মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার সঙ্গে অন্য অস্তিত্বশীল বস্তু বা প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্য রয়েছে। যেমন পূর্ণ মানুষ এবং পূর্ণ ফেরেশতা এক নয়। যদি কোন ফেরেশতা,ফেরেশতা হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বা সম্ভাব্য পূর্ণতার শেষ প্রান্তে পৌছায়,তা মানুষের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানো থেকে ভিন্ন।
মানুষের পূর্ণতার সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পূর্ণতার পার্থক্যের কারণ
যিনি আমাদের ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি (আল্লাহ্) বলেছেন,ফেরেশতারা এমন এক সৃষ্টি যারা নিখাদ আকল দিয়ে সৃষ্ট হয়েছেন,তাদের সৃষ্টির মূল কেবল চিন্তা ও বিবেচনা ছাড়া কিছুই নয় অর্থাৎ পার্থিব,জৈবিক চাহিদা,উত্তেজনা,উগ্রতা এগুলোর অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে অন্যান্য জীব শুধু শারীরিক এবং কোরআন যাকে রূহ বলছে তা থেকে বঞ্চিত। শুধু মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যে ফেরেশতাদের যা আছে তা লাভ করেছে আবার অন্যান্য সৃষ্টির যা আছে তারও সে অধিকারী। সে যেমন স্বর্গীয় তেমন পার্থিব। সে যেমন সর্বোচ্চ সৃষ্টি তেমনি সর্ব নিকৃষ্টও হতে পারে। এরই ব্যাখ্যায় উছুলে কাফীতে একটি হাদীস এসেছে এবং আহলে সুন্নাতও এর কাছাকাছি হাদীস বর্ণনা করেছে। মাওলানা রুমী তার মাসনভীতে এ হাদীস এভাবে কবিতার মাধ্যমে এনেছেন-
“ হাদীসে এসেছে গৌরবময় স্রষ্টা মহাজন,
সৃষ্টি জগতে করিলেন তিন রকম সৃজন।”
তারপর বলছেন,এক দলকে নিখাত নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন অন্য দলকে (উদ্দেশ্য জীবজন্তু) শুধুই উত্তেজনা এবং জৈবিক চাহিদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,কিন্তু মানুষকে এ দু’ য়ের মিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পরিপূর্ণ মানুষ যেমন একটি পরিপূর্ণ পশুর থেকে ভিন্ন (উদাহরণস্বরূপ সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি ঘোড়া থেকে আলাদা) তেমনি একজন পূর্ণ ফেরেশতা থেকেও ভিন্ন।
ফেরেশতা ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পাথর্ক্যের কারণ তার সত্তার উপাদান যেমন কোরআন বলছে,“ আমরা মানুষকে এমন বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি যাতে অনেক কিছুর মিশ্রণ রয়েছে।” আধুনিকতার ভাষায় বললে তার জীনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মেধা,যোগ্যতা ও ক্ষমতার সমন্বয় হয়েছে। মানুষ এমন মর্যাদায় পৌছেছে যে,আমরা তাকে পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করেছি। এটি অত্যন্ত.গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মানুষ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে,আমরা তাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা ও নম্বর প্রদানের জন্য যোগ্য মনে করেছি। ( إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ ) নিশ্চয়ই মানুষকে এমন বীর্য যা বহু গুণাবলী ও শক্তির মিশ্রণ তা থেকে সৃষ্টি করেছি। এজন্যই তাকে পরীক্ষা,পুরস্কার,শক্তি ও নম্বর প্রদান করেছি। কিন্তু অন্য কেউ যোগ্যতা রাখে না।
فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا
“ অতঃপর আমরা তাকে সম্যক শ্রবণকারী এবং দর্শনকারী করেছি। নিশ্চয় আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছি,হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে,নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে।” (সূরা দাহর : ২-৩)
এর থেকে ভালো ও সুন্দরভাবে মানুষের স্বাধীনতা ও এখতিয়ার এবং এর মূল ভিত্তিকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছি,উত্তীর্ণের পথও তাকে বলে দিয়েছি। এখন সে নিজেই বেছে নিবে কোন্ দিকে সে যাবে।
সুতরাং কোরআনের এ বর্ণনা থেকে পরিষ্কার হয় যে,পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার কারণ এ বহুবিধ গুণাবলী ও শক্তি। তাই ফেরেশতার সঙ্গে তার পার্থক্য।
মানুষের পূর্ণতা তার ভারসাম্যতার মধ্যেই নিহিত। অর্থাৎ মানুষ বহুবিধ যে যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তা তাকে তখনই পূর্ণ মানুষে পরিণত করে যখন সে শুধু একদিকে ঝুকে না পড়ে এবং অন্যান্য দিকগুলোকে উপেক্ষা বা নিষ্ক্রিয় করে না রাখে,বরং সবগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে এবং সমভাবে এগুলোর বিকাশে সচেষ্ট ও মনোযোগী হয়। যেমনভাবে জ্ঞানীরা বলেন প্রকৃতপক্ষে আদল বা সুবিচারের প্রত্যাবর্তন ভারসাম্য ও সমন্বয়ের দিকেই। এখানে ভারসাম্য ও সমন্বয়ের উদ্দেশ্য এটাই যে,মানুষের যোগ্যতাসমূহের বিকাশের সাথে সাথে সেগুলোর মধ্যে যেন সমন্বয় থাকে। একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে আপনাদের নিকট সেটা পরিষ্কার করছি। একটি শিশুর যে দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে,যেমন তার হাত,পা,মাথা,কান,নাক,জিহ্বা,মুখ,দাঁত,চোখ,হৃৎপিণ্ড,কলিজা,পেট,পরিপাকতন্ত্র এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশ অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। সে শিশুই সুস্থ ও সম্পূর্ণ যার এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করেছে। ধরি একজন মানুষের শুধু নাক বিকাশ লাভ করেছে এবং অন্যান্য অঙ্গ বিকাশ লাভ করেনি (যেমন কার্টুনে দেখা যায়) অথবা শুধু চোখ অথবা মাথার বৃদ্ধি ঘটেছে,কিন্তু দেহের বিকাশ হয়নি অথবা এর উল্টোটা। এমনিভাবে কারো হয়তো হাতের বৃদ্ধি ঘটেছে,কিন্তু পায়ের বৃদ্ধি ঘটেনি বা পায়ের বৃদ্ধি হয়েছে,কিন্তু হাতের হয়নি- এমন মানুষের বিকাশ ঘটেছে,তবে তা ভারসাম্যপূর্ণ নয়।
পরিপূর্ণ মানুষ সে-ই যার মধ্যে সকল মূল্যবোধেরই বিকাশ ঘটবে এবং কোন মূল্যবোধই বিকাশহীন অবস্থায় থাকবে না,সে সাথে সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় রেখে মূল্যবোধগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছবে। পূর্ণ মানুষ সেই মানুষ যাকে কোরআন ইমাম বলে সম্বোধন করেছে-
وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا
“
এবং যখন ইবরাহীমকে তার প্রভু কতিপয় আদেশবাণী দ্বারা পরীক্ষা করলেন এবং তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন,(তখন) বলা হলো নিশ্চয় আমি তোমাকে মানব জাতির জন্য ইমাম ও নেতা নিযুক্ত করলাম।” (সূরা বাকারাহ্ : ১২৪)
ইবরাহীম (আ.) যখন কয়েকটি বিচিত্র ও বড় ঐশী পরীক্ষায় অবতীর্ণ ও উত্তীর্ণ হলেন এবং সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত হলেন তখনই পূর্ণ মানব বা ইমামতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হলেন। ইবরাহীম (আ.)-এর অন্যতম বড় পরীক্ষা ছিল আল্লাহর আদেশে তার পথে নিজ সন্তানকে নিজের হাতে কুরবানী করার প্রস্তুতি। তার আনুগত্য এ পর্যায়ে ছিল যে,যখন তিনি জানলেন আল্লাহ্ তাকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন তখন কোন দ্বিধা ছাড়াই তা করতে রাজী হলেন।
أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا
“অতঃপর তারা উভয়েই (আল্লাহর সমীপে) আত্মসমর্পণ করলেন এবং তিনি তাকে যবেহ করার জন্য কপালের উপর উপুড় করে শোয়ালেন।” অর্থাৎ ইবরাহীম (আ.) যেমন কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত ইসমাইল (আ.)ও তেমন কুরবানী হওয়ার জন্য প্রস্তত। তখন আল্লাহ্ তাকে আহবান করে বললেন,‘“ হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে অবশ্যই পূর্ণ করেছ।” তোমার নিকট আমরা যা চেয়েছি তা এপর্যন্তই। আমরা প্রকৃতই চাইনি তুমি তোমার সন্তানকে যবেহ কর,বরং শুধু দেখতে চেয়েছি তোমার অনুগত্যের সীমা আমার নির্দেশ ও সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে কতটুকু।
অতঃপর যখন ইবরাহীম (আ.) আগুনে নিক্ষেপ থেকে ও সন্তানকে কুরবানীর প্রস্তুতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এবং একাই এক গোত্র ও জাতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো“ আমরা তোমাকে মানব জাতির জন্য ইমাম মনোনীত করলাম।” তুমি এখন সে পর্যায়ে পৌছেছো যে,আদর্শ হতে পার। অন্যদের ইমাম ও নেতা হতে পার। ভিন্নভাবে বলা যায়,তুমি পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়েছ,তাই অন্য সকল মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হতে চাইলে তোমাকে অনুসরণ করবে।
হযরত আলী (আ.) একজন পূর্ণ মানব। এজন্য যে,সকল মানবিক মূল্যবোধ তার মধ্যে‘ সর্বোচ্চ পর্যায়ে’ এবং‘ সম্পূর্ণ ভারসাম্য সহকারে’ বিকাশ লাভ করেছে অর্থাৎ তিনটি শর্তই তার মধ্যে পূর্ণ হয়েছে।
এখন সামঞ্জস্য ও সমন্বয়ের বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করব। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা অনেকে না দেখে থাকলেও অবশ্যই এর কথা শুনেছেন। সমুদ্রে সব সময়ই জোয়ার-ভাটা হয়। কখনো পানি একদিকে আকর্ষিত হয় কখনো অন্য দিকে। সমুদ্র সব সময়ই উত্তাল ও গর্জনশীল। মানুষের আত্মাও সব সময় অস্থির,কখনো তা একদিকে কখনো অন্যদিকে আকর্ষিত হয়। সমাজও তেমনি,কখনো একদিকে কখনো অন্যদিকে ধাবিত হয়। সমাজের প্রবণতার উৎস হয়তো কোন ব্যক্তিবর্গ বা আন্দোলন বা অন্যকোন কারণ,কিন্তু আকর্ষণ যে আছে এটা সত্য।
এমনকি মানুষের মানবিক মূল্যবোধসমূহও এরূপ। যেমন আপনারা এক শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গকে দেখেন যাদের প্রবণতা প্রকৃতই মানবীয় প্রবণতা। কিন্তু কখনো কখনো তাদের মধ্যে কোন কোন মানবিক মূল্যবাধ একপেশেভাবে একদিকে এমনভাবে ধাবিত হয় যে,অন্যান্য সকল মূল্যবোধকে তারা ভুলে যায়। তখন এর আকৃতি সেই ব্যক্তির মত হয় যার শুধু কান,নাক বা হাত বিকাশ লাভ করেছে।
এটি একটি লক্ষণীয় বিষয় যে,প্রায়ই সমাজ কোন প্রবণতার দ্বারা আকর্ষিত হয়ে একশ’ ভাগ বিচ্যুতি বা পথভ্রষ্টতার দিকেই শুধু ধাবিত হয় না,বরং বাড়াবাড়ির মাধ্যমে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। অধিকাংশ মানুষ এভাবেই সে দিকে ঝুকে পড়ে।
বিশেষ মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির নমুনা
১. ইবাদত : অন্যতম মানবিক মূল্যবোধ ইসলাম যাকে শত ভাগ গূরুত্ব দেয় তা হলো ইবাদত। এখানে ইবাদত যে বিশেষ অর্থে সাধারণত ব্যবহৃত হয় সেটা বলাই আমাদের লক্ষ্য। যেমন একান্তভাবে খোদার সঙ্গে বসা,নামায,দোয়া,মোনাজাত,তাহাজ্জুদ ও এ ধরনের অন্যান্য যে বিষয় ইসলামে রয়েছে এবং ইসলাম থেকে যেগুলো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
ইবাদত প্রকৃতপক্ষেই একটি মূল্যবোধ। কিন্তু যদি সাবধানতা অবলম্বন না করা হয় তবে সমাজ এ মূল্যবোধের চরম বাড়াবাড়ির দিকে ধাবিত হবে অর্থাৎ ইসলাম বলতে বুঝাবে শুধু ইবাদত করা,মসজিদে যাওয়া,মুস্তাহাব নামায পড়া,দোয়া করা,মিলাদ পড়া,মুস্তাহাব গোসল করা,কোরআন তেলাওয়াত। কোন কোন সমাজ এ পথে বাড়াবাড়ির এমন পর্যায়ে পৌছায় যে,অন্য সকল মূল্যবোধকে প্রায় মুছে ফেলে। এর উদাহরণ আমরা ইসলামের ইতিহাসে দেখেছি। এ ধরনের প্রবণতা ইসলামী সমাজে,এমনকি ব্যক্তির মধ্যেও ছিল। এজন্য শত ভাগ অনুভূতিহীন এই সকল ব্যক্তিকে একেবারে দায়ী করা যায় না। কারণ এরা এক মরুভূমিতে জীবন যাপন করত এবং যখন এ রাস্তায় তাদেরকে টেনে আনা হয়েছে তখন তারা এর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। এমন ব্যক্তি বুঝতে সক্ষম নয় যে,আল্লাহ্ তাকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন,ফেরেশতা হিসেবে নয়। যদি সে ফেরেশতা হতো তাহলে এ পথে চলতে পারত। তাই মানুষের উচিত তার বিভিন্ন মূল্যবোধকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিকাশ ঘটানো।
রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নিকট খবর পৌঁছল যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইবাদতে মশগুল হয়েছেন। রাসূল রাগান্বিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে মসজিদে আসলেন এবং কিছুটা উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ما بال اقوام؟ “ এই দলের কি হয়েছে? (যদি আমাদের ভাষায় বলি,তাহলে বলতে হয়-এদের কি অসুখ হয়েছে?) শুনলাম এমন সব ব্যক্তি আমার উম্মতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে,আমি তো তোমাদের নবী,তদুপরি এমন নই। কখনই রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ইবাদত করি না,বরং এর কিছু অংশ বিশ্রাম করি এবং কিয়দংশ ঘুমাই। আমি আমার স্ত্রী ও পরিবারের জন্য সময় দিই। আমি প্রতিদিন রোযা রাখি না,কোন কোন দিন রোযা রাখি,কোন কোন দিন ছেড়ে দিই। যারা এ ধরনের পথকে বেছে নিয়েছে অর্থাৎ দুনিয়াত্যাগী হয়েছে তারা আমার সুন্নাত থেকে বের হয়ে গেছে।”
নবী (সা.) যখন অনুভব করেছেন একটি মূল্যবোধ অন্য সকল ইসলামী মূল্যবোধকে নিঃশেষ করে দিচেছ এবং ইসলামী সমাজ একদিকে ঝুকে পড়েছে তখন শক্তভাবে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
আমর ইবনে আসের দু’ জন পুত্র ছিল। একজনের নাম মুহাম্মদ যে তার পিতার মতই দুনিয়াদার এবং দুনিয়াপূজারী,অন্যটির নাম আবদুল্লাহ্ যে তুলনামুলকভাবে শান্ত,ভালো ও ভদ্র। সাধারণত এ দু’ পুত্রের সঙ্গে পিতা যে পরামর্শ করত তাতে আবদুল্লাহ্ পিতাকে আলী (আ.)-এর দিকে দাওয়াত করত এবং মুহাম্মদ পিতাকে বলত আলীর পক্ষে থেকে কোন লাভ নেই,তাই মুয়াবিয়ার দিকে যাও। রাসূল (সা.) একবার আবদুল্লাহর নিকট গিয়ে বললেন,“ আমাকে খবর দেয়া হয়েছে যে,তুমি রাত্র হতে সকাল পর্যন্ত ইবাদত কর আর দিনের বেলা রোযা রাখ।” তিনি বললেন,“ হ্যাঁ,ইয়া রাসূলাল্লাহ্।” রাসূল বললেন,“ আমি এরূপ করি না এবং এটা ঠিকও নয়। তুমি এটা ত্যাগ কর।”
