আল হাসানাইন (আ.)

আরবী ভাষার চর্চার গুরুত্ব

2 বিভিন্ন মতামত 01.5 / 5

আরবি ভাষা বর্তমান বিশ্বের আলজিরিয়া, বাহরাইন, চাঁদ, কমোরোস, জিবুতি, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এসব আরব দেশ ছাড়াও তুর্কি, মালয়েশিয়া ও সেনেগালে এ ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী অমুসলিম দেশ ভারতেও এ ভাষার চর্চা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বের ৪২২ মিলিয়ন আরব জনগোষ্ঠী এবং দেড় শ’ কোটিরও বেশি মুসলিম তাদের দৈনন্দিন জীবনে এ ভাষা ব্যবহার করেন। জাতিসঙ্ঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ওআইসিসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসিয়াল ভাষা হলো এই আরবি। শুধু তা-ই নয়, ‘ট্রেড ল্যাংগুয়েজ’ হিসেবে এ ভাষা অনারব দেশেরও প্রায় প্রতিটি পণ্যের মোড়কে শোভা পায়। পণ্যের গুণগত মান ও বিজ্ঞাপন সংবলিত আরবি লেখা আমাদের দেশের দুই টাকার বিস্কুটের প্যাকেটেও লক্ষ করা যায়। এতে অতি সহজেই আমাদের কাছে আরবি ভাষার মর্যাদা, গুরুত্ব এবং এ ভাষাচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনুমিত হয়।

বাংলাদেশে আরবি ভাষার আগমন : বাংলাদেশের সাথে আরবি ভাষার পরিচয় ঘটে সুদূর অতীতে বাণিজ্য সূত্রে। আরব বণিকেরা বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বন্দর চট্টগ্রাম বা সন্দ্বীপে পৌঁছতেন এবং সেখান থেকে মিয়ানমার (বার্মা), মালয় উপদ্বীপ ইত্যাদি অতিক্রম করে চীনের ক্যানটন পর্যন্ত যেতেন। আরবে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পরও বাণিজ্য সূত্রে তারা এ দেশে আসতেন এবং তাদের সাথে আসতেন ধর্মপ্রচারকেরা। এভাবে প্রাচীনকালে আরবদের এবং পরবর্তীকালে আরব মুসলিমদের বাংলায় যাতায়াতের ফলে বাংলার অধিবাসীরা আরবি ভাষার সাথে পরিচিত হয়। কালক্রমে এ দেশীয় কিছু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের মধ্যে আরবি ভাষা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ইসলাম প্রচারকেরা নামাজ আদায়ের জন্য যেসব মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণ করেন, সেখানে আরবি কুরআন পাঠ ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই এ দেশে আরবি ভাষা চর্চার সূত্রপাত হয়। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরব বণিক এবং ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আরবি ভাষার মিশ্রণ শুরু হয়। বাংলাপিডিয়ায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামাঞ্চল বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপভাষার মোট শব্দের প্রায় অর্ধেক আরবি বা আরবি শব্দজাত। তবে বাস্তবতা হলো- ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরব বণিক আর ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বহুকাল আগে থেকেই এ দেশে আরবি ভাষা চর্চা শুরু হলেও আজো তা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভেতরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে সম্পৃক্ত আরবি ভাষা চর্চার পরিবেশ এখনো এ দেশে তৈরি হয়নি।

বাংলাদেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : আমরা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন নিজেদের আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনা, মতামত ও অভিব্যক্তি ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে অসংখ্য আরবি শব্দ ব্যবহার করি। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী আরব দেশগুলোতে কর্মের সন্ধানে, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আমরা আরবি ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। এভাবে নানা কারণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরবি ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন-

