আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত0%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত

লেখক: আল্লামাহ্ সাইয়্যেদ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন আল মুসাভী
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ:

ভিজিট: 62096
ডাউনলোড: 8040

পাঠকের মতামত:

আল মুরাজায়াত
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 62096 / ডাউনলোড: 8040
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

ছিয়াশিতম পত্র

৮ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

১।   বৃহস্পতিবারের কষ্টদায়ক ঘটনা।

২।   নবী কেন নির্দেশ দানের পর তা হতে বিরত হলেন?

১। নবী (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী আমল (কর্ম সম্পাদন) না করার ঘটনা অসংখ্য। এগুলোর মধ্যে সরচেয়ে প্রসিদ্ধ ও কষ্টদায়ক ঘটনা হলো বৃহস্পতিবারের বেদনাদায়ক ঘটনা।

সহীহ হাদীসগ্রন্থসমূহ ছাড়া অন্যান্য সুনান লেখকগণও এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইতিহাস ও হাদীস বর্ণনাকারীদের সকলেই তা উল্লেখ করেছেন। যেমন বুখারী৪৭৯ উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ সূত্রে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন,নবী (সা.)-এর ওফাতের পূর্বে একদল লোক রাসূলের ঘরে সমবেত হয়েছিলেন যাঁদের মধ্যে উমর ইবনুল খাত্তাবও ছিলেন। রাসূল (সা.) বললেন,هلمّ أكتُبْ لكم كتاباً لا تضلّوا بعده আন,তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দিয়ে যাব যাতে তারপর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। ৪৮০ উমর বললেন, তাঁর ব্যথা তীব্র হয়েছে। তোমাদের নিকট কোরআন রয়েছে। আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তখন উপস্থিত জনতার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলো ও পরস্পর বিতর্ক শুরু করল। কেউ কেউ বলল, কাগজ নিয়ে এসো। নবী (সা.) এমন কিছু লিখে দিয়ে যাবেন যাতে আমরা বিচ্যুত না হই। কেউ কেউ উমরের কথা পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। যখন বিতর্ক তীব্র হলো তখন রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা এখান থেকে চলে যাও।

ইবনে আব্বাস প্রায়ই বলতেন, বিপদ তখন থেকেই শুরু হয়েছে যখন বিতর্ক ও চিৎকারের মাধ্যমে রাসূল (সা.)-কে লিখা হতে বিরত রাখা হলো।

এ হাদীসটি সহীহ হাদীসসমূহের অন্তর্ভুক্ত ও এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বুখারী৪৮১ তাঁর সহীহ -এর কয়েক স্থানে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং মুসলিম তাঁর সহীহ তে৪৮২ ওয়াসাইয়া অধ্যায়ের শেষে এটি এনেছেন।

আহমাদ তাঁর মুসনাদে৪৮৩ ও অন্যান্য সুনান লেখকগণ তাঁদের গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁরা হুবহু শাব্দিক বর্ণনা না করে ভাবগত বর্ণনা করেছেন। কারণ হযরত উমর যে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তা হলোإِنّ النّبِيّ يَهجر  নবী প্রলাপ বকছেন কিন্তু তাঁরা বলেছেনاِنَّ النّبيّ قَدْ غَلَبَ عَليهِ الوجع নবীর ব্যথা তীব্র হয়েছে । এভাবে তাঁরা চেয়েছেন কথাটির কর্কশতাকে কমিয়ে সাধারণ পর্যায়ে আনতে। আমাদের দাবীর পক্ষে প্রমাণ হলো আবু বকর আহমাদ ইবনে আযীয জাওহারীর আসসাকিফা গ্রন্থ৪৮৪ যেখানে তিনি ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন, নবীর ওফাতের পূর্বে ঘরে বেশ কিছু লোক সমবেত হয়েছিলেন এবং উমর ইবনে খাত্তাব তাঁদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.) বললেন : কাগজ ও কলম নিয়ে আস। আমি তোমাদের জন্য এক পত্র লিখে দিয়ে যাব যাতে তোমরা কখনো বিপথগামী না হও। উমর তখন এমন এক কথা বললেন যার ভাবার্থ নবীর ব্যথা প্রকট হয়েছে,আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব রয়েছে তাই যথেষ্ট(حسبنا كتابُ الله) । তখন নবীর গৃহে অবস্থানরতদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিল। কেউ বলতে লাগলেন কাগজ ও কালি আন,নবী কিছু লিখে দিয়ে যাবেন। কেউ কেউ উমরের কথার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন। বিতর্ক তীব্র হলে নবী (সা.) রাগান্বিত হয়ে বললেন : সকলেই উঠে পড়। সুতরাং স্পষ্ট বুঝতে পারছেন হযরত উমরের উচ্চারিত শব্দ নয়,বরং তাঁরা ভাবার্থ এনেছেন। যে সকল হাদীসবেত্তা রাসূল (সা.)-এর বক্তব্যের বিরোধিতাকারীর নাম উল্লেখ করেন নি তাঁরা মূল শব্দটি তাঁদের বর্ণনায় এনেছেন। যেমন বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থের কিতাবে জিহাদ ও সাইর -এর জাওয়াযুল ওফাদ অধ্যায়ে কাবিছা সূত্রে ইবনে উয়াইনা হতে,তিনি সালমান আহ্ওয়াল হতে,তিনি সাঈদ ইবনে যুবাইর হতে বর্ণনা করেছেন, ইবনে আব্বাস আফসোস করে বললেন :

