আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত0%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত

লেখক: আল্লামাহ্ সাইয়্যেদ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন আল মুসাভী
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ:

ভিজিট: 61815
ডাউনলোড: 8010

পাঠকের মতামত:

আল মুরাজায়াত
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 61815 / ডাউনলোড: 8010
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

 
একশত দশতম পত্র

২৯ রবিউস সানী ১৩৩০ হিঃ

১।   শিয়া মাজহাব আহলে বাইতের ইমামদের হতে মুতাওয়াতির সূত্রে প্রতিষ্ঠিত।

২।   কোরআন-সুন্নাহর তাফসীর ও দীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে শিয়ারা সাহাবীদের সময়ই এর লিখন ও বিস্তারে রত হন।

৩।   শিয়া মুহাদ্দিস ও লেখকগণ তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের যুগেই পরিচিত ছিলেন।

১। সচেতন ব্যক্তিরা সন্দেহাতীতভাবে এ বিষয়ে অবহিত যে,বার ইমামী শিয়াগণ উসূল ও ফুরুয়ে দীনের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের সাথে সংযুক্ত ছিলেন এবং কখনোই তাঁদের হতে বিচ্ছিন্ন হন নি। সুতরাং শিয়া মত নবীর আহলে বাইতের মত হতেই গৃহীত। কোরআন ও সুন্নাহ্ হতে দীনের মৌল বিশ্বাস ও কর্মের সকল বিষয় তাঁরা তাঁদের হতে অর্জন করেছেন। এর কোনটিতেই তাঁরা আহলে বাইত ভিন্ন অন্য কারো ওপর নির্ভর করেন নি এবং এ বিষয়ে অন্য কাউকে প্রশ্নও করেন নি। সুতরাং তাঁরা আল্লাহর বিধানে বিশ্বাসী ও তাঁর সান্নিধ্য প্রত্যাশী। তবে এজন্য তাঁরা শুধু আহলে বাইতের পথকে সঠিক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ পথ থেকে ফিরে আসার কোন যুক্তিই তাঁরা দেখেন না এবং পূর্ববর্তী পুণ্যবান ও সৎ কর্মশীল ঐ সকল ব্যক্তি যাঁরা ইমাম আলী,হাসান ও হুসাইন (আ.) এবং ইমাম হুসাইনের বংশধর নয়জন ইমামের সময়কাল হতে এ পথে চলে এসেছেন তাঁরা এখনো তাঁদের অনুসৃত পথে চলছেন।

প্রথম তিন ইমামসহ ইমাম হুসাইনের বংশধারা হতে আগত নয়জন ইমামের সকল হতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাফিয,ক্বারী ও হাদীসবেত্তা শিয়া মাজহাবের উসূল ও ফুরুয়ে দীনের বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছেন। এদের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক তাকওয়া ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন যাঁদের সংখ্যা তাওয়াতুরের পর্যায় হতেও অধিক। তাঁরা পরবর্তীদের জন্য মুতাওয়াতির সূত্রে এ সকল বিষয়ে রেওয়ায়েত করে গিয়েছেন যা বংশ পরম্পরায় (প্রজন্ম হতে প্রজন্মে) স্থানান্তরিত হয়ে আমাদের নিকট পৌঁছেছে এবং দিবালোকের মত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে যার সামনে কোন পর্দা নেই। সুতরাং উসূল ও ফুরুয়ে দীনের ক্ষেত্রে আমরা (শিয়ারা) রাসূল (সা.)-এর বংশের ইমামদের পথেই রয়েছি এবং এ মাজহাবের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সকল বিষয় আমাদের পিতৃপুরুষরা তাঁদের পূর্ব-পুরুষদের সৎ কর্মশীলদের হতে অবিচ্ছিন্নভাবে ইমাম আসকারী,ইমাম হাদী,ইমাম জাওয়াদ,ইমাম রেযা,ইমাম সাদিক,ইমাম বাকির,ইমাম সাজ্জাদ,ইমাম হুসাইন,ইমাম হাসান এবং আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) হতে শিক্ষা লাভ করেছেন। তবে আমরা পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীল শিয়াদের সকল বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁরা ইমামগণের সাহাবী ছিলেন ও দীনের বিধি-বিধান এবং ইসলামী জ্ঞানসমূহ অর্জন ও সংরক্ষণ করেছেন তাঁদের সকলের পরিচয় দিতে সক্ষম নই কারণ এর জন্য যে ব্যাপক প্রচেষ্টা ও সময় প্রয়োজন তা এখন দেয়া সম্ভব নয়। তবে এজন্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ ও আলেমগণ এ সম্পর্কে যে গবেষণা চালিয়েছেন সেগুলো অধ্যয়ন করতে পারেন। নিঃসন্দেহে লক্ষ্য করবেন এ বিষয়ে লিখিত গ্রন্থসমূহের বর্ণনা হেদায়েতপ্রাপ্ত ইমামগণের জ্ঞানসমুদ্র হতে গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁদের পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণীই সেগুলোতে সংকলিত হয়েছে।

সুতরাং এ সকল লেখনী তাঁদের জ্ঞানপত্র ও প্রজ্ঞার শিরোনাম হিসেবে তাঁদের সময়েই সংকলিত হয়েছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের শিয়াদের জন্য সনদ ও পাণ্ডুলিপিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই অন্যান্য চার মাজহাব হতে আহলে বাইতের মাজহাব বিশেষত্বের অর্ধিকারী। চার মাজহাবের ইমামদের শিষ্যদের হতে কাউকেই আমরা জানি না যাঁরা তাঁদের ইমামদের জীবদ্দশায় ঐ মাজহাব সম্পর্কে কোন গ্রন্থ রচনা করেছেন,বরং তাঁদের মৃত্যুর পর যখন শাসকবর্গের পক্ষ হতে এ চারটি মাজহাবের যে কোন একটিকে অনুসরণ অপরিহার্য করা হয় তখন ধীরে ধীরে তাঁদের বিষয়ে পরিচিতি বৃদ্ধি পায় এবং জনগণ ধর্মীয় বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুসরণ শুরু করে। তৎকালীন সময়ে এ চার ইমাম অন্যান্য ফকীহ্ ও মুহাদ্দিস হতে বিশেষ কোন মর্যাদার অধিকারী ছিলেন না। তাই তাঁদের জীবদ্দশায় কেউ তাঁদের মত ও ফতোয়া লিখে রাখার বিষয়ে কোন গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু শিয়াগণ প্রথম হতে আহলে বাইতের ইমামদের কথা ও বক্তব্য লিখে রাখার বিষয়ে সচেতন ছিলেন ও এ বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন। কারণ মাজহাব ও ধর্মের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তাঁরা আহলে বাইত ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তির শরণাপন্ন হওয়াকে বৈধ মনে করতেন না। এজন্য তাঁরা সর্বক্ষণ তাঁদের ঘিরে থাকতেন ও তাঁদের হতে দীনি নির্দেশনা গ্রহণের জন্য অবিরাম প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকতেন। তাঁদের হতে যা কিছুই শ্রবণ করতেন তা লিখে রাখতেন ও তা সংরক্ষণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতেন। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি ইমাম সাদিক

(আ.)-এর সময় এ বিষয়ে চারশ গ্রন্থ রচিত হয় যা উসূলে আরবাআতু মিয়াহ্ বলে প্রসিদ্ধ। চারশ লেখক এই গ্রন্থসমূহ সংকলন করেছেন যাতে ইমাম সাদিক (আ.)-এর ফতোয়াসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শিষ্যগণ এই চারশ গ্রন্থের বাইরেও গ্রন্থসমূহ রচনা করেছেন যার বিবরণ আমরা ইনশাআল্লাহ্ পরবর্তীতে খুব শীঘ্রই দেব।

আহলে সুন্নাহর চার মাজহাবের ইমামগণের কেউই আহলে বাইতের ইমামগণের ন্যায় তাঁদের অনুসারীদের নিকট এতটা সম্মানিত নন। বিশেষত তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁরা যে মর্যাদা লাভ করেছেন তাঁদের জীবদ্দশায় তা ছিল না। ইবনে খালদুন তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় ফিকাহ্শাস্ত্র সম্পর্কিত একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে এটি স্বীকার করেছেন। আহলে সুন্নাহর বিশেষজ্ঞ আলেমদের অনেকেই তাঁদের গ্রন্থেও এ মত দিয়েছেন। আমরা নিঃসন্দেহে মনে করি এ মাজহাবসমূহের অনুসারীরা যে পথ অবলম্বন করেছেন তা তাঁদের ইমামদেরই পথ এবং তাঁদের কর্মসমূহ প্রজন্ম হতে প্রজন্মে লিখিতরূপে স্থানান্তরিত হয়েছে। যেহেতু প্রত্যেক মাজহাবের অনুসারীরাই স্বীয় মাজহাব সম্পর্কে অধিকতর অবগত সেহেতু শিয়াগণ তাঁদের ইমামদের মাজহাব সম্পর্কে অধিকতর অবগত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ তাঁরা এই মাজহাব অনুসারে আল্লাহর ইবাদত করছেন এবং এ পথ ভিন্ন আল্লাহর নৈকট্য লাভের কোন পথ নেই।

২। বিশেষজ্ঞগণ অবগত যে,ইসলামী জ্ঞানের সংকলনে শিয়াগণ অন্যদের হতে অগ্রগামী ছিলেন। প্রথম যুগে হযরত আলী (আ.) ও তাঁর সহযোগী শিয়া সাহাবীগণ ব্যতীত অন্যরা এরূপ ব্যাপক লেখনীর কাজ করেন নি। কারণ অন্যদের মধ্যে হাদীস লিপিবদ্ধ বৈধ কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ ছিল।

ইবনে হাজার আসাকালানী তাঁর ফাতহুল বারী গ্রন্থের ভূমিকায় (পৃষ্ঠা ৪) বর্ণনা করেছেন (অন্যরাও তা স্বীকার করেছেন),উমর ইবনে খাত্তাবসহ অনেক সাহাবী হাদীস লিপিবদ্ধকরণকে বৈধ মনে করতেন না এজন্য যে,কোরআনের সাথে তার মিশ্রিত হবার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু হযরত আলী,তাঁর উত্তরাধিকারী ও পুত্র ইমাম হাসান এবং সাহাবীদের মধ্যে তাঁদের অনুসারীরা হাদীস লিপিবদ্ধকরণকে বৈধ মনে করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শুরুতে তাবেয়ীদের সময় ইজমার মাধ্যমে হাদীস সংকলন বৈধ ঘোষিত হয়। তখনই ইবনে জারির,মুজাহিদ ও আত্তার সূত্রে তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। গাজ্জালীর মতে ইসলামের লিখিত প্রথম হাদীস গ্রন্থ এটি কিন্তু সঠিক হলো আহলে সুন্নাহ্ সূত্রে এটি ইসলামের প্রথম গ্রন্থ,সার্বিকভাবে নয়। সুন্নী সূত্রে এর পর যে গ্রন্থটি লিখিত হয় তা হলো মু’‏ তামার ইবনে রাশেদ সানআনীর এবং তার পর আসে মালিক ইবনে আনাসের মুয়াত্তা -এর নাম। ফাতহুল বারী র ভূমিকায় এসেছে- রাবী ইবনে সাবিহ্ সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি গ্রন্থ সংকলন করেন যার সময়কাল হলো তাবেয়ীদের যুগের শেষ পর্যায়ে।

সুতরাং এ বিষয়ে ইজমা বা ঐকমত্য রয়েছে যে,প্রথম যুগে শিয়াসূত্র ভিন্ন কোন গ্রন্থ রচনা হয় নি। হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা প্রথম যুগেই এ কাজে হাত দেন। হযরত আলী (আ.) সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তা হলো কোরআন সংকলন। তিনি নবী (সা.)-এর কাফন-দাফনের পর শপথ করেন কোরআন সংকলন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি নামাযের সময় ব্যতীত আবা (বিশেষ বস্ত্র) পরিধান করবেন না। তিনি কোরআন অবতীর্ণ হবার ধারায় তা সংকলন করেন এবং এর আয়াতসমূহকে নাসিখ,মানসুখ,স্পষ্ট ও রূপক (মুহকাম ও মুতাশাবিহ),শর্তযুক্ত ও শর্তহীন (মুতলাক ও মুকাইয়্যিদ),সর্বজনীন ও বিশেষায়িত (আম ও খাস) এভাবে শ্রেণীবদ্ধ করেন। এতে ফরয,হালাল,হারাম,মাকরুহ,মুবাহ্ ইত্যাদি বিষয়েও ব্যাখ্যা প্রদান করেন। আয়াতসমূহের শানে-নুযূলসহ তাফসীরও তাতে সংযুক্ত করেন। এজন্যই ইবনে সিরিন প্রায়ই বলতেন যদি ঐ কোরআনটি পেতাম তবে প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান পেতাম

অবশ্য সাহাবীদের কেউ কেউ কোরআন সংকলনের কাজে হাত দিয়েছিলেন কিন্তু তাতে তাঁরা অবতীর্ণ হবার ধারা অবলম্বন এবং উপরোক্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো অবতারণায় ব্যর্থ হন। সুতরাং বলা যায় হযরত আলী যে সংকলন করেন তা তাফসীর সদৃশ ছিল। কোরআন সংকলনের পর তিনি ফাতিমা (আ.)-এর জন্য একটি গ্রন্থ রচনা করেন যা তাঁর সন্তানদের নিকট মুসনাদে ফাতিমা বলে প্রসিদ্ধ। এ গ্রন্থে উপদেশ,নির্দেশ,শিক্ষামূলক ঘটনা,হাদীস,দিক-নির্দেশনা ও তাঁর পিতার ওফাতে তাঁকে সান্ত্বনা দানকারী বিষয়সমূহ লিপিবদ্ধ ছিল। অতঃপর তিনি দিয়াহ্ (হত্যা,অঙ্গহানী ঘটানো,আহত করা প্রভৃতির জন্য যে অর্থ রক্তপণ হিসেবে দিতে হয়) সম্পর্কিত একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন যার নাম সহীফা রাখা হয়। ইবনে সা দ তাঁর আল জামে নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের শেষে হযরত আলীর সনদে এটি বর্ণনা করেছেন। বুখারী ও মুসলিমও এই সহীফার কথা উল্লেখ করে কয়েক স্থানে তা বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে আ মাশ হতে ইবরাহীম তাইমী সূত্রে তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী (আ.) বলেছেন : আমাদের নিকট কোরআন ও এই সহীফা ব্যতীত পাঠ্য অন্য কোন গ্রন্থ নেই। অতঃপর তিনি এই সহীফা আনলেন,তাতে দেখলাম আঘাত,জখম,উষ্ট্রের দাঁত সম্পর্কিত বিধানাবলী রয়েছে। এক স্থানে লেখা রয়েছে মদীনা নিষিদ্ধ (হারাম) স্থান,এর সীমা আইর হতে সউর পর্বত পর্যন্ত। যে কেউ এই সীমায় অপরাধ ও অন্যায় করবে অথবা কোন অপরাধীকে আশ্রয় দেবে তার ওপর আল্লাহ্,তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী এবং সকল মানুষের অভিশম্পাত। এ হাদীসটি বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে কিতাবে ফারায়েয -এর ইসমুন মান তাবাররা মিন মাওয়ালিহী অধ্যায়ে ৪র্থ খণ্ডের ১১১ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৫২৩ পৃষ্ঠায় কিতাবে হজ্ব -এর ফাযলুল মদীনা অধ্যায়ে এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ -এর কয়েকটি স্থানে এ সহীফা সম্পর্কে বলেছেন। যেমন মুসনাদের ১ম খণ্ডের একশ পৃষ্ঠায় তারেক ইবনে শিহাব হতে বর্ণনা করেছেন, হযরত আলীকে মিম্বারে বলতে দেখেছি : আল্লাহর শপথ,আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব ও এই সহীফা ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থ নেই যা তোমাদের জন্য পাঠ করি। গ্রন্থটি তখন তাঁর তরবারীর সাথে ঝুলছিল এবং তিনি রাসূল (সা.) হতে তা গ্রহণ করেছেন।

অন্য এক রেওয়ায়েতে সাফার আবদুল মালিক হতে বর্ণনা করেছেন, হযরত বাকির (আ.) হযরত আলীর গ্রন্থটি চাইলেন,ইমাম জাফর সাদিক (আ.) তা আনলেন। গ্রন্থটি প্যাঁচানো ও এর পুরুত্ব একজন মানুষের ঊরুর ন্যায় ছিল। তাতে লিখা ছিল স্ত্রীরা তাদের স্বামীর মালিকানাধীন গৃহের উত্তরাধিকারী হবে না। ইমাম আবু জাফর (আ.) বললেন : আল্লাহর শপথ,এটি হযরত আলীর হস্তলিপি ও রাসূল (সা.)-এর কথা। হযরত আলীর একদল অনুসারী এ বিষয়ে (শ্রুতিলিখনে) তাঁর অনুসরণ করেছেন ও ঐ সময়েই সংকলনের কাজে হাত দেন,যেমন সালমান ফারসী ও আবু যর গিফারী। ইবনে শাহরাশুব বলেছেন, ইসলামের সর্বপ্রথম গ্রন্থ লেখক আলী ইবনে আবি তালিব (আ.),দ্বিতীয় সালমান ফারসী,তৃতীয় আবু যর গিফারী এবং চতুর্থ হলেন রাসূল (সা.)-এর মুক্ত দাস আবু রাফে। আবু রাফে হযরত আলীর বায়তুল মালের দায়িত্বে ছিলেন ও তাঁর বিশেষ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তিনি হযরত আলী হতে হাদীস শ্রবণ করে বিচার ও বিধান সম্পর্কিত সুনান গ্রন্থ সংকলন করেন। গ্রন্থটি পূর্ববর্তী যুগের শিয়া ব্যক্তিত্বদের নিকট বিশেষ গুরুত্ব রাখত। আমাদের হাদীসশাস্ত্রবিদরা তাঁদের নিজ সূত্র অনুযায়ী ঐ গ্রন্থ হতে বর্ণনা করেছেন।

এরূপ অপর একজন ব্যক্তিত্ব হলেন আলী ইবনে আবি রাফে। আল ইসাবাহ্ গ্রন্থে তাঁর পরিচিতি পর্বে এসেছে তিনি নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় জন্মগ্রহণ করেন এবং নবী স্বয়ং তাঁর নাম রাখেন আলী। তিনি আহলে বাইতের মাজহাব অনুসারে ফিকাহ্শাস্ত্র সংকলন করেন। আহলে বাইতের ইমামগণ এই গ্রন্থটিকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন এবং তাঁদের অনুসারীদের এটি অধ্যয়ন ও অনুসরণের জন্য নির্দেশ দিতেন। মূসা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসান বলেন, এক ব্যক্তি আমার পিতাকে তাশাহ্হুদ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন : আবু রাফের পুত্রের বইটি নিয়ে আস। অতঃপর তিনি তা হতে আমাদের জন্য পাঠ করেন।

রাওযাতুল জান্নাত গ্রন্থের লেখক বলেছেন, এটি শিয়াদের মধ্যে সর্বপ্রথম ফিকাহর বই। কিন্তু এটি ভুল। প্রথম যুগের শিয়াদের অন্যতম হলেন আবদুল্লাহ্ ইবনে আবি রাফে। তিনি হযরত আলীর ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন এবং তিনি এ বর্ণনাটি করেছেন যে,রাসূলকে জাফর তাইয়ারের উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছেন, তুমি সৃষ্টি ও চরিত্রগতভাবে আমার অনুরূপ । অনেকেই তাঁর হতে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন,যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ -এ এটি এনেছেন। ইবনে হাজার তাঁর আল ইসাবাহ্ গ্রন্থের ১ম খণ্ডে তাঁর নাম আবদুল্লাহ্ ইবনে আসলাম বলেছেন কারণ তাঁর পিতার নাম ছিল আসলাম। উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আবি রাফে সিফ্ফিনের যুদ্ধে রাসূলের যে সকল সাহাবী অংশ গ্রহণ করেছেন তাঁদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইবনে হাজার তাঁর ইসাবাহ্ গ্রন্থে এই গ্রন্থ হতে প্রচুর বর্ণনা করেছেন।৫৪০  

তৎকালীন গ্রন্থ সংকলকদের অন্যতম হলেন রাবিয়া ইবনে সামিই। তিনি পশুর যাকাত সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ সংকলন করেন এবং এ গ্রন্থের হাদীসসমূহ হযরত আলীর সূত্রে রাসূল হতে বর্ণিত। আবদুল্লাহ্ ইবনে হুর ফারসীও হযরত আলীর সূত্রে রাসূল হতে বর্ণিত হাদীসের একটি সংকলন লিখেন।

হযরত আলীর বিশেষ ভক্ত ও অনুসারী আসবাগ ইবনে নুবাতাও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত। মালিক আশতারের প্রতি লিখিত হযরত আলীর পত্র এবং পুত্র মুহাম্মদ হানাফীয়ার প্রতি তাঁর ওসিয়তনামা তিনিই নকল করেছেন। আমাদের হাদীস বর্ণনাকারীরা এ পত্র দু টি তাঁর হতে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

সালিম ইবনে কাইস হিলালী হযরত আলীর অন্যতম সাহাবী। তিনিও হযরত আলী ও সালমান ফারসী হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি ইমামত সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম নোমানী তাঁর আল গাইবা গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেছেন, সকল শিয়া আলেম ও পণ্ডিত এবং হাদীস বর্ণনাকারী এ সত্য স্বীকার করেছেন যে,সালিম ইবনে কাইসের গ্রন্থটি পূর্বকাল হতেই আহলে বাইতের হাদীসসমূহের অন্যতম ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল এবং তাঁদের নিকট একটি মৌলিক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হত।

যে সকল ব্যক্তি তৎকালীন সময়ে গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন তাঁদের সম্পর্কে শিয়া হাদীস ও রিজালবিদদের অনেকেই গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ সম্পর্কে জানার জন্য তাঁদের রিজালগ্রন্থসমূহ (বিশেষত মরহুম হাজ্ব আগা বুজুর্গ তেহরানীর আয্যাররিয়াত গ্রন্থ) দেখতে পারেন।

৩। দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ তাবেয়ীদের মধ্যে সংকলকদের সংখ্যা এত অধিক যে,এ ক্ষুদ্র পত্রে তার উল্লেখ সম্ভব নয়। তাঁদের পরিচয় ও লেখনী সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের আলেম ও মনীষীদের লিখিত রিজাল ও হাদীসসূচীর গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করতে পারেন।৫৪১

এ যুগেই (তাবেয়ীদের যুগ) আহলে বাইতের জ্যোতি সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এর পূর্বে অত্যাচারীদের অনাচারের মেঘে তা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এ যুগের মূলে ছিল কারবালার শোকাবহ রক্তাক্ত ঘটনা যা আহলে বাইতের শত্রুদের মুখে অপমানের ছায়া ফেলে দিয়েছিল,সচেতন ব্যক্তিদের চোখে তাদের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরতে পেরেছিল,বিশেষজ্ঞদের আহলে বাইতের মাজলুমিয়াতের দিকে আকৃষ্ট করে যা রাসূল (সা.)-এর ওফাতের সাথে সাথে শুরু হয়েছিল। কারবালার মর্মান্তিকতা মানুষদের এ শোকাবহ ঘটনার মূল উদ্ঘাটনে উদ্বুদ্ধ করে এবং এর কারণ নির্ণয়ে তারা এ মুসিবতের উৎপত্তির বীজ খুঁজতে থাকে। যে সকল মুসলমানের ভেতর পৌরুষত্ব রয়েছে তাঁরা আহলে বাইতের মর্যাদা রক্ষায় দাঁড়িয়ে যান কারণ মানুষ সহজাতভাবেই মজলুমের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অত্যাচারীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে। বাস্তবে এ শোকাবহ ঘটনার পর মুসলমানরা জাগরিত হয়ে নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। তারা ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং উসূল ও ফুরুয়ে দীনের বিষয়াবলীতে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তাঁর শরণাপন্ন হয়। কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের সার্বিক বিষয়ে জ্ঞান অন্বেষণে তারা ইমাম সাজ্জাদ ও তাঁর পুত্র বাকির (আ.)-এর নিকট যাতায়াত শুরু করে। প্রথম পর্যায়ের শিয়াদের সকলেই এই দুই ইমামের শিষ্য যাঁদের সংখ্যা চার সহস্রাধিক। রিজাল গ্রন্থসমূহে তাঁদের নাম উল্লিখিত হয়েছে এবং তাঁদের লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা দশ হাজারের অধিক। হাদীসবিদগণ সহীহ সনদে এ গ্রন্থগুলোর লেখনীকে প্রজন্ম হতে প্রজন্মে স্থানান্তরিত করেছেন। এদের অনেকেই এই দুই ইমাম ছাড়াও ইমাম সাদিক (আ.) হতে তাঁদের জ্ঞানের পাত্র পূর্ণ করেছেন। তাঁদের একজন হলেন আবু সাঈদ আবান ইবনে তাগলিব ইবনে রিয়াহ্ জারিরী যিনি একাধারে ফকীহ্,মুফাসসির,মুহাদ্দিস এবং ইলমে উসূলের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত রাবীদের একজন যিনি তিন ইমামেরই সাহচর্য লাভ করেছেন ও তাঁদের তিনজন হতেই হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষা লাভ করেছেন। প্রসিদ্ধ রিজালশাস্ত্রবিদ মির্যা মুহাম্মদ তাঁর মানহাজুল মাকাল গ্রন্থে আবানের জীবনী আলোচনায় আবান ইবনে উসমানের সূত্রে ইমাম সাদিক হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি শুধু ইমাম সাদিক (আ.) হতেই ত্রিশ হাজার হাদীস নকল (বর্ণনা) করেছেন।৫৪২

এই তিন ইমামের নিকট তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল। ইমাম বাকির (আ.) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছেন,

اِجلسْ فيْ المسجد و أفت الناّسَ فإنيّ أحبّ أَنْ يُرى في شيعتي مثلك

মসজিদে আসন গ্রহণ কর ও জনগণের জন্য ফতোয়া দাও। আমি পছন্দ করি আমার শিয়াদের মধ্যে তোমার মত ব্যক্তি প্রকাশিত হোক।

ইমাম সাদিক (আ.) তাঁকে বলেছেন,

ناظِرْ أهلَ المدينة فإِنيّ أحبُّ أَنْ يكونَ مثلك من رُواتي و رجالي

মদীনার লোকদের সাথে বিতর্ক কর। আমি চাই তোমার মত ব্যক্তি রিজাল ও রাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক।

আবান যখন মদীনার মসজিদে প্রবেশ করতেন তখন সকলেই তাঁর দিকে লক্ষ্য করত এবং সেখানে অন্যান্য আলেমদের সভায় উপস্থিত হলে রাসূল (সা.)-এর জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ স্তম্ভের নিকট তাঁকে বসার জায়গা করে দিত।

ইমাম সাদিক (আ.) সালিম ইবন আবি হাব্বাহকে বলেন, আবান ইবনে তাগলিবের নিকট যাও। সে আমা হতে অসংখ্য হাদীস শ্রবণ করেছে এবং তার হতে যে হাদীসই শ্রবণ করবে বলতে পার তা আমি বলেছি।

তিনি (ইমাম সাদিক) আবান ইবনে উসমানকে বলেন, আবান ইবনে তাগলিব আমা হতে ত্রিশ হাজার হাদীস বর্ণনা করেছে,তুমি তার হতে তা শিক্ষা ও বর্ণনা কর।

আবান ইবনে তাগলিব যখনই ইমাম সাদিক (আ.)-এর নিকট আসতেন তখন তিনি তাঁর সাথে মুসাফাহ (হাত মিলাতেন) করতেন এবং কোলাকুলি করে তাঁর জন্য বসার গদি ও বালিশ আনতে বলতেন ও তাঁর মুখোমুখি বসতেন।

আবানের মৃত্যুর খবর যখন ইমাম সাদিক (আ.)-কে দেয়া হয় তখন তিনি বলেন,

أماَ و الله لَقَد أوجَعَ قلبِيْ موتُ أبان আবানের মৃত্যু আমার হৃদয়ে ব্যথার সৃষ্টি করেছে।

আবান ১৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আবান আনাস ইবনে মালিক,আ মাশ,মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদের,সাম্মাক ইবনে হারব্,ইবরাহীম নাখয়ী,ফুযাইল ইবনে আমর এবং হাকাম হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুসলিম এবং সুনানে আরবাআহর সংকলকগণ তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমরা ১৬ নম্বর পত্রে উল্লেখ করেছি।

বুখারী তাঁর হতে কোন হাদীস বর্ণনা না করায় তাঁর কোন ক্ষতি হয় নি,বরং তিনি আহলে বাইতের ইমামগণের অনুসরণের কারণে সম্মানিত। বুখারী এই মহান ব্যক্তিদের হতেও হাদীস বর্ণনা করেন নি,এমন কি বেহেশতের যুবকদের নেতা ও রাসূলের বড় দৌহিত্র ইমাম হাসান হতেও হাদীস বর্ণনা করেন নি কিন্তু মারওয়ান ইবনে হাকাম,ইমরান ইবনে হাত্তান,আকরামাহ্ বারবারী,আমর ইবনে আস ও এদের মত ব্যক্তিবর্গ হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আবানের মূল্যবান কিছু রচনা রয়েছে। তার মধ্যে গারিবুল কোরআন নামক তাফসীর গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য যাতে কোরআনের শব্দ চয়নের সপক্ষে আরবী কবিতাসমূহ থেকে উদাহরণ পেশ করা হয়েছে।

পরবর্তী পর্যায়ে আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ আযদী কুফী,আবান,মুহাম্মদ ইবনে সায়েব কালবী,ইবনে রওক,আতিয়া ইবনে হারিসের গ্রন্থসমূহকে সংকলন করে একটি গ্রন্থে রূপ দেন। অতঃপর তাঁদের পারস্পরিক পার্থক্যের বিষয়ে এ গ্রন্থে ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তাই আবানের গ্রন্থ পৃথকভাবে যেমন পাওয়া যায় ঠিক তেমনি অন্য গ্রন্থের সাথে সংকলন হিসেবেও পাওয়া যায়। শিয়া হাদীসবিদগণ এ দু ধরনের গ্রন্থই নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

আবান আল ফাজায়েল সিফ্ফিন নামক দু টি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। শিয়াদের প্রসিদ্ধ চারশ মূল গ্রন্থের একটি আবানের রচিত। এই গ্রন্থসমূহ শরীয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বিবেচিত। আবানের সকল গ্রন্থই তাঁর সূত্রে বর্ণিত বলে রিজালশাস্ত্রবিদগণ উল্লেখ করেছেন।

অপর একজন বিশ্বস্ত ও প্রসিদ্ধ রাবী হলেন সাবেত ইবনে দীনার (আবু হামযাহ্ সুমালী)। তিনিও ইমাম সাজ্জাদ,ইমাম বাকির ও ইমাম সাদিক (আ.) হতে জ্ঞান শিক্ষা করেছেন এবং তাঁদের নিকট বিশেষ মর্যাদা রাখতেন। ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, আবু হামযাহ্ বর্তমান সময়ের সালমান ফারসী। ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন, আবু হামযাহ্ তার সময়ের লোকমান হাকিম।

আবু হামযাহর রচিত তাফসীরে কোরআন রয়েছে যা হতে ইমাম তাবারসী তাঁর মাজমায়ুল বায়ান ৫৪৩ গ্রন্থে নকল করেছেন। তিনি‘‎ আন নাওয়াদির নামক একটি গ্রন্থ সংকলন ছাড়াও যুহুদ (দুনিয়া বিমুখতা) সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি রেসালাতুল হুকুক ৫৪৪ গ্রন্থটি ইমাম যয়নুল আবেদীন হতে বর্ণনা করেছেন। রমযান মাসে সাহরীর সময় পড়ার মহামূল্যবান ও গভীর অর্থবহ দোয়াটি তিনিই ইমাম যয়নুল আবেদীন হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আনাস ও শা বী হতে হাদীস নকল করেছেন। নির্বিশেষে সুন্নী ও শিয়া রাবীগণ তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ওয়াকী,আবু নাঈম ও এ পর্যায়ের রাবীদের অনেকেই তাঁর হতে হাদীস শুনেছেন ও নকল করেছেন। ১৬ নম্বর পত্রে এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছি।

যে সকল মহান জ্ঞানী ব্যক্তি ইমাম সাজ্জাদের নিকট শিক্ষা গ্রহণ না করলেও ইমাম বাকির ও ইমাম সাদিক হতে হাদীস ও ইসলামী দীক্ষা নিয়েছেন তন্মধ্যে আবুল কাসেম,বুরাইদ ইবনে মুয়াবিয়া আজলী,আবু বাসির আসসাগীর অর্থাৎ লাইস ইবনে মুরাদ বুখতুরী মুরাদী,আবুল হাসান,যুরারাহ্ ইবনে আ য়ুন,আবু জাফর মুহাম্মদ,মুসলিম ইবনে রিবাহ্,কুফী,তায়েফী,সাকাফী উল্লেখযোগ্য যাঁরা অন্ধকারে আলোর প্রদীপ হিসেবে বিরাজ করতেন। এ ছাড়াও অনেকে রয়েছেন যাঁদের নাম উল্লেখের সুযোগ এখানে নেই।

উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বুরাইদ ইবনে মুয়াবিয়া,আবু বাসির লাইস ইবনে মুরাদ,যুরারাহ্ এবং মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছেছিলেন। তাঁরা এমন এক পূর্ণ পাত্রের সন্ধান লাভ করেছিলেন ও নাগাল পেয়েছিলেন যে,ইমাম সাদিক (আ.) তাঁদের সম্পর্কে বলেছেন,

هؤلاء أمناء الله على حلاله و حرامه তারা হালাল ও হারামের ক্ষেত্রে আল্লাহর আমীন অর্থাৎ প্রহরী।

অন্যত্র ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন,

ما أجِدُ أحدا أحيا ذِكْرنا إِلّا زرارة و أبو بصير ليث و محمد بن مسلم و بريد

যুরারাহ্,আবু বাসির লাইস,মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম এবং বুরাইদ ব্যতীত অন্য কাউকে আমি পাই নি যাঁরা আমাদের স্মরণকে জীবন্ত করেছেন।

অতঃপর তিনি বলেছেন,

هؤلاء خُفاّظُ الدّين، و أمناء أَبي , على حلال الله وحرامه و هم السّابقون إِلينا في الدّنيا السّابقونَ إلينا في الآخرة

তাঁরা দীনের সংরক্ষক,আল্লাহর হালাল ও হারামের ক্ষেত্রে আমার পিতার বিশ্বস্ত প্রহরী। তাঁরা দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের প্রতি সর্বাধিক অগ্রসরমান।

অন্যত্র ইমাম সাদিক (আ.) বিনয়ীদের প্রতি বেহেশতের সুসংবাদ দাও - এ কথা বলার পর এই চার ব্যক্তির নাম স্মরণ করে যে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন সেখানে বলেন, আমার পিতা আল্লাহর হারাম ও হালালের বিষয়ে তাঁদের বিশ্বস্ত মনে করতেন। তাঁরা তাঁর জ্ঞানের পাত্র ছিলেন যেমনি এখনও তাঁরা আমার রহস্যের ভাণ্ডার। তাঁরা আমার পিতার ন্যায়পরায়ণ সাহাবী এবং আমাদের শিয়াদের মধ্যে জীবন ও মৃত্যুতে (অর্থাৎ সর্বাবস্থায়) উজ্জ্বল তারকার ন্যায় সমুজ্জ্বল। তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ্ সকল বিদআতের মূলোৎপাটন ও ধ্বংস সাধন করেছেন। তাঁরা বাতিলপন্থীদের অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করেছেন ও ইমামদের সম্পর্কে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়িকারীদের অন্যায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে বিলুপ্তকারী।

এই মহান ব্যক্তিবর্গের সম্মান,মর্যাদা ও আনুগত্যের বিষয়ে ইমাম সাদিক (আ.) হতে এত অধিক হাদীস এসেছে যে,এ পত্রের কলেবরে তার বর্ণনা সম্ভব নয়। উন্নত চরিত্র সত্ত্বেও এ ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে বিভিন্ন লেখক যে মিথ্যাচার করেছেন তার জবাব আমরা মুখতাছারুল কালাম ফি মুয়াল্লিফিশ শিয়া ফি সাদরিল ইসলাম গ্রন্থে দিয়েছি। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচারিত এই মিথ্যাচার আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও মুমিনদের নিকট তাঁদের মর্যাদার কোন হানি ঘটায় নি যেমনটি নবীগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীরাও হিংসার মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদার বৃদ্ধি বৈ হ্রাসে সক্ষম হয় নি,বরং তাদের (বিদ্বেষ পোষণকারীদের) এ কর্ম তাঁদের মত ও পথের প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করেছে এবং জ্ঞানী ও সত্যপ্রত্যাশীদের অন্তরে তাঁদের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়কালে জ্ঞানের সর্বোচ্চ প্রসার ঘটে। শিয়াগণ তাঁর পিতার প্রতি যেমন আকৃষ্ট হয়ে ছুটে যেতেন তেমনি তাঁর প্রতিও আগ্রহ ও আশা নিয়ে এগিয়ে আসেন। তিনিও তাঁদের সানন্দে গ্রহণ করতেন এবং তাঁদের অজ্ঞতা দূরীকরণে সকল রকম প্রচেষ্টা চালাতেন। তিনি এ সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের নিকট জ্ঞানের রহস্য উন্মোচনে লিপ্ত হন।

আবুল ফাতহ শাহরেস্তানী তাঁর মিলাল ওয়ান নিহাল গ্রন্থে ইমাম সাদিকের৫৪৫ এ অবদানকে স্বীকার করে বলেছেন, তিনি (ইমাম সাদিক) ধর্মীয় জ্ঞানে পণ্ডিত,প্রজ্ঞায় সংস্কৃতিবান ও পূর্ণ,দুনিয়া বিমুখতায় আদর্শ ও প্রবৃত্তির মোকাবিলায় তাকওয়ার পূর্ণ নমুনা ছিলেন। অতঃপর বলেছেন, তিনি বেশ কিছুদিন মদীনায় তাঁর অনুসারী শিয়াদের জ্ঞান শিক্ষা দিতেন এবং তাঁর বন্ধুদের জ্ঞানের রহস্যের বৃষ্টিধারায় স্নাত করতেন। অতঃপর ইরাকে গমন করেন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। তিনি শাসকগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে কখনো হস্তক্ষেপ করেন নি এবং খেলাফতের বিষয়েও বির্তকে লিপ্ত হন নি (কারণ সে সময় পরিবেশ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরই উপযোগী ছিল,অন্য রকম ভূমিকা নেয়ার পরিবেশ ছিল না)।

অতঃপর ইমাম সাদিক (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানের সমুদ্রে অবগাহন করে সে একটি মেঘের প্রতি লোভ পোষণ করে না। যে সত্যের চূড়ায় অবস্থান করছে সে বাহ্যিক পদমর্যাদা লাভ না করাকে অপমান মনে করে না (পতনের ভয় করে না)।

و الحقّ ينطق منصفا و عنيداً

সত্য,ন্যায়পরায়ণ ও অহংকারী উভয় ব্যক্তিকেই কথা বলতে বাধ্য করে।

ইমাম সাদিকের অনেক সাহাবীই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এমন স্থানে পৌঁছেছিলেন যে,নিজেরাই হেদায়েতের পথ-প্রদর্শক,অন্ধকারের প্রদীপ,জ্ঞানের সমুদ্র ও উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ইরাক,হেজাজ,পারস্য,সিরিয়া ও ইয়েমেনের এরূপ চার হাজার ব্যক্তির বর্ণনা রিজাল গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় যাঁরা গ্রন্থ রচনা ও সংকলন করেছেন এবং এ গ্রন্থসমূহ শিয়াদের নিকট প্রসিদ্ধ। উসূলে আরবাআতু মিয়াহ্ বা চারশ মূল গ্রন্থ এই সকল ব্যক্তির লেখা হতেই সংকলিত যাঁরা ইমাম সাদিকের শিষ্য ছিলেন। এই গ্রন্থসমূহে তাঁর ফতোয়াসমূহ লিপিবদ্ধ হয়েছে যা পরবর্তী প্রজন্মের জ্ঞান ও কর্মের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ইমাম সাদিকের পর শিয়া মাজহাবের আলেমরা এবং ইমামগণের প্রতিনিধিরা সকলের বোঝার জন্য সহজ ও সংক্ষিপ্ত বিশেষ কিছু গ্রন্থ সংকলিত করেছেন। তন্মধ্যে প্রথম চারটি গ্রন্থ (কুতুবে আরবাআহ্) সে সময় হতে এখন পর্যন্ত উসূল ও ফুরুয়ে দীনের ক্ষেত্রে বার ইমামীদের নিকট শ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত। এই প্রসিদ্ধ চারটি গ্রন্থ হলো মরহুম সিকাতুল ইসলাম কুলাইনীর কাফী ,শেখ তুসীর তাহযীব ইসতিবসার এবং মরহুম সাদুকের মান লা ইয়াহ্দ্বারুহুল ফাকীহ্ । এ গ্রন্থ চারটি মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত এবং তাঁদের হতেই যে বর্ণিত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই চারটির মধ্যে কাফী সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য,সর্বোত্তম ও পুরাতন। এতে ১৬১৯৯টি হাদীস রয়েছে। এতে আহলে সুন্নাহর সিহাহ সিত্তাহর গ্রন্থসমূহ হতে অধিক সংখ্যক হাদীস রয়েছে। ইমাম সাদিক (আ.) এবং ইমাম কাযেম (আ.)-এর শিষ্যদের মধ্যে হিশাম ইবনে হাকামও অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন তন্মধ্যে উনত্রিশটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং আমাদের হাদীসবিদগণ তাঁর সনদে এ উনত্রিশটি গ্রন্থ নকল করেছেন। মুখতাছারুল কালাম ফি মুয়াল্লিফিশ্ শিয়া মিন সাদরিল ইসলাম গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে।

হিশাম ইবনে হাকামের গ্রন্থগুলো বিশেষ গুণে গুণান্বিত এবং বর্ণনা ও যুক্তি উপস্থাপনে অনন্য ও উজ্জ্বলতায় ভাস্বর। এই গ্রন্থগুলোতে উসূল ও ফুরুয়ে দীন,তাওহীদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন,নাস্তিক ও যিন্দীকদের যুক্তির বিপক্ষে আলোচনা,প্রকৃতি পূজারীদের অসারতা,কাযা ও ক্বদরের ক্ষেত্রে জাবরী মতবাদের সমালোচনা,খারেজী ও নাসেবীদের (হযরত আলীর প্রতি বিদ্বেষী) বিপক্ষে যুক্তি,হযরত আলী ও আহলে বাইতের ইমামদের ওসিয়তের পক্ষে দলিল,শ্রেয় নয় এমন কাউকে শ্রেয় স্থানে অধিষ্ঠিত করাকে যারা বৈধ মনে করে তাদের জবাব,আলী ও আহলে বাইতের ইমামদের বিষয়ে বাড়াবাড়ি এবং অতিরঞ্জনকারীদের প্রতি উত্তর প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে।

হিশাম কালামশাস্ত্র,ঐশী প্রজ্ঞা ও ইসলামী জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় দ্বিতীয় শতাব্দীর পুরোধা ছিলেন। তিনি ইমামতের বাস্তবতা প্রস্ফুটিত করে তুলে ধরেন ও দীনের বিষয়গুলোকে গভীর চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে পরিশোধিত করেন।

 তিনি ইমাম সাদিক ও ইমাম কাযেম (আ.) হতে অসংখ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাঁদের নিকট বিরল সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁরা তাঁকে এতটা প্রশংসা করেছেন যে,তাঁর আসন সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

তিনি প্রথমে বিচ্যুত একটি সম্প্রদায় জাহমীয়া র অনুসারী ছিলেন। পরে ইমাম সাদিক (আ.) তাঁকে হেদায়েতের নিদের্শনা দেন এবং তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। ইমাম সাদিক (আ.)-এর শাহাদাতের পর তিনি ইমাম কাযেম (আ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর শিষ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করেন।

দুঃখজনক যে,আল্লাহর প্রদীপ নির্বাপণের প্রচেষ্টাকারীরা তাঁকে মুজাসসিমাহ্ সম্প্রদায়ের (যারা কিয়ামতে আল্লাহর দৈহিক উপস্থিতিতে বিশ্বাসী) অন্তর্ভুক্ত বলেছে ও তাঁর প্রতি অন্যায় দোষারোপ করেছে। যারা আল্লাহর দীনের নূরকে প্রদীপের ফানুসের অভ্যন্তরেই নির্বাপিত করার পরিকল্পনা করেছিল তারাই তাঁর প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপের মাধ্যমে আহলে বাইতের প্রতি তাদের বিদ্বেষকে প্রকাশ করেছে। অথচ তাঁর মাজহাব সম্পর্কে আমরা সবচেয়ে বেশী অবগত এজন্য যে,তাঁর লেখনী ও বক্তব্য আমাদের নিকট সংরক্ষিত রয়েছে যেখানে তিনি আমাদের মাজহাব সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। সুতরাং আমাদের মাজহাবের অগ্রবর্তী হিসেবে তাঁর বক্তব্য ও লেখনীর এমন কিছু নেই যা আমাদের নিকট অপ্রকাশিত আর অন্যদের নিকট প্রকাশিত থাকবে। কারণ তারা তাঁর মাজহাব হতে দূরে ছিল আর আমরা নিকটবর্তী।

এগুলো বাদ দিলেও শাহরেস্তানীর মিলাল ওয়ান নিহাল গ্রন্থে হিশাম সম্পর্কিত আলোচনায় হিশাম যে মুজাসসিমাহ্ ছিলেন না তা প্রমাণিত হয়েছে। এখানে আমরা শাহরেস্তানী যে ঘটনা হতে হিশাম মুজাসসিমাহ্ ছিলেন বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন তা হুবহু বর্ণনা করছি। তিনি বলেন, হিশাম ইবনে হাকাম মাজহাবের মৌলনীতিতে গভীর চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। মু তাযিলাদের বিরুদ্ধে তিনি যে অভিযোগ আরোপ করতেন তা হতেই তাঁর আকীদা বোঝা যায়। কারণ ব্যক্তির আকীদা ও মত তার বিরোধীদের সে যে বিষয়ে অভিযুক্ত করে তা হতেই বোঝা যায়,যা সে প্রকাশ করে তা হতে নয়। যেমন আলাফের সাথে বিতর্কে হিশাম তাঁকে অভিযুক্ত করেন : তুমি বিশ্বাস কর বিশ্বজগতের স্রষ্টা জ্ঞানী তাঁর জ্ঞানের কারণে তবে তাঁর জ্ঞান তাঁর সত্তাগত। সুতরাং তুমি মনে কর তিনি জ্ঞানী কিন্তু অন্যান্য জ্ঞানীদের মত নন। তবে কেন বল না তাঁর দেহ রয়েছে তবে অন্যদের মত নয়।

এ বর্ণনা হতে শাহরেস্তানী বলতে চান হিশাম মুজাসসিমাহ্ বা আল্লাহর দৈহিক অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। তবে হিশাম আলাফের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবার কারণেই বলতে পারি না যেহেতু তিনি এ বিষয়ে তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন সেহেতু তিনি এরূপ মতবাদে বিশ্বাসী। কারণ হয়তো হিশাম এ পদ্ধতিতে আলাফকে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন যে,তিনি কতটা গভীর চিন্তা করেন। স্বয়ং শাহরেস্তানী স্বীকার করেছেন ব্যক্তির আকীদা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে সে যে অভিযোগে অভিযুক্ত করে তা হতেই বোঝা যায়,সে যা প্রকাশ করে তা হতে নয়।

তদুপরি যদিও এ বর্ণনা তাঁর দৃষ্টিতে হিশামের মুজাসসিমাহ্ হওয়াকেই প্রমাণ করে তবুও বলা যায় এটি তাঁর শিয়া হবার পূর্বের ঘটনা। কারণ আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি তিনি শিয়া হবার পূর্বে জাহমিয়া ফিরকায় বিশ্বাসী ছিলেন ও আহলে বাইতের ইমামদের মাধ্যমে হেদায়েতপ্রাপ্ত হন ও তাঁদের বিশেষ শিষ্যে পরিণত হন। এতদ্সত্ত্বেও আমাদের পূর্ববর্তীরা শত্রুগণ কর্র্তৃক তাঁর ওপর আরোপিত এরূপ অভিযোগের কোন ভিত্তি ও নমুনা খুঁজে পান নি। তেমনিভাবে যুরাবাহ্ ইবনে আ য়ুন,মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম,মুমিন তাঁকে ও তাঁদের মত ব্যক্তিবর্গের ওপর আরোপিত অভিযোগেরও কোন প্রমাণ পান নি। আমরাও এ বিষয়ে অনুসন্ধান ও প্রচেষ্টা চালিয়ে দেখেছি এগুলো তাঁদের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষপ্রসূত আরোপিত অসত্য বৈ কিছু নয়,যা অন্যায়।

و لا تحسبنّ الله غافلاً عمّا يعمل الظّالمون

কখনোই মনে কর না অন্যায়কারীরা যা করছে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ অসচেতন (অজ্ঞ)।

শাহরেস্তানী হিশাম সম্পর্কে আরো বলেছেন যে,তিনি আলীকে খোদা বলে বিশ্বাস করতেন। তাঁর এ কথায় শোকাক্রান্ত মহিলারাও হেসে উঠবে কারণ তিনি কখনোই এরূপ অবাস্তব বিষয়ে বিশ্বাস পোষণ করতেন না যখন তিনি নিজেই তাওহীদের আলোচনায় কোন কিছুর খোদার অবতার হবার বিরোধী মত পোষণ করেন ও আল্লাহকে এ থেকে পবিত্র মনে করেন। তাঁর বিরোধীরা বিদ্বেষ অথবা অজ্ঞতাবশত তাঁর প্রতি যে দোষারোপ করে তিনি তার ঊর্ধ্বে অবস্থান করছেন। 

তাঁর ইমামত ও ওসিয়ত সম্পর্কিত আলোচনায় তিনি আলী (আ.)-এর ওপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি বর্ণনা করে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আলী রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উম্মতের অন্যতম ও তাঁর অনুসারী,তিনি নবীর খলীফা ও ওয়াসি এবং আল্লাহর এমন এক বান্দা যাঁর প্রতি অন্যায় ও অবিচার করা হয়েছে। তিনি তাঁর অধিকার আদায়ে অক্ষম হয়ে শত্রুর নিকট বাহ্যত আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। তিনি ঐ সকল ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাঁরা সহযোগী ও বন্ধুর অভাবে ভয় ও আশঙ্কায় ছিলেন।

কিরূপে সম্ভব একদিকে শাহরেস্তানী বলছেন হিশাম মাজহাবের মৌলনীতিতে গভীর চিন্তা করতেন এবং মু তাযিলাদের বিপরীতে তাঁর উপস্থাপিত অভিযোগকে আমাদের ভুললে চলবে না কারণ তিনি আলাফের বিপক্ষে যে অভিযোগ আরোপ করেছেন তা হতেই আমরা তাঁর আকীদা সম্পর্কে জানতে পারব। তিনি আলাফকে বলেন, কেউ খোদার দৈহিক অস্তিত্বের বিষয়ে এ কথা বল না যে,তাঁর দেহ রয়েছে তবে অন্যদের মত নয়।

অন্যদিকে তাঁর সম্পর্কে বলছেন তিনি আলীকে স্বয়ং খোদা বলে বিশ্বাস করতেন। এ দুই বক্তব্য পরস্পর বিপরীত নয় কি? হিশামের মত সম্মানিত ব্যক্তিকে এরূপ অজ্ঞতাপূর্ণ মন্তব্যের অভিযোগে অভিযুক্ত করা কুপমণ্ডুকতা নয় কি? অথচ তাই করা হয়েছে। কারণ গুজব রটানো ব্যতীত তাঁদের কোন কিছু করার নেই। আহলে বাইত ও তাঁদের মাজহাবে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের প্রতি তাঁরা বিদ্বেষবশত এমনই করে থাকেন। ওয়া লা হাউলা ওয়া লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম।

ইমাম মূসা কাযেম,ইমাম রেযা,ইমাম জাওয়াদ,ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারীর সময়কালে অসংখ্য গ্রন্থ সংকলিত ও রচিত হয়েছে। তাঁদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ সরাসরি অথবা তাঁদের শিষ্যদের মাধ্যমে মুসলিম রাজ্যের বিভিন্ন শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। শিষ্যরা দীনের জ্ঞান প্রচারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় লিপ্ত ও গবেষণার কাজে ব্যাপৃত হন। তাঁরা দীনের সমুদ্রে মুক্তা আহরণে এর গভীরে প্রবেশ করেন এবং খাঁটি নির্যাস হস্তগত করে সত্যকে অসত্য হতে পৃথক করা শুরু করেন এবং গ্রন্থ রচনা ও সংকলনে সকল কলাকৌশল প্রয়োগ করে বিচ্ছিন্ন আলোচনাসমূহকে সুশৃঙ্খল আকারে রূপ দেয়ার কাজে লিপ্ত হন।

মুহাক্কেক (আল্লাহ্ তাঁর সম্মানকে সমুন্নত করুন) নির্ভরযোগ্য একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ইমাম জাওয়াদের ছাত্রদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা কম নয়। যেমন হুসাইন ইবনে সাঈদ ও তাঁর ভ্রাতা হাসান,আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি নাসর বাযানতী,আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বারকী,শাযান,আবুল ফযল আল আমা,আইয়ুব ইবনে নূহ,আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ঈসাসহ অনেকেই।

তিনি আরো বলেছেন যে,তাঁদের যে সকল গ্রন্থ আমাদের মাঝে বিদ্যমান সেগুলো তাঁদের জ্ঞানের গভীরতার প্রমাণ দেয়।

আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি বারকীর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। বাযানতীর একটি বৃহৎ গ্রন্থ রয়েছে যা জামে বাযানতী নামে প্রসিদ্ধ। হুসাইন ইবনে সাঈদের গ্রন্থ সংখ্যা ৩০টি।

ইমাম সাদিকের এই সন্তানের শিষ্যদের লেখা গ্রন্থের সংখ্যা অসংখ্য। তাই রাবীদের পরিচিতিমূলক গ্রন্থ এবং ফেহ্রেসত (সূচীপত্র) গ্রন্থসমূহে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের জীবনী অধ্যয়ন করুন : মুহাম্মদ ইবনে সিনান,আলী ইবনে মাহযিয়ার,হাসান ইবনে মাহবুব,হাসান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাম্মাআহ্,সাফওয়ান ইবনে ইয়াহিয়া,আলী ইবনে ইয়াকতীন,আলী ইবনে ফাযযাল,আবদুর রহমান ইবনে নাজরান,ফযল ইবনে শাযান (দুইশ গ্রন্থের রচিয়তা),মুহাম্মদ ইবনে মাসউদ আইয়াশী (দুই শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা),মুহাম্মদ ইবনে উমাইর,আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ঈসা (ইমাম সাদিকের একশ সাহাবী হতে হাদীস বর্ণনাকারী),মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মাহবুব,তালহা ইবনে তালহা ইবনে যাইদ,আম্মার ইবনে মূসা সাবাতী,আলী ইবনে নোমান,হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ্,আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে মেহরাওয়ান (ইবনে খানাহ্ নামে প্রসিদ্ধ),সাদাকাহ্ ইবনে মুনযির কুমী এবং উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আলী হালাবী। তন্মধ্যে হালাবী তাঁর সংকলিত গ্রন্থ ইমাম সাদিকের কাছে দেন এবং ইমাম তা সংশোধিত করে প্রশংসা করে বলেন, আহলে সুন্নাহর মধ্যে এরূপ গ্রন্থ দেখেছ কি? আবু উমর,তাবিব এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে সাঈদ তাঁদের গ্রন্থসমূহ ইমাম রেযার নিকট পেশ করেন। ইউনুস ইবনে আবদুর রহমানও তাঁর গ্রন্থ ইমাম আসকারীর নিকট পেশ করেন।

যদি কেউ শিয়া মাজহাবের পূর্ববর্তী বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের জীবনী অধ্যয়ন করেন বিশেষত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বংশধারার নয়জন ইমামের শিষ্যদের রচিত ও সংকলিত গ্রন্থ হতে যে সকল বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন (যাঁরা প্রকৃতপক্ষে উসূল ও ফুরুয়ে দীনের ক্ষেত্রে রাসূলের বংশের ইমামদের হাদীসের সংরক্ষক ছিলেন) ও বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁদের মাধ্যমে এ গ্রন্থসমূহ স্থানান্তরিত হয়েছে তাঁদের চরিত্র বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেন তাহলে তিনি নিশ্চিত হবেন আহলে বাইতের ইমামদের প্রতিষ্ঠিত মাজহাব মুতাওয়াতির সূত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করবেন উসূল ও ফুরুয়ে দীনের ক্ষেত্রে আমরা যে মাজহাবে বিশ্বাসী তা নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধরদের হতেই গৃহীত হয়েছে। একগুঁয়ে,উদ্ধত ও মূর্খ ব্যক্তি ছাড়া কেউ তা অস্বীকার করবে না।

الحمدُ للهِ الذي هدانا لِهذا و ما كناّ لِنهتدي لولا أَنْ هدانا الله

আল্লাহর প্রশংসা এজন্য যে,আমাদের এদিকে হেদায়েত করেছেন। যদি তিনি আমাদের হেদায়েত না করতেন তাহলে আমরা হেদায়েত পেতাম না।

ওয়াসসালাম