ইমাম হাসান (আ.)
জন্ম
মহানবী (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র,আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) ও হযরত ফাতেমা (আ.)-এর প্রথম সন্তান তৃতীয় হিজরীর পবিত্র রমজান মাসের পঞ্চদশ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।১
নবী করীম (সা.) অভিনন্দন জ্ঞাপনের অভিপ্রায়ে হযরত আলীর গৃহে গমন করেন। তিনি এ নবজাত শিশুর নাম আল্লাহর পক্ষ থেকে রাখেন হাসান।২
নবীর সাথে ইমাম হাসান
প্রায় সাত বৎসর মহানবী (সা.)-এর সাথে তাঁর নাতীর জীবনকাল অতিবাহিত হয়।৩
দয়াল নানা তাঁকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। কত বার তিনি নাতিকে কাঁধে নিয়ে বলতেন : “হে প্রভু,আমি তাকে ভালবাসি। তুমিও তাকে ভালবাস।”৪
তিনি আরো বলতেন : “যারা হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসবে তারা আমাকেই ভালবাসলো। আর যারা এ দুজনের সাথে শত্রুতা করবে তারা আমাকেই তাদের শত্রু হিসাবে গণ্য করলো।”৫
“হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা।”৬
তিনি আরো বলেছেন,“আমার এই দু’নাতি উভয়ই মুসলমানদের ইমাম বা নেতা (তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়াক বা না দাঁড়াক।”৭
তিনি এতটা মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর রুহ এতটা নিষ্কলুস ছিল যে রাসূল (সা.) তাঁকে শৈশবেই অনেক চুক্তি পত্রের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে মনোনীত করতেন। ঐতিহাসিক ওয়াকেদী তার কিতাবে লিখেছেন :
(( أَبْنَاىَ,هَذَانِ إِمَامَانِ,قَامَا أَوْ قَعَدَا.))
“রাসূল (সা.) ছাকিফ গোত্রের সাথে ‘জিম্মি চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিপত্র খালিদ বিন সাঈদ লিখেন আর ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.) সে পত্রে স্বাক্ষর করেন।”৮
যখন আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) নাজরানের খৃস্টানদের সাথে মুবাহিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখনও তিনি ইমাম হাসান,ইমাম হুসাইন,হযরত আলী ও হযরত ফাতেমাকে আল্লাহর নির্দেশক্রমে সঙ্গে নেন এবং তাতহীরের আয়াত তাদের পবিত্রতা ও নিষ্পাপতার ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়। ৯
পিতার সঙ্গে ইমাম
ইমাম হাসান (আ.) তাঁর পিতার পথে চলতেন এবং তাঁর সাথে ঐক্যমত পোষণ করতেন। পিতার সাথে তিনিও অত্যাচারীদের সমালোচনা এবং মজলুমদের সমর্থন করতেন।
যখন হযরত আবু যার গিফারী (রা.) রাবাযাতে নির্বাসনের নির্দেশপ্রাপ্ত হন তখন হযরত ওসমান আদেশ জারী করেন,কেউ যেন তাকে বিদায় সম্ভাষণ না জানায়। কিন্তু ইমাম হাসান ও তাঁর ভ্রাতা তাদের মহান পিতার সাথে সে মুক্তিকামী নির্বাসিত সাহাবীকে বিদায় সম্ভাষণ জানান। আর বিদায় জানানোর মুহূর্তে হযরত ওসমানের শাসনের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং হযরত আবু যারকে ধৈর্য ধারণ ও দৃঢ়তার পরামর্শ দেন।১০
হিজরী ছত্রিশ সনে পিতার সাথে মদীনা হতে বসরায় হযরত আয়েশা ও তালহা-যুবাইর কর্তৃক প্রজ্বলিত উষ্ট্রের যুদ্ধের অগ্নি নির্বাপনের জন্যে আগমন করেন। বসরাতে প্রবেশের পূর্বে তিনি হযরত আলীর নির্দেশে সম্মানিত সাহাবী হযরত আম্মার বিন ইয়াসিরকে সাথে নিয়ে জনগণকে সংঘবদ্ধ করার নিমিত্তে কুফায় যান। অতঃপর জনগণকে সাথে নিয়ে ইমাম আলীকে সাহায্যের জন্যে বসরায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১১
তিনি তাঁর সুদৃঢ় ও প্রাঞ্জল বক্তৃতা দ্বারা আবদুল্লাহ বিন যুবাইরের মিথ্যাবুলির দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেন। কেননা সে ওসমান হত্যার সাথে হযরত আলী জড়িত বলে প্রচার করতো। তিনি যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর সহযোগিতা করেন। পরিশেষে বিজয়ী বেশে কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন।১২
সিফফিনের যুদ্ধেও তিনি তাঁর পিতার সাথে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ যুদ্ধে মুয়াবিয়া তাঁর নিকট আবদুল্লাহ বিন ওমরকে এ কথা বলে পাঠায় যে,“যদি আপনার পিতার অনুসরণ থেকে বিরত থাকেন তাহলে আমরা আপনার পক্ষে খেলাফত ছেড়ে দেবো। কেননা,কোরাইশ গোত্রের লোকজন আপনার পিতার প্রতি তাদের পিতৃপুরুষদের হত্যার কারণে অসন্তষ্ট। তবে তারা আপনাকে গ্রহণ করতে কোন আপত্তি করবেন না...।”
ইমাম হাসান (আ.) উত্তরে বলেন :
“কোরাইশরা ইসলামের পতাকা ভূলুন্ঠিত করতে দৃঢ়চিত্ত ছিল। তবে আমার বাবা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইসলামের জন্যে তাদের মধ্যেকার অবাধ্য ও বিদ্রোহী ব্যক্তিদের হত্যা করে তাদের চক্রান্তকে নস্যাত করে দিয়েছিল। তাই তারা আমার পিতার বিরুদ্ধে শত্রুতার ঝাণ্ডা উত্তোলন করেছে।”১৩
তিনি এ যুদ্ধে এক মুহূর্তের জন্যে পিতার সহযোগিতা হতে হাত গুটিয়ে নেননি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিলেন ও সমচিত্তের পরিচয় দিয়েছেন। আর যখন দুই বাহিনীর (হযরত আলী (আ.) ও মুয়াবিয়ার বাহিনী) পক্ষ থেকে দু’জন মধ্যস্থতার জন্যে মনোনীত হলো এবং পরিশেষে অন্যায়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো,তখন ইমাম হাসান (আ.) তাঁর পিতার নির্দেশে এক অত্যন্ত আবেগময়ী ভাষণে বলেন : “তারা নির্বাচিত হয়েছিলো আল্লাহর কিতাবকে তাদের নফসের কু-প্ররোচনার উপর প্রাধান্য দেয়ার জন্যে,কিন্ত তারা এর বিপরীত আমল করেছে। আর এরকম ব্যক্তি কখনো মধ্যস্থতাকারী হতে পারে না বরং তারা সকলের নিন্দিত।”১৪
হয়রত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) ইন্তেকালের সময় পূর্ব থেকে নির্ধারিত নবী করীম (সা.)-এর নির্দেশ মোতাবেক ইমাম হাসানকে তাঁর খেলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। তিনি ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর অন্যান্য সন্তানদের এবং তাঁর উচ্চপদস্থ অনুসারীদের এ বিষয়ে সাক্ষী রাখেন।১৫
চরিত্র
পরহেযগারী
আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিনের প্রতি তাঁর এক বিশেষ অনুরাগ ছিল। এই আসক্তির বহিঃপ্রকাশ ওযুর সময় অনেকে তাঁর চেহারায় অবলোকন করেছেন। যখন তিনি ওযুতে মগ্ন হতেন তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো,তিনি কম্পিত হতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো : “আপনি এরকম হন কেন?” উত্তরে তিনি বলেন : “যে ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয় তাঁর এরকম অবস্থাই যথোপযুক্ত।”
ষষ্ঠ ইমাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,ইমাম হাসান (আ.) তাঁর সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আবেদ বা ইবাদতকারী ও মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। আর যখনি তিনি মৃত্যূ ও কিয়ামতের কথা স্মরণ করতেন,তখনি ক্রন্দন করতেন এবং বেহুশ হয়ে পড়তেন।১৬
তিনি পদব্রজে আবার কখনো নগ্নপদে পঁচিশ বার আল্লাহর ঘর যিয়ারত (হজ) করেন।১৭
মহানুভবতা
একবার তিনি হজে যান। হঠাৎ শুনতে পান যে একজন লোক আল্লাহকে বলছে,“হে খোদা,তুমি আমাকে দশ হাজার দেরহাম দান কর...।” ইমাম তৎক্ষণাৎ বাড়ীতে ফিরে আসেন এবং ঐ ব্যক্তির জন্যে ঐ পরিমান অর্থ প্রেরণ করেন।
একদিন ইমামের এক দাসী তাকে এক গুচ্ছ ফুল উপহার দেয়। ইমাম প্রতিদানে সেই দাসীকে মুক্ত করে দিলেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো : “আপনার এমনটি করার কারণ কি?” তখন তিনি উত্তরে বলেন : “আল্লাহ্ আমাদেরকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন।” তিনি পরক্ষণেই নিম্নের আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।
وَ إذَا حُيِّيْتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوْاْ بِأَحْسَنٍ مِنْهَا
অর্থাৎ “যখন তোমাদেরকে কোন কিছু দান করা হয় তখন তোমরা তার থেকে উত্তম কিছু দান কর।”১৮
তিনি জীবনে তিনবার তাঁর যা কিছু ছিল,এমন কি জুতো পর্যন্ত দু’অংশে ভাগ করে আল্লাহর পথে দান করেন।১৯
ধৈর্য ও সহনশীলতা
এক দিন সিরিয়াবাসী একজন লোক মুয়াবিয়ার উষ্কানিতে ইমামকে যা-তা বলে গালিগালাজ করে। প্রতুত্তোরে ইমাম কিছুই বললেন না। শেষ পর্যন্ত ঐ ব্যক্তিটি চুপ হয়ে গেল। অবশেষে ইমাম মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকে সালাম করলেন আর বললেন : “ওহে বৃদ্ধ,মনে হচ্ছে তুমি এখানে আগুন্তুক। আমার ধারণা তুমি ভুলের মধ্যে আছো। যদি তুমি আমাদের সন্তুষ্টি চাও তাহলে তা করবো। আর যদি তুমি অন্য কিছু কামনা কর,যদি কোন দিক নির্দেশনার প্রয়োজন মনে কর তোমাকে দিক নির্দেশনা দান করবো। যদি তোমার স্কন্ধে কোন বোঝা থাকে তাহলে তা তুলে নিবো। যদি তুমি ক্ষুধার্ত হও তাহলে তোমাকে পেট ভরে খেতে দিবো। যদি তুমি কোন কিছুর প্রয়োজন অনুভব কর,তোমার প্রয়োজন মিটাবো। তোমার যে কোন কাজের জন্যে আমি প্রস্তুত আছি। আর যদি তুমি আমাদের মেহমান হও তাহলে আরামে থাকতে পারবে,কেননা তোমাদের আপ্যায়নের জন্যে সকল উপকরণের ব্যবস্থা আছে।”
লোকটি লজ্জিত হয়ে ক্রন্দন শুরু করে দেয়,আর বলে : “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি জমিনের বুকে আল্লাহর খলীফা। আল্লাহ্ ভাল করেই জনেন যে তাঁর রেসালাত কোথায় নির্ধারণ করতে হয়।২০ আপনি ও আপনার পিতা এখন পর্যন্ত আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃন্য ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু এখন আপনারা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয়।
বৃদ্ধ লোকটি সেদিন ইমামের মেহমান হয়েছিল। ইমামের কাছ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সে ইমামের প্রেমিক হয়ে ফিরে গেলো।২১
মারওয়ান বিন হাকাম,যে ব্যক্তি ইমামকে বিরক্ত ও কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে কোন কিছুই বাকী রাখেনি ইমাম হাসান (আ.)-এর ইন্তেকালের সময় তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করে। হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন : আমার ভাইয়ের জীবদ্দশায় তাঁর সাথে আপনি যা মন চেয়েছে তাই করেছেন আর এখন তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেছেন এবং কাঁদছেন?
মারওয়ান উত্তর দেয় : “যা কিছু করেছি তা এমন এক মহান ব্যক্তির সঙ্গে করেছি যার সহনশীলতা এই পাহাড়ের (মদীনার পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত) চেয়েও অনেক বেশি ছিল।”২২
খেলাফত
হিজরী চল্লিশ সনের পবিত্র রমজান মাসের একুশের শেষ রাতে হযরত আলী (আ.) শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করেন। সেদিন প্রভাতে শহরের জামে মসজিদে জনগণ সমবেত হয়েছিল।
তখন হযরত ইমাম হাসান (আ.) মিম্বারে আরোহণ করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন :
“গতরাত্রে এক ও অনন্য ব্যক্তি ধরাপৃষ্ঠ থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। যিনি তাঁর পূর্বপুরুষগণ এবং ভবিষ্যত বংশধরদের মধ্যে জ্ঞান ও আচরণের ক্ষেত্রে এক ও অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি রাসূল (সা.)-এর সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন এবং ইসলামের প্রতিরক্ষা ও মহানবীর (সা.) জীবন রক্ষার্থে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করে গেছেন। নবী করীম (সা.) বিভিন্ন যুদ্ধে তাঁকে সেনাপতি হিসেবে প্রেরণ করতেন আর তিনি সর্বদা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসতেন... তিনি দুনিয়ার ধন-সম্পদের মধ্যে সাতশত দেরহামের বেশী রেখে যাননি এবং তা দিয়ে তাঁর পরিবারের জন্যে একটি গৃহভৃত্যের যোগাড় করতে চেয়েছিলেন।”
এই পর্যায়ে ইমাম হাসান ভীষণ কাঁদলেন সাথে সাথে জনগণও কাঁদলো। তখন ইমামত যেন তার সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত না হয় সেজন্য নিজের সম্পর্কে কয়েকটি কথা বললেন : “আমি সেই নবীর সন্তান যিনি ছিলেন সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী,তিনি আল্লাহর দিকে জনগণকে আহবান জানাতেন। আমি সেই রেসালাতের প্রজ্জ্বল প্রদীপের শিখা এবং সেই আহলে বাইতের সদস্য যাদের আল্লাহ্তায়ালা সকল ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা ও দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত রেখেছেন। তাছাড়া আমি তাদের-ই অর্ন্তভূক্ত,কোরআনের আয়াত অনুযায়ী যাদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করা ফরজ বলে গণ্য করা হয়েছে :
قُلْ لاَ أَسْألُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلاَّ اْلْمَوَدَّةَ فِى اْلْقُرْبَى
অর্থাৎ “তোমার উম্মতকে বলে দাও (হে রাসূল),আমি তোমাদের কাছ থেকে আমার রেসালতের পারিশ্রমিক বাবদ কিছু চাইনা। শুধু এতটুকুই কামনা করি যে,তোমরা আমার নিকটতম আÍীয়দের (আহলে বাইত) ভালবাসবে।”২৩
অতঃপর ইমাম হাসান বসে গেলেন আর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বলেন :
“হে লোকসকল! তিনি (ইমাম হাসানের প্রতি ইঙ্গিত) তোমাদের রাসূলের সন্তান এবং আলীর উত্তরাধীকারী আর তোমাদের ইমাম। তোমরা তার হাতে বাইয়াত কর।”
তখন জনগণ দলে দলে সামনে এগিয়ে আসে এবং তাঁর হাতে বাইয়াত করে।২৪
যখনি মুয়াবিয়া উপরোক্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত হলো তখনি সে কুফা ও বসরা হতে সংবাদ সংগ্রহ এবং ইমামের প্রশাসনের মধ্য থেকে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে কতিপয় গোয়েন্দা প্রেরণ করে। ইমামের নির্দেশে ঐ গোয়েন্দাদের গ্রেফতার করে ইসলামী আইনে তাদের বিচার করা হয়। তিনি মুয়াবিয়াকে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন,“গোয়েন্দা ও গুপ্তচর পাঠাও? দৃশ্যতঃ মনে হচ্ছে যে তুমি যুদ্ধকেই বেশী পছন্দ কর। হ্যাঁ! যুদ্ধ অতি নিকটে,অপেক্ষা কর! ইনশাআল্লাহ্।”২৫
ইমাম যে সব পত্র মুয়াবিয়াকে লেখেন এবং ইবনে আবিল হাদীদ তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন তন্মধ্যে একটি হচ্ছে এ রকম : “... অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর কোরাইশরা তাঁর উত্তরাধিকারীর পদ নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল এবং তারা নবী করীম (সা.)-এর গোত্রের লোক বিধায় নিজেদেরকে অন্যান্য আরবদের উপর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন মনে করতো। আর আরবরাও তাই মাথা পেতে নিল। অথচ আমরাও কোরাইশ এবং সবদিক থেকে তাদের উপর আমাদের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব থাকা সত্বেও তারা আমাদের নেতৃত্বের পতাকাতলে সমবেত হতে অস্বীকার করে। তদুপরি আমরা সকলের চেয়ে রাসূলের নিকটতম এবং আমাদের অধিকারই আমরা তাদের নিকট চেয়ে ছিলাম। কিন্তু আমাদেরকে তারা দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিয়ে আমাদের উপর জুলুম করল। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের পথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে চলেছি যেন শত্রু ও মুখোশধারীরা ইসলামের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে।
আজকে (হে মুয়াবিয়া) তোমার ব্যাপারে আমি আশ্চর্যান্বিত যে তুমি এমন এক বিষয়ের দাবীদার কোনভাবেই তুমি যার উপযুক্ত নও। তুমি না দীনের ক্ষেত্রে কোন উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী,না ভাল কোন অবদান রাখতে পেরেছ। তুমি সেই দলের সন্তান যারা রাসূল (সা.)-এর সাথে যুদ্ধ করেছে। আর তুমি তো কোরাইশদের মধ্যে নবী (সা.)-এর সাথে সর্বাপেক্ষা অধিক শক্রতা পোষণকারীর সন্তান। হ্যাঁ,তুমি জেনে রাখ তোমার কর্মের ফলাফল আল্লাহর কাছ থেকে পাবে। সেখানে তুমি দেখতে পাবে যে অবশেষে সফলকাম ও বিজয়ী কে হয়েছে। আল্লাহর কসম,বেশী দিন যাবেনা,দেখতে না দেখতে তোমার আয়ু ফুরিয়ে আসবে এবং আল্লাহর সম্মুখীন হবে। তখন তিনি তোমাকে তোমার পূর্বের পাঠানো কর্মের ফলাফল ও শাস্তি প্রদান করবেন। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের উপর কোন জুলুম করেন না। আলী আমাদের মাঝে নেই। তাই জনগণ আমার হাতে বাইয়াত করেছে। আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাকে এমন কিছু না দেন যার অভাব আমি পরকালে অনুভব করবো।
যে কারণে আমি তোমার কাছে এ পত্র লিখতে বাধ্য হয়েছি তা হচ্ছে,আমি যেন আল্লাহর কাছে কৈফিয়ত পেশ করতে পারি। যদি তুমিও অন্যান্য মুসলমানদের ন্যায় এ বিষয়টাকে গ্রহণ করে নাও তাহলে ইসলামেরই কল্যাণ সাধিত হবে। আর এতে তুমি নিজে অন্যদের চেয়ে বেশী উপকৃত হবে। বাতিলের পথে চলো না। তুমিও অপরাপর লোকদের ন্যায় আমার হাতে বাইয়াত গ্রহণ কর! তুমি ভাল করেই জান যে,আমি তোমার চেয়ে অধিক যোগ্যতার অধিকারী। আল্লাহকে ভয় কর এবং অত্যাচারী জালেমের মধ্যে গণ্য হয়ো না। মুসলমানদের রক্তকে সম্মানজনক বিবেচনা কর। আর তুমি যদি আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকার কর তাহলে আমি মুসলমানদের সাথে নিয়ে তোমার দিকে ধাবিত হবো এবং তোমাকে বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করাবো যেন আমাদের মধ্যে আল্লাহর বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় কেননা তিনি সবচেয়ে উত্তম বিচারক...।”
মুয়াবিয়া ইমামের পত্রের উত্তর লিখে :
“... এ মুহূর্তে আমার এবং তোমার অবস্থা,তোমার বংশের পূর্বপরুষের সাথে আবুবকরের অবস্থার তুলনা করা যায়। অর্থাৎ যেভাবে আবুবকর অধিক অভিজ্ঞতার অজুহাত তুলে খেলাফতের আসন আলীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়,সেভাবে আমিও নিজেকে তোমার চেয়ে বেশী যোগ্যতর মনে করি। যদি আমি জানতাম যে তুমি আমার থেকে উৎকৃষ্টতর পন্থায় জনগণের স্বার্থে নিবেদিত থাকবে এবং শত্রুর মুখোমুখী হবে তাহলে তোমার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতাম। তবে তুমি জান যে আমি তোমার চেয়ে বেশী অভিজ্ঞ। সুতরাং তোমার জন্য আমার আনুগত্য করাই অধিক উত্তম। আর আমিও তোমাকে কথা দিচ্ছি মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব আমার পরে তোমার উপরেই বর্তাবে এবং ইরাকের কোষাগারের সমস্ত সম্পদ ও মালামাল তোমারই থাকবে আর তুমি ইরাকের যে জেলারই রাজস্ব ও ভূমিকর হতে অংশ চাও আমি তোমার হাতে সোপর্দ করবো... ওয়াসসালাম।”২৬
কোরাইশগণ যে অজুহাতে আলীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেই একই অজুহাতে মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের নিকট আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকার করলো। মুয়াবিয়া অন্তর দিয়ে অবগত ছিল যে ইমাম তার চেয়ে বেশী উপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্বলিপ্সা তাকে সত্যের আনুগত্য থেকে বিরত রাখে। কেননা সে ভাল করেই জানতো বয়সের স্বল্পতা হযরত ঈসা ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.)-এর জন্য ঐশী রেসালাতের পথে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। ইমাম যিনি রাসূলের উত্তরাধিকারী,তাঁর বেলায়ও একই ব্যাপার প্রযোজ্য।
মুয়াবিয়া যে ইমামের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেনি শুধু তাই নয় বরং ইমামকে উৎখাতের জন্যে সে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সে কিছু লোককে গোপনে নিয়োগ করেছিল ইমামকে হত্যা করার জন্যে। আর এ কারণেই ইমাম জামার নিচে বর্ম পরিধান করতেন এবং বর্ম ব্যতীত নামাজে অংশ গ্রহণ করতেন না। আর এই উদ্দেশ্যে একদিন মুয়াবিয়ার এক গুপ্তচর ইমামের দিকে তীর নিক্ষেপ করলে তা লক্ষভ্রষ্ট হয়।২৭ যে মুয়াবিয়া ইমামের বয়সের স্বল্পতার অজুহাত তুলে তাঁর হাতে আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিল সেই আবার ইয়াযিদের খেলাফতের বেলায় এই অজুহাত অনায়াসে ভুলে যায়। সে নিজের তরুন সন্তানকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে এবং তার পক্ষে জনগণের আনুগত্য গ্রহণ করে। মুয়াবিয়া ইসলামী সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা এড়ানোর মিথ্যা অজুহাত তুলে তার গভর্ণরদেরকে নির্দেশ দেয় : “তোমরা তোমাদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দাও।” আর তারা তাই তার নির্দেশমত করেছিল। সে তাদেরকে জড়ো করে ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে ইরাকে প্রেরণ করে।
ইমামও হাজর বিন আদি কানদীকে নির্দেশ দিলেন যেন কমান্ডারদের ও জনগণকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করা হয়।
তৎকালীন রেওয়াজ অনুযায়ী সরকারী ঘোষণাকারী কুফা নগরীর অলি গলিতে আস্ সালাহ (নামাজ) বলে উচ্চৈঃস্বরে জনগণকে আহবান করতে থাকে ফলে জনসাধারণ কুফার জামে মসজিদে সমবেত হতে শুরু করে।
অবশেষে ইমাম মিম্বারে উপবিষ্ট হয়ে বলেন : “মুয়াবিয়া তোমাদের নিকট এসেছে যুদ্ধের জন্যে আর তোমরাও নুখাইলা যুদ্ধ শিবিরে গিয়ে সমবেত হও...।”
সকলে নিশ্চুপ। বিখ্যাত হাতেম তাঈ-এর পুত্র উদাই উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বলেন :
“আমি হাতেম তাঈ-এর ছেলে। সুবহানাল্লাহ! এই মরণাত্মক নীরবতার কারণ কি- যা তোমাদের অন্তঃকরণসমূহকে ঘিরে রেখেছে? কেন ইমাম ও তোমাদের রাসূলের সন্তানের আহবানে কোন সাড়া দিচ্ছো না? আল্লাহর ক্রোধকে ভয় কর! তোমরা কি লাঞ্ছনাকে ভয় করো না...?”
