আল হাসানাইন (আ.)

হোসাইনী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

বীরত্বপূর্ণ কথা হল সেই কথা যা দিয়ে মানুষের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিপুল অনুপ্রেরণা ও অদম্য শক্তি যোগানো যায়। আর প্রকৃত বীরপুরুষ হলেন সেই ব্যাক্তি যার মধ্যে অন্যায় রোধের এ মানসিকতা জোয়ারের মতো উথলে পড়ে। যার মধ্যে মহত্ত্ব,ন্যায়পরায়ণতা,দৃঢ়তা,সততা,সত্যতা,অধিকার রক্ষায় কঠোরতা,সৎ-সাহস এবং মুক্তবুদ্ধি রয়েছে তিনিই হলেন আসল বীরপুরুষ।

কারবালা ঘটনার একপিঠে রয়েছে পাশিবক নৃশংসতা ও নরপিশাচের কাহিনী এবং এ কাহিনীর নায়ক ছিল ইয়াযিদ,ইবনে সা’ দ,ইবনে যিয়াদ এবং শিমাররা। আর অপর পিঠে ছিল একত্ববাদ,দৃঢ় ঈমান,মানবতা,সাহসিকতা,সহানুভূতি ও সহমর্মিতা এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের কাহিনী এবং এ কাহিনীর নায়ক আর ইয়াযিদরা নয়,বরং এ পিঠের নায়ক হলেন শহীদ সম্রাট ইমাম হোসাইন (আ.),তার ভগ্নি হযরত যয়নাব এবং তার ভাই হযরত আব্বাসরা,যাদেরকে নিয়ে বিশ্বমানবতা গৌরব করতে পারে। তাই কারবালা ঘটনার সমস্তটাই ট্রাজেডি বা বিষাদময় নয়। অবশ্য পৃথিবীতে বহু ঘটনাই ঘটেছে যেগুলোর কেবল একপিঠ রয়েছে অর্থাৎ এসব ঘটনা কেবলমাত্র দুঃখজনক ও শোকাবহ।

কিন্তু কারবালাকে এভাবে বিচার করলে অবশ্যই ভুল হবে। এ ঘটনার একটি কালো অধ্যায় ছিল সত্য,কিন্তু আরেকটি উজ্জ্বল অধ্যায়ও আছে। শুধু তাই নয়,এর উজ্জ্বল অধ্যায় কালো অধ্যায়ের চেয়ে শত-সহস্র গুণে ব্যাপক ও শ্রেষ্ঠ । শহীদ সম্রাট ইমাম হোসাইন (আ.) আশুরার রাতে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে প্রশংসা করে বলেনঃ

‘‘আমি পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে বিশ্বস্ত ও উত্তম কোনো সহযোগীর সন্ধান পাইনি।’’ ( দ্রঃ তারিখে তাবারীঃ ৬/২৩৮-৯ , তারিখে কামেলঃ ৪/২৪ ,বিহারুল আনোয়ারঃ ৪৪তম খণ্ড,কিতাবুল ইরশাদঃ ২৩১,এ’ লামুল অরাঃ ২৩৪,মাকতালু মোকাররামঃ ২৫৮,মাকতালু খারাযমীঃ ২৪)

তিনি কিন্তু বললেন না : আগামীকাল তোমাদেরকে নিরাপরাধভাবে হত্যা করা হবে। বরং তিনি এমন এক সনদপত্র পেশ করলেন যার মাধ্যমে তার সহযোগীরা বদরের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা.) সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন,তার পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন। আম্বিয়াদের যারা সাহায্য করেছেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছেঃ

وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّـهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ

‘‘কত নবী যুদ্ধ করেছেন,তাদের সাথে বহু আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি ও নতি স্বীকার করেনি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে পছন্দ করেন।’’ (আল ইমরানঃ ১৪৬)

অথচ ইমাম হোসাইন (আ.) প্রকারান্তরে তার সহযোগীদেরকে আম্বিয়াকেরামের এ সকল সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

সুতরাং আমরা যখন স্বীকার করলাম যে,কারবালার ঘটনায় দু’ টি পিঠ ছিল তখন গৌরবের এ পিঠ নিয়েও আমরা একে গবেষণা করে দেখতে চাই। পাশাপাশি এটিও আমাদের মেনে নিতে হবে যে,এতকাল ধরে আমরা কেবল কারবালার অন্ধকার ও কলুষতার দিকটা নিয়ে মাতামাতি করে বড় ভুল করেছি। কেননা,এতে করে আমরা মনের অজান্তেই ইয়াযিদদেরকে জয়ের মালা পরিয়েছি এবং তাদেরকেই নায়ক বানিয়েছি।

কেউ যদি ইমাম হোসাইনের (আ.) মর্মান্তিক শাহাদাত উপলক্ষে শোক মিছিল করে,অথচ অমানুষ ইয়াযিদের নামের পাশে সম্মানসূচক নানান শব্দও ব্যাবহার করে থাকে-তাহলে সে কারবালা থেকে কোন শিক্ষাই নিতে পারলো না। মহাপুরুষদের শ্রদ্ধা করা মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি । অভ্যাসকে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা একান্তই বোকামি। কিন্তু মহাপুরুকে যেমন সম্মানভরে স্মরণ করা হয় তেমনি কাপুরুষকেও অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত। কেননা,মহাপুরুষ ও কাপুরুষ উভয়কেই যদি আমরা শ্রদ্ধা করলাম-তাহলে হক আর বাতিলের মধ্যে আর কি-ই বা তফাৎ থাকলো? কাজেই,যে কেবল ইমাম হোসাইনের (আ.) মজলুমতাকে নিয়েই মূর্ছিত হবে সে যেমন ভুল করবে ঠিক তেমনিভাবে যে ইয়াজিদকে নায়ক বানিয়ে তার নামের পাশে সম্মানার্থক বিভিন্ন উপাধি ব্যাবহার করবে সেও একজন কাপুরুষকেই স্বীকৃতি দিল। যদিও আমরা সবাই ইমাম হোসাইনকে (আ.) শ্রদ্ধা করি।

দ্রুত পরিবর্তনশীল বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের ভাগ্য নিজের হাতেই গড়ার স্বার্থে হোসাইনী আন্দোলনের যথার্থ মূল্যায়নের মাধ্যমে আজ সেভাবেই এগিয়ে যাবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে উেঠেছ। সুখের ব্যাপার হল যে,মুসলমানরা ইদানীং এ ব্যাপারে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

যারা বীর তাঁদের আত্মা সাহসী। তারা তাদের এ সাহসকে নিজের দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু যে বীর তার সাহসকে এমন কি মানবতার স্বার্থকে পেরিয়ে সমস্ত সৃষ্টিকুলের কল্যাণে প্রয়োগ করে-তিনি অবশ্যই আদর্শ ও অনুকরণীয়। কেননা তিনি সমস্ত শক্তি ও সাহসকে একমাত্র মহান অধিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই কাজে লাগিয়েছেন। আর এ কারণেই এ বীরত্ব মহান ও পবিত্রও বটে।