  يوم الخميس و ما يوم الخميس ثمّ بكى حتّى خضب دمْعه الحصباء বৃহস্পতিবার! হায় কি বৃহস্পতিবারই! অতঃপর তিনি এত অধিক ক্রন্দন করলেন যে,তাঁর গণ্ডদেশ ভিজে গেল। কিছুক্ষণ পর বললেন : বৃহস্পতিবার নবীর ব্যথা তীব্র হলে তিনি বললেন : কাগজ নিয়ে আস,আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব যাতে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট না হও। তখন উপস্থিতরা বিতর্কে লিপ্ত হলে একজন বলল :هجر رسول الله নবীর বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পেয়েছে।  নবী (সা.) বললেন :

 دعوني فالذي أنا فيه خير مما تدعوني إليه আমাকে আমার অবস্থায় ত্যাগ কর। তোমরা আমাকে যার দিকে আহবান কর তা হতে আমি উত্তম অবস্থায় রয়েছি। ৪৮৫ মহানবী (সা.) ওফাতের সময় তিনটি বিষয়ে ওসিয়ত করে গিয়েছেন : মুশরিকদের আরব উপদ্বীপ হতে বহিষ্কার করা,মদীনায় আগত অতিথিদের উপঢৌকন দেয়া এবং তৃতীয় বিষয়টি ভুলে গিয়েছেন বলে রাবী উল্লেখ করেছেন।৪৮৬ মুসলিম এ হাদীসটি তাঁর সহীহ -এর কিতাবুল ওয়াসিয়াহ্ অধ্যায়ের শেষে ও আহমাদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ২২ পৃষ্ঠায় ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি নকল করেছেন।

মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থের কিতাবুল ওয়াসিয়াহ্ অধ্যায়ে সাঈদ ইবনে যুবাইর হতে অন্য একটি সূত্রে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার! কি বৃহস্পতিবারই! অতঃপর তিনি কাঁদতে লাগলেন। তাঁর চক্ষু হতে অশ্রু মুক্তদানার মত গলদেশ বেয়ে পড়তে লাগল এবং বললেন, নবী বলেছিলেন : ভেড়ার কাঁধের হাড় বা কাগজ ও কালি নিয়ে আস,আমি এমন কিছু লিখে দিয়ে যাব তার পর আর কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তখন কেউ কেউ বললেন :إنّ رسول الله يَهجر রাসূল প্রলাপ বকছেন। ৪৮৭ যদি বৃহস্পতিবারের এই বড় মুসিবতের ঘটনা কেউ পর্যালোচনা ও অধ্যয়ন করে তার নিকট সুস্পষ্ট হবে রাসূল প্রলাপ বকছেন কথাটি উমর ইবনে খাত্তাবই প্রথম বলেছেন। অন্যান্যরা তারপর এ কথার পুনরাবৃত্তি করেন। কারণ প্রথম হাদীসটিতে৪৮৮ লক্ষ্য করেছেন ইবনে আব্বাস বলেছেন, যাঁরা রাসূলের গৃহে ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো। কেউ কেউ বলছিলেন কাগজ আন নবী তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দিয়ে যাবেন যাতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও। কেউ কেউ উমরের কথার পুনরাবৃত্তি করছিলেন অর্থাৎ বলছিলেন নবীর বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পেয়েছে,তিনি প্রলাপ বকছেন । (নাউযুবিল্লাহ্)

