আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)0%

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 14545
ডাউনলোড: 3733

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 14545 / ডাউনলোড: 3733
সাইজ সাইজ সাইজ
আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

২০তম পাঠ

আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা

ভূমিকা :

পূর্ববর্তী পাঠসমূহে বিভিন্ন বিষয়ে কালামশাস্ত্রবিদগণের দু সম্প্রদায়ের (আশায়েরী ও মো তাজেলী) মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ্য করেছি। এ বিষয়গুলোর মধ্যে কালাম,ইরাদা,গুণগত একত্ববাদ,জাবর ও এখ্তিয়ার এবং ক্বাযা ও ক্বাদারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ দু সম্প্রদায়ের মতামত ছিল চরম প্রান্তিক ও বাড়াবাড়ি ধরনের।

এ দু সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিরোধপূর্ণ অপর একটি বিষয় হল প্রভুর ন্যায় পরায়ণতা (عدل الهی )। উল্লেখ্য এ বিষয়টির ক্ষেত্রে শিয়া মাযহাবের মতামত মো তাজেলীদের অনুরূপ। আশায়রীদের প্রতিকুলে এ দু সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে আদলিয়াহ (عدلیة ) নামকরণ করা হয়ে থাকে। কালামশাস্ত্রে এ বিষয়টির উপর এতই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে,মুখ্য বিষয়সমূহের মধ্যে পরিগণিত হয়েছে। এমনকি একে আক্বায়েদের মূলনীতি এবং শিয়া ও মো তাজেলী মাযহাবের কালামশাস্ত্রের বিশেষত্ব বলেও মনে করা হয়েছে।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে,আশায়েরীগণও আল্লাহর আদল বা ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করেন না অর্থাৎ এমন নয় যে,আল্লাহকে অত্যাচারী (আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন) মনে করেন যেখানে কোরানের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রমাণ বহন করে এবং যে কোন প্রকারের জুলুমও অত্যাচারের অপবাদ থেকে প্রভু সত্তাকে পবিত্ররূপে প্রকাশ করে। বরং বিতর্কের বিষয় হল এটা যে,মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি কি শরীয়ত,কিতাব ও সুন্নতের সাহায্য ব্যতীত কোন কর্ম,বিশেষ করে ঐশী কর্মকাণ্ডের মানদণ্ড নিরূপণে সক্ষম যার উপর ভিত্তি করে কোন কর্মের গ্রহণ বা বর্জনের অপরিহার্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে? যেমন : বলবে যে,মু’মেনগণকে বেহেস্তে,আর কাফেরদেরকে দোযখে প্রেরণ করা মহান আল্লাহর জন্যে অপরিহার্য। না কি,এ ধরণের সিদ্ধান্ত দান কেবলমাত্র ওহীর ভিত্তিতে রূপ পরিগ্রহ করে,যা ব্যতীত বুদ্ধিবৃত্তি কোন প্রকার সিদ্ধান্ত দিতে অপারগ?

অতএব বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হল তাতেই,যাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাল-মন্দ’الحسن و القبح العقلی বলা হয়ে থাকে। আশায়েরীরা একে অস্বীকার করে এবং সুনির্ধারিত বিষয়ে (امور تکوینی ) বিশ্বাস স্থাপন করে,অর্থাৎ যা মহান আল্লাহ সম্পাদন করেন তা-ই সুকর্ম,আর (বিধিগত বিষয়ে) তিনি যা আদেশ করেন তা-ই ভাল এমন নয় যে,যেহেতু কর্মটি ভাল,তাই তিনি এটা সম্পাদন করেন বা সম্পাদন করার আদেশ প্রদান করেন।

