তাওহীদের মর্মবাণী (শেষ কিস্তি)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এ অর্থের ভিত্তিতেই আমরা মনে করি,তাওহীদ হচ্ছে দীনের মূল ও ভিত্তি যার ওপরে দীনের সকল স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।
যে মতাদর্শ কেবল অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াদির বিশ্লেষণ করে এবং বড় জোর চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব হিসেবে পরিগণিত হয় তাকে একটি হালকা সূক্ষ্ম বস্তুর সাথে তুলনা করা চলে না যা জীবন গঠনমূলক ইসলামী আদর্শের বিশাল দেহকে একটি সমাজ পদ্ধতি হিসেবে কাঁধে তুলে নিতে সক্ষম নয়।
অবশ্য সব সময়ই এমন কিছু লোক ছিল যারা আল্লাহ্ ও তাওহীদ বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এ বিষয়ের বাস্তব ও কর্মগত কাঠামো,বিশেষত সামাজিক কাঠামোর প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করেছে অথবা স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে একে উপেক্ষা করছে। এই উদাসীন লোকেরা সব সময়ই এবং সর্বাবস্থায়ই তাওহীদে অবিশ্বাসীদের ন্যায় জীবনযাপন করেছে।
ইসলামের আর্বিভাবের যুগে মূর্তিপূজার কেন্দ্রভূমি এবং আরবের নামকরা মূর্তিসমূহের অবস্থানস্থল মক্কা নগরীতে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর অনুসারী ‘হানিফ’নামক আদর্শনিষ্ঠ জনগোষ্ঠীও বসবাস করত। কিন্তু যেহেতু তাদের চিন্তাধারায় তাওহীদের ক্ষেত্র মন-মগজ-অন্তঃকরণ,বড়জোর ব্যক্তিগত আচরণ ও কর্ম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল,এর বাইরে তাদের তাওহীদের ক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল না,সেহেতু তাদের উপস্থিতি বিরাজমান চিন্তাগত ও সামাজিক পরিবেশের ওপর সামান্যতম প্রভাবও বিস্তার করতে পারে নি এবং সেই জাহেলী পথভ্রষ্টতার আবর্তে তাদের অস্তিত্ব আদৌ অনুভূত হতো না। ফলত সেই দুর্ভাগ্যজনক জীবনধারায় সামান্যতম কম্পনও সৃষ্টি হতো না। কার্যত সকলেই একই ঘাটের পানি পান করত এবং তথাকথিত তাওহীদ বিশ্বাসীরাও তেমন একটা মনোকষ্ট ছাড়াই অন্যদের সাথে চারণভূমিতে বিচরণ করত। আর যেহেতু তারা একই পদ্ধতিতে ও অভিন্ন ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিত,সেহেতু তাওহীদ তাদের নিকট এ ধরনেরই দৃষ্টিকোণ ও চিন্তাগত তাৎপর্য বহন করত অর্থাৎ তাওহীদ তাদের নিকট কোন অর্থ বহন করত না এবং জীবনে,বিশেষ করে সামাজিক জীবনে তাওহীদের কোন ভূমিকা ছিল না। ঠিক এমনি এক পরিস্থিতিতে জীবনের জন্য বিশেষ অর্থ বহনকারী চিন্তাধারা এবং সমাজের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ছাঁচ রচনাকারীরূপে ইসলামী তাওহীদ ময়দানে অবতীর্ণ হলো এবং প্রথম পদক্ষেপেই গ্রহণকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী নির্বিশেষে সকল শ্রোতার সামনে স্বীয় প্রকৃতিকে এক বিপ্লবী আহবানরূপে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরল। সবাই জানত,এ বাণী হচ্ছে এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা,অর্থ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা বিশ্বে বিরাজমান ব্যবস্থার সাথে কিছুতেই বিন্দুমাত্র আপোস করবে না।
অর্থাৎ তাওহীদ বিরাজমান ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অন্য একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। তাওহীদের এই সুস্পষ্ট মর্মবাণীর কারণেই এর সমর্থক ও গ্রহণকারীরা এভাবে পাগলপারা হয়ে তাওহীদকে আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং এর সামনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। অন্যদিকে এর প্রত্যাখ্যানকারী ও বিরোধিতাকারীরাও একই কারণে এত নির্মমতার সাথে এ তাওহীদের প্রতি স্বীয় থাবা বিস্তার ও দন্তরাজি প্রদর্শন করে এবং এর বিরুদ্ধে তাদের কঠোরতা দিনের পর দিন বৃদ্ধি করে।
এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে তাওহীদের দাবীর যাথার্থ্য ও অযাথার্থ্য নির্ণয় ও মূল্যায়নের মানদণ্ডরূপে গণ্য করা যায়। যেখানেই এমন লোকদেরকে তাওহীদের দাবী করতে দেখা যায় যাদের অবস্থা ইসলামের অত্যুদয়-পূর্ববর্তী মক্কার তাওহীদ বিশ্বাসীদের অনূরূপ তাদেরকে প্রকৃত তাওহীদ বিশ্বাসী বলে মনে করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। আপোসের তাওহীদ-যে তাওহীদ আল্লাহ তায়ালার প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমকক্ষ হবার দাবীদারদের সাথে আপোস করে,যে তাওহীদ চিন্তা জগতে গৃহীত ধারণার বেশি কিছু নয়,তা আসলে নবী রাসূলদের তাওহীদের এক নকল চিত্রের বেশি কিছু নয়।
এ দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রথম যুগে ইসলামের প্রভাব,বিস্তৃতি,শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য এবং পরবর্তী সকল যুগে ইসলামের পশ্চাৎপদতা,কূপমণ্ডুকতা ও প্রভাব গ্রহণকারী বৈশিষ্ট্যের রহস্য জানা যেতে পারে।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তাওহীদকে মানুষের সামনে চলার পথরূপে পেশ করেন। অন্যদিকে পরবর্তী যুগে ইসলামকে মজলিসে আলোচনা ও বিতর্কের মতবাদরূপে পেশ করা হয়। প্রথম যুগে সৃষ্টিলোক সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিকোণ এবং জীবনের গতিশীলতা ও কর্ম-প্রচেষ্টা সংক্রান্ত এক নতুন তত্ত্বরূপে তাওহীদ আবির্ভূত হয়,পরবর্তী যুগে তা কালাম শাস্ত্রের অবসরকালীন সূক্ষ্ম তর্কের মতবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। প্রথম যুগে তাওহীদ সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো এবং সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মূলমর্ম হিসেবে গণ্য হতো। আর বর্তমানে,এটি হলো ঘরের আলংকারিক সাজসজ্জার মাঝে টাঙ্গিয়ে রাখা একটি অনুপম সুন্দর শিল্পসমৃদ্ধ চিত্রপট যাতে সব কিছুর সমাহার ঘটেছে,তার মূলমর্মের সাথে তুলনীয় হচ্ছে তাওহীদ। কিন্তু যা কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতা মাত্র তা থেকে কি সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা আশা করা যায়?
এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা থেকে এ সত্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে,কর্মগত দৃষ্টিকোণ থেকে তাওহীদ হচ্ছে সমাজের জন্য কাঠামো ও ছাঁচ এবং জীবনের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি। ইসলাম মানুষের জীবনের জন্য যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে যথোপযুক্ত গণ্য করেছে এবং যার ছত্রছায়ায় মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব বলে মনে করেছে সামগ্রিকভাবে তারই সুস্পষ্ট ও বাক্সময় শিরোনাম হচ্ছে তাওহীদ। অন্যদিকে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ-থেকে তাওহীদ হচ্ছে এ জীবন ব্যবস্থার দার্শনিক ভিত্তি এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ।
এ পটভূমিতে আমরা আমাদের আলোচনার গোড়ার কথায় প্রত্যাবর্তন করতে চাই এবং এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যার ওপর আলোকপাত করতে চাই।
আমরা বলেছি,তাওহীদ শ্লোগানের বিরুদ্ধে প্রথম যারা সংঘাতে লিপ্ত হয় তারা ছিল সমাজের শক্তিমান এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বশালী অংশ। এ থেকে বোঝা যায়,এ ধ্বনির আঘাত সর্বাধিক ও সকল শ্রেণীর চেয়ে বেশি মাত্রায় সমাজের আধিপত্যবাদী ও শক্তিমান শ্রেণীর ওপর আপতিত হয়েছিল। কোরআন মাজীদের পরিভাষায় যারা মুস্তাকবির বা শক্তিমদমত্ত দাম্ভিক শ্রেণী। আমরা আরো বলছি,সকল যুগেই তাওহীদের দাওয়াত সমাজে উপস্থিত হবার সাথে সাথেই আধিপত্যবাদী শ্রেণীর সাথে স্বীয় হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে নিয়েছে। এ কারণে তাওহীদ সমাজের পরস্পর-বিরোধী দু’টি পক্ষের পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছে। তা হচ্ছে শক্তিমদমত্ত আধিপত্য লিপ্সুদের উপেক্ষা,বিরোধিতা ও বাঁধা এবং দুর্বল করে রাখা (মুস্তাদআফ) শ্রেণীর আগ্রহ প্রদর্শন,গ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
এরপর আমরা বলেছি,এই দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া কার্যত প্রকৃত ও খাঁটি তাওহীদের নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ অতীতের সকল যুগে ও ভবিষ্যতে যখনই তাওহীদকে তার প্রকৃত তাৎপর্য ও যথার্থরূপ সহকারে পেশ করা হয়েছে বা হবে,তখনই অনুরূপভাবে সমাজের দু’পক্ষের বিভক্তি ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান অনিবার্য ছিল এবং ভবিষ্যতেও তাই হবে।
এখন দেখতে হবে তাওহীদের বিভিন্ন কাঠামো ও দিকের মধ্যে কোনটির সাথে সমাজের আধিপত্যকামী শক্তিমদমত্ত শ্রেণীর স্বার্থের,বরং তাদের অস্তিত্বের সংঘর্ষ ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়। অন্য কথায় সমাজের আধিপত্যকামী শক্তিমদমত্ত শ্রেণী তাওহীদের কোন্ বিশ্বদৃষ্টিকে বা সমাজের জন্য প্রদত্ত তাওহীদের কোন্ প্রস্তাবনাকে সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে করে এমন দৃঢ়তার সাথে ও আপোসহীনভাবে তার বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়?
