কা’বা ঘর কেন্দ্রিক ইবাদাতের বিধান কি প্রতিমা পূজার সাথে তুলনীয় ?
প্রশ্ন : ইসলামে কা’বা ঘর কেন্দ্রিক ইবাদাতের বিধান কি প্রতিমা পূজার সাথে তুলনীয় নয়? এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
উত্তর : ইসলাম একত্ববাদের ধর্ম। শির্ক তথা পৌত্তলিকতাবাদের কোন স্থানে এতে নেই। অংশীবাদকে ইসলামে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কুরআনের ঘোষণা হল : ‘আল্লাহ্ সকল গোনাহ মার্জনা করবেন। কেবল শির্ক ছাড়া।’ আর মূর্তিপূজা হল অংশীবাদের জ্বলন্ত উদাহরণ। এ কারণে মহানবী (সা.) আপোষহীনভাবে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন সেটা হল হযরত আলী (আ.)-এর সাহায্য নিয়ে কা’বাঘরের অভ্যন্তর থেকে ছোট-বড় সকল মূর্তি নির্মূল করা। এটা শুধু মহানবী (সা.)-ই নন, আল্লাহ্র সকল পয়গম্বর এ ব্যাপারে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক মূর্তি ভাঙ্গার বিখ্যাত ঘটনা আমাদের সবারই জানা।
ইসলাম মূর্তিপূজা থেকে এতটাই বিমুখ যে, এর তাওহীদের (একত্ববাদের) দাওয়াতের সূচনা থেকে যাতে মুসলমানরা (যারা সবেমাত্র পৌত্তলিকতা ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল) কোনভাবেই মূর্তির দিকে মনোযোগী না হয় সেজন্য তাদের কা’বাঘরের দিকে ফিরে নয়; বরং বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায পড়ার নির্দেশ জারী করেছিল। যাতে তাদের দেহ-মন সর্বান্তকরণে যে কোন ধরনের পৌত্তলিকতা ও অংশীবাদী ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া থেকে পবিত্র থাকে। কারণ, কা’বা তখনও ছিল মূর্তিপূজকদের মূল প্রতিমালয়।
ইসলামের দীনি শিক্ষার আদর্শ হল আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি অশীরীরি, নিরাকার। আর আল্লাহ্-বিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ মানুষ কোন মাধ্যম ছাড়াই তার অন্তর্যামী অর্থাৎ আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম। তাঁর কাছে নিজের মনের কামনা নিবেদন করতে এবং তাঁর কাছে ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে।
এবার মূল প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। নিম্নোক্ত রেওয়ায়াতে উপরিউক্ত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ইবনে আবিল আওজা একজন কাফের, জিন্দিক (নাস্তিক) ও মুলহিদ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ছিল। একদিন সে হজের মৌসুমে তার মতানুসারী একদল লোক নিয়ে মসজিদুল হারামে বসেছিল এবং হাজীবৃন্দের তাওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি হজের আমলগুলো পর্যবেক্ষণ করছিল। এসব দেখে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও হাসাহাসি করছিল। মসজিদের আরেক স্থানে ইমাম সাদিক (আ.) অসংখ্য অনুসারী নিয়ে বসেছিলেন। তারা এ মহান ইমামের আসমানী জ্ঞানের ফায়েয লাভ করে চলেছিল।
এমন সময় ইবনে আবিল আওজা ইমামের মজলিসের নিকটবর্তী হয়ে বলল : ‘আর কতদিন এ খড়কুটোকে গুড়ো করবেন… এবং এ পাথর ও কাদার ঘরের ইবাদাত করবেন। আর চমকে ওঠা উটের পালের মতো ঐ ঘরের চারপাশে পড়বেন ও উঠবেন? যে কেউ এ ঘরের আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে চিন্তা করবে সে বুঝতে পারবে যে, এগুলোর নির্দেশদাতা বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞাবিবর্জিত ছিল।’
