ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব15%

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 20 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16063 / ডাউনলোড: 4445
সাইজ সাইজ সাইজ
ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ

শাসন-কর্তৃত্ব

জিজ্ঞাসা ও জবাব

মূলঃ আলী শীরাযী

অনুবাদঃ নূর হোসেন মজিদী

অনুবাদকের কথা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে আমাদের সমাজে বেলায়াতে ফকীহ্ বা মুজতাহিদের শাসন-কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে এ বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তির ব্যাপারে বিশেষ জিজ্ঞাসা ও ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। এ সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার জবাবে জানা যায় যে,বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্বের আক্বিদাহ্ পোষণের কারণেই কোনোরূপ দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়াই ইরানে এ বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে যখন জানা যায় যে,হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) ইরাকের নাজাফে নির্বাসিত জীবন যাপন কালে বেলায়াতে ফকীহ্ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন,তখন এ ধারণা অধিকতর শক্তিশালী হয়।

এ তথ্যের সাথে দু টি ধারণা প্রসূত ব্যাখ্যা যুক্ত হয়ে যায়। একটি ধারণা এই যে,হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বের উদ্গাতা; যদিও তিনি ইসলামী সূত্র থেকে উপাদান নিয়ে এ তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন,তবে তার আগে বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্বের বিষয়টির প্রতি কারোই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় নি। এ ধারণা গড়ে ওঠার পিছনে একটি বড় কারণ এই যে,ইমাম খোমেনীর আগে কেউই গায়রে ফকিহের শাসনকে অবৈধ গণ্য করে তার অবসান ঘটানো ও তদস্থলে ফকিহের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেন নি এবং সে লক্ষ্যে বিপ্লব ঘটাবার উদ্যোগ নেন নি। দ্বিতীয়তঃ ধারণা করা হয় যে,বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব শিয়া মাযহাবের সাথে সামঞ্জস্যশীল; আহলে সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। বলা হয় যে,শিয়া মাযহাবের ইমামতের আক্বিদাহর কারণে শিয়াদের মধ্যে দল-উর্ধ ধর্মীয় নেতার প্রতি যে আনুগত্য গড়ে উঠেছে আহলে সুন্নাতের মধ্যে তা সম্ভব নয়।

বলা বাহুল্য যে,দুটো ধারণাই প্রকৃত অবস্থা থেকে বেশ দূরে। বেলায়াতে ফকীহ্ হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) কর্তৃক উদ্ভাবিত কোনো তত্ত্ব নয়,যদিও তিনি এ ধারণাকে অনেক শানিত করেছেন। বেলায়াতে ফকীহ্ বা মুজতাহিদের শাসনের বিষয়টি ইসলামে সব সময়ই ছিলো। বিশেষ করে সকল যুগেই শিয়া মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে অতীতে এর রাজনৈতিক দিকটি কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো; বাস্তবে রূপায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় নি; তেমনি তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতিও তৈরী হয় নি। (স্মর্তব্য,বেলায়াতে ফকীহ্ কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয় নয়,বরং সর্বাত্মক দ্বীনী নেতৃত্বের বিষয়।) হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) উপযুক্ত প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেলায়াতে ফকীহর ধারণাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয়তঃ বেলায়াতে ফকীহ্ শিয়া মাযহাবের কোনো একান্ত বিষয় নয়,বরং এটা শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে গোটা মুসলিম উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। প্রকৃত পক্ষে শিয়াদের পূর্বেই সুন্নীদের জন্য বেলায়াতে ফকীহ্ তথা উপযুক্ততম দ্বীনি নেতা ও শাসকের অপরিহার্যতা দেখা দেয়। কারণ,শিয়া মাযহাবের ইমামতের আক্বিদাহর দাবী অনুযায়ী সর্বশেষ ইমামের জনসমাজের আড়ালে চলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইমাম ব্যতীত কোনো উপযুক্ততম দ্বীনী নেতা ও শাসকের অপরিহার্যতা দেখা দেয় নি। কিন্তু আহলে সুন্নাতের মাঝে ইমামতের আক্বিদাহ্ না থাকার অনিবার্য দাবী হচ্ছে,হযরত রাসূলে আকরামের (সা.) ইন্তেকালের পর পরই মুসলিম উম্মাহর জন্য উপযুক্ততম দ্বীনি নেতা ও শাসকের অপরিহার্যতা দেখা দেয়। কারণ,তাত্ত্বিকভাবে উপযুক্ততম দ্বীনী নেতা ও শাসক ব্যতীত কেউই আল্লাহর রাসূলের (সা.) স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন না। এখানে কেউ কেউ হয়তো ছাহাবীগণ,তাবে ঈন ও তাবে তাবে ঈন-কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত গণ্য করার কথা বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাত্ত্বিকভাবে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত গণ্য করা যেতে পারে না। কারণ,তারা ছিলেন একটি সীমিত সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ,যদিও তাদের মধ্যকার উপযুক্ততম ব্যক্তিগণকে উপযুক্ততম দ্বীনি নেতা ও শাসক হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে গণ্য করতে বাধা নেই। (অবশ্য ব্যক্তি হিসেবে উপযুক্ততম ব্যক্তি কে তা এক স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়।)

আল- উলামাউ ওয়ারাছাতুল্ আম্বিয়া (আলেমগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী) - এ হাদীছটি শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের সূত্রে বর্ণিত এমন একটি হাদীছ যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কখনোই বিতর্ক সৃষ্টি হয় নি এবং বিচারবুদ্ধিও এর প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে। মূলতঃ বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্বের তত্ত্ব এ হাদীছেই নিহিত। পরবর্তীকালে আহলে সুন্নাতের মনীষীগণ শাসকের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আহলুল হাল্লি ওয়াল্ আক্বদ্ তথা দ্বীনি বিষয়ে মতামত দানের যোগ্যতা সম্পন্ন লোকগণ কর্তৃক শাসক নির্বাচনের কথা বলেছেন যা বর্তমান ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রায় সমার্থক। তবে উক্ত হাদীছ ও বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী যদিও আহলে সুন্নাতের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের দূরদর্শী ও সুপরিচালক আলেমে দ্বীনই হবেন মুসলমানদের শাসক এবং তার পরিবর্তে গায়রে আলেমের শাসন-কর্তৃত্বের বৈধতা নেই - এ মর্মে আক্বিদাহ্ গড়ে ওঠা প্রয়োজন ছিলো,কিন্তু কার্যতঃ বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ না করার কারণে এ আক্বিদাহ্ গড়ে ওঠে নি। বিলম্বে হলেও,ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পরে অন্ততঃ এ দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়াই এটিকে ইমাম খোমেইনীর (রহ্ঃ) উদ্ভাবন ও শিয়া মাযহাবের সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে অভিহিত করে একে পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে।

যা-ই হোক,এখনো এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। এ ব্যাপারে বক্ষ্যমাণ অনুবাদগ্রন্থটি উৎসাহ সৃষ্টির কারণ হবে বলে আশা করা যায়। প্রশ্নোত্তর আকারে লিখিত অত্র সংক্ষিপ্ত গ্রন্থের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে,এতে বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন প্রশ্নে উদ্ভূত সর্বশেষ সংশয়মূলক প্রশ্নাবলীর জবাব দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য যে,ইসলামী হুকুমাতের বিরোধী শক্তির বিভ্রান্তিকর প্রচারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবেই এসব প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব থেকে বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের নিকট বেলায়াতে ফকীহ্ সংক্রান্ত ধারণা অনেকখানি সুস্পষ্ট হবে বলে আশা করি। সেই সাথে আরো আশা করি যে,এ থেকে বাংলাভাষী ইসলামী মহল সমূহ,বিশেষ করে ওলামায়ে কেরাম বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হবেন এবং সমাজের জন্য ফকীহ্ ও ফকীহ্ শাসকের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে উচ্চতর দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ইজতিহাদী শিক্ষাও যোগ করবেন(এ ক্ষেত্রে তারা শিয়াদের অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হতে পারেন)। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অবান্তর হবে না যে,আমাদের সমাজে দ্বীনী মহল সমূহের মধ্যকার অন্তর্বিরোধ,বিশেষতঃ গৌণ বিষয়াদি কেন্দ্রিক অন্তর্বিরোধের জন্য ইজতিহাদী শিক্ষা ও মুজতাহিদের উপস্থিতি না থাকাই প্রধান কারণ।

অনুবাদ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে,পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে বাংলাভাষী পাঠকদের জন্যে কয়েকটি বিষয়ের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা ও কিছু মনীষী সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা প্রদান জরুরী গণ্য করেছি এবং তা অন্ত্যটীকা আকারে সংযোজন করেছি। আশা করি টীকাগুলো পাঠক-পাঠিকাদেরদেরকে উপকৃত করবে।

অত্র গ্রন্থের অনুবাদ বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদেরকে আলোচ্য বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দিতে এবং এ বিষয়ে চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হলেই অনুবাদকের শ্রম সার্থক হবে। আল্লাহ্ তা আলা অত্র গ্রন্থের রচনা,অনুবাদ,প্রকাশ,প্রচার,অধ্যয়ন ও আলোচনা-পর্যালোচনাকে তার দ্বীনের খেদমত হিসেবে কবুল করুন। আমীন।

বিনীত

নূর হোসেন মজিদী

ঢাকা

১৬ই সফর ১৪৩০

১লা ফাল্গুন ১৪১৫

১৩ই ফেব্র য়ারী ২০০৯।

ভূমিকা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

বেলায়াতে ফাক্বীহ্ (ولايت فقيه -ফকীহ্ বা ফকীহর বেলায়াত্) পরিভাষায় বেলায়াত্ শব্দের অর্থ হচ্ছে কর্তৃত্ব বা অভিভাবকত্ব । এ কর্তৃত্ব হচ্ছে শরয়ী আইন-কানুন ও বিধি-বিধানগত কর্তৃত্ব (ولايت تشريعی )। অর্থাৎ খোদায়ী আইন-কানুন ও বিধিবিধানের সীমারেখার মধ্যে শাসনকর্তৃত্ব।

অন্যদিকে বেলায়াতে ফকীহ্ বিষয়ক আলোচনায় ফাক্বীহ্ (فقيه )পরিভাষার মানে হচ্ছে সকল শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ। এ ধরনের মুজতাহিদ তিনটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন। তা হচ্ছে: তাকে পরিপূর্ণভাবে ইজতিহাদী দক্ষতার অধিকারী হতে হবে,চিন্তা ও আচরণের ক্ষেত্রে তাকে নিরঙ্কুশ ন্যায়ানুগতা তথা ভারসাম্যের অধিকারী হতে হবে এবং তার মধ্যে পরিচালনা ও নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকতে হবে। এ দৃষ্টিতে সকল মুজতাহিদই ফকিহ নন,বরং শুধুমাত্র উপরি উক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মুজতাহিদই ফকিহ বলে গণ্য।

বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্বের মানে হচ্ছে ইসলামী সমাজের শাসন ও পরিচালনায় তার কর্তৃত্ব,যার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে দ্বীনী হুকুম-আহ্কাম কার্যকর করণ ও দ্বীনী মূল্যবোধ সমূহের বাস্তবায়ন এবং সমাজের সদস্যদের প্রতিভা ও সম্ভাবনা সমূহকে বিকশিত করণ,আর তাদেরকে তাদের প্রতিভা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী পূর্ণতা ও সমুন্নতিতে পৌঁছে দেয়া।

ঠিক এ কারণেই ইসলামের দুশমনরা ফকীহর নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কোমর বেঁধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বেলায়াতে ফকীহ্ তথা ফকিহ নেতা ও শাসকের বিরোধিতা এবং তাকে দুর্বল করার মাধ্যমে তাদের নিজেদের আধিপত্যের পথ উন্মুক্ত করা।

এ ক্ষেত্রে তাদের অন্যতম অপকৌশল হচ্ছে সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সন্দেহ-সংশয়ের বিস্তার ঘটানো। কিন্তু জ্ঞানের কোনো বিষয়ে যদি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গভীর ও নির্ভুল হয় তাহলে তারা কখনোই কারো সৃষ্ট সন্দেহ-সংশয়ের কারণে দোদুল্যমান হয়ে পড়বে না। এ ধরনের সন্দেহ-সংশয় নিরসনের অমোঘ মহৌষধ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লোকদের জ্ঞানের স্তর বিবেচনা করে তদনুযায়ী তাদেরকে ঐ সব প্রশ্নের নির্ভুল ও যুক্তিসঙ্গত জবাব প্রদান।

এ কারণেই,বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকিহর শাসন-কর্তৃত্ব এবং সেই সাথে ফকিহ শাসককে চিহ্নিতকরণ ও জনগণের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ পরিষদ সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নাবলীর জবাব দান ও সৃষ্ট সন্দেহ-সংশয়ের নিরসনের লক্ষ্যে স্বীয় সীমিত জ্ঞানের ভিত্তিতে অত্র পুস্তক রচনা করেছি যাতে সমকালীন জিজ্ঞাসা সমূহের অন্ততঃ অংশবিশেষের হলেও জবাব দিতে পারি।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস,এ সংক্ষিপ্ত পুস্তকে আমরা যে কাজে হাত দিয়েছি সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদের সুদৃষ্টি,প্রস্তাব ও সহযোগিতায় তাকে পূর্ণতা প্রদান করা সম্ভব হবে।

এ পুস্তক রচনার পিছনে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিষয়টির ওপরে জ্ঞানগত দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করা এবং এ ব্যাপারে বুযুর্গানে দ্বীন ও আল্লাহর ওলীগণের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। আমি এখানে এ বিষয়ে প্রধানতঃ ইসলামী বিপ্লবের পথিকৃৎ ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর দৃষ্টিকোণের প্রতি লক্ষ্য রেখেছি। কারণ,তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আল্লাহর ওলীগণ ও অতীত কালের প্রাজ্ঞ ওলামায়ে দ্বীনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। বরং হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সততা ও দৃঢ়তার সাথে এবং ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে উপস্থাপন করেছেন।

এ কারণেই আজকের দুনিয়ায় বেলায়াতে ফকীহ্ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ইসলামের দুশমনরাও বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বের সঠিক তাৎপর্য বুঝতে পেরে এর বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতার মাত্রা তীব্রতর করেছে। তাই তারা এর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বস্তুতঃ বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বের বিরোধিতা করা বর্তমানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্যতম উপসর্গে পরিণত হয়েছে।

এভাবে ইসলামী সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বেলায়াতে ফকীহর বিরুদ্ধে যে পরিকল্পিত সর্বাত্মক হামলা চলছে তার বিরুদ্ধে সর্বশক্তিতে মোকাবিলা করা আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য।

এটা আমাদের সকলেরই দ্বীনী দায়িত্ব। এ কারণে আমরা এ ব্যাপারে সৃষ্ট সমকালীন সন্দেহ-সংশয় নিরসনের লক্ষ্যে কলম হাতে তুলে নিয়েছি। এর লক্ষ্য সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদেরকে এ ব্যাপারে আরো গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং সেই সাথে ইসলামের দুশমনদেরকে জানিয়ে দেয়া যে,আমরা তাদের যে কোনো অপকৌশলের মোকাবিলায় এবং যে কোনো বিভ্রান্তির নিরসনে সক্ষম; আমরা কখনোই বেলায়াতে ফকীহকে তাদের হামলার মুখে একা ফেলে রাখবো না,বরং ইসলামী শাসন ব্যবস্থার হেফাযতের লক্ষ্যে বেলায়াতে ফকীহর পৃষ্ঠপোষকতা করবো।

আলী শীরাযী

ফকিহের নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বঃ জিজ্ঞাসা ও জবাব

ফকিহের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের তাৎপর্য কী?

উত্তরঃ পারিভাষিক অর্থে বেলায়াত্ (ولايت ) মানে হচ্ছে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ওপর কারো অভিভাবকত্ব বা শাসন-কর্তৃত্ব। প্রকৃত পক্ষে বেলায়াত হচ্ছে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কোনো ব্যপারে অন্য কারো হস্তক্ষেপ বা তার মতামত বাস্তবায়ন।

দ্বীনী জ্ঞানের পরিভাষায় ফকীহ্ (فقيه ) হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি দ্বীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন এবং ইসলামী হুকুমাতের দৃষ্টিকোণ সম্পর্কেও পরিপূর্ণরূপে অবহিত। এছাড়া তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হচ্ছে এই যে,তিনি ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এবং আত্মিক,নৈতিক ও মানসিক দিক থেকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য উন্নত অবস্থানের অধিকারী; তার সত্তায় এমন কতক গুণাবলী স্থায়ীভাবে নিহিত  যা তাকে গুনাহ্ ও নাফরমানী থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং এর ফলে তিনি প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বেঁচে থাকেন। এ ধরনের উন্নত ও লক্ষণীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সমূহকে সমন্বিতভাবে ইদালাত্ (عدالت -ভারসাম্যতা,নীতিনিষ্ঠতা,ন্যায়ানুগতা) বলা হয়।

কোনো ব্যক্তির মধ্যে যখন ফিক্বাহাত্ (فقاهت -দ্বীনী জ্ঞানের বিশেষজ্ঞত্ব ও দ্বীনী যুগজিজ্ঞাসার জবাব দানের যোগ্যতা) ও ইদালাত্ থাকে অর্থাৎ একই সাথে দ্বীনী জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের পাণ্ডিত্ব ও তা অনুসরণের ক্ষেত্রে ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় তৈরী হয়ে যায় এবং সেই সাথে তার মধ্যে সমাজ পরিচালনার জন্যেও যথেষ্ট যোগ্যতা তৈরী হয়ে যায়,তখন তিনি বেলায়াতের অধিকারী হন।

বেলায়াত্ পরিভাষাটি যখন ফাক্বীহ্ পরিভাষার সাথে যুক্ত করে ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ পরিভাষা হিসেবে বেলায়াতে ফাক্বীহ্ বলা হয়,তখন তার মানে হয় সমাজ বা রাষ্ট্রের ওপর ফকিহর শাসন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। বস্তুতঃ যে কোনো সমাজের জন্যই বৃহত্তর ও সামষ্টিক বিষয়াদি পরিচালনার জন্য উল্লেখযোগ্য ও বিশিষ্ট গুণাবলীর অধিকারী শাসক ও কর্তৃত্বশালীর প্রয়োজন হয়,ইসলামী সমাজে যে ধরনের গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী শাসক ও পরিচালকের প্রয়োজন পারিভাষিকভাবে তাকে বেলায়াতে ফকীহ্ বলা হয়।

আর এ শাসন-কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ হওয়ার মানে হচ্ছে এই যে,সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সব ক্ষমতা ও এখতিয়ারের প্রয়োজন তিনি পূর্ণ মাত্রায় তার অধিকারী হবেন।

এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে,ফকিহর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব মানে হচ্ছে ফকিহ শাসক এমন এক ব্যক্তি যিনি ইসলামী হুকুমাত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী এবং ইলম,তাক্ওয়া ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় মা ছূমগণের (আ.) অধিকতর নিকটবর্তী ও হুকুমাত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম। এরূপ ব্যক্তি সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে মা ছূমগণের (আ.) সমস্ত এখতিয়ারের অধিকারী হবেন এবং তার অনুমতি ব্যতীত কোনো আইনই কার্যকারিতা ও বৈধতার অধিকারী হবে না। তার অনুমতি ব্যতীত কেউই আইন বাস্তবায়নের অনুমতি পাবে না। বরং রাষ্ট্রের সকল কাজকর্মই তার অনুমতি সাপেক্ষে সম্পাদিত হবে।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) ফকীহ্ শাসকের বিভিন্ন দিক ও এখতিয়ার সমূহ (شؤون و اختيارات ولی فقيه ) গ্রন্থের ৩৩ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ এ দু টি বৈশিষ্ট্যের (আল্লাহর আইনের জ্ঞান ও ইদালাত্) অধিকারী কোনো সুযোগ্য ব্যক্তি যদি উত্থিত হন এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন সে ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কর্তৃত্বের (বেলায়াত্) অধিকারী ছিলেন,তিনি সেই একই কর্তৃত্বের অধিকারী এবং সকল জনগণের জন্য তার আনুগত্য করা অপরিহার্য।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার বেলায়াতে ফকীহ্ গ্রন্থের ৪০ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর হুকুমাতী এখতিয়ার আমীরুল মু মিনীন হযরত আলী (আ.)-এর হুকুমাতী এখতিয়ারের চেয়ে বেশী ছিলো বা হযরত আলী (আ.)-এর হুকুমাতী এখতিয়ার ফকীহর হুকুমাতী এখতিয়ারের চেয়ে বেশী ছিলো -এরূপ ধারণা পুরোপুরি ভ্রান্ত ও পরিত্যাজ্য।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর বাণী ও বক্তব্যের সংকলন ছাহীফায়ে নূর -এর ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৫১৯ নং পৃষ্ঠায় তার যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে এ বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে হযরত ইমাম বলেনঃ যদিও আমার দৃষ্টিতে এটা (ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান) কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ এবং এতে যা বলা হয়েছে ইসলামে ওলামায়ে কেরামের এখতিয়ার তার চেয়েও বেশী; মূলতঃ এই বুদ্ধিজীবীরা যাতে বিরোধিতা না করে সে লক্ষ্যে মহোদয়গণ এ ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দিয়েছেন। এ সংবিধানে যা উল্লিখিত হয়েছে তা বেলায়াতে ফকীহর কতক দিক মাত্র,সকল দিক নয়। এত সব শর্ত সহকারে যে এটি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তার সবই একটি বিষয়ের শর্তাবলী -যা তারা অত্যন্ত ভালোভাবে নির্ধারণ করেছেন; আমরাও এটা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু বিষয় এটা নয়,বরং বিষয়টি এর চেয়েও অনেক বড়।

ফকীহ্ বা মুজতাহিদের নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বের তাৎপর্য এটাই। ফকীহ্ হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সেই হুকুমাতী এখতিয়ারের অধিকারী। আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে বিশেষভাবে মনোনীত নবী ও ইমামগণ (আ.) নবুওয়াত ও ইমামতের আসনে বসে যে সব সুনির্দিষ্ট এখতিয়ারের অধিকারী,ফকীহ্ ইসলামী সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সেই অভিন্ন এখতিয়ারের অধিকারী।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার আল-বাই (البيع - ক্রয়-বিক্রয়/ ব্যবসায়) গ্রন্থে বেলায়াতে ফকীহ্ সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছেনঃ রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারণ সংক্রান্ত যে সব বিষয়ের এখতিয়ার হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও ইমামগণের (আ.) জন্য প্রযোজ্য,তার সবই আদেল (ন্যায়বান ও ভারসাম্যের অধিকারী) ফকীহর জন্য প্রযোজ্য এবং বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এতদুভয়ের এখতিয়ারের মধ্যে কোনোই পার্থক্য করা সম্ভব নয়।

ছাহীফায়ে নূর গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ২৩৭ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমামের যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহ্গণ মা ছূমগণের (আ.) পক্ষ থেকে শরয়ী,রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের সকল বিষয়ে প্রতিনিধিত্বের অধিকারী এবং হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত অবস্থায় থাকার যুগে সকল বিষয়ই তাদের ওপর অর্পিত।

স্বয়ং মা ছূমগণ (আ.) ফকীহদের এই বেলায়াত বা শাসন-কর্তৃত্বের অধিকারকে নিরঙ্কুশ বলেছেন। অতএব,পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহদের নিকট থেকে এ বৈশিষ্ট্যকে,বরং এ এখতিয়ারকে ফিরিয়ে নেয়া তারা (মা ছূমগণ) ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে যে সব ত্রুটি ছিলো ১৩৬৮ ফার্সী সালে (১৯৮৯ খৃস্টাব্দে) হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর নির্দেশে সংবিধান পর্যালোচনা পরিষদ কর্তৃক তা দূরীভূত করা হয় এবং এ সংশোধনীতে সংবিধানের ৫৭ নং ধারার নির্দেশ দানের কর্তৃত্ব (ولايت امر ) সংশোধন করে তদস্থলে নির্দেশ দানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব (ولايت مطلق امر ) লেখা হয়। সংবিধানের সংশোধন,পরিবর্তন ও সম্পূরণ ১৯৮৯ খৃস্টাব্দের ২৮শে জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত গণভোটে ইরানী জনগণ কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং এর ফলে তখন থেকে কার্যতঃ নির্দেশ দানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব (ولايت مطلق امر ) আইনগত রূপ পরিগ্রহণ করে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের এ মূলনীতিটি সংবিধানের ১১০ নং ধারাকে প্রভাবিত করে। সংবিধানের ৫৭ নং ধারা অনুযায়ী ফকীহ শাসকের শাসন-কর্তৃত্ব হচ্ছে নিরঙ্কুশ। অতএব,সংবিধানের ১১০ নং ধারায় যে ফকীহ শাসকের ১১টি এখতিয়ার বর্ণিত হয়েছে সে কারণে তার পুরো শাসন-কর্তৃত্ব এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বুঝায় না। বলা বাহুল্য যে,যে কোনো সীমাবদ্ধতাই তার বিরোধিতার তাৎপর্য বহন করে,কিন্তু সংবিধানের ৫৭ নং ধারা হচ্ছে নিরঙ্কুশ।

অতএব,শরীয়ত,বিচারবুদ্ধি ও সংবিধানের দৃষ্টিতে আমরা ফকীহ্ বা ফকীহ শাসকের নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বে বিশ্বাসী। আমাদের মহান মরহূম ইমামও ফিক্বহী দৃষ্টিকোণ বা বিচারবুদ্ধি ও শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে বলেনঃ নবী ও ইমামগণের (আ.) জন্য যত রকমের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক দায়িত্ব নির্ধারিত আছে তার সবই আদেল ফকীহর জন্য নির্ধারিত।

এর ভিত্তিতেই আমরা মনে করি,ফকীহ শাসকের অনুমোদন ব্যতীত কোনো আইন-কানুনই বৈধতা ও কার্যকরিতার অধিকারী নয় এবং সমগ্র রাষ্ট্রীয় কাজকর্মই তার অনুমতিক্রমে পরিচালিত হয়। এমনকি জনগণের রায়ও কেবল তখনি মূল্যবান হয় যখন তা মুজতাহিদ ফকীহ্ কর্তৃক অনুমোদিত হয় ,তা সে মুজতাহিদ ফকীহ্ হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) হোন,অথবা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ীই হোন - এতে কোনোই পার্থক্য নেই।

ছাহীফায়ে নূর গ্রন্থের নবম খণ্ডের ২৫৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকার যদি ফকীহ শাসকের অনুমতিক্রমে প্রতিষ্ঠিত না হয় বা ফকীহ শাসকের দ্বারা মনোনীত না হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বা ক্ষমতায় আরোহণ করে,তাহলে তা তাগূত।

অতএব ফকীহ শাসক কর্তৃক নিয়োজিত না হয়ে থাকলে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টও একজন তাগূত।

বস্তুতঃ ফকীহ শাসক হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সকল রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারের অধিকারী হবেন। প্রকৃত পক্ষে ফকীহ শাসকের হুকুমাত হচ্ছে স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বেরই একটি শাখা মাত্র,আর তার শাসন-কর্তৃত্ব ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের হুকুম সমূহের অন্যতম হিসেবে পরিগণিত - যা সমস্ত শাখা-প্রশাখাগত আহ্কামের ওপর,এমনকি নামায,রোযা ও হজ্বের ওপর অগ্রাধিকার রাখে। যেখানেই ইসলামী সমাজের কল্যাণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন হবে সেখানেই তিনি শরীয়ত ও ইসলামী মৌল নীতিমালার ভিত্তিতে তার শাসন-কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারবেন। বস্তুতঃ ফকিহ শাসকের অবস্থান সকল রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি ও কাজকর্মের ওপরে এবং সকল কাজই তার অনুমতিক্রমে ও তার অনুমতির ছায়াতলে বৈধতা লাভ করে।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার বেলায়াতে ফকীহ্ গ্রন্থের ৬৫ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ ফকীহ্গণ হচ্ছেন হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর দ্বিতীয় স্তরের অছি এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পক্ষ থেকে ইমামগণের (আ.) ওপর যে সব দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা তাদের জন্যও কার্যকর হবে। অতএব,তাদেরকে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সকল কাজকর্মই সম্পাদন করতে হবে।

আমরা এই প্রকৃত অবস্থাকেই ফকীহর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব হিসেবে গণ্য করি। আমরা মনে করি,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দীর্ঘ কালীন অন্তর্ধানের যুগে ফকীহ শাসক হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা ছূম ইমামগণের (আ.) ন্যায় জনগণের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল কাজকর্মে নিয়ন্ত্রণ,পরিচালনা ও হস্তক্ষেপের অধিকারী।

ফকীহ্ শাসক কি নির্বাচিত নাকি মনোনীত?

জবাবঃ ফকীহ শাসকের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বের মূলনীতিটির শরয়ী ভিত্তি আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত। যেহেতু ফকীহ্ শাসক হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করেন,সেহেতু তার নিয়োগও কোনো না কোনোভাবে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে বা তার অনুমতিক্রমে হওয়া প্রয়োজন। তবে ফকীহর হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্ব বাস্তব রূপ লাভের বিষয়টি জনগণ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার শর্তাধীন।

ইসলামী দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে আমরা বিশ্বাস করি,সমগ্র সৃষ্টিলোক তথা মানুষ সহ এ সমগ্র বিশজগতের অস্তিত্বলাভের পিছনে নিহিত মূল কারণ হচ্ছেন পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা আলা এবং তিনিই এ বিশ্বলোক ও এর অভ্যন্তরে নিহিত সব কিছুর প্রকৃত মালিক। তাই সকল মানুষই আল্লাহ্ তা আলার বান্দাহ্ ও দাস। প্রকৃত সত্য হলো এই যে,আমাদের সত্তার কোনো অংশই আমাদের নিজেদের নয়; আমাদের পুরো অস্তিত্বই তার মালিকানাধীন। এটা অনস্বীকার্য যে,কোনো সম্পদে তার মালিকের অনুমতি ছাড়া হস্তক্ষেপ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং তা যুলুম বৈ নয়। এর ভিত্তিতে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করা উচিৎ যে,কোনো মানুষেরই তার মালিক আল্লাহ্ তা আলার অনুমতি ব্যতিরেকে তার নিজের বা অন্যদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।

বলা বাহুল্য যে,কতগুলো কাজ রাষ্ট্রশক্তির সাথে অনিবার্য ও অপরিহার্যভাবে জড়িত। যেমনঃ বৈধ প্রয়োজনে কাউকে গ্রেফতার করা,কারাগারে নিক্ষেপ করা,জরিমানা করা,কর আদায় করা,হত্যা করা,মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা,বিভিন্ন ধরনের হস্তক্ষেপ করণ এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির আচরণে,কাজকর্মে ও জীবনযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করণ। অতএব,ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনে এভাবে হস্তক্ষেপ করার জন্য শাসককে অবশ্যই মানুষের প্রকৃত মালিক আল্লাহ্ তা আলার কাছ থেকে অনুমতির অধিকারী হতে হবে। অন্যথায় তার সমস্ত হস্তক্ষেপই হবে অবৈধ,জুলুম ও জবরদস্তি মূলক। এটাই বিচারবুদ্ধির রায়। বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্ব মূলনীতি অনুযায়ী আল্লাহ্ তা আলা ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহকে এ অধিকার প্রদান করা হয়েছে। তার আইনানুগ বৈধতার ভিত্তিও হচ্ছে এই মনোনয়ন - যা আল্লাহ্ তা আলা ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে সম্পাদিত হয়েছে।

ওমর বিন হানযালাহ্ বর্ণিত মাক্ববুলাহ হাদিসটি(যে হাদিসের বর্ণনাধারার শেষ বর্ণনাকারী অর্থাৎ যে ব্যক্তি নবী বা ইমাম হতে বর্ণনা করেছেন তার বিশ্বস্ততার স্বীকৃতি স্বরূপ নবী বা ইমাম হতে কিছু বর্ণিত হয়নি অবশ্য তারা তাকে কখনও মিথ্যাবাদীও বলেননি; এ হাদিসের বর্ণনাকারী ওমর বিন হানযালাহর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে অর্থাৎ তার বিশ্বস্ততার বিষয়টি অজ্ঞাত) এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ। ফকীহগণের অনেকেই বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব প্রমাণের জন্য এর সপক্ষে দলীল হিসেবে উক্ত রেওয়ায়েতটির উল্লেখ করেছেন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)ও তার বেলায়াতে ফকীহ্ গ্রন্থে এর উল্লেখ করেছেন। উক্ত রেওয়ায়েত অনুযায়ী,হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেনঃ   তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই আমাদের হাদীছ বর্ণনা করবে (অর্থাৎ হাদীস বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাদীসটি আদৌ নবী বা ইমামদের থেকে বর্ণিত কিনা যাচাই করতে পারবে) ,হালাল ও হারামের প্রতি দৃষ্টি রাখবে (এ ক্ষেত্রে মতামত দেয়ার যোগ্যতার অধিকারী হবে) এবং আমাদের আহ্কামের সাথে পুরোপুরি পরিচিত থাকবে,তোমরা তাকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করো। অবশ্যই জেনো যে,আমি তাকে তোমাদের ওপর শাসক ও বিচারক নিয়োগ করলাম (فانی قد جعلته عليکم حاکماً )। অতএব,সে যখন কোনো আদেশ দেয় তখন যারা তা গ্রহণ না করে তারা আল্লাহর আদেশকে উপেক্ষা করলো এবং আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলো। আর যে ব্যক্তি আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে সে আল্লাহকেই প্রত্যাখ্যান করলো,আর আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করা আল্লাহ্ তা আলার সাথে শিরক করার সমতুল্য।

এখানে হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ফকীহগণ ও ওলামায়ে দ্বীনের কথা বলেছেন যে,তিনি তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে জনগণের ওপর শাসক ও বিচারক নিয়োগ করেছেন এবং তিনি ফকীহগণের রায়কে তার নিজেরই রায় বলে গণ্য করেছেন। আর বলা বাহুল্য যে,মা ছূম ইমাম (আ.)-এর আদেশের আনুগত্য অপরিহার্য কর্তব্য। অতএব,ফকীহর আদেশের আনুগত্য করাও অপরিহার্য কর্তব্য এবং ফকীহর শাসন-কর্তৃত্ব অমান্য করা বড় ধরনের গুনাহ্ ও আল্লাহ্ তা আলার সাথে শিরক করার সম পর্যায়ভুক্ত।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার বেলায়াতে ফকীহ্ গ্রন্থের ১০৪ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ তিনি [ইমাম জাফর সাদিক (আ.)] এরশাদ করেছেনঃفانی قد جعلته عليکم حاکماً -অর্থাৎ এ ধরনের শর্তাবলী বিশিষ্ট কাউকে যখন আমি তোমাদের ওপর শাসক নিয়োগ করবো এবং যে ব্যক্তি এ ধরনের শর্তাবলীর অধিকারী সে আমার পক্ষ থেকে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ও বিচার বিষয়ক কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য আমার পক্ষ থেকে মনোনীত; মুসলমানদের অধিকার নেই তার নিকট ব্যতীত অন্য কারো নিকট (বিচার-ফয়সালার জন্য) গমন করার।

হযরত ইমাম (রহ্ঃ) তার একই গ্রন্থের ১২২ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ ফকীহগণ হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পক্ষ থেকে খেলাফত ও হুকুমাতের জন্য মনোনীত।

এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে,বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসনের বাস্তব রূপায়নের ক্ষেত্রে জনগণের অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর অভিমত ফকীহর পরিপূর্ণ স্বাধীনতার মতের সাথে সামঞ্জস্যশীল। আর তিনি তার বিভিন্ন লেখা ও ভাষণে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কথা পুরোপুরিভাবে উল্লেখ করেছেন। মূলতঃ হযরত ইমাম (রহ্ঃ) যে ফকীহর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন তাতে পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহর হুকুমাতী এখতিয়ার সমূহকে(শাসন ও কর্তৃত্বের পরিধি) হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা ছূম ইমামগণের (আ.) হুকুমাতী এখতিয়ারের সমপর্যায়ভুক্ত গণ্য করা হয়েছে। আর এ এখতিয়ারের উৎস হচ্ছে অভিন্ন খোদায়ী উৎস। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে,শাসনকার্যের দায়িত্ব একটি খোদায়ী দায়িত্ব,এ কারণে,খোদায়ী শাসকের এখতিয়ার সমূহ নির্ধারণ এবং তার নিয়োগ ও বরখাস্তের বিষয়টিও পরম প্রমুক্ত আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেই হয়েছে।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে ফকীহ শাসকের নিয়োগ এবং তার শাসনকার্যের বৈধতাদানের ক্ষেত্রে জনগণের কোনোই ভূমিকা নেই ,বরং এ ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা হচ্ছে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত অবস্থায় ফকীহর হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বের বাস্তব রূপায়ন ও তার প্রতিষ্ঠা। জনগণের তথা মুসলিম জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনের যুগে ফকিহগণের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্ব বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বস্তুতঃ নবী-রাসূলগণ (আ.) ও মা ছূম ইমামগণের (আ.) বেলায় যেমনটি ঘটেছে,ঠিক তদ্রূপই যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণ না চাইবে ততক্ষণ পর্যন্ত ফকীহ স্বীয় হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় গ্রহণ করবেন না (ইমাম খেমেনী(রহঃ) এ বিষয়ে বলেন: স্বীয় জাতির উপর ফকিহদের শাসন চাপিয়ে দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়,ইসলাম আমাদের এ অনুমতি দেয়নি যে,আমরা জনগণের উপর স্বৈরাচারী কায়দায় জেকে বসবো; আল্লাহ ও তার নবী এমন অনুমতি আমাদেরকে দেননি)। জনগণ যদি সমর্থন করে ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে কেবল তখনই দ্বীনের ও ফকীহগণের হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হবে। যদিও জনগণের উচিৎ ফকীহগণের অনুসরণ ও আনুগত্য করা এবং তারা যদি ফকীহগণের হুকুমাতের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে তাহলে তারা গুনাহ্গার হবে ও এ কারণে তাদেরকে আল্লাহ্ তা আলার নিকট জবাবদিহি করতে ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে,তথাপি তারা ফকীহর হুকুমাত প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা দেয়া ও না দেয়ার ব্যাপারে স্বাধীন। তারা যদি সহায়তা প্রদান করে তাহলে আল্লাহ্ তা আলা,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে মনোনীত ফকীহ শাসক হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনগণকে আল্লাহর ইবাদত ও গোলামী,দ্বীনদারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যান।

কতক লোক দু টি দ্বীনী বিষয়কে পরস্পরের সাথে গুলিয়ে ফেলে লোকদের মনে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে থাকে। তারা প্রশ্ন তোলেঃ বেলায়াতে ফকীহ্ কি নির্বাচনের বিষয়,নাকি মনোনয়নের বিষয়? তাহলে এ ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা কী? নির্বাচন অনুষ্ঠান কেন?

ফকীহ শাসক আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত,তবে এ ব্যাপারে জনগণের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ফকীহ শাসককে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জনগণের পক্ষ থেকে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের সহায়তা ও সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত হযরত আলী (আ.) রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকেন এবং তাদের সমর্থনক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেন ও কুফাকে কেন্দ্র করে ন্যায়বিচারের হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করেন ও যুলুম-অত্যাচারের প্রতিরোধ করেন।

জনগণের এ ক্ষমতা আছে যে,তারা তার প্রতি সমর্থন ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনবে এবং এমন এক অবস্থানে অধিষ্ঠিত করবে যেখান থেকে তিনি ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু জনগণ শাসন ক্ষমতার মূল(অধিকারী) হিসেবে তাকে নিয়োগ ও তার উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করার শরীয়তসম্মত কর্তৃপক্ষ নয়,বরং এটা হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার বিশেষ এখতিয়ার। তাই তিনি যাকে এমন এখতিয়ার দিবেন কেবল সেই তার পক্ষ থেকে অন্য কাউকে এমন অধিকার প্রদান করতে পারবেন। হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) যেহেতু আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে জনগণের ইমাম ও শাসক হিসেবে মনোনীত ছিলেন,সেহেতু তিনিও এ বিশেষ এখতিয়ারের অধিকারী ছিলেন। এ কারণেই তিনি ফকীহকে নিজের পক্ষ থেকে শাসক ও বিচারক নিয়োগ কওে বলেছেন যে,যারা তার মনোনীত শাসক ও বিচারককে প্রত্যাখ্যান করলো তারা আল্লাহর হুকুমকেই প্রত্যাখ্যান করলো।

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হবার পর প্রথম দিককার একটি ঘটনা। একজন আরব গোত্রপতি তাকে প্রশ্ন করলেনঃ আপনার নিজের পরে মুসলমানদের নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের বিষয়টি কি আমাদের ওপর ছেড়ে দেবেন? তার প্রশ্নের জবাবে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) বললেনঃ শাসন-কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের বিষয়টি আল্লাহ্ তা আলার এখতিয়ার(ইচ্ছাধীন বিষয়)। তিনি যাকে চাইবেন এ দায়িত্বের জন্য মনোনীত করবেন।

হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে ইসলামী সমাজের সামগ্রিক নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার হচ্ছে ন্যায়নিষ্ঠ ও যুগসচেতন ফকীহ-এর। প্রকৃত পক্ষে তিনি মা ছূমগণ (আ.) ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে মনোনীত এবং সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যে এখতিয়ার হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর,তা তার ওপর অর্পিত। ইমাম (আ.) স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে এ এখতিয়ারের অধিকারী এবং ফকীহকে এ দায়িত্বের জন্যে মনোনীত করার বিষয়টিও আল্লাহ্ তা আলার অনুমতিক্রমেই সম্পাদিত হয়েছে।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13