বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে যাকাতুল ফিতর
যাকাতুল ফিতর বা সাদাকাতুল ফিতরকে শরীরের যাকাতও বলা হয়। এ যাকাত কার ওপর ওয়াজিব,কার জন্য প্রদান করবে,পরিমাণ কি,কখন দিতে হবে এবং পাবার হকদার কে-এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।
কে দেবে?
আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মতে ছোট-বড় সকল সক্ষম মুসলমানের ওপর যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। অতএব,শিশু ও পাগলের ওয়ালীর জন্য শিশু ও পাগলের সম্পদ থেকে দরিদ্রদের যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ওয়াজিব।
হানাফীদের মতে সক্ষম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে যাকাতের নিসাবের মালিক অথবা যার সম্পদ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত।
শাফেয়ী,হাম্বলী ও মালিকীদের মতে সক্ষম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যার কাছে তার নিজ ও পরিবার-পরিজনের ঈদের দিন ও রাতের১ প্রয়োজন পূরণের অতিরিক্ত সম্পদ আছে,অবশ্য বাস-গৃহ,পোশাক-পরিচ্ছদ ও প্রয়োজনীয় হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি এর অন্তর্ভুক্ত নয়। সেই সাথে মালিকিগণ যোগ করেছেন,যে ব্যক্তি পরিশোধ করতে পারবে-এ নিয়্যতে ঋণ করার ফলে তার সম্পদ সক্ষম পর্যায়ভুক্ত হয়েছে সেও সক্ষম বলে গণ্য হবে।
ইমামীদের মতে যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবার জন্য বালেগ হওয়া,বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া ও সামর্থ্য থাকা জরুরী। সুতরাং শিশু ও পাগলের সম্পদে যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে না। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে,“তিন ব্যক্তির জন্য কোন দায়িত্ব-কর্তব্য নেই,তারা হচ্ছে : শিশু,যতক্ষণ না তার ‘এহতেলাম’ (স্বপ্নদোষ যা বালেগ হবার লক্ষণ) হচ্ছে;পাগল,যতক্ষণ না সে বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন হচ্ছে এবং ঘুমন্ত ব্যক্তি,যতক্ষণ না সে জাগ্রত হচ্ছে।” তাদের মতে সমর্থ বা সক্ষম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে তার নিজ ও পরিবার-পরিজনের সাংবৎসরিক প্রয়োজন পূরণের পরিমাণ ধন-সম্পদের মালিক অথবা কাজের মাধ্যমে বা কোন শিল্পকর্মের মাধ্যমে তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়।
হানাফীদের মতে মুকাল্লাফের (শরীয়তের হুকুম যার ওপর প্রযোজ্য) ওপর তার নিজের জন্য,তার ছোট সন্তানদের জন্য ও চাকর-চাকরানীর জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ওয়াজিব। বড় (বালেগ) সন্তানরা যদি পাগল হয়ে থাকে তাদের জন্যও তা দিতে হবে। কিন্তু বড় সন্তানরা যদি বিচার-বুদ্ধিসম্পন্নও হয় তাহলে তাদের জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা পিতার ওপর ওয়াজিব হবে না-ঠিক যেভাবে স্ত্রীর জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব নয়।
হাম্বলী ও শাফেয়ীদের মতে ব্যক্তির ওপর তার নিজের জন্য ও যাদের ভরণ-পোষণ করা তার জন্য ওয়াজিব,যেমন তার স্ত্রী,পিতা ও পুত্র,তাদের জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ওয়াজিব।
মালিকীদের মতে ব্যক্তির ওপর তার নিজের জন্য ও যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার ওপরে রয়েছে,তারা হচ্ছে দরিদ্র পিতা-মাতা,সেসব পুত্র সন্তান যারা সম্পদের অধিকারী নয় যতক্ষণ না তারা বালেগ ও উপার্জনক্ষম হয়,সম্পদের অধিকারী নয় এমন কন্যা সন্তান যতক্ষণ না তাদের বিবাহ হয় এবং তার স্ত্রী-এদের জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ওয়াজিব।
