আল হাসানাইন (আ.)

তাওহীদের মর্মবাণী-১ম কিস্তি

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী

মহানবী (সা.) যেদিন মানবতার মুক্তির মহামূল্য বাণী ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন সেদিন তাঁর বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে যারা রুখে দাঁড়াল এবং শুরুতেই শত্রুতা চরিতার্থকরণের আদিমতম অস্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করল অর্থাৎ তাঁকে উপহাস করল এবং তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা মুখর হয়ে উঠল,অতঃপর তাওহীদী আন্দোলন যতই বিস্তার লাভ করতে লাগল ততই তীক্ষ্ণতর অস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল,তারা ছিল সমাজের অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের প্রভাবাধীন লোকেরাও তাদের সাথে যোগদান করল। তারা মহানবী (সা.) ও তাঁর চিন্তাধারার অনুসারীদের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হলো এবং হিজরত-পূর্ব তেরটি বছরে ইতিহাসের লজ্জাজনক দৃশ্যাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকল।

এই ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এমন এক সত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যে,ইসলাম এবং ইসলামের প্রথম ও শেষ কথা ‘তাওহীদ’ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হলে এর প্রতি অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি প্রদান অপরিহার্য।

আমাদের যুগের সর্বাধিক দুঃখজনক ঘটনাবলীর অন্যতম হচ্ছে এই যে,যাকে মানবতার মুক্তির বাণীসহ যাঁরাই আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁদের সকলের অভিন্ন মতের প্রতি পরবর্তীতে অবিচার করা হয়েছে আর তা হচ্ছে তাওহীদের তাৎপর্যের বিকৃতি সাধন অর্থাৎ সকল ধর্মের মৌলতম বিষয়বস্তুর বিকৃতি। কারণ গোটা ইতিহাসে মানুষের মুক্তির জন্যে এসেছে এবং নিপীড়িত মানবতাকে মুক্তির সুসংবাদ দিয়েছে এমন দ্বিতীয় কোন বাণীই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পাই,নবী-রাসূলগণের আবির্ভাব ও নবুওয়াতে অভিষেকের ঘটনা ছিল প্রধানত মানবতার কল্যাণ আর দুর্বল ও পতিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সকল প্রকার জুলম,বৈষম্য ও অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিপ্লব। আর এই নবুওয়াতই হচ্ছে সকল শীর্ষস্থানীয় ধর্মের চারিত্রিক মূলনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এরিক ফোরামের ভাষায়- জ্ঞান,ভ্রাতৃসুলভ ভালবাসা,দুঃখ-কষ্ট লাঘব এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও দায়িত্বানুভূতির কেন্দ্রবিন্দু। (অবশ্য এছাড়াও আরো অনেক মহান ও সমুন্নত আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব রয়েছে যা একজন বস্তুবাদী পর্যবেক্ষক অনুধাবন করতে পারবেন বলে আশা করা যায় না।)

আর এই আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহের মূল স্তর তাওহীদে নিহিত রয়েছে। নবী-রাসূলগণ তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারণ করে একদিকে যেমন স্বীয় সকল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে পেশ করতেন,তেমনি এ ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে যে সংগ্রামের সূচনা করতেন তার পরিণতিতে তাঁদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতেন বা বাস্তবে রূপায়ণের কাছাকাছি পৌঁছে দিতেন।

এমতাবস্থায় যে যুগে উক্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহের বাস্তবায়ন অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি প্রয়োজন এবং অবিলম্বে বাস্তবায়ন প্রয়োজন সে যুগে তাওহীদের রহস্য ও বিষয়বস্তু অজানা-অজ্ঞাত থাকা বা বিকৃত হওয়া এবং এর ভাসাভাসা ও স্রেফ চিন্তাগত তাৎপর্য গ্রহণ যথেষ্ট মনে করাকে আসলেই একটি দুঃখজনক বিষয় বলে গণ্য করা উচিত। শুধু তাওহীদী বিশ্বদৃষ্টির অধিকারীদের জন্যেই নয়,বরং যারাই উক্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার দাবীদার তাদের সকলের জন্যেই দুঃখজনক বলে পরিগণিত হওয়া উচিত।

*****

ইসলামের অভ্যুদয়কালেই সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষের দুই পক্ষে বিভক্ত হওয়ার ঘটনা থেকে তাওহীদ সংক্রান্ত একটা গূঢ় সত্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ ধ্বনির আঘাত সর্বাগ্রে তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল যারা কোমর বেঁধে এ ধ্বনির বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছিল অর্থাৎ সমাজের শক্তিমান ও কর্তৃত্বশালী শ্রেণী।

কোন চিন্তা ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা থেকেই এর সামাজিক ভূমিকা এবং ঐ ভূমিকার গভীরতা ও প্রভাব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যেতে পারে। এ আন্দোলনের দুশমনদের স্বরূপ ও তাদের শ্রেণীচরিত্র নিয়ে গবেষণার মাধ্যমেই এ আন্দোলনের শ্রেণীগত ও সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে জানা যেতে পারে। তেমনি তাদের শত্রুতার গভীরতা ও প্রভাব পর্যালোচনার মাধ্যমে এ আন্দোলনের গভীরতা ও প্রভাব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব। এ কারণেই দীনী দাওয়াত সম্বন্ধে সঠিক ধারণা অর্জনের জন্যে অন্যতম নির্ভরযোগ্য পন্থা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের সমর্থক ও দুশমনদের জোটবদ্ধতা সম্বন্ধে গবেষণা।

আমরা যখন দেখতে পাই,দীনের বিরুদ্ধে মোকাবিলার জন্যে সর্বাগ্রে সমাজের শক্তিমান শ্রেণী কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে এবং এ ক্ষেত্রে কোনরূপ প্রচেষ্টা থেকেই বিরত থাকছে না,তখন আমাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে,দীন ও দীনী আন্দোলনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই শ্রেণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো,তেমনি তাদের শক্তিমদমত্ততা ও সম্পদের দাপট এবং নীতিগতভাবে তাদের শ্রেণীবদ্ধতারই বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান -যে শ্রেণীবদ্ধতা তাদেরকে অন্যদের থেকে এভাবে আলাদা করেছে।

তাওহীদকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থাৎ সমাজের আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের বিরোধিতার দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে জানতে হলে আমাদের আগেই জেনে রাখা দরকার যে,তাওহীদের তাৎপর্য সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে যে একটি স্রেফ দার্শনিক ও চিন্তাগত মতাদর্শ বলে গণ্য হয়ে থাকে তার বিপরীতে এ হচ্ছে মানুষ ও জগত সম্পর্কিত এবং এক বিশেষ সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপনকারী একটি মৌলিক মতাদর্শ।

ধর্মীয় ও ধর্ম বহির্ভূত পরিভাষাসমূহের মধ্যে তাওহীদের ন্যায় বিপ্লবী,গঠনমূলক এবং মানব জীবনের বিভিন্ন সামাজিক ও ঐতিহাসিক দিককে অন্তর্ভুক্তকারী এমন ব্যাপক তাৎপর্যবহ পরিভাষা একান্তই বিরল। তাই এটি কোন কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না যে,মানব জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রতিটি ধর্মীয় আহ্বান ও আন্দোলন মহান আল্লাহর একত্ব ও তাঁর নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব ও খোদায়ীর ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল।

তাওহীদের তাৎপর্যকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। এখানে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাচ্ছে :

ক) এক সর্বজনীন বিশ্বদৃষ্টি থেকে

তাওহীদের অর্থ হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব এবং এর সকল অংশ ও উপাদানের ঐক্য ও একত্ব। যেহেতু সৃষ্টিলোকের ধারাক্রম অভিন্ন এবং সবাই অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত-বিশ্বলোকের সৃষ্টি ও পরিচালনার পেছনে বিভিন্ন খোদা ও স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই,সেহেতু বিশ্বলোকের এই অংশসমূহ হচ্ছে এক সমন্বিত সমষ্টি এবং সমগ্র বিশ্বলোক হচ্ছে এক অভিন্ন সত্তা,আর তার লক্ষ্যও অভিন্ন।

মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ

“তুমি মহাদয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনরূপ অসামঞ্জস্য দেখতে পাবে না।” (সূরা মুলক : ৩)

মহান আল্লাহ্ আরো এরশাদ করেন :

أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا فِي أَنْفُسِهِمْ مَا خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّى

“তারা কি তাদের নিজেদের সম্বন্ধে (বা নিজে নিজে) চিন্তা করে নি? আল্লাহ্ তায়ালা আসমানসমূহ ও জমিনকে যথাযথ নিয়ম-শৃঙ্খলা সহকারে ও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ব্যতীত সৃষ্টি করেন নি।” (সূরা রুম : ৮)

এ দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী গতিশীল এ বিশ্বলোক হচ্ছে একটি কাফেলার ন্যায় যার প্রতিটি সদস্য একটি শিকলের পরস্পরযুক্ত এক একটি কড়ার ন্যায় এবং একটি যন্ত্রের ছোট-বড় বিভিন্ন অংশের ন্যায় যারা অভিন্ন লক্ষ্যে কর্মতৎপর ও সদাপ্রয়াসী। এই সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় স্বীয় অবস্থানের দৃষ্টিতেই প্রতিটি বস্তু তার যথাযথ তাৎপর্য প্রদর্শন করে থাকে এবং এর ভিত্তিতেই প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্য ও করণীয় নির্ণীত হয়ে থাকে। সুতরাং এই পূর্ণতা অভিমুখী অভিযাত্রায় সকলেই অন্যের কাজে সাহায্যকারী ও অন্যের পরিপূরক এবং প্রত্যেকেই এই সমষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ারস্বরূপ। এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোন একটির থেমে যাওয়া,স্থবিরতা,ধ্বংস বা পথভ্রষ্টতা গোটা যন্ত্রেরই শ্লথ গতি,অসামঞ্জস্য ও লক্ষ্যভ্রষ্টতার কারণ হয়ে থাকে। এ কারণে এ সমষ্টির প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে এক নৈতিক ও গভীর বন্ধন পরস্পর সংযুক্ত করে রাখছে।

তাওহীদের তাৎপর্যে এও নিহিত রয়েছে যে,সৃষ্টিলোক হচ্ছে লক্ষ্যাভিসারী, নিখুঁত হিসাবনিকাশভিত্তিক ও নিখুঁত শৃঙ্খলার অধিকারী এবং এর প্রতিটি অংশের স্বতন্ত্র তাৎপর্য ও চেতনাও রয়েছে। যেহেতু সৃষ্টিলোকের পেছনে একজন মহাজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন সেহেতু সৃষ্টিলোকের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যেমন তেমনি গোটা সৃষ্টিকুলের পেছনে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায় এবং নিঃসন্দেহে এর একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য রয়েছে।

মহান আল্লাহ্ বলেছেন :

وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ

“আমরা আসমান ও জমিন এবং এ দু’য়ের মাঝে সব কিছুকে ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করি নি।” (সূরা আম্বিয়া : ১৬)

এ দৃষ্টিকোণ থেকে এই গোটা বিশ্বলোক দিক নির্দেশবিহীন অনির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল অভিমুখী হতে পারে না,বরং এ হচ্ছে এমন একটি গাড়ীর ন্যায় যাকে তৈরি করা হয়েছে এবং বিশেষ লক্ষ্যে কাজে লাগানো হয়েছে। এ লক্ষ্য কি সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করা যেতে পারে,কিন্তু লক্ষ্য যে অবশ্যই রয়েছে সে সম্বন্ধে সন্দেহ করার অবকাশ নেই;ঠিক যেভাবে একটি তাৎপর্যবহ কবিতা অনুধাবনের জন্যে চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে,কিন্তু কিছুতেই তাকে ঘটনাক্রমে সৃষ্ট ধ্বনিসমষ্টিরূপে গণ্য করা চলে না।

এর চেয়েও বড় কথা,তাওহীদের অর্থ হচ্ছে সৃষ্টিজগতের সকল বস্তু ও সকল উপাদান মহান আল্লাহর নিকট নত হয়ে আছে। এই বিশ্বলোকে বিনা কারণে স্বতঃ গড়ে ওঠা কোন নিয়ম-কানুনের অস্তিত্ব নেই। বিশ্ব-জগতের নিয়ম-কানুন ও এ নিয়ম-কানুনের অধীনে যা কিছু পরিচালিত হচ্ছে এবং গতিমান রয়েছে তার সব কিছুই মহান আল্লাহর নির্ধারিত পথে চলমান ও তাঁর নির্দেশের সামনে মাথা নত করে রয়েছে।

অতএব,সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এই সৃষ্টি বিধান ও প্রাকৃতিক বিধানের অস্তিত্ব থেকে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও প্রভুত্ব এবং তাঁর সব কিছুর উৎস-মূল হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করার মত কোন উপসংহারে কোনমতেই উপনীত হওয়া যায় না।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَنِ عَبْدًا

“আসমানসমূহ ও জমিনে যারাই আছে তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে মহাদয়াময় আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করে নেয় নি।” (সূরা মারিয়ম : ৯৩)

মহান আল্লাহ্ আরো বলেছেন :

بَلْ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَهُ قَانِتُون

“আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে সব তাঁরই;সব কিছুই তাঁর নিকট নত হয়ে আছে।” (সূরা বাকারা : ১১৬)

মহান আল্লাহ্ আরো বলেছেন :

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَاوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ 

 “আল্লাহকে ঠিক যেরূপ মনে করা উচিত তারা তদ্রূপ মনে করে নি;কিয়ামত দিবসে ধরণী তাঁর কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং আসমানসমূহও গুটিয়ে এসে তাঁরই হাতের মুঠোয় স্থান গ্রহণ করবে;তারা যে সব অংশীদারিত্ব আরোপ করছে তা থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত ও সমুন্নত।” (সূরা যুমার : ৬৭)

খ) মানুষ সম্বন্ধে গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ করার দৃষ্টিতে

তাওহীদের অর্থ এও যে,মহান আল্লাহর সামনে মানুষ হিসেবে সকল মানুষ এক ও অভিন্ন। তিনি সকল মানুষেরই স্রষ্টা ও প্রভু। মানবীয় প্রকৃতির দৃষ্টিতে কেউই তাঁর সাথে বিশেষ ও একান্ত সম্পর্কের অধিকারী নয়। তিনি কোন জাতি,গোষ্ঠী বা গোত্র বিশেষের খোদা নন যে,অন্যদেরকে তাদেরই অনুগ্রহভাজনরূপে ও তাদেরই জন্যে,তাদের আনন্দের উপকরণ ও হাতিয়াররূপে সৃষ্টি করে ও জীবিকা প্রদান করে থাকবেন। তাঁর সামনে সকলেই এক। আর আল্লাহর কাছে যদি মানুষে মানুষে পার্থক্য থেকে থাকে তার কারণ হচ্ছে তাদেরই চেষ্টা-সাধনা- মানুষের কল্যাণের জন্যে যে চেষ্টা-সাধনা সকলেই করতে পারে এবং মানুষের প্রকৃত ও যথার্থ উন্নতির একমাত্র সন্দেহাতীত নিশ্চয়তা প্রদানকারী খোদায়ী কর্মসূচীভিত্তিক কর্ম সম্পাদন এবং এ লক্ষ্যে বেশি বেশি চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া।

মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

وَقَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَهُ قَانِتُون

“তারা বলল : আল্লাহ্ সন্তান পরিগ্রহণ করেছেন। আল্লাহ্ পরম প্রমুক্ত,বরং আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে সবই তাঁর,সব কিছুই তাঁর সামনে মাথা নত করে আছে।” (বাকারা : ১১৬)

আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

فَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَا كُفْرَانَ لِسَعْيِهِ وَإِنَّا لَهُ كَاتِبُونَ

“অতএব,যে ভাল কাজ করবে এবং সেই সাথে ঈমানেরও অধিকারী হবে,তার চেষ্টা-সাধনাকে অকৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে দেখা হবে না। আর নিঃসন্দেহে আমরা তা লিপিবদ্ধ করব।” (সূরা আম্বিয়া : ৯৪)

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আরো এরশাদ হয়েছে :

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ

 “হে মানুষ! নিঃসন্দেহে আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্র ও জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে জানতে পার। নিঃসন্দেহে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক তাকওয়ার অধিকারী।” (সূরা হুজুরাত : ১৩)

অর্থাৎ তাওহীদের তৎপর্য সৃষ্টিগতভাবে মানুষের অভিন্নতা,পারস্পরিক সমতা ও অভিন্ন মানবিক সৃষ্টি-মূলও বটে। মানবতা হচ্ছে এমন একটি একক ও অভিন্ন উপাদান যা এই প্রজাতির প্রতিটি সদস্যের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীভুক্ত মানুষ বিভিন্ন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি বা বিভিন্ন খোদার দাস নয় যে,তাদের সৃষ্টি উপাদান বিভিন্ন হবে এবং ফলে তাদের মধ্যে অনতিক্রম্য ব্যবধান থাকবে অথবা উচ্চ শ্রেণীর স্রষ্টা ও খোদা নিম্নশ্রেণীর খোদার তুলনায় অধিকতর শক্তিমান ও মহিমান্বিত হবে,বরং সকলেই এক খোদার সৃষ্টি এবং মূল সত্তার দিক থেকে সবাই অভিন্ন।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন :

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ

“হে মানুষ! তোমাদের সেই প্রভুকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা নিসা : ১)

মানবিক উন্নতি ও পূর্ণতা অর্জনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সকল মানুষই অভিন্ন ও পরস্পর সমান- এও তাওহীদের অন্যতম তাৎপর্য। যেহেতু মূল সত্তা ও মানবিক উৎস সকলেরই অভিন্ন,আর এ সত্তা মহাপ্রজ্ঞাময়তারই সৃষ্ট,সেহেতু জন্মগতভাবে কেউই মানবিক উন্নতি ও পূর্ণতার সরল সঠিক পথে চলতে অপারগ নয়। এ কারণে আল্লাহর দাওয়াত হচ্ছে এক সর্বজনীন দাওয়াত। এ দাওয়াত কোন জাতি বা শ্রেণী বিশেষের জন্যে নয়। যদিও বিভিন্ন পরিস্থিতি বিভিন্ন ধরনের গঠনমূলক প্রভাব বিস্তার করে থাকে,তথাপি এসব পরিস্থিতির বিলয়যোগ্য প্রভাব কখনোই মানুষকে স্থায়ীভাবে অসহায় ও ক্ষমতাবিহীন করে শয়তান বা ফেরেশতায় পরিণত করতে এবং তার জন্যে পরিবর্তন ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ রুদ্ধ করতে পারে নি।

আল্লাহ্ রাব্বুল আল্লামিন হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন :

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ

“আমরা তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্যে ব্যতীত (বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্যেও) প্রেরণ করি নি।” (সূরা সাবা : ২৮)

আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

وَأَرْسَلْنَاكَ لِلنَّاسِ رَسُولًا

“আর আমরা তোমাকে সকল মানুষের জন্যে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি।” (সূরা নিসা : ৭৯)

আরো এরশাদ হয়েছে :

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمْ بُرْهَانٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُبِينًا  فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَاعْتَصَمُوا بِهِ فَسَيُدْخِلُهُمْ فِي رَحْمَةٍ مِنْهُ وَفَضْلٍ وَيَهْدِيهِمْ إِلَيْهِ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا

“হে মানুষ! এখন তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে তোমাদের নিকটে অকাট্য প্রমাণ এসে গেছে এবং আমরা তোমাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী আলো প্রেরণ করেছি। অতএব,যারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে এবং নিজেদেরকে (পথভ্রষ্টতা হতে রক্ষার জন্যে) তাঁর সাথে ধারণ করে রেখেছে আল্লাহ্ শীঘ্রই তাদেরকে তাঁর রহমত ও অনুগ্রহে প্রবিষ্ট করাবেন এবং তাদেরকে সরল সঠিক সুদৃঢ় পথে পরিচালিত করবেন।” (সূরা নিসা : ১৭৪-১৭৫)

তাওহীদের আরেক তাৎপর্য হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া আর সকলের ও সব কিছুর বন্দিদশা ও গোলামীর বন্ধন থেকে সকল মানুষকে মুক্তি দান। আর এরই অন্য অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার বন্দেগী বা দাসত্বের অপরিহার্যতা। যে সব মানুষ আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নিকট কোন না কোনভাবে আত্মসমর্পিত ও বন্দী হয়ে আছে (সে বন্দিত্ব চিন্তা,সংস্কৃতি,অর্থনীতি ও রাজনীতি-যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন) ইবাদত বা গোলামীর ব্যাপক অর্থের দৃষ্টিতে সে তার নিজেরই মত গোলামদের দাসত্ব ও ইবাদতে জড়িয়ে পড়েছে এবং আল্লাহ তায়ালার জন্যে সমকক্ষ ও প্রতিযোগী গ্রহণ করেছে। তাওহীদ এ ধরনের জীবন যাপনকে প্রত্যাখ্যান করে। তাওহীদ মানুষকে শুধু আল্লাহর গোলাম মনে করে এবং আল্লাহর মোকাবিলায় প্রতিযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ যে কারো,যে কোন ব্যবস্থার ও সার্বিকভাবে যে কোন আধিপত্যকামীর দাসত্ব ও বন্দিত্ব অবস্থা থেকে তাকে মুক্ত করে দেয়। অতএব,তাওহীদ মানে হচ্ছে আল্লাহর আধিপত্য মেনে নেয়া এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সকলের ও সব কিছুর আধিপত্যকে-তা যে রং,যে ধরন ও যে পোশাকেরই হোক না কেন- অস্বীকার করা।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ

“সার্বভৌমত্ব আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জন্যই নয়;তিনি আদেশ করেছেন একমাত্র তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত বা গোলামী করো না। আর এটিই হচ্ছে সুদৃঢ় আদর্শ।” (ইউসুফ : ৪০)

আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ

“আর তোমার প্রভু এই চিরস্থায়ী বিধান দিয়েছেন যে,তোমরা কেবল তাঁকে ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করবে না।” (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩)

এ দৃষ্টিতে মানুষকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদানও তাওহীদের অন্যতম তাৎপর্য। মানুষের মধ্যে গৌরব ও মর্যাদার যে উপাদান রয়েছে তা এতই মূল্যবান যে,তাকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকটেই বন্দী,অবনত ও লাঞ্ছিত হওয়া চলে না। কেবল সে-ই নিরঙ্কুশ,পরম সত্তা ও পূর্ণ পরম সুন্দরের সামনেই মানুষের পক্ষে ভক্তি প্রকাশ,তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন শোভনীয় হতে পারে। কারণ এই মহান সত্তাই হচ্ছেন মহত্ত্ব ও উন্নত স্তরের প্রতীক। এই মহান ও সমুন্নত সত্তা ব্যতীত কেউই এমন স্তরের নয় যে,মানুষকে তার দাস ও প্রশংসাকারীতে পরিণত করতে পারে। যেসব প্রাণহীন বা প্রাণসম্পন্ন দেবদেবী নিজেদেরকে মানুষের মন-মগজ-অন্তঃকরণ ও শরীরের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং মানুষের জীবনের যে বিশাল ক্ষেত্র হচ্ছে মহান আল্লাহ্ রাজত্ব তাকে অন্যায়ভাবে জবরদখল করে নিয়েছে,তাদের সবাই ও সবই হচ্ছে অপবিত্র। আর অপবিত্র বস্তু হচ্ছে এমন বস্তু যা মানুষকে পবিত্রতা ও স্বভাবগত পরিচ্ছন্নতা থেকে বিচ্যুত করে এবং তাকে নিকৃষ্ট,হীন ও অপমানিত করে থাকে। মানুষকে তার উন্নত মর্যাদা ফিরে পাবার জন্য এসব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে এবং স্বীয় সত্তা থেকে তাদের দাসত্বের ঘৃণ্য নিকৃষ্টতা দূরীভূত করতে হবে।

বস্তুবাদে বিশ্বাসী কোন মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব,মহত্ত্ব ও মৌলিকত্বকে এত সূক্ষ্ম ও এত গভীরভাবে উপস্থাপন করতে পারে নি।

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ حُنَفَاءَ لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِينَ بِهِ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

“অতএব,তোমরা দেবমূর্তির নোংরামি,অপবিত্রতা ও মিথ্যা কথা পরিহার কর। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে তাঁর জন্যে একনিষ্ঠ হয়ে যাও। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে (তার তুলনা হচ্ছে যেন) সে আকাশ থেকে পতিত হলো এবং (মড়াখেকো) পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বায়ুপ্রবাহ তাকে দূররর্তী কোন স্থানে নিক্ষেপ করল।” (সূরা হজ্ব : ৩০-৩১)

মহান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন :

لَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَخْذُولًا

“আল্লাহর সাথে আর কাউকে ইলাহ্ হিসেবে গ্রহণ করো না,কারণ তাহলে তিরস্কৃত ও নিঃসহায় হয়ে বসে পড়বে (মানসিক গতিশীলতা হারিয়ে ফেলবে)।” (সূরা বনি ইসরাইল : ২২)

মহান আল্লাহ্ আরো বলেছেন :

وَلَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَدْحُورًا

“আল্লাহর সাথে আর কোন ইলাহ গ্রহণ করো না। কারণ তাহলে ধিকৃত ও সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৯)

মানুষের সত্তা ও তার জীবনক্ষেত্রের ঐক্য,অভিন্নতাও তাওহীদের অন্যতম তাৎপর্য। মানুষের জীবন হচ্ছে কল্পনাশক্তি ও বাস্তবতা তথা চিন্তা ও কর্মের সমষ্টি। এ দু’য়ের একটি বা প্রতিটির অংশ বিশেষ যদি খোদাবিরোধী কেন্দ্র ও শক্তির অনুগত হয়-আল্লাহর অনুগত মন-মগজ আল্লাহকে অস্বীকারকারী বাস্তবতার সাথে বা আল্লাহর পছন্দনীয় বাস্তবতা আল্লাহর পরিচয়বিহীন মন-মগজের সাথে যুক্ত হয় তাহলে মানুষের জীবনে স্ববিরোধিতার সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর ইবাদত বা দাসত্বে শিরকের আবির্ভাব ঘটে। এ ক্ষেত্রে মানুষের অবস্থা হচ্ছে কম্পাসের সেই কাঁটার ন্যায় যা কোন বাইরের চুম্বকক্ষেত্রের আওতায় এসে পড়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সে যদি সঠিক কেন্দ্রের দিকে মুখ ফেরাতে সক্ষম না হয় তাহলে তাকে কম্পিত ও দিশাহারা অবস্থার শিকার হতে হয় অর্থাৎ সে মানবীয় উৎসের দাবী সঠিক সুদৃঢ় পথ ও সঠিক লক্ষ্য তথা খোদায়ী লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ

“তোমরা কি কিতাবের এক অংশকে গ্রহণ কর এবং অপর অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? তোমাদের মধ্যে যারাই এরূপ করবে তাদের এ ছাড়া আর কি প্রতিদান হতে পারে যে,তারা পার্থিব জীবনে লাঞ্ছিত-অপদস্ত হবে এবং কিয়ামতের দিনে কঠিনতর শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে।” (সূরা বাকারা : ৮৫)

মানুষের পারস্পরিক সমন্বয় ও তার চতুষ্পার্শ্বস্থ বিশ্ব-জগতের সাথে তার সহযোগিতাও তাওহীদের অন্যতম তাৎপর্য। সুবিশাল ও সুবিস্তৃত সীমাহীন বিশ্ব হচ্ছে সৃষ্টির অসংখ্য ও অমোঘ বিধি-বিধানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিশাল ক্ষেত্র। এ জগতের ক্ষুদ্রতম বস্তুটিও এই নিয়মের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার আওতার বাইরে নয়। সৃষ্টির নিয়মকানুনসমূহের পারস্পরিক মিল ও সমন্বয়ের মাধ্যমেই সৃষ্টিলোকের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং বিশ্বের পছন্দনীয় ও মনোমুগ্ধকর শৃঙ্খলা অস্তিত্ব লাভ করে থাকে। মানুষও এই সমষ্টির অংশ বিশেষ এবং সে সৃষ্টিজগতের সর্বজনীন ও বিশেষ নিয়ম-কানুনের সাথে সমন্বয়ের অধিকারী।

কিন্তু অন্যান্য সৃষ্টি যেখানে প্রকৃতির পান্থশালায় ও নিজ প্রকৃতির নিকটে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সমর্পিত,তার বিপরীতে মানুষ নির্বাচন ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তির অধিকারী;স্বাধীন সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তাকে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পথ বেছে নিতে ও অনুসরণ করতে হবে। কারণ এতেই তার উন্নতি-অগ্রগতি নিহিত রয়েছে। এর মানে হচ্ছে,সে চাইলে এই প্রাকৃতিক গতিধারা থেকে বিচ্যুত হতে পারবে।

মহান আল্লাহ্ বলেন :

فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ

“অতঃপর যে চাইবে ঈমান আনয়ন করুক এবং যে চাইবে কুফরী করুক” (সূরা কাহাফ :২৯)

তাওহীদ মানুষকে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পথের দিকে আহ্বান করে-যে পথ সমগ্র বিশ্বলোকের অভিন্ন চলার পথ। আর এ তাওহীদ বিশ্বলোকের শ্রেষ্ঠতম সদস্য মানুষকে কাজ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর সাথে জুড়ে দেয় এবং এভাবেই বিশাল সৃষ্টিলোকে ঐক্য ও অভিন্নতার আবির্ভাব ঘটায়।

মহান আল্লাহ্ এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ

“তারা কি মহান আল্লাহর ধর্মকে ত্যাগ করে অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে? অথচ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবাই নিজের ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক,তাঁর (আল্লাহর) কাছে আত্মসমর্পিত রয়েছে। আর তার কাছেই সবাইকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (আলে ইমরান : ৮৩)

মহান আল্লাহ্ আরো বলেছেন :

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ

“তুমি কি দেখ না,আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে যারা রয়েছে এবং চন্দ্র,সূর্য,নক্ষত্ররাজি,পাহাড়-পর্বত,বৃক্ষরাজি,চতুষ্পদ প্রাণীকুল এবং অনেক মানুষ তাঁকে সিজদাহ্ করে থাকে?” (সূরা হজ্ব : ১৮)

গ) সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে

তাওহীদ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যে কারো জন্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও মানুষ সংক্রান্ত বিষয়ে নিজের খেয়াল খুশী মাফিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার যোগ্যতা ও অধিকার অস্বীকার করেছে। এর কারণ হচ্ছে,যিনি মানুষ ও বিশ্বলোকের স্রষ্টা এবং এতদ্সংক্রান্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিকল্পনাকারী কেবল তিনিই তাদের মধ্যে নিহিত সম্ভাবনা ও তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকেফহাল। মানুষের শরীর ও আত্মায় নিহিত প্রতিভা,সম্ভাবনা ও শক্তি সম্বন্ধে,সমগ্র বিশ্ববহ্মাণ্ডে সঞ্চিত সীমাহীন সম্পদ ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে এবং এ সবের ব্যবহারের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে তিনিই অবগত এবং অত্যন্ত উত্তমরূপে অবগত। অতএব,কেবল তিনিই মানুষের জীবনধারা নির্ধারণ ও মানুষের যাবতীয় সম্পর্কের রূপরেখা প্রণয়ন-যা হচ্ছে এই সৃষ্টিলোকে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীনে তার চলার পথ তা নির্ধারণে এবং তার জীবন পদ্ধতি ও সমাজ ব্যবস্থা রচনায় সক্ষম।

মহান আল্লাহর এই অধিকার হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু হিসেবে স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত অধিকার। অতএব,মানুষের জন্যে চলার পথ ও কর্মধারার ক্ষেত্রে অন্যদের যে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ,খোদার বরাবরে অন্যদেরকে ইলাহ্ বলে ঘোষণা করাও শিরক বলে গণ্য।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

“না,(তারা যা বলছে,প্রকৃত ব্যাপার তদ্রূপ নয়,বরং) তোমার খোদার শপথ,যতক্ষণ না তারা তাদের বিরোধপূর্ণ বিষয়সমূহে (হে রাসূল) তোমার কর্তৃত্ব ও বিচার অধিকার মেনে নেয় এবং এরপর তোমার দেয়া ফয়সালা সম্বন্ধে অন্তরে কোনরূপ অসন্তেুাষ ও কষ্ট অনুভব না করে,বরং পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে ততক্ষণ তারা ঈমানের অধিকারী হবে না।” (সূরা নিসা : ৬৫)

আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا

“কোন মুমিন নারী-পুরুষের এ অধিকার নেই যে,কোন ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মীমাংসা দেয়ার পর স্বীয় ব্যাপারে নিজেই ইখতিয়ারের অধিকারী হবে। আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে নিঃসন্দেহে সে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হবে।” (সূরা আহযাব : ৩৬)

তাওহীদ সমাজের শাসন-কর্তৃত্ব ও মানুষের জীবনের ওপর কর্তৃত্বের অধিকার আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যে কারো জন্যেই অস্বীকার করে। মানুষের ওপর মানুষের শাসন-কর্তৃত্বকে যদি একটি দায়িত্বহীন স্বাধীন অধিকার হিসেবে দেখা হয় তাহলে তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে জুলুম-নির্যাতন,বিদ্রোহ ও সীমা লঙ্ঘন। উচ্চতর শক্তির পক্ষ থেকে সমাজের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ব্যক্তি বা সমষ্টির ওপর অর্পিত হলে এবং এর সাথে যথাযথ দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা জড়িত থাকলে কেবল তখনই বক্রতা,বিদ্রোহাত্মক আচরণ ও বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত থাকার সম্ভাবনা থাকে। ধর্মীয় মতাদর্শের এই উচ্চতর শক্তি হচ্ছেন আল্লাহ্ যার জ্ঞান সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :

لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ

“আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে একটি অণুও তাঁর নিকট থেকে গোপন নয়।” (সূরা সাবা : ৩)

যিনি শৌর্য গুণের অধিকারী এবং যাঁর প্রতিশোধ অত্যন্ত কঠোর- যে কারণে তিনি কঠোর শাস্তি দাতা (شدید العقاب) এবং মহাপরাক্রান্ত প্রতিশোধ গ্রহণকারী (عزیز و ذو انتقام)। সুতরাং তাঁর মনোনীত ব্যক্তিবর্গ যে পথভ্রষ্ট হবেন তার কোনই আশংকা নেই। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

ولَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ

 “সে (নবী) যদি নিজের পক্ষ থেকে কিছু কথা আমাদের নামে চালিয়ে দিত তাহলে আমরা তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম;এরপর তার কণ্ঠ শিরা ছিঁড়ে ফেলতাম।” (আল হাক্কাহ্ : ৪৪-৪৬)

আল্লাহ তায়ালা ‘জনগণ’ বা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠঅংশের’র মত নন যে,তাঁকে বোকা বানানো যাবে বা তাঁর ঘাড়ে সওয়ার হওয়া যাবে। তিনি রাজনৈতিক দলের মতও নন যে,তাঁকে শক্তিমত্তা প্রদর্শন ও কণ্ঠরোধ করার হাতিয়ারে পরিণত করা যাবে। তিনি অভিজাত শ্রেণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতও নন যে,তাঁকে কিনে নেয়া যাবে বা তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন করা যাবে।

আরো সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে,মানুষের জীবনের জন্যে যদি এটিই অপরিহার্য হয়,জীবনের সকল সংস্থা অভিন্ন শক্তিকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সকল কাজের নিয়ন্ত্রণ এক মহাশক্তিমান সত্তার হাতে নিবদ্ধ থাকবে-আসলেও ব্যাপারটি ঠিক এরকমই,তাহলে এই হাত বিশ্ব-জগত ও মানুষের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর হাত ব্যতীত অন্য কিছু হওয়া সম্ভব নয়।

অতএব,রাষ্ট্রক্ষমতা ও মানুষের ওপর কর্তৃত্ব হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অধিকার যা তাঁর মনোনীত ব্যক্তিদের যাঁরা খোদায়ী মতাদর্শে নির্ণীত মানদণ্ড ও আদর্শের বিচারে যে কারো চেয়ে যোগ্যতর,তাঁদের মাধ্যমে বাস্তবরূপ লাভ করে থাকে এবং তাঁদের মাধ্যমে খোদায়ী রাষ্ট্রব্যবস্থার হেফাজত ও তাঁর বিধি-বিধান বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَتَّخِذُ وَلِيًّا فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ يُطْعِمُ وَلَا يُطْعَمُ قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَسْلَمَ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

“বল,আমি কি আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা-যিনি জীবিকা দেন এবং জীবিকা গ্রহণ করেন না-সেই আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে শাসক ও কর্তা হিসেবে গ্রহণ করব? বল,নিঃসন্দেহে আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে,আমি যেন সর্বাগ্রে আত্মসমর্পণকারী হই;আর তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (সূরা আনআম : ১৪)

আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :  

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ

‘‘নিঃসন্দেহে তোমাদের অভিভাবক হচ্ছেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রসূল ও সেই মুমিনগণ যারা নামাজ কায়েমকারী এবং রুকু অবস্থায় যাকাত আদায়কারী।” (সূরা মায়েদাহ্ : ৫৫)

মহান আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ مَلِكِ النَّاسِ إِلَهِ النَّاسِ

‘‘বল,আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের প্রভু,মানুষের মালিক ও মানুষের উপাস্যের নিকট?’’ (সূরা নাস : ১-৩)

তাওহীদ মানে বিশ্বলোকে বিরাজমান সকল নেয়ামত-সকল ধন-সম্পদের নিরঙ্কুশ ও প্রকৃত মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। অন্য কেউই কোন কিছুর স্বাধীন মালিক নয়,বরং সব কিছু মানুষের হাতে আমানতস্বরূপ;নিজেদের পূর্ণতা ও উন্নতির জন্য নিজেরা এসব থেকে ফায়দা ও সহায়তা গ্রহণ করবে। বিশ্বের হাজার হাজার প্রচেষ্টাকারীর প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিস্বরূপ এসব সম্পদ যাদের হাতে রয়েছে তারা এসব সম্পদ ধ্বংস বা বিনা ব্যবহারে ফেলে রাখার বা মানুষের উন্নতি ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করার অধিকার রাখে না। মানুষের হাতে যে সম্পদ রয়েছে যদিও সে সম্পদ তারই জন্য তথাপি তা আল্লাহ তায়ালারই দান বৈ অন্য কিছু নয়। অতএব,তা আল্লাহ তায়ালার নিদের্শিত পথেই ব্যয় করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এ সব সম্পদের স্বাভাবিক ও যথার্থ ব্যবহার হতে হবে যে ব্যবহারের জন্য এ সবকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর বাইরের অন্য যে কোন লক্ষ্যে বা যে কোন পথেই ব্যবহার করা হোক,তাতে সম্পদকে তার স্বাভাবিক ব্যবহার থেকে বিচ্যুত করা হয় এরই নাম ‘ফাসাদ’ বা ধ্বংস সাধন।

আল্লাহ তায়ালার দেয়া হরেক রকমের বিপুল সম্পদের ক্ষেত্রে মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে এ সবের সঠিক ব্যবহার;অবশ্য তার পূর্বে এ সম্পদকে প্রাণময় করে তুলতে হবে;পূর্ণতায় উপনীত করতে হবে।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

قُلْ لِمَنِ الْأَرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

“বল,তোমাদের যদি জানা থাকে তাহলে বল,এ যমিন এবং তাতে যারা রয়েছে তারা কার? তারা বলবে : আল্লাহর। তাহলে কেন তোমরা সতর্ক হও না?” (সূরা মুমিনুন : ৮৪-৮৫)

তিনি আরো এরশাদ করেন :

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

“যমিনে যা কিছু আছে তার সব কিছু তিনিই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।” (বাকারা : ২৯)

আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ هُوَ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَاسْتَعْمَرَكُمْ فِيهَا

“তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর,কারণ তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ্ নেই। তিনিই তোমাদেরকে যমিন থেকে উদ্ভব ঘটিয়েছেন এবং এর বুকেই তোমাদের বসতি স্থাপন করিয়েছেন।” (সূরা হুদ : ৬১)

আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেছেন,

وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ

‘‘যারা আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ্ যা সংযুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং ধরণীর বুকে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে,তাদের ওপরে (আল্লাহর) অভিশাপ।” (সূরা রা’দ : ২৫)

তাওহীদ মানে এও যে,বিশ্বের সম্পদরাজির ক্ষেত্রে সকল মানুষের অধিকার সমান। এতদ্সংক্রান্ত সকল উপায়-উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধার অধিকার সর্বজনীন যাতে এই বিশাল সম্পদ ভাণ্ডার থেকে প্রত্যেকে স্বীয় প্রচেষ্টা ও কর্মতৎপরতা অনুযায়ী সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। এই সুবিশাল সীমাহীন বিশ্বের কোন অংশই বিশেষভাবে কারো নয়,বরং প্রত্যেকে এ বিশ্ব থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা অর্জনের জন্য নানা চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও স্বাধীন ইচ্ছার ব্যবহার করতে পারে। এ সুযোগ কোন বিশেষ কোন বর্ণের,বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের বা ইতিহাসের বিশেষ অধ্যায়ের,এমন কি কোন আদর্শে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত নয়।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

‘‘তিনিই ধরণি বক্ষের সব কিছুকে তোমাদের সকলের জন্য (সকল মানুষের জন্য,গোষ্ঠী বিশেষের জন্য নয়) সৃষ্টি করেছেন।’’ (সূরা বাকারা : ২৯)

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সূরা নাহলের প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াতে সকল মানুষকে সম্বোধন করে বলেছেন,

وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ  وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ

‘‘তিনি জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি করেছেন;তাতে তোমাদের জন্য পোশাক ও অন্যবিধ উপকার রয়েছে এবং তোমরা তাদের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করে থাক। তাতে তোমাদের জন্য সৌন্দর্য রয়েছে যখন তোমরা (সেগুলোকে) বিচরণের জন্য পাঠাও এবং যখন ফিরিয়ে আন। আর তারা তোমাদের বোঝাসমূহ বহন করে।’’ (নাহল:৫-৭)

و................ لِتَرْكَبُوهَا

‘‘এবং যাতে তোমরা তাদের ওপর সওয়ার হতে পার।’’ (৮)

এই ধারাক্রমে এরপর এরশাদ হয়েছে :

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لَكُمْ مِنْهُ شَرَابٌ وَمِنْهُ شَجَرٌ فِيهِ تُسِيمُونَ يُنْبِتُ لَكُمْ بِهِ الزَّرْعَ

‘‘তিনিই আসমান থেকে তোমাদের জন্য পানি বর্ষণ করেছেন যা থেকে তোমরা পান কর এবং এ থেকে উদ্ভিদ জন্ম গ্রহণ করে যাতে তোমরা (পশু) চরিয়ে থাক। তিনি এ পানির সাহায্যে তোমাদের জন্য ফসল ফলান।’’ (১০-১১)

وَمَا ذَرَأَ لَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ

‘‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীতে রংবেরঙের (বস্তু) সৃষ্টি করেছেন।” (১৩)

وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا

‘‘তিনিই তোমাদের জন্য সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছেন যাতে তোমরা তা থেকে তাজা গোশত খেতে পার এবং তোমাদের পরিধানের জন্য সৌন্দর্য-শোভার বস্তুসমূহ আহরণ করতে পার।” (১৪)

এই ধারাক্রমের শেষদিকে এরশাদ হয়েছে :

إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ

‘‘তোমাদের খোদা হচ্ছেন একই খোদা।’’ (২২)

এই ধারাক্রমের মাঝে আরো এরশাদ হয়েছে।

وَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ

‘‘তিনি যদি চাইতেন তোমাদের সকলকেই পথ প্রদর্শন করতেন।’’ (৯)

এসব আয়াতের সর্বত্রই সকল মানুষকেই সম্বোধন করা হয়েছে,গোষ্ঠী বিশেষকে নয়।

এ পর্যন্ত যা উল্লেখ করা হলো তা হচ্ছে তাওহীদের অত্যন্ত সমৃদ্ধ,গভীর ও বহুমুখী তাৎপর্যের অংশ বিশেষ মাত্র। এ সংক্ষিপ্ত উল্লেখ থেকেই বোঝা যেতে পারে,তাওহীদ কেবল একটি দার্শনিক ও চিন্তাপ্রসূত মতাদর্শ নয় বা কোন অবৈজ্ঞানিক ধারণা নয় যা মানুষের ভালো-মন্দ ধারণা নিয়ে মাথা ঘামাবে না,মানুষের কাফেলায় হস্তক্ষেপ করবে না এবং মানুষের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও তার চেষ্টা-সাধনা,কর্মতৎপরতা,উচিত-অনুচিতের ব্যাপারে কথা বলবে না এবং শুধু মানুষকে কোন বিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়ে অন্য কোন বিশ্বাস গ্রহণ করানোকেই যথেষ্ট মনে করবে,বরং তাওহীদ হচ্ছে একদিকে এক বিশ্বদৃষ্টি- বিশ্বলোক,মানুষ,বিশ্বের অন্যান্য সৃষ্টির মোকাবিলায় মানুষের অবস্থান,ইতিহাসে তার অবস্থান,তার মাঝে নিহিত প্রতিভা ও সম্ভাবনা,তার সহজাত প্রয়োজন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং শেষ পর্যন্ত তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য,তার উন্নতির শীর্ষবিন্দু ইত্যাদি সম্বন্ধে বিশেষ তাৎপর্য গ্রহণ। অন্যদিকে তাওহীদ হচ্ছে এক সামাজিক মতবাদ,মানুষের উপযোগী পরিবেশ গঠনের এক পরিকল্পনা- এমন এক পরিবেশের পরিকল্পনা যেখানে মানুষ খুব সহজে ও অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বিকাশ লাভ করতে পারবে এবং বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত উন্নতি ও পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। তাওহীদ হচ্ছে সমাজের জন্য সীমারেখা ও সমাজকে ঢেলে গড়ার লক্ষ্যে ছাঁচের প্রস্তাবনা যাতে তার মূল ও নীতিগত সীমারেখা ও পন্থরেখাসমূহ চিহ্নিত করে দেয়া হয়। এ কারণে যখনই জাহেলী ও খোদাদ্রোহী সমাজে- যে সব সমাজ মানুষের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞতা অথবা তার সঠিক মূল্যমানের প্রতি বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,সেখানে তাওহীদ উপস্থাপিত হয়,তখন সেখানে এক ওলট-পালট সৃষ্টি করে। তখন তা মৃত অন্তঃকরণকে পুনরুজ্জীবিত করে,অসুস্থ প্রাণকে সুস্থ করে তোলে,সমাজের বদ্ধ ডোবায় ঝড়-তুফানের সৃষ্টি করে,বিশৃঙ্খল ও বল্গাহারা সমাজে শৃঙ্খলা ও সমণ্বয়ের উদ্ভব ঘটায়;মনস্তাত্ত্বিক সংগঠনে,অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিসমূহে এবং চারিত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধে পরিবর্তন ও রূপান্তর আনয়ন করে। মোদ্দা কথা,তাওহীদ হচ্ছে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং তার সংরক্ষণকারী শক্তি ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে,এবং সেখানে বিরাজমান ও লালিত পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

অতএব,তাওহীদ শুধু মতাদর্শগত ও জ্ঞানক্ষেত্রে বিশিষ্ট বিষয়ে নতুন কথা মাত্র নয়,বরং মানুষের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া নতুন পথও বটে,যদিও তা চিন্তাপ্রসূত ও মতাদর্শগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করে থাকে। কিন্তু তার পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে জীবনযাপন ও কর্ম সম্পাদনের এক ভিন্নতর পদ্ধতির প্রদর্শন। ( সূত্র:জ্যোতি, বর্ষ ১, সংখ্যা ৩)

(চলবে)

 

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)