আল হাসানাইন (আ.)

হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)এর শাহাদাতবার্ষিকী

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

২৮শে সফর নবীজীর আহলে বাইতের ইমাম হযরত হাসান মুজতাবা (আ.)এর শাহাদাতবার্ষিকী। ৫০ হিজরির এই দিনে ইমাম হাসান মুজতাবা (আ) খোদার দিদারে চলে যান আর সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ইমামকে হারানোর ব্যথায় শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। নবীজীকে রেসালাতের যে মহান দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, নবীজীর অবর্তমানে সেই মহান দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় তাঁর আহলে বাইত ব্যাপক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালান। নবীজীর চিন্তার সেই গভীর জ্ঞানের আলো দিয়ে তাঁরা মুসলিম উম্মাহর সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনায়ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেন। আমরা যদি একবার নবীজীর আহলে বাইতের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো ইসলামের মৌলিক ভিত্তিকে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে তাঁরা মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন।

তাঁরা সবসময় কায়েমি স্বার্থবাদীদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন যাতে ইসলামের মহান স্বরূপ সর্বদা অটুট থাকে। ইমাম হাসান মুজতাবা (আ) নবীজীর আহলে বাইতের একজন ইমাম যিনি তাঁর প্রায় ১০ বছরের ইমামতিকালে সবসময় ইসলামের প্রচার-প্রসারে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মহান এই ইমামের বেদনাঘন শাহাদাতবার্ষিকীতে তাই আপনাদের জানাচ্ছি আন্তরিক শোক ও সমবেদনা।

রাসূল ( সা ) বলেছেন, ˜যারা হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসবে তারা আমাকেই ভালবাসলো,আর যারা এ দুজনের সাথে শত্রুতা করবে তারা আমাকেই তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করলো।' এই হাসান-হোসাইনকে রাসূল এতো বেশি আদর করতেন এইজন্যে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দুইজনকে বেহেশতে যুবকদের নেতা বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়া তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ চরিত্রের অধিকারী। আটাশে সফর তারিখে হযরত ইমাম হাসান (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকী। তো রাসূলের হাদীস অনুযায়ী এই ইমামের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন স্বয়ং নবীজীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনেরই শামিল। তাই আমরা ইমাম হাসান মুজতবা (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকীতে তাঁরি জীবনেতিহাস নিয়ে আলোচনা করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করার চেষ্টা করবো।

হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) ছিলেন দ্বিতীয় ইমাম । তিনি আমিরুল মু’মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর প্রথম সন্তান এবং তৃতীয় ইমাম হযরত হুসাইন (আ.) এর ভাই ছিলেন । মহানবী (সা.) অসংখ্যবার বলেছেন : হাসান ও হুসাইন আমারই সন্তান । এমনকি হযরত ইমাম আলী (আ.) তার সকল সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য করে একই কথার পুনারুক্তি করেছিলেন । তিনি বলেছেনঃ তোমরা আমার সন্তান এবং হাসান ও হুসাইন আল্লাহর নবীর সন্তান ।[‘মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব’ ৪র্থ খণ্ড, ২১ থেকে ২৫ নং পৃষ্ঠা । ‘যাখাইরূল উকবা’ ৬৫ ও ১২১ নং পৃষ্ঠা ।] হযরত ইমাম হাসান (আ.) হিজরী ৩য় সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন । তিনি প্রায় সাত বছরেরও কিছু বেশী সময় মহানবী (সা.)-এর সাহচর্য লাভ করতে সক্ষম হন । তিনি বিশ্বনবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় তিন বা ছয় মাস পর যখন নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) পরলোক গমন করেন, তখন তিনি তার মহান পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হতে থাকেন । পিতার শাহাদতের পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পিতার ‘ওসিয়াত’ অনুযায়ী তিনি ইমামতের পদে আসীন হন । অতঃপর তিনি প্রকাশ্যে খেলাফতের পদাধিকারীও হন । প্রায় ৬মাস যাবৎ তিনি খলিফা হিসেবে মুসলমানদের রাষ্ট্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন । কিন্তু মুয়াবিয়া ছিলেন নবীবংশের চরম ও চিরশত্রু । ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় খেলাফতের মসনদ অধিকারের লোভে ইতিপূর্বে বহু যুদ্ধের সূত্রপাত সে ঘটিয়ে ছিল (প্রথমত : ৩য় খলিফার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী রাজনৈতিক শ্লোগানের ধোয়া তুলে এবং পরবর্তীতে সরাসরি খলিফা হওয়ার দাবী করে) । তখন ইরাক ছিল হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফতের রাজধানী । মুয়াবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে কেন্দ্রীয় খেলাফতের পদ থেকে অপসারণের লক্ষ্যে ইরাক সীমান্তে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে । একইসাথে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে গোপনে ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীর বহু অফিসারকে ক্রয় করে । এমনকি ঘুষ ছাড়াও অসংখ্য প্রতারণামূলক লোভনীয় প্রতিশ্রুতি প্রদানের মাধ্যমে মুয়াবিয়া, ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীকে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটাতে সক্ষম হয় ।[‘কিতাবুল ইরশাদ’ (শেইখ মুফিদ), ১৭২ নং পৃষ্ঠা । ‘মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব’ ৪র্থ খণ্ড, ৩৩ নং পৃষ্ঠা । ‘ফসুলুল মুহিম্মাহ’ ১৪৪ নং পৃষ্ঠা]

