পবিত্র কুরআনে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি প্রসঙ্গ
মো. আশিফুর রহমান
ভূমিকা
...قُلْ هَلْ يَسْتَوِى الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَ الَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ إنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُوا الْأَلْبَابِ
...‘(হে নবী!) বল,যারা মূর্খ ও যারা বিদ্বান তারা কি সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।’১
মানুষ বুদ্ধিমান বা বিবেকসম্পন্ন প্রাণী। অন্যান্য প্রাণীর সাথে তার মূল পার্থক্যই হল তার জ্ঞানের ব্যবহার। যদি জ্ঞান দিয়ে মানুষকে সজ্জিত করা না হত তা হলে অন্যান্য প্রাণীর সাথে তার কোন পার্থক্যই থাকত না। অন্যান্য প্রাণী যেমন খাদ্য গ্রহণ করে ও বংশ বৃদ্ধি করে,একইভাবে মানুষেরও এর থেকে বেশি কিছু করার থাকত না।
কেবল বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই মানুষ এত উন্নত হতে পেরেছে। বাবুই পাখি সেই সৃষ্টির শুরু থেকে আজও একইভাবে বাসা তৈরি করে,অন্যদিকে মানুষ চাঁদে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে। মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে তার জীবন যাপন ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে পেরেছে। যদি সে জ্ঞানের ব্যবহার না করত তা হলে তার অবস্থাও অন্যান্য প্রাণীর মতই হত।
আবার মহান আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিই তাঁর ইবাদত করে। কিন্তু অন্যান্য সৃষ্টির ইবাদতের সাথে মানুষের ইবাদতের পার্থক্য রয়েছে। মহান আল্লাহ্ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এজন্যই যে,সে যেন জ্ঞানবুদ্ধি ব্যবহার করে তার স্রষ্টার পরিচিতি লাভ করার মাধ্যমে ইবাদত করতে পারে। আর তাই মহান আল্লাহ্ বার বার মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি ব্যবহার করার জন্য বলেছেন। লক্ষণীয় বিষয় যে,অন্যান্য ধর্মের বিপরীতে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহারে এত অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহারে যে বিপুল সংখ্যক নির্দেশনা ইসলাম ধর্মে পাওয়া যায় তা অন্য কোন ধর্মে পাওয়া যায় না। বাইবেলে এমনকি জ্ঞানকে আদি পাপের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কেবল সত্যধর্মের পক্ষেই জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ সম্ভব। কেননা,সত্যে উপনীত হওয়ার মূল প্রক্রিয়াটি হচ্ছে জ্ঞানগত চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো।
পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ্ মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দানের কথা বলেছেন :
إِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ إِقْرَأْ وَ رَبُّكَ الْأَكْرَامُ الّذِيْ عَلَّمَ بَالْقَلَمِ عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
‘পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে,যিনি সৃষ্টি করেছেন,সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে,পাঠ কর,আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত,যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’২
আবার রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাদিসেও জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে বলা হয়েছে :
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরয।’৩
আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিসে বলা হয়েছে :
اُطْلُبِ الْعِلْمَ مِنَ الْمَهْدِ إِلَى اللّهَدِ
‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর।’
পবিত্র কুরআনে ‘তারা কি চিন্তা করে না’ (أَفَلَا يَتَفَكَّرُوْنَ),‘তারা কি গবেষণা করে না’ (أَفَلَا يَتَدَبَّرُوْنَ),‘তোমরা কি বোঝ না’ (أَفَلَا تَعْقِلُوْنَ),‘তারা কি লক্ষ্য করে না’ ( أَلَمْ يَرَوْا),‘তারা কি (সৃষ্টি প্রক্রিয়া) অবলোকন করে না’ (أَفَلَا يَنْظُرُوْنَ) এমন বাক্য ব্যবহার করে মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
আবার কুরআনের কোন কোন স্থানে বলা হয়েছে : ‘এতে নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানবান জাতির জন্য’ (لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ) অথবা ‘অনুধাবনকারী সম্প্রদায়ের জন্য আমি নিদর্শনসমূহ বিবৃত করেছি’ (فَصَّلْنَا الآيَاتِ لِّقَوْمٍ يَّفْقَهُوْنَ)।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে অসংখ্য উপমা উপস্থাপন করেছেন এবং এর কারণও তিনি বলে দিয়েছেন যে,যেন মানুষ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
...وَ يَضْرِبُ اللهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُوْنَ
‘...এবং আল্লাহ্ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন,যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে।’৪
বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহার
যারা বিবেক ব্যবহার করে আর যারা বিবেক ব্যবহার করে না তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলছেন :
...قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَ الْبَصِيْرُ...
...‘বল,‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান?’...৫
যারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগায় না,কোনরূপ চিন্তা করে না,গবেষণা করে না তাদেরকে কুরআনে মূক,বধির,অন্ধ ইত্যাদি অভিধায় তিরস্কৃত করা হয়েছে :
إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِيْنَ لَا يَعْقِلُوْنَ
‘আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব সেই বধির ও মূক যারা কিছুই উপলব্ধি করে না।’৬
আরও বলা হয়েছে :
وَ مَنْ كَانَ فِيْ هٰذِه أَعْمَى فَهُوَ فِى الْآخِرَةِ أَعْمَى وَ أَضَلُّ سَبِيْلًا
‘আর যে ব্যক্তি এখানে অন্ধ সে আখিরাতেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট।’৭
এমনকি তাদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে :
...لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا يَفْقَهُوْنَ بِهَا وَ لَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُوْنَ بِهَا وَ لَهُمْ آذَانٌ لَّا يَسْمَعُوْنَ بِهَا أُولَائِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَائِكَ هُمُ الْغَافِلُوْنَ
...‘তাদের হৃদয় আছে,কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না,তাদের চোখ আছে,তা দিয়ে দেখে না এবং তাদের কান আছে,তা দিয়ে শোনে না,এরাই পশুর ন্যায়,বরং তারা তার চেয়েও নিকৃষ্ট। তারাই গাফেল।’৮
মহান আল্লাহ্ বলছেন :
...فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَ لكِنْ تَعْمَى الْقُلُوْبُ الَّتِيْ فِي الصُّدُوْرِ
...‘বস্তুত চোখ তো অন্ধ নয়,বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।’৯
আর তাই চিন্তা-গবেষণা করতে হবে,বিবেকের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে এবং এর মাধ্যমেই ইহকালীন ও পরকালীন জীবনকে সুন্দর করতে হবে।
আল কুরআনে জ্ঞানের প্রতি আহবান
স্রষ্টার অস্তিত্ব ও একত্ব প্রমাণে,নবী-রাসূলগণের সত্যতা প্রমাণে,কিয়ামতে পুনরুত্থান প্রমাণে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অসংখ্য যুক্তি উপস্থাপন করে জ্ঞানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের কতিপয় আয়াত উপস্থাপন করা হল।
স্রষ্টার অস্তিত্ব
মানুষের মৌলিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তা হল স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে কি নেই। মহান আল্লাহ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়ার ব্যাপারে বারবার তাকিদ দিয়েছেন। অসংখ্য আয়াতের মাধ্যমে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। কোথাও চমৎকার উপমার মাধ্যমে বিষয়টির সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। মহান আল্লাহ মানুষকে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কেই চিন্তা করার মাধ্যমে স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপার উপসংহারে পৌঁছতে বলেছেন :
أَمْ خُلِقُوْا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُوْنَ
‘তারা কি অন্যের দ্বারা সৃষ্ট নাকি তারা নিজেরাই স্রষ্টা?’১০
তিনি সৃষ্টিজগতের অন্যান্য সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করার কথা বলেছেন :
أَفَلَا يَنْظُرُوْنَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ وَ إِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ وَ إِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ وَ إِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ
‘তারা কি উটের দিকে লক্ষ্য করে না যে,কীরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে,আর আসমানের দিকে যে কীরূপে সুউচ্চ করা হয়েছে,আর পর্বতমালার দিকে যে,কীরূপে দাঁড় করানো হয়েছে,আর যমিনকে যে,কীরূপে সম্প্রসারিত করা হয়েছে?’১১
তিনি সৃষ্টিজগতের নিয়মশৃঙ্খলা নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন :
إِنَ فِيْ خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَ الْأَرْضِ وَ اخْتِلَافِ الّيْلِ وَ النَّهَارِ وَ الْفُلْكِ الَّتِيْ تَجْرِيْ فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَ مَا أَنْزَلَ اللهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَ بَثَّ فِيْهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَّ تَصْرِيْفِ الرِّيَاحِ وَ السَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَ الْأَرْضِ لآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ
‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে,রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তনে,যা মানুষের হিত সাধন করে,তা সহ সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহে,আল্লাহ্ আকাশ থেকে যে বারি বর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন তাতে এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীবজন্তুর বিস্তারণে,বায়ুর দিক পরিবর্তনে,আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’১২
স্রষ্টার একত্ব
যখন কারো কাছে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ হয়ে যায় তখন তার কাছে দ্বিতীয় যে প্রশ্নের উদ্ভব হয় তা হল স্রষ্টা কি এক,নাকি একের অধিক। পবিত্র কুরআন এ বিষয়েও চমৎকার যুক্তি উপস্থাপন করেছে। বলা হয়েছে :
قُلْ لَّوْ كَانَ مَعَهُ آلِهَةٌ كَمَا يَقُوْلُوْنَ إِذًا لَّابْتَغَوْا إِلَى ذِي الْعَرْشِ سَبِيْلًا
‘বল,‘যদি তাঁর সাথে আরো উপাস্য থাকত,যেমন তারা বলে,তবে তারা আরশ-অধিপতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপায় অন্বেষণ করত।’১৩
আল্লাহ্ একাধিক স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকার পরিণাম সম্পর্কে বিবেককে জাগ্রত করার জন্য বলছেন :
...لَوْ كَانَ فِيْهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا...