ভীরু কোনিদন বীর হতে পারে না। নাদির শাহ,বখিতয়ার খিলজী,নেপোলিয়ান-এরা সবাই সাহসী। সাহস ছিল বলেই এরা দেশজয় করতে পেরেছিল। এদের সবারই দৃঢ় মনোবল ও দুর্দম সাহস ছিল। এরা বীরও ছিল বটে। কিন্তু তাদের এ সাহস-তাদের এ বীরত্ব পবিত্র ও মহৎ নয়। এদের সবাই হুকুমতের লোভে,পদের লোভে ও স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই সাহস দেখিয়েছে। এরা অন্য জাতির রক্ত নিংড়িয়ে নিজের নাম ইতিহাসে অমর করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। স্বদেশের কাছে সে হয়তো একজন মহাবীর,কিন্তু পরাজিত জাতির কাছে সে চরম শত্রু। নেপোলিয়ান ফরাসিদের চোখে হয়তো একজন মহান বীর,কিন্তু রুশ কিংবা ইংরেজদের কাছেও কি সে মহাবীরের সম্মান পাবে? -কখনই না। কারণ,সে রুশ ও ইংরেজদের মান-ইজ্জত পদদলিত করে ফ্রান্সের মর্যাদা বাড়াতে চেয়েছিল। এসব ব্যক্তি সাহসী বীর ছিলেন। কিন্তু তাদের বীরত্ব আত্মসিদ্ধির বীরত্ব । নিজের স্বার্থ পুরণের বীরত্ব । একজন বড় সাম্রাজ্যবাদীর বীরত্ব । কিন্তু এ বীরত্ব তো কখনো মহৎ হতে পারে না। মহৎ ও পবিত্র বীরত্বের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন রকম। সে সব বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে,নেপোলিয়ান,ইস্কান্দার এরা মহান বীর ছিল না। মহান বীর হলো সেই ব্যক্তি যিনি নিজের স্বার্থ,দেশের স্বার্থ,জাতির স্বার্থ,এমন কি নিজের মহাদেশেরস্বার্থের জন্যেও বাহাদুরি দেখায় না। তার লক্ষ্য এসব দেশ-জাতির সীমানার উর্ধ্বে । সে কেবল হাকীকত ও সত্যকেই দেখে। সংক্ষেপে বলতে গেল বলতে হয় যে,সে সমস্ত মনুষ্যত্বও মানবতার জন্যে নিজের সাহস প্রয়োগ করে। উদাহরণস্বরূপ কোরআনের এই আয়াতটি উল্লেখ্য :

) قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّـهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّـهِ(

‘‘বলুন,হে আহলে কিতাবগণ! এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই;যেন আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারো উপাসনা না করি,কোনো কিছুকেই তার শরীক না করি এবং আল্লাহ ব্যাতীত আমাদের কাউকে প্রতিপালক রূপে গ্রহণ না করি।’’ (আল ইমরানঃ ৬৪)

অর্থাৎ তোমরা যারা আহলে কিতাব বলে দাবী করো! এসো আমরা সবাই এক সুরে কথা বলি;এক আকীদার স্বার্থে আমরা নিজেদেরকে বিলীন করে দেই,আমরা সবাই জোর কন্ঠে ঘোষণা করিঃ

‘আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও দাসত্ব মানি না।’

এসো শোষণ-নিপীড়নের অবসান ঘটাই,মানব পূজা বন্ধ করি,সমাজে ন্যায়-নীতি এবং সমতা ও সামঞ্জস্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করি। কোরআন বলেনি যে,এসো আমার ও তোমার জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অপর এক জাতিকে শোষণ করি। এ ধরনের কোনো কথাই কোরআনে পাওয়া যাবে না। তাই কোনো আন্দোলন-কোনো বীরত্ব তখনই মহান ও পবিত্র হবে যখন তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও পবিত্র ও মহান হবে,তা সমস্ত মানবতার পথে পরিচালিত হবে যেমনভাবে সূর্য তার আলো দিয়ে সমস্ত জাতি ও সব মানুষকেই উপকার প্রদান করে।

দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য কোনো আন্দোলন ও বিদ্রোহকে মহান করে তা হলো এমন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আন্দোলন অনুষ্ঠিত হবে যখন কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না। ঘন অন্ধকারের মধ্যে এক খণ্ড আলোর ঝলকানি,ব্যাপক জুলুম-স্বৈরাচারের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার বজ্র আওয়াজ,চরম স্থবিরতার মধ্যে প্রকাণ্ড ধাক্কায় নিস্তব্ধ নিশ্চুপের মধ্যে হঠাৎ গর্জে ওঠা। উদাহরণস্বরূপ নমরুদের মতো একজন অত্যাচারী শোষক পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু আজীবন এ পিরিস্থিতি অব্যাহত থাকেনি। হঠাৎ করে একজন ইবরাহীমের (আ.) আবির্ভাব ঘটে ও নমরুদের কাল হয়ে দাঁড়ায়।

) إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا(

‘‘ইবরাহীম একাই এক অনুগত জাতি ছিলেন।’’ (নাহলঃ ১২০) তেমনি ফেরাউনের মতো একজন নির্দয় ও অহংকারীও রক্ষা পায়নি। কোরাআন ভাষায় :

) إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلَا فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعًا يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ(

‘‘ফেরাউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদেরকে সে হীনবল করেছিল। তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করতো এবং নারীদেরকে সে জীবিত রাখত।’’ (কাসাস-৪)

কিন্তু এই পরাক্রমশালী ফেরাউনও টেকেনি। হঠাৎ করে একজন মূসা (আ) তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন।

তারপর আরব যখন শোষণ-নিপীড়ন,মূর্তিপূজা,কন্যাসন্তানকে জীবিত হত্যা,রক্তপাত,দ্বন্দ-কলহ,ব্যভিচারে এবং অন্ধকারে ছেয়ে গেল তখন একজন মুহাম্মদের (সা.) আবির্ভাব হয় যিনি ফরিয়াদ করে বলতে থাকেনঃ

‘‘বলো,আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই,তবেই তোমরা সুখী হতে পার।”

আর আজ স্বৈরাচারী উমাইয়া সরকার স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সকল সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। এমন কি ধর্মকে ভাঙ্গিয়েও স্বৈরতন্ত্রের ভিত গাড়তে উদ্যত হয়েছে,দুনিয়ালোভী হাদীস বর্ণনাকারীদেরকে টাকা দিয়ে কিনে তাদের সপক্ষে হাদীস জাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়,একজন দরবারী আলেম বলেছিলঃ

انّ الحسین قتل بسیف جدّه

‘‘ ইমাম হোসাইন (আ.) তার নানার তেলোয়ারের আঘাতেই নিহত হয়েছেন।’’ একথার মাধ্যমে সে বলতে চেয়েছিল যে,ইমাম হোসাইনের (আ.) নানার ধর্মমতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

কিন্তু আমি (ওস্তাদ মোতাহারী) বলবো যে,এক অর্থে একথা ঠিকই। কেননা,বনি উমাইয়া ইসলামকে এমনভাবে তাদের শোষণ ও স্বৈরাচারের সেবায় নিয়োগ করতে পেরেছিল যে,একদল দুনিয়ালোভী ও নামমাত্র মুসলমানকে ইসলামী জিহাদের নামে ইমাম হোসাইনের (আ.) বিরুদ্ধে লিপ্ত করতে সক্ষম হয়।

‘‘তারা ইমাম হোসাইনের (আ.) বুকের রক্ত ঝরিয়ে আল্লাহর নৈকট্য পেতে চায়।’’

তারা ইমাম হোসাইনকে (আ.) হত্যা করতে পারার জন্যে শোকর আদায়স্বরূপ একাধিক মসিজদ নির্মাণ করে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে,মানুষকে কিভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল।

এ রকম এক বিপর্যয়ের মুহুর্তে ইমাম হোসাইন (আ.) মুক্তির মশাল জ্বালিয়ে এগিয়ে এলেন। যখন মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল,মানুষের মতামত প্রকাশের কোনো সাহস ছিল না। কোনো সত্যি কথা বলাও যখন কারও সাহসে কুলাতোনা,এমন কি এর কোনো প্রতিরোধ অবাস্তবে পরিণত হয়-ঠিক সে মুহুর্তে ইমাম হোসাইন (আ.) বীরদর্পে বিরোধিতায় নামলেন,বজ্রকন্ঠে সত্যবাণীর স্লোগান তুলে দুনিয়া কাপিয়ে দিলেন। খোদাদ্রোহী স্বৈরাচারের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিলেন। আর এ কারণেই তার আন্দোলন মহিমা লাভ করেছে। তার আন্দোলন কালের গন্ডী ছাড়িয়ে যুগ-যুগান্তরের মুক্তি কামী ও সত্যান্বেষী মানুষের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে।

তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি হোসাইনী আন্দোলনকে মহতী ও পবিত্র করেছে তা হলো ইমাম হোসাইনের (আ.) দুরদর্শিতা ও উন্নত চিন্তাধারা। অর্থাৎ এ আন্দোলন এ কারণেই মহান যে,আন্দোলনকারী যা বুঝতে ও দেখতে পারেছন তা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ঐ প্রবাদ বাক্যেটির মতো বলতে হয় যে,অন্যরা আয়নায় যা দেখতে পাচ্ছে না তিনি খড়কুটোর মধ্যেই তা দেখছেন। তিনি তার একাজের সুদূর প্রসারী ভাব দেখতে পাচ্ছেন। তার চিন্তাধারা সমসাময়িক যেকানো চিন্তাশীল লোকের উর্ধ্বে । ইবনে আব্বাস,ইবনে হানাফিয়া,ইবনে উমর প্রমুখ হয়তো পুরোপুরি নিষ্ঠার সাথে ইমামকে (আ.) কারবালায় যেতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের চিন্তার মান অনুযায়ী ইমামকে বাধা দেয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হোসাইন (আ.) যা দেখেছিলেন তারা তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারা অত্যাসন্ন বিপদকেও যেমন অনুভব করছিলেন না তেমনি এ ধরনের আন্দোলন ও বিদ্রোহের সুদুরপ্রসারী ভাবকেও অনুধাবন করতে পারছিলেন না। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) সবকিছুই দিনের আলোর মতো দেখছিলেন। তিনি একাধিকবার বলেছেনঃ ওরা আমাকে হত্যা করবেই;আর আল্লাহর শপথ করে বলছি যে,আমার হত্যার পর ওদের অবস্থা বিপন্ন হবে। এ ছিল ইমাম হোসাইনের (আ.) তীক্ষ্ণ দুরদর্শিতা।

ইমাম হোসাইন (আ.) এক মহান ও পবিত্র আত্মার নাম। মূলত যখন কোন আত্মা মহান হয় তখন বেশী কষ্টের সম্মুখীন হয়। কিন্তু ছোট আত্মা অধিক নির্ঝঞ্জাটে থাকে। এ এক সার্বিক নিয়ম। ইবনে আব্বাসরা যদি ইমাম হোসাইনকে (আ.) বাধাও দেয় তবুও কি তিনি বিরত হতে পারেন! আরবের খ্যাতনামা কবি‘ মোতানাববী’ এ প্রসঙ্গে সুন্দর একটি উক্তি করেছেন,তিনি বলেন :

‘‘যখন কোনো আত্মা মহান হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সে অন্যদের পরিত্রাণে ছোটে,অন্যদের জন্যে কষ্ট ও যন্ত্রণা বরণ করে নেয়। কিন্তু যার আত্মা ছোট সে কেবল নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিয়েই।’’ ( দিওয়ানে মোতানাববীঃ ২/২৬৭)

ছোট আত্মা একটু ভাল খাবারের জন্যে চাটুকারও হতে রাজি। ছোট আত্মা ক্ষমতা বা খ্যাতির লোভে হত্যা-লুন্ঠনও করতে রাজি। কিন্তু যার রয়েছে মহান আত্মা ,সে শুকনো রুটি খেয়ে তৃপ্ত হয়,তারপর ঐ সামান্য আহার শেষে সারারাত জেগে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হয়। নিজের দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র গাফলতি করলে ভয়ে তার শরীর কাপতে থাকে। যার আত্মা মহান সে আল্লাহর পথে ও স্বীয় মহান লক্ষ্যে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে চায়। আর এ পথে যখন সফলকাম হয় তখন আল্লাহকে শোকর করে। আত্মা মহান হলে আশুরার দিনে,এক শরীরে তিনশ’ ক্ষত সহ্য করতে হয়। যে শরীর ঘোড়ার পায়ে পয়মল হয় সে একটি মহান আত্মার জরিমানা দেয়,একটি বীর,সত্য পূজারী এবং শহীদের আত্মার জরিমানা দেয়।

এই মহান আত্মা বলে ওঠে আমি আমার রক্তে মূল্য দিতে চাই। শহীদ কাকে বলে? প্রতিদিন কত মানুষ নিহত হচ্ছে । কিন্তু তাদেরকে কেন শহীদ বলা হয় না? শহীদ শব্দটি ঘিরে কেন এক পবিত্রতার আবেশ পাওয়া যায়? কারণ শহীদ সেই ব্যক্তি যার এক মহান আত্মা আছে সে আত্মা এক মহান লক্ষ্যকে অনুসরণ করে। শহীদ সে ব্যক্তি যে স্বীয় ঈমান ও আকীদা রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে,যে নিজের জন্যে তো নয়ই বরং মনুষ্যত্ব ও মানবতার স্বার্থে,সত্য ও হাকিকতের স্বার্থে চরম দুঃখ-দুর্দশা এমন কি মৃত্যুকেও সাদরে বরণ করে নেয়। শহীদ তার বুকের রক্ত দিতে চায় যেমনভাবে একজন ধনী তার ধনকে ব্যাংক বন্দী না করে তা সৎপথে দান-খয়রাত করে স্বীয় ধনের মূল্য দিতে চায়। সৎপথে ব্যয়িত প্রতিটি পয়সা যেমন লক্ষ -কোটি পয়সার মতো মূল্য লাভ করে তেমনি শহীদের প্রতি ফোটা রক্ত লক্ষ-কোটি ফোটায় পরিণত হয়। অনেকে হয়তো স্বীয় চিন্তাশক্তির মূল্য দেয় ও একটি আদর্শিক গ্রন্থ মানবকে উপহার দেয়। কেউ কেউ নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি উপকারী শিল্প মানুষকে উপহার দেয়। কিন্তু শহীদরা তাদের রক্ত দিয়ে মানবের শান্তি ও কল্যাণের পথকে মসৃণ ও সুনিশ্চিত করে।

এখন প্রশ্ন হলো: এদের মধ্যে কে মানবতাকে সবচেয়ে বেশী সেবা করলো ?

অনেকে হয়তো ধারণা করতে পারে যে,একজন লেখক বা একজন ধনী কিংবা একজন শিল্পীর সেবাই সবচেয়ে বেশী। কিন্তু আসলে এ ধারণা একবারেই ভুল। শহীদদের মতো কেউই মানুষকে তথা মানবতাকে সেবা করতে পারে না। শহীদরাই সমস্ত কন্টকময় পথ পেরিয়ে মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতাকে বয়ে নিয়ে আসে। তারাই ন্যায়-নীতিবান ও শান্ত সমাজ গড়ে দিয়ে যায় যাতে জ্ঞানীর জ্ঞান,লেখকের কলম,ধনীর ধন,শিল্পীর শিল্প সুস্থ পরিবেশে বিনা বাধায় বিকাশ লাভ করতে পারে এবং মানবতা নিশ্চিন্তে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শহীদরাই প্রদীপের মতো একটি পরিবেশকে আলোকিত করে রাখে যাতে সবাই অনায়াসে পথ চলতে পারে।

পবিত্র কোরআন রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে একটি প্রদীপের সাথে তুলনা করেছে। জগতে অবশ্যই প্রদীপ থাকতে হবে। অন্ধকার জগত নীরব-বধির,জীবনযাত্রা সেখানে অচল। এ সম্বন্ধে প্রখ্যাত কবি পারভীন এ’ তেসামী সুন্দর একটি উপমার অবতারণা করেছেন। তিনি একজন দক্ষ শিল্পী ও একটি প্রদীপের কথোপকথনকে এভাবে চিত্রিত করেছেন-

শিল্পী প্রদীপকে বলেঃ‘ তুমি জান না,আমি গত রাতে এক মুহুর্তেও ঘুমাইনি। সারা রাত জেগে কত সুন্দর সুন্দর ফুল তুলেছি। আমার জামাটিকে ফুলবাগিচা বানিয়েছি। তুমি কখনোই আমার মতো ফুল তুলতে পারবে না। আমি আমার শরীরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে অসামান্য দক্ষতা খরচ করেছি।’

শিল্পীর একথা শুনে প্রদীপ একটু মুচকি হেসে বললোঃ

তুমি যে দাবী করছো সারা রাত জেগে তোমার রুচি ও দক্ষতাকে ফুটিয়ে তুলেছো-এসবই ছিল আমার আত্ম -নিঃশেষ করার ফল। আমি তিলে তিলে ক্ষয় হয়েছি ও তোমাকে আলো দিয়েছি বলেই তো তুমি তোমার দক্ষতাকে সুচ ও সুতোয় আাকতে পেরেছো। তোমার এসব দক্ষতা আমার জীবনের বিনিময়েই সম্ভব হয়েছে। তারপর বলছে:

‘তাই তুমি সারা রাত ধরে যা করেছ বলে দাবী করছো-এসবই আমি করেছি।’

আজকে ইবনে সিনা-ইবনে সিনা হতো না,শেখ সাদী-শেখ সাদী হতো না,জাকারিয়া রাজী-জাকারিয়া রাজী হতে পারতো না যদি শহীদরা তাজা রক্ত খরচ করে ইসলামের চারাগাছকে সজীব না করতেন,ইসলামী সভ্যতাকে বাঁচিয়ে না রাখতেন। তাদের সমস্ত অস্তিত্বে একত্ববাদ, খোদাভীতি,ন্যায়পরায়ণতা,সৎসাহস আর বীরত্বে ভরপুর। তাই আমরা আজ যারা মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি তারা সবাই এ শহীদদের প্রতি ঋণী। ইমাম হোসাইনের (আ.) রক্তের প্রতি নবীজীর (সা.) উম্মত ঋণী।

ইমাম হোসাইনের (আ.) বাণী কমই আমাদের কাছে পৌছেছে। তবে যেটুকু আছে তা থেকেই তার এ মহান মানসিকতার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো যে,আপনি যেসব কথা নিজ কানে রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছ থেকে শুনেছেন তার থেকে দু’ একটি আমাদেরকে বলুন। তখন ইমাম হোসাইন (আ.) রাসূলুল্লাহর (সা.) শত-সহস্র বাণীর মধ্যে কোন বাণীটি নির্বাচন করলেন তা থেকেই সহজে ইমাম হোসাইনের (আ.) ব্যক্তিত্বের ধরন অনুধাবন করা যায়। ইমাম হোসাইন (আ.) বললেন,আমি নিজ কানে রাসূলুল্লাহর (সা.) মুখ থেকে যা শুনেছি তা হলোঃ

‘‘আল্লাহ বড় এবং মহান কাজকে পছন্দ করেন এবং নীচ কাজকে তিনি ঘৃণা করেন।’’ (জামেউস সাগীর ১/৭৫)

ইমাম হোসাইনের (আ.) মর্যাদা এবং মহত্ত্ব কোথায়! রাসূলুল্লাহর (সা.) বাণী থেকে কোনটি নির্বাচন করে নিলেন ? মূলত তিনি নিজেকেই তুলে ধরেছেন।

ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতিটি কথায় মনুষ্যত্ব ও মানবতার ইজ্জত সম্মান এবং মর্যাদা প্রতিফলিত হয়েছে। -

مَوْتُ فِی عِزٍّ خَيْرٌ مِنْ حَيَاةٍ فِی ذُلٍّ

‘‘সম্মানের মৃত্যু অপমানের জীবনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’’

অন্য এক বাণীতে তিনি বলেন :

‘যা কিছুর উপর সূর্য আলো দান করে-সারা দুনিয়া এবং তার বাসিন্দারা,সাগর-মাটি,পাহাড়-পর্বত-মরুভূমি এসব কিছুই একজন খোদাভক্ত এবং খোদা-পরিচিত ব্যক্তির কাছে একটি ছায়ার চেয়ে মূল্যবান কিছু নয়। এরপর তিনি বলেন :

‘এমন কাউকে কি পাওয়া যাবে না যে দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে তার প্রতি অনাসক্ত থাকবে?’ (লুমআতু মেন বালাগাতিল হোসাইন নাফাসুল মাহমুম)

যারা দুনিয়া নিয়ে মত্ত এং দুনিয়ার দাসত্ব করে তারা আসলে জানে না যে,এমন কিছু‘ লুমাযাহ’ র মতো।‘ লুমাযাহ’ -র অর্থ কী? মানুষ যখন ভাত খায় তখন তার দাঁতের ফাঁকে হয়তো এক টুকরো গোস্ত কিংবা এক টুকরো খাবার বেঁধে থাকে। যা খুঁচিয়ে বের করতে হয়। এই বেঁধে যাওয়া খাদ্য টুকরোকেই‘ লুমাযাহ’ বলে। ইমাম হোসাইনের (আ.) চোখে ইয়াযিদ,ইয়াযিদের হুকুমত,ইয়াযিদের দুনিয়া সবকিছুই ঐ এক টুকরো লুমাযাহর মতো।

তারপর তিনি বলেনঃ ‘‘হে মানুষ! জেনে রেখো যে,জগতে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কিছু নেই যার কাছে তুমি নিজেকে সোপর্দ করতে পারো। যার কাছে তুমি নিজের আত্মা ও জীবনকে বেচে দিতে পারো। তোমরা দুনিয়ার কাছে নিজেকে বেচে দিও না,স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ হও,দাসত্বের শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধে ফেলো না। ইসলামের অনুসারী হও। একমাত্র ইসলামই তোমাদেরকে মুক্তি ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে পারে। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর। তাহলেই পরাধীনতার শৃঙ্খল তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই উপাসনার যোগ্য নয়। একমাত্র আল্লাহকে উপাসনা করো তাহলে দুনিয়া নিজেই তোমাদের পদতলে সমাহিত হবে।’’

কারবালার পথে অনেকেই ইমাম হোসাইনকে (আ.) বলেছে যে,এ পথ বিপজ্জনক? আপনি বরং ফিরে যান। ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের জবাবে এ কবিতা পড়েনঃ

‘‘আমাকে যেতে নিষেধ করছো? কিন্তু আমি অবশ্যই যাবো। আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাও? একজন বীরের কাছে কি মৃত্যু অপমানজনক? যে ব্যক্তি অসৎ ও নীচ লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ করে এবং তাতেও পৌঁছতে পারে না এদের জন্যে মৃত্যু অপমানের হতে পারে। কিন্তু যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম কাজ অর্থাৎ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে নিহত হয় তার জন্যে তো অপমানের হতে পারে না! তার রাস্তা সেই রাস্তা যেখান দিয়ে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ও সৎ বান্দারা চলেছেন।

সুতরাং যেহেতু আমার এ পথ হতভাগ্য,পাপিষ্ট ও দুর্ভাগা ইয়াযিদের বিরোধী পথ তাই আমাকে আমার এ পথে চলতে দাও। হয় বাঁচবো না হয় মরবো-এ দুটোর বাইরে তো আর কিছু নয়।

যদি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকি তাহলে কেউ তখন বলতে পারবে না যে,কেন বেঁচে আছেন?

‘‘আর যদি মারা যাই তাহলেও কেউ আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না যদি সে জানে আমি কি জন্যে নিহত হলাম ?’’

‘‘কিন্তু জেনে রেখো যে জীবনের জন্যে সবচেয়ে অপমান হলো কেউ বেঁচে থাকবে বটে,কিন্তু লোকে তার কান ধরে উঠাবে আর বসাবে।’’ এ বক্তব্যেও পৌরুষত্ব ও বীরত্বের ছাপ পরিস্কার চোখে পড়ে। পথিমধ্যে আরেকটি বক্তৃতায় তিনি বলেন :

‘তোমরা চোখে দেখছো না যে সত্যকে মেনে চলা হচ্ছে না ও বাতিলের বিরুদ্ধেও কেউ কিছু বলছে না?’

‘‘আমি মৃত্যুকেই আমার জন্যে কল্যাণকর এবং জালেমদের সাথে বেঁচে থাকাকে অবমাননা ও লজ্জাকর মনে করি।’’

ইমাম হোসাইনের (আ.) সব কথা বর্ণনা করতে গেল দীর্ঘ হয়ে যাবে। তবে এখানে আশুরার রাতের এক দিকের প্রতি ইশারা করা দরকার যে দিকগুলোর প্রতি খুব কমই লক্ষ্য করা হয়।

ইতিহাসের সব স্মরণীয় পুরুষই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন,যে পরিস্থিতিতে ইমাম হোসাইন (আ.) পড়েন আশুরার রাত্রে । অর্থাৎ বস্তুগত দিক দিয়ে তিনি সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন এবং শত্রুকে পরাজিত করার বিন্দুমাত্র আশা নেই বরং অতিশীঘ্রই তিনি তার সঙ্গী-সাথীসহ শত্রুদের হাতে খণ্ড-বিখণ্ড হবেন এটিই নিশ্চিত হয়ে ওঠে। অনেকেই এ মুহুর্তে অভিযোগ করেন,আফসোস করেন ইতিহাস এ ধরনের বহু ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী। বলা হয় যে,নেপোলিয়ন যখন ঐ পরিস্থিতিতে পড়লো তখন বলেছিল : হায় প্রকৃতি! তুমি আমাকে এভাবেই মারলে।

কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) সবকিছু বুঝতে পেরেও মৃত্যু নির্ঘাত জেনেও আশুরার রাতে কী বলছেন? তিনি সঙ্গী-সাথীদেরকে সমবেত করলেন যেন যে কোনো বিজয়ীর চেয়েও তার মানসিকতায় উজ্জ্বলতার ঢেউ খেলে যাচ্ছে । তিনি বললেন :

‘‘আল্লাহকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রশংসা জানাই এবং সুখে-দুঃখে সব অবস্থাতেই তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ আমাদেরকে নবুওয়াত দিয়ে সম্মানিত করেছেন,আমাদেরকে কোরআনের জ্ঞান দিয়েছেন এবং আপনার দীন পালনে আমাদেরকে সফল করেছেন-তাই আপনার লাখো শোকরিয়া আদায় করছি।’’

যেন সবকিছুই ইমাম হোসাইনের (আ.) অনুকূলে আছে এবং সত্যি -সত্যিই সবকিছু তার অনুকূলে ছিল। কেননা এ পিরিস্থিতি একমাত্র তার জন্যেই দুঃখবহ ও প্রতিকূল,যে কেবল দুনিয়া ও ক্ষমতা চায় আর ব্যর্থ হয়ে এখন মৃত্যুর প্রহর গুণছে। কিন্তু যার সবকিছুই আল্লাহর জন্যে,এমন কি যদি হুকুমতও চান তাহলেও তা আল্লাহর জন্যই চান এবং জানেন যে আল্লাহর পথেই এগিয়ে এসেছেন তাহলে তার কাছ তো এ পিরিস্তিতি অবশ্যই অনুকূল। এজন্যে তিনি আল্লাহর কাছে শোকরগুজারী-ই তো করবেন।

মোটকথা আমরা দেখলাম যে,এ আন্দোলনের গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত কেবল পৌরুষত্ব,বীরত্ব,সত্যানুসরণ এবং সত্যপূজা। কিন্তু এ বীরত্ব কোনো গোত্র বা দেশ বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়,এতে কোনো ‘‘আমিত্ব’’ এবং আত্মস্বার্থ নেই। সবই ও সবকিছুই আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর পথে। তিনি এ পথে শেষ নিশ্বাস নেয়া পর্যন্ত ও অটল ছিলেন। যুদ্ধক্লান্ত ইমাম হোসাইন (আ.) যখন শেষ তীর খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন তখনও সে কেবলা থেকে কখনও পথভ্রষ্ট হননি যে কেবলার দিকে ফিরে পরম শান্তিতে বললেন

‘আপনার বিচারে আমি সন্তুষ্ট,আপনার আদেশের প্রতি আমি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত,আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই হে অসহায়দের সহায়।’ ( বিহারুল আনোয়ারঃ ৪৪/৩৮৩ ,তুহাফুল উকুলঃ ১৭৬,আল-লুহুফঃ ৩৩,মাকতালু মোকাররামঃ ২৩২, তারিখে তাবারীঃ ৬/২২৯ , তারিখে ইবনে আসাকেরঃ ৪/৩৩৩ , কাশফুল গোম্মাহঃ ২/৩২)

হোসাইনী আন্দোলন মুসলিম সমাজের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের আন্দোলন

সব মুসলমানই বিশ্বাস করে যে,ইমাম হোসাইন (আঃ) স্বীয় প্রাণকে কোরবানি করে ইসলামের প্রাণকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তার বুকের রক্ত দিয়ে ইসলামের চারাগাছকে পুষ্ট ও সজীব করে তুলেছেন। আমরা এ সত্য বিশ্বাস করি বলেই ইমাম হোসাইনের (আঃ) যিয়ারত পড়ার সময় আমরা বলিঃ

اَشْهَدُ اَنَّكَ قَدْ اَقَمْتَ الصَّلَاةَ وَآتَيْتَ الزَّکاةَ وَ اَمَرْتَ بِالْمَعْرُوفِ وَ نَهَيْتَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ جَاهَدْتَ فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ

‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আপনি নামায কায়েম করেছেন,যাকাত প্রদান করেছেন,সৎকাজের আদেশ দিয়েছেন,অসৎকাজে বাধা দিয়েছেন এবং সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন। (মাফাতিহুল জিনান)

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে ইমাম হোসাইনের (আঃ) প্রাণ হারানোর সাথে ইসলামের প্রাণ ফিরে পাবার মধ্যে কি সম্পর্ক থাকতে পারে? কেননা রক্তপাত ঘটলেই যে ইসলাম শক্তি লাভ করবে-এমনতো কোনো কথা নেই। ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাত ও ইসলামের পুনরুজ্জীবনের মধ্যকার যে নিগুঢ় সম্পর্ক আছে বলে আমরা দাবি করে এসেছি এবং ইতিহাসও যে সম্পর্ককে সাক্ষ্য দেয় সেটা আসলে কতদুর সত্য -সে সম্পর্কে এ পর্যায়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।