ইমাম সাদিক (আ.) উত্তর দিলেন : ‘এ (কা’বা) হল এমন ঘর যা প্রজ্ঞাবান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করার মাধ্যম হিসাবে নির্ধারণ করেছেন এবং তাদেরকে এর সম্মান ও যিয়ারত করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। যাতে এটা মহান আল্লাহ্র দরবারে বান্দাদের ইবাদাত ও বিনায়বনত হওয়ার ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও আত্মসমর্পণের দীপ্যমান মাপকাঠি হয়। আর নিখাঁদ ঈমানদার ও মহান আল্লাহ্র নির্দেশের নিষ্ঠাবান আনুগত্যকারীরা ঈমানহীন মুনাফিক লোকদের থেকে পৃথক হয়ে যায়। এ হল নবিগণের অবস্থান স্থল এবং নামায আদায়কারীদের কিবলা। আর পরম দয়াময় মহান আল্লাহ্র ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথস্বরূপ। কাজেই, এখানে পাথরকে পূজা করাও উদ্দেশ্য নয়, মূর্তির ইবাদাত করাও উদ্দেশ্য নয়; বরং উপাস্য হলেন মানবের দেহ ও প্রাণের স্রষ্টা, যিনি যমিন ও আসমানের স্রষ্টাও বটে। এ গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং এ পাথরকে চুম্বন করা মূলত আল্লাহ্র নির্দেশ পালনার্থেই (বিহারুল আনওয়ার, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২০৯)।’
এ কারণেই আখলাক শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ বলেন : ‘যখন হজ পালনকারীর চোখ কা’বা ঘরের ওপরে পড়ে, তখন তার এ ঘরের মহিমা উপলব্ধিতে আনা উচিত এবং এমন কল্পনা করা উচিত যেন ঘরের মালিককে দর্শন করছে। আর আশা পোষণ করবে যেন তাকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য দান করেন, যেমনভাবে তাঁর ঘরের সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য তাকে প্রদান করেছেন। আর আল্লাহ্কে শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে। কেননা, তিনি তাকে নিজের ঘরে এনে পৌঁছিয়েছেন এবং তাঁর অতিথিবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সে আরও স্মরণ করবে কিয়ামতের কথা, যেদিন সকল সৃষ্টি বেহেশত লাভের আশা-নিরাশায় দুলতে থাকবে (জামেউস সা’দাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৯১; হাজ্জে আরেফান, পৃ. ১০৭;)।’
এখন কা’বাঘর যিয়ারত ও মসজিদুল হারামে ইবাদাত করা আর মূর্তিপূজা ও প্রতিমালয়ে উপাসনা করার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মূর্তিপূজকরা স্বয়ং মূর্তির পূজা করে। আর তাদের পাথর বা কাঠের মূর্তিগুলোর সুরক্ষার জন্য প্রতিমালয় নির্মাণ করে। কিন্তু কা’বা নির্মাণ হয়েছে আল্লাহ্র নির্দেশে জমিনের ওপরে তাঁরই চিহ্ন হিসাবে, যা ইতিহাসের শুরু থেকেই নির্মিত হয়েছে।
মসজিদুল হারাম, যা কা’বাঘরকে বেষ্টন করে অবস্থিত, এর ইতিহাস খোদ কা’বা ঘরের ইতিহাসেরই সমান। সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আদম (আ.) ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর পুনঃনির্মাণ করেন। মসজিদুল হারাম হল জমিনের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ। কুরআন মহা সম্মানে এর স্মৃতিচারণ করেছে এবং কাফের ও মুশরিকদের জন্য এর তত্ত্বাবধান তো দূরের কথা, এর ভেতরে প্রবেশকেই নিষিদ্ধ করেছে।
আল্লাহ্র মহান নবিগণ এবং তাঁর সৎকর্মশীল (সালেহ) ও সত্যবাদী (সিদ্দীক) বান্দাগণ এ ঘরে উপস্থিত হয়েছেন এবং আল্লাহ্র ইবাদাত-বন্দেগী করেছেন। অন্য সব মসজিদও তাঁরই ইবাদাত ও তাঁর কাছে দো‘আ করার স্থান, মুসলমানদের সমাবেত হওয়ার স্থান ও ঐক্যের কেন্দ্র। শুধু পবিত্র লোকেরাই এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। আর স্বয়ং আল্লাহ্ মসজিদের গুণ-বর্ণনা করেছেন এরূপে :
‘জমিনে মসজিদগুলোই হল আমার ঘর। এ ঘর আসমানবাসীর জন্য জ্বলতে থাকে, যেমনভাবে আকাশের তারকারাজি যমিনের বাসিন্দাদের জন্য আলো ছড়াতে থাকে। ধন্য সেই বান্দা, যে তার নিজের ঘরে ওযু গ্রহণ করে, অতঃপর আমার ঘরে আমাকে যিয়ারত করে..(ওসায়িলুশ শিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৬৮)।’
এখন আপনিই আল্লাহ্র মসজিদগুলোকে অন্যান্য উপাসনালয়ের (মন্দির, গীর্জা …) সাথে তুলনা করুন এবং এদের পার্থক্য চিত্রিত করুন। (সূত্র:প্রত্যাশা)