মানুষের নৈতিকতা
মানবসত্তা ও তার স্বরূপ সম্পর্কে বিশেষ মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও এ বিষয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট অন্য একটি বিষয়ে কোন মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। আর তা হলো এমন বিষয়ের অস্তিত্ব যা বস্তু বা বস্তুগত নয়- যাকে ‘নৈতিকতা’ নামকরণ করা যেতে পারে এবং যা মানুষকে মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব দান করে। মানুষ বলতে তার এই বৈশিষ্ট্য ধারণকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যদি তাকে এ বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথক করা হয় তাহলে পশুর সাথে তার কোন পার্থক্য থাকে না। অন্যভাবে বলা যায়,মানুষের মনুষ্যত্ব তার বাহ্যিক দেহাবয়বে নয় যে,কারো একটি মাথা,দু’ টি কান,প্রশস্ত নখ,পরিমিত উচ্চতা ও যা ইচ্ছে তা-ই করুক না কেন তাকে মানুষ বলা যাবে। না,তেমনটি নয়। শেখ সা’ দী যথার্থই বলেছেন,
“দেহ তোমায় মহান করে না,করে যা আত্মায়,
হৃদয় রাঙানো পোশাকে তোমার সৌন্দর্য নয়,
নয় তাতে মনুষ্য পরিচয়।
চক্ষু,কণ্ঠ,জিহ্বা আর নাসিক্যে যদি হয় মনুষ্য পরিচয়,
কি তফাৎ বল দেয়ালের ঐ ছবি আর মানবসত্তায়?”
যদি এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারীকেই মানুষ বলা হয়,তবে সকলেই মানুষ (আমরা দৈনন্দিন জীবনে মানুষ থাকা ও মানুষ হওয়া এ কথাগুলো ব্যবহার করি,এমনকি এ দৃষ্টান্ত ধর্মীয় ছাত্রদের মধ্যেও ব্যাবহৃত হয়,যেমন মোল্লা হওয়া কত সহজ,কিন্তু মানুষ হওয়া কত কঠিন!) হিসেবেই মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে জন্ম নিত। কিন্তু না। মানুষ হওয়া মানে হলো বিশেষ গুণ,চরিত্র ও অর্থের অধিকারী হওয়া। যার ফলে তাকে মানুষ বলা যায় এবং সে মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব অর্জন করে। ইদানিংএ সকল বিষয়ই (যার উপস্থিতি মানুষকে মূল্যবোধ দান করে আর যার অনুপস্থিতি তাকে পশুর সামিল করে)-‘মানবিক মূল্যবোধ’ নামে পরিচিত।
অদ্যকার এ সভায় আমার বক্তব্যকে পূর্ববর্তী সভার আলোচ্য বিষয়ের ধারাবাহিকতায় অনুবর্তন করব। উল্লেখ্য যে,ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিচ্যুতিসমূহকে দু’ ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের বিচ্যুতি আছে যাতে‘ মূল্যবোধহীনতা’ ‘মূল্যবোধ’ -এর বিপরীতে অবস্থান নেয়। যেমন : অন্যায় ন্যায়ের বিরুদ্ধে,ভয়-ভীতি মুক্তির বিরুদ্ধে,খোদার প্রতি উদাসীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা খোদার উপাসনা ও শৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে; অজ্ঞতা ও মূর্খতা জ্ঞান,বিবেক ও প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে সম্ভবত অধিকাংশ বিচ্যুতিই উল্লিখিত ধরনের নয় যাতে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেয়। যেখানে মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেয় সেখানে প্রথমোক্তটি (মূল্যবোধহীনতা) অপনোদিত হয়। মানবকুলের অধিকাংশ বিচ্যুতিই নদীর জোয়ার ভাটার মতই। কখনো কখনো কোন বিশেষ মূল্যবোধ অপর মূল্যবোধসমূহ অপেক্ষা এতটা প্রবৃদ্ধি লাভ করে যে,অন্যান্য মূল্যবোধকে ধ্বংস করে ফেলে। যেমন : সংযম ও ধর্মানুরাগ একটি মূল্যবোধ যা মনুষ্যত্বের মানদণ্ডসমূহের মধ্যেও একটি। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যুহদের (দুনিয়া বিমুখতা) প্রতি এতটা ঝুকে পড়ে যে,তাতে বিলীন হয়ে যায় এবং অন্য সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অবশেষে এমন এক মানুষে পরিণত হয় যার একটি অঙ্গই (যেমন : নাক) প্রবৃদ্ধি লাভ করে এবং অন্যান্য অঙ্গ অপরিবর্তিত থেকে যায়।