ইহুদী জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ইহুদী জাতি নিজেদের আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত জাতি হিসাবে গণ্য করে,নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, অন্যান্য জাতিকে হীন বলে গণ্য করে । অথচ তাদের মধ্যে জগতের সকল নিকৃষ্ট ও জঘন্য কার্যকলাপ বিদ্যমান । তারা সেই আদিকাল থেকেই পৃথিবীর বুকে নানান অশান্তি, যুদ্ধ - বিগ্রহ বাধঁতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।
ইহুদী এমন একটি জাতি যাদের নামের সাথে জড়িয়ে আছে বহু সংখ্যক নবী ও রাসুল হত্যার ইতিহাস। তারা হযরত ইয়াহিয়া (আ.) কে হত্যা করেছিল, হযরত যাকারিয়া (আ.) কে করাত দিয়ে চিরে দুই টিকরা করে ফেলেছিল, ইউসুফ (আ.) কেও হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।
ইহুদীরা পবিত্র ও সতী-সাধ্বী নারী হযরত মরিয়ম (সা.)'র ওপর ব্যাভিচারের জঘন্য অপবাদ আরোপ করেছিল। তারা এ অপবাদ রটিয়ে হযরত ঈসা (আ.)কে মরিয়মের ব্যভিচারের ফসল হিসেবে তুলে ধরে এবং এর মাধ্যমে এটা দেখাতে চেয়েছে যে, ঈসা (আ.) নবী বা পথ-প্রদর্শক হওয়ার উপযুক্ত নন। আর এ অপবাদের ভিত্তিতেই ইহুদীরা ঈসা (আ.) কে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। তারা হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে এমন জঘন্য অপবাদ প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, এমনকি তাঁকে হত্যারও ষড়যন্ত্র করে। ইহুদী ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে হত্যা করতে পেরেছিল বলেও এক ধরনের ধাঁধা বা ভুল ধারণার শিকার হয়। আর ওই হত্যাকাণ্ডের ভিত্তিতে অত্যন্ত দম্ভ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তারা বলেছিল, আমরাই ঈসাকে হত্যা করেছি। কিন্তু মহান আল্লাহ কোরআনে বলছেন যে, আসলে তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল যে ছিল দেখতে ঈসার মত এবং তারা ধোঁকা বা সন্দেহের শিকার হয়েই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
সূরা নিসার ১৫৬ থেকে ১৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَبِكُفْرِهِمْ وَقَوْلِهِمْ عَلَى مَرْيَمَ بُهْتَانًا عَظِيمًا (১৫৬) وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا (১৫৭) بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا ((১৫৮
"আর তাদের কুফরী এবং মরিয়মের প্রতি মহা অপবাদ আরোপ করার কারণে (তারা আল্লাহর ক্রোধ বা অভিশাপের পাত্র হয়েছিল)।" (৪:১৫৬)
"আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধার শিকার হয়ে (দেখতে ঈসার মত এক ব্যক্তিকে হত্যা করে) ছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি।" (৪:১৫৭)
এ প্রবন্ধে হযরত মূসা (আ.)-এর যুগ থেকে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত ইহুদী জাতির একটি সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা সংক্ষিপ্তাকারে চিত্রিত হয়েছে । আমরা ‘নিকট প্রাচ্যের গীর্জাসমূহের সংঘ’ কর্তৃক প্রকাশিত পবিত্র বাইবেল বা ‘কিতাব-ই মুকাদ্দাসের অভিধান’ নামক গ্রন্থ এবং মরহুম মুহাম্মদ ইয্যাত দ্রুযেহ্ প্রণীত ‘ইহুদীদের গ্রন্থসমূহের ভিত্তিতে তাদের ইতিহাস’- এ দু’গ্রন্থের ভিত্তিতে আমরা তাদের এ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনা করেছি । এ দীর্ঘ সময়ে ইহুদী জাতির ইতিহাস দশ পর্যায়ে বিভক্ত । যথা-
১. হযরত মূসা (আ.) ও ইউশা (আ.)-এর যুগ ( খ্রি.পূ. ১২৭০-১১৩০)
২. বিচারকদের যুগ (খ্রি.পূ. ১১১০-১০২৫)
৩. হযরত দাউদ ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর যুগ (খ্রি.পূ. ১০২৫-৯৩১)
৪. অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ (খ্রি.পূ. ৯০১-৮৫৯)
৫. আশুরীয়দের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি.পূ. ৮৫৯-৬১১)
৬. ব্যাবিলনীয়দের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের যুগ (খ্রি.পূ. ৫৯৭-৬১১)
৭. ইরানীদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি. পূ. ৫৩৯-৩৩১)
৮. গ্রীকদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি.পূ. ৩৩১-৬৪)
৯. রোমীয়দের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি.পূ. ৬৪-৬১৮ খ্রি.)
১০. ইসলাম ও মুসলমানদের শাসন কর্তৃত্বের যুগ (খ্রি. ৬১৮-১৯২৫)
১. হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ইউশা (আ.) এর যুগ
হযরত মূসা (আ.) ১২০ বছর জীবিত ছিলেন । তিনি তাঁর জীবনের প্রায় প্রথম ৩০ বছর মিশরের ফিরআউনের প্রাসাদে এবং হযরত শুআইব (আ.)-এর কাছে ক্বাদাশ বারনী নামক স্থানে ১০ বছর অতিবাহিত করেছিলেন । উল্লেখ্য যে, এ স্থানটি ফিলিস্তিনের দিক থেকে সীনাই পর্বতের শেষ প্রান্তে আরাবাহ্ উপত্যকার অদূরে অবস্থিত ।
বর্তমান তাওরাতের সিফরে খুরুজ পুস্তিকার ১২তম অধ্যায়ের ৩৭ নং আয়াতে এবং সিফরে আদাদ-এর ৩৩তম অধ্যায়ের ৩৬ নং আয়াতে যে সব ইসরাইলীয় হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে হিজরত করেছিল তাদের সন্তানদেরকে বাদ দিয়ে তাদের সংখ্যা ছয় লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । তবে কতিপয় পাশ্চাত্য গবেষকের মতে, তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজার ।
ঐতিহাসিকগণ অধিকতর সম্ভাবনার ভিত্তিতে বলেছেন : খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতাব্দী আগে অর্থাৎ প্রায় খ্রি.পূ. ১২৩০ সালে ফিরআউন মিনফাতাহ্-এর আমলে ইসরাইলীরা মিশর ত্যাগ করেছিল ।
হযরত মূসা (আ.) কাদাশ পর্বতের কাছে মারা যান এবং তাঁর উত্তরাধিকারী ইউশা বিন নূন তাঁকে ঐ স্থানে দাফন করেন এবং তিনি তা গোপন রাখেন । হযরত মূসা (আ.) তাঁর জীবদ্দশায়, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও বনি ইসরাইলের কাছ থেকে বহু কষ্ট ও যাতনা পেয়েছিলেন । ইহুদীদের তাওরাতে তাঁর ও হযরত হারূন (আ.)-এর ব্যাপারে উল্লিখিত আছে যে, আল্লাহ্ মূসা (আ.)-কে বলেছিলেন : “যেমন করে তোমার ভাই হারূন হুর পর্বতে মৃত্যুবরণ করেছে ঠিক তেমনি তুমিও এ পর্বতে মৃত্যুবরণ করবে । কারণ তোমরা দু’জন সীনাই দেশে কাদাশ ভূ-খণ্ডের জলাভূমিতে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করনি আর এভাবে তোমরা দু’জন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ!! অতএব,তুমি যমীনকে ঠিক এর বিপরীত (দিক) থেকে দেখবে, অথচ যে ভূ-খণ্ড আমি বনি ইসরাইলকে প্রদান করেছি সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না ।”১
আরো বলা হয়েছে : ইউশা বিন নূন সেখানে প্রবেশ করবেন ।২
মূসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি নবী ইউশা বনি ইসরাইলের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । তিনি তাদেরকে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে নিয়ে যান এবং আবীহা (জেরিকো) শহর থেকে শুরু করে আরো ৩১টি ক্ষুদ্র রাজ্য জয় করেন যার প্রতিটি ছিল শহর বা ছোট শহর এবং এগুলোর প্রতিটির অধীনে বেশ কিছু কৃষিনির্ভর গ্রাম ছিল । উল্লেখ্য যে,এ সব নগররাজ্যের অধিবাসীরা ছিল কিনআন গোত্রীয় পৌত্তলিক ।
তখন তিনি ঐ অঞ্চলকে ইয়াকূব (আ.)-এর বংশধরদের মধ্যে বণ্টন করে দেন যারা একে অপরের প্রতি হিংসা-দ্বেষ পোষণ করত । ইউশার পুস্তিকায় ১৫ থেকে ১৯ অধ্যায়ে উক্ত অঞ্চলের নগর ও ক্ষুদ্র শহরের সংখ্যা ২১৬ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । হযরত ইউশা (আ.) খ্রিস্টপূর্ব ১১৩০ সালে প্রায় ১১০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন ।
২.বিচারকদের যুগ
অস্থিতিশীল যুগের বিচারকদের শাসন কর্তৃত্ব এবং ইহুদী জাতির ওপর স্থানীয় শাসক ও রাজন্যবর্গের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার : হযরত ইউশা ইবনে নূনের পর বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব বিচারকদের কাছে স্থানান্তরিত হয় এবং তাদের মধ্যে ১৫ জন শাসনকর্তা হয়েছিল । তাদের যুগের দু’টি বৈশিষ্ট্য সবসময় বনি ইসরাইলের মাঝে লক্ষ্য করা যায় ।
একটি বৈশিষ্ট্য হলো মহান নবীদের পথ থেকে তাদের (বিচারকদের) বিচ্যুতি এবং অপর বৈশিষ্ট্য হলো মহান আল্লাহ্ কর্তৃক এমন সব ব্যক্তিকে তাদের ওপর কর্তৃত্বশীল করা যারা তাদের অত্যন্ত বেদনাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবে;আর এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে ।
তৃতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ে বিচারকদের পুস্তিকায় হযরত ইউশা (আ.)-এর পর বনি ইসরাইলের বিচ্যুতির কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে :
কিনাআনী, হেইথী, আমূরী, ফার্যী, হেভী ও ইয়াবুসীয়দের মাঝে তারা বসবাস করতে থাকে এবং ঐসব জাতির মেয়েদেরকে তারা স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিল এবং নিজেদের কন্যাসন্তানদেরকে তারা তাদের ছেলেদের কাছে বিবাহ দিয়েছেল । তারা ঐ সব জাতির প্রতিমা এবং দেব-দেবীদেরও পূজা করত ।
তৃতীয় অধ্যায়ের ৮ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : বিচারকদের মধ্য থেকে যে সর্বপ্রথম বনি ইসরাইলের ওপর শাসনকর্তৃত্ব লাভ করেছিল এবং তাদেরকে ৮ বছর শাসন করেছিল সে ছিল আরামুন নাহরাইনের শাসনকর্তা রাশ্তাআম ।
তখন বনি আম্মোন এবং আমালিকারা তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আরীহা (জেরিকো) শহর দখল করে নেয় ।৩ এরপর কিনআন দেশের শাসনকর্তা ইযারীন হাসূর অঞ্চলে তাদের ওপর ১০ বছর শাসন করেছিল ।৪
এরপর বনি আমোন ও ফিলিস্তিনীরা তাদেরকে ১৮ বছর দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছিল ।৫
এরপর ফিলিস্তিনীরা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল এবং চল্লিশ বছর তাদেরকে নিজেদের আধিপত্যাধীন রেখেছিল ।৬
ইউশা ইবনে নূনের পর বিচারকদের শাসন নবী হযরত সামূঈল (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । হযরত সামূঈল (আ.) ছিলেন ঐ নবী পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াতে যাকে এভাবে স্মরণ করেছেন :
“আপনি কি বনি ইসরাইলের ঐ গোত্রকে দেখেছেন যারা মূসার পরে তাদের নবীর (সামূঈল) কাছে এ প্রার্থনা করেছিল : আপনি আমাদের জন্য এমন একজন বাদশাহ্ নিযুক্ত করে দিন যাতে করে আমরা মহান আল্লাহর পথে জিহাদ করতে পারি । তাদের নবী বলেছিলেন : তোমাদের ওপর জিহাদ অবধারিত (ফরয) হয়ে গেলে কি তোমরা নাফরমানী করবে? তারা বলেছিল : এটি কিভাবে সম্ভব যে, আমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করব না । অথচ তারা আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে । অতঃপর যখন তাদের ওপর জিহাদ নির্ধারণ করা হলো তখন তাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ব্যতীত সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং মহান আল্লাহ্ অত্যাচারীদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত আছেন ।”৭
ঐতিহাসিকরা এ যুগকে খ্রিস্টপূর্ব ১১৩০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০২৫ সাল পর্যন্ত একশ’ বছর অর্থাৎ হযরত তালুত ও হযরত দাউদ (আ.)-এর শাসনকালের শুরু পর্যন্ত বলে মনে করেন, অথচ তাওরাতে বিচারকদের পুস্তিকায় এ সময় কাল (বিচারকদের শাসনকাল) একশ’ বছরের চেয়েও অধিক বলে উল্লিখিত হয়েছে ।
৩. হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামল
রাজা তালুতের যুগকে আমরা হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলের অংশবিশেষ বলে গণ্য করব । কারণ যদিও তালূত নবী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন মহান নবীদের ধারার একজন শাসক । ঐতিহাসিকরা তাঁর শাসনামল খ্রি.পূ. ১০২৫ থেকে ১০১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর বলে উল্লেখ করেছেন । তারপর হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.) খ্রি.পূ. ১০১০ সাল থেকে খ্রি.পূ. ৯৩১ সাল পর্যন্ত শাসন করেছেন । হযরত সুলাইমান (আ.) খ্রি.পূ. ৯৩১ সালে ইন্তেকাল করেন ।
বর্তমান তাওরাত (পুরাতন নিয়ম)-এর রচয়িতারা হযরত মূসা (আ.), হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.)-এর ওপর জুলুম করেছে এবং জঘন্য চারিত্রিক, রাজনৈতিক ও বিশ্বাসগত মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে ।
পাশ্চাত্যের অধিকাংশ খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা কেবল এ সব রচয়িতার অনুসরণ করেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাঁদের বক্তব্যের সাথে আরো বেশ কিছু ভিত্তিহীন বিষয়ও যোগ করেছেন । অতঃপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমর্থক মুসলমান নামধারীরাও পাশ্চাত্যের এসব লেখকের অনুসরণ করেছে । মহান আল্লাহর দরূদ ও সালাম তাঁর সকল নবী-রাসূলদের ওপর বর্ষিত হোক । আর যে সব ব্যক্তি এ সব মহামানবের ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে মহান আল্লাহর দরবারে আমরা তাদের থেকে সম্পর্কোচ্ছেদ ঘোষণা করছি ।
হযরত দাউদ (আ.) ইসরাইলীদেরকে পৌত্তলিকতা ও মুশরিকদের আধিপত্য থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং তাঁর ঐশ্বরিক শাসন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহেও বিস্তার লাভ করেছিল । যে সব জাতি তাঁর শাসনাধীন ছিল তিনি তাদের সাথে এমন সদাচরণ করতেন যে, মহান আল্লাহর পবিত্র কোরআনে এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কণ্ঠে তা বর্ণনা করেছেন । হযরত দাউদ (আ.) আল কুদসে মারীয়া পাহাড়ের ওপর তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ইবাদত-বন্দেগী করার স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু সেখানে আরুনা নামের আল কুদসের ইয়াবূস বংশীয় একজন বাসিন্দার শস্যক্ষেত্র ছিল । হযরত দাউদ (আ.) ঐ লোকের কাছ থেকে ঐ জমি ৫০ শাকোল (ওজনের পিণ্ড) রূপার বিনিময়ে ক্রয় করেন । বর্তমান তাওরাতের বক্তব্য অনুসারে সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ এবং নামায কায়েম করেছিলেন । আর তিনি এর একটি অংশে মহান আল্লাহর জন্য কোরবানীও করতেন ।৮
হযরত সুলাইমান (আ.) হযরত দাউদ (আ.)-এর রাজত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন । তাঁর হুকুমত ও রাজত্ব ঐ পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছিল যার উল্লেখ পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ্য় বিদ্যমান । তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা হযরত দাউদ (আ.) এবং শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মসজিদটিকে একটি জাঁকজমকপূর্ণ ইমারতে রূপান্তরিত করেছিলেন যা ‘মা’বাদ-ই সুলাইমান’ অর্থাৎ The temple of King Solomon নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে ।
হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামল মহান নবীদের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী যুগ । এ যুগে মহান আল্লাহ্ তাঁর আশ্চর্যজনক ও বিচিত্র নেয়ামতসমূহের কিছু নমুনা মানব জাতির কাছে প্রকাশ করেছিলেন । যদি জাতিসমূহ মহান নবী এবং তাঁদের উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বের রাজনৈতিক ধারাটি বহাল রাখত এবং মহান আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দমন কার্যে ব্যবহার না করত, তাহলে মহান আল্লাহ্ তাদেরকে এ সব নেয়ামত নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রদান করতে থাকতেন । মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :
“মহান আল্লাহ্ যদি মানব জাতির জন্য অজস্র জীবিকার ব্যবস্থা করতেন, তাহলে তারা পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচার করত । কিন্তু মহান আল্লাহ্ যতটুকু চান কেবল ততটুকুই তিনি অবতীর্ণ করেন । আর তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে জ্ঞাত এবং তাদের সব কিছু দেখেন ।”৯
হযরত সুলাইমান (আ.) নিজ সিংহাসনের ওপর উপবিষ্টাবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেন । ঐতিহাসিকরা তাঁর মৃত্যুর তারিখ খ্রিস্টপূর্ব ৯৩১ সাল বলে উল্লেখ করেছেন ।
হযরত সুলাইমানের মৃত্যুর সাথে সাথেই বনি ইসরাইলের মধ্যে বিচ্যুতি এবং তাদের হুকুমত ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিভক্তি দেখা দেয় । আর এ কারণেই মহান আল্লাহ্ তাদের ওপর এমন ব্যক্তিকে কর্তৃত্বশীল করে দিয়েছিলেন যে তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করিয়েছিল ।
বর্তমান তাওরাতের রাজন্যবর্গ ও শাসকদের প্রথম পুস্তিকায় সুলাইমান (আ.)-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হয়েছে এভাবে যে, তিনি মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী বর্জন করে মূর্তি পূজা করতেন । তাওরাতে উল্লিখিত হয়েছে : “তিনি সুলাইমানকে বললেন : এ শাস্তির কারণ তুমি নিজেই । যে সব চুক্তি এবং ওয়াজিব বিধান পালন করার আদেশ আমি তোমাকে দিয়েছিলাম, তুমি সেগুলো সংরক্ষণ কর নি । আমিও তোমার হাত থেকে রাজত্ব কেড়ে নিয়ে তা টুকরো টুকরো করে ফেলব ।”১০
৪. অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ
তাদের অধঃপতন এতটাই হয়েছিল যে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য তাদের মধ্যকার পৌত্তলিকরা মিশরের ফিরআউন, আশুরীয় ও ব্যাবেলনীয়দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল ।
হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মৃত্যুর পর ইহুদীরা শেকীম (নাবলুস) নামক স্থানে সমবেত হয়ে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইয়ারবাআম বিন নাবাত-এর হাতে বাইআত করে । উল্লেখ্য যে, এ ইয়ারবাআম বিন নাবাত হযরত সুলাইমানের অন্যতম শত্রু ছিল । সে সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলে মিশরে পালিয়ে যায় এবং ফিরআউনদের কাছে আশ্রয় নেয় । হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মৃত্যুর পর সে ফিরে আসলে ইহুদীরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল । সে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ‘ইসরাইল’ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যার রাজধানী ছিল শেকীম বা সামেরাহ্ । খুব অল্প সংখ্যক ইহুদী হযরত সুলাইমানের পুত্র রাহাবাআমের হাতে বাইআত করে । রাহাবাআমের রাজ্য ‘ইয়াহুদা’ নামে পরিচিত ছিল । এ রাজ্যের রাজধানী ছিল আল কুদ্স (জেরুজালেম) ।১১
কিন্তু আসিফ বিন বারখিয়া যিনি ছিলেন হযরত সুলাইমান (আ.)-এর উত্তরাধিকারী, মহান আল্লাহ্ তাঁর সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেছেন : (عنده علم من الكتاب) অর্থাৎ তার কাছে কিতাবের কিছু জ্ঞান ছিল । বনি ইসরাইল তাঁর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছিল । তিনি বনি ইসরাইলের কাছ থেকে মিথ্যা অপবাদ লাভ করা ছাড়া আর কিছুই পান নি ।
তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে : “কুফর ও মূর্তিপূজা ইয়ারাবাআম-এর অনুসারীদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিদ্যমান ছিল । সে স্বর্ণ দিয়ে দু’টি গোবৎস মূর্তি বানিয়ে এগুলোর একটি আল কুদসে এবং অপরটি দানে স্থাপন করেছিল । সে প্রতিটি মূর্তির পাশে একটি করে কোরবানী করার জায়গাও নির্মাণ করেছিল এবং তাদেরকে বলেছিল : “তোমাদের খোদারাই তোমাদেরকে মিশর থেকে বের করে শেকীমে এনেছেন । অতএব, তাঁদের সামনে তোমরা কোরবানী করবে এবং ঊরশালিমে যাবে না ।” আর ইহুদী জাতিও তার কথা মেনে নিয়েছিল ।১২
গোবৎস উপাসনা করার পাশাপাশি ইয়ারাবাআম তাদেরকে অন্যান্য দেব-দেবী, যেমন- সাইদূনীদের দেবতা আশতারুত (عشتروت), মুআবীদের দেবতা কামুশ (كموش) এবং আমোনদের দেবতা মাকলুম (مكلوم)-এর উপাসনা করার আদেশ দিয়েছিল ।১৩
আদি রাজা ও শাসকবর্গের কাহিনীসমূহ সংক্রান্ত পুস্তিকার বক্তব্য অনুসারে ইয়াহুদা রাজ্যও তিন বছর পরে এই একই পরিণতি বরণ করেছিল (অর্থাৎ সেখানেও মূর্তিপূজা, পৌত্তলিকতা এবং শিরকের প্রসার হয়েছিল) ।১৪
মিশরের ফিরআউন শীশক (شيشق) এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইয়ারাবাআমকে সাহায্য ও ইয়াহুদা রাজ্যের ধ্বংস সাধন করার জন্য খ্রি.পূ. ৯২৬ সালে হযরত সুলাইমান (আ.)-এর পুত্র রাহাবাআম ও তাঁর অনুসারীদেরকে পরাজিত করে আল কুদ্স দখল করে এবং বেথ-ঈল (মহান আল্লাহর গৃহ)-এর ধনভাণ্ডার, শাসনকর্তার সিংহাসন, এমনকি হযরত সুলাইমান (আ.) যে সব স্বর্ণের ঢাল বানিয়েছিলেন সেগুলো নিজের সাথে নিয়ে গিয়েছিল ।
সম্ভবত মিশরের ফিরআউনের নিজ রাজ্যে দুর্বল অবস্থানের কারণে নিজে অথবা তার সহযোগীর (ইয়ারাবাআম) মাধ্যমে ইয়াহুদা রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে পারে নি ।
অতএব, শীশকের পশ্চাদপসরণ করার পর এ ক্ষুদ্র রাজ্যটি নিজ অবস্থান কিছুটা ফিরে পেয়েছিল এবং তারা ইয়ারাবাআমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিল । আরামীরা উক্ত রাজ্যদ্বয়ের দুর্বলতার সুযোগ নেয় এবং ইয়াহুদা রাজ্য আক্রমণ করে সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে বন্দী করে নিজেদের রাজধানী দামেশকে নিয়ে যায় । তারা বিজিতদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করে । এ ঘটনা আরামী বিন হুদের রাজত্বকালে (খ্রি.পূ. ৮৭৯- খ্রি.পূ. ৮৪৩) ঘটেছিল ।১৫
অতঃপর আখাব বিন আওমেরীর রাজত্বকালে খ্রি.পূ. ৮৭৪- খ্রি.পূ. ৮৫৩ সালের মধ্যে আরামীয়রা ইয়ারাবাআমের রাজ্যের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করে সে দেশকেও তাদের করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল ।
একইভাবে তাওরাতে ইয়েহুরামের শাসনকালে ইয়াহুদা রাজ্যের সাথে কোশেসীয়ীদের যুদ্ধে আরবদের সাথে ফিলিস্তিনীদের যুদ্ধ ও সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তারা আল কুদ্স দখল করে শাসনকর্তার প্রাসাদে সংরক্ষিত ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে বন্দী করেছিল ।১৬
তাওরাতে আরো বর্ণিত আছে : “আরামীয় সেনাবাহিনী বাইতুল মুকাদ্দাসে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং সেখানকার সকল নেতাকে হত্যা করতঃ সকল ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে । অতঃপর তারা সে সব লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ আরামীয়দের রাজা হাযাঈলের কাছে অর্পণ করে ।”১৭
ঠিক একইভাবে ইসরাইল রাজ্যের শাসনকর্তা ইউআশ ইয়াহুদা রাজ্য আক্রমণ করে নগরীর দুর্গ ধ্বংস করেছিল । সে মহান আল্লাহর ঘরে সংরক্ষিত যাবতীয় স্বর্ণ, রৌপ্য, বাসন-কোসন এবং রাজকীয় কোষাগার লুণ্ঠন করেছিল ।১৮
আশুরীয়দের দখল করার আগ পর্যন্ত বনি ইসরাইলের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় অবস্থা এবং তাদের ওপর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে ।
৫. আশুরীয়দের আধিপত্য বিস্তারের যুগ
খ্রি. পূ. ৮৫৯ সাল থেকে খ্রি. পূ. ৮২৪ সাল পর্যন্ত আরামীয় রাজ্য ও ইসরাইলে আশুরীয় রাজ তৃতীয় শালমান্নাসরের আক্রমণের মাধ্যমে ইহুদীদের ওপর আশুরীয়দের আধিপত্যের সূত্রপাত ঘটে । পুরো অঞ্চলই তার এবং তার পরবর্তী আশুরীয় রাজন্যদের শাসনাধীনে চলে যায় । তবে সম্ভবত প্রথমে ইসরাইল রাজ্যের পরিবর্তে ইয়াহুদা রাজ্যটি আশুরীয়দের শাসনাধীনে এসেছিল ।
কারণ তাওরাতের বর্ণনানুসারে সেখানকার শাসনকর্তা আহায বিন ইউসাম আশুর রাজ্যের নৃপতি তাঘলিস ফালাসারকে ইসরাইল ও আরামীয়দের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর জন্য আহবান করেছিল; আর আশুর রাজও তার সর্বশেষ আবেদন গ্রহণ করে খ্রি.পূ. ৭৩২ সালে আক্রমণ করার উদ্যোগ নেন । আশুর রাজের উত্তরাধিকারী নৃপতি ৫ম শালমান্নাসরও তাঁর পূর্বসূরির কর্মপন্থা অব্যাহত রাখেন । কিন্তু তিনি ইসরাইলের রাজধানী শেকীম (নাবলুস) অবরোধকালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত নৃপতি দ্বিতীয় সিরজাওন সামেরাহ্ নগরী পুরোপুরি দখল করেছিলেন এবং এভাবে তিনি এ দেশটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন । ইসরাইল আক্রমণ করার মাধ্যমে ইহুদীদেরকে তাদের দেশ ও মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা হয় । তাঘলিস ফালাসার ইহুদীদেরকে বন্দী করে নিজ দেশে নিয়ে আসেন এবং আশুরীয়দেরকে তাদের দেশে আবাসন দেন ।১৯
তারপর সুলতান ফাকাহ্ উক্ত পরিকল্পনা সমাপ্ত করেন এবং তিনি মানসীর বংশধরদের ও ইহুদী জনসংখ্যার অর্ধেকাংশকে বন্দী করেছিলেন ।২০
দ্বিতীয় সিরজাওন প্রায় ত্রিশ হাজার ইহুদীকে হাররান, খাবূর নদীর তীর এবং মিডিয়ায় নির্বাসিত করেন এবং তাদের স্থলে আরামীয়দেরকে আবাসন দেন ।২১
হিযকিয়ার শাসনামলে ইয়াহুদা রাজ্য আশুরীয়দের হাত থেকে বের হয়ে আসে । বাহ্যত তিনি মিশরীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করছিলেন । তাঁর এ উদ্যোগে আশুর রাজ্যের নৃপতি সিনহারীব তার ওপর খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং খ্রি. পূ. ৭০১ সালে ইয়াহুদা রাজ্যকে বশীভূত করার জন্য এবং আশুরীয়দের সর্বশেষ আক্রমণের মাধ্যমে উক্ত অঞ্চল নিজ শাসনাধীনে আনেন এবং আল কুদ্স দখল করেন । হিযকিয়া মহান আল্লাহর গৃহে বিদ্যমান যাবতীয় রৌপ্য এবং শাসনকর্তার প্রাসাদে গচ্ছিত সকল ধন-সম্পদ তাঁর কাছে অর্পণ করেছিলেন ।২২
বর্তমান তাওরাতে আশুর দেশের যে সব নৃপতির বিবরণ প্রদান করা হয়েছে তাঁরা ব্যতীত আসরহাদ্দুন এবং তাদের সর্বশেষ নৃপতি আশুর বানিবাল সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেছে : “এ দু’জন আশুর রাজ্য থেকে বেশ কিছু সম্প্রদায়কে সামেরাহ্ নগরীতে এনে আবাসন দিয়েছিলেন ।”২৩
৬. বাবেলীয়দের আধিপত্য বিস্তারের যুগ
মাদ ও বাবেলীয়দের (কালদানীদের) হাতে খ্রি.পূ. ৬১২ সালে আশুরীয়দের রাজধানী নেইনাভার পতন ঘটে এবং উক্ত রাজ্যকে বিজয়ীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় । ইরাক, শাম ও ফিলিস্তিন বাবেলীয়দের ভাগে পড়ে । তাদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন বাখতুন নাসর- যিনি শাম ও ফিলিস্তিনকে নিজ শাসনাধীনে আনার জন্য খ্রি.পূ. ৫৯৭ সালে প্রথম বার এবং খ্রি.পূ. ৫৮৬ সালে দ্বিতীয় বার সেখানে আক্রমণ করেছিলেন ।
প্রথম আক্রমণে তিনি আল কুদ্স অবরোধ ও জয় করেন । তিনি সেখানকার শাসনর্তার প্রাসাদের যাবতীয় ধন-রত্ন ও সম্পদ হস্তগত করেন । বিরাট সংখ্যক ইহুদী, এমনকি সুলতান ইয়াহুভা ইয়াকীন ও তাঁর সমর্থকদেরকে বন্দী করেন এবং ধৃত সুলতানের পিতৃব্য সিদিকইয়াকে অবশিষ্ট ইহুদীদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । তিনি বন্দীদেরকে বাবিলের (ব্যাবিলনের) খাবূর নদীর কাছে নাইবূর এলাকায় নির্বাসিত করেন ।২৪
দ্বিতীয় আক্রমণ : বাখতুন নাসর ও মিশরের ফিরআউন খোফরার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । কারণ, ফিরআউন খোফরা শাম ও ফিলিস্তিনের শাসনকর্তাদের, যেমন আল কুদসের নয়া শাসক সিদিকইয়াকে বাবেলীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে এবং তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে । তারাও তা মেনে নেয় এবং মিশরের ফিরআউন অত্র অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে । কিন্তু বাখতুন নাসর দ্রুত আরেকটি আক্রমণ পরিচালনা করে মিশরীয়দেরকে পরাজিত করেন এবং সমগ্র অঞ্চল তাঁর করায়ত্তে চলে আসে । ইহুদীদের উপাসনালয়ে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস এবং তাদের ধন-ভাণ্ডারসমূহ লুণ্ঠন করা হয় । তাদের সব ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদীকে বন্দী করা হয় । সিদিকইয়ার সন্তানদেরকে বাখতুন নাসরের সামনে জবাই এবং তারপর সিদিকইয়ার দু’চোখ উপড়ে ফেলা হয় । তাকেও পায়ে বেড়ী পড়িয়ে বন্দীদের সাথে নিয়ে যাওয়া হয় । আর এভাবেই ইয়াহুদা রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় ।২৫
৭. ইরানীদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ
পারস্য-সম্রাট সাইরাস (কোরুশ) বাবেল নগরী ও রাজ্য দখল করে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে সেখানকার সরকার ও প্রশাসনের পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটান । তিনি শাম ও ফিলিস্তিন আক্রমণ করে সে দেশগুলো নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । তিনি বাখতুন নাসরের বন্দীদেরকে এবং যে সব ইহুদী বাবেলে বসবাস করত তাদেরকে আল কুদসে ফিরে যাওয়ার অনুমতি এবং সুলাইমান (আ.)-এর ইবাদতগাহের ধন-সম্পদসমূহ তাদের কাছে ফিরিয়ে দেন । তিনি তাদেরকে তাদের উপাসনালয় সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করার অনুমতি দেন এবং যেরবাবেলকে তাদের প্রশাসক নিযুক্ত করেন ।২৬
সাইরাস কর্তৃক নিযুক্ত ইহুদী শাসনকর্তা, হযরত সুলাইমান (আ.)-এর ইবাদতগাহ্ পুনঃনির্মাণ প্রক্রিয়ায় হাত দিলে তৎসংলগ্ন এলাকার জনগণ ভয় পেয়ে সম্রাট সাইরাসের উত্তরাধিকারী কামবুজিয়ার কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করে । তিনি ইবাদতগাহ্ নির্মাণ কার্য বন্ধ রাখার নির্দেশ জারী করেন । অতঃপর ১ম দারা (দারায়ূশ) তাদেরকে ইবাদতগাহ্ পুনঃনির্মাণের অনুমতি দিলে খ্রি. পূ. ৫১৫ সালে ইবাদতগাহের ইমারত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় ।
খ্রি. পূ. ৫৩৯ সাল থেকে খ্রি. পূ. ৩৩১ সাল পর্যন্ত ইহুদীদের ওপর ইরানী জাতির আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল । এ দীর্ঘ সময় সম্রাট সাইরাস, কামবুজিয়াহ্, প্রথম দারায়ূশ, খেশার ইয়ার্শা এবং হযরত উযাইর (আ.)-এর সমসাময়িক আরদাশীর ইহুদীদের শাসন করেছেন । এদের পর আরো কতিপয় ইরানী সম্রাট, যেমন দ্বিতীয় দারায়ূশ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আরদাশীর রাজত্ব করেছেন । তৃতীয় আরদাশীর ছিলেন শেষ পারস্য সম্রাট যিনি গ্রীক সম্রাট ইস্কান্দারের (আলেকজান্ডার)২৭ হাতে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন । বর্তমান তাওরাতে এ সব সম্রাট ও রাজা-বাদশার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ।
৮. গ্রীকদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ
গ্রীকসম্রাট ইস্কান্দার আলেকজান্ডার মিশর, শাম ও ফিলিস্তিনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ঐ সব অঞ্চল পদানত ও নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । ইরানী সামন্তরা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাঁর মুখোমুখি হলে তিনি তাদের পরাজিত করে আল কুদসে প্রবেশ করেন এবং উক্ত অঞ্চল পূর্ণরূপে নিজ শাসনাধীনে আনয়ন করেন । অতঃপর সম্রাট ইস্কান্দার উত্তর ইরাকের আরবীলে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে পারস্য সম্রাট তৃতীয় আরদাশীরের শাসনকর্তৃত্ব ও সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ নির্মূল করেন । এরপর তিনি সম্মুখপানে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে পারস্য ও আরো অন্যান্য অঞ্চল দখল করেন । আর এভাবে খ্রি.পূ. ৩৩১ সালে ইহুদীরা গ্রীকদের অধীন হয়ে যায় ।
ইস্কান্দারের মৃত্যুর পরে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের ওপর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর সেনাবাহিনীর সেনাপতিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় যা ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল । বাতালিসা (বাতলীমূসীয়রা) মিশর সরকারের অধিকাংশ অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং সেলূকীয়রা (সেলূকূস-এর সাথে সংশ্লিষ্ট) সিরিয়া ও অন্যান্য অংশের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন ।
আর এভাবেই আল কুদ্স খ্রি.পূ. ৩১২ সালে বাতলীমূসীয়দের নিয়ন্ত্রণে আসে । কিন্তু তৃতীয় সেলূকীয় নৃপতি আনতিয়োকূস খ্রি. পূ. ১৯৮ সালে বাতলীমূসীয়দের নিয়ন্ত্রণ থেকে আল কুদ্স মুক্ত করেন । অতঃপর আবারও বাতলীমূসীয়রা আল কুদসের ওপর নিজেদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং খ্রি. পূ. ৬৪ সালে রোম কর্তৃক উক্ত অঞ্চল বিজিত হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে নিজেদের শাসনকর্তৃত্ব অব্যাহত রাখে ।
বর্তমান তাওরাত ছয় জন বাতলীমূসীয়কে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ষষ্ঠ বাতলীমূসীয় পর্যন্ত স্মরণ করে বলেছে : “তাদের মধ্যকার প্রথম ব্যক্তি শনিবার ঊরশালিমে প্রবেশ করে বিপুল সংখ্যক ইহুদীকে বন্দী করে মিশরে প্রেরণ করেছিলেন ।”২৮
ঠিক একইভাবে তাওরাত পাঁচ জন সেলূকীয় শাসনকর্তাকে প্রথম, দ্বিতীয় এভাবে পঞ্চম আনতিয়োকূস নামে উল্লেখ করেছে এবং বলেছে : “তাদের মধ্যকার চতুর্থ ব্যক্তি খ্রি.পূ. ১৭৫ সাল থেকে খ্রি.পূ. ১৬৩ সাল পর্যন্ত আল কুদসে সেনাভিযান পরিচালনা করেন এবং হযরত সুলাইমান (আ.)-এর উপাসনালয়ের যাবতীয় মূল্যবান জিনিস লুণ্ঠন করেন এবং দু’বছর পরে আল কুদসের ওপর এক বিরাট আঘাত হানেন । সেখানে যা কিছু ছিল তা লুণ্ঠন এবং উক্ত নগরীর বাড়ি-ঘর ও প্রাচীরসমূহ ধ্বংস করা হয় । আক্রমণকারী চতুর্থ আনতিয়োকূস নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করেন । তিনি নিজেদের উপাস্য যিউসের প্রতিমা উক্ত ইবাদতগাহে স্থাপন করেন এবং ইহুদীদেরকে উক্ত প্রতিমার উপাসনা করার আহবান জানান । তাদের অনেকেই তাঁর এ আহবানে সাড়া দিয়েছিল । অথচ মেকাবী ইহুদীদের আন্দোলনের কারণে খ্রি. পূ. ১৬৮ সালে তাদের অনেকেই গোপন স্থান ও গুহাসমূহে আশ্রয় নিয়েছিল ।২৯
ইহুদীরা নিজেদের যে বিপ্লব ও আন্দোলনের ব্যাপারে গর্ব করে তা গেরিলা গোষ্ঠীসমূহের যুদ্ধের সাথেই বেশি সদৃশ ছিল । ইহুদী ধর্মে বিশ্বাসীরা মূর্তিপূজারী গ্রীকদের বিরুদ্ধে এ সব যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল । তারা বিভিন্ন সময়ে সীমিত সাফল্য লাভ করেছিল এবং এ অবস্থা রোমীয়দের চূড়ান্ত আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপন করা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ।
৯. রোমীয়দের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের যুগ
রোম-সম্রাট বোম্বেই খ্রি. পূ. ৬৪ সালে সিরিয়া দখল এবং তা রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন । পরের বছর তিনি আল কুদ্স দখল করেন এবং তা সিরিয়াস্থ রোমান শাসনকর্তার অধীন করে দেন । মথির ইঞ্জিলে (মেথিউসের বাইবেল) বর্ণিত হয়েছে : “খ্রি.পূ. ৩৯ সালে রোম-সম্রাট অগাস্ট হিরোডিস আদোমীকে ইহুদীদের প্রশাসক নিযুক্ত করেন । নব নিযুক্ত শাসনকর্তা হযরত সুলাইমান (আ.)-এর ইবাদতগাহের ওপর একটি নতুন ও সুন্দর অট্টালিকা নির্মাণ করেন এবং তিনি খ্রি. পূ. ৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন ।”৩০
ইঞ্জিলসমূহের বিবরণ অনুসারে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় হেরোডিস খ্রি.পূ. ৪ সাল থেকে ৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইহুদীদের শাসন করে এবং তার যুগে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন । এ শাসনকর্তাই ইয়াহ্ইয়া ইবনে যাকারিয়াকে হত্যা করে তাঁর কর্তিত মস্তক একটি সোনালী পাত্রে রেখে সালূমার কাছে উপঢৌকনস্বরূপ প্রেরণ করে । উল্লেখ্য যে, এ সালূমা ছিল বনি ইসরাইলের এক জঘন্য নারী ।৩১
ইঞ্জিলসমূহ ও ঐতিহাসিকরা নেরোনের (নিরো) যুগে ৫৪-৬৮ খ্রিস্টাব্দে রোমান ও ইহুদীদের মধ্যে যে সব ঘটনা এবং কুদ্স ও ফিলিস্তিনে যা কিছু ঘটেছে তা উল্লেখ করেছেন । রোমান সম্রাট কাসবেসীয়ান তাঁর পুত্র তিতুসকে ৭০ খ্রিস্টাব্দে উক্ত অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত করেন । তিনি আল কুদসে আক্রমণ চালান । ফলে সেখানকার ইহুদীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তাদের রসদপত্রও শেষ হয়ে গেলে তারা দুর্বল হয়ে যায় । তিনি তিতুস শহরের প্রাচীর ধ্বংস করেন এবং পুরো শহর তাঁর দখলে চলে আসে । তিনি শহরে প্রবেশ করে হাজার হাজার ইহুদীকে হত্যা এবং তাদের বাড়ি-ঘর ধ্বংস করেন । তাদের উপাসনালয় গুঁড়িয়ে ফেলা হয় এবং তাতে অগ্নি সংযোগ করা হয় । উপাসনালয়টি এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যে, এর অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যায় নি । শহরের যে সব অধিবাসী প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তাদেরকে রোমে নিয়ে যাওয়া হয় ।
ঐতিহাসিক আল মাসউদী তাঁর ‘আত্ তাম্বীহ্ ওয়াল আশরাফ’ গ্রন্থে বলেন : “এ আক্রমণে নিহত ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সংখ্যা ছিল তিন মিলিয়ন- যা বাহ্যত অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছে । এ সব ঘটনার পর রোমানরা ইহুদীদের সাথে বেশি কঠোর আচরণ প্রদর্শন করে যা ঐ সময়ে তুঙ্গে পৌঁছে যখন সম্রাট কন্সটানটাইন এবং তাঁর পরবর্তী কায়সাররা (সম্রাটরা) খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন । তাঁরা ইহুদীদেরকে নির্যাতন ও শাস্তির মধ্যে রাখেন । এ কারণেই ৬২০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.)-এর যুগে শাম ও ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের সাথে পারস্য সম্রাট খোসরু পারভেযের যে যুদ্ধ হয়েছিল সে যুদ্ধে রোমান বাহিনীর পরাজয় বরণ করার কারণে ইহুদীরা খুব খুশী হয়েছিল । ঠিক একইভাবে হিজাযের ইহুদীরাও আনন্দ প্রকাশ করেছিল এবং তারা মুসলমানদের ওপর তাদের বিজয়ী হওয়ার দূরাশা পোষণ করত । তখন এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় :
“আলিফ লাম মীম । এ সব অক্ষরের শপথ রোম পরাজিত হয়েছে । খুব নিকটবর্তী অঞ্চলে এবং পরাজয় বরণ করার পর তারা অতি শীঘ্রই বিজয়ী হবে, খুব অল্প কয়েক বছরের মধ্যে । অতীত এবং ভবিষ্যতের সকল বিষয় কেবল মহান আল্লাহরই । আর মহান আল্লাহর সাহায্য ও শক্তির দ্বারা ঈমান আনয়নকারীরা সেদিন আনন্দিত হবে । তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সাহায্য করেন । আর তিনিই পরাক্রমশালী বিজয়ী এবং দয়ালু ।”৩২
ঐতিহাসিকদের অভিমত অনুযায়ী রোমানদের ওপর বিজয় লাভ করার পর বিজয়ী ইরানীদের কাছ থেকে ইহুদীরা নব্বই হাজার খ্রিস্টান যুদ্ধবন্দী ক্রয় করে তাদের সবাইকে হত্যা করেছিল ।
কয়েক বছর পর যখন রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস ইরানীদের ওপর বিজয়ী হন তখন তিনি ইহুদীদেরকে শাস্তি দেন এবং আল কুদসে যে ইহুদীই ছিল তাকে তিনি সেখান থেকে বহিষ্কার করেন; আর এভাবে খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে এ শহর ইহুদীদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় । দ্বিতীয় খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে খ্রিস্টানরা শর্তারোপ করেছিল যে, কোন ইহুদী যেন সেখানে বসবাস না করে এবং তিনিও তাদের ইচ্ছার প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেন এবং এ বিষয়টি তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্রে লিপিবদ্ধ করেন । আর তা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ হিজরী ১৮ সালে যখন আল কুদ্স ও ফিলিস্তিন ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় তখন থেকে ১৩৪৩ হিজরী অর্থাৎ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ পাশ্চাত্যের হাতে তুর্কী উসমানী খিলাফতের পতন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ।
এ হচ্ছে ইহুদী জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস যা আমাদের কাছে নানাবিধ বিষয়, যেমন ইহুদীদের ব্যাপারে সূরা ইসরা (বনি ইসরাইল) ও অন্যান্য সূরার আয়াতসমূহের তাফসীরও স্পষ্ট করে দেয় ।... এ সব আয়াতের তাফসীর এবং ‘তোমরা পৃথিবীতে দু’বার ফিতনা করবে’- এ আয়াতে মহান আল্লাহর বক্তব্যের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে এই যে, মহানবী (সা.)-এ নবুওয়াতে অভিষেকের আগে একবার এবং এরপর আরেকবার তোমরা পৃথিবীতে ফিতনা করবে । আর এটিই হচ্ছে তাদের বহু ফিতনা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের পর্যায় ব্যাখ্যাকারী একমাত্র শ্রেণীবিন্যাস । উল্লেখ্য যে, ইহুদী জাতির ইতিহাস এ সব বিষয় দিয়ে পরিপূর্ণ ।
১০. ইসলাম ও মুসলমানদের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের যুগ
‘আমাদের পক্ষ থেকে এমন সব বান্দাদেরকে প্রেরণ করব যারা হবে প্রচণ্ড শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী’- মহান আল্লাহর এ বাণীর অর্থ হচ্ছে মুসলমানরা । কারণ মহান আল্লাহ্ ইসলামের প্রাথমিক যুগে আমাদেরকে তাদের ওপর কর্তৃত্বশীল করে দিয়েছিলেন । আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তন্নতন্ন করে তল্লাশী করেছেন । এরপর তাঁরা মসজিদে আকসায় প্রবেশ করেন । আবার যখন আমরা পবিত্র ইসলাম ধর্ম থেকে দূরে সরে যাই তখন মহান আল্লাহ্ আমাদের বিরুদ্ধে ইহুদীদেরকে শক্তিশালী করে দেন এবং তাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি (লোকবল) দিয়ে সাহায্য করেন এবং জনশক্তির দিক থেকে তাদেরকে আমাদের চেয়ে সংখ্যায় বৃদ্ধি করে দিয়েছেন । অতঃপর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী আন্দোলন এবং তাঁর আবির্ভাব আন্দোলনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে তাদের ওপর বিজয়ী ও কর্তৃত্বশীল করে দেবেন । আমরা ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহ্ ব্যতীত অন্য কোন জাতিকে প্রত্যক্ষ করি না যাদেরকে মহান আল্লাহ্ ইহুদীদের ওপর বিজয়ী করে অতঃপর ইহুদীদেরকে তাদের ওপর বিজয়ী করেছেন ।
তবে জাতিসমূহের ওপর ইহুদীদের প্রতিশ্রুত শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য অর্জন কেবল একবারই হবে, তা দু’বার হবে না । তাদের এ আধিপত্য লাভ তাদের দ্বিতীয় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এবং ফিতনার সমসাময়িক হবে অথবা তারা তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও সৃষ্ট ফিতনা-ফাসাদের মাধ্যমেই তা অর্জন করবে । আর আমরা ইহুদীদের এ শ্রেষ্ঠত্ব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কাল ব্যতীত তাদের ইতিহাসের আর কোন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ করি না ।
আজ ইহুদীরা তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার দ্বিতীয় পর্যায়ে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের তুঙ্গে অবস্থান করছে । আমরা বর্তমানে আমাদের ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের সূচানলগ্নে প্রবেশ করেছি এবং আমরা তাদের কুৎসিত চেহারা উন্মোচন করার পর্যায়ে রয়েছি ঐ সময় যখন মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করবেন । যেমনভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রথমবার মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে পৃথিবীতে তাদের গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি আমরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে অথবা তাঁর সাথে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করব এবং তাদের আধিপত্য, গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকামিতার ধ্বংস সাধন করব ।
তবে ‘যদি তোমরা প্রত্যাবর্তন ও তওবা কর তাহলে আমরাও প্রত্যাবর্তন করব, আর আমরা জাহান্নামকে কাফিরদের জন্য কারাগাররূপে নির্ধারণ করেছি’- মহান আল্লাহর এ বাণী থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসরাইল ধ্বংস হওয়ার পর অনেক ইহুদী পৃথিবীতে থেকে যাবে । যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে না ইমাম মাহ্দী (আ.) তাদেরকে আরব দেশসমূহ থেকে বহিষ্কার করবেন । রেওয়ায়েত অনুসারে তারা আবার নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হবে । আর তা হবে এক চোখ বিশিষ্ট দাজ্জালের ফিতনা চলাকালে । ইমাম মাহ্দী (আ.) এবং মুসলমানরা এ সব ফিতনা সৃষ্টিকারীদের চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করবেন এবং মহান আল্লাহ্ তাদের মধ্য থেকে যারা নিহত হবে তাদের জন্য জাহান্নামকে কারাগার করে দেবেন এবং মুসলমানরা তাদের অবশিষ্টদেরকে কারাগারে অন্তরীণ করে তাদের নাশকতামূলক কর্মতৎপরতা ও ফিতনা চিরতরে বন্ধ করে দেবে ।
(মোহাম্মাদ মুনীর হোসেইন খান কর্তৃক অনুদীত ‘ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।)
তথ্যসূত্র :
১. দ্বিতীয় পুস্তিকা, অধ্যায় ৩৩ : ৫০-৫৩ ।
২. দ্বিতীয় পুস্তিকা, অধ্যায় ১ : ৩৮ ।
৩. বিচারকগণ, অধ্যায় ৩ : ১৩ ।
৪. বিচারকগণ, অধ্যায় ৪ : ২ ।
৫. বিচারকগণ, অধ্যায় ১ : ৮ ।
৬. বিচারকগণ, ১৩ : ১ ।
৭. সূরা বাকারা : ২৪৬ ।
৮. সামূয়েলের পুস্তিকা, ইসহাহ্ (আয়াত) ২৪ :২৪ এবং খবরসমূহ সংক্রান্ত ১ম পুস্তিকা, ইসহাহ্ ২১ : ২২, ২৮ ।
৯. সূরা শুরা : ২৭ ।
১০. রাজন্যবর্গ ও শাসকদের ১ম পুস্তিকা, ইসসাহ্, ১১ : ১-২ ।
১১. জেরুজালেমকে হিব্রু ও আরবীতে ঊর শালিমও (اور شاليم) বলা হয় ।
১২. রাজা ও শাসকবর্গের কাহিনীসমূহ সংক্রান্ত পুস্তিকা, অধ্যায় ১২ : ২৬-৩৩ ।
১৩. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ১২ : ৩১; প্রাগুক্ত, অধ্যায় ১১ : ১৩-১৫ এবং অধ্যায় ১৩ : ৯ ।
১৪. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ১৪ : ২১-২৪; প্রাগুক্ত, ২য় পুস্তিকা, অধ্যায় ১১: ১৩-১৭ এবং অধ্যায় ১২ ।
১৫. রাজা ও শাসকবর্গের কাহিনীসমূহ সংক্রান্ত ২য় পুস্তিকা, অধ্যায় ১৩ : ৩-১৩ ।
১৬. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ২১ : ১৬-১৭ ।
১৭. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ২৪ : ৩ এবং অধ্যায় ১২ : ১৭-১৮ ।
১৮. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ১৪ :১১, অধ্যায় ২৫ : ২১-২৪ ।
১৯. প্রাগুক্ত, ২য় পুস্তিকা, অধ্যায় ১৫ : ২৯ ।
২০. দিবসসমূহের সংবাদ ও তথ্যাবলী, ৫ম অধ্যায় : ২৯ ।
২১. রাজা ও শাসকবর্গের তথ্য ও বিবরণাদি সংক্রান্ত ২য় পুস্তিকা,অধ্যায় ১৭ : ৫, ৬ ও ১৭ ।
২২. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ১৭ : ১৩-১৫ ।
২৩. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ১৮ : ১৩-১৫ ।
২৪. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ২৪ : ১-৬ ।
২৫. প্রাগুক্ত, অধ্যায় ২৪ : ১৭-২০ এবং ২৫; অধ্যায় ৩৬ : ১১-২১; ইরেমিয়ার পুস্তিকা, অধ্যায় ৩৯ : ১-৪ ।
২৬. আযরার পুস্তিকা, অধ্যায় ৬ : ৩-৭, অধ্যায় ১ : ৭-১১ ।
২৭. তিনি মূলত মাকদুন বা ম্যাসেডোনিয়ার অধিবাসী ছিলেন ।
২৮. দানিয়ালের পুস্তিকা, অধ্যায় ১১ :৫ ।
২৯. মেকাবীয়দের পুস্তিকা, অধ্যায় ১ : ৪১-৫৩ ।
৩০. মথির ইঞ্জিল, পৃ. ২ ।
৩১. মারকোসের ইঞ্জিল, ৬ : ১৬-২৮ ।
৩২. সূরা রূম : ১-৫ ।