আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত4%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 71396 / ডাউনলোড: 9668
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

অষ্টম পত্র

১৫ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   যে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছি তা লক্ষ্য করা হয় নি।

২।   কেউ নিজের পরিচয় দান করলে তা চক্রের সৃষ্টি করে এ ধারণা ভুল।

৩।  হাদীসে সাকালাইন।

৪।   হাদীসে সাকালাইন মুতাওয়াতির হবার পক্ষে দলিল।

৫।   যে ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের (عترت ) সঙ্গে সংযুক্ত না হবে সে বিপথগামী হবে।

৬।   আহলে বাইত নূহ (আ.)-এর তরণীস্বরূপ;ক্ষমার দ্বার এবং দীনী বিভেদ হতে মুক্তির উপায়।

৭।  আহলে বাইত বলতে এখানে কাদের বোঝানো হয়েছে?

৮।  কেন তাঁদেরকে নূহ (আ.)-এর তরণী ও ক্ষমার দ্বারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

১। আমরা মহানবী (সা.)-এর বাণীর মাধ্যমেই শুধু যুক্তি প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন করি নি,বরং আমাদের পত্রের শুরুতে এরূপ একটি হাদীসের প্রতি ইশারা করেছি যা পরিষ্কাররূপে আহলে বাইতের ইমামগণের অনুসরণকে ফরয ঘোষণা করেছে,অন্যদের নয়।

কেননা বলেছি রাসূল (সা.) তাঁদেরকে কোরআনের সমকক্ষ,জ্ঞানবানদের নেতা,মুক্তির তরণী,উম্মতের রক্ষাকেন্দ্র ও ক্ষমার দ্বার বলে ঘোষণা করেছেন। এগুলো রাসূল হতে বর্ণিত সহীহ ও স্পষ্ট হাদীসসমূহের সারসংক্ষেপ। বলেছিলাম,আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ইশারা ও ইঙ্গিতই যাঁদের বোঝার জন্য যথেষ্ট (কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই)।

২। সুতরাং আমরা যা বলেছি,এ হাদীসের ভিত্তিতে তাঁদের কথা আহলে বাইতের বিরোধীদের ওপর প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে তাঁদের উপস্থাপিত বাণী চক্র বলে গণ্য হবে না।

৩। এখন রাসূলের বাণীতে যে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছিল তার প্রতি লক্ষ্য করুন। তিনি অজ্ঞ ও অসচেতন ব্যক্তিবর্গকে উচ্চৈঃস্বরে আহবান করে বলেছেন,

يَا أيّهَا النّاسُ إنّي تَرَكتُ فِيكُم مَا إِن أَخَذتُم بِهِ لَن تَضِلّوا , كِتَابَ الله وَ عِترَتِي أهلَ بَيتِي

হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি যদি তা ধারণ কর তবে কখনোই বিপথগামী হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় (আহলে বাইত)। ১৬

তিনি আরও বলেছেন,

إنّي ترَكتُ فِيكُم مَا إِنْ تَمَسّكتُم بِهِ لَن تَضِلّوا بَعدِي كِتَابَ اللهِ حَبلٌ مَمدُوْدٌ منَ السّمَاءِ إِلَى الأرضِ وَ عِترَتِي أَهلَ بَيتِي وَ لَن يَفتَرِقَا حَتّى يَرِدَا عَلَيّ الحَوضَ فَانظُرُوا كَيفَ تُخَلِّفُونِي فِيهِمَا

নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মধ্যে দু টি জিনিস আমানত রেখে যাচ্ছি,যদি এ দু টিকে আঁকড়ে ধর তাহলে কখনোই গোমরাহ হবে না। তার একটি হলো আল্লাহর কিতাব কোরআন যা আসমান হতে যমীন পর্যন্ত প্রসারিত রজ্জু ও অন্যটি আমার আহলে বাইত। এ দু টি কখনোই পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না এবং এ অবস্থায়ই হাউজে কউসারে আমার সাথে মিলিত হবে। তাই লক্ষ্য রেখো তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে। ১৭

অন্য এক স্থানে রাসূল (সা.) বলেছেন,

আমি তোমাদের মাঝে দু টি খলীফা বা প্রতিনিধি রেখে যাচ্ছি। আল্লাহর কিতাব যা আসমান হতে যমীন পর্যন্ত প্রসারিত এবং আমার নিকটাত্মীয় ও পরিবার। তারা হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না। ১৮

