খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরলোকগমণের পর সাহাবীগণ কর্তৃক প্রথম খলিফা হিসাবে হযরত আবু বকরের নিয়োগ এবং তার পক্ষে বাইয়াত গ্রহণকে কোনক্রমে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা যাবেনা।
বনি সকিফা নামক স্থান খলিফা নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী সকল সাহাবাদের রায় স্বস্থানে সম্মানের দাবী রাখে।
তবে প্রশ্ন হলো রাসূলের (সা.) খেলাফতের পদটি কি কোন বৈষয়িক ব্যাপার নাকি ঐশ্বরীক বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত ? দ্বীন ইসলাম মানবতার উভয় জগতের শান্তি ও মুক্তির বার্তা নিয়ে আগমন করেছে । তাই এ পদটিও নিশ্চয় একাধারে বৈষয়ীক ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত।
যখন সামান্য বৈষয়ীক ব্যাপারে মানুষ ভূল করতে পারে সেক্ষেত্রে এতবড় ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা নির্বাচন কোনক্রমেই ভূলের উর্ধে হতে পারে না ।
তর্কের খাতিরে যদিও বা মেনে নেই যে সাহাবীদের নির্বাচন সঠিক হয়েছে এবং খলিফা নির্বাচনের সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে মদীনার কতিপয় সাহাবীদের নির্বাচন অন্যকথায় জনগন কর্তৃক নির্বাচন । কিন্তু এ ব্যাপারে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি উত্থাপন হতে পারে তা হচ্ছে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ খলিফা তো জনগন কর্তৃক নির্বাচিত হননি, তাহলে তারা খলিফা হবেন কি করে ?
হযরত ওমর মনোনয়ন পেয়েছেন হযরত আবুবকরের কাছ থেকে, হযরত ওসমান খলিফা হয়েছেন হযরত ওমর কর্তৃক নির্ধারিত ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটা বোর্ডের মাধ্যমে, আর হযরত আলী ইবনে আবি তালিব খেলাফত লাভ করেছেন গন-বিপ্লবের মাধ্যমে। চার খলিফা চার পদ্ধতিতে খেলাফত লাভ করেছেন, তাহলে কি খলিফা নির্বাচনে ইসলামে সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি নেই ? আর যদি বলা হয় হযরত আবু বকর গনভোটে নির্বাচিত খলিফা হিসাবে তার মনোনয়ন অনুযায়ী হযরত ওমরের খেলাফত বৈধ হয়েছে, তাহলে আবারো প্রশ্ন হতে পারে, এ কাজটি কি রাসূল (সা.) করে যেতে পারতেন না ? যখন নির্বাচনের উপর কেউ আপত্তি তোলে তখন তাকে বলা হয় ‘মহানবী (সা.) খেলাফতের ভার উম্মতের উপর ছেড়ে গিয়েছেন’ । তাহলে হযরত আবু বকর কি নবীজীর পদাংক অনুসরণ করে খেলাফতের ভার উম্মতের উপর ছেড়ে যেতে পারতেন না ? এর জটিলতার গিট উম্মুক্ত করে দিতে পারে আমাদের পরবর্তী আলোচনা ।
নবী (সা.) এর উত্তরাধীকার
প্রকৃতপক্ষে উম্মতের কান্ডারী দয়াল নবী নিশ্চয়ই হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ও হযরত ওসমানের ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীদের চেয়েও বেশী জ্ঞান রাখতেন। তিনি সকল জ্ঞানের আধার। হযরত আবু বকর ও হযরত ওমরের এর মস্তিস্কে এ চিন্তা আসতে পারলো যে, উম্মতের জন্য পরবর্তী খলিফা নিয়োগ করে যেতে হবে। আর বিশ্বনবীর (সা.) মস্তিস্কে এ বিষয়ে চিন্তার উদ্রেক হবে না এটা কোন সুস্থ বিবেকবান ধার্মীক মুসলমান কিছুতেই যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নিতে পারেন না । নভী (সা.) হলেন সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ট মহা-মানব । তিনি নিশ্চয়ই অন্যান্য সকলের চেয়ে অধিক জ্ঞানের অধিকারী । তাই তো তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দ্বাযিত্ব প্রাপ্ত ছিলেন । তিনি নিঃসন্দেহে তার উম্মতের হেদায়েতের জন্যে কাউকে নিয়োগ করে গেছেন ।