কোরআন মজীদে আধিপত্যকামী শক্তিমদমত্ত বা মুস্তাকবির শ্রেণীর যে চেহারা তুলে ধরা হয়েছে তা এ বিষয়টি অনুধাবনে বিরাট সহায়তা করতে সক্ষম।
কোরআন মাজীদে চল্লিশোর্ধ্ব ক্ষেত্রে মুস্তাকবির শ্রেণীর মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ,সামাজিক অবস্থান ও তাদের আধিপত্যকামিতা ও সম্পদলিপ্সার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এসব আয়াত থেকে সামগ্রিকভাবে এ শ্রেণীর যেসব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তার অন্যতম হচ্ছে : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’বাক্যে আল্লাহ্ তায়ালার যে পরিচিতি পাওয়া যায় অর্থাৎ নিরঙ্কুশ ও একক সার্বভৌমত্ব,আধিপত্য,কর্তৃত্ব ও মালিকানার ইখতিয়ার আল্লাহ্ ছাড়া কারো নয়-তাকে তারা প্রত্যাখ্যান করে,এমন কি,চিন্তাগত,অনুষ্ঠানসর্বস্ব বা সীমিত ক্ষেত্রের তাৎপর্য সহকারে হলেও তাকে গ্রহণ করতে রাজী নয়।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :
انّهم كانوا إذا قيل لهم لا إله إلّا الله يستكبرون
“নিঃসন্দেহে তারা এমন ছিল যে,যখন তাদের সামনে ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই’বলা হলো আত্মম্ভরিতা প্রদর্শন করল (এবং মানল না)।”(সূরা আস সাফফাত : ৩৫)
তারা মর্যাদার কোন যথার্থ মানদণ্ড বৈশিষ্ট্যের অধিকারী না হয়েও নিজেদেরকে অন্য মানুষের তুলনায় উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করে এবং তাদের এ দাবী প্রমাণের জন্য শক্তি ক্ষমতা ও সম্পদের ন্যায় জাহেলী মানদণ্ডের আশ্রয় গ্রহণ করে।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
فاستكبروا في الأرضِ بغير الحقِّ وقالوا مَنْ أشدُّ مِنَّا قوّةً
“অতঃপর তারা ধরণিবক্ষে অন্যায়ভাবে বড়ত্ব জাহির করল এবং বলল: আমাদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কে আছে?”(সূরা ফুসসিলাত : ১৫)
এ ভ্রান্ত ধারণার কারণেই তারা নতুন সমাজ ব্যবস্থার বাণীবাহী ও সঠিক মানদণ্ড নির্ণয়কারী খোদায়ী আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :
وإذا تتلى عليه آياتنا ولَّى مستكبراً كأن لَّم يسمعها كأنَّ في أُذنَيْه وقرًا فبشِّره بعذابٍ ألِيْمٍ
“অতঃপর যখন তার নিকট আল্লাহর বাণী পাঠ করে শোনানো হলো,দাম্ভিকতার সাথে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল যেন তা সে শুনতেই পায় নি,যেন তার কান বধির হয়ে আছে,অতএব,তাকে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।”(সূরা লোকমান : ৭)
তারা নবীর পক্ষ থেকে উপস্থাপিত মুক্তির পথ নির্দেশসম্বলিত আহবানের সাথে মোকাবিলা করতে গিয়ে উপেক্ষা ও অস্বীকৃতির নীতি অবলম্বন করে এবং এই বলে অপযুক্তির আশ্রয় নেয়,‘সত্য হলে আমরা তা আগেই বুঝতে পারতাম’এবং ‘আল্লাহ্ সরাসরি আমাদের সম্বোধন করে জানিয়ে দিতেন’,এই বলেই তারা এ দাওয়াতের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
وقال الّذين كفروا للّذين ءامنوا لوكان خيرًا مّا سبقونا إليه
“আর সত্য প্রত্যাখ্যান ও গোপনকারীরা ঈমানদারদের বলে : এটি (নবীর দাওয়াত) যদি ভাল (সঠিক) হতো তাহলে তা (গ্রহণ) থেকে আমরা পেছনে পড়ে থাকতাম না।”(আহকাফ : ১১)
তাদের সম্পর্কে আরো এরশাদ হয়েছে :
و إذا جآءتهم ءاية قالوا لن نؤمنَ حتى نؤتى مثل مآ أوتي رسل الله
“যখন তাদের সামনে আয়াত আগমন করে,তারা বলে : আল্লাহর রাসূলদের নিকট যা এসেছে তা আমাদের নিকট না আসা পর্যন্ত কিছুতেই আমরা বিশ্বাস করব না।”(আনআম : ১২৪)
তারা তাওহীদী দাওয়াতের পথিকৃৎ ও নেতাকে ক্ষমতালিপ্সু ও স্বার্থান্বেষী বলে আখ্যায়িত করে এবং প্রাচীন বস্তাপচা নিয়ম-কানুন ও আচার আচরণ যা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি,তাকে অবলম্বন করে মানুষের মাঝে তাওহীদী দাওয়াতের কার্যকারিতা ও প্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
قالوا أجئتنا لتلفتنا عمّا وَجَدْنا عليه ءاباءَنَا وتكونَ لكما الْكِبريآء في الأرض وما نحن لكما بمؤمنين
“(মূসাকে সম্বোধন করে) তারা বলল : আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের যেসব (আচার-আচরণ)-এর ওপর পেয়েছি সেসব থেকে তোমরা কি আমাদের ফিরিয়ে নিতে চাও এবং ধরণির বুকে তোমাদের দু’জনের (মূসা ও হারুনের) নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চাও? আমরা কিছুতেই তোমাদের দু’জনের ওপর ঈমান আনয়ন করব না।”(সূরা ইউনুস : ৭৮)