কখনো সমাজ যুহদ (দুনিয়াবিমুখতা বা আত্মসংযম) অবলম্বন করতে গিয়ে বৈরাগ্যের দিকে ধাবিত হয়। যুহদ একটি প্রয়োজনীয় বস্তু যা অস্বীকার করা যায় না। এটি একটি মূল্যবোধ যার উপকারী ও ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এটি ব্যতীত সমাজ সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌছতে পারে না। যে সমাজে এটি নেই সে সমাজকে ইসলামী সমাজ বলা যায় না। কিন্তু কখনো কখনো এই মূল্যবোধ সমাজকে এমনভাবে নিজের দিকে টেনে নিয়ে যায় তখন সমাজে যুহদ ছাড়া কিছুই থাকে না।
২. সৃষ্টির সেবা : ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য মূল্যবোধ আল্লাহর সৃষ্টির সেবা যা প্রকৃতই একটি মানবীয় মূল্যবোধ। এ বিষয়ে রাসূল (সা.) অত্যন্ত তাকিদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন একে অপরকে সহযোগিতা ও সাহায্য করার ব্যপারে বলছে,
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ
“এটা পুণ্যকর্ম নয় যে,তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডলকে পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে ফেরাও,বরং প্রকৃত পুণ্যবান ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহ্,পরকাল,ফেরেশতাগণ,কিতাবসমূহ এবং নবিগণের উপর ঈমান রাখে এবং তারই প্রেমে আত্মীয়-স্বজন,এতীম,মিসকীন,মুসাফির,সাহায্যপ্রার্থীদের এবং বন্দী মুক্তির জন্য ধন-সম্পদ খরচ করে।” (সূরা বাকারাহ্ : ১৭৭)।
কিন্তু মানুষ হঠাৎ করে শেখ সা’ দীর মতো হয়ে (যদিও ব্যবহারিক জীবনে সা’ দী এরূপ ছিলেন না) কবিতার ভাষায় বলে ওঠে,“ ইবাদত সৃষ্টির সেবা ছাড়া কিছুই নয়।” শুধু এটা করলেই যথেষ্ট। কেউ কেউ এটা বলার মাধ্যমে ইবাদতের গুরুত্বকে অস্বীকার করে। আত্মসংযমের মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। জ্ঞানার্জন ও জিহাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করে। এ সকল মহামূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ যা ইসলামে রয়েছে তা অস্বীকার করে বসে। বলে যে,‘ জানেন মনুষ্যত্ব কি? মনুষ্যত্ব হলো আল্লাহর সৃষ্টির সেবা।’ বিশেষ করে আজকালের কিছু বুদ্ধিজীবী মনে করেন একটি অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি হাতে পেয়েছেন যার নাম মানবতাবাদ ও মানবপ্রেম। মানবপ্রেম কি? তারা বলেন,সৃষ্টির সেবা করা। আমরা আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করছি। আমরা বলি,অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করতে হবে। কিন্তু ঐ খোদারসৃষ্টি নিজে কি হবে? ধরে নিলাম যে,আল্লাহর সৃষ্টির উদরকে পূর্ণ করলাম,তার দেহকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করলাম তাতে স্রষ্টার সৃষ্টির সেবা একটি পশুকে সেবা দানের সমান হয়েছে,এর বেশি কিছু নয়। যদি আমরা মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় কোন মূল্যবোধকে গ্রহণ না করে শুধু সৃষ্টির সেবার মূল্যবোধকে গ্রহণ করি তাহলে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মূল্য ছাগল বা ঘোড়ার সমপর্যায়ের হবে। যদি মানুষ একটি প্রণীকে খাদ্য দেয়,তবে অবশ্যই সে একটি কাজ করেছে। কিন্তু মানুষের সর্বোচ্চ মর্যাদা কি এটা যে,আমার মতো অন্যান্য প্রাণীকে সেবা করব? না,মানব সেবার এর থেকেও বড় মূল্যবোধ রয়েছে। কিন্তু শর্ত হলো‘ মানুষ কি’ সেটা জানতে হবে। সব সময়ই (এ কথা বলে উদাহরণ দিই) :লুলুম্বাও একজন মানুষ,মুসা চুম্বাও একজন মানুষ। যদি বিষয়টি শুধু সৃষ্টির সেবা হয় তবে মুসা চুম্বাও এক সৃষ্টি লুলুম্বাও অন্য এক সৃষ্টি এদের মধ্যে কেন পার্থক্য করব। আবু যার (রা.) ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সেবার দৃষ্টিতে কি দু’ জনকেই সেবা করতে হবে?
