর্বদা তাঁর সাথে থাকতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) যে রাতে মদীনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কাফেররা সে রাতে তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং শেষ রাতে তাঁকে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলবে বলে কর্মসূচি ঘোষণা করে। সে রাতে হযরত আলী মহানবীর বিছানায় তদস্থলে শুয়ে থাকেন। এতে মহানবী (সা.) গৃহত্যাগ করে মদীনায় চলে যেতে সক্ষম হন। মহানবীর বিদায়ের পর হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর কাছে গচ্ছিত বিভিন্ন লোকের আমানত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে ফিরিয়ে দেন। পরবর্তীকালে হযরত আলী (আ.) ও তাঁর মাতা মহানবী (সা.)-কে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সকল কর্মকাণ্ডে সার্বক্ষণিক সহায়তা দান করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যেসব যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তার মধ্যে একমাত্র তাবুকের যুদ্ধ ছাড়া হযরত আলী সবগুলো যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাবুকের যুদ্ধের সময় তাঁকে মহানবীর স্থলে মদীনায় অবস্থান করতে বলা হয়েছিল। তিনি কখনও মহানবীর কোনো কথা অমান্য করেননি। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আলী কখনও সত্য থেকে আলাদা হয় না, আর না সত্য আলী থেকে।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) যেদিন ইন্তেকাল করেন তখন হযরত আলীর বয়স ৩৩ বছর। সাহাবীদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি ধর্মীয় জ্ঞানী ও অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.) নিহত হওয়ার পর জনসাধারণ তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং খলীফা হিসাবে মনোনীত করেন।
ইমাম আলী (আ.) তাঁর চার বছর নয় মাসের খেলাফতকালে হুবহু মহানবী (সা.)-এর পথ অনুসরণ করেন এবং খেলাফতকে একটি আধ্যাত্মিক আন্দোলনে রূপ দান করেন। তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু সংস্কারও সাধন করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এসব সংস্কার কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে যায়, যার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য একটি উপদল তৈরি হয়।
এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিরোধ অবসানের লক্ষ্যে হযরত আলীকে তাঁর খেলাফতকালে বসরার কাছে হযরত তালহা ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে উষ্ট্রের যুদ্ধ, আমীর মুআবিয়ার বিরুদ্ধে ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্তের কাছে দেড় বছরব্যাপী ফিসফিনের যুদ্ধ এবং খারিজীদের বিরদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ করতে হয়। এতে তাঁর খেলাফতকালের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় হয় অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা কাটিয়ে উঠতে।
শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের সাক্ষ্য মতে হযরত আলী (আ.) ছিলেন একজন পরিশুদ্ধ মানুষ এবং ইসলামী জ্ঞান ও মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও দিকনির্দেশনা লাভকারী এক যথার্থ দৃষ্টান্ত। মহানবী (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম এবং সাধারণভাবে সকল মুসলমানের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনিই প্রথম তাঁর জ্ঞান-ভা-ারের মাধ্যমে যুক্তিবিদ্যা ও খোদায়ী বিজ্ঞান (মা’রেফুল ইলাহিয়ার) দ্বার উন্মোচন করেন। কুরআনের প্রকাশভঙ্গি সংরক্ষণের জন্য তিনি আরবি ব্যাকরণ উদ্ভাবন করেন।
ইমাম আলী (আ.)-এর বীরত্ব ছিল প্রবাদবাক্যের মতো। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরে যতগুলো যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার কোনোটিতেই তাঁকে কখনও শঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন দেখা যায়নি। এমনকি ওহুদ, হুনায়ন, খায়বার ও খন্দকের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সহকর্মী ও মুসলিম সেনাবাহিনীর মধ্যকার কিছু কিছু লোক ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল এবং পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হযরত আলী কখনই শত্রুর দিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত কোনো সৈনিক বা যোদ্ধা জীবিত বের হয়ে যেতে পারেনি। তবে তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় এই বীরত্বগুণও বিদ্যমান ছিল যে, তিনি কখনই কোনো দুর্বল সৈনিককে হত্যা করেননি এবং কোনো পলায়নপর সৈনিককে আক্রমণের লক্ষ্য নির্ধারণ কনেনি। তিনি শত্রুদের ওপর কখনও আকস্মিক হামলাও করতেন না। খায়বারের যুদ্ধের সময় দুর্গের ওপর হামলাকালে হযরত আলী দুর্গের প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছে সজোরে এক আকস্মিক আঘাতে ভেঙে ফেলেন এবং দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেন। মক্কা বিজরয়র দিন তিনি মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ মোতাবেক কাবা ঘরের ছোট বড় সকল মূর্তি ভেঙে ফেলেন এবং বাইরে ফেলে দেন।
মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির দিক দিয়েও হযরত আলী (আ.) ছিলেন অতুলনীয়। সাহাবী হযরত আবু দারদা একদিন দেখেন যে, হযরত আলী মদীনার এক খেজুরের বাগানে অসাড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। তখন তিনি মৃত ভেবে হযরত আলী (আ.)-এর বাড়িতে গেলেন এবং তাঁর স্ত্রী ফাতেমা যাহরার কাছে শোক প্রকাশ করলেন। হযরত ফাতেমা আবু দারদাকে বললেন, আলী মারা যাননি; বরং তিনি আল্লাহর ভয়ে মূর্ছা গেছেন। প্রায়ই তার এ রকম অবস্থা হয়।
হীন, দরিদ্র, অভাবী ও দুঃখী মানুষের প্রতি হযরত আলীর দয়া, সহানুভূতি ও মহানুভবতা সম্পর্কে বহু গল্প রয়েছে। তিনি যা আয়-উপার্জন করতেন তার প্রায় সবই নিঃস্ব ও দরিদ্রদের সাহায্যে ব্যয় করতেন এবং নিজে অত্যন্ত অনাড়ম্বর ও সরল জীবনযাপন করতেন। হযরত আলী কৃষি কাজ ভালোবাসতেন এবং অধিকাংশ সময় তিনি কূপ খনন, বৃক্ষ রোপন ও জমি আবাদে ব্যস্ত থাকতেন। তবে তিনি যেসব জমি আবাদ করতেন এবং কূপ তৈরি করতেন তার সবই দরিদ্রদের জন্য ওয়াকফ করে দিতেন।
হযরত আলী (আ.)-পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুমাত কায়েম করতে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু ঘাতকের তরবারি তা থামিয়ে দেয়। আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম ৪০ হিজরির ১৯ রমজান তাঁকে এক বিষমাখানো ছোরা দিয়ে আঘাত করে। আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.) সে সময় কুফার মসজিদে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। ২১ রমজান তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং ইহজগৎ থেকে বিদায় নেন। সিংহদিল, বীর হৃদয় হযরত আলী (আ.) জন্মলাভ করেছিলেন আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবার আর মৃত্যুও বরণ করেন আল্লাহর ঘর কুফার মসজিদে। আল্লাহর এই মহান বান্দার জীবন শুরু হয় আল্লাহর ধ্যানমগ্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে। জীবন অতিবাহিত হয় ইসলামের সেবার মধ্য দিয়ে আর জীবনের অবসান হয় ইবাদতরত অবস্থার মধ্য দিয়ে।
(নিউজলেটার, মার্চ-এপ্রিল ১৯৯২)