তাবরানী তাঁর আওসাত গ্রন্থে উমর ইবনে খাত্তাব৪৮৯ হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। সেখানে উল্লিখিত হয়েছে- যখন নবী (সা.) অসুস্থ হলেন তখন বললেন : কালি ও কাগজ নিয়ে আস,আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দিয়ে যাব যাতে পরবর্তীতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও। পর্দার আড়াল হতে মহিলারা বললেন : তোমরা শুনতে পাচ্ছ না,নবী কি বলছেন? উমর বলেন, আমি বললাম,তোমরা নারীরা হযরত ইউসুফের নারীদের ন্যায়। যখনই নবী অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তোমরা চোখের ওপর চাপ দিয়ে কাঁদার চেষ্টা কর আর যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন তোমরা তাঁর ঘাড়ে চেপে বস। নবী (সা.) এ কথা শুনে বললেন, তারা তোমার থেকে উত্তম। তাদেরকে কিছু বল না(دعوهنّ فإنّهنّ خير منكم)

এখানে লক্ষ্য করুন তিনি সুন্নাহর অনুবর্তী না হয়ে বিরোধিতা করেছেন। যদি তিনি এক্ষেত্রে অনুবর্তী হতেন তাহলে পথভ্রষ্টতা হতে রক্ষা পেতেন। আফসোস যদি তিনি অনুসরণ হতে বিরত থেকেই স্তব্ধ হতেন! কিন্তু তিনি তা না করে বিরোধিতা করে বলেছেনحسبنا كتاب الله আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট । যেন নবী (সা.) তাঁদের মাঝে আল্লাহর কিতাবের অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন না এবং তাঁরা নবী অপেক্ষা কোরআনের বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞাত। এরপরও যদি ক্ষান্ত হতেন ও নবীকে চরম অসন্তুষ্ট না করে বলতেন তিনি প্রলাপ বকছেন । নবীর বিদায় মুহূর্তে ও জীবন সায়াহ্নে এমন শব্দ ব্যবহার করে তাঁর হৃদয়কে যদি ক্ষতবিক্ষত না করতেন!

তাঁদের এ কর্ম হতে মনে হয় যদিও তাঁরা বলেছেন আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট তদুপরি তাঁরা শুনেন নি আল্লাহর কিতাব সর্বক্ষণ আহবান করে বলছে,

( ما آتيكم الرَّسولُ فَخُذُوه و ما نَهاكُم عَنْه فانتهوا ) নবী তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যে বিষয় হতে তোমাদের নিষেধ করেন তা হতে বিরত হও। (সূরা হাশর : ৭)

নবী প্রলাপ বকছেন কথাটি বলার সময় তাঁরা বোধ হয় কোরআনের এ আয়াতটি ভুলে গিয়েছিলেন-

এ বাণী সম্মানিত রাসূলের যিনি শক্তিমান ও আরশের অধিপতির নিকট বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী। আসমানসমূহে তাঁর আনুগত্য করা হয় এবং তিনি বিশ্বস্ত। তোমাদের বন্ধু (মহানবী) উম্মাদ নন। (সূরা তাকভীর : ২২)

তাঁরা কোরআনের এ আয়াতটিও কি পড়েন নি যেখানে বলা হয়েছে-

নিশ্চয়ই এটি সম্মানিত রাসূলের বাণী এবং এটি কোন কবির কথা নয়। তারা কমই ঈমান আনে। এটি কোন গণকের কথাও নয়। কত কম তারা উপদেশ গ্রহণ করে! এটি মহান বিশ্ব প্রতিপালকের পক্ষ হতে অবতীর্ণ। (সূরা হাক্কাহ্ : ৪০-৪৩)

যেন তাঁরা কোরআনের এ আয়াতটিও অধ্যয়ন করেন নি যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

তোমাদের সাথী পথভ্রষ্ট নন ও তিনি বিচ্যুতও হন নি। তিনি প্রবৃত্তি হতেও কিছু বলেন না। তিনি যা বলেন তা তাঁর ওপর অবতীর্ণ ওহী বৈ কিছু নয় যা শক্তিশালী ফেরেশতা তাঁকে শিক্ষাদান করে। (সূরা নাজম : ২-৫)

যেন তাঁরা কোরআনের এরূপ অন্যান্য সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ শ্রবণ করেন নি যেখানে বলা হয়েছে- নবী নিষ্পাপ,তাঁর কথা প্রলাপ নয়,চিন্তা ও যুক্তি ব্যতীত তিনি কথা বলেন না। তদুপরি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিও এটি স্বীকার করে যে,নবী (সা.) মাসুম বিধায় বৃথা ও অযথা কথা বলেন না।

তাই সত্য এই যে,তাঁরা জানতেন নবী (সা.) খেলাফতের প্রতিশ্রুতিকে দৃঢ় ও আহলে বাইতের ইমামদের সর্বজনীন নেতৃত্বকে সুন্নাহর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিশেষত আলী (আ.)-এর অভিভাবকত্ব ও স্থলাভিষিক্ত হবার বিষয়টিকে তাগিদের জন্য তেমনটি করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁরা রাসূলকে এ কাজ হতে বিরত থাকতে বাধ্য করেন। দ্বিতীয় খলীফার সাথে ইবনে আব্বাসের কথোপকথন হতে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়।৪৯০

আপনি যদি নবীরايتوني أكتب لكم كتابا لن تضلّوا بعده আমার জন্য কালি ও কাগজ আন,আমি এমন কিছু লিখে দিয়ে যাব যার পর তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না এ হাদীসটির সাথে হাদীসে সাকালাইনকে অর্থাৎإنّي تارك فيكم ما إن تمسكتم به لنْ تضِلوا : كتاب الله و عترتي أهل بيتي আমি তোমাদের মাঝে যে বস্তু রেখে যাচ্ছি যদি তা তোমরা আঁকড়ে ধর কখনোও পথভ্রষ্ট হবে না : আল্লাহর কিতাব ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত মিলিয়ে দেখেন তাহলে লক্ষ্য করবেন এ দুই হাদীসের লক্ষ্য একই এবং নবী (সা.) তাঁর অসুস্থতার সময় হাদীসে সাকালাইনে যা উম্মতের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা প্রদান করতে চেয়েছিলেন।

২। কিন্তু কেন পরবর্তীতে তিনি লেখা হতে বিরত হলেন? এর জবাবে বলব ঐ সকল ব্যক্তির পক্ষ হতে তাঁর নামে যে কথাগুলো বলা হয়েছিল তাতে তিনি বাধ্য হন লেখা হতে বিরত থাকতে। কারণ এরূপ কথার পর তাঁর লেখা ফিতনা ও বিভেদ ছাড়া অন্য কোন ভূমিকা রাখতে পারত না এজন্য যে,তাঁর লেখা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠত রাসূল (সা.) নাউযুবিল্লাহ্ হয়তো ঘোরের মধ্যে প্রলাপ বকছিলেন যেহেতু তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি তখন লোপ পেয়েছিল। এটি অসম্ভব কোন কথা ছিল না,কারণ রাসূলের সামনে যখন এরূপ কথা বলা হয়েছে তখন রাসূলের ওফাতের পর তা বলা আরো স্বাভাবিক। তাই রাসূল (সা.)-এর জন্য তোমরা সকলেই উঠে পড় বলা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। যদি নবী লেখার বিষয়ে নাছোড়বান্দা হতেন তাহলে তারাও নবীকে প্রলাপ বকছেন বলে গোঁয়ারতুমি করত এবং তাঁদের পক্ষের লোকেরা শেষ জীবনে নবী পাগল হয়ে গিয়েছিলেন (নাউযুবিল্লাহ্) বলে প্রচারের জন্য উঠে পড়ে লাগত এবং নবীর কথাকে খণ্ডনের জন্য গ্রন্থসমূহ রচনা করত এবং যাঁরা সে হাদীসের ওপর নির্ভর করতেন তাঁদের যুক্তিকে এভাবে অগ্রাহ্য করত।

তাই মহানবী (সা.)-এর সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা তাঁকে লেখা হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয় যাতে তাঁর নবুওয়াতের ওপর কোন আঘাত না আসে। অন্যদিকে নবী (সা.) জানতেন আলী (আ.),তাঁর অনুসারী ও বন্ধুরা যাঁরা পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী,তাঁরা এ লেখার বিষয়বস্তুর প্রতি অনুগত যদিও অন্যরা তা গ্রহণযোগ্য মনে করে আমল করবে না। সুতরাং এরূপ পরিস্থিতিতে বুদ্ধিবৃত্তি (আকল) না লেখার পক্ষেই মত দেয় কারণ লেখা সে পরিস্থিতিতে বিভেদ ছাড়া অন্য কিছুর জন্ম দিত না এ সত্য সকলের নিকট স্পষ্ট।

ওয়াসসালাম

সাতাশিতম পত্র

৯ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

ঘটনাটির ভিন্নরূপ ব্যাখ্যা

সম্ভবত নবী (সা.) যখন কাগজ ও কালি আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন তা কিছু লিখবার জন্য নয়,বরং সাহাবীদের পরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে চেয়েছিলেন তাঁদের চিন্তাগত অবস্থান কতটা উন্নত হয়েছে এবং তাঁরা কি বুঝতে পেরেছেন নবী (সা.) সব কিছু বর্ণনা করে ফেলেছেন। মহান আল্লাহ্ হযরত উমরকে হেদায়েত করেছেন এভাবে যে,তিনি এটি বুঝতে পেরে বলেছেন আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট কিন্তু অন্যরা তা বুঝতে পারেন নি।

সুতরাং কলম ও কাগজ আনার বিরোধিতাকে আল্লাহর নির্দেশের পক্ষে হযরত উমরের অবস্থান বলে তাঁরা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। কিন্তু ন্যায়তلا تضلّوا بعده এরপর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না বাক্যটি কাগজ ও কালি আনার লক্ষ্যকে বর্ণনা করছে। তাই এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে হাদীসটির অর্থ হবে যদি কাগজ ও কলম আন তাহলে আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখব যে তোমরা কখনো বিপথগামী হবে না

তাই পরীক্ষার জন্য রাসূল (সা.) এমনটি বলেছেন বলে ব্যাখ্যা দেয়া হলে তা সুস্পষ্ট মিথ্যা হবে। তদুপরি নবীগণ এরূপ করতে পারেন না। তাঁরা যে বলেছেন, কাগজ ও কলম না আনা আল্লাহর নির্দেশের পক্ষে কাজ করার সামিল আমি এ কথাটিরও বিরোধী তবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে ভিন্ন। তাঁদের অনেকেই বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে,মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ এ বাক্যে ফরয বলে গণ্য ছিল না যে,তা পালন না করা হারাম হবে। তাই তা অগ্রাহ্য করলে বা সে সম্পর্কে কোন মন্তব্য করলে গুনাহগার হবার সম্ভাবনা ছিল না বিধায় এক্ষেত্রে কেউ কোন মন্তব্য করলে তা পরামর্শ বলে গৃহীত হবে এবং নবী (সা.) তখন সাহাবীদের সাথে কথোপকথন করছিলেন ও হযরত উমর তা সঠিকভাবে অনুধাবন করেছিলেন বলেই আল্লাহর পক্ষ হতে ইলহামপ্রাপ্ত হয়ে তা বলেছিলেন যাতে কঠিন অসুস্থতা ও তীব্র ব্যথায় রাসূলের ওপর পত্র লেখার কঠিন কষ্ট আপতিত না হয়। এ জন্যই কালি ও কাগজ আনতে তিনি নিষেধ করেছেন।

তাছাড়া এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে,তিনি ভেবেছেন নবী (সা.) এমন কিছু লিখে দিয়ে যাবেন যা পালনে মানুষ অক্ষম হবে ফলে শাস্তি তাঁদের জন্য অবধারিত হয়ে যাবে কারণ সুস্পষ্ট হাদীস চলে আসলে ইজতিহাদ করার সুযোগ থাকবে না।

সম্ভবত হযরত উমর ভয় পেয়েছিলেন মুনাফিকরা রাসূলের অসুস্থ অবস্থায় লিখিত পত্রের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ফিতনার সৃষ্টি করবে,তাই বলেছেনحسبنا كتاب الله আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট । যেহেতু আল্লাহ্ বলেছেন আমি কোরআনে কোন কিছুই পরিত্যাগ করি নি এবং বিদায় হজ্বে ঘোষণা করেছেন( اليوم أكملت لكم دينكم ) এদিন আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম সেহেতু তিনি মনে করেছেন দীনের পূর্ণতার মাধ্যমে পথভ্রষ্টতার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে এবং পথভ্রষ্টতা হতে রক্ষার জন্য নতুন কিছুই লিখার প্রয়োজন নেই।

উপরোক্ত যুক্তিসমূহ আহলে সুন্নাহর আলেমদের হতে উপস্থাপিত হয়েছে এবং সবগুলোতেই সমস্যা রয়েছে। যেহেতুلا تضلّوا বাক্যটি হতে বোঝা যায় সেটি ফরয ছিল যা ত্যাগ করা হারাম বলে গণ্য ছিল। এমন কর্ম যা বিচ্যুতি হতে রক্ষার কারণ ক্ষমতা থাকলে তা পালন করা নিঃসন্দেহে ওয়াজিব। তোমরা উঠে যাও নবীর এ কথা হতে বোঝা যায় তাঁর নির্দেশ পালন না করায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তাঁর নির্দেশটি পরামর্শমূলক নয়,বরং অবশ্য পালনীয় ছিল। সম্ভাবনা রয়েছে কেউ হয়তো এর প্রতিবাদে বলতে পারে বিষয়টি ফরয হলে নবী (সা.) নিজে তা করা হতে বিরত থাকতেন না যেমনভাবে তিনি কাফিরদের বিরোধিতা সত্ত্বেও দীনী দাওয়াতের কাজ হতে বিরত হন নি।

এর উত্তরে বলা যায় এ কথাটি সঠিক হলেও এ থেকে একটি বিষয়ই শুধু পরিষ্কার হয় তা হলো নবী (সা.)-এর ওপর লিখা ফরয ছিল না এবং তাঁদের ওপর কাগজ ও কালি আনা ওয়াজিব হবার সাথে এর কোন বিরোধিতাও নেই। কারণ রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়ে এর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে,এ কাজ তাঁদের চিরতরে পথভ্রষ্টতা হতে রক্ষা করবে এবং চিরন্তন হেদায়েতের দিকে পরিচালিত করবে। কোন কর্মের ক্ষেত্রে নির্দেশিত ব্যক্তির জন্য তা পালন অপরিহার্য,নিদের্শদাতার ওপর নয়,বিশেষত নির্দেশিত বিষয়ের কল্যাণ যদি নির্দেশিতদের জন্যই হয়ে থাকে। সুতরাং এক্ষেত্রে দায়িত্ব অবশ্য পালনীয় হিসেবে নবী (সা.)-এর ওপর নয়,বরং উপস্থিত ব্যক্তিদের ওপর প্রযোজ্য হয়।

তদুপরি যদি নবীর ওপরও কাজটি অপরিহার্য হত তবে নবী প্রলাপ বকছেন উপস্থিত ব্যক্তিদের এরূপ মন্তব্যের পর তাঁর ওপর কর্মটির অপরিহার্যতা আর থাকে না কারণ তা ফিতনা ছাড়া অন্য কিছুর জন্ম দেবে না।

অনেকে বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন- হযরত উমরের নিকট বিষয়টি পরিষ্কার ছিল না যে,এ লেখা সকল উম্মতকে বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্টতা হতে রক্ষা করবে এবং এরপর কেউই পথভ্রষ্ট হবে না,বরং হযরত উমর মনে করেছিলেন পথভ্রষ্ট হবে না অর্থ সকল উম্মত পথভ্রষ্টতার ওপর একতাবদ্ধ হবে না ও বিচ্যুতির বিষয়টি সকলকে আক্রান্ত করবে না। যেহেতু হযরত উমর পথভ্রষ্টতার ওপর সকলেরই একমত হওয়া সম্ভব নয় বলে জানতেন সেহেতু লেখার কোন প্রয়োজনীয়তা তিনি দেখেন নি এবং নবীর এ কর্মকে উম্মতের প্রতি তাঁর অত্যধিক ভালবাসা হতে নিঃসৃত মনে করেছেন যার কারণে নবী (সা.) সতর্কতামূলকভাবে এ পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই নিজ মতানুযায়ী নবীকে উদ্দেশ্য করে পূর্বোক্ত কথাগুলো বলেছিলেন। এক্ষেত্রে রাসূলের নির্দেশ ওয়াজিব না হয়ে ভালবাসাপ্রসূত বলে গণ্য হবে।

উপরোক্ত বিভিন্ন মতামতের মাধ্যমে আহলে সুন্নাহর আলেমরা চেয়েছেন বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু যে কেউ রাসূল (সা.)-এর হাদীসটি পড়বে তাতে নিশ্চিত হবে যে,এ ব্যাখ্যাগুলো সত্য হতে দূরে। কারণ তোমরা গোমরাহ হবে না কথাটি হতে যেমন কাজটি ফরয বলে প্রতীয়মান হয় তেমনি নবী (সা.)-এর অসন্তুষ্টিও প্রমাণ করে যে,একটি ফরয কাজ পরিত্যাগ করা হচ্ছে।

সুতরাং এক্ষেত্রে সর্বোত্তম জবাব হলো এটি এমন একটি বাস্তব ঘটনা যা আকস্মিক ও ব্যতিক্রমীরূপে তার মূল থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ঘটনাটি তাঁদের জীবন পদ্ধতির বিপরীতে সংঘটিত হয়েছিল বলে প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ্ই সত্যপথের হেদায়েতকারী।

ওয়াসসালাম