আল কোরআন ও হাদীসে নববী থেকে খেলাফতের উত্তরাধীকার সম্পর্কিত প্রমাণ পেশ করার পূর্বে বিবেকবান ব্যক্তিদের কাছে সামান্য বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা উপস্থাপন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছি ।
ধরুন আপনাকে বলা হল আপনার এলাকার সমস্যাবলী তুলে ধরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সমীপে একটি সুন্দর পত্র প্রেরণ করতে হবে যাতে তার কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য হয় । আপনার সামনে চারটি কাগজ রাখা আছে । প্রথম কাগজটির উপরিভাগ কালিমাখা ও আকাবাকা অনেক দাগে ভরপুর আর নিচের অংশ পরিস্কার । দ্বিতীয় কাগজের নিচের অংশ ময়লা ও কালিমাখা আর উপরের অংশ পরিস্কার । তৃতীয় কাগজটির সম্পূর্ণটাই কালো আর আর বহু আকাবাকা দাগ । আর চতুর্থ কাগজটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, দাগের লেশ মাত্র নেই, সুন্দর একখানা কাগজ । আপনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লেখার জন্য কোন ধরণের কাগজটি নির্বাচন করবেন ? নিশ্চয়ই প্রতিটি রুচিশীল ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্যে চতুর্থ প্রকার কাগজে চিঠি লেখাটাই হবে সর্বোত্তম কাজ ।
তাহলে বলুন নবী (সা.) এর এ মহাসম্মানিত খেলাফতের পদে নির্বাচনের জন্যে আপনি কি এমন কোন সাহাবীকে নির্বাচন করবেন যার কাজ কর্ম, চিন্তা-ধারায় ইসলাম পূর্ব কালে বহু কালিমা বিদ্যমান ছিল ? নাকি এমন কোন ব্যক্তিকে, যিনি ইসলাম পূরর্বকালে খুব ভাল লোক ছিলেন কিন্তু ইসলামের সুমহান আদর্শে নিজেকে আলোকিত করতে পারেন নি ? আর যার সবটুকুই অন্ধকারে নিমজ্জিত তাকে তো কোন মতে কেউ এ সম্মানিত পদের জন্যে নির্বাচন করবেন না । তাকেই নির্বাচন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে যার জীবনে সামান্য পরিমান কালিমা পড়েনি । যিনি এক মূহুর্তের জন্যেও শেরক করেন নি । যিনি বাল্যকাল থেকে মহানবীর (সা.) পবিত্র কোলে লালিত-পালিত হয়েছেন । যার জ্ঞানের তোরণ অতিক্রম করে মহানবীর জ্ঞানের মহানগরীতে পদার্পন করতে হয় ।
নবীজী (সা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
انا مدینة العلم و علی بابها
অর্থাৎঃ আমি হলাম জ্ঞানের নগরী আর আলী হচ্ছে তার দরজা ।১
নবী (সা.) ও তার পরবর্তী উত্তরাধীকার নির্বাচনের প্রতি দিক-নির্দেশনার লক্ষ্যে আল কোরআন স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছে ।
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
অর্থাৎঃ-আল্লাহ মনস্থ করলেন তোমাদেরকে সমস্ত অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখতে হে আহলে বাইত এবং মনস্থ করলেন তোমাদেরকে পুত-পবিত্র করতে ।২
তথ্যসূত্রঃ
১. সহি তিরমিযি, খণ্ড-২, পৃঃ ২৯৯, হাদীস নং-৩৮০৭ ।
২. সূরা আহযাব, আয়াত নং-৩৩ ।