হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) এর শাহাদত
সাহাবী হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বনী মাখযুম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমবয়সী। তাঁর মাতার নাম সুমাইয়া বিনতে খাইয়াত যিনি বনী মাখযুম প্রধান আবু হুযাইফার দাসী। কুরাইশ গোত্রের আর অন্য কোন দাসী হযরত সুমাইয়ার মত মহানুভব,বুদ্ধিমতী,দয়ালু,বিশ্বস্ত,শালীন,ভদ্র ও চরিত্রবান ছিল না। হযরত আম্মারের পিতা ইয়াসির ইবনে আমের ছিলেন উনাস বংশীয়। এই উনাস গোত্র ছিল ইয়ামানের মাযহাজী কাহ্তানীয় আরবদের অন্তর্ভুক্ত। স্মর্তব্য,আম্মার এবং তাঁর পিতা-মাতা ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমান। অর্থাৎ তাঁরা ‘আস্ সাবেকুনাল আওয়ালুন’-এর অন্তর্ভুক্ত। আম্মারের পিতা-মাতা ইয়াসির ও সুমাইয়া ইসলামের প্রথম শহীদ। পাপিষ্ঠ আবু জাহল তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। হযরত আম্মারও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে কুরাইশদের বিশেষ করে আবু জাহলের হাতে অত্যাচারিত ও অবর্ণনীয় দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। মহানবীর নিম্নোক্ত হাদীসগুলো থেকে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের সুমহান ব্যক্তিত্ব,উচ্চ মর্যাদা ও ঈমান সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।
আলী ইবনে আবি তালিব থেকে বর্ণিত : “আমি নবী (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম। ইত্যবসরে আম্মার ইবনে ইয়াসির সেখানে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তখন নবী (সা.) বললেন : তাকে আসার অনুমতি দাও। এ পবিত্র ব্যক্তির আগমন মুবারক হোক।”১
হানী ইবনে হানী (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন,“একদা আম্মার আলীর কাছে উপস্থিত হন। তখন তিনি বলেন : এই পবিত্র ব্যক্তির আগমন মুবারক হোক। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে বলতে শুনেছি,আম্মারের গলা পর্যন্ত ঈমানে ভরপুর।”২
হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন,“রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : আম্মার এমন ব্যক্তি দু’টি বিষয়ে তাকে ইখতিয়ার দেয়া হলে সে এর থেকে হেদায়েতে পরিপূর্ণ বিষয়টি ইখতিয়ার করে।”৩
আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,“রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
أبشر يا عمّار تقتلك الفئة الباغية
হে আম্মার! সুসংবাদ গ্রহণ কর,বিদ্রোহী দলটি তোমাকে হত্যা করবে।”৪
আবু ঈসা বলেন,এ অনুচ্ছেদে উম্মে সালামাহ্,আবদুল্লাহ্ ইবনে আম্মার আবু ইউসর ও হুযাইফা (রা.) থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীসটি হাসান,সহীহ এবং আলা ইবনে আবদুর রহমানের রেওয়ায়েত হিসেবে গরীব।
আনসার ও মুহাজির সাহাবিগণ হযরত উসমানের অপব্যয়,প্রশাসনিক নীতি এবং বনু উমাইয়্যা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও প্রাদেশিক গভর্নরদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অপরাধসমূহের কারণে তীব্র অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সত্য ও ন্যায়পন্থী সাহাবী হযরত আম্মারও স্বাভাবিকভাবে প্রতিবাদী ও সমালোচনামুখর হয়েছিলেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির সুষ্ঠু প্রতিকার ও সমাধান করার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। একদিন কতিপয় সাহাবী হযরত যুবাইর,তালহা ও মিকদাদের সাথে মিলিত হয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা ও আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে খলীফা উসমানের কাছে একটি চিঠি লেখার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা চিঠিতে খলীফার নীতি ও কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা খলীফাকে তাঁর কৃত কার্যকলাপের জন্য অনুতাপ করে পদত্যাগ করারও আহবান জানান।
চিঠিটি লেখার পর হযরত আম্মার এবং আরও দশ ব্যক্তি তা খলীফা উসমানের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। একে একে সকলেই সরে পড়লে হযরত আম্মার একাই চিঠিটি খলীফা উসমানের কাছে হস্তান্তর করলেন। খলীফা উসমান চিঠিটি পড়ে জিজ্ঞেস করলেন,“এ চিঠি কি আপনি লিখেছেন?” আম্মার জবাব দিলেন,“হ্যাঁ আমিই লিখেছি।” তখন খলীফা উসমান জিজ্ঞেস করলেন,“এ চিঠি কি আপনি একাই লিখেছেন?” আম্মার উত্তর দিলেন,“আমি একা লিখি নি। আমার সাথে আরও কয়েকজন ছিলেন।” খলীফা উসমান তখন জিজ্ঞেস করলেন,“আপনি আমাকে তাদের নামগুলো বলুন।” আম্মার জবাবে বললেন,“আমি কোনক্রমেই তাঁদের নাম বলব না।” হযরত উসমান এ কথা শুনে বললেন,“অন্যরা যখন ভয় পেল তখন আপনি কেন একাকী এ পদক্ষেপ নিলেন?”
ঐ সময় মারওয়ান খলীফা উসমানকে বলল,“আর কতক্ষণ আপনি এ কালো দাসের সামনে ধৈর্যধারণ করবেন? এ লোকটিই জনগণকে আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। আপনি যদি তাকে হত্যা করেন তাহলে যারা তাকে সাহায্য করছে তারা ভয় পাবে। আর অন্যান্য বিদ্রোহী জনগণও তার হত্যা থেকে শিক্ষা নেবে।”
মারওয়ানের কথা শোনার পর খলীফা উসমান হযরত আম্মারকে প্রহার করার আদেশ দেন। আদেশপ্রাপ্ত হয়ে খলীফার দাসেরা আম্মারকে প্রহার করতে লাগল এবং খলীফাও তাদের সাথেঅংশগ্রহণ করলেন। তারা তাঁকে এতটা মারল যে,তিনি হার্নিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। তাঁকে মাটি থেকে তুলে এনে রাস্তায় পরিত্যক্ত বস্তুর মত ছুঁড়ে ফেলা হয়।
এ ঘটনা ঘটার পর উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামাহ্ শোরগোলের কারণ জানার জন্য সেখানে আসলেন এবং অজ্ঞান আম্মারের কাছে গেলেন। যখন তিনি আম্মারকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পেলেন তখন তিনি তাঁকে তাঁর ঘরে আনার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা আম্মারকে হযরত উম্মে সালামার ঘরে বহন করে আনল। সেখানে আম্মার সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে রইলেন যার ফলে তাঁর যোহর,আসর,মাগরিব ও এশার নামায ক্বাযা হয়ে গেল।
সংজ্ঞা ফিরে এলে হযরত আম্মার দেখতে পেলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামাহ্,আয়েশা ও হাফসা এবং যারা তাঁর সাথে কলহ করেছিল তারা সকলেই তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তখন তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তাঁর ক্বাযা নামাযগুলো আদায় করলেন। নামাযান্তে তিনি আবু জাহলের কীর্তিকলাপ স্মরণ করিয়ে বললেন,
الحَمْدُ لله ليسَ هذا أوَّلَ يومٍ أُوْذينا في اللهِ
“এই প্রথমবারের মত আমি প্রহৃত হই নি;বরং এর আগেও আমি মহান আল্লাহর পথে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছি।”
হযরত আম্মারকে প্রহার ও সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার পর খলীফা উসমান তাঁর বাড়ী থেকে বের হয়ে দেখতে পেলেন,বনু মাখযুম সেখানে একত্রিত হয়ে হৈ চৈ করছে এবং তাদের নেতা হিশাম বিন ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্ও সেখানে উপস্থিত এবং তাঁদের সহযোগীরা আম্মারের প্রতি যে অপমান করা হয়েছে সে কারণে খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন।
হযরত আম্মারের মুমূর্ষু অবস্থা স্মরণ করে খলীফা উসমানের দিকে লক্ষ্য করে হিশাম বলেছিলেন,“মহান আল্লাহর শপথ,আম্মার মারা গেলে আমি অবশ্য অবশ্যই বনু উমাইয়্যার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাকে হত্যা করব।”
হযরত আম্মারের প্রতি এ নিষ্ঠুর আচরণ জনগণের মনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিল। কিন্তু খলীফার কর্মকর্তা ও কর্মচারিগণ এ সব ঘটনা থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করে নি। কারণ তারা মনে করত,তারা কোনভাবে জনগণকে দমন করতে সক্ষম হবে। এত সব নির্যাতন ও লাঞ্ছনার পরও হযরত আম্মার হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন নি;বরং তিনি এ ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন।৫