১. মুসলিম দেশ হিসেবে ধর্মীয় প্রয়োজনে : বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ হওয়ায় দৈনন্দিন ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবি ভাষাশিক্ষা ও চর্চার গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই অনুভূত হয়। নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া পাঠ করা এবং কুরআন, হাদিস, তাফসির (কুরআনের ব্যাখ্যা) ও ফিকাহর (ইসলামি আইন) বিধিবিধান সঠিকভাবে জানার জন্য আরবি ভাষা শিক্ষার বিকল্প নেই। কারণ ইসলামের বিশুদ্ধ ও মৌলিক জ্ঞান সবই আরবি ভাষায় লিখিত ও রচিত। এ ছাড়া সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ, অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আবির্ভাব এবং পৃথিবীতে মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনের ফলে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে গবেষণালব্ধ ইসলামের বিধিবিধান জানার মুখাপেক্ষী হতে হয়। আধুনিক যুগ সমস্যার সমাধানকল্পে প্রতিষ্ঠিত বেশির ভাগ ফিকাহ অ্যাকাডেমি ও ইসলামি আইন গবেষণা কেন্দ্র আরব দেশগুলোতে অবস্থিত। এখান থেকেই সাধারণত নতুন নতুন বিষয়ে ইসলামীকরণের যথার্থ ব্যাখ্যা এসে থাকে। তাই ইসলামের সব বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান অর্জনের তাগিদে তথা ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবি ভাষা চর্চা একান্তই জরুরি।

২. অধিক রেমিট্যান্স অর্জনের লক্ষ্যে : এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরবসহ আরবি ভাষাভাষী দেশ থেকে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আরবদেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু তারা পেশাগতভাবে আরবি ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় যথার্থ বেতনভাতা ও নানাবিধ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানের মতো আমাদের দেশেও যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশগামী জনশক্তিকে ভাষাগত দক্ষতাসম্পন্ন করে রফতানি করা যেত, তাহলে তারা আরো অধিক বেতন ও নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারত; দেশে আরো অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স আসত। এ দিক বিবেচনায় জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থেই দেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করে এ ভাষায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা প্রয়োজন।

৩. কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণে : আরব দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার ব্যাপক ও সুদূর পরিকল্পনা থাকা দরকার। কারণ আরবদেশগুলো আমাদের দেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক বিভিন্ন খাতে প্রচুর আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। বন্যা, সিডর, আইলা ও বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা আরবদেশগুলো থেকেই সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়ে থাকি। অপর দিকে অনেক আরব দেশ আমাদের চেয়ে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বহু ধাপ এগিয়ে গেছে। দক্ষ আরবিভাষী হয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণের মাধ্যমে আমরা তাদের কাছ থেকে সহজে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়নের রূপরেখা ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক নানা দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতে পারি।

৪. ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনে : ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, ইসলাম আগমনের বহু বছর আগ থেকেই এ দেশের সাথে আরবদেশের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল এবং অদ্যাবধি আছে। এ সম্পর্ককে আরো জোরদার করার জন্য আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার বিকল্প নেই। কারণ আরবেরা ব্যবসায়িক কার্যক্রমসহ সব ক্ষেত্রে আরবি ভাষা ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া আরবি ভাষা বর্তমান বিশ্বে ট্রেড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বিশাল ভূখণ্ডের আরব বিশ্বে ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের জন্য আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।

অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুসলিম অধ্যুষিত বিশাল জনসংখ্যার এ দেশে সরাসরি আধুনিক আরবি ভাষা শিক্ষা ও চর্চার জন্য সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। যদিও এ দেশে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি পড়ানো হয়, তবুও এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরবি বিশেষজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের নজর না থাকায় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় পেশাগত আধুনিক আরবির বিষয়াবলি সিলেবাসভুক্ত না করায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আধুনিক আরবি ভাষায় যোগ্য জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না।

অবশ্য সরকার ইচ্ছে করলে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমেও এ দেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার পথকে সুগম করতে পারে। তবে সরকারের কার্যক্রম দ্বারা বোঝা যায় না যে, এ বিষয়ের প্রতি সরকারের তেমন কোনো সুপরিকল্পনা আছে।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান বিশ্বে আরবি ভাষার অবস্থান, গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা ভেবে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ভাষাগত দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে আরবি ভাষা চর্চার প্রতি গুরুত্ব দেয়া। সাথে সাথে আরবি পত্রপত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে আরব বিশ্বের সামনে দেশের ভাবমর্যাদাকে উজ্জ্বল করা। (লিখেছেন : সোহাগ)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)