কিন্তু,আদলিয়াহগণ বিশ্বাস করেন যে,কর্মকাণ্ডসমূহ সুনির্ধারিত ও বিধিগত হিসেবে মহান আল্লাহর সাথে সস্পর্কিতকরণ ব্যতীতই,ভাল অথবা মন্দ নামে অভিষিক্ত হয়ে থাকে এবং মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিও একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ভাল-মন্দকে অনুধাবন করতে ও প্রভু সত্তাকে সকল প্রকার মন্দকর্ম সম্পাদন করা থেকে পবিত্র ভাবতে সক্ষম। তবে তা মহান আল্লাহর প্রতি আদেশ-নিষেধ করা (মহান আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন) অর্থে নয়। বরং এ অর্থে যে,কোন কর্ম মহান আল্লাহর কামালিয়াতের সাথে সস্পর্কিত কি-না। আর এর উপর ভিত্তি করেই মহান আল্লাহ কর্তৃক মন্দকর্ম সম্পাদনকে অসম্ভব বলে মনে করা হয়।

এটা অনস্বীকার্য যে,এ বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা এবং আশায়েরীদের পক্ষ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাল-মন্দের ধারণার অস্বীকৃতি ও অবশেষে যা তাদেরকে আদলিয়াহদের বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে,তার জবাব প্রদান,এ প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে অসম্ভব। অনুরূপ এ ব্যাপারে মো তাযেলীদের বক্তব্যেরও অনেক দুর্বলতা থাকতে পারে,যে সম্পর্কে যথাস্থানে আলোচনা করা উচিৎ। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ভাল-মন্দের মূলভাষ্য শিয়া সম্প্রদায় কর্তৃক গৃহীত,কিতাব ও সুন্নতের উৎস থেকে অনুমোদিত ও মাসুমগণ (আঃ) কর্তৃক গুরুত্বারোপকৃত হয়েছে ।

ফলে আমরা এখানে সর্বপথমে আদলের ধারণা সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করব। অতঃপর মহান আল্লাহর এ ক্রিয়াগত গুণের স্বপক্ষে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের উল্লেখ করব। সর্বশেষে এ বিষয়টি সম্পর্কে বিদ্যমান ভ্রান্ত ধারণাসমূহের জবাব প্রদানে সচেষ্ট হব।

আদলের ( ন্যায়পরায়ণতার) তাৎপর্য :

আদলের (عدل ) আভিধানিক অর্থ হল বরাবর বা সমমান সস্পন্ন করা এবং সাধারণের ভাষায় অত্যাচারের (অপরের অধিকার হরণ) বিরুদ্ধে অপরের অধিকার সংরক্ষণার্থে ব্যবহৃত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আদলকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করা যায়।

اعطاء کل ذی حق حقه

যার যার অধিকার তাকে প্রদান করা।

অতএব সর্বাগ্রে এমন এক অস্তিত্বকে বিবেচনা করতে হবে যার অধিকার আছে;অতঃপর তার সংরক্ষণকে ন্যায়বিচার বা আদল (عدل ),আর তার লংঘনকে অত্যাচার বা জুলুম (ظلم ) নামকরণ করা যায়। কিন্তু কখনো কখনো আদলের ধারণার সম্প্রসারণে বলা হয়ে থাকে :

وضع کل شئ فی موضعه

প্রত্যেক বস্তুকেই তাদের নিজ নিজ স্থানে স্থাপন করা।

অর্থাৎ সকল কিছুকে যথাস্থানে সংস্থাপন অথবা সকল কর্মকে উপযুক্তরূপে সস্পন্ন করণই হল‘আদল’। আর এ সংজ্ঞানুসারে আদল,প্রজ্ঞা (حکمت ) ও ন্যায়ভিত্তিক কর্মের সমার্থবোধক অর্থ বা প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্ম অর্থে রূপ পরিগ্রহ করে। তবে কিরূপে অধিকারীর অধিকার’এবং সকল কিছুর যথোপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করা হয় -এ সম্পর্কে বক্তব্য অনেক -যা আখলাক্বের দর্শন’ও অধিকারের দর্শন’রূপে গুরুত্বপূর্ণ শাখা সৃষ্টি করেছে। স্বভাবতঃই এখানে আমরা এ বিষয়ের উপর আলোচনা করতে পারব না।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল : সকল বুদ্ধিসস্পন্ন মানুষই অনুধাবন করতে পারে যে,যদি কেউ কোন কারণ ছাড়াই কোন অনাথ শিশুর হাত থেকে এক টুকরা রুটিও ছিনিয়ে নেয় অথবা নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরায়,তবে সে জুলম করেছে এবং অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। আবার বিপরীতক্রমে,যদি কেউ ছিনতাইকারীর নিকট থেকে ছিনতাইকৃত রুটির লোকমা উদ্ধার করে,ঐ অনাথ শিশুকে ফিরিয়ে দেয় অথবা অপরাধী ঘাতককে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে,তবে সে ন্যায়বিচার করেছে বা সঠিক কর্মসম্পাদন করেছে। এ সিদ্ধান্তগুলো প্রভু কর্তৃক নির্ধারিত বিধি-নিষেধের উপর নির্ভরশীল নয়। এমনকি যদি কেউ খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নাও হয়ে থাকে,তবে সেও এ ধরনের সিদ্ধান্তই নিবে।

কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্তের গুঢ় রহস্য কী বা কোন সে শক্তির মাধ্যমে মানুষ ভাল-মন্দকে অনুধাবন করে ইত্যাদি বিষয়গুলোকে দর্শনের একাধিক শাখায় আলোচনা করতে হবে ।

সিদ্ধান্ত : আদলের জন্যে বিশেষ ও সাধারণ এ দু ধরনের ভাবার্থকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এদের একটি হল অন্যের অধিকার সংরক্ষণ’এবং অপরটি হল প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্ম সম্পাদন’যেখানে‘অন্যের অধিকার সংরক্ষণ’এর একটি দৃষ্টান্তরূপে পরিগণিত হবে ।

অতএব আদলের অবিচ্ছেদ্য অর্থ,সকল মানুষকে বা সকল কিছুকে এক বরাবর বা এক রেখায় স্থাপন নয়। যেমন : ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক তিনিই নন যিনি পরিশ্রমী বা অলস নির্বিশেষে সকল ছাত্রকেই একরূপ প্রশংসা বা ভর্ৎসনা করবেন। অনুরূপ ন্যায়বিচারক তিনিই নন যিনি বিবাদপূর্ণ কোন সস্পদকে,কলহে লিপ্ত দু পক্ষের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করবেন। বরং ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক তিনিই যিনি সকল ছাত্রকে তাদের যোগ্যতানুসারে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করবেন। তদনুরূপ ন্যায়বিচারক তিনিই যিনি বিবাদপূর্ণ সস্পদকে এর প্রকৃত মালিকের নিকট অর্পণ করবেন।

একইভাবে প্রভুর প্রজ্ঞা ও আদলের দাবী এটা নয় যে,সৃষ্টির সবকিছুকেই সমানভাবে সৃষ্টি করবেন। যেমন : মানুষকেও শিং,কেশর বা পাখা ইত্যাদি দিবেন। বরং সৃষ্টিকর্তার প্রজ্ঞার দাবী হল এই যে,বিশ্বকে তিনি এরূপে সৃষ্টি করবেন যাতে সর্বাধিক কল্যাণ ও উৎকর্ষ অর্পিত হয় এবং বিভিন্ন সৃষ্ট বিষয় যেগুলো এ জগতের সুসংহত অংশসমূহ রূপে পরিগণিত,সে গুলোকে এমনভাবে সৃষ্টি করবেন,যেন ঐ চূড়ান্ত উদ্দেশ্যের (উৎকর্ষ ও কল্যাণ) সাথে সস্পর্কযুক্ত হয়। অনুরূপ প্রভুর আদল ও প্রজ্ঞার দাবী হল এই যে,সকল মানুষকেই তার যোগ্যতানুসারে দায়িত্ব প্রদান। অতঃপর তার স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ও প্রচেষ্টার আলোকে তার বিচার করণ এবং পরিশেষে তার কর্মফলস্বরূপ তাকে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করা।

) لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا(

আল্লাহ কারও উপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না,যা তার সাধ্যাতীত। (সূরা বাকারা - ২৮৬)

) وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ(

তাদের মীমাংসা ন্যায়বিচারের সাথে করা হবে এবং তাদের প্রতি জুলম করা হবে না। (সূরা ইউনুস - ৫৪)