অতঃপর তিনি ইমামের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন : “আপনার বক্তব্য শুনেছি। আমি জান-প্রাণ দিয়ে আপনার নির্দেশের অনুগত।” তারপর তিনি বলেন : “আমি এক্ষণি যুদ্ধ শিবিরের দিকে রওয়ানা হচ্ছি। যাদের ইচ্ছে হয় আমার সাথে যেন যোগ দেয়।”
কাইস বিন সা’দ বিন উবাদাহ,মা’কাল বিন কাইস রিয়াহি এবং যিয়াদাহ বিন সাসায়াহ্ তাইমিও তাদের আবেগময় ভাষণের মাধ্যমে যুদ্ধের প্রতি জনগণের আগ্রহ সৃষ্টি করেন এবং তারা সমর সজ্জায় আত্মনিয়োগ করেন। পরিশেষে তারা সকলে এভাবে যুদ্ধ শিবিরে পৌঁছান। ২৮
এই শিবিরে সমবেত বিপুল সংখ্যক সৈন্যের মধ্যে ইমামের অনুসারী ছাড়াও নিম্নের কয়েকটি দলের লোকেরাও একত্রিত হয়েছিল :
১.খারেজী দল : যারা শুধুমাত্র মুয়াবিয়ার সাথে যুদ্ধ করার জন্যে এসেছিলো,ইমামের পক্ষাবলম্বনের জন্যে আসেনি।
২.লোভীর দল : যারা যুদ্ধের গনিমতের মাল সংগ্রহের জন্যে এসেছিল।
৩.যারা তাদের গোত্রপতিদের অনুসরণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং তাদের কোন দীনি উদ্দেশ্য ছিলো না।
ইমাম তাঁর বাহিনীর একাংশকে হাকামের সেনাপতিত্বে আনবার শহরে প্রেরণ করেন। কিন্তু হাকাম মুয়াবিয়ার সাথে আঁতাত করে বসে। তদ্রূপ তাঁর পরবর্তী সেনাপতিদের অবস্থাও এরকম হয়েছিল।
ইমাম স্বয়ং মাদায়েনের সাবাত এলাকায় গমন করেন। সেখান থেকে তিনি বার হাজার সৈন্যকে ওবায়দুল্লাহ বিন আব্বাসের সেনাপতিত্বে মুয়াবিয়ার সাথে লড়াইয়ের জন্যে প্রেরণ করেন। আর কাইস বিন সা’দ বিন উবাদাহকে উপসেনাপতি করেন যেন ওবায়দুল্লাহর অনুপস্থিতিতে তিনি সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
মুয়াবিয়া কাইসকে ধোকা দেয়ার ফন্দি করে। সে তার সাথে সহযোগিতা অথবা অন্ততঃ ইমামের পক্ষ ত্যাগ করার লক্ষ্যে কাইসের নিকট এক মিলিয়ন দেরহাম পাঠায়। কাইস উত্তর দেয় : “প্রতারণার মাধ্যমে তুমি আমার দীনকে কেড়ে নিতে পারবেনা। যাও এই ফাঁদ অন্য এমন কোন পাখির জন্যে পাত যার মুখ বড়।২৯
ইমাম হাসানের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি অর্থাৎ ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস,মুয়াবিয়ার প্রেরিত সেই অর্থেই প্রতারিত হয় এবং রাত্রের অন্ধকারে তার একদল একনিষ্ঠ লোকদের সাথে নিয়ে মুয়াবিয়ার শিবিরে পলায়ন করে। সেদিন সকালে সেনাবাহিনী নেতৃত্ব শূন্য পড়ে থাকে। অবশেষে কাইস জনগণের সাথে নামাজ আদায় করেন এবং তিনি সেনাপতির দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন। তিনি সমস্ত ঘটনার তথ্য বিবরণী ইমামের কাছে পেশ করেন।৩০
কাইস বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন। মুয়াবিয়া যখন তাকে ধোঁকা দেয়ার সকল পথ অবরুদ্ধ দেখতে পায় তখন ইমামের সেনাবাহিনীতে গুপ্তচর প্রেরণ করে আর তারা মুয়াবিয়ার সাথে কাইসের সন্ধি স্থাপনের মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদের অপপ্রচার চালায়। এদিকে অন্য আরেক দল গোয়েন্দাকে কাইসের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ভিতর অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়। তারা বলতে থাকে “ইমাম হাসান মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেছেন।”৩১
এভাবে খারেজী ও সন্ধি বিরোধী গোষ্ঠী এই ধোঁকায় প্রতারিত হলো এবং তারা অকস্মাৎ সাথে ইমামের তাঁবুতে হামলা করে লুটতরাজ চালায় এমনকি তারা ইমামের পদতলের বিছানা পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যায়। তারা এমন জোড়ে ইমামের উরুতে তলোয়ারের আঘাত হানে যে ইমাম প্রচন্ড রক্তপাতের ফলে শোচনীয় অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন...।৩২
ইমামের সাথীরা তাকে মাদায়েন শহরের গর্ভণর সা’দ বিন মাসউদ সাকাকী- যিনি ইমাম আলীর পক্ষ থেকে এ পদে নিযুক্ত ছিলেন,তার গৃহে নিয়ে যান। ইমাম কিছুদিন তার গৃহে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময়ে ইমামকে বলা হলো,অনেক গোত্রপতি যাদের কোন দীনি উদ্দেশ্য ও উৎসাহ ছিল না অথবা যারা ইমামের সাথে গোপনে শত্রুভাবাপন্ন ছিল,তারা মুয়াবিযার কাছে গোপনে লিখে পাঠায় যে,“যদি তুমি ইরাকে আগমন করো তাহলে আমরা তোমার সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধা যে ইমামকে তোমার হাতে তুলে দিবো।”
মুয়াবিয়া হুবহু তাদের পত্রাবলী ইমামের নিকট প্রেরণ করে সন্ধি করার জন্যে অনুরোধ পেশ করে। সে আরো বলে যে এ সন্ধি পত্রে ইমাম যে শর্ত-ই দেন না কেন,তাই মেনে নেয়া হবে।৩৩
ইমাম খুবই অসুস্থ ছিলেন এবং তাঁর অনুসারীরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। সেনাবাহিনীর সদস্য এবং যোদ্ধারা আকিদা ও লক্ষ্যের ব্যাপারে ঐকমত্যে ছিলো না। তারা প্রত্যেকে পৃথক পৃথক ধ্বনি তোলে। তাদের পথ ও মতের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। কোন দিক দিয়েই যুদ্ধ অব্যাহত রাখা ইমামের অনুসারীদের জন্য এমনকি ইসলামের স্বার্থের অনুকূলে ছিল না। কেননা,মুয়াবিয়া যদি যুদ্ধের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী হয় তাহলে ইসলামের মূলোৎপাটন করে ছাড়তো এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে ইসলামের অনুসারী তথা সত্যিকার মুসলমানদের উৎখাত করে ছাড়তো।
সুতরাং অগত্যা ইমাম কতগুলো কঠিন শর্ত সাপেক্ষে সন্ধি চুক্তিতে সম্মত হলেন।৩৪ এ সমস্ত শর্তগুলোর কয়েকটি ধারা নিম্নে উল্লেখ করা
হলো :
১. আহলে বাইতের অনুসারীদের রক্ত সম্মানিত ও হেফাজত থাকবে এবং তাদের অধিকার পদদলিত করা যাবে না।
২. ইমাম আলীকে গালি-গালাজ করা যাবেনা।৩৫
৩. মুয়াবিয়া রাষ্ট্রের আয় থেকে এক মিলিয়ন দেরহাম সিফফিন ও জামালের যুদ্ধের ইয়াতিমদের মধ্যে বন্টন করবে।
৪. ইমাম হাসান মুয়াবিয়াকে আমিরুল মুমিনীন বলে সম্বোধন করবে না।
৫. মুয়াবিয়াকে অবশ্যই আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত মোতাবেক আমল করতে হবে।
৬. মুয়াবিয়া,তার মৃত্যুর পরে খেলাফতের ভার অন্য কারো উপর সোপর্দ করে যাবে না।৩৬
মুয়াবিয়া উপরোক্ত শর্তগুলো এবং অন্যান্য আরো সব শর্তাবলী মেনে নিয়েছিল যার সবটাই ইসলাম ও বিশেষ করে আহলে বাইতের অনুসারীদের হেফাজতের জন্যে প্রয়োজন ছিল । ফলে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