তিনি আরও বলেছেন,

তোমাদের মাঝে দু টি ভারী বস্তু (মূল্যবান বস্তু) রেখে যাচ্ছি। আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত। তারা হাউজে কাওসারে আমার সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। ১৯ (*৯)

রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেছেন,

খুব শীঘ্রই আল্লাহ্পাকের পক্ষ থেকে আমাকে আহবান করা হবে এবং আমি তা গ্রহণ করবো। আমি তোমাদের মাঝে দু টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত। আল্লাহর কিতাব রজ্জুর মত আসমান হতে যমীন পর্যন্ত প্রসারিত। তিনি আরো বলেছেন, আমার ইতরাত অর্থাৎ নিকটাত্মীয় রক্তজ বংশধরগণই আমার আহলে বাইত। সর্বজ্ঞাত ও সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ্ আমাকে জানিয়েছেন,এরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না ও এ অবস্থায়ই আমার সাথে হাউজে কাওসারে মিলিত হবে। আমি লক্ষ্য করব আমার পর তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ কর। ২০

যখন রাসূল বিদায় হজ্ব হতে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন গাদীরে খুম নামক স্থানে অবতরণ করে নির্দেশ দিলেন বৃহৎ বৃক্ষসমূহের নীচে পরিষ্কার করে সেখানে সকলকে অবস্থান নিতে। অতঃপর তিনি বললেন,

আমাকে আহবান করা হয়েছে ও আমি তা গ্রহণ করেছি। আমি তোমাদের মাঝে দু টি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি যার একটি অপরটি হতে বৃহৎ। কোরআন ও আমার নিকটাত্মীয় ও রক্তজ বংশধর (আহলে বাইত)। তাদের প্রতি লক্ষ্য রেখো এবং মনে রেখো তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। অতঃপর তিনি বললেন,

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ مَولاي وَ أنا مَولى كُلِّ مُؤْمِنٍ

নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ আমার অভিভাবক এবং আমি সকল মুমিনের অভিভাবক।

তারপর আলী (আ.)-এর হাত উঁচু করে ধরে বললেন,

مَن كُنتُ مَولاهُ فَهذَا وَلِيُّهُ , اَللّهُمَّ وَالِ مَن وَالاهُ وَعَادِ مَنْ عَادَاه .

আমি যার মাওলা বা অভিভাবক আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ্,তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে এবং তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। ২১

আবদুল্লাহ ইবনে হানতাব বলেছেন, রাসূল (সা.) জুহফাতে আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা দান করেন ও প্রশ্ন করেন : আমি কি তোমাদের ওপর তোমাদের অপেক্ষা অধিক অধিকার রাখি না? সবাই বলল : হ্যাঁ।

অতঃপর বললেন,

إنّي سَائِلُكُمْ عَنْ اِثنَيْن :اَلْقُرْآن وَ عِتْرَتِيْ

আমি তোমাদেরকে অবশ্যই দু টি বিষয়ে প্রশ্ন করবো। আর তা হলো কোরআন ও আমার আহলে বাইত। ২২

৪। নির্ভরযোগ্য সুন্নাহ্ দু টি মূল্যবান বস্তুকে আঁকড়ে ধরাকে ফরয বলেছে যা মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত। হাদীসটির বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা বিশ-এর অধিক এবং এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে একথাগুলো বিভিন্নভাবে বলেছেন।

যেমনটি লক্ষ্য করেছেন বিদায় হজ্ব থেকে ফিরার পথে গাদীরে খুমে,তদ্রুপ আরাফাতের ময়দানে,তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর,আবার কখনো মদীনার মিম্বারে,এমন কি তাঁর শেষ অসুস্থতার সময়ও (যখন তাঁর কক্ষ সাহাবীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল) তিনি এ কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করেছেন।

হে লোকসকল! অতি শীঘ্রই আমার আত্মা স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করবে এবং (আমি) এ পৃথিবী থেকে চলে যাব। আমি তোমাদের এরূপ একটি কথা বলব যার পর তোমাদের ওজর পেশ করার কোন সুযোগ থাকবে না। জেনে রাখ,আমি কোরআন ও আমার আহলে বাইতকে তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি।

অতঃপর আলী (আ.)-এর হাত উঁচু করে ধরে বললেন,

هذَا عَلِيّ مَعَ الْقُرْآنِ وَ الْقرآنُ مَعَ عَلِيٍّ لا يَفْتَرِقَانِ حَتَّى يَرِدَا عَلَيَّ الْحَوْض

এই আলী কোরআনের সঙ্গে এবং কোরআনও আলীর সঙ্গে। তারা হাউজে কাওসারে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। ২৩

এ বিষয়টিকে আহলে সুন্নাহর অনেক বড় বড় আলেম স্বীকার করেছেন,এমন কি ইবনে হাজার হাদীসে সাকালাইন বর্ণনা করার পর বলেছেন, জেনে রাখুন,কোরআন ও আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং বিশের অধিক সাহাবী তা বর্ণনা করেছেন।

অতঃপর এর সঙ্গে এ কথাগুলো যোগ করেছেন, ১১ নম্বর সন্দেহের জবাবে এ হাদীসগুলোর কয়েকটি সনদের কথা আমরা বলেছি যার কোনটি রাসূল (সা.) বিদায় হজ্বে আরাফাতের ময়দানে,কোনটি মদীনাতে অসুস্থতার সময় তাঁর গৃহে যখন প্রচুর সাহাবী সমবেত হয়েছিলেন তখন বর্ণনা করেছেন,কোনটি গাদীরে খুমে এবং কোনটি তায়েফ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় বর্ণনা করেছেন বলে বলা হয়েছে। এ হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী নয়। কারণ হতেই পারে সকল স্থানেই রাসূল (সা.) এ সত্যকে পুনরাবৃত্তি করেছেন কোরআন ও আহলে বাইতের মহান গুরুত্বের কথা চিন্তা করে।২৪

আহলে বাইতের ইমামগণের মর্যাদার জন্য এটিই যথেষ্ট যে,আল্লাহ্ ও রাসূল (সা.) তাঁদেরকে কোরআনের পাশাপাশি ও এর সমপর্যায়ে স্থান দিয়েছেন যার মধ্যে অসত্য ও বাতিল কোনরূপেই প্রবেশ করতে পারে না।

) لا يأتَيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَ لا مِنْ خَلْفِهِ(

অর্থাৎএতে মিথ্যার প্রবেশাধিকার নেই , না সামনের দিক হতে, না পেছন দিক হতে। ২৫

এগুলোই আহলে বাইতের ইমামগণের অনুসরণের পক্ষে কোরআন ও সুন্নাতের স্পষ্ট দলিল হিসেবে আমাদের এ পথে পরিচালিত করেছে। কারণ মুসলমানরা কোরআনের স্থলে অন্য কিছুকেই গ্রহণ করতে পারে না। তাই কিরূপে সম্ভব তদস্থলে এমন কিছু গ্রহণ করবে যা কোরআনের সমমানের ও সমমর্যাদার হবে না?

৫। তদুপরি হাদীসে এসেছে-

إنّي تارِكٌ فِيكُمْ ما إن تَمسّكْتُمْ بِهِ لَنْ تَضِلّوا :كِتابَ اللهِ وَ عِتْرَتِيْ

অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি যাকে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও বিপথগামী হবে না। (ভাবার্থ হলো যে কেউ এ দু'টিকে একসঙ্গে আঁকড়ে না ধরবে সে গোমরাহ হয়ে যাবে।) এ হাদীসের (হাদীসে সাকালাইন) সঙ্গে তাবরানীর বর্ণনানুসারে রাসূলুল্লাহ্ এ কথাটিও সংযোগ করেছেন,

فَلا تُقَدِّموهُمَا فَتُهْلِكُوا وَ لا تُقَصِّرُوا عَنهُما فَتُهْلِكُوا وَلا تُعَلِّمُوهُمْ  فَإِنَّهُمْ أعْلَمُ مِنْكُمْ

তাদের চেয়ে অগ্রবর্তী হয়ো না তাহলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং তাদের ব্যাপারে উপেক্ষার দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না,তবে ধ্বংসগহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষাদান করতে যেও না কারণ তারা তোমাদের চেয়ে জ্ঞানী।

ইবনে হাজার বলেন, তাদের চেয়ে অগ্রবর্তী হয়ো না বা তাদেরকে উপেক্ষা করো না,তাদেরকে কিছু শেখানোর চেষ্টা করো না- নবীর এ কথাটির অর্থ হলো যে কেউ জ্ঞানের যে পর্যায়েই পৌঁছে থাকুক না কেন আহলে বাইত দীনি দায়িত্ব ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের ওপর প্রধান্য রাখেন। ২৬  

৬। যে সকল প্রামাণ্য দলিল মুসলমানদের আহলে বাইতের প্রতি পরিচালিত করে ও এ পথে চলতে বাধ্য করে তার একটি হলো নবী করিম (সা.)-এর এ বাণীটি-

