হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ মানব
নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) সকল যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। কারণ, তাঁর মধ্যে মানবিক পূর্ণতার সকল বৈশিষ্ট্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। মহান আল্লাহ্ তাঁকে স্বীয় অসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান দান করেছিলেন (সূরা নামল : ৬) এবং স্বয়ং তিনিই তাঁকে প্রশিক্ষিত করেছেন (আল কাফি, ১ম খণ্ড, ২৬৬)। এজন্যই তাঁর মধ্যে সত্যকেন্দ্রিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ, স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা, মানবপ্রেম, আত্মমর্যাদাবোধসহ সকল উত্তম বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি অজ্ঞতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ এবং মানবতার স্পর্শবর্জিত চরম অনগ্রসর এক সমাজে জন্মগ্রহণ করে বিশ্ববাসীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। অমুসলমান মনীষী ও চিন্তাবিদরাও তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দান করেছেন। টমাস কার্লাইল, বার্নার্ড শ, জর্জি যাইদান, হেনরী কোরবেন প্রমুখ প্রসিদ্ধ ব্যক্তি তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করেছেন। বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ মাইকেল হার্ট তাঁর ‘দি হানড্রেড স’ গ্রন্থে মহানবী (সা.)-কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের কেউই তাঁর জীবনের সকল দিক নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করেননি। তাঁরা কেবল তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি বা কয়েকটি দিক পর্যালোচনা করেই ঐরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু এ মহামানবের প্রকৃত পরিচয় জানার জন্য তাঁর সত্তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিকসমূহ এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আর এ বিষয়গুলো সম্পর্কে কেবল তাঁর সৃষ্টিকর্তাই সম্যক অবহিত। তাই একমাত্র তিনিই আমাদের সামনে তাঁর সঠিক পরিচয় তুলে ধরেছেন।
সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহ্ মহানবী (সা.)-এর সমগ্র জীবনকে মানবজাতির জন্য আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করে বলেছেন : ‘নিশ্চয় এ রাসূলের মধ্যে তোমাদের অনুসরণের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে’ (সূরা আহযাব : ২১)। আর তাঁকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণের অন্যতম প্রধান কারণ হল তাঁর মহান চরিত্র যার স্বীকৃতি আল্লাহ্ এভাবে দিয়েছেন : ‘নিশ্চয় (হে রাসূল!) তুমি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছ’ (সূরা কালাম : ৪)। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতী জীবন শুরুর পূর্বেও পবিত্রতার প্রতিমূর্তি ছিলেন। তাঁর অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল তিনি ছিলেন সকলের প্রতি পরম দয়াশীল। এ কারণেই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন : ‘নিশ্চয় আমরা তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ তিনি বিধর্মীদের প্রতিও এতটা স্নেহশীল ছিলেন যে, তারা সত্যকে গ্রহণ না করার মনোকষ্টে তাঁর প্রাণ বিনাশের উপক্রম হত (সূরা কাহ্ফ : ৬, ফাতির : ৮, শোয়ারা : ৩)। তাঁর এ ভালবাসার জ্বলন্ত প্রমাণ তিনি মক্কা বিজয়ের পর উপস্থাপন করেছিলেন যখন তিনি তাঁর ঘোরতর শত্রুদের থেকে চরম প্রতিশোধের সুযোগ পেয়েও অকপটে ক্ষমা করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.)-এর কথা, কর্ম, আচরণ সকল কিছুই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নির্দেশের অনুবর্তী ছিল (সূরা নাজম : ৩-৪)। তাঁর এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই মহান প্রতিপালক তাঁর আনুগত্যকে স্বীয় আনুগত্য বলে অভিহিত করেছেন (সূরা নিসা : ৮০) এবং তাঁর আদেশ-নিষেধকে নিঃশর্তভাবে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা হাশর : ৭)। এর বিপরীতে তাঁর নির্দেশ অমান্যকারীকে স্পষ্ট বিপথগামী বলেছেন (সূরা আহযাব : ৩৬)। তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমেই মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া সম্ভব (সূরা আলে ইমরান : ৩১)।
মহানবী (সা.) পূর্ণতম দীন নিয়ে এসেছেন (সূরা মায়িদা : ৩) এবং তাঁর মাধ্যমেই নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে (সূরা আহযাব : ৪১)। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ গ্রন্থ আল কুরআন চিরন্তন মুজিযা যার সকল শিক্ষা যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থেকে মানবজাতিকে সত্যের পথে পরিচালিত করবে। এ গ্রন্থ পূর্ববর্তী সকল ঐশীগ্রন্থের সংরক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে সেগুলোর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী (সূরা মায়িদা : ৪৮); যেমনভাবে তিনি অন্য সকল নবীর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। এ কারণেই মহান আল্লাহ্ কিয়ামত দিবসে যখন সকল নবীকে তাঁদের উম্মতের ওপর সাক্ষী হিসাবে আনয়ন করবেন (সূরা যুমার : ৬৯) তখন তাঁকে তাঁদের সকলের ওপর সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত করবেন (সূরা নিসা : ৪১, নাহল : ৮৯)। মানবজাতির মধ্যে শুধু তাঁর প্রতিই আল্লাহ্ ও ফেরেশতামণ্ডলী দরুদ প্রেরণ করেন (সূরা আহযাব : ৫৬), কেবল তাঁর জন্যই নিরঙ্কুশ প্রশংসনীয় মর্যাদা নির্ধারিত রয়েছে (সূরা বনি ইসরাঈল : ৭৯) এবং তাঁর স্মরণকেই আল্লাহ্ সমুন্নীত করেছেন (সূরা ইনশিরাহ : ৪)।
রাসূল (সা.) মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছেন (সূরা সাবা : ২৮, ফুরকান : ১)। আর তাই তাঁর আহ্বান হল বিশ্বজনীন। তাঁর আনীত ধর্ম নিছক ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আচারসর্বস্ব ও কিছু নীতিকথানির্ভর ধর্ম নয়; বরং তা মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা মানুষের আত্মিক ও দৈহিক সকল চাহিদার প্রতি প্রয়োজন অনুযায়ী দৃষ্টি দিয়েছে। এজন্যই তিনি মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সকল দিকের জন্য উত্তম আদর্শ ছিলেন। তিনি তাওহীদের শিক্ষা দ্বারা মানুষকে চিন্তাগতভাবে পরিশুদ্ধ ও তাদের ঐশী সহজাত প্রবণতাকে জাগ্রত করেছিলেন। তাদেরকে তিনি ইসলামের প্রাণবন্ত ও আলোকময় ব্যবহারিক আচার ও ইবাদাতের পদ্ধতি শিক্ষাদানের মাধ্যমে আত্মিক ও নৈতিকভাবে উন্নত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছিলেন। তিনি মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিতকারী সুন্দরতম পারিবারিক জীবনের নমুনা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছেন। অজ্ঞ ও বর্বর এক সমাজে আবির্ভূত হয়ে তিনি তার সদস্যদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করেছিলেন যে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ এমন এক সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল যা অন্য সকল সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল এবং তার থেকে শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি গোত্র, বর্ণ, জাতি, ভাষা সকল বৈষম্য দূর করে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে ধনী-দরিদ্র সকলের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। নারী, শিশু, দুর্বল, অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের অধিকারকে নিশ্চিত করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি এমন এক রাষ্ট্র স্থাপন করেছিলেন যাতে মুসলিম- অমুসলিম সকলের মানবিক অধিকার পূর্ণরূপে সংরক্ষিত হয়েছিল। সে রাষ্ট্রে তিনি ইসলামের বিধিবিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা এবং হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, সম্মানহানি, আত্মসাৎসহ সকল অন্যায়-অনাচারের অবসান ঘটিয়ে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করেছিলেন। সত্য ও ন্যায়ের প্রতিবন্ধক শক্তিকে সন্ত্রস্ত রাখার জন্য মুসলিম সমাজকে ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান করার পাশাপাশি সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছিলেন। এভাবে তিনি সর্বব্যাপী ঐশী শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ এক সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। একমাত্র তাঁর আদর্শ অনুসরণের মধ্যেই সকল মানুষের জন্য শান্তি, মুক্তি, কল্যাণ, সৌভাগ্য ও সফলতা নিহিত রয়েছে।
(প্রত্যাশা, ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা)