ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন

 ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন0%

 ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 44 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14685 / ডাউনলোড: 4973
সাইজ সাইজ সাইজ
 ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন

ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন

লেখক:
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বাংলা

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কবর জিয়ারতের ফজিলত

আহলে বাইতের ইমামগণের হাদীসসমূহে ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারতের বিষয়ে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। যেমন :

১। ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : আমাদের অনুসারীদের অবশ্যই ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারত করতে বল। কারণ ইমাম হুসাইনের ইমামতে বিশ্বাসী যে কোন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাঁর কবর জিয়ারত ওয়াজিব করেছেন। ১৭০

২। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : আমাদের অনুসারীদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারত করবে ফিরে আসার পূর্বেই তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। ১৭১

৩। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর পিতা মূসা কাজিমের সূত্রে ইমাম সাদিক (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন : ইমাম হুসাইনের জিয়ারতকারীর জিয়ারতের সময় তার জীবনকাল হিসেবে পরিগণিত হবে না। ১৭২

৪। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : যে ব্যক্তি মহানবী (সা.),হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা জাহরার (আ.) প্রতিবেশী হিসেবে বেহেশতে থাকতে চায়,সে ইমাম হুসাইনের জিয়ারত ত্যাগ করতে পারে না। ১৭৩

৫। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : যে কেউ ইমাম হুসাইনের জিয়ারতে যাবে এমতাবস্থায় সে ইমাম হুসাইনের সত্যিকার অবস্থান ও মর্যাদাকে অনুধাবন করেছে তবে তার সকল গুনাহ (পূর্বের ও পরের) ক্ষমা করে দেয়া হবে। ১৭৪

৬। আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি নাসর বলেছেন : আমাদের কিছু নির্ভরযোগ্য রাবী ইমাম রেজাকে (আ.) ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারতের সওয়াব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি জবাবে বলেন, এর সওয়াব এক উমরাহর সমান।১৭৫

৭। মুহাম্মদ ইবনে সিনান বলেছেন : আমি ইমাম রেজাকে বলতে শুনেছি যে,তিনি বলেছেন, যে কেউ ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারত করবে আল্লাহ তার আমলনামায় মকবুল হজ্জ্বের সওয়াব লিখে দিবেন। ১৭৬

৮। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারতের সওয়াব বিশটি হজ্জ্বের সমান অথবা তার হতেও উত্তম। ১৭৭

কেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কবর জিয়ারত কাবা ঘরের জিয়ারত হতে উত্তম?

কোন কোন ওয়াহাবী আলেম উপরিউক্ত হাদীসসমূহ দেখে ইমামীয়া শীয়াদের উপর ক্রোধান্বিত হয়েছে এবং তাদের উপর প্রচণ্ড হামলা করেছে। তারা দাবী করেছেন যে,এ ধরনের হাদীসসমূহ মুসলমানদের হজ্জ্ব করা হতে বিরত রাখে এবং হজ্জ্বের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে দুর্বল করে। শুধু তাই নয় (নাউজুবিল্লাহ্) ইমাম হুসাইনকে আল্লাহর উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাই এরূপ চিন্তা বিশ্বাসের প্রচারকে প্রতিহত করতে হবে। কারণ তা একরূপ অতিরঞ্জন। এই আপত্তির জবাবে আমরা কয়েকটি বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে করছি :

১। সম্ভাবনা রয়েছে এই হাদীসসমূহ বিশেষ দৃষ্টিকোণ হতে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ যখনই ইসলাম হুমকির সম্মুখীন এবং মুসলমানরা নামায,রোজা,হজ্জ্ব প্রভৃতির মত ইবাদতগুলোর বাহ্যিকতার প্রতিই কেবল লক্ষ্য করবে কিন্তু ইবাদত তার প্রকৃত মর্ম ও অর্থ হারিয়ে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়বে তখন অবশ্যই শাহাদাতের রক্তিম পথে অগ্রসর হতে হবে। কারণ প্রথমে ইসলামী সমাজ ও শরীয়তের দেহে প্রকৃত প্রাণের সঞ্চার করতে হবে তারপর শরীয়তের বাহ্যিকতার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। (৬০ হিজরীর জিলহজ্জ্ব মাসের ৮ তারিখে ইমাম হুসাইন (আ.) হজ্জ্বের জন্য আরাফার দিকে যাত্রা না করে কুফার দিকে যাত্রা করেন। তাঁর এ কর্মের উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে বলা যে,ইসলামের প্রাণের অস্তিত্ব না থাকলে,তা শুধুই সামাজিক আচারে পরিণত হলে ও সমাজে তার শিরক,কুফর,ও বিদআত প্রতিরোধকারী ভূমিকা না থাকলে জিহাদ ও শাহাদাতের পথ বেছে নিতে হবে-সেক্ষেত্রে নিছক আচারভিত্তিক ইবাদত মূল্যহীন। যদি কোন মুসলিম দেশে ইসলামের শুধু নাম থাকে,কিন্তু তার শরীয়তের কোন প্রাণ না থাকে তখন উচিত হবে ইমাম হুসাইনের পথ অবলম্বন করে জাতিকে প্রকৃত ইসলামের সাথে পরিচিত করানো। অতঃপর শরীয়তের বাহ্যিকতার প্রতি দৃষ্টি দেয়া,যেমনটি ইমাম হুসাইন করেছেন। যখন সবাই হজ্জ্ব করার জন্য মক্কায় আসছিল তখন তিনি হজ্জ্বের অনুষ্ঠান অসমাপ্ত রেখে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে রত হন। মুসলিম উম্মতকে জাগরিত করতে ও শরীয়তকে পুনর্জীবন দানের লক্ষ্যে স্বীয় জীবন বিলিয়ে দেন।

২। কাবার সম্মান এ কারণেই যে,তা আল্লাহর নির্দেশে তাঁর প্রেরিত এক রাসূলের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে। কোন কোন হাদীসের বর্ণনামতে কাবা আল্লাহর প্রতিপালক ও মাবুদ হওয়ার বৈশিষ্ট্যের প্রতিপালক,কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ আল্লাহর সকল গুণের প্রতিচ্ছায়া ও প্রকাশ। এ কারণেই আমরা জিয়ারতে জামেয়ে কাবিরাতে পড়ে থাকি

من أراد الله بدأ بکم و من وحّدهُ قبل عنکم و من قصده توجَّهُ

অর্থাৎ যারা আল্লাহকে চায়,তারা আপনাদের থেকে শুরু করে,যে কেউ আল্লাহকে এক জানে,সে আপনাদের থেকে গ্রহণ করে,যে কেউ আল্লাহর প্রতি যাত্রা করে,আপনাদের প্রতি দৃষ্টি দেয়। দোয়া নুদবাতেও আমরা পড়ি

أین وجهُ الله الّذی إلیه یتوجَّهُ الاولیاء

কোথায় আল্লাহ বিরাজমান যার প্রতি তাঁর ওলীরা মুখ ফেরায়।

৩। প্রতি মুসলমানের জন্য ওয়াজিব হলো শরীয়তের বিধি-বিধান শিক্ষা করা,তারপর তা পালন করা,যেমন হজ্জ্ব ও হজ্জ্ব সম্পর্কিত মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা করা অপরিহার্য। অতঃপর হজ্জ্বে গমনের পর তা আদায় করতে হবে। যেহেতু ইমামগণ মহানবী (সা.)-এর শরীয়তের ব্যাখ্যা দানকারী সেহেতু প্রথমে তাঁদের শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের ঐশী ও শরীয়তগত বেলায়েতকে (অভিভাবকত্ব) মেনে নিয়ে তাঁদের নির্দেশানুযায়ী হজ্জ্ব পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে ইমামদের বেলায়েত শরীয়তের বিধান,যেমন হজ্জ্বের উপর প্রাধান্য রাখে।

৪। সম্ভবত ইমামের মর্যাদা ও সঠিক পরিচয়সহ জিয়ারত করলে তবেই তা মুস্তাহাব হজ্জ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখবে এবং এ হাদীসের উদ্দেশ্য ওয়াজিব হজ্জ্ব নয়। কারণ জিয়ারতের মতো মুস্তাহাব কর্ম কখনোই হজ্জ্বের মতো ওয়াজিব কর্মের উপর প্রাধান্য রাখতে পারে না। কিন্তু মুস্তাহাব জিয়ারত ও মুস্তাহাব হজ্জ্বের মধ্যে মুস্তাহাব জিয়ারতের প্রাধান্য রয়েছে।

কবরের উপর সৌধ নির্মাণ

মুসলমানদের সাথে ওয়াহাবীদের বিরোধের অন্যতম  বিষয় হলো কবরের উপর গম্বুজ ও সৌধ নির্মাণ সম্পর্কিত। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মুসলমানগণ এই রীতিটি অনুসরণ করে এসেছে এবং এ বিষয়টি জায়েয ও মুস্তাহাব হওয়ার সপক্ষে কোরআন ও হাদীস হতে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। উপরন্তু এ কর্মটি যৌক্তিক এবং তা বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসৃত রীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল। কিন্তু ইবনে তাইমিয়ার সময় হতে এই রীতির বিরোধিতা শুরু হয়। তিনি কবরের উপর সৌধ ও গম্বুজ তৈরিকে শিরক বলে ঘোষণা করেন। হিজাযে আলে সউদের আধিপত্যের সময় এই বিশ্বাস তুঙ্গে পৌঁছায় ও সউদী শাসকগণ এই ফতোয়ার ব্যবহারিক বাস্তবায়নে রত হয়। ওয়াহাবী আলেমদের ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সকল মাজার,কবরের উপরে নির্মিত সৌধ ও গম্বুজ ধ্বংসকার্যে রত হয়। মহানবীর কবর ব্যতীত সকল সৌধ তারা ধ্বংস করে। তাঁর পবিত্র রওজা ধ্বংসের ইচ্ছা থাকলেও মুসলমানদের প্রতিরোধের ভয়ে তারা তা করতে পারে নি। তারা তাদের এ ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে এ প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করব।

ওয়াহাবীদের  ফতোয়া

১। ইবনে তাইমিয়া বলেছেন : আল্লাহর নবিগণ তাঁদের আহলে বাইতের সদস্য ও অন্যান্য সৎকর্মশীল বান্দাদের কবরের উপর যে সকল সৌধ নির্মিত হয়েছে তা হারাম ও বিদআত। যা অন্য স্থান হতে ইসলামে প্রবেশ করেছে।১৭৮

২। তিনি অন্যত্র বলেছেন : শিয়ারা কবরসমূহের উপর যে সৌধ নির্মাণ করে তার সামনে সম্মান প্রদর্শনের জন্য নত হয়ে থাকে তা মুশরিকদের মূর্তিপূজার ন্যায়। তারা কাবা ঘরের হজ্জ্বের ন্যায় ঐ সকল কবর ও সৌধের উদ্দেশ্যে হজ্জ্ব করে থাকে।১৭৯

৩। সেনআনী বলেছেন : ওলীদের কবরের উপর নির্মিত সৌধ মূর্তির ন্যায় এবং তারা জাহেলী যুগের মুশরিকদের ন্যায় ওলীদের কবরের সামনে বিভিন্ন আচার পালন করে। ১৮০

৪। ওয়াহাবীদের ফতোয়া প্রদানের স্থায়ী পরিষদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেছে, কবরের উপর সৌধ নির্মাণ নিষিদ্ধ বিদআত যা কবরবাসীর প্রতি অতিমানবীয় বিশ্বাস ও তার প্রতি অতিরঞ্জিত সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে হয়ে থাকে এবং তা মানুষকে শিরকের দিকে পরিচালিত করে। তাই মুসলমানদের (দায়িত্বশীল) নেতা অথবা তার প্রতিনিধির কবরের উপর নির্মিত এরূপ সৌধসমূহ ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার নির্দেশ দান করা উচিত। এর মাধ্যমে কর্মগত বিদআতের মূলোৎপাটন করে শিরকের পথ চিরতরে রুদ্ধ করতে হবে। ১৮১

৫। নাসিরুদ্দীন আলবানী সউদ বংশের শাসকদের প্রস্তাব করেছে মহানবীর পবিত্র রওজার সবুজ গম্বুজটি ভেঙ্গে ফেলার। সে বলেছে, এটি আফসোসের বিষয় যে,দীর্ঘদিন হল রাসূলের কবরের উপর একটি গম্বুজ প্রস্তুত হয়েছে আমার বিশ্বাস সউদী সরকারের একত্ববাদের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে তবে তাদের উচিত তা চূর্ণ করে মসজিদে নববীকে তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা। ১৮২

কবরের উপর সৌধ নির্মাণ ও পবিত্র কোরআন

পবিত্র কোরআন কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু না বললেও কোরআনের আয়াত হতে এ সম্পর্কিত বিধান পাওয়া যায়। এ যুক্তিতে যে-

১। কবরের উপর সৌধ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শামিল। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন,কারণ তা অন্তরের পরহেজগারীর (আত্মসংযম) প্রমাণ। যেমন বলা হয়েছে,

( وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ)

যারা আল্লাহর ( দ্বীনের) নিদর্শনসমূহের সম্মান করে তা অন্তরের পরহেজগারীর প্রমাণস্বরূপ ১৮৩

شعائر শব্দটি شعیره শব্দের বহুবচন যার অর্থ নিদর্শন ও প্রমাণ। আল্লাহর নিদর্শন (شعائر الله )হলো এমন কোন প্রতীক যা আল্লাহর দিক নির্দেশক। যদি কেউ আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে চায় (নৈকট্য পেতে চায়) তবে ঐ প্রতীকের মাধ্যমে তাতে পৌঁছাতে পারে। অবশ্য আল্লাহর নিদর্শন অর্থ যদি তাঁর দ্বীনের নিদর্শন বুঝায় তবে আয়াতটির অর্থ হবে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় তবে তাঁর দ্বীনের নিদর্শনসমূহের স্থান প্রদর্শনের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে।

পবিত্র কোরআনে সাফা ও মারওয়াকে আল্লাহর নিদর্শন ও চিহ্ন বলা হয়েছে:

( إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ)

নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া (পর্বত দু টি) আল্লাহর (দ্বীনের) নির্দশন। ১৮৪

কোরবানীর উদ্দেশ্যে যে উটকে মিনায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকেও আল্লাহর নিদর্শন বলা হয়েছে,

( وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ)

আমরা কোরবানীর হৃষ্টপুষ্ট উষ্ট্রকে তোমাদের জন্য আল্লাহর ( দ্বীনের) নিদর্শন বানিয়েছি। ১৮৫

এ বিষয়গুলো ইবরাহীমের ধর্মের (দ্বীনে হানিফের) নিদর্শনসমূহরে অন্তুর্ভুক্ত। মুজদালিফাকেمَشعَر বলা হয়,কারণ তা আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন ও প্রতীক স্বরূপ। হজ্জ্বের সকল আচারই আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন কারণ তা একত্ববাদী ও অবিকৃত ধর্মের প্রতীকস্বরূপ।

যেহেতু এই আচারসমূহ আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শনস্বরূপ এবং মানবজাতিকে একত্ববাদী ও অবিকৃত ঐশী দ্বীনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়,সেহেতু নিঃসন্দেহে বলা যায়,আল্লাহর নবী ও ওলিগণ তাঁর দ্বীনের সর্বোচ্চ নিদর্শন। কারণ তারা হলেন নিষ্পাপ,কখনোই অন্যায়কর্ম করেন না এবং তাদের বাণী ও কর্ম সত্যের অনুরণন। তাঁরা এমন এক আদর্শ যাদের অনুসরণে একত্ববাদ ও মহাসত্যের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।

যখন মহানবী (সা.),তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি (পবিত্র ইমামগণ) ও আল্লাহর অন্যান্য ওলিগণ এরূপ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তখন তাদের সকল স্মৃতি সংরক্ষন যেমন তাঁদের কবর,তা সংরক্ষনের নিমিত্তে তার উপর সৌধ ও গুম্বুজ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মানেরই নমুনা স্বরূপ। কারণ এরূপ কর্ম সেই ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করা হয়,যাদের কর্ম,বাণী ও নির্দেশনা মানুষকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে।

কুরতুবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর নিদর্শন হলো এমন কিছু যা তাঁর দ্বীনের চিহ্ন ও স্মৃতি বহন করে বিশেষত যে সকল বিষয় দ্বীনের আচারের পথে সংশ্লিষ্ট।১৮৬

মিশরীয় লেখক প্রফেসর আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ কারবালা ও ইমাম হুসাইনের মাজার সম্পর্কে বলেছেন : কারাবালা এমন একস্থান যেখানে মুসলমানরা শিক্ষাগ্রহণ ও ইমাম হুসাইনের স্মরণের জন্য যায়। অমুসলমানরাও সেখানে দর্শনের জন্য যায়। কিন্তু যদি ঐ ভূমির প্রকৃত মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তবে অবশ্যই তা সেই সব ব্যক্তিদের জিয়ারতের স্থান হওয়া উচিত যারা স্বজাতির জন্য বিশেষ পবিত্রতা ও মর্যাদায় বিশ্বাসী। কারণ জিয়ারতের স্থানগুলোর মধ্যে ইমাম হুসাইনের মাজার হতে উত্তম কোন স্থানের কথা আমার জানা নেই।

২। মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদের কবরসমূহের উপর সৌধ নির্মাণ মহানবীর নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ।

পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টরূপে আল্লাহর নবীর রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা পোষণের নির্দেশ দিয়েছে-

( قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّة)

  তোমাদের হতে আমি আমার ( রিসালাতের দায়িত্বের) কোন বিনিময় চাই না কেবল আমার অতিনিকটাত্মীয়দের প্র তি ভালোবাসা ছাড়া১৮৭

নিঃসন্দেহে মহানবীর অতিনিকটাত্মীয়দের কবর সংরক্ষণের নিমিত্তে তার উপর সৌধ নির্মাণ করে জিয়ারতকারীদের জন্য তা চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন তাঁদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ। কারণ প্রতিটি ভালোবাসারই প্রকাশ আছে এবং শুধু তাঁদের আনুগত্য করা ও তাঁদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা পোষণ করাই ভালোবাসার নিদর্শন নয়,বরং সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে তাঁদের কবর সংরক্ষণও তাঁদের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন,যেহেতু এরূপ কর্ম কোন সূত্রেই নিষিদ্ধ করা হয় নি। (আবুশ শুহাদা,পৃ. ৫৬)

৩। আল্লাহর ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণ পবিত্র গৃহসমূহকে সমুন্নত রাখার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত,মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে অনুমতি দিয়েছেন যেসকল গৃহে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় তা সমুন্নত করার।

( فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ) ( رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ)

  আল্লাহ যেসব গৃহকে (যাতে তাঁর নূর রয়েছে) মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এমন লোকেরা যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। (সূরা নূর : ৩৬-৩৭)

উপরিউক্ত আয়াত হতে আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে দু টি প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়।

প্রথমত উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে শুধু মসজিদ বুঝানো হয়নি,বরং আয়াতের উদ্দেশ্য মসজিদসহ যে কোন স্থান যেখানে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়,যেমন নবিগণ ও তাঁদের স্থলাভিষিক্ত পবিত্র প্রতিনিধিদের গৃহ। এমনকি এ দাবীও সত্য যে,উপরিউক্ত আয়াতটিতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের বা গৃহসমূহের কথা বলা হয়েছে। কারণ গৃহ বলতে যে কোন চার দেয়াল ও ছাদ বিশিষ্ট স্থানকে বুঝানো হয়। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