তারা শক্তি প্রয়োগ করে এবং মানুষের ওপর জবরদস্তি খাটাবার বা তাদের বোকা বানাবার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তাদের নিজেদের পছন্দনীয় পথে অর্থাৎ গোলামী,সুবিধাদানকারী ও নিঃশর্ত আদেশ পালনকারীতে পরিণত করার পথে মানুষকে টেনে নেয় এবং মুক্তিবাণী তাওহীদী আহবানের মোকাবিলায় বাধা সৃষ্টিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
وقالوا ربّنآ إنّآ أطَعْنا سادتنا وكبرآءَنا فأضلّونا السّبيلا
“(তাদের অনুসারীরা কিয়ামতের দিন) বলবে : হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের সর্দারদের ও আমাদের মুরুব্বীদের আনুগত্য করেছি,আর তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ছেড়েছে।”(সূরা আহযাব : ৬৭)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :
فيقول الضّعفآؤُا للّذين استكبروا إنّا كنّا لكم تبعاً فهل أنتم مّغنون عنّا نصيباً مِنَ النّار
“কিয়ামতের দিন দুর্বলরা মুস্তাকবিরদেরকে বলবে : আমরা তো (দুনিয়ার বুকে) তোমাদের অনুসরণকারী ছিলাম;আজ তোমরা আমাদের দোজখের শাস্তির একটি অংশ নেবে কি?”(সূরা মু’মিন : ৪৭)
আরো এরশাদ হয়েছে :
قال الملأ مِنْ قوم فرعون إنّ هذا لساحر عليم يريد أن يخرجكم مّن أرضكم فما إذا تأمرون
“ফিরআউনের গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা (জনগণকে সম্বোধন করে) বলল : এ (মূসা) হচ্ছে এক সুদক্ষ যাদুকর;সে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দিতে চাচ্ছে;অতঃপর (ভেবে দেখ) তোমরা কি করবে?”(সূরা আ’রাফ : ১০৯-১১০)
শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা ও চিন্তাধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী এবং তার পরিবর্তন সাধনে প্রয়াসী নবী ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে তারা নিষ্ঠুরতম হামলা পরিচালনা করে এবং ঘৃণ্য পৈশাচিকতা ও নির্মমতা প্রদর্শনে মোটেই ত্রুটি করে না। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন :
قتل أصحاب الأُخدود، النّار ذات الوقود، إذ هم عليها قعود، وهم على ما يفعلون بالمؤمين شهود
“ধ্বংস হোক সেই (অগ্নি) খন্দকের অধিবাসীরা-জ্বলন্ত আগুনের অধিকারীরা যখন তারা যা করছিল (যে নির্যাতন চালাচ্ছিল) তা দর্শন করছিল।”(সূরা বুরুজ : ৩-৭)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেছেন :
وقال فرعون ذروني أقتل موسى وليدع ربّه إنّي أخاف أن يبدّل دينكم أو أن يظهر في الأرض الفساد
“ফিরআউন (তার পারিষদবর্গকে) বলল : আমাকে ছেড়ে দাও,মূসাকে হত্যা করি,আর সে তার খোদাকে ডাকতে থাকুক। আমি ভয় পাচ্ছি,সে তোমাদের ধর্মকে বদলে দেবে এবং ধরণির বুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। (সূরা মুমিন : ২৬)
এ হচ্ছে কোরআন মাজিদে উপস্থাপিত মুস্তাকবিরদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যসমূহের কয়েকটি মাত্র।
কোরআন মাজিদে তাদেরকে চিহ্নিত করতে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে মুস্তাকবির শ্রেণীকে বিশেষ গ্রুপের আকারে বা বিভিন্ন বিশিষ্ট গ্রুপের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের পরিচয়ে উপস্থাপন করেছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন :
ثمّ بعثنا من بعدهم مّوسى وهارون إلى فرعون و ملإيه بئاياتنا فاستكبروا
“অতঃপর তাদের (ঐ নবীদের) পরে আমরা মূসা ও হারুনকে আবির্ভূত করলাম এবং আমাদের নিদর্শন সহকারে ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের নিকট প্রেরণ করলাম। কিন্তু তারা শক্তিমদমত্ততা প্রদর্শন করল।”(সূরা ইউনুস : ৭৫)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :
وقارون وفرعون وهامان ولقد جآءهم مّوسى بالبيّنات فاستكَبروا في الأرض
“(মনে করো) কারুন,ফিরআউন ও হামানের কথা;মূসা অকাট্য ও সন্দেহাতীত নিদর্শনাদি সহকারে তাদের সামনে এল;তারা ধরণির বুকে শক্তিমদমত্ততা প্রদর্শন করল।”(আনকাবুত: ৩৯)