যদি ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাত স্রেফ একটি দুঃখজনক ঘটনা কিংবা একজন নিরপরাধ মানুষের অনর্থক হত্যার ঘটনা হতো তাহলে তিনি হয়তো বড় জোর একজন সম্মানীত ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত হতেন। কিন্তু তার এ আত্মদানের সূত্র ধরে মুসলিম বিশ্বে যে আমূল পরিবর্তন এবং সুদূর প্রসারী ও সাড়া জাগানো প্রভাব পড়েছিল-তা কখনোই হত না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হোসাইনী আন্দোলন মুসলিম বিশ্বকে যেভাবে ‘‘মুক্তি সোপান’’ হিসেবে পথ দেখিয়ে এসেছে তার কারণ হলো,এ আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে ইসলামী ও ঐশী আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি আন্দোলন। তদুপরি এ আন্দোলনের নেতা ছিলেন এমন একজন কালজয়ী মহান বীরপুরুষ যিনি তলোয়ারের উপরে রক্তের বিজয় এনে সত্যের পতাকাকে উন্নীত করেছেন। তিনি মুসলিম সমাজের শিরায় শিরায় নতুন প্রাণস্পন্দন জাগিয়েছেন।

আগই বলা হয়েছে যে,কোনো মহান ও বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য হলো যে,তা মানুষের অন্তরের গভীরে বীরত্বের সাড়া জাগায়। রক্তের কণায় কণায় মুক্তিকামী স্পৃহা সঞ্চার করে দেয় এবং সকল গাফলতি ও অচৈতন্যের কালো অমানিশার অবসান ঘটিয়ে সমাজে জাগরণের ঢেউ সৃষ্টি করে।

অনেক সময় দেখা যায় কোনো রক্তাক্ত ঘটনা মানুষকে সজাগ ও প্রাণবন্ত না করে বরং তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও হতাশার বীজ ছড়ায়। তাদের রক্তে জোয়ার না এনে তাকে জমাটবদ্ধ করে দেয়। তার কারণ হলো এসব ঘটনায় কেবল অনর্থক রক্তপাত,প্রাণহানি এবং নিরাপত্তার অভাব সৃষ্টি হয়। আবার এমন অনেক ঘটনা আছে যা রক্তাক্ত বটে কিন্তু এ সমস্ত ঘটনা সমাজকে মুক্তিকামী এবং শূচি-শুভ্র করে তোলে। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ও দেখা যায় কোনো কোনো কাজ আমাদের অন্তরকে কালিমায় লিপ্ত করে দেয়। পক্ষান্তরে,কিছু কিছু কাজ আছে যা করলে আমাদের অন্তর নির্মল এবং শুভ্র হয়ে ওঠে। সমাজের বেলায়ও একথা প্রযোজ্য । কোনো কোনো ঘটনা সমাজের প্রাণসত্তাকে কলুষময় করে দেয়,হতাশা-নিরাশা আর ভয়-ভীতি সঞ্চারণের মাধ্যমে সমাজকে হীনবল ও দাসত্ব করার মনোবৃত্তি সম্পন্ন করে তোলে। অথচ এমন কিছু ঘটনা আছে যা সমাজকে দাসত্বের থেকে মুক্ত করে,দুর্বার সাহসী ও সকল পঙ্কিলতা দূর করে তাকে স্বচ্ছ করে তোলে।

ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাতের পরে মুসলিম সমাজও এভাবে সমস্ত দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করার সুযোগ পেল। সমাজের সকল পঙ্কিলতা দূর হয়ে সেখানে প্রবেশ করলো শান্তির মুক্ত -শীতল বায়ু । তিনি চরম বীরত্বের সাথে শক্তহাতে মুসলিম সমাজের হারানো ব্যক্তিত্বকে পুনরায় ফিরিয়ে দিলেন। তিনি সেই কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত হানলেন যার ফলশ্রুতিতে সেখান থেকে প্রতিটি মুসলমান একেকজন মুমীন,সাহসী,সত্যান্বেষী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে পুনর্জন্ম লাভ করলো।

ব্যক্তিত্বের অনুভূতি অমূল্য সম্পদ। সমাজের জন্যে এ সম্পদ অনেক বড় জিনিস। যে সমাজ আত্মশক্তিতে বলীয়ান,যে সমাজ একটি স্বাধীন আদর্শ ও স্বতন্ত্র জীবনদর্শন অনুসরণ করে বেঁচে থাকে,যে সমাজ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সর্বোপরি যে সমাজের ব্যক্তিত্বের অহংকার আছে-তার চেয়ে ধন্য ও সমৃদ্ধ সমাজ কি হতে পারে?

যে সামজ স্বীয় ব্যক্তিত্বকে বিকিয়ে দিয়ে পরের দাসত্বকে মেনে নেয় তার চেয়ে জঘন্য সমাজ দ্বিতীয়টি নেই। ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা সমাজের জন্যে দূরারোগ্য ব্যাধির সমতুল্য । এতে সমাজ উন্নত ও মহান না হয়ে অধঃপতনের অন্ধ কুয়ায় বিলীন হয়ে যায়।

স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জীবনদর্শনকে বিকিয়ে দিলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু কোনো জাতি যদি সব কিছুকে হারিয়েও তার স্বীয় স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিত্বকে অটুট রাখতে পারে তাহলে অচিরেই সে পুনরায় সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। অর্থাৎ একমাত্র যে জিনিস কোন সমাজ কিংবা ব্যক্তিত্বকে অন্য কোনো সমাজের বা ব্যক্তির হাতে বিলুপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে তা হলো ঐ সমাজের বা ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা চরমভাবে পরাজিত হয় এবং অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারপরও তারা বলেছিলঃ আমরা হয়তো সবকিছুই হারালাম কিন্তু আমাদের কাছ থেকে একটি জিনিস কেউ কেড়ে নিতে পারেনি,তাহলো আমাদের স্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তিত্ব । আর এই ব্যক্তিত্বের অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল বলেই অচিরেই জার্মানরা তাদের হারানো স্থান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু কোনো জাতি যদি সব কিছুর মালিক হয়েও তার স্বাতন্ত্র্যবোধকে বিকিয়ে দিয়ে বসে তাহলে তাদের ধ্বংস অত্যাসন্ন । নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব হারিয়ে সে অন্য জাতির মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অতন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়,আজ আমাদের মুসলিম দেশগুলোর অনেকেই প্রকৃতির দেয়া অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক এবং অতীতের সুদীর্ঘ উজ্জ্বল ইতিহাসের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের পাশ্চাত্যের দাসত্ব করতে লজ্জাও করে না।

প্রখ্যাত চিন্তাবিদ আল্লামা ইকবাল লাহোরী বলেন,মুসোলিনীর মতেঃ মানুষ যদি রুটি চায় তাহলে তার অস্ত্র থাকতে হবে। অর্থাৎ খাবার হাতে আনতে হলে বাহুর জোর থাকা চাই। মুসোলিনীর এই মতকে খণ্ডন করে আল্লামা ইকবাল বলেনঃ যদি রুটি পেতে চাও তাহলে তুমি নিজেই অস্ত্র হও। অর্থাৎ,তুমি দৃঢ় হও,তোমার ব্যক্তিত্ব,তোমার স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করো। তিনি বলেন,কেন শক্তির আশ্রয় নিতে চাও? তুমি শক্ত হও। তুমি নিজে লৌহমানব হও,তোমার ব্যক্তিত্বকে অটুট রাখো তাহলেই তুমি যা চাইবে তা পাবে।

যদি কোনো হতভাগা জাতি তার স্বীয় জীবন-দর্শন থেকে গৃহীত ঈমানকে বিসর্জন দিয়ে অন্য কোনো জাতির মধ্যে মিলে যায় তাহলে সবক্ষেত্রে সে তাদের মতোই চিন্তা করতে থাকে,তাদের মতোই চলতে থাকে। কোনো ব্যাপারেই সে আর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না,তখন যেকানো অশ্লীলতাকে সেও মেনে নেয়। তাদের চাটুকারিতা করতেই তখন তার ভাল লাগে।

সত্যকে পাওয়া মাত্র গ্রহণ করার অভ্যাস অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু সত্য ও সততাকে বিকিয়ে দেয়া সবচেয়ে কু-অভ্যাসগুলোর অন্তর্গত। গান্ধী কিংবা নেহেরু ঐ নিজস্ব পোশাক নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন তাতে তো তাদের কোনো অসম্মান হয়নি। বরং তার ভারতীয় সত্তার পরিচয়টিই বিদেশে ফুটে উঠে। যারা দেশীয় সংস্কৃতির বদলে বিদেশী ভাষা-সাংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করে নেয় তারা কাপুরুষ ছাড়া কিছু নয়। এরা দেশের,সমাজের ও জাতির কুলাঙ্গার।

আরবী হরেফ লেখা তুর্কী ভাষা আতাতুর্কের পছন্দ হল না। তাই সে ল্যাটিন হরফে তুর্কী ভাষার প্রবর্তন ঘটালো। (খোদা না করুক) হয়তো দেখা যাবে একিদন পশ্চিমাভক্ত আরব রাজা-বাদশাহদেরও আরবী অক্ষরে আরবী ভাষা পছন্দ হবে না। তারাও দেখা যাবে ল্যাটিন অক্ষরে আরবী ভাষার চলন করবে। পরিণতিতে মহাপবিত্র খোদায়ী আল কোরআনের আর সহজভাবে অর্থ করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো ইসলাম ধর্মই থাকবে না। মুসলিম ব্যক্তিত্ব ও মুসলিম ঐতিহ্যকে হয়তো পুরোপুরি হারিয়ে বসতে হবে।

মহানবী (সাঃ) এসে আরবেদেরকে কি দিয়েছিলেন? বস্তুত একজন গরীব ও অনাথ ব্যক্তি যেখানে সমস্ত গোত্র এবং সমাজ তার বিরোধিতায় নেমেছে তাদেরকে কি-ই বা দিতে পারতেন। কিন্তু তবুও কিভাবে তিনি তাদেরকে ঐ নরকালয় থেকে বের করে সম্মানের চুড়ায় এনে বসাতে পরলেন?

তিনি সমাজে এমন এক ঈমানী শক্তি প্রবাহিত করে দিলেন যা তাদেরকে ব্যক্তিত্ব– সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। ফলে যে আরবরা গতকাল উটের দুধ খেয়ে জীবন যাপন করতো,হিংস্র জন্তু খেত,দস্যুতা যাদের পেশা ছিল,যে মূর্খ পাষণ্ড আরবরা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, তারাই আজ হঠাৎ করে হুশ ফিরে পেল। ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে তারা বলে উঠলো যে,আমাকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাস করা থেকে বিরত হতে হবে। অতীতে কি করতো না করতো তা আর ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না,বরং গর্ব করে বলতে লাগলো;দেখা,আমি গতকাল এরকম অধম ছিলাম,এরকম বঞ্চিত চিন্তা-ভাবনা করতাম কিন্তু আজকে আমি সোনার মানুষ। আমি তোমাদের চেয়েও উন্নত চিন্তা করার শক্তি অর্জন করেছি। একেই বলে ব্যক্তিত্ব । পৃথিবীতে‘‘ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ র চেয়ে ভাল কোনো কালেমা খুজে পাওয়া যাবে কি যা মানুষের অন্তরকে অধিকতর ব্যক্তিত্ব এবং বীরত্ব দান করতে পারে? আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। এসব গ্রহ-তারা,পশু-পাখী,মাটি-পাথর,গাছ-গাছালি কোথায় আর মানুষের মাথা অবনত করা কোথায়? আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে মাথা নত করতে পারবো না। আমি সত্য,ন্যায় এবং মান-সম্মানের পক্ষপাতী। এগুলো হলো ব্যক্তিত্ব থেকে উদ্ভূত মনোবৃত্তি ।

কিন্তু উমাইয়ারা এসে এমন কিছু করলো যাতে মুসলমানদের ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যায়। কুফা মুসলিম বাহিনীর কেন্দ্রভূমি ছিল। ইমাম হোসাইন (আঃ) যদি সেদিন কুফার লোকদের দাওয়াত অনুযায়ী কুফায় না আসতেন তাহলে অনাদিকালের ঐতিহাসিকরা তাকে দোষারোপ করে বলতো,হাজার হাজার লোক আপনার প্রতিনিধির সাথে বাইয়াত করেছে,তারা আপনাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৮ হাজার চিঠি পাঠিয়েছে,কিন্তু আপনি কেন তাদের দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে এত বড় ভূল করলেন? কুফার চেয়ে অনুকূল কোনো জায়গা আর ছিল কি?

ইমাম হোসাইন (আঃ) সবকিছু বুঝে সবচেয়ে উত্তম পথেই পা বাড়ালেন। কিন্তু হাজার হাজার মুসলিম সেনারা যারা ইমাম হোসাইনের (আঃ) জন্যে বাইয়াত করে তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাওয়াত করলো;ইবনে যিয়াদের লেজ দেখেই তারা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল কেন? কারণ ইবনে যিয়াদের বাবাকে সবাই চিনতো। সে দীর্ঘদিন ধরে কুফায় শাসন করে কত মায়ের অশ্রু ঝরিয়েছে,কত লোকের হাত-পা কেটে পঙ্গু করে দিয়েছে,কত মানুষের পেট চিরে কলিজা বের করে এনেছে,কত মানুষকে বন্দি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে-এসবই কুফাবাসীদের ভালমতো মনে ছিল। তাই ইবনে যিয়াদকে দেখে কুফাবাসীদের মনে তার বাবার নৃশংসতার কথা স্মরণ হয় এবং তাতেই তাদের সমস্ত বীরত্ব ও ব্যক্তিত্ব পানি হয়ে যায়। তাই ইবনে যিয়াদের কুফায় আগমনের সংবাদ শোনা মাত্র মা সন্তানের হাত ধরে,স্বামী স্ত্রীর হাত ধরে,ভাই বোনের হাত ধরে মুসলিম ইবনে আকিলের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। কুফায় হযরত আলী (আঃ)-এর অনুসারীরাও ছিল প্রচুর। কিন্তু তারা এমন দিশেহারা হয়ে পড়ে যে,শেষ পর্যন্ত নিজের হাতেই ইমাম হোসাইনকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। সে সময় বলা হলোঃ

‘‘তাদের অন্তরগুলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) সাথেই ছিল কিন্তু তাদের তলোয়ারগুলো ইমাম হোসাইনের (আঃ) বিরুদ্ধে উত্তোলিত হয়।”

(মাকতালুল মোকাররামঃ ২৩০, তারিখে তাবারীঃ ৬/২১৭ , কামেলে ইবনে আছীরঃ ৬/১৫ ,ইরশাদে মুফীদঃ ২১৮, মানাকিবে ইবনে শাহের আশুবঃ ৪/১৯৫ , কাশফুল গোম্মাহঃ ২/৩২)

এর কারণ হলো উমাইয়ারা মুসলিম সমাজের ব্যক্তিত্বকে ভূ-লুন্ঠিত করে দেয়,মুসলমানদের ঐতিহ্যকে পদদলিত করে। ফলে আর কেউই নিজেদের মধ্যে ইসলামী অনুভূতি খুজে পায়নি। সবাই যেন ইবনে যিয়াদের মধ্যে হারিয়ে গেল।

কিন্তু এই কুফাবাসীরাই এ ঘটনার মাত্র তিন বছর পরেই বিপ্লব করে। পাঁচ হাজার ‘‘তাওয়াব’’ বা অনুতপ্ত ব্যক্তি ইমাম হোসাইনের (আঃ) রওজায় গিয়ে আহাজারি করে অশ্রু ঝরায়। তারা নিজেদের পাপের জন্যে তওবা করে ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে যতক্ষণ ইমাম হোসাইনের (আঃ) রক্তের প্রতিশোধ না নিতে পারবে ততক্ষণ শান্ত হবে না। হয় নিহত হবে না হয় এর প্রতিশোধ নেবে। যেমন কথা তেমন কাজ। ১২ই মহররম অর্থাৎ,আশুরার মাত্র দু’ দিন পর শুরু হল তাদের অভিযান এবং শেষ পর্যন্ত এরাই কারবালায় নবীর (সাঃ) সন্তানদের হত্যাকারীদেরকে ধ্বংস করলো।

তাদের এ অনুভূতিকে কে ফিরিয়ে দিল? অবশ্যই ইমাম হোসাইনের (আঃ) আন্দোলন। কোনো জাতিকে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন করার অর্থ হলো সে জাতিকে দেশ প্রেমিক ও শ্রদ্ধাবান করে তোলা। যে জাতির মধ্যে এগুলো ধুলোর আবরণে ঢাকা পড়েছে তাকে ঝেড়ে-মুছে পুনরায় প্রাণবন্ত করা। ইমাম হোসাইন (আঃ) যেখানেই আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন সেখানেই বলেছেনঃ

‘‘যদি ইয়াযিদের মতো কাপুরুষ উম্মতের অভিভাবক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের সমাপ্তি ঘটবে।’’ তিনি আরও বলেনঃ

‘‘আমি কোনো ক্ষমতা বা পদের লোভে নয় বরং আমি আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করার জন্যেই বিদ্রোহে নেমেছি।’’ ২৩ বছর ধরে যেসব কথা মরে গিয়েছিল সেসব কথাকে পুনর্জাগরুক করার জন্যে তিনি একজন সংস্কারক হিসেবে বিদ্রোহ করলেন। নানার উম্মত আজ নানার পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাই ইমাম হোসাইন (আঃ) উম্মতকে নানার পথে আনতে চান। তিনি বিদ্রোহ করে উম্মতকে পুনরায় সত্য প্রেমিক ও আদর্শবান করে তুললেন। কোনো জাতির মধ্যে প্রাণসঞ্চার করার পথও এই একটি । সেই জাতিই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যার মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও স্বনির্ভরতার অনুভূতি রয়েছে। এসবগুলোই হোসাইনী আন্দোলনের শিক্ষা যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তিনি মুসলিম সমাজকে স্বনির্ভর হওয়ার মনোবৃত্তি দান করেন। যেদিন ইমাম হোসাইন (আঃ) মদীনা থেকে রওয়ানা হন সেদিন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভরভাবেই পদক্ষেপ শুরু করেন। তিনি বলেনঃ

‘‘আল্লাহ চাহেন তো আমি আগামীকাল সকালেই রওয়ানা হচ্ছি । তোমাদের মধ্যে যে জীবনকে সত্যের পথে উৎসর্গ করতে পারবে এবং আল্লাহর দিদার পেতে প্রস্তুত সে আমার সঙ্গী হতে পারো। আমার মতো আমি চললাম। এর বেশী কোন কথা নেই।’ (মুলহাকাতু এহকাকুল হকঃ ১১/৫৯৮ ,নাফাসুল মাহমুমঃ ১০০, কাশফুল গোম্মাহঃ ২/২৯ আল লুহুফঃ২৫ , মাকতালুল খারাযমিঃ ২৮৫, বিহারুল আনোয়ারঃ ৪৪/৩৬৬)

এতটুকু আত্মনির্ভরতা ও অভাব মুক্তির নজীর পৃথিবীতে নেই। এর চেয়েও বড় আত্মনির্ভরতার পরিচয় তিনি দেন আশুরার রাত্রে । তিনি তার মুষ্টিমেয় সাহায্যকারীদের থেকেও বাইয়াত তুলে নিয়ে তাদেরকে বিপদমুক্তির সমস্ত পথ দেখিয়ে দিয়ে বললেনঃ তোমরা যদি চলে যেতে চাও অনায়াসে যেতে পার। এমন কি কেউ ইমাম হোসাইনের (আঃ) মুখের দিকে চেয়ে মায়ায় পড়ে চলে যেতে দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে কিনা এ কারণে ইমাম হোসাইন (আঃ) আলো নিভিয়ে দিলেন। তিনি একবারও বললেন না যে,আমি একাকী হয়ে পড়বো,অসহায় হয়ে যাব। কত বড় আত্মবিশ্বাস ও নির্ভরতার শিক্ষা ইমাম হোসাইন (আঃ) শেখালেন।

এই আত্মনির্ভরতার শিক্ষা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এই আত্মনির্ভরতাই মুসলমানদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে ও এ সূত্র ধরে কত শত শত বিপ্লব এবং বিদ্রোহ পৃথিবীতে সংঘটিত হয়েছে। ইমাম হোসাইন (আঃ) মুসলমানদেরকে ধৈর্য,অধ্যবসায় এবং পরিশ্রমী হতে শিক্ষা দিয়েছেন। এসবই মুসলমানদের মূলধন হিসেবে কাজে লাগে। সুতরাং যদি কেউ বলে যে,ইমাম হোসাইনের (আঃ) শাহাদাতের সাথে ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হবার মধ্যে কী সম্পর্ক রয়েছে;তাহলে জবাবে বলতে হবে যে,ইমাম হোসাইন মুসলমানদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন,রক্তের মধ্যে জোয়ারের বান তোলেন,মুসলমানদের স্বীয় ব্যক্তিত্ব এবং হিম্মতকে ফিরিয়ে দিলেন। তাদেরকে সত্যপ্রিয় এবং আদর্শবান করে তোলেন,আত্মনির্ভর ও স্বয়ম্ভর হতে শেখান। তাদেরকে বিপত্তি ও প্রতিকূল পরিবেশে ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী হতে শেখান,ভয়-ভীতির অবসান ঘটিয়ে দৃঢ়ভাবে দাড়াতে শেখান, ভয় ভীতির অবসান ঘটিয়ে দৃঢ়ভাবে দাড়াতে শেখান। যে লোকগুলো ঐ পরিমাণ ভীতসন্ত্রস্ত ছিল তাদের সবাইকে একেকজন সাহসী বীরপুরুষ করে গড়ে তোলেন।

ইমাম হোসাইনের (আঃ) জন্যে শোক-পালন করা,মার্সিয়া পড়া-এসবের কেউ বিরোধিতা করে না। তবে এগুলো এমনভাবে পালন করা উচিত যাতে হোসাইনী বীরত্ব আমাদের প্রতিটি রক্তকণায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। ইমাম হোসাইন (আঃ) সর্বকালের জন্যে একটি সামাজিক আদর্শ। সেদিনও এ আদর্শ মুসলিম সমাজকে আলোড়িত করেছিল। যারাই অন্যায়ের গলা চেপে ধরতে এবং সৎকাজের উপদেশ কিংবা অসৎকাজে বাধা দিতে অগ্রণী হতো তাদের সবার স্লোগান ছিলঃ

‘হে হোসাইনের রক্ত’ ( মুসনাদে ইমাম রেযাঃ ১/১৪৮ উয়ুনুল আখবার আর রেযাঃ ১/২৯৯)

তাই,আজকেও অন্যায়ের পথ রুখতে,নামায কায়েম করতে,ইসলামকে পুনর্জাগরিত করতে ও মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের মহান ঐতিহ্য এবং অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে হলে ইমাম হোসাইনের (আঃ) আদর্শে আদর্শবান হতে হবে।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)