বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে পুনরুত্থান
মানবদেহ কাদামাটি দিয়ে গঠিত এবং পরিবর্তন ও রূপান্তরের ঘূর্ণাবর্তে তা আবার মাটিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ মূল আকৃতিতে ফিরে আসে। এর কারণ মানবদেহের অভ্যন্তরে পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মতো একটি উপযুক্ততা বিদ্যমান, কিন্তু এর অস্তিত্বের সারবস্তু এসব পরিবর্তনের ফলে কখনই অনস্তিত্বের দিকে চালিত হয় না। অন্যসব শরীরের মতো তা তার মূল বস্তুকে কোন রকম পরিত্যাগ না করেই কেবল তার গঠনের বিশেষ প্রকৃতি হারায় মাত্র।
অনুরূপভাবে, মানুষের মৃত ও জীবনহীন আকৃতি অভ্যন্তরীণ ও বাইরের উপাদানের কর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটিতে রূপান্তরিত হয়, কোন না কোনভাবে সকল সময়েই তা নতুন আকৃতি গ্রহণ করে। যেমন, যেখানে কোন ব্যক্তিকে দাফন করা হয় কালক্রমে সেই মাটিতে একটি গাছ জন্ম নিতে পারে এবং কোন প্রাণী তা খেয়েও ফেলতে পারে, তাতে ঐ প্রাণীর বিকাশে সহায়তা হয়। যে বস্তু নিয়ে মানবদেহ গঠিত তার মধ্যে এভাবেই বিভিন্নতা প্রবর্তিত হয়েছে, কিন্তু যত পরিবর্তনই সাধিত হোক না কেন, মানব দেহের সার ও মর্মবস্তু অটুট ও অবিনাশী থেকে যায়।
আমাদের যাবতীয় ভালো বা মন্দ কর্মের শক্তি দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন রূপও অনুরূপ স্থিতি ও স্থায়িত্ব পেয়েছে; সেগুলো আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণের উপাদান হিসাবে বিশ্ব সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত থাকে, হতে পারে তা ভালো অথবা খারাপ, চিরন্তন সুখোপযোগী বা স্থায়ী যন্ত্রণার উৎস। আমরা আমাদের কর্মের পরিণতির কাছে সমর্পিত হতে বাধ্য।
অতীতের মানব সমাজ কথা বলার মাধ্যমে শব্দের যে প্রবাহ সৃষ্টি করেছে তা ধারণ করতে গবেষকদের প্রচেষ্টা কিছুটা সফল হয়েছে; বিশেষ যন্ত্র-সরঞ্জামের সাহায্যে তারা সীমিত পরিমাণে যন্ত্রের প্রস্তুতকারকদের বলা কথার শব্দ প্রবাহ পুনঃধারণ করেছে ঐ সব যন্ত্র-সরঞ্জামের ওপরে হাতের ছাপে বিকিরণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে।
তাদের মধ্যকার এই বৈজ্ঞানিক কর্ম সম্পাদন পুনরুত্থানের বাস্তবতারই একটি ইঙ্গিত; তারা একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে যা প্রতিবিম্বের সাথে মিলিত হয়ে আমাদেরকে পুনরুত্থান বুঝতে এবং তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পেতে সহায়তা করবে।
সবকিছু বাদ দিয়েও আমরা এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা কেন মানুষের গঠনাকৃতি পুনরায় দিতে সক্ষম হবেন না? যা অস্তিত্ব লাভ করেছিল মাটির বিক্ষিপ্ত কণা একত্র হয়ে এবং ঐ অস্তিত্বই পরে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বারবার আলোকপাত করা হয়েছে। যেমন : ‘মৃত্তিকা হতে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেব এবং তা হতে পুনর্বার তোমাদেরকে বের করব।’ (সূরা ত্বাহা : ৫৫)
এই আয়াতে স্রষ্টার সৃষ্টিশীল ক্ষমতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। একটি একক দৃশ্যপটে মানুষের অতীত ও ভবিষ্যতকে উপস্থাপন করার মাধ্যমে মানুষের অস্থির ও সন্দেহপ্রবণ আত্মাকে সান্তনা ও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর মধ্যেই মানুষ নিঃশেষিত হয়ে যায়- এই চিন্তাধারা অযৌক্তিক বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং বলতে গেলে মানুষের এই পরিবর্তন ও রূপান্তরের লক্ষ্যহীনতা অসম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এই পৃথিবীর সংকীর্ণ পরিমণ্ডলে জীবন তার সৃষ্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য তুলে ধরার জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। আমরা যদি সৃষ্টির পুরো চিত্র বিবেচনায় রাখি, তাহলে দেখতে পাব যে, এই স্বল্প পরিসর ক্ষেত্র জীবনের উন্মুক্ত উৎসের বিবেচনায় একেবারেই মূল্যহীন।
যেসব অবিশ্বাসী লোক ধারণা করে যে, মানবদেহ মাটির মধ্যে রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বিলুপ্ত ও অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তা পুনরুত্থিত হতে পারে না তাদের উদ্দেশে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : “কিন্তু কাফেররা তাদের মধ্যে একজন সতর্ককারী আবির্ভূত হতে দেখে বিস্ময়বোধ করে ও বলে, ‘এ তো এক আশ্চর্য ব্যাপার। আমাদের মৃত্যু হলে এবং আমরা মাটিতে পরিণত হলে আমরা কি পুনরুত্থিত হব? সুদূর পরাহত সেই প্রত্যাবর্তন।’ আমি তো জানি মৃত্তিকা ক্ষয় করে তাদের কতটুকু এবং আমার নিকট আছে রক্ষিত ফলক।” (সূরা কাফ : ২-৪)
এই আয়াতগুলো উদ্ধৃত হয়েছে ঐ অবিশ্বাসী দলের উদ্দেশ্য যারা মৃত্যু-পরবর্তী পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে। এতে তাদেরকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা ভালোভাবেই জানেন যে, মানবদেহের উপাদানগুলো ছত্রভঙ্গ হওয়ার আগে এবং প্রকৃতির সংরক্ষণাগারে ফিরে আসার পর কোথায় থাকে। তিনি ঐ উপাদানগুলো পুনঃসংযোজনের মাধ্যমে খুব সহজেই পুনরুত্থান ঘটাবেন। এভাবে একটি বিশেষ পন্থায় মানবদেহের পুরো পূর্বানুরূপ কাঠামো এবং সারবত্তা অনুসরণ করা হবে- যার ভিত্তিতে তা অস্তিত্ব লাভ করে ও টিকে থাকে।
মহানবী (সা.) যখন বিধর্মী আরবদের কাছে পুনরুত্থান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন তখন উবাই ইবনে খালাফ নামের এক বেদুইন দশককালের পুরানো একটি হাড় তুলে এনে মহানবী (সা.)-কে দেখানোর জন্য মদীনায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। পুনরুত্থান সম্পর্কিত মহানবী (সা.)-এর যুক্তি ও পবিত্র কুরআনের ঘোষণাকে নাকচ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং তার বক্তব্যের সপক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য যুক্তি মনে করে সে ঐ হাড়টি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এবং ধুলাবৎ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তা বাতাসে উড়িয়ে দেয়। পরে সে অজ্ঞানতা ও বিদ্রোহাত্মক মানসিকতাবশত মহানবী (সা.)-এর উদ্দেশে কর্কশ ও অশোভন ভাষায় বলে : ‘এই অপসৃয়মাণ হাড়ের অণুগুলোকে কে জীবনে ফিরিয়ে আনবে?’
ঐ বেদুইন মনে করেছিল এভাবে সে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সংক্রান্ত মহানবী (সা.)-এর যুক্তি এবং অন্যদের বিশ্বাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে। আর জাহেলি চিন্তাচেতনা তাকে জীবনের সৃষ্টি সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা গ্রহণ করতে বাধাগ্রস্ত করেছে, যার ফলে সে মনে করে যে, দশককালের পুরানো বিক্ষিপ্ত অণুগুলোকে পনুরায় জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সে অনমনীয়ভাবে এই ধারণা পোষণ করত যে, মানবদেহের অগণিত অণুকে পুনঃএকত্রীকরণের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
পবিত্র কুরআন অত্যন্ত যুক্তিভিত্তিক ও গ্রহণীয় বক্তব্য উপস্থাপন করে এর জবাব দিয়েছে : ‘(হে নবী!) বল, তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই যিনি এটা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’… যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মহাদ্রষ্টা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা ইয়াসীন : ৭৯ ও ৮১)
পবিত্র কুরআন মানুষকে তার জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে সুবিশাল গোটা সৃষ্টি কাঠামো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখার আহ্বান জানিয়েছে। কেননা, বিশ্ব সাম্রাজ্যের নীতি পদ্ধতিকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য মানুষের মাধ্যম তো এগুলোই। মানুষ এভাবে যদি দৃষ্টিপাত করে তাহলে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষে পুনরুত্থানের মাধ্যমে জীবন দানের কাজ প্রথমবার সৃষ্টির সময়কার চেয়ে অধিকতর কঠিন নয়। কেননা, প্রথমবার বিভিন্ন উপাদানকে একত্র করে সৃষ্টি করতে হয়েছে।
চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনা মানুষকে সঠিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়; এসবের মাধ্যমে একটি পদ্ধতি তৈরি হয় যার সাহায্যে মানুষ তার বসবাসস্থল পৃথিবী সম্পর্কে একটি সঠিক ও সত্য জ্ঞান অর্জন করতে পারে। এছাড়া তারা একটি যৌক্তিক ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ ধারণা অর্জনও নিশ্চিত করতে পারে।
পবিত্র কুরআনে পুনরুত্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়েছে : ‘আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে, পুনরায় সৃষ্টির ব্যাপারে ওরা সন্দেহ পোষণ করবে।’ (সূরা কাফ : ১৫)
কুরআন মানুষকে এ কথা বুঝাতে চায় যে, মানুষের অনুধাবন ক্ষমতার বাইরে মৃত থেকে জীবনের পুনরুদ্ধার অসম্ভব মনে হতে পারে বটে, কিন্তু এই ধারণা অনেকটা সরাসরি খোদার অসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণ, যে খোদা প্রথম মানবদেহের অভ্যন্তরে জীবন ফুঁকে দিয়েছিলেন।
মানুষ নিজেই নিজেকে বুঝাতে পারে যে, মানবদেহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলো একবার মাটির অভ্যন্তরে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলে তাতে নতুন করে জীবন বায়ু ফুঁকে দেয়া যেতে পারে কীভাবে এবং গঠিত উপাদানগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর ঐ জীবনহীন বস্তুতে কীভাবে জীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
তবে এই বিক্ষিপ্ততা উপাদানগুলোর একটিকে অপরটি থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে না এবং মানুষের বুদ্ধিমত্তা ভালোভাবেই বুঝতে সক্ষম যে, আল্লাহ তাআলার অসীম ও চিরন্তন সৃষ্টিক্ষমতার পক্ষে ঐ বিক্ষিপ্ত উপাদানাগুলোকে নতুন করে একত্র করা কঠিন নয়।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নিম্নোক্ত ভাষায় মানুষকে তাদের বিক্ষিপ্ত অংশগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ ও যথাযথভাবে সকল সময়েই একত্র করার অসীম ও চূড়ান্ত খোদায়ী ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় : ‘মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্র করতে পারব না? বস্তুত আমি তার অঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।’ (সূরা কিয়ামা : ৩-৪)
আয়াত দুটিতে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর অবাধ ও অতুলনীয় ক্ষমতাবলে কেবল মৃত মানুষের অস্থিগুলোকেই একত্র করতে ও পুনরায় জীবন দান করতে সক্ষম তাই নয়; বরং তিনি তাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে পর্যন্ত একত্র করতে এবং তাদেরকে পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
সকল জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মানুষের জীবনকে পুনরুজ্জীবনের জন্য আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে শুরু করেন তখন তাঁর অসীম ক্ষমতা মানবদেহের সকল বৈশিষ্ট্য যথাযথভাবে ফিরিয়ে আনতে কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় না, অনুরূপ অক্লান্তভাবেই তিনি এই বিশাল জগতে প্রথম জীবনের প্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেন।
বুদ্ধিবৃত্তিক ও গবেষণামূলক সচেতনতা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আমরা জীবনে প্রবেশ করি এবং সকল রূপান্তরের মধ্যেও আমাদের শারীরিক গঠন, এমনকি হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। এসব হচ্ছে আমাদের শারীরিক অবস্থার অব্যাহত পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়।
যদি কোন দুর্ঘটনায় আমাদের হাতের চামড়া উঠে যায়, তাহলে একই বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেখানে নতুন চামড়া সৃষ্টি হয়। যারা বিশেষজ্ঞ তাঁরা ভালো করেই জানেন যে, আঙ্গুলের ছাপ হচ্ছে একজন অপরাধীর পরিচয় জানার সর্বোত্তম উপায়। আঙ্গুলের ছাপের এই অনন্য গুণ ও মানের কথা প্রথম উল্লিখিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। ১৯৮৪ সালে কতিপয় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কর্তৃক তা আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিষয়টি অনেকের কাছেই অজানা ছিল।
সত্য ও বাস্তবানুরাগী যে কোন ব্যক্তি এ কথা নির্দ্বিধায় অনুধাবনে সক্ষম হবেন যে, খোদার শক্তিশালী হাত এসব অত্যাশ্চর্য ঘটনা প্রকাশ করতে সদা সক্রিয়। কোন বুদ্ধিমান লোক একথা মেনে নেবেন না যে, কতিপয় অন্ধ যান্ত্রিক শক্তি মানুষের মতো আচারনিষ্ঠ ও বিস্ময়কর আকৃতি সৃষ্টি করতে পারে। (সূত্র: কাওসার বিডি)