...‘যদি এতদুভয়ের মধ্যে (আকাশ ও পৃথিবীতে) আল্লাহ ব্যতীত বহু উপাস্য থাকত তা হলে উভয়ই (আকাশ ও পৃথিবী) ধ্বংস হয়ে যেত’...১৪
নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে
মহান আল্লাহ্ নিরর্থক কোন কিছুই সৃষ্টি করেননি। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি উদ্দেশ্যমণ্ডিত। তিনি পৃথিবীতে মানব সৃষ্টি করে পাঠিয়েছেন এরও উদ্দেশ্য রয়েছে। মানবের পূর্ণতা অর্জনই হল সেই উদ্দেশ্য। তাই এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপায়-উপকরণও তিনি পৃথিবীতে দিয়েছেন। এর অন্যতম হল নবী-রাসূল প্রেরণ যেন মানুষ তাঁদের নিকট থেকে প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা নিয়ে সাফল্য লাভ করতে পারে।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে,সৃষ্টিকর্তা মানুষের সব ধরনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত,তবে কেন তিনি তাদেরকে কোন বিষয় জানানো বা কোন বিষয়ে সতর্ক করার কোন পদক্ষেপ নিলেন না? এ প্রশ্নেরই জবাব নিহিত রয়েছে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণের মধ্যে।
প্রকৃতপক্ষেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে,মানুষের জানার ক্ষেত্র সীমিত,তাই কোনটি ভাল,কোনটি মন্দ,কোনটি তার জন্য কল্যাণকর,কোনটি তার জন্য অকল্যাণকর তার সবকিছুই সে নিজে থেকে জানতে বা বুঝতে পারে না। এক্ষেত্রে সে বিকল্প কোন কিছুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে চিন্তা করে এমন কোন উৎস থাকতে হবে যে উৎস থেকে মানুষ এ বিষয়গুলো জানতে পারে। আর এমন উৎসই হলেন নবী-রাসূলগণ। আবার মানুষ তার স্বভাবের কারণে অনেক সময় কল্যাণকর বিষয় থেকে দূরে যায় বা তা তার মধ্যে নিষ্পৃহতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে তাকে এ বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়া ও সতর্ক করারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর তাই মহান আল্লাহ্ও মানুষের জন্য অনুগ্রহ স্বরূপ ঐশী ব্যক্তিত্বদের পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
...وَ إِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيْهَا نَذِيْرٌ
...‘এমন কোন জাতি নেই যেখানে ভীতি প্রদর্শনকারী পাঠানো হয়নি।’১৫
আরও বলা হয়েছে :
إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَ لِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ
‘নিশ্চয়ই আপনি সতর্ককারী এবং প্রতিটি জাতির জন্য পথপ্রদর্শক রয়েছে।’১৬
নবী-রাসূলগণ প্রেরণের অন্যতম কারণ হল যেহেতু পৃথিবীর ভাল ও মন্দ কর্মের প্রতিদান পরকালে দেওয়া হবে সেহেতু মানুষ যেন কোন অজুহাত দেখাতে না পারে যে,তারা কিছুই জানত না অথবা তারা অনেক বিষয়ই ভুলে গিয়েছিল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
رُسُلاً مُّبَشِّرِيْنَ وَ مُنْذِرِيْنَ لِئَلَّا يَكُوْنَ لِلنَّاسِ عَلَى اللهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ...
‘আমি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে রাসূল প্রেরণ করেছি যাতে রাসূলের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অজুহাত না থাকে।’...১৭
হযরত আদম (আ.),নূহ (আ.),ইবরাহীম (আ.),মূসা (আ.),ঈসা (আ.) এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সহ মোট ছাব্বিশ জন নবী সম্পর্কে তিনি পরিচয় দিয়েছেন। যেমন :
وَ لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوْحًا إِلَى قَوْمِهِ...
‘আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট পাঠিয়েছিলাম।’...১৮
وَ لَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوْسى بِآيَاتِنَا وَ سُلْطَانٍ مُّبِيْنٍ
‘আমি মূসাকে আমার নিদর্শনাবলি ও স্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছিলাম।’১৯
তবে যে কেউ নবুওয়াত দাবি করলেই যে তাকে মেনে নিতে হবে পবিত্র কুরআন তা সমর্থন করে না। বরং এ ক্ষেত্রেও পবিত্র কুরআন জ্ঞানবুদ্ধি ব্যবহার করতে বলেছে। নবী-রাসূলগণ মোজেজার মাধ্যমে তাঁদের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করতেন যেটা অন্য কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকের কাছেই তা যাদুবিদ্যা মনে হতে পারে। কিন্তু মানুষ যদি তার জ্ঞান দিয়ে যাচাই করে তবে তার কাছে এ বিষয়টি প্রমাণ হয়ে যায়। আমরা হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে যাদুকরদের মোকাবিলার ঘটনায় এটি দেখতে পাই।২০
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে
নবী-রাসূল প্রেরণের সাথে সাথে মহান আল্লাহ্ জীবনবিধান সম্বলিত ঐশী গ্রন্থও প্রেরণ করেছেন। যারা স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তারা স্বাভাবিকভাবেই স্রষ্টার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত গ্রন্থকেও অস্বীকার করে। তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণে পবিত্র কুরআনে যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করা হয়েছে তেমনি সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কেও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনের সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্যও বিবেক কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। তিনি পবিত্র কুরআনের মত কোন রচনা নিয়ে আসার জন্য যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন,তার মাধ্যমেই বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিতে বলেছেন যে,এটা মানুষের রচনা নয়। মহান আল্লাহ্ কুরআনের অনুরূপ রচনা করার চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছেন :
فَلْيَأْتُوْا بِحَدِيْثٍ مِّثْلِهِ إِنْ كَانُوْا صَادِقِيْنَ
‘তারা যদি সত্যবাদী হয়,তবে এর সদৃশ কোন রচনা উপস্থিত করুক!’২১
এরপর সেই চ্যালেঞ্জকে সহজ করে দিয়ে বলেছেন :
قُلْ فَأْتُوْا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِّثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ وَ ادْعُوْا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُوْنِ اللهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ
‘বল,তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা আন এবং আল্লাহ্ ব্যতীত অপর যাকে পার ডেকে নাও।’২২
সবশেষে মাত্র একটি সূরা রচনা করে আনার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন :
وَ إِنْ كُنْتُمْ فِيْ رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِنْ مِثْلِهِ وَ ادْعُوْا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُوْنِ اللهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ
‘আমরা আমাদের বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি তোমরা সন্দেহে নিপতিত হও তা হলে এর অনুরূপ একটি সূরা (রচনা করে) নিয়ে আস,আর আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের অন্যসব সাক্ষীকে আহ্বান কর,যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।’২৩
أَمْ يَقُوْلُوْنَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِثْلِهِ وَ ادْعُوْا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُوْنِ اللهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ
‘তারা কি বলে সে এটা রচনা করেছে? বল : তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা (রচনা করে) নিয়ে এস,আর আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যাকে পার আহ্বান কর,যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।’২৪
তিনি এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় কেবল মানুষ নয়,বরং মানুষ ও জ্বিন জাতির সম্মিলিত শক্তির অক্ষমতার কথা তুলে ধরেছেন :
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَ الْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوْا بِمِثْلِ هَذا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُوْنَ بِمِثْلِهِ وَ لَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيْرًا
‘যদি এই কুরআনের অনুরূপ আনার জন্য মানুষ ও জ্বিন সমবেত হয় তবুও তারা এর অনুরূপ আনতে পারবে না,এমনকি যদি তারা পরস্পরকে সাহায্যও করে।’২৫
পরিশেষে তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক করছেন :
فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوْا وَ لَنْ تَفْعَلُوْا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِيْ وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَ الْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِيْنَ
‘আর যদি (তা) না পার এবং কখনই পারবে না,তা হলে সেই (দোযখের) আগুনকে ভয় কর,যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর,যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’২৬
অন্যত্র মহান আল্লাহ্ আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে কুরআন যে তিনি ব্যতীত আর কারও পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয় সে সম্পর্কে বলেছেন :
...وَ لَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُوْا فِيْهِ اخْتِلَافاً كَثِيْرًا
‘...যদি তা (কুরআন) আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও নিকট থেকে আসত,তবে তারা তাতে অনেক অসংগতি পেত।’২৭
কিয়ামতে পুনরুত্থান সম্পর্কে
পূর্বেও যেমন নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে কিয়ামতকে অস্বীকার করা হত,বর্তমানেও তা করা হচ্ছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ কিয়ামত অস্বীকারকারীদের এসব প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিয়েছেন এবং তা অনুধাবন করার জন্য বলেছেন।
فَسَيَقُوْلُوْنَ مَن يُّعِيْدُنَا قُلِ الَّذِيْ فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ
‘তারা বলবে,কে আমাদেরকে পুনরুত্থিত করবে? বল,তিনিই যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন।’২৮
فَانْظُرْ إِلَى آثَارِ رَحْمَتِ اللهِ كَيْفَ يُحْيِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا إِنَّ ذٰلِكَ لَمُحْيِ الْمَوْتَى وَ هُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٍ
‘আল্লাহর অনুগ্রহের ফল সম্পর্কে চিন্তা কর,কীভাবে তিনি ভূমির মৃত্যুর পর এটাকে পুনর্জীবিত করেন,এভাবেই আল্লাহ্ মৃতকে জীবিত করেন,কারণ,তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’২৯
وَ يَقُوْلُ الْإِنْسَانُ ءَإِذَا مَامِتُّ لَسَوْفَ أُخْرَجُ حَيًّا أَوَ لَا يَذْكُرُ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ وَ لَمْ يَكُ شَيْئًا
‘মানুষ বলে,‘আমার মৃত্যু হলে আমি কি জীবিত অবস্থায় উত্থিত হব?’ মানুষ কি স্মরণ করে না যে,আমি তাকে পূর্বে সৃষ্টি করেছি যখন সে কিছুই ছিল না?’৩০
এমনকি মানুষ আজ গবেষণার মাধ্যমে যে বিষয়টি জানতে পেরেছে যে,প্রত্যেক মানুষের হাতের আঙ্গুলের রেখা স্বতন্ত্র সেই স্বতন্ত্র রেখাও আল্লাহ্ কিয়ামতে পুনরুত্থানের সময় সৃষ্টি করতে সক্ষম এটি উল্লেখ করেছেন :
أَ يَحْسَبُ الْإِنْسَانُ أَ لَّنْ نَّجْمَعَ عِظَامَهُ بَلَى قَادِرِيْنَ عَلَى أَنْ نُّسَوِّيَ بَنَانَهُ
‘মানুষ কি মনে করে যে,আমি তার অস্থিসমূহ একত্র করতে পারব না? বস্তুত আমি তার আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।’৩১
পবিত্র কুরআনে যুক্তি প্রদর্শনের নমুনা
পবিত্র কুরআন থেকেই আমরা জেনেছি যে,নবী-রাসূলগণ মানুষকে হেদায়েত করার জন্য বারবার বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করতে বলেছেন। কীভাবে জ্ঞান-বুদ্ধি ব্যবহার করে যুক্তি প্রদর্শন করতে হয় তার শিক্ষাও তাঁদের জীবনী থেকে পাওয়া যায়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল নমরুদের মোকাবিলায় ইবরাহীম (আ.)-এর যুক্তি প্রদর্শনের ঘটনা।
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْ حَاجَّ إِبْرَاهِيْمَ فِيْ رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيِي وَ يُمِيْتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَ أُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ فَإِنَّ اللهَ يَاْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ...
