সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
রহমত, বরকত ও মাগফেরাতের মাস পবিত্র রমজান । চন্দ্র্বৎসরের নবম মাস রমজান। এই রমজান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সহবাস সহ আল্লাহর নিষিদ্ধ সব কাজ থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলে। তাক্বওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করাই রোজার প্রধান উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। আশা করা যায়, এ থেকে তোমাদের মধ্যে তাক্বওয়ার গুনাবলী সৃষ্টি হবে।” সূরা বাকারা : ১৮৩।- মাহে রমযানের গুরুত্ব ও ফযিলত অসীম। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন সহ সকল আসমানী কিতাব রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। হাজার মাসের চাইতে উত্তম লাইলাতুল ক্বদর এই রমজান মাসেই। রোজা ফরজ হয় এই রমজান মাসেই। রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস এই রমজান। এই মাসে জান্নাতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। আর জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু মাত্র রমজানের জন্য বাকী এগারো মাস জান্নাতকে সাজানো হয়। এই মাসে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পথভ্রষ্ঠ শয়তানকে বেঁধে ফেলেন, যাতে সে মোমিনদের কোন ক্ষতি করতে না পারে। এ মাসের একটি ফরজ আদায় অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান। আর একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরজের সমান। এই মাসে যে কোন দান-সদকা, ভাল কাজের প্রতিফল আল্লাহপাক ৭০গুন করে দিয়ে থাকেন। যা অন্য মাসে মাত্র ১০গুন। জান্নাতের একটি দরজার নাম রাইয়ান। রোযাদারকে ঐ দরজা দিয়েই ডাকা হবে। যে রোজাদার এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সে কখনও পিপাসিত হবে না (তিরমিযী)।- যে ব্যক্তি আল্লাহার জন্য একদিন রোজা রাখেন, আল্লাহ পাক তাকে দোযখ থেকে সত্তর বছরের পথ দূরে রাখবেন (বুখারী)।- রোজাদার দুবার আনন্দ লাভ করে- (এক) ইফতারের সময় এবং (দুই) আল্লাহকে দেখার সময় (বুখারী ও তিরমিযী)।- রোযা ও কুরআন উভয়ই বান্দার জন্য শাফায়াত করবে। রোজা রাখা হয় আল্লাহর জন্য আর এর প্রতিদান দিয়ে থাকেন স্বয়ং আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন।
ইসলামের তৃতীয় রুকন হচ্ছে রোজা। শারিরীকভাবে সক্ষম, সাবালক ও আক্কেল প্রত্যেক মুসলমান নারী পুরুষ পবিত্র রমযান মাসে দিনের বেলা রোযা এরং রাতে বাদ এশা তারাবীর নামায আদায় করে থাকেন। যদিও রোযার সাথে তারাবীর কোন সম্পর্ক নেই। রোযা হচ্ছে ফরজ ইবাদত আর তারাবীর নামায হচ্ছে সুন্নত ইবাদত। রাতে তারাবীর নামায না পড়তে পারলেও দিনে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। মাযহাব অনুযায়ী তারাবীর নামায ৮/১২/২০ রাকাত পড়া হয়ে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে খতম তারাবী পড়ার প্রতি মুসল্লিদের ঝোঁক খুব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর একটি কারণ হতে পারে রমজান শরীফে কুরআন তেলাওয়াত করা এবং শোনায় অনেক বেশি সওয়াব। তবে আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিতে খতম তারাবীর মাধ্যমে কুরআন পড়া ও শোনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা সঠিক পদ্ধতিতে করা হচ্ছে কীনা তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। মহাপূণ্যময় মাস পবিত্র রমজানের পরিপূর্ণ সওয়াব প্রাপ্তির আশায় আমরা দিনের বেলা ক্ষুধা তৃষ্ণাকে তুচ্ছজ্ঞান করে সারাদিন উপবাস ও অনেক হালাল কাজ থেকে বিরত থাকি এবং রাতের বেলা অনেক কষ্ট করে ৮/১২/২০ রাকাত তারাবী নামায আদায় করি। আর এত কষ্টের এই তারাবী নামাযের ভিত্তি ও পদ্ধতি যদি সঠিক না হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে ?