আপোষকামিতা ও শিথিলতা ছিল না
অনেক প্রাচ্যবিদ তাদের গবেষণায় বিষয়বস্তুর উপর গভীরভাবে চিন্তা করেন না এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবদিকও বিবেচনা করে দেখেন না। তারা তাদের দুর্বল ও প্রাথমিক ধারণাসমূহের উপর ভিত্তি করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছান তাই তাদের দৃষ্টিতে সুদৃঢ় মত বলে গণ্য হয় ও উল্লাসিত হন।
এ ধরনের লোকদের একাংশ তাদের এই ভাসাভাসা অধ্যয়নের মাধ্যমে এবং সঠিক তথ্য সম্পর্কে বেখবর থাকার কারণে তারা মনে করেছেন যে ইমাম হাসান (আল্লাহর দরুদ ও সালাম তাঁর উপর বর্ষিত হোক) মুয়াবিয়ার সাথে যুদ্ধে অবহেলা করেছেন,তা না হলে তিনি অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালালে নিশ্চয়ই বিজয়ী হতেন!
তারা যদি গভীরভাবে তৎকালীন সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাস গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করতেন এবং সর্বদিক বিবেচনা করতেন তাহলে কখনো এ ধরনের আজগুবি সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন না। কেননা ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ইমাম তাঁর জীবনের গঠনমূলক দিনগুলো মর্যাদার সাথে পিতার সাথে উষ্ট্র ও সিফফিনের যুদ্ধে এবং আরো অন্যান্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি সর্বদা দুর্দম সাহসিকতার সাথে শক্রর তীরের আওতায় তলোয়ার চালিয়েছেন এবং সামনে এগিয়ে গিয়েছেন আর এভাবে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেছেন।
তাই ইমাম হাসান (আ.) যুদ্ধকে ভয় পেতেন না। তিনি স্বয়ং মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্যে জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তবে সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁর সন্ধির পদক্ষেপ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি,আহলে বাইতের অনুসারীদের প্রাণ রক্ষা এবং মুসলিম উম্মাহর অভ্যন্তরীণ স্বার্থ ও কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিলো। তাছাড়াও ইসলামী পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিতেও এটি ছিল একটি দূরদর্শী ও বিস্ময়কর পদক্ষেপ। কেননা তৎকালীন সময়ে পূর্ব রোম সাম্রাজ্য-যারা ইসলামের কাছ থেকে এর পূর্বে কয়েকবার শক্ত আঘাত খেয়েছে- প্রতিশোধ নেয়ার নিমিত্তে ওঁৎ পেতে ছিল। তারা শুধু সময়ের সুযোগ খুঁজছিল যেন সুযোগ মত প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারে।
যখন ইমাম হাসান ও মুয়াবিয়া যুদ্ধের জন্যে পরস্পরের মুখোমুখী অবস্থান নিয়েছিলেন তখন তারা আকস্মিক আক্রমণের সকল প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছিল। আর যদি ইমাম যুদ্ধ অব্যাহত রাখতেন তাহলে ইসলামের উপর প্রচন্ড আঘাত আসার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ইমাম যেহেতু সন্ধি চুক্তিতে সম্মত হলেন তাই তারা তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়িত করতে পারেনি।৩৭
পশ্চাদপসরণ ছিল না
উপরোল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের চিন্তা ধারণার চেয়েও আরো বেশী বিস্ময়কর হচ্ছে আরেকদল লোকের অনর্থক ও ভিত্তিহীন ধারণা। তারা বলেন : “ ইমাম হাসান কার্যতঃ মুয়াবিয়াকে নিজের চেয়েও বেশী উপযুক্ত দেখতে পান। তাই তিনি মুয়াবিয়ার অনুকূলে পদত্যাগ করেন এবং ইসলামী খেলাফত তার হাতে সোপর্দ করে তার সাথে বাইয়াত করেন।”
কিন্তু আমরা জানি যে ইমাম সন্ধির পূর্বের ও পরের সব পত্রেই সরাসরি তিনি নিজেকে খেলাফতের যোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
যখন মুয়াবিয়া কুফা শহরে প্রবেশ করে বক্তৃতায় বলে : “হাসান আমাকে যোগ্য মনে করেছে,নিজেকে নয়। এ জন্যে সে খেলাফত আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে।” ইমাম হাসান (আ.) সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন : “মুয়াবিয়া মিথ্যাচার করছে।” অতঃপর তিনি তাঁর মর্যাদা ও যোগ্যতার ব্যাপারে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। সেগুলোর মধ্যে মুবাহিলাতে তাঁর অংশ গ্রহণের কথা ব্যক্ত করেন। অবশেষে তিনি বলেন : “আমরা কোরআন এবং নবীর সুন্নাত মতে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং এ কারণেই আমরা সকলের চেয়ে যোগ্যতর।”৩৮ তাছাড়া আমরা সন্ধি পত্রের কয়েকটি ধারা পাঠকদের উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করেছিলাম যে ইমাম সেখানে শর্ত আরোপ করেছিলেন : “মুয়াবিয়াকে আমিরুল মু’মিনীন বলা যাবে না”। অতএব,এটা কিভাবে সম্ভব যে ইমাম তার হাতে বাইয়াত করবেন? যদি ধরে নেয়া হয় যে তিনি বাইয়াত করেছেন তাহলে তো মুয়াবিয়ার নির্দেশেই তাকে চলা উচিত। কিন্তু ইতিহাসই প্রমাণ করে যে তিনি কখনো মুয়াবিয়ার নির্দেশের আনুগত্য করেন নি। তদ্রূপ যখন খারেজীরা মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তখন মুয়াবিয়া ইমামকে নির্দেশ দিয়েছিল তাদের সাথে লড়াই করার জন্যে। কিন্তু ইমাম তার কথায় মোটেও কর্ণপাত করেন নি বরং তিনি বলেছিলেন : “যদি আমি কাবা গৃহের দিকে নামাজ আদায়কারীদের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা পোষণ করতাম তাহলে সর্বাগ্রে তোমার সাথে যুদ্ধ করতাম...।”৩৯
সুতরাং আমরা এসব বিবেক বর্জিত ও ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞাত লেখকের লেখায় অর্থহীন ও বানোয়াট তথ্য ব্যতীত অন্য কিছুই পাইনা।
ইমামের সন্ধি চুক্তি ইসলামের বৃহত্তর ও মহান স্বার্থে সম্পাদিত হয়েছে,মুয়াবিয়াকে বেশী উপযুক্ত মনে করার কারণে নয়।
অন্যায় প্রতিবাদ
আবার অনেকে জিজ্ঞেস করেন : “আচ্ছা! নেতা তো সমাজের দাবী অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে; তাহলে কেন ইমাম তাঁর অনুসারীদের দাবীর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করলেন না,তারা তো মুয়াবিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন?