সুতরাং মানবিকতা অর্থাৎ সৃষ্টির সেবাকে যদি একমাত্র মূল্যবোধ ধরা হয়,তবে তা এক ধরনের বাড়াবাড়িই হবে।
৩. স্বাধীনতা : স্বাধীনতা একটি বড় ও উচ্চ পর্যায়ের মানবিক মূল্যবোধ। অন্যভাবে বলা যায়,এটা মানুষের নৈতিকতা ও আত্মিকতার বিষয় অর্থাৎ পশু পর্যায়ের অনেক উপরের বিষয়। স্বাধীনতা মানুষের বস্তুগত মূল্যবোধের ঊর্ধ্বের একটি মূল্যবোধ। কোন মানুষের মধ্যে যদি মনুষ্যত্বের কিছুমাত্র থাকে,তবে সে ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত,বস্ত্রহীন বা সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় জীবন যাপন করতে পারে,কিন্তু কারো দাস হতে রাজী নয়। সে কারো অধীনে থাকতে চায় না,বরং স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে চায়।
নিশ্চয় জানেন দুঃখজনকভাবে ইবনে সিনা কিছুদিন বাদশাহর উজির ছিলেন। তার জীবনের তৎসময়ের একটি চমৎকার গল্গ‘ নামেহ্-ই-দানেশওয়ারান’ গ্রন্থে এসেছে- একদিন তিনি রাজকীয় আভিজাত্যময় পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে যাচিছলেন। তিনি দেখলেন এক মেথর পঁচা ময়লা ও আবর্জনা পরিষ্কার করছে আর এ কবিতা পড়ছে-
“ আমি গর্বিত আমার আত্মসম্মানকে নিয়ে,
যেহেতু আমার হৃদয়ের জন্য এ বিশ্বকে সহজ করে দিয়েছে।”
আবু আলী সিনা এটা শুনে মুচকি হেসে চিৎকার করে ডেকে তাকে বললেন,“ বাস্তবে সম্মান ও মর্যাদার সীমা কি এটাই যা তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বলছ। চিন্তা করেছ কি যার আত্মমর্যাদাবোধতাকে নর্দমার গর্তে নিকৃষ্ট মেথরের কাজে নিয়োজিত করেছে। যার ইজ্জত ও সম্মান এটাই যে,অসম্মান ও অমর্যাদার মধ্যে পড়ে আছে,মূল্যবান জীবনকে মানবেতর পথে ধ্বংস করছে,তাকে নিয়ে তুমি গর্ব করছ?” মেথর লোকটি কাজ বন্ধ করে সংক্ষেপে জবাব দিল,“ পৃথিবীতে সম্মান এটাই যে,খাদ্যের জন্য নীচ পর্যায়ের কাজ হলেও করা,কিন্তু কোন প্রভুর অধীনে না থাকা” (অর্থাৎ স্বাধীনতার অর্থ কোন প্রভুর মন যুগিয়ে চলা নয়)। আবু আলী লজ্জিত হয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
আবু আলী দেখলেন বাস্তবিকই এটি এমন যুক্তি যার কোন জবাব নেই। বস্তুগত ও পাশবিক দৃষ্টিতে এর কোন অর্থ হয় না যে,মানুষ মুরগী,পোলাও,দাস-দাসী,অশ্ব ও অর্থকে ত্যাগ করে মেথর হয়ে স্বাধীনতা লাভ ও আত্মতৃপ্তির কথা বলে। স্বাধীনতা ও মুক্তি কি? এটা কি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করার মত বিষয়? না,এ রকম কিছু নয়। কিন্তু মানুষের বিবেকের কাছে স্বাধীনতার গুরুত্ব এত অধিক যে,বন্দিত্ব থেকে মেথর হওয়াকে প্রাধান্য দেয়।