ফিরআউন সম্বন্ধে আমাদের সকলেরই জানা আছে। ঐ যুগে মিশরে ফিরআউনের প্রশাসনে তার পরে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল তার বিশেষ উপদেষ্টা হামান। আর ‘মালায়ে ফিরআউন’মানে হচ্ছে ফিরআউনের প্রশাসনের দায়িত্বশীল ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বা তার পারিষদবর্গ;এরাই ফিরআউনের প্রশাসনের নীতিনির্ধারক,দিক নির্দেশক ও সহযোগী ছিল;মতামত ব্যক্ত করার অধিকারও তাদেরই ছিল। (সূরা আ’রাফের ১২৬তম আয়াত এবং আরো অনেক আয়াতে এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে)। আর কারুন হচ্ছে সেই পুঁজিপতি যার স্বর্ণ-রৌপ্যের ভাণ্ডারসমূহের সবগুলো চাবি বহন করতে কোন শক্তিশালী লোকও সক্ষম ছিল না।
কোরআন মাজিদের বহু আয়াতে মুস্তাকবিরদের যে চেহারা তুলে ধরা হয়েছে তা থেকে আমরা মোটামুটি এই পরিচয় লাভ করি,মুস্তাকবির শ্রেণী হচ্ছে জাহেলী সমাজ আধিপত্যের অধিকারী শ্রেণী যারা কোনরূপ বৈধ অধিকার ছাড়াই সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি কুক্ষিগত করে এবং এই সুবিধা ভোগ ও জুলুমমূলক আধিপত্য স্থায়ী করার লক্ষে মানুষের সংস্কৃতি ও চিন্তা-বিশ্বাসকে পর্যন্ত কুক্ষিগত করে,আর বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে জনগণের মধ্যে এমন চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটায় যার পরিণামে মানুষ তাদের সামনে আত্মসমর্পণ করে এবং বিরাজমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলে। তারা তাদের এ সুবিধা সংরক্ষণের লক্ষে বিপ্লবী ও ওলটপালট সৃষ্টিকারী দাওয়াতের বিরুদ্ধে ত বটেই,বরং সচেতনতা সৃষ্টিকারী ও সঠিক জ্ঞান বিস্তারকারী যে কোন দাওয়াতের বিরুদ্ধে আপোসহীন ও অক্লান্ত সংঘাতে লিপ্ত হয়,কারণ এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম তাদের জন্য জীবন-মরণতুল্য।
*****
এবার আমরা পুনরায় আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাব। তা হচ্ছে : নবী-রাসূলগণ তাওহীদেকে কিভাবে পেশ করতেন? নবী-রাসূলগণের পক্ষ থেকে এ শ্লোগানের উপস্থাপণ একদিকে যেমন তাঁদের প্রচারিত আদর্শের মৌলতম ভিত্তিসমূহকে তুলে ধরে,তেমনি উপস্থাপনের পদ্ধতি খুব সহজে প্রমাণ করে দেয়,তাওহীদের কোন্ কাঠামো ও রূপটি মুস্তাকবিরদের নিকট অসহনীয়।
দ্বিতীয়ত : তা থেকে এও সুস্পষ্ট হয়ে যায়,তাদের নিকট তা অসহনীয় হওয়ার কারণ এবং তাওহীদকে এ অর্থে পেশ করা হলে এ শ্রেণীটি কেন তা সহ্য করতে পারে না।
আমরা জানি,সকল নবী-রাসূলের দাওয়াতের সূচনা হচ্ছে তাওহীদী শ্লোগান;তাঁরা বলতেন,
قولوا لا اله اله تفلحوا
“বল : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”
এ হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জবানীতে বর্ণিত একটি বিখ্যাত বাণী। অন্যদিকে ياقوم اعبدوا الله مالكم من اله غيره (হে জনগণ! আল্লাহর গোলামী কর,কারণ তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ্ নেই) বাক্যটি হযরত নূহ,হযরত হুদ,হযরত সালেহ,হযরত শুআইব প্রমুখ মহান নবী-রসূলদের জবানীতে উদ্ধৃত হয়েছে;নবী-রাসূলগণের দাওয়াতের মূল শিরোনাম হিসেবে কোরআন মাজিদে বেশ কয়েক জায়গায় এ বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
তেমনি আমরা দেখতে পাই,এই শ্লোগানসমূহে অন্য সব কিছুর তুলনায় আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের গোলামী প্রত্যাখ্যানের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে এবং তাওহীদকে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয়েছে। জাহেলিয়াত ও খোদাদ্রোহিতার (তাগূতী) পূতিগন্ধময় পচা ডোবায় হাবুডুবু খাচ্ছে এমন মূর্খ ও আত্মভোলা জনগোষ্ঠীকে নবী এই ধ্বনিসমূহ সহকারে ভয় প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যে কোন মেরু,কেন্দ্র ও শক্তির গোলামী থেকে বিরত থাকার জন্য হুশিয়ার করে দেন;এভাবে কার্যত কর্তৃত্ব-আধিপত্য,প্রভুত্ব ও খোদায়ীর দাবীদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে তাঁর দাওয়াতী কাজের সূচনা করেন।
কোন সমাজে খোদায়ীর দাবীদার কারা? খোদা দাবীদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানে কি?এই সংগ্রাম প্রস্তুতি থেকে নবী-রাসূলদের প্রতিশ্রুত সমাজের জন্য কি ধরনের পরিস্থিতির উপস্থাপনা পাওয়া যায়?