যার পরিণামে হযরত ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন । উক্ত চুক্তি অনুসারে হযরত ইমাম হাসান (আ.) প্রকাশ্যে খেলাফতের পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । চুক্তির শর্ত অনুসারে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পরপরই হযরত ইমাম হাসান (আ.) পুনরায় খলিফা হবেন এবং খেলাফতের পদ নবীবংশের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে । আর এই অন্তর্বর্তী কালীন সময়ে মুয়াবিয়া শীয়াদের যে কোন প্রকারের রাষ্ট্রিয় নিপীড়ন থেকে বিরত থাকবে ।[‘কিতাবুল ইরশাদ’ শেইখ মুফিদ, ১৭২ নং পৃষ্ঠা । ‘মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব’ ৪র্থ খণ্ড, ৩৩ নং পৃষ্ঠা । ‘আল ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ, আবদুল্লাহ বিন মুসলিম বিন কুতাইবাহ , ১ম খণ্ড, ১৬৩ নং পৃষ্ঠা । ‘ফুসুলুল মুহিম্মাহ্’ ১৪৫ নং পৃষ্ঠা । ‘তাযকিরাতুল খাওয়াস’ ১৯৭ নং পৃষ্ঠা] আর এভাবেই মুয়াবিয়া কেন্দ্রীয় খেলাফতের পদ দখল করতে সমর্থ হয় এবং ইরাকে প্রবেশ করে । কিন্তু ইরাকে প্রবেশ করে সে এক জনসভার আযোজন করে । ঐ জনসভায় প্রকাশ্যভাবে জনসমক্ষে সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে ইতিপূর্বে সম্পাদিত চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ বাতিল বলে ঘোষণা করে।[‘কিতাবুল ইরশাদ’ শেইখ মুফিদ, ১৭৩ নং পৃষ্ঠা । ‘মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব’ ৪র্থ খণ্ড, ৩৫ নং পৃষ্ঠা । ‘আল ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ, আবদুল্লাহ বিন মুসলিম বিন কুতাইবাহ , ১ম খণ্ড, ১৬৪ নং পৃষ্ঠা] আর তখন থেকেই সে পবিত্র আহলে বাইত (নবীবংশ) ও তাদের অনুসারীদের উপর সর্বাত্মক অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে শুরু করে । হযরত ইমাম হাসান (আ.) তার দীর্ঘ দশ বছর সময়কালীন ইমামতের যুগে শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে সৃষ্ট প্রচন্ড চাপের মুখে এক শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হন । এমনকি নিজের ঘরের মধ্যকার নিরাপত্তাও তিনি হারাতে বাধ্য হন । অবশেষে হিজরী ৫০সনে মুয়াবিয়ার ষড়যন্তে ইমাম হাসান (আ.) জনৈকা স্ত্রীর দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।[‘কিতাবুল ইরশাদ’ শেইখ মুফিদ, ১৭৪ নং পৃষ্ঠা । ‘মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব’ ৪র্থ খণ্ড, ৪২ নং পৃষ্ঠা । ‘ফসুলুল মুহিম্মাহ’ ১৪৬ নং পৃষ্ঠা] মানবীয় গুণাবলীর শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে হযরত ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন স্বীয় পিতা ইমাম আলী (আ.) এর স্মৃতিচিহ্ন এবং স্বীয় মাতামহ মহানবী (সা.)-এর প্রতিভু । মহানবী (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন, হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) সবসময়ই তাঁর সাথে থাকতেন । এমনকি মহানবী (সা.) প্রায়ই তাদেরকে নিজের কাধেও চড়াতেন ।

মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার এই দু’সন্তানই (ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন) ইমাম, তারা আন্দোলন করুকু অথবা না করুক, সব অবস্থাতেই তারা ইমাম (এখানে আন্দোলন বলতে প্রকাশ্যে খেলাফতের অধিকারী হওয়া বা না হওয়ার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে)[‘কিতাবুল ইরশাদ’ শেইখ মুফিদ, ১৮১ নং পৃষ্ঠা । ‘ইসবাতুল হুদাহ’ ৫ম খণ্ড, ১২৯ ও ১৩৪ নং পৃষ্ঠা ]

হে ইমাম ! বিষের পেয়ালায় চুমু দিয়ে আমাদের করেছো ঋণী

আমরা তোমার পদাঙ্ক দেখে দেখে এগিয়ে চলেছি

তোমার সাক্ষাতে, কোথায় তুমি ,

মরুঝড় এসে বুঝি মুছে দিলো তোমার পদচিহ্ন

এবার কী করে পাবো সত্যের নাগাল !

রাতের আঁধারে দূর আকাশে জ্বলজ্বলে একটি তারা

পথ দেখালো শেষে , যার আলোয় জ্বলমান

বেহেশতের যুবনেতার নাম - ইমাম হাসান !

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)