স্বাধীনতা প্রকৃতই একটি বড় মূল্যবোধ। কখনো দেখা যায় একটি সমাজে এই মূল্যবোধ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। কখনো দেখা যায় এই অনুভুতি জেগে উঠেছে। কেউ কেউ বলেন মানুষের মনুষ্যত্বতার স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। তাদের মতে এটি ছাড়া অন্য কোন মূল্যবোধই যেন নেই অর্থাৎ তারা চান সকল মূল্যবোধকেই এই এক মূল্যবোধের মধ্যে মুছে ফেলতে। কিন্তু স্বাধীনতা একমাত্র মূল্যবোধ নয়। ন্যায়পরায়ণতা,সুবিচার,প্রজ্ঞা স্বতন্ত্রভাবে একেকটি মূল্যবোধ। জ্ঞান একটি মূল্যবোধ,আধ্যাত্মিকতা একটি মূল্যবোধ,এরূপ অন্য সকল মূল্যবোধ।৪ . ইশ্ক বা ভালবাসা : কখনো কখনো ইশ্ক বা প্রেম একমাত্র মূল্যবোধে পরিণত হয় যেরূপ এরফান (আধ্যাত্মিক),তাসাউফ ও সুফী গজলগুলোতে দেখা যায়।
“ ফেরেশতা জানে না ভালবাসা কি এই সাকী,
ঢালতে যদি চাও শরাব তবে ঢাল আদমেরই পায়।”
তখন তারা অন্যান্য সকল মূল্যবোধকে,এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধকেও ভুলে যায়। আরেফগণ ইশ্কের প্রতি যে টান অনুভব করেন অনেক সময় তা পুরোপুরি বুদ্ধিবৃত্তির বিরোধী ও এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাফেজ শিরাজী বলেন,
“ সুফীর কাছেই রয়েছে রহস্যকে জানার আলো
সব কিছুর গোপন ভেদ এর থেকেই জানো,
ভোরে ডাকা মোরগই জানে‘ সকল ফুলের’ * ব্যাখ্যা
প্রতিটি কুক কুরুকের অর্থ তার জানা।”
(*সকল ফুল অর্থ আল্লাহর সত্তা যা সকল পূর্ণতার সমষ্টি।)
তিনি বলতে চান,কেবল আরেফই পারে ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহতে পৌছতে। কয়েক ছত্র পরেই বলছেন,
“ এই আকলের খাতা থেকে প্রেমের যে বাণী শিখেছ হায়,
শংকিত আমি জান না সত্যিই-যা জানার তায়।”
এ ছত্রে তার লক্ষ্য আবু আলী সিনার পুস্তক‘ ইশারাত’ যাতে তিনি ইশ্কের ব্যাপারে কথা বলেছেন।সুতরাং তাদের দৃষ্টিতে মানুষ ও মনুষ্যত্বের অর্থ হলো ইশ্ক এবং আকল একটি হাতকড়া,বেড়ী বা শৃঙ্খল বৈ কিছু নয়; তাই তা সম্পূর্ণরূপে নিন্দিত।
এক সময় দেখা যায় একমাত্র মূল্যবোধ বলতে হয়ে যায় শুধুই আকল এবং চিন্তা। বলা হয় এগুলো (ভালবাসা ও অন্যান্য মূল্যবোধ) আবার কি? এগুলো খেয়ালী ও গুরুত্বহীন যেমন-তেমন বিষয়। আবু আলী সিনা কখনো তার বক্তব্যে বলেছেন,“ এ শব্দগুলো সুফীদের খেয়ালী ও কল্পিত বস্তু,আমাদের উচিত আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির উপর ভর করে এগিয়ে যাওয়া।”
এ সকল প্রকার মূল্যবোধই মানুষের মধ্যে রয়েছে,যেমন বুদ্ধিবৃত্তি,স্নেহ-ভালবাসা,আকর্ষণ,ন্যায়বিচার,খেদমত (মানুষের জন্য কাজ করা),ইবাদত,স্বাধীনতা এবং অন্যান্য। এখন প্রশ্ন হলো কি ধরনের মানুষ পূর্ণ মানুষ? সে ব্যক্তি যে শুধুই উপাসক? নাকি যে ব্যক্তি স্বাধীন? নাকি যে ব্যক্তি শুধুই প্রেমিক? অথবা সে ব্যক্তি যে শুধু চিন্তাশীল? না,প্রকৃতপক্ষে এদের কেউই পূর্ণ মানব নয়। পূর্ণ মানব সেই ব্যক্তি যার মধ্যে এ সকল প্রকার মূল্যবোধই সর্বোচ্চ পর্যায়ে ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছে। আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তেমন একজন মানুষ।