পাঠক আপনারা ভাবতে পারেন, এ আবার কোন ফেতনার কথা শুনি। যে তারাবী নামায মুসলিম সমাজে শত শত বৎসর ধরে চলে আসছে এবং আলেম উলামা নির্বিশেষে সকল মুসলমান অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় পূণ্যের কাজ হিসেবে অনেক কষ্টে তারাবী নামায আদায় করে আসছেন, সেই তারাবী নামায সম্পর্কে আবার নতুন কী শুনি?
একটু ধৈর্য ধরে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পড়ুন, তারাবী নামাযের ইতিহাস এবং বাংলাদেশে খতমে তারাবী আয়োজনের বর্তমান অবস্থা। তারপর নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন এবং নিজেই সিদ্ধান্ত নিন। রোজা ফরজ হয় হিজরী দ্বিতীয় সনে এবং দশম হিজরীর রোজা পালন শেষে মহানবী (সাঃ) ইন্তেকাল করেন। এ হিসেবে তিনি তারঁ জীবদ্দশায় মোট ৮ বার রমজান শরীফ পেয়েছিলেন। প্রতি রমজান মাস ৩০ দিন ধরে হিসেব করলে আট বছরে হয় ২৪০ দিন আর ২৯দিন ধরে হিসেব করলে হয় ২৩২ দিন। যদি নবী করীম (সাঃ) এর জীবদ্দশায় প্রতিটি রমজান মাসকে আমরা ২৯দিন হিসেবে ধরেও হিসেব করি তাহলে তিনি মোট ২৩২ দিন দিনে রোযা এবং রাতে তারাবী নামায আদায় করার কথা। কিন্তু হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, তিনি প্রতিদিন রোযা রেখেছেন ঠিকই কিন্তু বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে তারাবীর নামায আদায় করি, তিনি সে পদ্ধতিতে একদিনও তারাবীর নামায আদায় করেননি।
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ফরজ নামায মসজিদে এবং অন্যান্য নামায নিজ ঘরে আদায় করতেন এবং এভাবে আদায় করার জন্য সবাইকে বলতেন। এতে সওয়াব বেশি। এটা আমরা সবাই জানি এবং মানি। হাদীস শরীফে আছে মহানবী (সাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র তিন দিন একা একা মসজিদে তারাবী নামায আদায় করেছিলেন। কোন কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণীত ২৩, ২৫ ও ২৭ রমযান এই তিন দিন তিনি এতেকাফরত অবস্থায় মসজিদের মেহরাবে নয়, এতেকাফের জন্য মসজিদের একপাশে চাটাই ঘেরা অস্থায়ী খাস কামরায় যখন তিনি একা একা নামায পড়ছিলেন তখন উপস্থিত অল্প সংখ্যক সাহাবা তা দেখতে পেয়ে তারাঁও তাঁর অজান্তে তাঁর পিছনে একতেদা করে নামায পড়েন। এভাবে একে একে তিন দিন চলে। চতুর্থ দিন বহু সংখ্যক সাহাবা মসজিদে গিয়ে উপস্থিত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু তিনি অস্থায়ী খাস কামরা থেকে বের হলেন না। তাতে তাঁরা ডাকাডাকি করলেন, দরজায় ধাক্কধাক্কি করলেন ও উচ্চস্বরে শোরগোল করলেন। তখন তিনি রাগান্বিত হয়ে তাঁদের দিকে বেরিয়ে এসে বলেন, “হে লোকেরা, তোমাদের অব্যাহত কার্যকলাপ দেখে আমার মনে হচ্ছে, অচিরেই উহা তোমাদের উপর ফরজ করে দেয়া হবে। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে, ‘নিজ নিজ ঘরে নামায আদায় করা। কেননা কোন ব্যক্তি তার নিজ ঘরে যে নামায আদায় করে তাই সর্বোত্তম; তবে ফরজ নামায ছাড়া।” কোন কোন হাদীসে ২৩,২৫, ২৭ তারিখে নামায পড়ার কারন হিসেবে নবীজীর শবেক্বদর তালাশ করার কথা বলা হয়েছে। তবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) রমজান শরীফে শেষ রাতে যে নামায আদায় করতেন তা সালাতুল তাহাজ্জুদ বা কিয়ামো রমজান ছিল নাকি? বর্তমান পদ্ধতির তারাবী নামায ছিল তা নিয়ে বির্তক আছে। এই ছিল নবী করিম (সাঃ) জীবদ্দশায় তারাবী নামায আদায়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। তিনির ইন্তেকালের পর হযরত আবুবকর (রাঃ) এর খিলাফতকালে তারাবী নামায জামাতবন্দী হয়ে পড়া হয়নি এমন কী হযরত ওমর (রাঃ) শাসন কালের প্রথম দিকেও। আর আল্লাহর নবীত জীবনে একদিনও জামাতে তারাবী নামায আদায় করেন নি।
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) খিলাফতকালের শেষের দিকে রমজান মাসের কোন এক রাতে তিনি মসজিদে গিয়ে দেখলেন মুসল্লিরা একা একা যার যার মত নামায আদায় করছেন। এতে কেউ দাঁড়ানো, কেউ সিজদায়, কেউ রুকুতে, কেউ সামনে পিছনে যাচ্ছেন, মোট কথা হযবরল অবস্থা। এই বিশৃঙ্খলা দেখে তিনি নিজে নিজে মন্তব্য করেন, “একটা নিয়ম শৃঙ্খলা থাকা দরকার।’ উপস্থিত মুসল্লিরা এ মন্তব্য শুনে পরবর্তীতে কাতার ও জামাতবন্দী হয়ে তারাবী নামায পড়া শুরু করেন, যা বর্তমানেও অব্যাহত আছে। যেহেতু রমজান মাসে ক্বোরআন তেলাওয়াত করা এবং শোনায় সওয়াব অত্যন্ত বেশি, তাই হয়ত ঐ সময় ক্বোরআনে হাফেজরা তারাবী নামাযে ক্বোরআন খতম করতেন এবং মুসল্লিরা তা শুনে অশেষ সওয়াব হাসিল করতেন। কিন্তু এর বিনিময়ে হাফেজ সাহেবরা কোন আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিতেন না বা মুসল্লিরাও দিতেন না। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চলছে এর সম্পূর্ণ উল্টো। আমাদের দেশে রমজান শরীফ আসন্ন হলে খতম তারাবীর জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বা অন্য যে কোন মাধ্যমে সুকণ্ঠী কোরআনে হাফেজ খোঁজা হয়, সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, তারপর নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার হাফেজ সাহেবরাও বিভিন্ন মাধ্যমে বড় বা ধনী মহল্লার খোঁজ করে থাকেন। বড় বা ধনী মহল্লার মসজিদে নিয়োগ পেতে কখনো মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাবকে অনেক সময় কাজে লাগানো হয়। তারাবীর নামাযে তেলাওয়াতে ভূলভ্রান্তি ধরার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ২জন হাফেজ রাখা হয়। নামাযের মধ্যে তেলাওয়াতে প্রায়ই ভূলভ্রান্তি ধরা পড়লে হাফেজ সম্পর্কে মুসল্লিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বিধায় অনেক সময় ২জন হাফেজের মধ্যে ভূল না ধরার জন্য অলিখিত চুক্তিও হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২৭ রমজান কুরআনে খতম সমাপ্ত করা হয়। কুরআন খতমের ২/৪ দিন আগে মসজিদের মুতাওয়াল্লী বা গণ্যমান্য কেউ তারাবী নামায শেষে প্রকাশ্যে ঘোষনা করেন অমুক দিন খতম তারাবী শেষ হবে, দোয়া হবে। আপনারা যে যা পারেন তরাবীর হাদিয়া দিবেন, বা হাফেজ সাহেব আমাদেরকে কুরআন শুনিয়েছেন আল্লাহর ওয়াস্তে আমরাও তাঁকে আল্লারহ ওয়াস্তে দান করবো। এ ধরনের ঘোষনার পর শহরের মসজিদ, বড় বা ধনী মহল্লার মুসল্লিরা স্বইচ্ছায় যা দান করেন তাতে হাফেজ সাহেবদের সম্মানজনক সম্মানীর ব্যবস্থা হয়ে যায়। সমস্যা দেখা দেয় যেসব মহল্লা ছোট, তুলনামূলক দরিদ্র এলাকা বা সরকারী-বেসরকারী স্বায়ত্বশাসিত কোন প্রতিষ্ঠানের মসজিদ সেখানে। এসব মসজিদে মুসল্লিদের স্বেচ্ছায় দান সন্তোষজনক না হওয়ায় বাধ্যতামূলক চাঁদা আদায় করা হয়। দেখা গেছে মহল্লার যে পরিবারে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ার মত পুরুষ মানুষ নেই সেই পরিবারকে মহল্লার চাপে বা প্রতিষ্ঠানের মসজিদের ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে অধস্থন কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হচ্ছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে মনকষাকষি, ঝগড়া, ফ্যাসাদও হয়। তাছাড়া হাফেজ সাহেবদের বাড়ি মসজিদ এলাকা থেকে অনেক ক্ষেত্রে দূরে থাকায় হাফেজ সাহেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে একই রকম সমস্যা হয়। এই গেল একটি দিক। অন্য দিক হলো ১২মাস ইমাম হিসেবে যিনি ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামায পড়ালেন, মসজিদের খেদমত করলেন তাঁকেও এই সময় হাফেজ সাহেবদের সাথে কিছু দান করা হয়ে থাকে। তবে এই দান হাফেজ সাহেবদের চেয়ে শত সহস্রগুনকম। এতে আপনা আপনি প্রমাণ হয়ে যায় ফরজের চাইতে সুন্নতকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যদিও কোটি কোটি সুন্নত একটি ফরজের সমান নয়। তাছাড়া তারাবীর জামাতকে সুন্নত ধরা হলে সেটা রাসুল (সাঃ) সুন্নত নয়। এটা বড়জোর হযরত ওমর (রাঃ) সুন্নত। বাস্তবে দেখা যায় অনেক মুসল্লি এশার জামাতে যোগ না দিয়ে তারাবীর জামাতে যোগ দিচ্ছেন। এর কারণ মুসল্লিদের এশার জামাতের চাইতে তারাবীর জামাতকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া।
অনেক মহল্লায় খতম তারাবী পড়া হবে না সূরা তারাবী পড়া হবে, এই নিয়ে মতানৈক্য হয়। আবার একাধিক হাফেজ সাহেবের মধ্য থেকে কোন হাফেজ সাহেবকে নিয়োগ দেওয়া হবে তানিয়ে ও মতানৈক্য হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী বা অধিকাংশের মতামত প্রাধান্য পায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মহল্লার দুর্বল বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠি মনক্ষুন্ন হন। অনেকে রাগ করে আর নিজ মহল্লায় নামাজে না গিয়ে অন্য মহল্লায় গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এতে মহল্লাবাসীর মধ্যে ফিতনা-ফ্যাসাদের সৃষ্টি হয়। বলা হয়ে থাকে হাফেজ সাহেব আল্লাহর ওয়াস্তে— ক্বোরআন পড়ে শুনিয়েছেন, আর মুসল্লিরা আল্লাহর ওয়াস্তে— হাদিয়া দিচ্ছেন। এর মধ্যে পার্থিব কোন উদ্দেশ্য নেই। এই ধারনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঠিক নয়। অভিজ্ঞতায় দেখাগেছে কোন হাফেজ সাহেবকে হাদিয়া কম দেয়া হলে রাগ করেছেন, মনক্ষুন্ন হয়েছেন, বিরূপ মন্তব্য করেছেন বা পরের বৎসর চাইলে ও পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ আবার রমজানের আগেই হিসেব করে ফেলেন খতম তারাবী পড়াইয়া যে হাদিয়া পাব তা দিয়ে এই সেই করব ইত্যাদি। তারাবীর হাদিয়া প্রদানের ক্ষেত্রে কোন কোন মুসল্লীর ধারনা, আমি যদি হাদিয়া না দেই তাহলে আমার নামাযই হবেনা বা সওয়াব কম পাব। এটা বুঝা যায় তখনই, যখন কোন মহল্লার এক বা একাধিক ব্যক্তি বলেন যে, এবারের খতম তারাবীর সমস্ত হাদিয়া আমি বা আমরা দিয়ে দেব। তখন মহল্লার অন্যান্যরা তাতে জোর আপত্তি জানান। আবার হাদিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে পাশের মহল্লার সাথে অনেক ক্ষেত্রে কম্পিটিশন করে বেশি দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অনেক জায়গায় তারাবীর হাফেজ সাহেবকে ইমাম হিসেবে দেখানোর জন্য ওয়াক্তিয়া নামাযের ২/৪ জামাতে ইমামতি করতে দেয়া হয়। এটা এক ধরনের হিল্লা, যা না বুঝার কথা নয়।
অতএব পাঠক গভীর মনোযোগের সহিত ভেবে দেখুন, অনেক ক্ষেত্রে জোর-জবরদস্তি মূলকভাবে আমরা যে খতম তারাবীর আয়োজন করছি, হাদিয়া দিচ্ছি, তা কী সঠিক হচ্ছে ? ইবাদতের ক্ষেত্রে জোর-জবরদস্তি কী চলে ? নামায এবং তেলাওয়াতের বিনিময়ে দেওয়া নেওয়া যায় কী না ? দেওয়া গেলে ফরজের হাদিয়া বেশি হবে না সুন্নতের হাদিয়া বেশি হবে ? যেখানে কোরআন শরীফে হাদিয়া নেওয়ার কথা নিষেধ করা আছে। দারুল ইফতাহ ও দাওরুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার ফতোয়া হচ্ছে ‘যে হাফিজ সাহেব টাকার লোভে কোরআন মজিদ শোনায় তাহা শোনার চাইতে যে সুরা তারাবী আদায় করে তাহার মুক্তাদি হওয়া ভাল। যদি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোরআন শরীফ শোনানো হয় তাহলে ইমামের সওয়াব হইবে না মুক্তাদিরও সওয়াব হইবে না। পাঠক ভেবে দেখুন আমরা আল্লার হুকুম এবং নবীর তরিকায় তারাবি আদায় করছি, না আমাদের মনগড়া করছি?
পক্ষান্তরে পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ পাক সূরা বণি ইসরাইলের ৭৯নং আয়াতে এরশাদ করেছেন, ‘হে মুহাম্মদ (সাঃ) রাত্রির একাংশে কোরআন তেওলায়াত সহ তাহাজ্জুদ নামায আদায় করুন। ইহা আপনার জন্য অতিরিক্ত নামায। শীঘ্রই আপনার প্রতিপালক আপনাকে মাকামে মাহমুদ (প্রশংসিত স্থান) দান করিবেন।’ হযরত মুগিরাহ (রাঃ) হইতে বর্ণিত, ‘রাত্রিকালে হযরত (সাঃ) অতি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দাঁড়াইয়া তাহাজ্জুদের নামায আদায় করিতেন। ফলে তাঁহার পা মোবারক রসাক্রান্ত্র হইয়া পড়িত। তিনি জিজ্ঞাসিত হইতেন, হে আল্লাহর রাসুল আপনি এরূপ কষ্ট করেন কেন ? অথচ আপনার পূর্বের ও পরের সকল গুনাহ মাফ করা হয়েছে। উত্তরে হযরত (সাঃ) বলিতেন, আমি কী আল্লাহর শুকুর আদায়কারী বান্দা হইব না ? (বোখারী মুসলিম)।- রাসুলে পাক (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘অর্ধরাত্রির পর তাহাজ্জুদের দুই রাকাত নফল নামায দুনিয়া ও উহার মধ্যে যত সম্পদ আছে, উহার চেয়ে বেশি মূল্যবান। যদি ইহা আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর মনে না করিতাম তাহলে এই নফল নামায আমি ফরজ করে দিতাম।’ রাসুল (সাঃ) সারা বছর ব্যাপী রাতের শেষাংশে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন এর পর তিনি বিতরের নামায আদায় করতেন। এ তাহাজ্জুদের নামাযকে কিয়ামুল লাইলের নামাযও বলা হয়। আর রমজানে এ নামাযকে বলা হয় কিয়ামু রামাদ্বান। অনেক সহী হাদিসে এ রকম বর্ণনা পাওয়া যায় বিধায় পবিত্র রমজান শরীফের রাতে বাদ এশা নবীজির মাত্র তিন দিনের আমল বর্তমান পদ্ধতির ৮/১২/২০ রাকাত তারাবি না শেষ রাতে তাঁর সারা জীবনের আমল ১২ রাকাত তাহাজ্জুদের নামায পড়া বেহেতর। নবীজী রমজান মাসের রাতে কোন নামাজ পড়েছিলেন? তা তালাশ করে দেখুন। এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদীস বিশারদদের আরো গবেষণার অবকাশ রয়েছে। (সুরমা টাইমস)