أَلا إِنَّ مَثَلَ أَهْل بَيْتِيْ فِيْكُم مَثَلُ سَفِيْنَةِ نُوح مَنْ رَكِبَهَا نَجا وَ مَنْ تَخَلَّفَ عَنْهَا غَرَقَ

জেনে রাখো,নিশ্চয়ই আমার আহলে বাইত তোমাদের জন্য নূহের তরণির মত। যে ব্যক্তি তাতে আরোহণ করবে সে মুক্তি পাবে আর যে তা থেকে বিরত থাকবে সে নিমজ্জিত হবে।২৭

এছাড়াও রাসূল বলেছেন,

শুধু আমার আহলে বাইতই নূহের কিস্তির মত যে তাতে আরোহণ করবে সে নাজাত পাবে,যে আরোহণ না করবে সে নিমজ্জিত হবে। আমার আহলে বাইত তোমাদের মাঝে বনি ইসরাঈলের ক্ষমার দ্বারের অনুরূপ,যে তাতে প্রবেশ করবে সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। ২৮

অন্যত্র বলেছেন,

النُّجُومُ  أمَانٌ لِأهْلِ الأرْضِ مِنَ الْغَرَقِ وَ أَهْلُ بَيْتِي أمانٌ لِأمّتِي مِنَ ا لْلاِخْتِلافِ (فِي الدّينِ )فَإِذَا خَالَفَتْهَا قَبِيلَةٌ مِنَ الْعَرَبِ (يَعْني في اَحْكامِ اللهِاِخْتلفوا فَصَارُوا حِزْبَ     

তারকারাজি পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষাকবচ। আর আমার আহলে বাইত উম্মতের দীনের ক্ষেত্রে বিভক্তি হতে রক্ষার আশ্রয়স্থল। যদি আরবদের মধ্যে কোন গোত্র তাদের বিরোধিতা করে (আল্লাহর হুকুম ও বিধানের ক্ষেত্রে) তবে সে গোত্র শয়তানের দলে পরিণত হবে। ২৯ (*১১)

এগুলোই উম্মতের জন্য আহলে বাইতের অনুসরণকে অপরিহার্য করে তোলে এবং তাঁদের বিরোধিতা থেকে দূরে রাখে। আমার মনে হয় না এর থেকে সুষ্ঠু কোন ভাষা ও শব্দের মাধ্যমে এটি মানুষকে বোঝানো সম্ভব।

৭। কিন্তু আহলে বাইত বলতে এখানে যা বোঝানো হয়েছে তা রাসূল (সা.)-এর বংশধারার মধ্যকার ইমামগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ,অন্য কোন ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ এই সম্মান ও মর্যাদা যাঁরা আল্লাহর নির্দেশকে বাস্তবায়ন করেন ও তাঁরই ঐশী নিদর্শন তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। একথাটি যেরূপ হাদীস ও রেওয়ায়েত হতে সেরূপ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও প্রমাণিত। আহলে সুন্নাতের অনেক প্রসিদ্ধ আলেমও তা স্বীকার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ : ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েকুল মুহরাকাহ্ গ্রন্থে বলেছেন,

অনেকে বলেছেন : যে আহলে বাইতের কথা বলা হয়েছে তাঁরা রক্ষিত,তাঁরা আহলে বাইতের আলেমগণ হতে পারেন কারণ মানুষ তাঁদের মাধ্যমেই হেদায়েতপ্রাপ্ত হন;তাঁরা মানুষের মাঝে তারকাস্বরূপ এবং যদি তাঁরা পৃথিবীতে না থাকেন তবে মানুষের ওপর আল্লাহর আজাব পতিত হয়।

অতঃপর বলেন, এবং এটি মাহ্দী (আ.)-এর সময় ঘটবে। কারণ ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কিত হাদীসসমূহ থেকে জানা যায় হযরত ঈসা (আ.) তাঁর পেছনে নামায পড়বেন এবং দাজ্জাল তাঁর সময়েই নিহত হবে। এর পরই একের পর এক আল্লাহর নিদর্শনসমূহ প্রকাশিত হতে শুরু করবে। ৩০

অন্যত্র তিনি বলেছেন, মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো : আপনার আহলে বাইতের পরবর্তীতে মানুষ কিরূপে জীবন যাপন করবে? জবাব দিলেন : কোমর ভাঙ্গা গাধার ন্যায়। ৩১