) فَالْيَوْمَ لَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَلَا تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ(

আজ কারও প্রতি জুলম করা হবে না এবং তোমরা যা করেছ কেবল তারই প্রতিফল দেয়া হবে। (সুরা ইয়সীন - ৫৪)

প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ :

ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে,প্রভুর ন্যায়পরায়ণতা এক দৃষ্টিকোণ থেকে মহান আল্লাহর হিকমাত বা প্রজ্ঞাধীন এবং অপর দৃষ্টিকোণ থেকে প্রজ্ঞারই অভিন্ন রূপ। স্বভাবতঃই এর প্রমাণও সে যুক্তির মাধ্যমেই করা হবে যা প্রভুর প্রজ্ঞাকে প্রতিপাদন করার ক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয়েছিল। একাদশ পাঠে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ফলে এখানে আমরা এ সম্পর্কে আর ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করব।

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে,মহান আল্লাহ চূড়ান্ত স্বাধীনতা ও ক্ষমতার অধিকারী। সম্ভাব্য অস্তিত্বের জন্যে কোন কর্ম সম্পাদন করার বা না করার ক্ষেত্রে তিনি কোন শক্তি কর্তৃক প্রভাবিত বা কোন শক্তির নিকটই পরাভূত নন। বরং তিনি ইচ্ছে করলে কোন কিছু নাও করতে পারেন এবং যা তিনি সম্পাদনের ইচ্ছে করবেন তাই করবেন।

অনুরূপ তিনি কোন অর্থহীন ও অহেতুক ইচ্ছা পোষণ করেন না। বরং যা কিছু তাঁর পূর্ণতমগুণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই তিনি ইচ্ছা করেন। যদি তাঁর পূর্ণতম গুণ কোন কর্মকে দাবি না করে,তবে তিনি কখনোই তা সম্পাদন করেন না। যেহেতু মহান আল্লাহ চূড়ান্ত পূর্ণতার অধিকারী,সেহেরতু তাঁর ইরাদাও মূলতঃ সৃষ্টির কল্যাণ ও পূর্ণতার দিকেই হয়ে থাকে এবং যদি কোন অস্তিত্বশীলের আস্তিত্ব বিশ্বে অনিবার্য অকল্যাণ ও অভিসম্পাতের কারণ হয়,তবে তা হয়ে থাকে প্রসঙ্গক্রমে। অর্থাৎ যেহেতু ঐ অকল্যাণ সর্বাধিক কল্যাণের অবিচ্ছেদ্য বিষয়,সেহেতু প্রভুর ইরাদা বা ইচ্ছা উক্ত সর্বাধিক কল্যাণের অনুগামী হয়ে থাকে।

অতএব প্রভুর পূর্ণতম গুণের দাবি এই যে,বিশ্ব এমনভাবে সৃষ্টি হবে যাতে সম্মিলিতভাবে সম্ভাব্য সর্বাধিক পূর্ণতা ও কল্যাণ অর্জিত হয়। আর এখানেই মহান আল্লাহর জন্যে প্রজ্ঞা (حکمت ) নামক গুণটি প্রতিপন্ন হয়।