এ ধরনের লোকদের উত্তরে বলতে হয় :
“যেহেতু যুদ্ধ অব্যাহত রাখা ইসলাম এবং মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল তাই তাদের দাবী অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া মোটেও যথোপযুক্ত পদক্ষেপ বলে গণ্য হতো না।”
প্রকৃত কথা হলো,আহলে বাইতের অনুসারীদের মতানুসারে ইমাম হচ্ছেন খোদায়ী নেতৃত্ব এবং নবীদের নেতৃত্বের অনুরূপ। তার কারণ হচ্ছে যে,ইমাম বিশ্বের উৎসমূল তথা মহান রাব্বুল আ’লামিনের সাথে সম্পর্কিত। তাই ঐশী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই তিনি সমাজের কল্যাণ নির্ধারণ করে থাকেন । আর তাঁর সিদ্ধান্ত কখনো অবাস্তব হয় না।
অনেক সময় এরকম হয়েছে যে,নবী অথবা ইমাম কোন একটা কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন এবং জনগণ তখন সে কাজের মঙ্গলজনক দিকটার সাথে পরিচিত ছিল না। কিন্তু কাল পরিক্রমায় জনগণ সে কাজের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ,মহানবী (সা.) যখন কাবা গৃহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের সাথে নিয়ে মদীনা থেকে বের হয়ে হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছান তখন কোরাইশরা সেখানে তাকে মক্কা প্রবেশে বাধা দেয়। কেননা তারা নবী করীম (সা.) এবং তাঁর সাথীদের বিনা অনুমতিতে ও পূর্ব সংবাদ ব্যতীত প্রবেশকে নিজেদের জন্যে এক প্রকার অপমান হিসেবে গণ্য করেছিল। অবশেষে অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে তারা পরস্পর নিম্ন শর্তানুযায়ী তিন বৎসর সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ থাকবেন :
এক : কোরাইশরা পরবর্তী বৎসরে তিন দিন আল্লাহর গৃহ মুসলমানদের অধীনে সোপর্দ করবে যেন তারা মুক্তভাবে সেখানে তাদের দীনি কাজ সম্পাদন করতে পরেন।
দুই : তিন বৎসর পর্যন্ত কোরাইশ ও মুসলমানরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কোন অভিযান চালাবে না এবং মক্কা নগরীতে মুসলমানদের যাওয়া-আসা মুক্ত থাকবে।৪০
তিন : মক্কার মুসলমানরা প্রকাশ্যে তাদের দীনি কাজ-কর্ম আঞ্জাম দিতে পারবে।
চার : উপরোল্লিখিত ধারাসমূহ এই শর্ত অনুযায়ী কার্যকরী হবে যে যদি কেউ মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় নেয় মুসলমানরা তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। অপর দিকে যদি মদীনা থেকে কেউ মক্কায় আশ্রয় নেয় কোরাইশরা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে না।৪১
নবী করীম (সা.) এই চুক্তি পত্রের ধারাসমূহের সাথে একমত প্রকাশ করেন। কিন্তু মুসলমানরা শেষোক্ত ধারার ব্যাপারে সাংঘাতিক অসন্তুষ্ট ছিলেন। তারা সন্ধি চুক্তি মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না।৪২ আর এ ব্যাপারে হযরত ওমর সবচেয়ে বেশী বিরোধিতা করেছিলেন।
তখন রাসূল (সা.) বলেছিলেন :
أَنَا عَبْدُ اللهِ وَ رَسُولُهُ لَنْ اُخَالِفْ أَمْرَهُ وَ لَنْ يُضَيِّعَنِى
অর্থাৎ “আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আমি কখনো তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করি না এবং তিনি কখনো আমার কোন ক্ষতি করেন না।”৪৩
আর তাই হয়েছিল। কিছুদিন পর এই শান্তি চুক্তির কল্যাণকর দিক সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিল। কেননা যুদ্ধের আগুন নিভে যাওয়া এবং মক্কাতে মুসলমানদের গমনা গমনের কারণে মুশরিকরা ইসলামের প্রকৃত স্বরূপের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল আর এভাবে ইসলাম তাদের অন্তরে বাসা বাধতে শুরু করে। তাদের অনেকেই মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।
এ অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে চুক্তি পত্রের মেয়াদ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই ইসলাম মক্কাবাসীদের অধিকাংশের ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। ৪৪
যোহরী বলেন : “সন্ধির এই দুই বৎসরের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের সমান সংখ্যক পরিমান বৃদ্ধি পায়।”
ইবনে হিশাম বলেন : “যোহরী সত্য বলেছেন। কেননা যখন মুসলমানরা মহানবীর সাথে হুদায়বিয়াতে এসেছিলো তখন তদের সংখ্যা ছিল ১৪০০। কিন্তু দুই বৎসর পর মক্কা বিজয়ের সময় নবীর সাথীদের সংখ্যা দশ হাজারে গিয়ে দাড়ায়।৪৫ তাই যোহরী যথার্থই বলেছেন :
لَمْ يَكُنْ فَتْحٌ أَعْظَمَ مِنْ صُلْحِ اْلْحُدَيْبِيَّةِ
অর্থাৎ “হুদাইবিয়ার সন্ধির ন্যায় এমন বিরাট বিজয় আর হয়নি।”৪৬
এবং ইমাম জা’ফর সাদিক (আ.)ও বলেন :
مَا كَانَتْ قَضِيَّةٌ أَعْظَمَ بَرَكَةً مِنْهَا
অর্থাৎ “এ ঘটনার মত এত বরকতময় ঘটনা আর ঘটেনি।”৪৭
সুতরাং যারা ইমামদের নেতৃত্বের উপর ঈমান রাখেন,ইমাম হাসানের সন্ধির ব্যাপারে তাদের আপত্তি ও অভিযোগ অনুচিত। যেমনি করে কোরাইশদের সাথে রাসূল (সা.)-এর সন্ধির ব্যাপারে তাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।
এ কারণে যখন আহলে বাইতের অনুসারীদের মধ্যে কেউ ইমামের কাজে আপত্তি করেন-যেমনি করে কিছু মুসলমানরা স্বয়ং নবী করীম (সা.)-এর কাজে আপত্তি করেছিল- তখন ইমাম হাসান (আ.) বলেছিলেন : “ইমামের কাজে হস্তক্ষেপ করতে নেই এবং নিজের ইমামের আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হয়। কেননা তিনি আল্লাহর নির্দেশে এবং প্রকৃত মঙ্গল বিবেচনায় কাজ কর্ম সম্পাদন করে থাকেন,যদিও অন্যেরা সে কাজের মূল কারণ ও রহস্য সম্পর্কে অবহিত নয়।”
আবু সাঈদ আকিসা বলেন : “ইমাম হাসানকে বললাম,কেন আপনি মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করলেন? যখন আপনি জানতেন যে আপনি সত্য পথে আছেন আর মুয়াবিয়া বিচ্যুত পথে আছে এবং সে একজন অত্যাচারী?”