সাধারণত “খোদায়ীর দাবীদার”বলতে মনে করা হয় যে,মানব জাতির ইতিহাসে সব সময়ই মানুষ যে এক পরম শক্তির ওপর বিশ্বাস পোষণ করে আসছে কোন ব্যক্তি বুঝি নিজেকে তদ্রূপ মনে করছে। কিন্তু এ হচ্ছে ‘ইলাহ্’বা ‘খোদা’কথাটির অত্যন্ত হালকা ও অগভীর অর্থ।
অবশ্য এটি অনস্বীকার্য,যুগে যুগে ধ্বংসের নায়ক অজ্ঞ-মূর্খরা নিজেদের তুলনায় অধিকতর অজ্ঞ মানুষের ওপর রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির বদৌলতে তাদের বুঝিয়েছে যে,বিভিন্ন খোদা বা দেব-দেবী হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা একক খোদার আত্মার অংশবিশেষের অধিকারী। কিন্তু কোরআন মাজীদে ‘ইবাদত’,‘রব্যুবিয়্যত’ও ‘উলুহিয়্যাত’যেভাবে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা থেকে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া যায়,‘উলুহিয়্যাত’বা ‘খোদায়ীর দাবীদার’তাৎপর্য অনেক বেশি ব্যাপক।
কোরআন মাজীদে বিভিন্ন প্রসঙ্গে যেভাবে ‘ইবাদত’পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়েছে তা থেকে বোঝা যায়,ইবাদত হচ্ছে মানুষ বা অন্য যে কোন সত্তার নিকট নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য। আমরা যখন নিজেদেরকে কারো নিকট সোর্পদ করি,বিনা শর্তে তার হাতের রশির ফাঁস গলায় পরি,তার ইচ্ছা,পছন্দ ও নির্দেশ অনুযায়ী চলি এবং তার নিকট আত্মসমর্পণ করি তখন কার্যত আমরা তার ইবাদত করি। তেমনি আমাদের ব্যক্তিসত্তার অভ্যন্তরীণ বা বাইরের যে কোন সত্তা বা শক্তি যখন আমাদেরকে এমনভাবে পোষ মানিয়ে নেয় এবং অনুগত করে নেয় যে,আমাদের দেহ-মন এবং প্রাণ তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় এবং আমাদের শক্তি-ক্ষমতাকে যে উদ্দেশে চায় ব্যবহার করে,সে কার্যত আমাদেরকে তার ‘আবদ’বা গোলামে পরিণত করে। নিম্নলিখিত আয়াতসমূহে এর দৃষ্টান্ত রয়েছে :
হযরত মূসা (আ.) তাঁর দাওয়াতের সূচনাতেই ফিরআউনকে সম্বোধন করে তিরস্কারের সাথে এরশাদ করেন :
وذلك نعمة تمنّها عليَّ أن عبّدت بني إسراءيل
“তুমি যে বনি ইসরাইলকে নিজের আবদ-এ (গোলামে) পরিণত করেছ আমার প্রতি কি সেই অনুগ্রহের খোটা দিচ্ছ? (সূরা শুআরা : ২২)
ফিরআউন ও তার সরকারের কর্তাব্যক্তিরা পরস্পরের উদ্দেশে বলে :
أنؤمن لبشرين مثلنا وقومهما لنا عابدون
“আমাদেরই ন্যায় দু’জন মানুষের ওপর কি আমরা ঈমান আনয়ন করব যাদের কওম হচ্ছে আমাদের আবদ (গোলাম)।”(সূরা মুমিনুন : ৪৭)
হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জবানীতে তাঁর পক্ষ থেকে তাঁর পিতার প্রতি সম্বোধনের ভাষায় :
يآ أبت لا تعبد الشّيطان إنّ الشّيطان كان للرّحمان عصيًّا
“হে পিতা! শয়তানকে ইবাদত করো না,নিঃসন্দেহে শয়তান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী।”(সূরা মরিয়ম : ৪৪)
সকল মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার সাধারণ দাওয়াতে এরশাদ হয়েছে :
ألم أعهد إليكم يا بني ءادم أن لا تعبدوا الشّيطان إنّه لكم عدوٌّ مّبين
“হে বনি আদম! আমি কি তোমাদেরকে এ প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ করি নি যে,তোমরা শয়তানের ইবাদত করবে না? নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।”(সূরা ইয়াসিন : ৬০)
চিন্তাশীল লোকদের সান্তনা দিয়ে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন :
والّذين اجتنبوا الطّاغوت أن يعبدوها وأنابوا إلى الله لهم البشرى
“আর যারা তাগুতের (খোদাদ্রোহী ও সীমা লঙ্ঘনকারী শক্তিসমূহের) ইবাদত পরিহার করেছে এবং সমগ্র সত্তা সহকারে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে।”(সূরা যুমার : ১৭)
যারা আল্লাহ্ ও আল্লাহর ওহীর প্রতি ঈমানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাদের জবাব দিতে গিয়ে এরশাদ হয়েছে :
من لعنه الله وغضب عليه وجعل منهم القردة و الخنازير و عبد الطّاغوت، أولآئك شرّ مكانًا و أضلّ عن سوآء السّبيل
“সে ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্ অভিশাপ বর্ষণ করেছেন (স্বীয় সন্নিধ্য থেকে বিতাড়িত করেছেন),তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন,যাদের মধ্যে থেকে কতককে বানর ও শূকর বানিয়েছেন,আর যে তাগূতের (খোদাদ্রোহী বা খোদায়ী মর্যাদার দাবীদারদের) ইবাদত (গোলামী) করেছে তার জন্য রয়েছে জঘন্যতম জায়গা এবং সে অধিকতর পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে।”(মায়েদাহ্ : ৬০)