এ ছাড়াও অপর যে ঘটনাটি হযরত আম্মারের খলীফার রোষানলে পড়ার কারণ তা ছিল এ রকম যে,হযরত আম্মার খলীফাকে না জানিয়েই সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের জানাযার গোসল দিয়েছিলেন,নামায পড়েছিলেন এবং জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে দাফন করেছিলেন। আর যখন উসমান এ ব্যাপারটি জানতে পারলেন তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং হযরত আম্মারকে প্রহার ও তিরস্কার করেছিলেন।৬
তথ্যসূত্র
১. সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,হাদীস নং ১৪৬,পৃ. ৯৩,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।
২. সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,হাদীস নং ১৪৭,পৃ. ৯৩,ই. ফা. বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।
৩. সুনানে ইবনে মাজাহ্ ১ম খণ্ড,হাদীস নং ১৪৮,পৃ. ৯৩,ই. ফা. বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।
৪.“হে আম্মার! বিদ্রোহী দলটি তোমাকে হত্যা করবে” শীর্ষক হাদীসটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাতাদাহ্ ইবনুন নোমান,উম্মে সালামাহ্ (সহীহ মুসলিমে),আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর (নাসাঈ),উসমান ইবনে আফ্ফান,হুযাইফা,আবু আইউব,আবু রাফে,খুযাইমা ইবনে সাবেত,মুয়াবিয়া,আমর ইবনুল আস,আবুল ইউসর ও আম্মার (সকলের বর্ণনা তাবরানীতে) প্রমুখ সাহাবী (রা.)। এখানে বিদ্রোহী দলটি বলতে আমীর মুয়াবিয়া ও তাঁর দলকে বোঝানো হয়েছে। কারণ তারা বৈধ ইমামের বিরোধিতা করেন এবং ভ্রান্ত বক্তব্যের আশ্রয় নিয়ে তাঁর আনুগত্য পরিহার করেন। সহীহ বুখারীতে আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত মসজিদে নববী নির্মাণ সম্পর্কিত হাদীসে আছে : “আমরা একটি করে ইট বহন করে নিয়ে যেতাম,আর আম্মার দু’টি করে ইট বহন করে নিত। নবী (সা.) তা দেখে আম্মার-এর চেহারা থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলেন আর বলেন : হায় আম্মার বিদ্রোহী দলটি তাকে হত্যা করবে। সে তাদের জান্নাতের দিকে ডাকবে আর তারা তাকে দোযখের দিকে ডাকবে। উল্লেখ্য,হযরত আম্মার সিফ্ফিনের যুদ্ধে আমীর মুয়াবিয়ার বাহিনী কর্তৃক নিহত হন। (তুহফাতুল আহ্ওযায়ী,১০ম খণ্ড,পৃ. ৩০১) [জামে আত্-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৬৮-৩৬৯,হাদীস নং ৩৭৩৮,বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত]
৫. সাদরুদ্দীন শারাফুদ্দীন প্রণীত আম্মার ইয়াসির (রা.) পৃষ্ঠা ২১৮-২২০,ইসলামিক সেমিনারী পাবলিকেশন্স,করাচী,পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত;আল্লামাহ্ বালাযুরী প্রণীত আনসাবুল আশরাফ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৪৮;ইবনে আবদুল বার প্রণীত আল ইস্তিয়াব,২য় খণ্ড,পৃ. ৪২২;ইবনে কুতাইবাহ্ প্রণীত আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ২৯।
৬. আল্লামাহ্ বালাযুরী প্রণীত আনসাবুল আশরাফ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৪৯;তারিখে ইয়াকূবী,২য় খণ্ড,পৃ. ১৪৭।