৮। আপনি ষ্পষ্টত বুঝতে পেরেছেন যে,নবী (সা.)-এর আহলে বাইতকে নূহ (আ.)-এর তরণীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কারণ যে কেউ দীনের মৌলিক ও বিধানগত বিষয়ে (ফিকাহ্গত) আহলে বাইতের ইমামগণ হতে নির্দেশনা গ্রহণ করবে তারা জাহান্নামের শাস্তি হতে মুক্তি লাভ করবে। আর কেউ যদি তার বিরোধিতা করে সে ঐ ব্যক্তির মত যে নূহ (আ.)-এর সময়ের প্লাবন হতে পাহাড়ের ওপর আশ্রয় গ্রহণ করেও মুক্তি পায় নি। এখানে নিমজ্জিত হবার অর্থ জাহান্নামে পতিত হওয়া। তাই এমন কর্ম হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

তাঁদেরকে ক্ষমার দ্বারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কারণ আল্লাহ্ ঐ দ্বারকে তাঁর শক্তিমত্তার বরাবরে তাঁর নির্দেশানুযায়ী মস্তক অবনত করা ও বিনয়ী হবার পথ হিসেবে বলেছেন এবং এ কারণেই এ দ্বার বনী ইসরাঈলের জন্য ক্ষমার পথ হয়েছিল। তদ্রুপ এই উম্মতের জন্য এ দ্বারকে আহলে বাইতের মোকাবিলায় আল্লাহর নির্দেশের অনুকূলে আত্মসমর্পণ করা এবং ক্ষমা ও মাগফিরাত লাভের উপায় করা হয়েছে। ইবনে হাজার এই হাদীসগুলো উদ্ধৃত করার পর আহলে বাইতকে নূহ (আ.)-এর তরণী ও ক্ষমার দ্বারের সঙ্গে তুলনা করার কারণ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন,

তাঁদেরকে নূহ (আ.)-এর তরণীর সঙ্গে তুলনা করার কারণ এটিই,যে কেউ তাঁদের ভালবাসবে ও সম্মান করবে সে আল্লাহর নিয়ামতের শোকর আদায় করেছে এবং সে অবশ্যই আহলে বাইতের ইমামগণের মাধ্যমে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে ও তাঁদের বিরোধিতার অন্ধকার হতে মুক্তি লাভ করবে। আর যে কেউ তাঁদের বিরোধিতা করবে আল্লাহর নিয়ামতের অস্বীকৃতির সাগরে নিমজ্জিত ও ধ্বংসের গহ্বরে পতিত হবে। ৩২

অতঃপর বলেছেন, তাঁদেরকে ক্ষমার দ্বারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এজন্য যে,এ দ্বারে প্রবেশ করা বায়তুল মুকাদ্দাস বা রাইহার দ্বারে প্রবেশের মত (যদি তা আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করার উদ্দেশ্যে হয়) ক্ষমা লাভের কারণ। আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের ভালবাসাকে উম্মতের ক্ষমা লাভের উপায় করে দিয়েছেন। ৩৩

সুতরাং আহলে বাইতের অনুসরণের বিষয়টি অপরিহার্য হওয়া সম্পর্কিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির ও বহুল প্রচারিত। বিশেষত আহলে বাইত হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ সহীহ বলে পরিগণিত। আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন এ ভয় যদি না করতাম তবে আমার লেখনীকে স্বাধীন করে ছেড়ে দিতাম যাতে তা পূর্ণতায় পৌঁছায়। যা হোক যতটুকু লিখলাম আশা করি তা এ উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম হবে।

ওয়াসসালাম

নবম পত্র

১৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

এ বিষয়ে আরো অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনার আহবান।

আপনার কলমের লাগামকে ছেড়ে দিন ও কোন সমালোচনাকে ভয় করবেন না। আমার কান আপনার পূর্ণ অধিকারে এবং আমার হৃদয় আপনার জ্ঞান হতে কিছু অর্জন করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমি সম্পূর্ণ শান্তভাবে আপনার কথা শ্রবণ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছি। আপনার যুক্তি প্রদর্শনের প্রক্রিয়া আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই ক্লান্তি ও সমালোচনার ভয়কে মন থেকে দূরীভূত করেছি। সুতরাং আপনার বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রজ্ঞাময় বক্তব্য থেকে আমাকে আরো অধিক জানার সুযোগ দিন। কারণ আপনার কথার মধ্যে আমি হারিয়ে যাওয়া প্রজ্ঞাকে খুঁজে ফিরছি। আপনার সচল কলম থেকে প্রজ্ঞাময় সকল কথা আমাকে বলুন।

ওয়াসসালাম

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49