উল্লিখিত আয়াতসমূহে ফিরআউনের,তার সরকারের কর্তাব্যক্তিদের,তাগূতের ও শয়তানের আদেশ মেনে চলাকে ‘ইবাদত’বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ আয়াতসমূহ ও কোরআন মাজীদের আরো অনেক আয়াত থেকে এটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে,‘ইবাদত’এর কোরআনী তাৎপর্য হচ্ছে,ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়,আগ্রহ বা অনাগ্রহ সহকারে,প্রশংসা ও গুণকীর্তন সহকারে বা তা ছাড়াই কোন প্রকৃত বা কাল্পনিক শক্তির অনুসরণ এবং তার নিকট আত্মসমর্পণ ও তার আনুগত্যকরণ। এর যে কোন অবস্থায়ই ঐ শক্তি হচ্ছে মা’বুদ ও আনুগত্যকারী ব্যক্তি হচ্ছে তার ‘আবদ’(গোলাম) ও আবেদ (ইবাদতকারী) দাসত্বকারী।
এ ব্যাখ্যার আলোকে ‘মা’বুদ হওয়া’ও মা’বুদ এর অন্য কথায়,‘উলুহিয়্যাত’ও ‘আল্লাহ্’পরিভাষার সঠিক ব্যাখ্যা দাঁড়ায় :
একটি ভ্রান্ত জাহেলী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেখানে জনগণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত থাকে-এক শ্রেণী মুস্তাকবির (শক্তিমদমত্ত অভিজাত) ও অপর শ্রেণী মুস্তাদআফ (দুর্বল করে রাখা) অর্থাৎ এক শ্রেণী সকল ক্ষেত্রে ও সকল কাজে কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধিকারী,অতএব,ভাগ্যবান এবং অপর শ্রেণী নীচে পড়ে আছে,কোন কিছুর ওপরেই তার অধিকার নেই,অতএব,বঞ্চিত;সে সমাজের এ দুই শ্রেণীর মধ্যকার অন্যায় ও ভারসাম্যহীন সম্পর্কই হচ্ছে উলুহিয়্যাত (খোদায়ী/প্রভুত্ব) ও উবুদিয়্যত (গোলামী/ইবাদত) এর সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত। অতএব,মানব ইতিহাসে আল্লাহর পরিবর্তে বা তাঁর পাশাপাশি যেসব খোদা বা ইলাহর ইবাদত করা হয়েছে তাদের চেনার জন্য অযথা মানুষ,পশু বা জড় পদার্থের মধ্যে পবিত্র সত্তা আরোপের অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই। কারণ এসব সমাজে মা’বুদ ও ইলাহর জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে সেই লোকেরা যারা মুস্তাকবির শ্রেণীর বলে বলীয়ান হয়ে দুর্বল করে রাখা (মুস্তাদআফ) শ্রেণীর লোকদেরকে স্বীয় ক্রূর থাবার নীচে আত্মসমর্পিত ও পরাভূত করে রেখেছিল এবং যে পথে তাদের লালসা ও বিশ্বাসঘাতকতা চরিতার্থ করা সম্ভব ছিল তাদেরকে সে পথেই নিক্ষিপ্ত ও পরিচালিত করেছিল।
এ ধরনের সমাজে প্রকৃত সমাজধর্ম হচ্ছে শিরক। কারণ যতগুলো মেরু ও শক্তি মানুষের ওপর হুকুম প্রদান করে এবং তাদেরকে হাত-পা-চোখ-কান বাঁধা অবস্থায় যে পথে খুশী পরিচালনা করে,সে সমাজে ততগুলো দেব-দেবী,মা’বুদ বা ইলাহ্ বিরাজমান রয়েছে। শিরক মানে হচ্ছে আল্লাহর পাশাপাশি অন্যকে ইলাহ্ রূপে গ্রহণ এবং তার আনুগত্য ও গোলামীকরণ অর্থাৎ জীবনের কার্যাবলীর নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের হাতে তুলে দেয়া অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া যে কোন মেরু,কেন্দ্র ও শক্তির নিকট আত্মসমর্পণ,তাদের নিকট মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা এবং তাদেরই নির্ধারিত পথে পথ চলা।
আর তাওহীদ হচ্ছে শিরকের পুরোপুরি বিপরীত অর্থাৎ এই প্রভু,মা’বুদ বা ইলাহ্ এবং খোদা ও প্রভুদের সকলকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা,তাদের নিকট আত্মসমর্পণ না করা,তাদের শক্তি ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা,তাদের সাহায্য ও দয়া থেকে আন্তরিক বিমুখতা এবং সবশেষে তাদেরকে অস্বীকার ও উৎখাতের জন্য কোমর বেঁধে লেগে যাওয়া,আর গোটা সত্তা নিয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ। সকল নবী-রাসূলের প্রথম শ্লোগান ছিল এই প্রত্যাখ্যান ও পরিগ্রহণ। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন :
ولقد بعثنا في كلّ أمّة رّسولاً أن اعبدوا الله واجتنبوا الطّاغوت
“আমরা প্রতিটি জাতির মধ্যেই রাসূলের অভ্যুদয় ঘটিয়েছি (এই দাওয়াত সহকারে) যে,তোমরা আল্লাহর গোলামী কর এবং তাগূত (আল্লাহ্ বিরোধী যে কোন শক্তি) থেকে দূরে থাক-তাদেরকে বর্জন কর।”(সূরা নাহল : ৩৬)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেছেন :
وما أرسنا من قبلك من رّسول ألّا نوحي إليه أنّه لا إله إلّا أنا فاعبدون
“আমরা তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল পাঠাই নি যাকে এ মর্মে অহী করি নি যে,(মানুষকে এই বলে দাওয়াত প্রদান করুক যে) আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই,অতএব,তোমরা আমারই দাসত্ব কর।”(সূরা আম্বিয়া : ২৫)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে,নবী-রাসূলগণ এ শ্লোগান সহকারে পচাগলা ও শ্বাসরুদ্ধকর জাহেলী ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করতেন এবং তাগূতদের তথা এই ব্যবস্থার শাসকদের বিরুদ্ধে,আর যারা খাঁটি মানবিক মূল্যবোধসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং স্বীয় জুলুম অবস্থানের হেফাজতের উদ্দেশে মানুষের ওপর অন্তঃসারশূন্য কাল্পনিক মূল্যবোধসমূহ চাপিয়ে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মহাসমরের জন্য জনগণকে আহবান জানাতেন। শিরককে প্রত্যাখ্যান মানে প্রকৃতপক্ষে জাহেলী সমাজ ব্যবস্থা যেসব রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তার সবগুলোকে এবং সমাজের অন্যায় ও ভারসাম্যহীন অবস্থার আবরণ ও ব্যাখ্যা হিসেবে তৈরী শিরকী ধর্মের প্রত্যাখ্যান।
আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সমস্ত ইলাহ্ ও মা’বুদকে প্রত্যাখ্যান মানে যারা মানুষকে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করছে এবং মানুষকে বাধ্য করে বা বোকা বানিয়ে তাদের ঘাড়ে সাওয়ার হয়ে স্বীয় খোদাদ্রোহী ও পাপাচারী আশা-আকাঙ্ক্ষার লালসা চরিতার্থ করছে তাদের প্রত্যাখ্যান।
হযরত মূসা (আ.) এ শ্লোগান সহকারে রাব্বুল আলামীনের বা বিশ্বলোকের প্রভু সম্পর্কে কথা বলে ফিরআউনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। যদিও এতে সন্দেহ নেই,ফিরআউনের পারিষদবর্গ হযরত মূসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ করে তার মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে পূজিত দেবদেবীদের প্রত্যাখ্যানের কথাও উল্লেখ করেছিল এবং তাঁকে দেবদেবী বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছিল,যেমন এরশাদ হচ্ছে :
وقال الملأ من قوم فرعون أتذر موسى وقومه ليفسدوا في الأرض و يذرك وءالهتك
“ফিরআউনী প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা (তাকে) বলল : জমিনের বুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং তোমাকে ও তোমার দেবদেবীদের প্রত্যাখ্যান করার জন্য মূসা ও তার অনুসারীদের তুমি কি স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবে?”(সূরা আ’রাফ : ১২৭)
তথাপি ফিরআউন ও তার দুস্কৃতিকারী সাঙ্গ-পাঙ্গরা ভালভাবেই জানত যে,ঐ দেবদেবীরা অর্থাৎ প্রাণহীন মূর্তিগুলো ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের খোদায়ীর জন্য আবরণ ও ব্যাখ্যাস্বরূপ বৈ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে প্রাণহীন দেবদেবীগুলো ছিল প্রাণশীল দেবদেবীদের (ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের) খোদায়ী বা প্রভুত্বের অবলম্বন মাত্র। এ কারণে হযরত মূসা (আ.) যখন আসমান জমিনের স্রষ্টা,সকলের মালিক ও প্রভু এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের একক ও অদ্বিতীয় খোদার প্রতি দাওয়াত দিলেন,তার জবাবে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই ফিরআউন তাকে কারাগারে নিক্ষেপ ও হত্যা এবং তাঁর সহযোগীদের কঠিনতম নিপীড়নের হুমকি প্রদান করেছিল। এরশাদ হচ্ছে :
قال لئن اتخذْت الها غيرى لأجعلنّك من المسجونين
“(ফিরআউন) বলল,তুমি যদি আমাকে ছাড়া অন্য কোন ইলাহ্ গ্রহণ কর তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে কারাবাসীদের (যারা আমার কারাগারে রয়েছে এবং যাদের অবস্থা তোমার জানা আছে) অন্তভুর্ক্ত করব।”(সূরা শূআরা : ২৯)
আর ফিরআউনের পারিষদবর্গ তাকে হযরত মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর ও নির্মম পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উস্কানি দিলে তার জবাবে ফিরআউন বলল :
سنقتل أبنآءهم ونستحي نسآئهم و إنّا فوقهم قاهرون
“অচিরেই আমরা তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করব এবং তাদের নারীদের জীবিত রাখব,আর আমরা তো তাদের ওপর পুরোপুরি কর্তত্বের অধিকারী।”(সূরা আ’রাফ : ১২৭)
ফিরআউনের ধারণার বিপরীতে যাদুকররা হযরত মূসা (আ.)-এর দলে যোগদান করলে সে তাদেরকে এই বলে হুমকি দেয় :
لأقطِّعنَّ أيديكم وأرجلكم من خلاف ثمّ لأصلِّبَنَّكم أجمعين
“এখনি আমি বিপরীত পাশ থেকে তোমাদের হাত ও পা কেটে ফেলব এবং এরপর তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করব।”(সূরা আরাফ : ১২৪)
আল্লাহর নাম ও তাওহীদের বাণীবাহকের মোকাবিলায় এহেন নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতার একমাত্র কারণ-এ বাণী হচ্ছে সকল বন্ধন ছিন্নকারী অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার প্রভুত্ব বরণ তথা অন্য সকল খোদায়ী দাবীদারকে প্রত্যাখ্যান এবং তাঁর গোলামীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া তথা অন্য সকল বন্ধন ছিন্ন করা। আর এটিই হচ্ছে তাওহীদের মূল চেতনা এবং তার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
(সমাপ্ত)
সূত্র: জ্যোতি ১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা