রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ততা প্রসঙ্গে
সেই আদিকাল থেকেই শিয়া-সুন্নী বিতর্ক চলছে এবং সেই সাথে চলছে এর বিভিন্ন শাখা-প্রমাখাগত দিক নিয়ে বিতর্ক। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, শাখা-প্রশাখা নিয়ে বিতর্ক করে কোনো সমাধানে পৌঁছা যাবে না, তাই মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। আর আলোচনা ও অনুসন্ধান করতে হবে কেবল সত্যে উপনীত হওয়ার নিয়্যতে ইখ্লাছের সাথে। এর ভিত্তিতে আমি এমন একটি আবেদন করতে চাই যা সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মতো। তা হচ্ছে,
ইসলামের মৌলিক উপস্থাপনাগুলোকে অর্থাৎ তাওহীদ, আখেরাত, নবুওয়াতের প্রয়োজনীয়তা এবং নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ), খাতমে নেবুওয়াত ও কোরআন মজীদের সত্যতাকে বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্)-এর সাহায্যে নতুন করে বুঝতে হবে ঠিক যেভাবে একজন অমুসলিম বিচারবুদ্ধির সাহায্যে বুঝে এগুলোর ওপর ঈমান আনে।
এরপর কোরআনকে পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, অবশ্য কোরআন থেকে সঠিক তাৎপর্য গ্রহণের জন্য আরবী ভাষার জ্ঞান সহ বিভিন্ন পূর্বপ্রস্তুতি অর্জন করতে হবে এবং সেই সাথে ‘আক্বল্-এর সাহায্য নিতে হবে। কোরআনেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্নের জবাব আছে; আমরা কোরআন-চর্চা কম করি বলে অনেক প্রশ্নের জবাব পাই না।
মুসলমান হওয়ার জন্য কোরআনে ঈমান থাকা অপরিহার্য, অন্য কোনো গ্রন্থে বা অন্য কোনো তথ্যসূত্রে ঈমান থাকা শর্ত নয়। তাছাড়া আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআনকে হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, অন্য কোনো গ্রন্থকে হেফাযতের দায়িত্ব নেন নি। বিশেষ করে হাদীছ গ্রন্থসমূহ অনেক পরে সংকলিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর যে কোনো কথাই ওয়াহী (ওয়াহীয়ে মাত্লু‘ বা গ্বায়রে মাৎলূ‘), তাই তাতে সন্দেহ করলে ঈমান থাকে না। কিন্তু অনেক পরে সংকলিত হাদীছ সমূহের মধ্যে এমন অনেক হাদীছ থাকা স্বাভাবিক যেগুলো রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর নামে তৈরী করা হয়েছে।
আমি হাদীছ ও তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না, বরং বলতে চাই যে, হাদীছ বিস্তারিত বিধি-বিধান ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, তা ‘আক্ব্ল্ বা কোরআনের সাথে সাংঘর্ক হবে না। এই সাথে যোগ করতে চাই যে, যে সব হাদীছ ছ্বাহাবী থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে এতো বেশী সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, সেগুলোর সত্য হওয়ার ব্যাপারে ‘আক্বল্ সন্দেহ পোষণ করে না (মুতাওয়াতির হাদীছ) সেগুলো অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং যে সব কাজ ইসলামের প্রথম যুগ থেকে মুসলমানরা করে এসেছেন (যেমন, কবরবাসীদেরকে সম্বোধন করে সালাম দেয়া) সেগুলোও অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
অতএব, কম সূত্রে বর্ণিত হাদীছ (খবরে ওয়াহেদ্) কেবল এ চার সূত্রের কোনোটির সাথেই সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য।
এবার আসুন, ইমামত ও খেলাফত প্রশ্নের জবাব সন্ধান করি।
আমি মনে করি, কেউ যদি অন্যান্য তথ্যসূত্রের ওপর বা তার ব্যাখ্যার বা প্রয়োগের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন তো কোরআন মজীদই এ প্রশ্নের জবাবের জন্য যথেষ্ট। আয়াতে তাৎহীরে (সূরাহ্ আল্-আহযাব - ৩৩) আল্লাহ্ তা‘আলা আহলে বাইতকে পবিত্রকরণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন যা অন্য কোনো ছ্বাহাবীর জন্য করেন নি, আর সর্বসম্মত মত অনুযায়ী আহলে বাইত্ হচ্ছেন ফাতেমাহ্, ‘আলী, হাসান ও হুসাইন্ (‘আ)। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও সতর্কতার নীতির দাবী অনুযায়ী মুসলমানদের জন্য স্বীয় দ্বীন ও ঈমানকে হেফাযতের লক্ষ্যে আহলে বাইত্-এর সদস্যদেরকেই পর্যায়ক্রমে খলীফাহ্ মেনে নেয়া উচিত ছিলো। কারণ, কোরআন মজীদে যার পবিত্রতা তথা নিষ্পাপত্বের কথা উল্লেখ করা হয় নি এমন কারো আনুগত্য ছিলো ঝুঁকিবহুল। আর ইসলামের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এ ঝুঁকিবহুল কাজের পরিণাম ইসলাম ও মুসলমানের জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়েছিলো।
অবশ্য যারা এ ঝুঁকিবহুল কাজ করেছিলেন তাঁরা কি ঐ আয়াতের সাথে পরিচিত না থাকার কারণে বা তার প্রয়োগক্ষেত্র সঠিকভাবে বুঝতে না পারার কারণে করেছিলেন, নাকি বুঝতে পেরেও ভুল কাজটি করেছিলেন এ বিষয়টি আল্লাহর ওপর সোপর্দ। তাঁদের ভুল কাজকে সঠিক প্রমাণ করার কোনো দায়িত্ব আমাদের নেই। আর আল্লাহ্ তালা তাঁদের কাজের হিসাব নেয়ার সময় এটা দেখবেন না যে, আমাদের মধ্যে কতো জন তাঁদেরকে ভালো বলেছি ও কতো জন তাঁদেরকে মন্দ বলেছি।
এখানে আরো একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ণ করতে চাই। তা হচ্ছে হানাফী মায্হাবে (আহলে সুন্নাতের মধ্যে ও বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে যার অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) নামাযে যে দরূদে ইবরাহীমী পাঠ করা হয় তাতে আালে মুহাম্মাদের (ছ্বাঃ) ওপর দরূদ পড়া হয়, অন্য কোনো ছ্বাহাবীর ওপর পড়া হয় না এবং এ দরূদে তাঁদেরকে আালে ইবরাহীমের সাথে তুলনা করা হয়েছে, আর আালে ইবরাহীম বলতে হযরত ইবরাহীম (‘আঃ)-এর বংশে আগত নবী-রাসূলগণকে বুঝানো হয়েছে (কারণ, আল্লাহ্ ইমামতের প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে বলেছেন, লা ইয়ানালু ‘আহদিয্ যালেমীন -- আমার প্রতিশ্রুতি যালেম বা গুনাহ্গারদের জন্য নয়)। অর্থাৎ দরূদে ইবরাহীমীতে আালে মুহাম্মাদকে ইবরাহীমের (‘আঃ) বংশের নবীদের অনুরূপ মর্যাদা দেয়া হয়েছে, যদিও তাঁরা নবী ছিলেন না। এমতাবস্থায় তাঁদেরকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে অনুসরণ করা যেতে পারে না।
অতএব, আসুন, শিয়া-সুন্নী বিতর্ক ও শাখা-প্রশাখাগত বিতর্ক পরিহার করে উপরোক্ত চার অকাট্য সূত্রের ও আহলে বাইতের অনুসরণ করি এবং অন্য সমস্ত সূত্রকে ও অন্য সমস্ত ব্যক্তিকে উপরোক্ত চার অকাট্য সূত্র ও আহলে বাইতের মানদণ্ডে যাচাই করে গ্রহণ-বর্জন করি। (লিখেছেন: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবীদ জনাব নূর হোসেন মজিদী)