( وَلَوْلَا أَنْ يَكُونَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ يَكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ سُقُفًا مِنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيْهَا يَظْهَرُونَ)

যদি সব মানুষের এক মতাবলম্বী (কাফের) হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকত তবে যারা দয়াময়কে (আল্লাহকে) অস্বীকার করে তাদের গৃহসমূহের ছাদ ও সিঁড়িকে যা দ্বারা তারা উপরে যেত আমি রৌপ্য নির্মিত করে দিতাম। ১৮৮

উপরিউক্ত আয়াত হতে বোঝা যায় আরবী ভাষায় যে,কোন ছাদ বিশিষ্ট কক্ষকেই গৃহ((بیت)) বলা হয়। তদুপরি হাদীসসমূহে বলা হয়েছে মসজিদ ছাদবিহীন হওয়া মুস্তাহাব। তাই উল্লিখিত আয়াতে গৃহ বলতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু রাসূলের আহলে বাইতের সূত্রে ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে,উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে নবিগণ ও হযরত আলীর গৃহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।১৮৯

পবিত্র কাবাগৃহকে বাইতুল্লাহ্ বলা হয়,কারণ তার ছাদ রয়েছে।

দ্বিতীয়ত আয়াতে যে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে তার দু রকম অর্থ হতে পারে :

ক) গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা দান যেমনটি আমরা এ আয়াতটিতে পড়ি

( وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا عَلِيًّا)

আমরা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছি। ১৯০

খ) আয়াতের লক্ষ্য বাহ্যিক ও বস্তুগত উন্নয়ন অর্থাৎ ঐরূপ গৃহ বা স্থানের যেমন ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে গৃহ বা কবরকে উন্নীত করা।

জামাখশারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেছেন : গৃহকে উন্নীত করার অর্থ গৃহের কাঠামোকে উচ্চ করা যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে-

( وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ)

( স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের ভিত্তিকে উন্নীত করেছিল। অথবা কাবাগৃহের প্রতি মর্যাদা দেখানোও সম্মান প্রদর্শন।"১৯১

তাফসীরে রুহুল বায়ানে বলা হয়েছে(أن ترفع) উন্নীত করার অর্থ উচ্চ করা অথবা সেগুলোর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করা।১৯২

যদি আয়াতটিতে উন্নীত করার অর্থ বাহ্যিক ও কাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়ে থাকে তবে তা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর নবী ও ওলীদের কবরকে উন্নীত করণের দলিল হবে। বিশেষত যখন মহানবী (সা.) সহ তাঁর আহলে বাইতের কয়েকজন ইমাম তাঁদের গৃহেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন। আর যদি উন্নীত করণের অর্থ মর্যাদা দান ও অবস্তুগত উন্নয়ন হয়ে থাকে তবে তার অর্থ হবে নবী ও আল্লাহর ওলীদের গৃহ ও কবরসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে তা সংরক্ষন করা,সৌধ নির্মাণ ও তার মেরামত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আল্লামা সুয়ূতী আনাস ইবনে মালিক ও কুরাইদা হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.)فی بیوت اذن أن ترفع আয়াতটি পাঠ করলে একব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল : এখানে কোন গৃহসমূহের কথা বলা হয়েছে?

রাসূল (সা.) বললেন : নবিগণের গৃহসমূহ । হযরত আবু বকর রাসূলকে তখন হযরত আলী ও ফাতিমার গৃহের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন : হে আল্লাহর রাসূল! এই গৃহটিও কি ঐসব গৃহের অন্তর্ভুক্ত,আল্লাহ ও আপনার দৃষ্টিতে যার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা উচিত। তিনি বললেন : এই গৃহটি ঐ গৃহসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। ১৯৩