তখন ইমাম উত্তরে বলেন,“আমি কি আমার পিতার পরবর্তীতে আল্লাহর হুজ্জাত বা অকাট্য দলীল এবং ইমাম নই?”
বললাম : জি,হ্যাঁ।
তিনি বলেন : আল্লাহর রাসূল (সা.) কি আমি এবং আমার ভাইয়ের ব্যাপারে বলেন নি?
أَلْحَسَنُ وَ اْلْحُسَيْنِ إِمَامَانِ قَامَا أَوْ قَعَدَا؟
অর্থাৎ “হাসান ও হুসাইন উভয়েই ইমাম,তারা (অন্যায়ের বিরুদ্ধে ) কিয়াম করুক বা না করুক?”
বললাম : জি,হে রাসূলের সন্তান।
তিনি বলেন : সুতরাং আমি তোমাদের ইমাম। কিয়াম করি বা না করি। তখন তার জন্যে ইমাম কিয়াম না করার কারণ এভাবে বর্ণনা করেন :
“আমি মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেছি যেমনি করে রাসূলুল্লাহ্ বনি যামরাহ,বনি আশজা এবং মক্কাবাসীদের সাথে হুদাইবিয়া নামক স্থানে সন্ধি করেছেন। তবে পার্থক্য এটাই যে,তারা ছিল কাফের আর মুয়াবিয়া ও তার সাহায্যকারীরা কাফেরদের মত ।
হে আবু সাঈদ,যদি আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমাম হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে থাকি,তাহলে আমার মতকে খাটো করে দেখার কোন-ই অর্থ হয় না,যদিও এর মঙ্গল তোমার কাছে ঢাকা থাকে।
আমার এবং তোমার উদাহরণ হযরত খিজির (আ.) ও হযরত মুসা (আ.)-এর মত। হযরত খিজির (আ.) এমন সব কাজ করতেন যার আসল দিক হযরত মুসা (আ.) অবগত ছিলেন না। তাই তিনি রাগান্বিত হয়ে যেতেন। কিন্তু যখন হযরত খিজির (আ.) তাকে অবহিত করলেন,তখন তিনি শান্ত হলেন। আমিও তোমাকে রাগান্বিত করেছি। তার কারণ এই যে,তুমি আমার কাজের মঙ্গলজনক দিক সম্পর্কে অবহিত নও। তবে তুমি এতটুকু জেনে রাখ যে,যদি আমি মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি না করতাম তাহলে পৃথিবীর বুকে আহলে বাইতের কোন অনুসারীই টিকে থাকতো না।”৪৮
মুয়াবিয়ার চুক্তি ভঙ্গ
মুয়াবিয়া যখন সকল কিছুর উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তখন নিজের আসল চেহারা জনগণের সামনে উম্মোচিত হয়। ‘নুখাইলা’ নামক স্থানে এক ভাষণে মুয়াবিয়া প্রকাশ্যে বলে : “আল্লাহর কসম,আমি তোমাদেরকে নামাজ আদায়ে,রোজা রাখতে এবং হজ গমনে বাধ্য করতে তোমাদের সাথে লড়াই করিনি,বরং তোমাদের উপর শাসন চালানোর জন্যে যুদ্ধ করেছি। আর এখন আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছেছি। আমি স্পষ্ট ঘোষণা করছি যে,হাসান বিন আলীর সাথে সন্ধি চুক্তির সবগুলো শর্ত পদদলিত করবো।”৪৯
যদিও বাস্তবে ইমাম হাসানের পূর্ব পরিচিতি ও প্রভাবের কারণে বাস্তবে কোন কোন শর্ত পালন করতে বাধ্য হয়েছিল। এ ব্যাপারে ইবনে আবিল হাদীদ লিখেন :
“একদা কুফার গভর্ণর যিয়াদ ইমাম হাসানের এক অনুসারীকে পশ্চাদ্ধাবন করতে মনস্থ করে। তখন ইমাম তার কাছে বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি বলেন আমরা আমাদের অনুসারীদের জন্যে নিরাপত্তা চেয়ে নিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে তুমি আমার একজন অনুসারীর অসুবিধা সৃষ্টি করছো,এরকম করো না।”
যিয়াদ ইমামের কথা মানলো না। সে বলল : আমি তার পশ্চাদ্ধাবন করবো যদিও সে তোমার দেহের চামড়া ও মাংসের মধ্যে অবস্থান করে...।
ইমাম যিয়াদের উত্তরের হুবহু কপি মুয়াবিয়ার জন্যে প্রেরণ করেন।
মুয়াবিয়া যিয়াদকে তিরস্কার করে বলে :
“তুমি তার অনুসারীদের জন্যে অসুবিধা সৃষ্টি করো না। আমি তোমাকে এ কাজের দায়িত্ব প্রদান করিনি।”৫০
মদীনায় প্রত্যাবর্তন
মুয়াবিয়া সবদিক থেকে,সর্ব পন্থায় ইমামকে কষ্ট ও বিরক্ত করার জন্যে প্রাণপন চেষ্টা চালাতে থাকে। সে ইমাম এবং তাঁর অনুসারীদেরকে কড়া নজরে রাখতো আর এভাবে সে তাদেরকে কঠিন সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন করে তোলে। সে হযরত আলী এবং তাঁর পরিবারের অবমাননা অব্যাহতভাবে চালাতে থাকে। কখনো সে এতটা নির্লজ্জ হত যে এমনকি যে অনুষ্ঠানে ইমাম হাসান স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন সেখানে সে হযরত আলীকে গালমন্দ করতো।৫১ যদিও ইমাম তৎক্ষণাৎ দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে দিতেন এবং তাকে শিক্ষা দিয়ে দিতেন তবুও কুফা শহরে অবস্থান তাঁর জন্যে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাই তিনি আবার মদীনায় ফিরে গেলেন।
কিন্তু এই সফরও বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে কোন সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। কেননা,মুয়াবিয়ার অন্যতম নোংরা প্রতিনিধি মারওয়ান ছিল তৎকালীন মদীনার গভর্ণর। যে ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন :
هُوَ اْلْوَزَغُ اْبْنُ اْلْوَزَغِ، أَلْمَلْعُوْنُ اْبْنُ اْلْمَلْعُوْنِ
অর্থাৎ “সে ভীতু ও কাপুরুষের ছেলে ভীতু ও কাপুরুষ,অভিশপ্ত ব্যক্তির পুত্র অভিশপ্ত।”৫২
সে ইমাম ও তার অনুসারীদের জীবনকে অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থার মধ্যে আটকে ফেলে। আর সে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে ইমামের গৃহে তার সঙ্গী-সাথিদের গমনাগমন পর্যন্ত অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে কারণে,মদীনাতে ইমামের দশ বৎসর অবস্থানের পরও তাঁর খুব অল্প সংখ্যক অনুসারীই সেই মহান ব্যক্তির জ্ঞানের উৎস থেকে উপকৃত হতে পেরেছে। আর এ জন্যেই এই মহান ইমামের কাছ থেকে অতি অল্প সংখ্যক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।
মারওয়ান সর্বদাই ইমাম হাসান (আ.)-এর উপস্থিতিতে ইমাম আলীর ব্যাপারে অশোভন উক্তি করতে চেষ্টা করতো। কখনো সে অন্যান্য লোকজনকে স্বয়ং ইমাম হাসান (আ.)-কে অপমান করতে বাধ্য করতো।৫৩
এই দশ বৎসরে মারওয়ানের পর যে ব্যক্তিই মদীনার গভর্ণর হয়েছে সেই ইমাম ও তাঁর অনুসারীদের নির্যাতন করতে ও কষ্ট দিতে ত্রুটি করেনি।
শাহাদাত