ইমামীদের মতে ব্যক্তির ওপর তার নিজের জন্য এবং ঈদুল ফিতরের রাতে যারা তার ঘরে খানা-পিনা করবে তাদের সকলের জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ওয়াজিব। এ ক্ষেত্রে তাদের ভরণ-পোষণ তার ওপর ওয়াজিব কিনা তাতে কোন পার্থক্য নেই। তেমনি ছোট-বড়,মুসলিম-অমুসলিম,রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় ও দূরদেশ থেকে আগত অপরিচিত ব্যক্তি,এমন কি শাওয়ালের চাঁদ দেখা যাবার কয়েক মুহূর্ত পূর্বে আগত মেহমানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এদের সকলেই ঐ রাতের জন্য তার ঘরে খাদ্য গ্রহণকারীরূপে গণ্য হবে এবং তার ওপরে তাদের সকলের জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ওয়াজিব হবে। একইভাবে ঈদুল ফিতরের রাত শুরু হবার পূর্বে অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বে বা সময়ে তার যে শিশুর জন্ম হবে বা যে নারীর সাথে তার বিবাহ হবে তাদের জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা তার জন্য ওয়াজিব হবে। কিন্তু সূর্যাস্তের পরে সন্তান জন্ম নিলে বা স্ত্রী পরিগ্রহণ করলে বা মেহমান এলে তাদের জন্য যাকাতুল ফিতর প্রদান করা তার জন্য ওয়াজিব হবে না। আর যার যাকাতুল ফিতর প্রদান করা অন্যের ওপর ওয়াজিব হয়েছে তার নিজের ওপরে তা পরিশোধ করার দায়িত্ব থাকে না,এমন কি সে ধনী হলেও।
পরিমাণ
যাকাতুল ফিতরের পরিমাণের ব্যাপারে হানাফী বাদে ইসলামের অন্য সকল মাজহাবের মধ্যে অভিন্ন মত রয়েছে। তা হচ্ছে এক ব্যক্তির জন্য দেয় যাকাতুল ফিতর এক ছা পরিমাণ গম,যব,খোরমা (খেজুর),শুষ্ক আঙ্গুর (কিশমিশ),চাল,ভ্ট্টুা বা এ জাতীয় অন্য কোন প্রধান খাদ্য। কিন্তু হানাফী মাজহাবের মতে একজনের যাকাতুল ফিতর হিসেবে অর্ধ ছা’ গম দেয়াই যথেষ্ট। আর এক ছা’ প্রায় তিন কিলোগ্রামের সমান।
ওয়াজিব হবার সময়
হানাফী মাজহাবের মতে ঈদের দিনের সূর্যোদয় থেকে সারা জীবনের জন্য যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। কারণ যাকাতুল ফিতর হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক ওয়াজিব। তাই আগে হোক বা পরে হোক,তা আদায় করতে হবে।
হাম্বলীদের মতে যাকাতুল ফিতর প্রদান ঈদুল ফিতরের দিনের পর পর্যন্ত বিলম্বিত করা হারাম। অবশ্য ঈদের দুই দিন আগে দেয়া জায়েয কিন্তু তার চেয়ে আগে দিলে জায়েয হবে না।
শাফেয়ীদের মতে রমযানের শেষ অংশে ও শাওয়ালের প্রথম অংশে অর্থাৎ রমযান মাসের শেষ দিনের সূর্যাস্তের সময় ও তার সামান্য আগে যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয় এবং ঈদের দিনের শুরুতে তা প্রদান করা ওয়াজিব। শারয়ী কারণ ব্যতীত ঈদের দিনের সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত তা প্রদান বিলম্বিত করা হারাম।
এ ব্যাপারে ইমাম মালিক থেকে দু’টি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। তার একটিতে বলা হয়েছে,রমযান মাসের শেষ দিনের সূর্যাস্তের সময় যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়।
ইমামীদের মতে ঈদুল ফিতরের রাত শুরু হবার সাথে সাথে যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। আর ঈদুল ফিতরের রাত শুরু হবার পর থেকে ঈদের দিন দুপুর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তা আদায় করা ওয়াজিব। তবে ঈদুল ফিতরের নামাযের পূর্বে আদায় করা উত্তম। এ সময়ের মধ্যে যদি এর হকদার না পাওয়া যায় তাহলে মুকাল্লিফের দায়িত্ব হচ্ছে হকদার পাবার সাথে সাথে তাকে প্রদানের নিয়্যতে নিজ সম্পদ থেকে তা আলাদা করে রাখা। আর যদি হকদার পাওয়া সত্ত্বেও তা প্রদান না করে থাকে তাহলে তা পরে প্রদান করা ওয়াজিব হবে। কোন অবস্থায়ই তার ওপর থেকে এ ওয়াজিব বিলুপ্ত হবে না।
হকদার
এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে,কোরআন মজীদের إنما الصدقات للفقراء... আয়াত অনুযায়ী যারা সাধারণ যাকাতের হকদার তারাই যাকাতুল ফিতরের হকদার।
পাদটিকা:
১.শারয়ী বিষয়ে দিনরাত্রি (২৪ ঘণ্টা)-এর ক্ষেত্রে আগে রাত ও পরে দিন ধরা হয়। অতএব,ঈদুল ফিতরের রাত মানে রমযানের শেষ দিনের সূর্যাস্ত পরবর্তী রাত।- অনুবাদক।
[الفقه على المذاهب الخمسة গ্রন্থ থেকে অনুদিত । জ্যোতি,১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা।]