এর ভিত্তিতে যেখানেই মানুষের অস্তিত্বলাভের সম্ভাবনা বিদ্যমান ও তার অস্তিত্ব সর্বাধিক কল্যাণের উৎস,সেখানেই মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রভুর ইচ্ছার সমাপতন ঘটেছে। মানুষের একটি মৌলিক বিশেষত্ব হল এখ্তিয়ার ও স্বাধীন ইচ্ছা এবং নিঃসন্দেহে স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতার অধিকার মানুষের একটি অস্তিত্বগত পূর্ণতা বলে পরিগণিত। আর যে অস্তিত্বশীল এ পূর্ণতার অধিকারী,সে অস্তিত্বশীল অপর কোন অস্তিত্বশীল,যা এর অধিকারী নয়,তা অপেক্ষা পূর্ণতর বলে পরিগণিত হবে। কিন্তু স্বাধীনতার অধিকারী হওয়ার জন্যে অপরিহার্য হল : মানুষ যেমনি সুকর্ম ও যথোপযুক্ত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে অনন্ত ও চূড়ান্ত পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হতে পারবে তেমনি কুকর্ম ও অপছন্দনীয় কর্মে লিপ্ত হয়ে অনন্ত দুর্দশা ও ক্ষতির পথে পতিত হতে পারবে। তবে প্রভুর ইরাদার বিষয় হল মূলতঃ মানুষের পূর্ণতা প্রাপ্তি। কিন্তু মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন পূর্ণতার অবিয়োজন (لازمه ) যেহেতু অধঃপতনের সম্ভাবনাযুক্ত,যা পাশবিক কামনা ও শয়তানী প্রবণতার অনুসরণে অর্জিত হয়,সেহেতু এ ধরনের স্বাধীন নির্বাচনাধীন অধঃপতনও সঙ্গত কারণেই প্রভুর ইরাদার বিষয়ে পরিণত হয়।

আবার যেহেতু সচেতনভাবে নির্বাচন করার জন্যে ভাল ও মন্দ পথগুলোর সঠিক পরিচিত প্রয়োজন সেহেতু মহান আল্লাহ মানুষকে যা কিছু তার কল্যাণ ও সৌভাগ্যের কারণ,তার প্রতি আহ্বান করেছেন এবং যা কিছু অধঃপতন ও অকল্যাণের কারণ,তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে পূর্ণতার পথ সুগম হয়। অনুরূপ যেহেতু আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব মানুষকে তার কর্মফলে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছে এবং তা মহান আল্লাহর জন্যে কোন কল্যাণ (বা অকল্যাণ) বয়ে আনে না,সেহেতু প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল বান্দার ক্ষমতানুযায়ী দায়িত্ব প্রদান করা। কারণ যে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব,সে দায়িত্ব অর্পণ করাটা হবে অনর্থক ও অহেতুক কর্ম।

অতএব আদলের প্রথম পর্যায় (বিশেষ অর্থে) অর্থাৎ দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা,এ যুক্তিতে প্রতিপাদিত হয় যে,যদি মহান আল্লাহ বান্দাগণের ক্ষমতাতিরিক্ত দায়িত্ব তাদেরকে প্রদান করেন,তবে ঐ দায়িত্ব সম্পাদন অসম্ভব হবে এবং এটি একটি অনর্থক কর্ম বলে পরিগণিত হবে।(অথচ মহান আল্লাহর প্রজ্ঞার দাবি হল তিনি অনর্থক কোন কর্ম সম্পাদন করেন না)।

আবার বান্দাগণের মধ্যে বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা,এর উপর ভিত্তি করে প্রমাণিত হয় যে,এ বিচারকর্ম বিভিন্ন প্রকার পুরস্কার ও শাস্তির ক্ষেত্রে বান্দাগণের অধিকার নির্ধারণের জন্যে সম্পাদিত হয়। যদি এ কর্ম ন্যায়নীতির পরিপন্থি হয় তবে উদ্দেশ্যহীন কর্ম বলে পরিগণিত হবে। (অথচ প্রজ্ঞাবান আল্লাহর পক্ষে উদ্দেশ্যহীন কর্ম সম্পাদন অসম্ভব,কারণ সেটা তাঁর প্রজ্ঞার ব্যতিক্রম)।

অবশেষে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা,সৃষ্টির চূড়ান্ত উদ্দেশ্যের আলোকে প্রমাণিত হয়। কারণ যিনি মানুষকে তার সুকর্ম ও কুকর্মের প্রতিফল প্রদানের জন্যে সৃষ্টি করেছেন,যদি তিনি তাদেরকে তাদের লভ্য ও প্রাপ্তির ব্যতিক্রম কোন পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করেন তবে তা তাঁরই উদ্দেশ্যকে ব্যহত করবে।

অতএব প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার সর্বজনস্বীকৃত ও সঠিক দলিল হল এই যে,তাঁর সত্তাগত গুণই প্রজ্ঞাপূর্ণ ও ন্যায়পরায়ণ কর্মের কারণ এবং অত্যাচার,অবিচার অথবা অনর্থক ও অহেতুক কর্মের দাবিদার কোন গুণই তাঁর অস্তিত্বে বিরাজ করে না।

কয়েকটি ভ্রান্ত ধারণার জবাব :

১। সৃষ্টির মধ্যে বিশেষ করে মানুষের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান,কিরূপে তা আল্লাহর প্রজ্ঞাও ন্যায়পরায়ণতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে? কেন প্রজ্ঞাবান ও ন্যায়পরায়ণ প্রভু সকল সৃষ্টিকেই এক রকম করে সৃষ্টি করেন নি?

জবাব : অস্তিত্বলাভের ক্ষেত্রে সৃষ্টির বৈসাদৃশ্য,সৃষ্টি ব্যবস্থার অপরিহার্যতা ও কার্যকারণত্বের অধীন হয়ে থাকে। সৃষ্টিকুলের সকলেই এক রকম হওয়ার ধারণা হল একটি স্থুল চিন্তুা এবং যদি কিঞ্চিত পর্যবেক্ষণ করি দেখতে পাব যে,এ ধরনের ধারণা সৃষ্টি ধারার বিরধী বৈ কিছু নয়। কারণ উদাহরণত : যদি সকল মানুষই হয় পুরুষ অথবা স্ত্রী হত,তবে সৃষ্টির ধারা ব্যহত হত এবং মানব সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে যেত। আবার যদি সৃষ্টির সকলেই মানুষ হত তবে খাদ্যাহরণ ও অন্যান্য চাহিদা পূরণ সম্ভব হত না। অনুরূপ যদি সকল পশু-পাখী ও বৃক্ষরাজি একই ধরণের এবং একই রং ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হত,তবে এ অসণিত কল্যাণ,মনোমুগ্ধকর ও মনোহর দৃশ্যের সৃষ্টি হত না। সৃষ্টির এ বৈচিত্র ও বৈসাদৃশ্য,বস্তর পরিবর্তন ও বিবর্তন ধারায় একাধিক শর্ত ও কারণের অধীনে রূপপরিগ্রহ করে। সুতরাং মহান আল্লাহ কোন কিছুকেই সৃষ্টির পূর্বে তার নির্দিষ্ট স্থান,কাল ও পাত্রে স্থান দেন না,যাতে ন্যায়-অন্যায়ের কোন স্থান থাকবে।

২) এ মহাবিশ্বে মানবজীবনের অস্তিত্ব,যদি প্রভুর প্রজ্ঞার দাবী হয়ে থাকে তবে কেন মানুষকে মৃত্যদান করা হয় এবং তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো হয় ?

উত্তর :

প্রথমতঃ জীবন ও মৃত্য,এ বিশ্বে সুনির্ধারিত নিয়ম-নীতির অধীন ও কার্যকারণত্বের সাথে সস্পর্কিত এবং সৃষ্টি ব্যবস্থার জন্যে অপরিহার্য। দ্বিতীয়তঃ যদি কোন জীবন্ত অস্তিত্বশীল মৃত্যুবরণ না করত,তবে পরবর্তী অস্তিত্বশীলের জন্যে কোন ক্ষেত্র প্রস্তুত হত না। ফলে পরবর্তীরা এ জীবন‘ও অস্তিত্বের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হত। তৃতীয়তঃ শুধুমাত্র মানুষের কথাই যদি ধরা হয় যে,সকল মানুষ অমর থাকুক,তবে অচিরেই তাদের জন্যে এ বিশ্বের আবাসস্থল সংকীর্ণ হয়ে পড়ত আর ব্যথা-বেদনা ও ক্ষুধার তীব্রতায় তখন সকলেই মৃত্যূ কামনা করত। চতুর্থতঃ মানব সৃষ্টির পশ্চাতে প্রকৃত উদ্দেশ্য হল,তাকে অনন্ত সুখ ও বৈভবে পৌঁছানো এবং যতক্ষণ পর্যন্ত মানব সম্প্রদায় মৃত্যর মাধ্যমে এ বিশ্ব থেকে স্থানান্তরিত না হবে,ততক্ষণ পর্যন্ত এ চূড়ান্ত উদ্দেশ্যে পৌঁছতে পারবে না।

৩) এ সকল দুঃখ-কষ্ট,রোগ-ব্যাধি,প্রকৃতিক দুর্যোগসমূহ (যেমন : বন্যা ও ভূমিকস্প) ও সামাজিক সংকট (যেমন : যুদ্ধ ও অত্যাচার) ইত্যাদির অস্তিত্ব কিরূপে মহান আল্লাহর ন্যায়পরয়ণতার সাথে সাযুজ্য রক্ষা করে ?

জবাব : প্রথমতঃ অনাকাংখিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল বস্তুগত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ও সংঘর্ষের অবিযোজ্য ফল। যেহেতু এগুলোর কল্যাণ,অকল্যাণের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে,সেহেতু প্রজ্ঞা-বিরোধী নয়। অনুরূপ সামাজিক অনাচারের উদ্ভব হল মানুষের স্বাধীনতারই অবিযোজ্য ঘটনা যা,প্রভুর প্রজ্ঞারই দাবি। তদুপরি,সামাজিক জীবনের কল্যাণ,অকল্যাণের চেয়ে অধিক। আর যদি অকল্যাণ,কল্যাণের উপর আধিপত্য বিস্তার করত,তবে পৃথিবীতে কোন মানুষ অবশিষ্ট থাকত না। দ্বিতীয়তঃ এ দুঃখ-দুর্দশা ও সংকটের অস্তিত্ব,একদিকে যেমন প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে মানুষের প্রচেষ্টা এবং জ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশের কারণ;অপরদিকে তেমনি,সংকটময় পরিস্থিতির সাথে সংগ্রাম করণের মাধ্যমে মানুষের বিকাশ,যোগ্যতার প্রস্ফুটন,অগ্রগতি ও পূর্ণতার জন্য এক বৃহত্তম নির্বাহক।

সর্বোপরি এ বিশ্বে দুঃখ-কষ্ট এবং যে কোন সংকটময় পরিস্থিতিতে যদি কেউ সত্যিকার অর্থেই ধৈর্য ধারণ করেন,তবে পরকালীন অনন্ত জীবনে মহামূল্যবান পুরস্কার লাভ করবেন এবং সর্বোত্তম পন্থায় এর বিনিময় পাবেন।

৪) এ জগতে সীমাবদ্ধ পাপাচারের জন্যে অনন্ত শাস্তি প্রদান,কি করে প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়?

জবাব : সুকর্ম ও কুকর্ম এবং পরকালীন পুরস্কার ও শাস্তির মধ্যে এক প্রকার কারণগত সস্পর্ক বিদ্যমান,যা আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ওহীর মাধ্যমে আবিস্কৃত ও মানুষের কর্ণগোচর করা হয়েছে। যেমন করে এ বিশ্বে কোন কোন ঘটনার সংঘটনে দীর্ঘকাল ধরে এর কুপ্রভাব বজায় থাকে। যেমন : নিজের চোখ বা অন্যের চোখ বিনষ্ট করতে এক মুহর্তের প্রয়োজন,কিন্তু আমৃত্য এর প্রতিফল বহন করে যেতে হয়। তেমনি ভয়ংকর পাপকর্মসমূহেরও পরকালীন চিরস্থায়ী কুফল বজায় থাকে এবং যদি কেউ এ বিশ্বে এর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা (যেমন : তওবাহ) না করে তবে এর কুফল তাকে অনন্তকাল পর্যন্ত বহন করতে হবে। যেমন করে এক মুহর্তের অপরাধের ফলে কোন মানুষের আমৃত্য অন্ধত্ব প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না,তেমনি ভয়ংকর পাপাচারের ফলে অনন্ত শাস্তিুতে পতিত হওয়াও প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার ব্যতিক্রম নয়। কারণ এটি হল পাপীর সেই কর্মের ফল যাতে সে সচেতনভাবে লিপ্ত হয়েছে।