‘তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখনি,যে ইবরাহীমের সাথে তার প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল,যেহেতু আল্লাহ্ তাকে কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন। যখন ইবরাহীম বলল,‘তিনি আমার প্রতিপালক যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান’,সে বলল,‘আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই’। ইবরাহীম বলল,‘আল্লাহ্ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করান,তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদয় করাও তো...।’৩২
প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে নমরুদের জীবন দান ও মৃত্যু ঘটানোর বিষয়টি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যখন নমরুদের সাথে বিতর্কের এক পর্যায়ে ইবরাহীম (আ.) এ যুক্তি প্রদর্শন করেন যে,‘আমার প্রতিপালক জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান’,তখন নমরুদও দাবি করে যে,সেও জীবন দান করে ও মৃত্যু ঘটায়। এর প্রমাণ হিসাবে সে এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরে এনে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। জল্লাদ এ হুকুম তাৎক্ষণিকভাবে পালন করে। এরপর সে একজন মৃত্যু দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অপরাধীকে জেলখানা থেকে ডেকে এনে মুক্ত করে দেয়ার আদেশ দেয়।৩৩
ইবরাহীম (আ.) বুঝতে পারলেন যে,নমরুদ জনসাধারণকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে এবং এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বোঝানোর মত পরিস্থিতিও নেই,তাই তিনি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে এমন এক প্রসঙ্গের অবতারণা করেন যাতে নমরুদ কোনরকম ভুল ব্যাখ্যা করার সুযোগ না পায়। তিনি বলেন : ‘আমার প্রতিপালক সূর্য পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন,তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদয় কর’। আর এ যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি নমরুদকে হতবুদ্ধি করে দেন।
ভিন্ন ভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের উপাস্যের উপাসনাকারীদের নিকট ইবরাহীম (আ.) যে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন সেসবও অতুলনীয়।
فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ الَّيْلُ رَأَ كَوْكَبًا قَالَ هٰذَا رَبِّيْ فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَا أُحِبُّ الْآفِلِيْنَ فَلَمَّا رَأَ الْقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هذَا رَبِّيْ فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِنْ لَّمْ يَهْدِنِيْ رَبِّيْ لَأَكُوْنَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّيْنَ فَلَمَّا رَأَ الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هٰذَا رَبِّيْ هذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَاقَوْمِ إِنِّيْ بَرِئٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ
‘অতঃপর রাত্রির অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল তখন সে নক্ষত্র দেখে বলল,‘এটাই আমার প্রতিপালক।’ অতঃপর যখন তা অস্তমিত হল তখন সে বলল,‘যা অস্তমিত হয় তা আমি পছন্দ করি না।’ অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখল তখন বলল,‘এটা আমার প্রতিপালক।’ যখন এটাও অস্তমিত হল তখন বলল,‘আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ অতঃপর যখন সে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হতে দেখল তখন বলল,‘এটা আমার প্রতিপালক,এটা সর্ববৃহৎ।’ যখন এটাও অস্তমিত হল,তখন সে বলল,‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর,তার সাথে আমার কোন সংশ্রব নেই।’৩৪
এখানে অনেক সময় ভুল বোঝার অবকাশ রয়ে যায় যে,ইবরাহীম (আ.) বোধ হয় সত্যিসত্যি এগুলোকে তাঁর প্রতিপালক মনে করেছিলেন এবং পরে তাঁর বিবেকের কাছে প্রমাণ হয়েছে যে,এরা তাঁর প্রতিপালক হতে পারে না। বিষয়টি এমন নয়। বরং তিনি গ্রহ-নক্ষত্রের পূজারীদের কাছে এসব উপাস্যের দুর্বলতা প্রকাশ করার জন্যই এমনভাবে যুক্তি প্রয়োগ করেছেন যাতে তা তাদের বিবেককে নাড়া দিতে সক্ষম হয়।
পবিত্র কুরআনের সূরা আনআমের ৮৩ নং আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে :
وَ تِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيْمَ عَلَى قَوْمِهِ...
‘আর এটা আমার যুক্তি-প্রমাণ যা ইবরাহীমকে দিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের মোকাবিলায়...।’
পবিত্র কুরআনে কাফির মুশরিকদের মূর্তির অক্ষমতা বুঝানোর জন্য ইবরাহীম (আ.) যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন সে সম্পর্কে বলা হয়েছে :
فَجَعَلَهُمْ جُذَاذًا إِلَّا كَبِيْرًا لَّهُمْ لَعَلَّهُمْ إِلَيْهِ يَرْجِعُوْنَ قَالُوْا مَنْ فَعَلَ هٰذَا بِآلِهَتِنَا إِنَّهُ لَمِنَ الظَّالِمِيْنَ
‘অতঃপর সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল মূর্তিগুলোকে তাদের প্রধান ব্যতীত; যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। তারা বলল,‘আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এরূপ করল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালঙ্ঘনকারী।’৩৫
এরপর বলা হয়েছে :
قَالُوْا ءَأَنْتَ فَعَلْتَ هٰذَا بِآلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيْمُ قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيْرُهُمْ هٰذَا فَسْئَلُوهُمْ إِنْ كَانُوْا يَنْطِقُوْنَ فَرَجَعُوْا إِلَى أَنْفُسِهِمْ فَقَالُوْا إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّالِمُوْنَ ثُمَّ نُكِسُوْا عَلَى رُءُوسِهِمْ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلَاءِ يَنْطِقُوْنَ قَالَ أَفَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَّ لَا يَضُرُّكُمْ أُفٍّ لَّكُمْ وَ لِمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَفَلَا تَعْقِلُوْنَ
‘তারা বলল,‘হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এরূপ করেছ?’ সে বলল,‘বরং এদের এই প্রধান,সে-ই তো এটা করেছে,এদেরকে জিজ্ঞাসা কর,যদি এরা কথা বলতে পারে।’ তখন তারা মনে মনে চিন্তা করে দেখল এবং একে অপরকে বলতে লাগল,‘তোমরাই তো সীমালঙ্ঘনকারী।’ অতঃপর তাদের মাথা অবনত হয়ে গেল এবং তারা বলল,‘তুমি তো জানই যে,এরা কথা বলে না।’ ইবরাহীম বলল,‘তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না,ক্ষতিও করতে পারে না। ধিক্ তোমাদেরকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদেরকে। তুবও কি তোমরা বুঝবে না?’৩৬
কত চমৎকারভাবে জ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন ইবরাহীম (আ.)। আমাদের তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে হয়।
উপসংহার
ইসলাম জ্ঞানের ধর্ম। ইসলাম যুক্তির ধর্ম। তাই ইসলামের প্রচার কাজও হতে হবে যুক্তিভিত্তিক। আমরা যখন কোন অমুসলিমের কাছে ইসলাম ধর্মকে উপস্থাপন করব তখন অবশ্যই যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে এ ধর্মের সত্যতা তুলে ধরতে হবে। একইভাবে অন্যান্য ধর্মের অসারতাও যুক্তির ভিত্তিতেই প্রমাণ করতে হবে। কুরআন যে সর্বশেষ ঐশী ধর্মগ্রন্থ তা প্রমাণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যে সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং তাঁর প্রচারিত ধর্ম যে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম তাও প্রমাণ করতে হবে। তার কাছে পবিত্র কুরআনের এ দলিল উপস্থাপন করা অর্থহীন যে,যেহেতু মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে বলেছেন পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে গেছে,তাই সেসব ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে। বরং এ পুরো প্রক্রিয়ার জন্য স্বতঃসিদ্ধ যুক্তিবুদ্ধির ব্যবহার অপরিহার্য; অন্যথায় ইসলাম ধর্মে অবিশ্বাসীদের নিকট তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়বে।
আবার একইভাবে নাস্তিকের কাছে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হবে। ধর্মবিরোধীরা ধর্ম সম্পর্কে যে সব আপত্তি উত্থাপন করে তার যৌক্তিক জবাব প্রদান করতে হবে। ধর্মহীনতা মানব জীবনে কী ক্ষতিকর প্রভাব রাখে তা ব্যাখ্যা করতে হবে। ধর্মীয় জীবন যাপন মানব সমাজের জন্য যে সব কল্যাণকর ভূমিকা রাখতে পারে সেগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে। অর্থাৎ জ্ঞানের বিকল্প কোন কিছুই এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। তাই ধর্মকে যথাযথভাবে প্রত্যেকের কাছে উপস্থাপন করতে হবে যেমনটি পবিত্র কুরআনও নির্দেশ দিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে মহান আল্লাহ্ প্রজ্ঞাসহকারে মানুষকে ধর্মের দিকে আহ্বান করতে বলেছেন :
أُدْعُ إِلَى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَ الْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَ جَادِلْهُمْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ
‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত (প্রজ্ঞা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’৩৭
এতো অমুসলিম ও নাস্তিকদের প্রসঙ্গ। কিন্তু একজন মুসলমানের কাছেও সবকিছু উপস্থাপন করতে হবে যুক্তি দিয়ে। কোন মুসলমান যে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে- সেটা হতে পারে আল্লাহ্ সম্পর্কে,হতে পারে নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে অথবা ইসলাম ধর্মের কোন বিধান সম্পর্কে,যেমন উত্তরাধিকার আইন,পুরুষের একের অধিক বিবাহের বিষয় ইত্যাদি।
যদি যথোপযুক্ত জবাব দানের মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করা না যায় তবে হয়তো সে তা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে না। যখন সে সঠিক জবাব পেতে ব্যর্থ হবে তখন সে ধর্মের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। ইসলাম ধর্মের প্রতি তার সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। সে মনে করতে পারে যে,এটি জবর-দস্তিমূলক কোন ধর্ম যেখানে যুক্তিকে অগ্রাহ্য করা হয়,যে ধর্ম জ্ঞানের পরিবর্তে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয় অথবা এটি অজ্ঞ ও অন্ধ অনুসারীদের ধর্ম।
মানুষের মধ্যে যে সহজাত সত্যাণ্বেষী মনোবৃত্তি রয়েছে তা অবশ্যই পরিতৃপ্ত করতে হবে। মানুষের মনে প্রশ্ন আসবেই। তাকে ধমক দিয়ে অথবা যেন-তেনভাবে বুঝিয়ে দাবিয়ে রাখা উচিত নয়,বিশেষ করে বর্তমান নাস্তিকতাপূর্ণ পরিবেশে যেখানে ধর্মের বাঁধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে।
মুসলমানদের মধ্যেও নানা মত ও পথের বিভাজন রয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই সকলের মধ্যেই নিজেকে সঠিক দাবি করার ব্যাপারটি ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রেও সকল মুসলমানের জন্য পবিত্র কুরআনে যে বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে সেই বিবেক-বুদ্ধিরই আশ্রয় নেওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যজনক যে,কেউ কেউ এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে নিষেধ করে থাকেন অথবা নিরুৎসাহিত করেন। যেন তাঁরা কুরআনের নির্দেশনার বিপরীতে আশংকা করেন যে,বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার তাঁদেরকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলতে পারে। আসলে হয় তাঁরা নিজেদের জ্ঞানের স্বল্পতা হেতু এ ধরনের অমূলক আশংকায় ভোগেন অথবা কোন বিষয়ের প্রতি অন্ধ ভাললাগা বা আনুগত্য এ ধরনের একপেশে অযৌক্তিক মত প্রকাশ করতে তাঁদের বাধ্য করে।
প্রশ্ন করা যেতে পারে যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যুগের মানুষের সাথে আজকের যুগের মানুষের কী পার্থক্য? রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওপর যে ওহী নাযিল হয়েছিল এবং যা তিনি তাঁর যুগের মানুষের কাছে সরাসরি মৌখিকভাবে উপস্থাপন করেছেন সে কথাই লিখিত আকারে কুরআন রূপে আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। যদি চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে পবিত্র কুরআন বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহারের কথা বলে থাকে,তবে আজ কি তার আবেদন নিঃশেষ হয়ে গেছে? কুরআন কি কেবলই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যুগের জন্য এসেছিল? এর আহ্বান কি কেবল সেই সময়ের মানুষের জন্য ছিল?
প্রকৃতপক্ষে পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালালেই মানুষ মহান আল্লাহ্কে চিনতে পারবে,নবী-রাসূলগণকে চিনতে পারবে,জীবনকে কীভাবে গঠন করবে তার দিক নির্দেশনা পাবে,পার্থিব ও পরকালীন জীবনের মুক্তির দিশা পাবে। যদি বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগানো না হয়,যদি কুরআন নিয়ে গবেষণা না করা হয়,তা হলে না আল্লাহকে চেনা সম্ভব,না নবী-রাসূলগণকে। মানুষ যেমন পার্থিব জীবনের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে,তেমনি পরকালীন অনন্ত জীবনের কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত হবে।
আর যদি আল্লাহ্কে চেনা সম্ভব না হয়,তাঁর রাসূল (সা.)-কে চেনা সম্ভব না হয় তাহলে মানুষ নিজেরা যেমন পথভ্রষ্ট হবে,তেমনি অন্যদেরও পথভ্রষ্টতার দিকে ঠেলে দেবে। মক্কার কাফেররা যেমন (নাউযুবিল্লাহ) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কবি,যাদুকর,পাগল বলেছিল,অনেক প্রাচ্যবিদ বিধর্মী লেখক যেমন রাসূলকে মৃগী রুগী,নারীলিপ্সু,যুদ্ধবাজ বলেছে,মুসলমানরাও তেমনি রাসূলকে (নাউযুবিল্লাহ্) ভুল-ভ্রান্তির শিকার হওয়া,ধর্মীয় বিধানের ব্যাপারে উদাসীন হওয়া অথবা অন্য কোন দোষে দোষী সাব্যস্ত করবে এবং দুঃখজনকভাবে সত্য হল এটিই যে,আজ মুসলমানদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সঠিক পরিচয় লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মর্যাদার পরিপন্থী অসংখ্য হাদিসকে অবলীলায় সত্য বলে গ্রহণ করেছে। শুধু তা-ই নয়,প্রতিটি অসত্য হাদিসকে সত্য প্রমাণ করার জন্য নানারূপ অপব্যাখ্যারও আশ্রয় নিয়েছে।
যা হোক পার্থিব যে কোন কিছুকে মানুষ বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করে থাকে। পার্থিব জীবনের নানা কাজ,যেমন পড়ালেখা,জীবিকার ব্যবস্থা করা,বিবাহ,সন্তান গ্রহণ,বাসস্থান তৈরি ইত্যাদি কাজে মানুষ জ্ঞান-বুদ্ধির যথোপযুক্ত ব্যবহার করার চেষ্টা করে। আর এর সবই করছে পৃথিবীতে মাত্র কয়েক বছরের জীবনকে আরামপ্রদ করার জন্য। অথচ মৃত্যুর পর যে জীবন রয়েছে,সে জীবনের ব্যাপারে বিশ্বাস থাকার পরও সে জীবনকে সুখময় করার জন্য মুসলমানদের মধ্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টার ঘাটতি চরম মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুর পরের এ জীবনকে সুখময় করার জন্য একমাত্র পথই হল জ্ঞান-বুদ্ধির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সত্যপথ খুঁজে নিয়ে সে পথের অনুসরণ। যদি মৃত্যু-পরবর্তী অনন্তকালের জীবনকে সুখময় করার জন্য জ্ঞানের ব্যবহার করা না হয় তবে কি মহান আল্লাহ কেবল এ ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনে ব্যবহারের জন্যই মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন?
সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করা ছাড়া আর কোন পথ আছে কি? আর যদি বিষয়টি এমন হয় যে,সকলেই পূর্বপুরুষদের অথবা অন্যান্যের দোহাই দেবে যে,আমি তাঁদের যে পথের ওপর পেয়েছি সে পথই অনুসরণ করেছি,এ ছাড়া আমার আর কোন পথ ছিল না। এটা কি নবী-রাসূলগণের যুগের সেই মূর্তিপূজকদের কথা নয় যারা পূর্বপুরুষদের দোহাই দিত? পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে কাফেরদের কথা বার বার বলা হয়েছে যারা পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে রাসূলগণের আনুগত্য করতে অস্বীকার করেছিল।
হযরত সালেহ (আ.)-এর জাতি তাঁকে বলেছিল :
...أَتَنْهَانَا أَنْ نَّعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا...
...‘তুমি কি আমাদেরকে তাদের ইবাদত করতে নিষেধ করছ,আমাদের পিতৃপুরুষরা যাদের ইবাদত করত?’...৩৮
হযরত শুয়াইব (আ.)-এর জাতি এ ব্যাপারে বলেছিল :
...يَا شُعَيْبُ أَصَلَوتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَّتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا أَوْ أَنْ نَّفْعَلَ فِيْ أَمْوَالِنَا مَا نَشَاؤُا
...‘হে শুয়াইব! তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে,আমাদের পিতৃপুরুষরা যার ইবাদত করত আমাদেরকে তা বর্জন করতে হবে অথবা আমরা আমাদের ধনসম্পদ সম্পর্কে যা করি তাও?’৩৯
হযরত মূসা (আ.)-এর জাতি বলেছিল :
أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ أبَاءَنَا
‘আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যাতে পেয়েছি তুমি কি তা থেকে আমাদেরকে বিচ্যুত করার জন্য আমাদের নিকট এসেছ?’৪০
একইভাবে রাসূল (সা.)-কেও কাফেররা একই কথা বলেছিল যা পবিত্র কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে :
وَ إِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءُنَا أَوَ لَوْ كَانَ آبَاؤًهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَّ لَا يَهْتَدُوْنَ
‘যখন তাদেরকে বলা হয়,‘আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তা তোমরা অনুসরণ কর’,তারা বলে,‘না,বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যাতে পেয়েছি তার অনুসরণ করব। এমনকি,তাদের পিতৃপুরুষরা যদিও কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎ পথেও পরিচালিত ছিল না,তথাপি।’৪১
তা হলে কী পার্থক্য সেদিনের সেই কাফেরদের সাথে আমাদের? আজকের বিধর্মীদের তবে কী দোষ যে,তারা তাদের ধর্ম ত্যাগ করবে? তারাও তো তাদের পিতৃপুরুষদের তাদের ধর্মের ওপর পেয়েছে। তাই আবার বলতে হয় পবিত্র কুরআনের আবেদন কি তবে নিঃশেষ হয়ে গেছে?
পবিত্র কুরআনের এ আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থের দিকে অবশ্যই মুসলমানদের গভীর মনোযোগ দিতে হবে :
وَ لَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إلَّا عَلَيْهَا وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى...
‘প্রত্যেকে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী। কেউ বহন করবে না অন্যের বোঝা।’...৪২
তাই প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্যকর্তব্য হল মহান আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ মান্য করা। সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজের আকীদা নির্ধারণ করা। আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে বিচারবুদ্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলগণের পরিচয় লাভ করা এবং কুরআন ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নির্দেশিত সঠিক পথ বেছে নিয়ে সে অনুযায়ী জীবন যাপন করে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির ব্যবস্থা করা। যারা এ কাজ করতে পারবে তারাই মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে বুদ্ধিমান। কারণ,মহান আল্লাহ্ বলছেন :
الَّذِيْنَ يَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُوْنَ أَحْسَنَهُ أُولَائِكَ الَّذِيْنَ هَدٰهُمْ اللهُ وَ أُولَائِكَ هُمْ أُولُوا الْأَلْبَابِ
‘যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং তার মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে। তাদেরকে আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তারাই বোধশক্তিসম্পন্ন।’৪৩
আর মহান আল্লাহ্ তো পবিত্র কুরআনে ওয়াদা করেছেন যে,যাঁরা এজন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা করবেন তাঁদের তিনি নিজেই পথ প্রদর্শন করবেন :
وَ الَّذِيْنَ جَاهَدُوا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا...
‘যারা আমাদের উদ্দেশ্যে কঠোর চেষ্টা করে,আমরা তাদের অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব...।’৪৪
তথ্যসূত্র :
১. সূরা যুমার : ৯
২. সূরা আলাক : ১-৫
৩. ইবনে মাজাহ,১ম খণ্ড,হাদীস নং ২২৪,আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত
৪. সূরা ইবরাহীম : ২৫
৫. সূরা রাদ : ১৬
৬.সূরা আনফাল : ২২
৭. সূরা বনি ইসরাইল : ৭২
৮. সূরা আরাফ : ১৭৯
৯. সূরা হাজ্ব : ৪৬
১০. সূরা তূর : ৩৫
১১. সূরা গাশিয়াহ্ : ১৭-২০
১২. সূরা বাকারা : ১৬৪
১৩. সূরা বনি ইসরাইল : ৪২
১৪. সূরা আম্বিয়া : ২২
১৫. সূরা ফাতির : ২৪
১৬. সূরা রাদ : ৭
১৭. সূরা নিসা : ১৬৫
১৮. সূরা হুদ : ২৫
১৯. সূরা হুদ : ৯৬
২০. সূরা ত্বহা : ৬১-৭৩
২১. সূরা তূর : ৩৪
২২. সূরা হুদ : ১৩
২৩. সূরা বাকারা : ২৩
২৪. সূরা ইউনূস : ৩৮
২৫. বনি ইসরাইল : ৮৮
২৬. সূরা বাকারা : ২৪
২৭. সূরা নিসা : ৮২
২৮. সূরা বনি ইসরাইল : ৫১
২৯. সূরা রূম : ৫০
৩০. সূরা মারইয়াম : ৬৬-৬৭
৩১. সূরা কিয়ামাহ : ৩-৪
৩২. সূরা বাকারা : ২৫৮
৩৩. কাছাছুল কোরআন,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৪,এমদাদিয়া লাইব্রেরী,ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত
৩৪. সূরা আনআম : ৭৬-৭৮
৩৫. সূরা আম্বিয়া : ৫৮-৫৯
৩৬. সূরা আম্বিয়া : ৬২-৬৭
৩৭. সূরা নাহল : ১২৫
৩৮. সূরা হুদ : ৬২
৩৯. সূরা হুদ : ৮৭
৪০. সূরা ইউনূস : ৭৮
৪১. সূরা বাকারা : ১৭০
৪২. সূরা আনআম : ১৬৪
৪৩. সূরা যুমার : ১৮
৪৪. সূরা আনকাবুত : ৬৯
সূত্র:প্রত্যাশা,১ম বর্ষ,২য় সংখ্যা।