যে মুয়াবিয়া ইমামের বয়সের স্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে খেলাফত ইমামের হাতে সোপর্দ করতে প্রস্তুত ছিল না,সে এখন তার নাপাক ও নোংরা পুত্র ইয়াযিদের জন্যে পরবর্তী শাসন কর্তৃত্ব পাকা-পোক্ত করার জন্যে কোমর বেঁধে লেগে যায় যেন তার খেলাফতের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা দেখা না দেয়। কিন্তু সে তার এই অভিসন্ধি চরিতার্থ করার পথে ইমামকে এক মস্ত বড় বাধা হিসেবে মনে করে। কেননা সে ধারণা করেছিল যদি তার মৃত্যুর পর ইমাম হাসান জীবিত থাকেন তাহলে সম্ভবত জনগণ যেহেতু মুয়াবিয়ার পরিবারের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট তাই তারা ইমামের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। তাই সে কয়েক বার ইমামকে হত্যা করার চেষ্টা করে। অবশেষে চক্রান্ত করে পবিত্র ইমামকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। তিনি পঞ্চদশ হিজরীর সফর মাসের আটাশ তারিখে শাহাদাতের সুধা পান করে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তাঁকে জান্নাতুল বাকীর কবরস্থানে দাফন করা হয়।৫৪ আল্লাহর অফুরন্ত দরুদ তাঁর উপর বর্ষিত হোক।
তথ্যসূত্র:
১। ইরশাদ,মুফিদ,পৃ. ১৬৯। তারিখুল খুলাফা,সুয়ূতি,পৃ. ১৭৭,মিসর প্রিন্ট,মরহুম কুলাইনী এই মহান ব্যক্তির জন্ম তারিখ ‘দ্বিতীয় হিজরী’ লিখেছেন।
২। বিহারুল আনওয়ার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ২৩৮,নতুন মুদ্রণ।
৩। দালাইলুল ইমামাহ্,মুহাম্মাদ বিন জারীর আত তাবারী,পৃ. ৬০।
৪। তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৮৮।
৫। বিহারুল আনওযার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ২৬৪।
৬। তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৮৯। (( أَلْحَسَنُ وَ اْلْحُسَيْنُ سَيِّدُ شَبَابِ أَهْلِ اْلْجَنَّةِ. ))
৭। ইরশাদ,মুফিদ,পৃ. ১৮১,বিহারুল আনওয়ার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ২৭৮।
৮। তাবাকাতে কাবির,১ম খণ্ড,পৃ. ৩৩,২য় অধ্যায়।
৯। গায়াতুল মারাম,পৃ. ২৮৭।
১০। হায়াতুল ইমাম আল হাসান বিন আলী,পৃ. ২৬০-২৬১।
১১। তাবাকাতে কাবির,৩য় খণ্ড,১ম পর্ব,পৃ. ২০।
১২। হায়াতুল ইমাম আল হাসান বিন আলী,১ম খণ্ড,পৃ. ৩৯৬-৩৯৯।
১৩। হায়াতুল ইমাম আল হাসান বিন আলী,১ম খণ্ড,পৃ. ৪৭৯।
১৪। হায়াতুল ইমাম আল হাসান বিন আলী,১ম খণ্ড,পৃ. ৪৭৯।
১৫। উসুলে কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ২৯৭,২৯৮।
১৬। বিহারুল আনওয়ার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ৩৩১।
১৭। বিহারুল আনওয়ার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ৩৩১,৩৩২। তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৯০।
১৮। বিহারুল আনওয়ার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ৩৪২,৩৪৩।
১৯। বিহারুল আনওয়ার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ৩৩২। তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৯০।
২০। ((এর আরবী বাক্যটি হচ্ছে ঃ اللهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ ))
২১। বিহারুল আনওয়ার,৪৩তম খণ্ড,পৃ. ৩৪৪।
২২। তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৯১।
২৩। আশ শুরা : ২৩ ।
২৪। ইরশাদ,শেখ মুফিদ,পৃ. ১৬৯,১৭০। শারহে নাহ্জুল বালাগাহ্; ইবনে আবিল হাদীদ,১৬তম খণ্ড,পৃ. ৩০।
২৫। ইরশাদ,শেখ মুফিদ,পৃ. ১৭০।
২৬। শারহে নাহ্জুল বালাগাহ্,ইবনে আবিল হাদীদ,১৬তম খণ্ড,পৃ. ৩৫।
২৭। বিহারুল আনওয়ার,৪৪তম খণ্ড,পৃ. ৩৩।
২৮। নাহ্জুল বালাগাহ্,ইবনে আবিল হাদীদ,১৬তম খণ্ড,পৃ. ৩৭-৪০।
২৯। তারিখে ইয়াকুবী,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৪-২০৭।
৩০। ইরশাদ,শেখ মুফিদ,পৃ. ১৭২।
৩১। তারিখে ইয়াকুবী,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৪-২০৭।
৩২। তারিখে ইয়াকুবী,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৪-২০৭। তারিখে তাবারী,৭ম খণ্ড,পৃ. ১।
৩৩। ইরশাদ,শেখ মুফিদ,পৃ. ১৭২,১৭৩।
৩৪। তারিখে ইয়াকুবী,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৪-২০৭।
৩৫। ইরশাদ,শেখ মুফিদ,পৃ. ১৭৩। মাকাতিল আত তালিবীন,পৃ. ২৬।
৩৬। বিহারুল আনওয়ার,৪৪তম খণ্ড,পৃ. ৬৫।
৩৭। তারিখে ইয়াকুবী ,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৬।
৩৮। বিহারুল আনওয়ার ,৪৪তম খণ্ড,পৃ. ৬২।
৩৯। আল কামেল,ইবনে আসির,৩য় খণ্ড,পৃ. ২০৮।
৪০। তারিখে ইয়াকুবী,২য় খণ্ড,পৃ. ৪৪,৪৫।
৪১। বিহারুল আনওয়ার,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৬৭,৩৬৮।
৪২। বিহারুল আনওয়ার,২০তম খণ্ড,পৃ. ৩৫০।
৪৩। সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩১৭।
৪৪। বিহারুল আনওয়ার,২০তম খণ্ড,পৃ. ৩৬৮।
৪৫। সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩২২।
৪৬। বিহারুল আনওয়ার,২০তম খণ্ড,পৃ. ৩৪৫।
৪৭। বিহারুল আনওয়ার,২০তম খণ্ড,পৃ. ৩৬৮।
৪৮। বিহারুল আনওয়ার,৪৪তম খণ্ড,পৃ. ১।
৪৯। বিহারুল আনওয়ার,৪৪তম খণ্ড,পৃ. ৪৯।
৫০। শারহে নাহ্জুল বালাগাহ্,ইবনে আবিল হাদীদ,১৬তম খণ্ড,পৃ. ১৮-১৯।
৫১। ইরশাদ,শেখ মুফিদ,পৃ. ১৭৩।
৫২। হায়াত আল ইমাম আর হাসান বিন আলী,১ম খণ্ড,পৃ. ২১৮।
৫৩। তারিখুল খুলাফা,আল্লামা সুয়ূতি,পৃ. ১৯০।
৫৪। মুরুযুয যাহাব,২য় খণ্ড,পৃ. ৪২৭। দালাইলুল ইমামাহ্,পৃ. ৬০। তাবাকাতে ইবনে সা’দ,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৪। এবং আরো অন্যান্য গ্রন্থ। যদিও তাঁর মৃত্যুর বৎসর ও দিন তারিখের ব্যাপারে ভিন্ন মতের বর্ণনা আছে। আগ্রহী পাঠক মহোদয়গণ ‘তারিখে বাগদাদ’,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪০,তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৯২ এবং ‘দালাইলুল ইমামাহ্’,পৃ. ৬০-এ অধ্যয়ন করতে পারেন।